আমাদের স্বাধীনতার পর কয়েকটি বছর ধরে তরুণ সমাজের মাঝে যে হতাশা বিরাজ করছিল তা নিয়ে খুব ভালো কথাশিল্প হয়েছে বলা যায় না। তবে দু-চারজন গল্পকার সে-সময়ের নাগরিক সমাজের চিত্র কিছুটা আঁকার চেষ্টা করেছেন। কবি মুস্তাফা মহিউদ্দীন সে-সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কয়েকটি সাহিত্যিক আড্ডার চিত্র একটু ভিন্নভাবে আঁকার চেষ্টা করেছেন তাঁর বন্ধুদের স্মৃতি নির্ভর করে। কমলকুমার মজুমদারের একটি বিখ্যাত লেখার একটি পঙ্ক্তিকে একটু বদলিয়ে লেখাটার নাম রেখেছেন ‘কিছু মায়া রয়ে গেল’! বইটি শীর্ণকায়। কিন্তু কেন যেন বইটি বেশ কিছুদিন ধরে মাঝে মাঝে পড়ি, তার কারণ শুধু যে এই লেখকের ভাষা বা স্মৃতিতর্পণের মাঝে জড়িয়ে থাকা কিছু মমতামাখারেণু তাই নয়, আমার মনে হয় যাদের বয়স এখন সত্তর বা তার এদিক ওদিক তারা কেউ এ বইটির গভীর অন্তঃস্রোতে একটা তীর তীরে বেদনা-ধরা দীর্ঘশ্বাস অনুভব করবেন। আমি বার বার করেছি। পড়তে বসে কখনোই দুচার পাতার বেশি পড়তে পারিনি, নিজের অজান্তে অনেকগুলো ছবি মনটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ’৭৩ সালের জুলাই থেকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কিন্তু এই বইয়ের লেখক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন সত্তর সালের মাঝামাঝি। যদিও আমার দু-বছরের জ্যেষ্ঠ তিনি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কারণে আমাদের সামান্য কিছুটা সময় পেরিয়ে আইএসসি পরীক্ষা শেষ হয়, ভর্তি হতে হতে আরও কিছুটা সময় চলে যায়। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কথা ছিল বিজ্ঞান, কিন্তু আমি পড়েছিলাম মানবিক বিভাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতেই কয়েক বন্ধুর প্ররোচনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ওখানেই চলে যাই, সেটা একেবারে ভিন্ন কারণ। অন্য সময় লেখা যাবে, বা কিছুটা আগে লিখেছিও।
তাই বলা যায় ’৭৩ সালের জুলাই থেকেই আমি প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি পাড়ায় স্থায়ী এক আড্ডার সদস্য। বইটি পড়তে গিয়ে সে-সময়ে যারা রোকেয়া হলের উল্টোদিকের গেট থেকে একেবারে লাইব্রেরির উত্তর দিকের মসজিদের পাশের ছাপরার চায়ের দোকান, শরীফ মিয়ার দোকান, আফসার মিয়ার চায়ের দোকান, মধুর ক্যান্টিনের আশপাশ এলাকায় বা ছড়িয়ে থাকা ঝাল মুড়ির বা সিগারেটের দোকানগুলো ঘিরে যে কয়েক ডজন স্থায়ী মুখের ছবি আমার স্মৃতিতে ভাসছে, তাঁদের সবার কথা মনে পড়ছিল আর চোখ ভিজে আসছিল। আমার খাতা কলমে ততদিনে নাম রয়েছে জাহাঙ্গীরনগরে, কিন্তু আমি কখনোই সেখানে যাই না! সারাদিন লাইব্রেরি পাড়ায় আড্ডায়, কখনো বন্ধুরা অন্য বিভাগের ক্লাসে গেলে তাদের সঙ্গে গিয়ে তাদের ক্লাসে বসি, নয়তো লাইব্রেরির ভেতরে রেফারেন্স সেকশনে আলমারি থেকে বই নিয়ে নিজের আনন্দে পড়ি! দুপুরে সামান্য কিছু খেয়ে নিই টিএসসিতে নয়তো অন্য কোনো সস্তা দোকানে। বন্ধুদের কেউ কেউ হলে দুপুরে গেলে খুব কদাচিৎ তাদের সঙ্গে গিয়ে সূর্য সেন হলের সামনের ক্যান্টিনে খাবার কিনে খাই। এরপর সবাই হলে ঘুমুতে যায়, আমি লাইব্রেরিতে বা ব্রিটিশ কাউন্সিলে ঘণ্টা কয়েক অবিরাম পড়ি। দিনের এই পড়াটুকুই আমার সবচেয়ে প্রিয় সময়। যদিও ষাটের দশকের মাঝামাঝি ও শেষের দিক থেকে আমি ব্রিটিশ কাউন্সিলের নিয়ম করা বই গ্রাহক, পাঠক, সেই আমার কলেজিয়েট স্কুলের দিনগুলো থেকে। কিন্তু আমি সবচেয়ে বেশি সময় এই লাইব্রেরিটিতে কাটিয়েছি ’৭২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ‘৮৩ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। এমন একটা সময় ছিল আমার চোখের সামনে সাহিত্য, ইতিহাস ও দর্শনের বইয়ে ঠাসা আলমারিগুলোর কোন তাকে কোন বই রয়েছে, তাও মনে ভেসে উঠত। তাই মুস্তাফা মহিউদ্দিন এই বইয়ে যাঁদের কথা লিখেছেন তাঁরা কোন সময়টাতে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি বা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে ঢুকতেন তাও আমি জানতাম। বইটি পড়তে পড়তে সে-সব স্মৃতির প্রতিটি অণুকণা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। মুস্তাফা ভাইয়ের সহপাঠী ও বন্ধুদের অনেকে আমার ভীষণ প্রিয় মানুষ, প্রিয় লেখক। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আমিনুল ইসলাম ভুঁইয়া, আখতারুল হক, শিহাব সরকার ও মাসুদ ভাই। এই চারজন সহপাঠী ইংরেজি বিভাগে এবং বর্তমানে দেশের নামকরা লেখক। আখতার ভাই কম লিখেছেন, সারা জীবন ইংরেজি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেই কাটালেন। যদিও তাঁর মজ্জায় রয়েছে রাজনীতি, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষদের কল্যাণের রাজনীতি। ভুঁইয়া ভাইও মুস্তাফা ভাইয়ের সঙ্গে সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়েছেন, শিহাব ভাই শুধুই কবিতা লিখেছেন, জীবিকার জন্য ইংরেজি পত্রিকায় সাহিত্য সাময়িকীর পাতা সম্পাদনা করেছেন সারা জীবন! মাসুদ ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক। সহপাঠী বন্ধুদের কথা ছাড়াও বইটিতে সত্তর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আড্ডায় যারা যোগ দিতেন মূলত তাঁদের নিয়ে স্মৃতিই বিবৃত হয়েছে।
এরপর সবাই হলে ঘুমুতে যায়, আমি লাইব্রেরিতে বা ব্রিটিশ কাউন্সিলে ঘণ্টা কয়েক অবিরাম পড়ি। দিনের এই পড়াটুকুই আমার সবচেয়ে প্রিয় সময়। যদিও ষাটের দশকের মাঝামাঝি ও শেষের দিক থেকে আমি ব্রিটিশ কাউন্সিলের নিয়ম করা বই গ্রাহক, পাঠক, সেই আমার কলেজিয়েট স্কুলের দিনগুলো থেকে। কিন্তু আমি সবচেয়ে বেশি সময় এই লাইব্রেরিটিতে কাটিয়েছি ’৭২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ‘৮৩ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। এমন একটা সময় ছিল আমার চোখের সামনে সাহিত্য, ইতিহাস ও দর্শনের বইয়ে ঠাসা আলমারিগুলোর কোন তাকে কোন বই রয়েছে, তাও মনে ভেসে উঠত। তাই মুস্তাফা মহিউদ্দিন এই বইয়ে যাঁদের কথা লিখেছেন তাঁরা কোন সময়টাতে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি বা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে ঢুকতেন তাও আমি জানতাম।
‘কিছু মায়া রয়ে গেল’ শুরু হয়েছে দেড় পাতার লেখা ‘চলো উজানে, রেখায়নে’ দিয়ে। লেখাটায় স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার তরুণ সৃজনশীল লেখক শিল্পী কবি সাহিত্যিকদের আড্ডাটা কোথায় এবং কেমন ছিল তার বয়ান রয়েছে। শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন, আবসার মিয়ার চায়ের দোকানে যে সকল লেখকরা জড়ো হতেন আড্ডায়, তাঁদের প্রায় সবারই প্রতিকৃতি আঁকা রয়েছে এই বইয়ের পাতায় পাতায়। কিন্তু প্রথম ক্ষীণকায় প্রবন্ধটিতে