অগুণিত গল্পের দেশে
১.
ল্যাপটপ থেকে ধোঁয়া বের হয়ে এলো, ভেতরে যুদ্ধ চলছে সিনেমায়! আমি তার গন্ধ পেলাম। আমাদের এই বাসায় আজ কিছুটা শোক লেগে আছে। আমার এক কাজিন মারা গেছেন, বয়স মরে যাওয়ার মতো নয়; চল্লিশের কাছাকাছি হবে! তারপরও মারা গেলেন স্ট্রোকে। মা কাঁদছেন! আমি কান্নার পাশে তেমন বসে থাকতে পারি না। পা টিপে টিপে আমার রুমে ফিরে এলাম, ল্যাপটপে যুদ্ধের ছবি ছাড়লাম। তার আগে মোবাইল থেকে কাজিনের ছবি বের করলাম। তাকে দেখেছি আঠারো বছর আগে বা তারো আগে, সময়কাল মনে নেই। মা বললেন আঠারো বছর হয় ওরে আমরা দেখি নাই! উনি একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে গ্রিস চলে গেলেন! আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, বাড়ি থেকে পালিয়ে আমি রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে আবার বাড়ি চলে এসেছিলাম। আর উনি গ্রিস চলে গেলেন! এরপর যখন ফেরত এলেন কিছুদিন আগে, বয়স বাড়িয়ে আর বিয়ে ও স্ট্রোকের সম্ভাবনা নিয়ে। আমি তার বিয়ের সম্ভাবনার কথা জানতাম, স্ট্রোকের না। আজ যখন মারা গেলেন, তখন খুব হালকা মনে পড়লো ছোটো বেলার কথা। আমরা কাজিনরা একসাথে আড্ডা দিতাম, গল্প করতাম । মানুষ মারা গেলে তার সাথে করা গল্পগুলোও কি মারা যায়! গল্পগুলো কি কবরে চলে যায়! জানি না! মায়ের ভারী নিঃশ্বাস আর আমার না-ঘুম-সময় একটা অস্বস্তি দিচ্ছে। আর ল্যাপটপের ভেতরকার সিনেমা থেকে ধোঁয়া এসে চোখ জ্বালাচ্ছে! আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ল্যাপটপ বন্ধ করে দেব। বন্ধ করার পর মোবাইল হাতে নিতে দেখি মানুষজন প্রতিবাদ করছে ফেসবুকে। গোটা ফেসবুক রণাঙ্গন। এক মেজরকে মেরে ফেলেছে ক্রসফায়ারে। রক্তাক্ত ব্যক্তি গড়াগড়ি খাচ্ছেন ফেসবুকে! আমার পায়ে রক্ত লাগবে ভেবে আমি তাড়াতাড়ি স্লিপার পরে নিলাম! স্লিপার ভিজে রক্ত আমার পায়ে পায়ে লাল হয়ে রইল! আমি মানুষের কাছে ফিরে আসি! অনেকেই বিচার চাচ্ছে ক্রসফায়ারকারী ওসির। কেউ মনে মনে বলল, তাকে পাথর মারা হোক! কেউ লেখার ভেতর চিৎকার মিশিয়ে বলল, তাকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হোক! কেউ বলল মেজরের মতো মানুষকে কেন ক্রসফায়ারে দিল! মেধাবী মানুষ! অনেকেই বিচার চাইল, কেউ কেউ ওসিকে মনে মনে মেরে ফেলতে চাইল, কেউ কেউ বলল এটা পুলিশ ডিপার্টমেন্টের দোষ। কেউ বলল এসপি’র দোষ, কেউ বলল রাষ্ট্রের! কারা যেন ওসিকে নিয়ে মিম বানাল, তার ইংরেজি বলতে না পারা নিয়ে প্রচুর হাসল! কেউ বিচার চাইল, কেউ মিম বানাল, কেউ হাসল! কেউ মিম বানাল, কেউ হাসল! বিচার চেয়ে লাভ নেই বলল কেউ! তারপর ওসি’র পাশাপাশি অন্যদের নিয়ে মিম বানানো হলো! তারপর সবাই হাসল! বিচার চাওয়া নিয়ে মিম বানাল! আবার হাসল! হাসতে হাসতে দেখি আমার কাজিন উঠে এলো বুকে ব্যাথা নিয়ে, বলল, ‘আরে থাম আর হাসতে পারি না!’ মেজর উঠে এলো গুলির নিচ থেকে, হাসতে হাসতে বলল, ‘ওসি কি হাস্যকর! ইংরেজি বলতে পারে না, আবার আমাকে মেরে ফেলল!’ সবাই হাসল! আমি হাসলাম! মায়ের কাছে গিয়ে হাসতেই মা ধমক দিল, আমি ভাবলাম মায়ের কান্না নিয়ে মিম বানাতে হবে! মা তখন ওজু করে নামাজ পড়তে শুরু করলেন। মায়ের কান্না তখনো ভারী!
