ওর চোখ প্রতিদিন আমি মুখস্থ করি। মনে হয় চোখ দুটি কত চেনা! ওকে দেখলে আমার মনটা কেমন এক বিষাদে ভরে যায়। বিষাদ বড়ো বেদনার। হাহাকার এসে দমকা বাতাসের মতো উড়িয়ে নেয় অজানা কোথাও। মনে হয় কত চেনা চোখ; আগে যেন কোথাও দেখেছি। মুগ্ধ পাঠকের মতো পাঠ করি বারবার। আমরা দুজনই কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোয় পড়াশুনা করি। আমি নিশ্চিত ও আমার ডিপার্টমেন্ট ডায়াসপোরা এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল স্টাডিজের ছাত্রী নয়, তবে মনে হচ্ছে আমরা একই সেশনে। ক্যাম্পাসের পুরনো পুরনো বিল্ডিংয়ের সামনে ও যখন চলাফেরা করে তখন ওকে দারুণ মানায়। মনে হয় রূপকথার রাজবাড়ির সেই রাজকণ্যা। আমি এই রাজকণ্যার সাথে পরিচিত হতে বেশ কয়েকবার ডালিমকুমারের মতো সাহসের ঘোড়ায় চড়ে গিয়েছি; শেষমেষ টরন্টো লেকের ঢেউয়ের মতো তীরে এসে মিইয়ে গেছি। চারপাশ ঘুরঘুর করে ফিরে এসেছি। আমার ভয় করে, সাহসে ধরেনি। অবশ্য বন্ধুদের ডাকাডাকিতে সেই থেকে জেনেছি ওর নাম ইয়েলিনা।
আমাদের ভার্সিটিতে অনেক ক্লাব আছে। এই যেমন, ফটোগ্রাফি ক্লাব, ড্রামা ক্লাব, সিনে ক্লাব। হঠাৎ একদিন ক্যাম্পাসের পাবলিক ম্যাসেজ বোর্ডে একটা নোটিশ দেখে আমার চোখ আটকে গেল। এটাকে নোটিশ না বলে পোস্টার বলা উচিত। পোস্টারে অনেকের সাথে ইয়েলিনার ছবি। পোস্টারটি ক্যাম্পাসের স্টোরি-টেলিং ক্লাব আয়োজিত রূপকথার গল্প বলার সান্ধ্য আয়োজন নিয়ে। আইডিয়াটা আমার কাছে দারুণ লেগেছে, একেবারেই নতুন। রূপকথার এই আসরে গল্প বলবে ইয়েলিনা। পোস্টার থেকে জেনেছি ওর পুরা নাম ইয়েলিনা স্তেপানোভা।
কানাডায় সবকিছুকেই সংক্ষেপ করে বলে এই যেমন, ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোকে ডাকে ইউ অফ টি। ইউ অফ টি তে তিন ধরণের ছাত্রছাত্রী রয়েছে। প্রথমত, আমার মতো; মানে যারা স্কলারশিপ নিয়ে এসেছে। দ্বিতীয়ত, ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট; এরা নিজস্ব অর্থায়নে আসে। মূলত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের টাকা পয়সাওয়ালার ছেলেমেয়ে আর তৃতীয় হচ্ছে কানাডিয়ান; যারা স্থায়ীভাবে বসবাস করে।
কানাডায় সবকিছুকেই সংক্ষেপ করে বলে এই যেমন, ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোকে ডাকে ইউ অফ টি। ইউ অফ টি তে তিন ধরণের ছাত্রছাত্রী রয়েছে। প্রথমত, আমার মতো; মানে যারা স্কলারশিপ নিয়ে এসেছে। দ্বিতীয়ত, ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট; এরা নিজস্ব অর্থায়নে আসে। মূলত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের টাকা পয়সাওয়ালার ছেলেমেয়ে আর তৃতীয় হচ্ছে কানাডিয়ান; যারা স্থায়ীভাবে বসবাস করে। এর মধ্যে কানাডিয়ান বাংলাদেশি ছেলে-মেয়েরা বাংলাদেশ থেকে আসা ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের সাথে মেলামেশা করতে পারে না। কারণ ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের মধ্যে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী এবং সরকারি আমলাদের ছেলে মেয়েরাই বেশি। ওদের হাত-খরচ অনেক বেশি। ওদের সাথে কানাডিয়ান বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা কুলিয়ে উঠতে পারে না। ফলে ওরা ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের এড়িয়ে চলে। এরা বুঝে উঠতে পারে না ওরা এত টাকা কোথায় পায়? আমি এতদিনে বুঝতে পেরেছি ইয়েলিনা কানাডিয়ান।