বিশেষ করে উল্লেখ রয়েছে ‘রেখায়ন’ নামক একটি লেখক শিল্পীদের নিয়মিত আড্ডার জায়গা সম্পর্কে। লেখক মুস্তাফা মহিউদ্দীন লিখেছেন, ‘কোথায় রেখায়ন? আজকের প্রজন্মকে চেনানো খুব কষ্টকর। যারা বর্তমানের আজিজ মার্কেট আর পিজির এক্সটেনশন দেখে অভ্যস্ত তারা ভাবতেও পারবেন না যে শাহবাগ মার্কেট পার হয়ে ছিল কিছু টিনশেড দোকান। পাপ্পুর রেস্টুরেন্ট নামে ছিল একটি চালু হোটেল। শেষ মাথায় ছিল সাইনবোর্ডের দোকান ‘রেখায়ন’। পুরোনো একটি টেবিল, হাতলওয়ালা একটা কাঠের চেয়ার। দোকানে একটা হার্ডবোর্ডের পার্টিশন, সামনে বসার ঘর আর পেছনে পার্টিশনের আড়ালে বিভিন্ন তৈজসপত্র, রঙের কৌটা ও বিভিন্ন নেমপ্লেট, টিনের ওদিকে ঢোকা হতো না। সামনের অংশে হাতলওয়ালা মূল চেয়ারে বসে থাকত কালো, লিকলিকে লম্বা চুলের, খদ্দরের লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি পরা রাগীব আহসান। চোখে পুরু লেন্সের কালো চশমা, সামনে ঝকঝকে দুটো দাঁত একটু সামনের দিকে বেরোনো। এই রাগীবই ছিল রেখায়নের প্রাণভোমরা। তাকে ঘিরেই যত আড্ডা, কিন্তু সে থেকেও যেন নেই। সবাই মনে করত রেখায়নটা যেন তার নিজের।’
এভাবেই কবি মুস্তাফা মহিউদ্দীন তাঁদের শিল্প ও সাহিত্যের বিখ্যাত ‘সেলন’ রেখায়নের বর্ণনা দিয়েছেন। সত্তর দশকে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, ছিলেন সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক, শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা বা সংগীত শিল্পী, এমন খুব কম মানুষ আছেন যারা সেখানে আড্ডায় দিনের কোনো একটা সময় যেতেন না, বা দুচার মিনিট চা সহযোগে আড্ডায় সামিল হতেন না! এছাড়া পঞ্চাশের বা ষাটের বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের অনেকেই সেখানে বাড়ি ও কর্মস্থলে আসা যাওয়ার পথে বাহন থামিয়ে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে যেতেন। এমনকি তরুণদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ, চিঠি বা জরুরি জিনিসপত্র রেখে যাওয়ার মেইলবক্স হিসেবেও বিবেচিত হতো রেখায়ন। বহুদিন গ্রামের বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা বাউণ্ডুলে কবি ও চিত্রকরের ফেলে আসা উদ্বিগ্ন মায়ের চিঠি এসে অপেক্ষা করত রেখায়নে।
লেখক লিখেছেন, ‘কবে কখন রেখায়নের আড্ডায় জড়িয়ে গেলাম এখন স্পষ্ট মনে পড়ছে না। তবে যদ্দুর মনে পড়ে শওকতই নিয়ে গিয়েছিল। শওকত রেখায়নের রাগীবের চাচাতো ভাই। পড়ত রসায়ন শাস্ত্র, লিখত কবিতা।’ আজকের অবসরে যাওয়া সার্বক্ষণিক লেখক শওকত আহসান ফারুক সে-সব দিনে ছিলেন অন্য বন্ধুদের মতোই টগবগে তরুণ, রাজনীতিতে মুহ্যমান, ততোধিক মুহ্যমান সাহিত্যে! বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের হলের ‘১৪৬ নম্বর কক্ষ’ নিয়ে একটি অসাধারণ স্মৃতিচারণ লিখেছেন। শওকত ভাইয়ের কবিতা বা গদ্য ভীষণ আকর্ষণীয়। তাঁর লেখা রাজনীতিমনস্কতাপুষ্ট, কিন্তু শিল্পমূল্যের দিক থেকে উঁচু সৌন্দর্যমণ্ডিত। রেখায়নের আড্ডার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বন্ধুগোষ্ঠীর এক ঝাঁক লেখক আমার প্রিয় লেখক। তাঁদের মধ্যে আমিনুল ইসলাম ভুঁইয়া, শিহাব সরকার, সাইয়ীদ মনোয়ার, শওকত আহসান ফারুক, মুস্তাফা মহিউদ্দীন, আবিদ আজাদসহ বেশ কয়েকজনের নাম আগেই উল্লেখ করেছি। সম্ভবত সমকালীন ও চিরায়ত সাহিত্যে এঁদের গভীর পাঠ ও মুক্তিযুদ্ধ উত্তরকালীন এক ঝড়ো সময়ের গভীর রাজনৈতিক সমাজবীক্ষা থাকার কারণেই এই তরুণদের লেখায় ভিন্ন সৌন্দর্য পরিলক্ষিত হতো, যা আজও পাঠককে মুগ্ধ করে।