যেভাবে শীত আসে
থলের ভেতর থেকে বের হয়ে এলো মুরাকামির বেড়াল, তার সাথে আলাপ করতে গিয়ে খুইয়ে ফেলি বছর পাঁচেক। প্রতিবছর শীতকাল আসছে, তবু প্রতিবছর সুপর্ণার কাছে আর্তি নিয়ে পৌঁছাই, ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’। সুপর্ণা ৩৬৫ দিন ধরে বাংলাদেশে থাকে কিন্তু শীতকাল আসি আসি করলে মুরাকামির বেড়ালের মতো বেরিয়ে আসে।
প্রতিবছর একটা উপন্যাস শুরু করার কথা থাকে, আর বছরের শেষে শীত জেঁকে বসলে বোঝা যায় এবারও আর লেখা হলো না।
নুরু পুশি আয়শা শফি সবাই বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, তারা আবৃত্তি করতে থাকে ‘বয়স হয়ে গেলো তো’ এইসব বয়স হয়ে যাওয়ার ভীড়ে অভিকর্ষ ঠেলে না-মানুষ হয়ে উঠি। কতো দেশ আছে যেখানে যাইনি। মন খারাপের মতো বরফ পড়ে যেখানে, যেখানে ইয়েতি থাকার সম্ভাবনা আছে, যারা বাংলাদেশে ‘সন্ধ্যার পর মাইয়া মানুষ এত দূর যাস না’ থেকে কম ভয়ংকর!
এইসব ভয় ডর ফেলে সন্ধ্যার পর একটা ফ্লাইওভারে ঘুরে বেড়াই বিল্ডিং এর মাথা ছুঁয়ে, বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে সমান্তরালে চলতে চলতে মনে হয় শীতকাল আসার সময় সমস্ত শহরে গায়েবি শিউলি ফোটে, সেসব ঘ্রাণ নিতে নিতে সুপর্ণার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করব অভ্যাসবশত, ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা, আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকবো’।
মুরাকামির বেড়াল তখন পাশে পাশে থাকে তৃতীয় জন হয়ে, এখানে দ্বিতীয় জন নেই তাই তৃতীয় জন নিয়ে চলতে হয়, who is the third one who always walk beside you!
সাহিত্যচর্চায় নিবিষ্ট এই লেখিকার জন্ম চট্টগ্রামে। তাঁর লেখালেখির চর্চা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই। প্রচারবিমুখ ও নিভৃতচারী এই লেখিকার গদ্য, কবিতা ও ভ্রমণকাহিনি রচনায় রয়েছে সাবলীল বিচরণ। ভাষার উৎকর্ষে, শব্দের ব্যাঞ্জনায় যেকোনো লেখাকেই হৃদয়গ্রাহী করে তোলার অসাধারণ শক্তি তাঁকে তাঁর সমসাময়িক লেখকদের থেকে কিছুটা আলাদা পরিচয়ে পরিচিত করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন।