মালিঙ্গার আসল নাম রহমত।
আমাদের স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের পিওন। একটা ঢোলা জামা পরে ঘোরে। মাথায় সবসময় একটা বেসবল ক্যাপ থাকে। এই ক্যাপ ছাড়া রহমতকে কল্পনাও করা যায় না।
বছরখানেক আগেও সবাই ওকে রহমত বলেই ডাকত। সে যথারীতি ওই নামে সাড়াও নিত। কিন্তু সাংবাদিক ইউনিয়নের এক ক্রিকেট টুর্নামেন্টের পর ওর নাম বদলে গেল।
আমাদের পত্রিকা সাধারণত সাংবাদিক ইউনিয়নের টুর্নামেন্টে অংশ নেয় না। মানে, অংশ নেওয়ার মতো এতো খেলোয়াড় পাওয়া যায় না। এবার ক্রাইম রিপোর্টার সাদেক ভাই খুব খেপে গেল। সে যে কোনোভাবেই হোক, টিম করবে বলে উঠে পড়ে লাগল।
আমাদের পত্রিকা সাধারণত সাংবাদিক ইউনিয়নের টুর্নামেন্টে অংশ নেয় না। মানে, অংশ নেওয়ার মতো এতো খেলোয়াড় পাওয়া যায় না। এবার ক্রাইম রিপোর্টার সাদেক ভাই খুব খেপে গেল। সে যে কোনোভাবেই হোক, টিম করবে বলে উঠে পড়ে লাগল। বিজ্ঞাপনের এক জন, নিউজ সেকশনের তিন জন আর ফিচারের এক জনকে নিয়ে হলো ৫ জনের দল। কিন্তু আরেক জন তো লাগবে— সিক্স আ সাইড টুর্নামেন্ট।
আরেক জন কিছুতেই মিলছিল না। এই নিয়ে চিফ রিপোর্টারের সামনে দাঁড়িয়ে সাদেক ভাই খুব আফসোস করছিল,
‘একটা প্লেয়ারের অভাবে টুর্নামেন্টটা খেলব না?’
আমাদের রহমত আস্তে করে আমাকে এসে বলল,
‘স্যার, আমাকে নেবে?’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘তুই ক্রিকেট খেলতে পারিস?’
‘স্যার, আমি খুব জোরে বল করতে পারি।’
সাদেক ভাইকে ডাক দিয়ে বললাম,
‘এই আপনার সিক্সথ প্লেয়ার পাওয়া গেছে।’
সাদেক ভাইকে খুব কনভিন্সড মনে হলো না। উনি মাথা চুলকে বললেন,
‘ও রোগা পটকা ছেলে। পারবে?’
আমি হেসে বললাম,
‘ক্রিকেট খেলবেন তো আপনারা। কুস্তী করবেন না। রোগা পটকায় কী হবে?’
তারপর সাদেক ভাই অফিস থেকে আরও জনা দুই খেলোয়াড় খুঁজে বের করল। রহমতের ওপর কেউ ভরসা করতে পারছিল না। ওকে ব্যাক আপ হিসেবে রাখা হলো।
কিন্তু প্র্যাকটিসে সবাইকে তাজ্জব করে দিল।
আউটার স্টেডিয়ামে মূল টুর্নামেন্ট। তার আগে আমাদের দল দু’দিন প্র্যাকটিস করল। আমাকে স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে থাকতে হলো। আমি কিছুতেই যেতে চাচ্ছিলাম না। সাদেক ভাই বললেন,
‘ধুর মিয়া। আমরা এতো আয়োজন করে খেলছি। আপনি খেলার লোক হয়ে না থাকলে হয়!’
গেলাম। গিয়েই রহমতের তাজ্জবটা দেখলাম।
ওকে বল করতে দিল সাদেক ভাই একেবারে শেষ বেলায় এসে। লম্বা একটা রান আপ মেপে দাঁড়াল। এই প্রথম আমি ওকে টুপিটা খুলতে দেখলাম। সাথে সাথে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো— মালিঙ্গা!
কী বৈচিত্র্য!
দৌড়ে গিয়ে হুবহু মালিঙ্গার অ্যাকশনে বল করল। ব্যাটিং করতে থাকা রফিকের পায়ের কাছে বল পড়ে লাফ দিয়ে উঠল। সিলিং অ্যাকশন দেখে সবাই অভ্যস্থ না।
দৌড়ে গিয়ে হুবহু মালিঙ্গার অ্যাকশনে বল করল। ব্যাটিং করতে থাকা রফিকের পায়ের কাছে বল পড়ে লাফ দিয়ে উঠল। সিলিং অ্যাকশন দেখে সবাই অভ্যস্থ না। সাদেক ভাই বলল,
‘আম্পায়ার আবার নো বল বলবে না তো?’
আমি হেসে বললাম,
‘নাহ। এটা বৈধ অ্যাকশন।’
পরের বলটা করল একেবারে পারফেক্ট ইয়র্কার। তছনছ হয়ে গেল রফিকের স্ট্যাম্প।
সাদেক ভাই সাথে সাথে ওকে খেলানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। আমি কিছু বলার আগেই রফিক এসে বলল,
‘এ তো মালিঙ্গার মতো বল করে।’
সেই থেকে রহমতের নাম হয়ে গেল মালিঙ্গা।
তবে নামকরণের সার্থকতা দেখা গেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সেই টুর্নামেন্টে। ফাইনাল পর্যন্ত তিনটে ম্যাচ খেলে রহমত ৪টা উইকেট পেয়েছিল। ফাইনালে বিপক্ষ টিভি চ্যানেলের দলটার ৫ উইকেটে ৩ টাই তুলে নিল সে একা। সেটা ব্যাপার না, ব্যাপার হলো, তিন উইকেট নিল রহমত সত্যি সত্যিই পরপর তিন বলে— হ্যাটট্রিক।
ফাইনাল পর্যন্ত তিনটে ম্যাচ খেলে রহমত ৪টা উইকেট পেয়েছিল। ফাইনালে বিপক্ষ টিভি চ্যানেলের দলটার ৫ উইকেটে ৩ টাই তুলে নিল সে একা। সেটা ব্যাপার না, ব্যাপার হলো, তিন উইকেট নিল রহমত সত্যি সত্যিই পরপর তিন বলে— হ্যাটট্রিক।
প্রথমবার অংশ নিয়েই অফিসের দল টুর্নামেন্ট জিতে ফেলল।
সম্পাদক সবাইকে মোরগ পোলাও খাইয়ে দিলেন। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হওয়া রহমত এক হাজার টাকা পুরষ্কার পেল সম্পাদকের কাছ থেকে।
পরদিন অফিসে এসে রহমতকে ডাক দিলাম,
‘এই রহমত, চা দে।’
রহমত যেন শুনতেই পেল না। দুই বার ডাক দেওয়ার পর জোরে বললাম,
‘মালিঙ্গা, চা দে।’
‘জি স্যার, দেই।’
সে এখন মালিঙ্গা না ডাকলে ডাকও শুনতে পাচ্ছে না। পুরো অফিস কয়েক দিনের মধ্যে তাকে মালিঙ্গা বলেই ডাকতে শুরু করল। এক সময় আমরা ভুলেও গেলাম, এটা ওর আসল নাম না।
ক্যান্টিনে সেদিন নাস্তা করছিলাম। রহমত নিচে দোকান থেকে পরোটা আর ডাল এনে দিয়েছে।
ওকে বললাম,
‘মালিঙ্গা, সত্যিকারের ক্রিকেট খেলবি?’
‘নাহ স্যার। আমার ভয় করে।’
অবাক হলাম। এতো জোরে বল করতে পারা ছেলের ক্রিকেট খেলতে ভয় করে,
‘ক্রিকেট খেলায় তোর কিসের ভয়।’
রহমত সাধারণত বেশি কথা বলে না। আজ প্রথমবারের মতো ওকে একটু মন খুলে কথা বলতে দেখলাম। বলল,
‘স্যার, আমি এক সময় এলাকায় ক্রিকেট খেলতাম। আমার এক বন্ধু মাথায় বল লাইগে মরে গেছিল।’
‘বলিস কী!’