কানাডায় চারটি ঋতু। হেমন্ত, শীত, বসন্ত আর গ্রীষ্ম। এই চারটি ঋতুই এখানকার জীবন-যাপনে ভীষণ প্রভাব ফেলে। যাবতীয় উৎসব-অনুষ্ঠান হেমন্ত, গ্রীষ্ম আর বসন্তেই হয়। গ্রীষ্মের ফুরফুরে বাতাসের এই পড়ন্ত বিকালে আমি যখন হলঘরের সামনে পৌঁছলুম তখন আরও পঁচিশ মিনিট বাকি রূপকথার আসর শুরু হতে। থেকে থেকে তিরিতিরি বাতাস এসে মনকে বেশ প্রফুল্ল করে তুলছে। বাতাসের সাথে নাম না জানা ফুলের গন্ধে বুকটা ভরে যায়। ইচ্ছে করে নিঃশ্বাস টেনে বুকের ভেতর গন্ধটা জমিয়ে রাখি। দেখতে দেখতে হলঘর কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে। অনুষ্ঠান শুরুর সময় ঘনিয়ে আসে। দশর্ক সবাই ইউ অফ টি র ছাত্র-ছাত্রী; এর মধ্যে বেশ কিছু টিচার বা অন্যান্যরাও থাকতে পারে তবে আমার জানা নেই। রূপকথার গল্প বলা এটা একটা মজার কনসেপ্ট। এই যান্ত্রিক সমাজের মানুষেরা কোথাও হারিয়ে যেতে একটা জানালা খুঁজে পেতে চায়, এই জন্যে এত ভির। টিকেট সব শেষ, হাউজফুল। বেশ কয়েকটা দেশের গল্প শুনতে শুনতে ফ্যান্টাসির জগতে চলে যাওয়া আবার গল্প শেষে সবার হাততালিতে বাস্তবতার হলঘরে ফেরা। আফ্রিকার গল্পটি একটি সিংহ এবং একটি হরিণ নিয়ে। একই জঙ্গলে এক সিংহ আর এক হরিণের বসবাস। প্রতিদিন রাতে সিংহের টেনশন আগামীকাল ভোরে এই জঙ্গলের সবচেয়ে দ্রুতগামী হরিণের চেয়ে তাকে দ্রুত দৌড়াতে হবে নয়তো শিকার ধরতে পারবে না। শিকার ধরতে না পারলে তাকে না খেয়ে থাকতে হবে। একই ধরণের টেনশন হরিণের। আগামীকাল ভোরে এই জঙ্গলের সবচেয়ে দ্রুতগামী সিংহের চেয়ে তাকে দৌড়াতে হবে নয়তো সিংহের শিকার হয়ে তাকে মরতে হবে। সিংহের চেয়ে দ্রুত দৌড়াতে না পারলে বেঁচে থাকতে পারবে না। আহারে জীবন! এটি যেন আফ্রিকার কোনো রূপকথা নয়, এই বৈশ্বিক গ্রামের প্রতিটি মানুষেরই বেঁচে থাকার সংগ্রাম। এই গ্লোবাল ভিলেজে তুমি সিংহ হও কিংবা হরিণ হও; তোমাকে বেঁচে থাকতে হলে কেবল দৌড়াতে হবে। গল্পটি বলেছে আফ্রিকার একটি ছেলে। তার বলায় টানটান উত্তেজনা ছিল ভীষণ। এবার শেষ গল্পের পালা। গল্প শোনাবে ইয়েলিনা স্তেপানোভা…
ইয়েলিনা সাদা রংয়ের গাউন পড়ে খুব সুন্দর করে সাঁজগোজ করেছে, আকাশ থেকে নেমে আসা পরীদের মতো। আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে। টেনশনে এখনই মনে হয় ঘাম ঝরা শুরু হবে। মঞ্চে বসা অচেনা ইয়েলিনার সাথে আমার কেমন যেন চুম্বক চুম্বক খেলা শুরু হয়ে গেছে। নীলাভ আলোয় অদ্ভূত আবহ সংগীতে শুরু হয় তার গল্প বলা। নর্থ আমেরিকায় বিশেষ করে কানাডার ইংরেজি বলার নিজস্ব একটা ধরণ আছে। উদ্ভাসিত চোখে আর ভাঁজ করা ঠোঁটে ছুড়ে দেয়া প্রতিটি ইংরেজি শব্দ আমার কাছে ধরা দিচ্ছে বাংলা হয়ে। গল্পের নায়িকা আলিওনুশকা বোন আর নায়ক ইভানুশকা ভাই। এক ডাইনীবুড়ী মন্ত্র দিয়ে সুন্দরী বোন আলিওনুশকাকে হাতে পায়ে পাথর বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়, আর ভাই ইভানুশকাকে বানিয়ে ফেলে ভেড়া। ভাই যখনই নদীর পাড়ে যায় শুনতে পায় নদীর গভীর থেকে ভেসে আসা বোনের আর্তনাদ—
ইভানুশকা ভাইটি মোর
তলায় টানে ভারী পাথর
ঘাসেতে পা চেপে ধরে
হলুদ বালি বুকের পরে।
ইয়েলিনার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দে আমি ফিরে যাই আমার ছেলেবেলায়। আমাদের বাড়িতে রুশদেশের উপকথা নামে কাপড়ের মলাটে প্রগতী প্রকাশনের একটি বই ছিল। সেই বইয়ে আমি গল্পটা পড়েছি বাংলায়। পড়তে পড়তে বোন আলিওনুশকা ও ভাই ইভানুশকার কষ্টে লুকিয়ে লুকিয়ে কতবার যে কেঁদেছি! ইয়েলিনার গল্প বলা দিয়েই অনুষ্ঠান শেষ হয়। তুমুল হাততালিতে যেন সমুদ্রে ঢেউয়ের নাচন। যারা গল্প বলেছেন অর্থাৎ পারফর্মার, সবাই স্টেজ থেকে নেমে সামনে এসে অনুষ্ঠানের ফিডব্যাক নিতে দর্শকদের সাথে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। পেছন থেকে যেন লাফিয়ে লাফিয়ে ইয়েলিনার সামনে গিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে তার পরিবেশনা খুব ভালো হয়েছে জানালাম।
: এ গল্পটি আমি ছোটোবেলায় পড়েছি।
: বলো কী? তোমার ব্যাকহোম কি রাশিয়া?
: না।
: তাহলে? গল্পটা কীভাবে পড়লে?
: আমার ভাষায় এটা অনুদিত হয়েছে। সোভিয়েট আমলে মস্কো থেকে রুশদেশের উপকথা নামে একটা বই বের হয়েছিল।
: ভেরি ইন্টারেস্টিং!
কি আলাপ করব আমি বুঝতে পারছিনা তাই কথা বাড়াতে জিজ্ঞেস করি—
: তোমার ব্যাকহোম কি রাশিয়ায়?
: আমার জন্ম বেড়ে উঠা কানাডায়, এই টরন্টো শহরে। তবে আমার মা কিরগিজ আর বাবা রাশিয়ান। বলতে পারো আমার মা-বাবার ব্যাকহোম রাশিয়ায়।
এই পযর্ন্ত আলাপ হওয়ার পর ইয়েলিনা অন্যদের সাথে কথাবলায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এই এতটুকু আলাপ হলো কিন্তু কী যে হাল্কা লাগছে নিজেকে! মনে হচ্ছে মাথা থেকে একটা পাহাড় সরে গেছে।
অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে একা একা হাঁটতে থাকি ডর্মিটরি যাওয়ার পথে। খুব একটা লোকজন নেই। এমনিতেই থাকে না, আজও নেই। নিঃসঙ্গ ল্যাম্পপোস্টগুলি আলো দিয়ে অবিরত অন্ধকার তাড়াচ্ছে। চারপাশে গাছ আর গাছ। বাতাসে দুলছে ম্যাপল লিফ আর পাইন গাছের পাতা, কেমন যেন শিনশিন শব্দ। কোনো কারণে গাছ-গাছালি যেন কঁখিয়ে উঠছে থেকে থেকে। মনে হচ্ছে আমি একটা গহীন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি। বাউরী বাতাস। চারপাশে বাতাসের উৎসব চলছে। আমার কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগছে। মনে হচ্ছে আমার দু’টি ডানা আছে, এখনই উড়ে চলে যাব আকাশে কিংবা আকাশেরও উপরে। ঘোরের মধ্যে ডর্মিটরিতে ফিরে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম কিছুই মনে নেই। সকালে ক্লাস। দারুণ ঘুম হয়েছে। পড়িমরি করে রেডি হয়ে ক্লাসের জন্যে দ্রুত বের হয়ে যাই। ক্যাম্পাসে পা রেখেই চারপাশে খুঁজতে থাকি ইয়েলিনাকে। না, কোথাও নেই। খুব অস্থিরতা নিয়ে প্রথম ক্লাস শেষ করি। প্রথম ক্লাসেই মাথাটা ভারী হয়ে গেছে। এরকম মাথা ভারী আর কোনোদিন হয়নি আমার। শুনেছি মাথা ভারী ভারী লাগলে নাকি চা অথবা কফি খেতে হয়। কফি খাব বলে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে হাঁটছি আচমকা দেখি ইয়েলিনাও আসছে ক্যাফের দিকে। একা একা। কাছাকাছি হতেই আমি তাকে হাই জানালাম। হ্যলো বলে অন্যভাবে ভাষাহীন চাহনিতে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে থাকে। মনে হলো চিনতে পারেনি। না পারারই কথা, গতকাল রাতে অনুষ্ঠান শেষে খুব ব্যস্ততার সময় বেশিক্ষণ কথা হয়নি। তারপর মনে হলো স্মরণ করতে পেরেছে। দুজনই সমান তালে হাঁটতে থাকি ক্যাফের দিকে।
ক্যাফেতে আমরা কফি নেই, যে যার মতো। হিজ হিজ হুজ হুজ ডলার পে করেছি। কফি নিয়ে মুখোমুখি দুজনের আলাপ শুরু হয়। ইয়েলিনা পড়ে ইকোনোমিক্সে আমরা একই সেমিস্টারে।
: গতকাল বলেছিলে তুমি গল্পটা পড়েছো?
: হ্যাঁ। এটা আমি পড়েছি।
: তোমার মাতৃভাষা কী?
: বাংলা
: এটা কি এশিয়ার কোনো ভাষা?
: হুম।
: তুমি কোন দেশের?
: আমার দেশের নাম বাংলাদেশ।
: আমার মা তোমাদের অঞ্চলের একটা ভাষা জানে। ওই ভাষা শিক্ষায় পড়াশুনা করেছিল। আমি মা কে জিজ্ঞেস করে কাল তোমাকে জানাব।
ইয়েলিনার তাড়া আছে তাই সে খুব তাড়াহুরো করে চলে গেল। আজ আমার আর ক্লাস নেই।
ইয়েলিনার সামনে আজ নিজেকে আর টরন্টো লেকের সেই মিইয়ে যাওয়া ঢেউয়ের মতো মনে হয়নি। ও বলেছে আগামীকাল আবার কথা বলবে ফলে আজকে ওর চলে যাওয়াটা অনেক অপেক্ষা জমা রেখে গেছে আমার কাছে। অপেক্ষার সময় নাকি অনেক লম্বা হয়। মানুষ যখন একা থাকে তখন নিজের সাথে নিজে এক ভয়ংকর আড্ডায় মেতে উঠে। হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে আসি। রাস্তার গলিতে এক এ্যাংলো মেয়ে আপন মনে ভায়োলিন বাজিয়ে পুরানো দিনের গান গাইছে ‘ড্রিংক টু মি অনলি উইথ থিন আইস’ যদি আক্ষরিক বাংলা করা হয় তাহলে দাঁড়ায় এই রকম ‘শুধু তোমার চোখ দিয়ে আমাকে পান করো’ খুব পরিচিত সুর। এটি ষোল শতকের একটি বৃটিশ গান। এই গান থেকেই আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুরটি নিয়েছিলেন তাঁর ‘কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া’ গানটির জন্যে। গানে মেয়েটির মায়াময় কন্ঠ আর ভায়োলিনের করুণ সুর মিলে মনটা উদাস করা গ্রীস্মের বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে বারবার।
আজ টরন্টো শহরে উদ্দেশ্যহীন, গন্তব্যহীন অনেক হাঁটলাম। এ এমন এক শহর হাঁটতে গেলে হাঁটার নেশা পেয়ে বসে। এ শহরে কোন রাজপথ নেই, চারপাশে কেবলই জনপথ। বসন্ত আর গ্রীষ্মে শহরের অলিগলিতে চব্বিশ ঘন্টার উৎসব লেগে থাকে। এসময়ে কোনো মানুষই ঘরে থাকতে চায় না।
ডর্মিটরিতে ফিরে জ্যাক এর সাথে দেখা। জ্যাক আমার সাথে পড়ে, আয়ারল্যান্ডের ছেলে। স্টলারে নিজের বাচ্চা নিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে যেন রেগে ফেটে পড়ল লিসার উপর। জ্যাক আর লিসা লিভ টুগেদার করে। লিসার বাড়ি ক্যারেবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের বাহামায়। ওদের দুজনের এই কণ্যা সন্তান। ওরা ঝগড়া করে প্রতি মুহূর্তে। কথায় কথায় জ্যাক-লিসার সংসার ভেঙে দেয় লিসা। জ্যাকের কাছে বাচ্চা রেখে লিসা চলে যায়। কী ফুটফুটে বাচ্চাটা, এখনও নাম রাখা হয়নি। স্টলারে শুয়ে শুয়ে হাত পা ছুড়ে অবোধ্য ভাষায় কি যেন বলতে থাকে। মা-বাবার যুদ্ধ তাকে একেবারেই ছোঁয় না। লিসা পারেও! এই দুজনের ঝগড়ার বিষয়ে ক্যাম্পাসের সবাই জানে। জ্যাক এর সাথে সংসার করবে না বলে লিসা সব ফেলে এমনকি বাচ্চাটিও রেখে কোথায় যেন উধাও হয়ে চলে যায়। ঘন্টাখানিক পর এদিক-সেদিক ঘুরেফিরে আবার চলে আসে। এসেই জ্যাক এর সামনে লিসা নিজেকে নিজে অনেক কথা শোনায়। তখন জ্যাক খুব চুপচাপ থাকে। আহারে মায়া! আহারে টান! জ্যাকের সাথে কথা বলতে বলতে বাংলাদেশ থেকে মায়ের ফোন। জ্যাককে হাত দিয়ে বাই বাই জানিয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে রুমে চলে যাই।
মায়ের সাথে কথা হলো অনেক। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর ভীষণ একা হয়ে গেছে আমি। স্কলারশিপ নিয়ে কানাডায় আসার পর আরও একা। ক্যালেন্ডারে তারিখ দেখি আর সময়ের হিসাবে করি, কবে পড়াশুনা শেষ হবে, কবে যে দিন ফুরাবে, দেশে যাব মায়ের কাছে।
ইয়েলিনা আরও জানাল ওর মায়ের শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না আজকাল। সময় ও সুযোগ করে কোনো এক উইকেন্ডে আমাকে আমন্ত্রণ জানাবেন তাদের বাসায়। উনি খুব খুশি হয়েছেন জেনে যে বাংলাভাষী কারোর সাথে ইয়েলিনার সাথে পরিচয় হয়েছে। উনি এখনও বাংলাকে ভালোবাসেন।
সকালে ক্যাম্পাসে যেতেই ইয়েলিনা এসে গল্প শুরু করে আমার সাথে। অনেক উৎসাহ নিয়ে জানাল ওর মা বাংলা ভাষাই জানে। অনর্গল বলতে পারে, লিখতেও পারে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সময় অফিসের এ্যসাইনমেন্ট হিসেবে বাংলা ভাষা শিখতে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে। মস্কো থেকে প্রকাশিত বেশ কয়েকটা বাংলা পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিমালা দেখভাল করতেন মন্ত্রণালয়ের হয়ে। ইয়েলিনা আরও জানাল ওর মায়ের শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না আজকাল। সময় ও সুযোগ করে কোনো এক উইকেন্ডে আমাকে আমন্ত্রণ জানাবেন তাদের বাসায়। উনি খুব খুশি হয়েছেন জেনে যে বাংলাভাষী কারোর সাথে ইয়েলিনার সাথে পরিচয় হয়েছে। উনি এখনও বাংলাকে ভালোবাসেন। ইয়েলিনাকে শুনিয়েছেন বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। ইয়েলিনার সাথে আড্ডা দিতে দিতে আমার একটা ক্লাস করা হলো না। অনেক অনেক আলাপ হলো। মনে হলো, দুজনেই গুপ্তধনে ভরা একটি রুমে ঢুকে কেবলই কিছু একটা খুঁজছি। ইয়েলিনাকে জানালাম আমার বাবাও মস্কোর প্যাট্রিস লুমুম্বা গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিক্যালে পড়াশুনা করেছেন সোভিয়েত সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে।
ক্যাম্পাস থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা টরন্টো লেকের পাড়ে চলে যাই, বিচের মতো। লেকটা বিশাল। কুল নাই, কিনার নাই। চোখের পলকে রাজ্যের কথা ভির করে। প্রতিটি কথাকে মনে হচ্ছে নির্মিয়মাণ দালানের এক একটি ইট। রাজমিস্ত্রীর মতো দুজন মিলে যেন একটি ঘর নির্মাণ শুরু হয়েছে। গড়ানো দুপুরে সেল ফোনে সময় দেখে ইয়েলিনা বলল—
: চলো।
: কোথায়?
: আজকে তোমাকে আমার একটা প্রিয় খাবার খাওয়াব।
আমি কি না করতে পারি? আগবাড়িয়েই রাজি হয়ে যাই।
: রেস্ট্রুরেন্টটা একটু দূরে। হাঁটতে হবে। কোনো সমস্যা নেই তো?
: কেন সমস্যা হবে।
: তাহলে চল।
: হুম, চল।
পৃথিবীতে জল হচ্ছে সেই পরিব্রাজক যেদিকে সে চলা শুরু করে সেটিই তার পথ হয়ে যায়।
জল গড়ানোর মতো দুজনেই হাঁটতে শুরু করলাম। পৃথিবীতে জল হচ্ছে সেই পরিব্রাজক যেদিকে সে চলা শুরু করে সেটিই তার পথ হয়ে যায়। হেঁটে হেঁটে একটা কোরিয়ান রেস্টুরেন্ট এলাম। প্রচণ্ড ভির, বসার জায়গা নেই। একটু অপেক্ষা করতে হবে, দাঁড়াতে হবে। ভিরের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুজনের কথা চলে। চারপাশে কি ঘটছে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, এ যেন অনিমেষ গল্প। ইয়েলিনা জানাল তার মায়ের নাম গালিনা আইৎমাতভ। মায়ের শরীরটা খুব ভালো যাচ্ছে না। ওভারিয়ান ক্যান্সার ধরা পড়েছে। থার্ড থেকে ফোর্থ স্টেজের মাঝামাঝি। ও সব সময় খুবই আতংকে থাকে। ওদের ব্যাকহোম বলা চলে রাশিয়া। মা কিরগিজিস্তানের বাবা ইগোর স্তেপানভ, রাশিয়ান। বাবার সঙ্গে বনিবনা না হওয়াতে ও যখন পেটে পাঁচ-ছয় মাস তখনই ইমিগ্রেশন নিয়ে কানাডায় চলে আসেন। মা ভীষণ আত্মসচেতন এবং জেদী। ইয়েলিনার জন্ম টরন্টোয়। বাবার সাথে খুব একটা যোগাযোগ নেই। মস্কোয় বাবা বিয়ে করে অন্য একটা সংসার নিয়ে আছেন। ইয়েলিনার নানী মারা যাওয়ার পর মা গালিনা নানাকে স্পন্সর করে নিয়ে এসছেন টরন্টোয়। নানা রুসলান আইৎমাতভ সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারি আমলা ছিলেন। ইয়েলিনা, মা গালিনা আর নানা রুসলানকে নিয়ে তাদের সংসার। ইয়েলিনার দুই ফুফু টরন্টো শহরেই থাকে। তাদের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক, মায়ের সাথে খুবই সদ্ভাব শুধু বাবার সাথেই বনিবনা হলো না। সেই থেকে মা আর বিয়ে করেনি।
আমাদের খাবার অর্ডারের পালা এলে ইয়েলিনা বুলগোগি অর্ডার করে। এটি কোরিয়ান ৬৬৮ খ্রিষ্টাব্দের গোগুরিয়ো সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী খাবার। শুকর কিংবা গরুর মাংশ লম্বা চিলতে কুঁচি কুঁচি করে কেটে ঝাল মিস্টি দিয়ে কাবাবের মতো বেশ ঘন ঝোল করে সবুজ সব্জি দিয়ে রান্না করা হয়; সাথে ফিনফিনে সাদা ভাত। প্রথাগতভাবে খেতে হয় কাঠি দিয়ে কিন্তু কাটা চামচ দিয়েও খাওয়া যায়। কাটা চামচে খেতে খেতে ইয়েলিনা জানাল বিখ্যাত সোভিয়েত লেখক চিঙ্গিজ আইৎমাতভ তার নানা রুসলান আইৎমাতভের চাচাতো ভাই। এ নিয়ে নানার গল্পের শেষ নেই। ভীষণ অহংকার তার, দেখা হলেই নানা তাকে এসব শোনাবে। ইয়েলিনা কোনোদিন তাকে দেখেনি কিন্তু তাঁর লেখা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত জামিলা পড়েছে। তাঁর লেখায় সে মুগ্ধ। চিঙ্গিজের লেখায় এক ধরণের জাদু আছে। পাঠককে হিপনোটাইজ করে দেয়। আমার মনে আছে মস্কো থেকে বাংলা ভাষায় সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে প্রতি মাসে ঢাউস সাইজের একটি রঙ্গিন পত্রিকা প্রকাশিত হতো। আমাদের বাসায় তা বাঁধাই করে রাখা আছে। সেখানে দেখেছিলাম জামিলা নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস। অনুবাদ করেছিলেন খালেদ চৌধুরী। পাতা উল্টিয়ে দেখেছি কিন্তু পড়া হয়ে উঠেনি। আলাপে আলাপে আমাদের খাবার শেষ। বুলগোগি ভীষণ স্বাদ, ঘ্রাণময়।
দেখতে দেখতে হেমন্ত চলে যাচ্ছে। গাছের পাতাদের রঙ বদলাচ্ছে, চারপাশ ভীষণ রঙ্গময়, বাঙময়। হিম মাখানো বাতাস। পাতা ঝরা শুরু হয়ে গেছে। পাতা ঝরার সময় এখানে উৎসব শুরু হয়। দলবেঁধে সবাই জঙ্গলে যায় পাতার বাহারী রঙ, পাতা ঝরা দেখতে। এ এক পতনের উৎসব। হাহাহিহি করে হেসে সবাই ছবি, সেলফি তোলে। পাতা ঝরার হেমন্ত নিয়ে লেখক আলবেয়ার কাম্যুর একটি বিখ্যাত উক্তি আছে ‘হেমন্ত হচ্ছে দ্বিতীয় বসন্ত, যেখানে পাতারা ফুল হয়ে ফোঁটে।’ প্রকৃতিকে মনে হয় চিত্রশিল্পী ভ্যানঘঁগের ক্যানভাস। টরন্টো শহর চষে বেড়ানো শেষ। গেল সপ্তাহে আমরাও এক জঙ্গলে গিয়েছিলাম দিন দুপুরে। হঠাৎ দেখি এক মা ভাল্লুক তার বাচ্চাদের নিয়ে আমাদের সামনে। কী যে ভয় পেয়েছিল ইয়েলিনা! কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে। বছরের পর বছর অবিরল জলধারা ঝরছে– কোনো থামাথামি নেই। কী অপার বিস্ময়! ওন্টারিওর নায়াগ্রা অঞ্চলে গিয়ে একটি প্রবাদ শুনেছিলাম। আমার আর ইয়েলিনার খুব মনে ধরেছিল। প্রবাদটি হচ্ছে—
‘প্রেম অনেকটা জলপ্রপাতের মতো ভীষণ স্বাধীন, বুনো আর ক্ষ্যাপাটে।’
ইয়েলিনাদের বাসায় যেতে যেতে প্রবাদটির কথা মনে পড়ল। ইয়েলিনার মা গালিনার সাথে এই আমার প্রথম দেখা হতে যাচ্ছে। নভেম্বরের শেষ বিকেল এখনও স্নো পড়া শুরু হয়নি তবে যে কোনোদিন থেকেই শুরু হয়ে যেতে পারে। ইয়েলিনাদের পাড়াটা খুবই শান্ত, ছিমছাম। প্রচুর গাছ-গাছালিতে ভরা। ছায়াময়। চোখের পলকে এই কয়দিনে গাছের সব পাতা ঝরে কেমন ন্যাড়া হয়ে গেছে। ওদের বাড়িটাও খুব সুন্দর, গোছানো। আমি অনেকবার এ বাড়ির সামনে এসেছি ইয়েলিনাকে এগিয়ে দেয়ার জন্যে, কিন্তু কোনোদিনই ঘরে ঢুকেনি। ইয়েলিনাও চায়নি হুটহাট মায়ের সঙ্গে, নানার সঙ্গে দেখা হোক। ও চেয়েছে একটু আনুষ্ঠানিকভাবেই হোক। মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা আর অফিসের ছুটি না থাকার ফলে বেশ দেরিই হয়ে গেল। ওদের বাসায় ঢুকে অবাক হয়ে যাই। গালিনা শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন তার সাথে গালিনার বাবা রুসলান আর সবার পেছনে ইয়েলিনা। গালিনা হাত দুটো জড়ো করে উপরে তুলে বললেন—
: নমস্কার
ফুলের তোড়াটা কোলে নিয়ে আমিও গালিনার মতো হাত উপরে তুলে উত্তর দেই। ভাঙা ভাঙা রুশ ভাষায় বলি
: দ্রোবিয় দিয়েন। মানে হলো শুভ অপরাহ্ণ।
ফুল তোড়া হাতে তুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করি
: কাক-উ-বাস দেলা। কাক ভি সে পাজিভহিসে? খারাশো? যার মানে— কেমন আছেন? আপনারা সবাই ভালো?
গালিনা হাসতে হাসতে বললেন
: লিনা তোমাকে ভালোই শিখিয়েছে। ও তো ভালো শিক্ষক দেখছি।
কাছে এসে আমাকে সোফার দিকে এগিয়ে নিয়ে বসতে বললেন আর পরিচয় করিয়ে দিলেন রুসলানের সাথে। আমি কথা বলা শুরু করি।
: আমার বাবা কিন্তু প্যাট্রিস লুমুম্বা ইউনির্ভাসিটিতে পড়াশুনা করেছেন।
: হ্যাঁ। আমি জানি। লিনা আমাকে সব বলেছে।
: আমার বাবা সোভিয়েত নারী পত্রিকায় পার্ট টাইম কাজ করতেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে মস্কোর ২২, কুজনেৎস্কি মোস্ত থেকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হতো সোভিয়েত নারী। অফিসের দায়িত্ব হিসাবে বাংলা সংস্করণে যুক্ত ছিলেন গালিনা আইৎমাতভ। সেটিই তার জীবনের চাকরির শুরু। গালিনা বাংলা শিখেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলকাতা শহরটি ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠেছিল তার।
শোনার সাথে সাথে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আবার বেশ নিস্পৃহও হয়ে গেলেন। অন্য বিষয়ে কথা শুরু হয়ে গেলে এ প্রসঙ্গটি চাপা পড়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে মস্কোর ২২, কুজনেৎস্কি মোস্ত থেকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হতো সোভিয়েত নারী। অফিসের দায়িত্ব হিসাবে বাংলা সংস্করণে যুক্ত ছিলেন গালিনা আইৎমাতভ। সেটিই তার জীবনের চাকরির শুরু। গালিনা বাংলা শিখেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলকাতা শহরটি ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠেছিল তার। একা একা খুব ঘোরোঘুরি করতেন। গোর্কী সদনে আড্ডা দিতে যেতেন। সে সময়ে কলকাতার অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছিল তার। যোগাযোগ না থাকাতে নাম পরিচয় ভুলতেও বসেছেন। সময়তো আর কম বয়ে গেল না! কথাশিল্পী মহাশ্বেতা দেবী এবং কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম এখনও মনে আছে। সোভিয়েত নারী বাংলা ভাষা সংস্করণের দায়িত্বশীল সম্পাদিকা ছিলেন নিনা দ. বালিয়াসনিকভা। খুব অমায়িক মানুষ। এখন কোথায়? কি করে কিছুই জানেন না গালিনা। পুরো ঘরময় বাজছে চাইকোভস্কির সোয়ান লেক। রাশিয়ান সংগীতগুরু সুরকার পিউতর ইলিচ চাইকোভস্কি রুশদেশের উপকথা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কম্পোজ করেছিলেন এই সিম্ফনি। আমরা তিনজন মানে আমি, রুসলান আর ইয়েলিনা রাশিয়ান ভদকা পান করছি আর সাথে রাশিয়ার বিখ্যাত সালাদ। ডাক্তারের নিষেধ থাকায় গালিনা ভদকা বা কোনো ধরনের এ্যলকোহল পান করছেন না– তবে আমাদের সাথে আড্ডায় আছেন। এমনিতে ইয়েলিনা সারাদিন আমার সাথে খই ফোটার মতো অনেক কথা বলে কিন্তু এখন সে থতমতো খেয়ে কোথায় যেন আটকে আছে। খুব