‘হ স্যার। ব্যাটসম্যানের কাছে দাঁড়ায়ে ফিল্ডিং করতেছিল। ব্যাটসম্যান জোরে মারল বল। একেবারে কানের উপর দিয়া লাগল। সেই ধাক্কায় শেষ।’
‘সে তো একটা অ্যাক্সিডেন্ট। ক্রিকেট খেলায় কী আর রোজ এরকম হয় নাকি?’
‘হইতে পারে স্যার। আমার ভয় লাগে।’
‘মরার অ্যাতো ভয় কেন?’
‘স্যার, আমার মরার খুব ভয়। আমি মরলে আমার সংসার দেখবে কেডা?’
আমি কখনো রহমতের সংসারের খোঁজ নেইনি। জিজ্ঞেস করলাম,
‘তোর সংসারে আছে কে কে?’
‘স্যার দুইটা মেয়ে আছে। বৌ আছে। আর বুড়া মা আছে।’
‘বলিস কী! তোর বয়স কতো?’
‘২৮-৩০ হবে।’
‘এর মধ্যে দুই বাচ্চা হয়ে গেছে?’
রহমত শুধু হাসে।
একগাল হেসে বলে,
‘স্যার, এই চাকরিও আর বেশিদিন করব না।’
‘কেন? চাকরি ছেড়ে করবি কী?’
‘বাড়িতে দোকান দেব।’
‘বাড়ি কই?’
‘মানিক নগর।’
‘জায়গা আছে?’
‘হ স্যার। জায়গায় একটা বিল্ডিং তুলতেছি। ওটা হয়ে গেলেই সব ছাইড়ে বাড়ি চলে যাব।’
‘বিল্ডিং তোলার টাকা পাইলি কই?’
আমি স্যার আরেকটা কাম করি। দিনে পত্রিকা অফিসে ডিউটি করি। আর রাইতে সিএনজি চালাই। রাইতে সিএনজিতে ভালো টাকা হয়। বাড়ির পাশের একটা মহাজনের কাছ থেইকা ধারে ইট-বালু-সিমেন্ট লই। সিএনজি চালায়ে তার টাকা শোধ দেই।
‘আমি স্যার আরেকটা কাম করি। দিনে পত্রিকা অফিসে ডিউটি করি। আর রাইতে সিএনজি চালাই। রাইতে সিএনজিতে ভালো টাকা হয়। বাড়ির পাশের একটা মহাজনের কাছ থেইকা ধারে ইট-বালু-সিমেন্ট লই। সিএনজি চালায়ে তার টাকা শোধ দেই।’
রহমতের মতো সুন্দর একটা স্বপ্ন থাকলেও হতো।
অবশ্য রহমতের আরেকটা স্বপ্ন আছে। সেদিন বেশি কথা বলায় সাহসটা পেয়ে গিয়েছিল। বলল,
‘স্যার, আমার একটা আবদার আছে।’
‘বল, কী আবদার?’
‘আমি একবার মালিঙ্গার সাথে দেখা করতে চাই।’
‘তারে কই পাবো এখন?’
‘এহন দরকার নাই। উনি যখন আসবে, তখন।’
কথাটা ওখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু লাসিথ মালিঙ্গার সাথে যখন সত্যিই মাস কয়েক পর দেখা হলো, আমাদের রহমত মালিঙ্গার কথা উঠে গেল।
মালিঙ্গা এবার এসেছিল বিপিএল খেলতে। মাত্রই ইনজুরি থেকে উঠে শ্রীলঙ্কার হয়ে দুটো ম্যাচ খেলেছে। তারপরই বিপিএল খেলতে চলে এসেছে। খুলনার হয়ে খেলছিল। ওর দলেরই কোচ আবার জয়াবর্ধনে।
আমি জয়াবর্ধনের একটা ইন্টারভিউ নেব বলে হোটেলের লবিতে ঘোরাঘুরি করছিলাম। এর মধ্যেই মালিঙ্গার সাথে দেখা হয়ে গেল। কুশল বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করল,
‘তোমাদের রুবেল কেমন আছে?’
একটু মজা পেলাম। রুবেলের খোঁজ করছে হঠাৎ! বললাম,
‘ভালো আছে। মাঠে হয়তো দেখা হয়ে যাবে।’
‘রুবেল শুরুতে আমার মতো সিলিং অ্যাকশনে বল করত, মনে আছে?’
মনে থাকবে না! রুবেলকে নেটে দেখে প্রথম আমিই স্টোরি করেছিলাম— বাংলাদেশের নেটে মালিঙ্গা। তখনও রুবেল আন্ডার নাইনটিন খেলেনি। রুবেলের কথা উঠলে মনে পড়ে গেল মালিঙ্গার কথা।
সত্যিকারের মালিঙ্গাকে বললাম,
‘দ্যাখো, আমার অফিসে একজন মালিঙ্গা আছে।’
‘কী সিলিং অ্যাকশনে বল করে?’
‘শুধু তাই না। তোমার মতো কোকড়া কোকড়া চুল।’
হেসে বলল,
‘এখন আমার মতো রং করিয়ে দাও।’
‘তা দেওয়া যাবে। এখন তুমি বলো, তুমি ওকে একদিন সময় দিতে পারবে?’
‘পারবো না কেন? আমাদের প্র্যাকটিসে নিয়ে আসো যে কোনো দিন। কথা বলা যাবে।’
পরদিন অফিসে গিয়েই রহমতকে ডাকলাম,
‘এই মালিঙ্গা, এদিকে আয়।’
‘স্যার, চা?’
‘নাহ। চা পরে দে। আগে তোর জন্য খবর আছে।’
‘বলেন স্যার। মালিঙ্গারে পাইছেন?’
‘হ। কথা হয়েছে। তোরে সময় দেবে। কাল মাঠে চল।’
মুখটা খুব কালো করে রহমত বলল,
‘স্যার, কাল তো আমার মেয়ের টিকা দিতে হবে। পরশু হলে হয় না?’
‘হয়। পরশু চল।’
সেদিন চা খেয়ে মনে হলো, আজ রহমত বিশেষ যত্ন করে চা বানিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, মনটা খুব ভালো।
অফিস থেকে আসার সময়ও মনে করিয়ে দিল,
‘তাহলে পরশু স্যার।’
এমনকি পরদিন বিকালে আমাকে ফোনও দিল,
‘স্যার, কাল সকালে যাবো তাহলে?’
‘চলে আয়।’
‘স্যার, ঠিক কোহানে যাবো, তা তো চিনি না।’
‘মিরপুর স্টেডিয়াম চিনিস?’
‘জি, স্যার। চিনি।’
‘ওইটার এক নম্বর গেটে চলে আসবি। এসে আমাকে ফোন দিবি। ঠিক এগারোটায় আসবি।’
সকাল আটটায় খুলনার প্র্যাকটিস; ১২টা নাগাদ শেষ হয়ে যাবে। তাই রহমতকে ১১টা সময় দিলাম। আমাকেও একটু আগে আগে ঘুম থেকে উঠতে হবে। তাই আগেই বিছানায় গিয়েছিলাম।
সকাল নয়টায় অফিস থেকে ফোন এলো। বুঝলাম, আজ একটা ঝামেলা হবে। এই সময় ফোন মানে, মিটিং। তার মানে, মাঠে যাওয়া হবে না। সেক্ষেত্রে রহমতকে ‘না’ বলে দিতে হবে। বেচারা!
ফোন রিসিভ করতেই ও পাশে শহীদ ভাইয়ের কন্ঠ,
‘দাদা, সকাল বেলায় একটা খারাপ খবর আছে।’
‘কী, চাকরি চলে গেছে?’
‘না, দাদা। কী যে বলেন!’
‘তাহলে আর খারাপ খবর কী?’
‘আপনাদের ডিপার্টমেন্টের পিয়ন ছিল না মালিঙ্গা?’
‘হ্যাঁ, রহমত। ছিল বলছেন কেন?’
‘ও রাতে সিএনজি এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে।’
আমি চুপ করে রইলাম। কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ও পাশ থেকে শহীদ ভাই বলল,
‘ঢাকা মেডিকেলের মর্গে লাশ রাখা। আপনি কী দেখতে যাবেন?’
কথাসাহিত্যিক, ক্রীড়া সাংবাদিক