কম কথা বলছে কিন্তু হাসাহসি করছে বেশ প্রাণখুলে। ধীর স্থির এবং সুললিত কণ্ঠে বিশুদ্ধ বাংলায় বলেন গালিনা। ঘরে আমরা মানুষ চারজন কিন্তু কথা হচ্ছে তিনটি ভাষায় যেমন ইংরেজি, বাংলা এবং রাশিয়ান। টরন্টো শহরটা এরকমই। রাস্তায় বের হলে পৃথিবীর অনেক ভাষা এসে কানে ধরা দেয়। রুসলান রাজ্যের কথা বলেন। খুব মজার এবং মিশুক মানুষ। বাচ্চাদের মতো পুরানো দিনের এ্যালবাম বের করে চিঙ্গিজ আইৎমাতভের সাথে কিরগিজস্তানের পাহাড়ের কোল ঘেষে তোলা তাঁর সাদাকালো ছবি দেখালেন। আমি জানালাম চিঙ্গিজ আৎমাতভের নাম জানি, খুব বেশি না তবে টুকটাক লেখা পড়েছি বাংলায়। এই কথা শোনার পর রুসলান উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। তার অহংকার আরও বেড়ে গেল। ইয়েলিনা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মেরে ঠোঁট কামড়িয়ে হাসল। অনেক গল্প করলেন। বসার টেবিলে একটি সামোভার রাখা আছে, শোকেসে অনেকগুলো মাত্রিউসকা। ঘরের কোণের সোভিয়েত আমলের একটি গ্লোব। তাঁদের ঘরে আরও অনেক সোভিয়েত ঐতিহ্য রয়েছে। এক চোট নিলেন সে সময়ের বিশ্ব নেতাদের। চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করলেন তৎকালীন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল মিখাইয়েল গর্বাচেভ আর গ্লাসন্স্ত, পেরেস্ত্রাইকোর। রুসলানের এক অদ্ভূত স্বভাব। স্বাভাবিক কন্ঠে আলাপ করতে করতে হঠাৎ আশেপাশে তাকিয়ে কেউ আছে কি না দেখে ফিসফিসিয়ে কথা বলা শুরু করে দেন। বেশ কয়েকবার করার পর নিজেই এর কারণ ব্যাখ্যা করলেন। যেহেতু উনি সোভিয়েত সময়ের সরকারি আমলা। পুরোটা জীবনই সরকারি চাকরি করেছেন অনেক সময় অফিসে প্রায় সময়েই বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে নীচু গলায় ফিসফিসিয়ে কথা বলতে হতো প্রতিদিন ফলে এটি স্বভাবে জড়িয়ে গেছে। সোভিয়েত আমলে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর সরকারি অফিসগুলিতে নাকি প্রতিটি দেয়ালেরই কান ছিল। এ নিয়ে আমাদের হাসাহাসি শেষ না হতেই সবাইকে গালিনা ডাইনিং টেবিলে বসতে তাড়া দিলেন। বাঙালি খাবার আর রাশিয়ান খাবার মিলে অনেক আইটেম করলেন। খাবারের পরও এক পশলা আড্ডা হলো। আড্ডা যেন শেষ হতে চায় না। রাত সোয়া এগারোটা বেজে গেছে। ভীষণ আনন্দময়, অনাবিল সন্ধ্যা কেটেছে। শীতের জ্যাকেট পড়ে ঘর থেকে বের হবো গালিনা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কী যে কান্না শুরু করলেন! সবাই হতভম্ব হয়ে গেছি। গালিনা অনেক ইমোশনাল হয়ে গেছেন। আমি প্রস্তর খণ্ডের মতো দাঁড়িয়ে আছি আর আমাকে ঘিরে যেন বরফ গলে গলে নদী বইছে। গালিনা নিজেকে সামলিয়ে আমাকে বিদায় জানালেন।
ইয়েলিনা অনেকবার বলেছে ওর মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না ইদানিং। ইয়েলিনার বাবার সাথে মতের মিল না হওয়াতে আর সংসার করতে যাননি। ইয়েলিনাকে নিয়েই তার অন্যরকম যাপন। একাকীত্বের সংগ্রাম। ও আরও বলেছে তার মা ভীষণ নরোম মনের মানুষ কিন্তু আবার খুবই শক্ত। প্রত্যয়ী। এসব ভাবতে ভাবতে ডর্মিটরিতে পৌঁছে যাই।
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। টরন্টোর জন্যে অনেক রাত তবুও একটু চঞ্চলতা আছে উইকেন্ডের রাত বলে। রাস্তায় তেমন একটা মানুষজন নেই। সাঁই সাঁই করে দু একটা গাড়ি চলে যাচ্ছে। বাসের জন্যে খানিকটা পথ হাঁটতে হবে। গালিনার এরকম ইমোশনাল হয়ে যাওয়াটা মাথা থেকে সরাতে পারছি না। ইয়েলিনা অনেকবার বলেছে ওর মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না ইদানিং। ইয়েলিনার বাবার সাথে মতের মিল না হওয়াতে আর সংসার করতে যাননি। ইয়েলিনাকে নিয়েই তার অন্যরকম যাপন। একাকীত্বের সংগ্রাম। ও আরও বলেছে তার মা ভীষণ নরোম মনের মানুষ কিন্তু আবার খুবই শক্ত। প্রত্যয়ী। এসব ভাবতে ভাবতে ডর্মিটরিতে পৌঁছে যাই। আজকে আর বাংলাদেশে ফোন করে মায়ের সাথে কথা হলো না। সকালে উঠতে হবে বলে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলাম। দুবার তিনবার ফোনে রিং বাজল। চারবারের মাথায় কিছু না দেখেই ঘুমের মধ্যে ফোনটা ধরলাম। লিনার ফোন। ও ত্রস্ত কন্ঠে জানাল মা হঠাৎ করেই অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই ইমরিজেন্সি এ্যম্বুলেন্স কল করে টরন্টোর মাইকেল গোরান হসপিটালে নিয়ে এসেছে। রাত চারটা। আমি পড়িমরি করে রেডি হয়ে হাসপাতালে ছুটলাম। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। হাসপাতালের রিসেপশনে রুসলান আর লিনা বসে আছে। চোখে মুখে ভীষণ উদ্বেগ। আমাকে দেখে দুজনই যেন শক্তি ফিরে পেল। লিনার দুই ফুফু আসছেন, রাস্তায়। অবস্থা খুব একটা ভালো না। গালিনা আইসিউতে আছেন অবচেতন অবস্থায়।
লিনার বন্ধুরা আসছে পালা করে। আসছে পারিবারিক বন্ধু, স্বজনরাও। আশংকা আর উৎকন্ঠায় পাঁচটা দিন কেটে গেল। অবস্থা ভালো নয়। সময় সময় ডাক্তার সবকিছু আপডেট করছে। লিনা সকাল থেকে সন্ধ্যা পযর্ন্ত হাসপাতালের রিসেপশনে বসে থাকে, সাথে আমিও। রুসলান এমনিতেই বয়স্ক মানুষ; এত প্রেসার নিতে পারছে না। সবাই বুঝে গেছে সময় শেষ। লিনা নিজেকে তৈরি করছে সেইভাবে, মন শক্ত করছে। ওর মা চলে গেলে ওর আর কে থাকল? নানা রুসলান আর আমি। বাবাকে ও তো কোনোদিন পায়ইনি। ছয়দিনের মাথায় গালিনাকে বাঁচানো গেল না। ও সব কিছুই সামলে নিচ্ছে। লোকজন আসছে খবর শুনে। রুসলান শেষকৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করছে। বাবার জন্যে এটা কী যে কষ্টের তার সন্তানের সমাহিত করা কিন্তু করতে তো হবে। রুসলান আর লিনাকে ঝড়াক্রান্ত বিধ্বস্ত পাখির মতো দেখাচ্ছে। সব কৃত্যাদি শেষ হওয়ার পর সমাহিত করার জন্যে আমরা কবরস্থানে গেলাম। এ বছরের তুষারাপাত আজই প্রথম শুরু হলো। চারপাশ সাদা হয়ে যাচ্ছে। সবাই দাঁড়িয়ে আছি মূর্তির মতো। শব্দহীনতা পরিবেশকে আরও থমথমে করে তোলে। একটি ক্রেন দিয়ে গালিনার ডেডবডি নামানো হচ্ছে কবরে। শুনশান নীরবতা। পেছনে দাঁড়িয়ে আমার পিঠে ইয়েলিনা মাথা রেখে গগণবিদারী চিৎকারে কান্না শুরু করে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরি। চরাচর ডুবে যাচ্ছে শ্বেত শুভ্রতায়। গালিনা বিলীন হয়ে যাচ্ছে সেই শুভ্রতায়। অনেক জোড়ে জোড়ে কান্নাকাটি করল, যেন বাঁধভাঙা আতর্নাদ। কান্না এক পর্যায়ে রূপ নেয় গোঙানিতে। এরকম তুষারাপাতে আমি কাউকে আগে কখনই কাঁদতে দেখেনি। গালিনাকে সমাহিত করে সবাই ফিরে আসি। লিনাদের বাসায় ওর ফুফুরা এসেছেন পালা করে থাকবে। সবকিছু থমথমে। অনর্গল কথা বলা রুসলান কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেলেন। আগামীকাল আমার একটা এক্সাম থাকায় আমি চলে যাই ভাসির্টিতে। এই কয়দিনে আমার অ্যাকাডেমিক অবস্থা খুবই বাজে হয়ে গেছে। ক্লাস তো বাদ গেছেই বেশ কয়েকটা এক্সাম ড্রপ করেছি। এখন যে ভাবেই হোক এইগুলি পূরণ করতে হবে। সন্ধ্যায় কিছুক্ষণের জন্যে ইয়েলিনাদের বাসায় থেকে আবার ডর্মে ফিরে আসি এক্সামের প্রিপারেশন নিতে।
পরদিন এক্সাম শেষ করতে না করতেই লিনার ফোন। আমি দ্রুত ওর বাসায় যাই। বাসায় গিয়ে দেখি লিনা তাঁর মায়ের আলমারিটা খুলে অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। এই আলমারিটা গালিনার একান্তই নিজস্ব ছিলো। অনেক কিছু বের করেছে। এ সব কিছুতেই গালিনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, তাঁর গন্ধ লেগে আছেন। সেখানে একটা মোটা ভারী প্যাকেটে বিদেশি ভাষার কিছু পুরনো কাগজপত্র পাওয়া গেছে। আমার হাতে দেয় এগুলো বাংলায় লেখা কি না জানতে। লিনা তো আর বাংলা পড়তে পারে না। আমি কাগজগুলো হাতে নিতে নিতে দেখি ওদের ঘরের কোণে রাখা সোভিয়েত আমলের সেই ছোট্ট গোল পৃথিবীটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কাগজগুলো বাংলায়ই। গালিনাকে লেখা প্রেমের চিঠি। লেখাগুলি আমার বাবার হাতের…
লেখক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি টেরেস্ট্রেরিয়াল টেলিভিশন একুশে টেলিভিশনের প্রযোজক। এনটিভির নিবার্হী প্রযোজক। দেশ টিভির অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান হিসাবে কাজ করেছেন। প্রযোজনা করেছেন বাংলাদেশের অনেক জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠান। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘কিছুটা দুঃখবাদী হওয়া যায়’, ‘হিরণ্ময় নিঃস্তব্ধতায় পাখিদের মুখোমুখি’, ‘অনন্তকাল বৃষ্টির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি’, ‘চে গুয়েভারাকে নিয়ে কবিতা’, ‘কানাডার সমকালীন কবিতা’, ‘স্বপ্নযাজক’, ‘ইমেজ অব ওয়াল’।