রেখায়নের মতোই অনেক তরুণের ঠিকানা ছিল শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন। কবি মুস্তাফা মহিউদ্দীন তাই হয়তো এই অধ্যায়টির শিরোনাম রেখেছেন ‘আমাকে যদি পেতে চাও এসো শরীফের ক্যান্টিনে’! অনেক বোহেমিয়ান কবি শিল্পী তরুণের একমাত্র ঠিকানা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই ক্যান্টিন। আড্ডার, সামাজিকতা করার, এমনকি ক্লান্ত দুপুরে সিগারেটের খালি প্যাকেটর উল্টো দিকের নগ্ন গায়ে কবিতা লেখার জায়গাও ছিল এই ক্যান্টিন। লেখক এই ক্যান্টিন সম্পর্কে বলতে গিয়ে যারা সেখানে জড়ো হতেন তাঁদের বর্ণনা দিয়েছেন কিছুটা শিল্পীর তুলির ভাষায়, ‘আমাদের সেই যুদ্ধোত্তর নড়বড়ে সময়ে নির্মল’দা (কবি নির্মলেন্দু গুণ) ছিলেন উঠতি তরুণ কবিদের কাছে অনুসরণীয় বোহেমিয়ান চরিত্র। কালো ছিপছিপে দীর্ঘাঙ্গী যুবক, একমাথা ঝাঁকড়া লম্বা কালো চুল, মাঝে মধ্যে বিনুনি করা এবং জীবন-যাপনে পুরোপুরি অগতানুগতিক নির্মল’দার ছিল যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে চলার অসাধারণ ক্ষমতা!’ কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুক ও রসিকতা গুণের কথাও লেখক উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন কবি মাসুদ আহমেদ মাসুদ ‘প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অর্ধ-উন্মাদ ও মানসিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত, তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, মাসুদ, তুমি এক কেসেই কুপোকাত? এইরকম কত কেইস যে আমাগো বগলের তলা দিয়া, উরুর নিচ দিয়া, কানের পাশ দিয়া চইলা গেল, আমাগো তো কিছুই হয় না! ধুর মিয়া, তুমি তো দেখি দুবলা কবি!’ সত্যিই জীবনকে ‘খুব হাল্কাভাবে নেয়ার ও প্রচণ্ড রসবোধ দিয়ে জীবনকে উপভোগ করার এক অদম্য প্রাণশক্তি ছিল গুণ’দার।’ দক্ষ শিল্পীর তুলিতে অসাধারণ জীবন্ত এক চিত্র এঁকেছেন লেখক কিংবদন্তী কবি নির্মলেন্দু গুণের!
কবি মাসুদ আহমেদ মাসুদ ‘প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অর্ধ-উন্মাদ ও মানসিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত, তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, মাসুদ, তুমি এক কেসেই কুপোকাত? এইরকম কত কেইস যে আমাগো বগলের তলা দিয়া, উরুর নিচ দিয়া, কানের পাশ দিয়া চইলা গেল, আমাগো তো কিছুই হয় না! ধুর মিয়া, তুমি তো দেখি দুবলা কবি!’ সত্যিই জীবনকে ‘খুব হাল্কাভাবে নেয়ার ও প্রচণ্ড রসবোধ দিয়ে জীবনকে উপভোগ করার এক অদম্য প্রাণশক্তি ছিল গুণ’দার।’ দক্ষ শিল্পীর তুলিতে অসাধারণ জীবন্ত এক চিত্র এঁকেছেন লেখক কিংবদন্তী কবি নির্মলেন্দু গুণের!
এছাড়া সত্তর দশকের শুরুর দিক থেকে কয়েক বছর একজন সত্যিকার বোহেমিয়ান তরুণ কবি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, তাঁর নাম সাবদার সিদ্দিকী। তাঁর জীবনাদর্শ থেকে পোশাক পরিচ্ছদ, ভাষা, সংস্কৃতি ও সবকিছুই ছিল সত্যিকার একজন উনমূল মানুষের। সারাক্ষণ তিনি ক্যাম্পাসেই কাটাতেন, তাঁর কোনো স্থায়ী আবাস সম্ভবত ছিল না। বাবা মা সম্ভবত খুলনা বা কলকাতায় ছিলেন। কোনো জীবিকা বা আয়ের উৎস ছিল না, জীবনকে দেখেছিলেন আলবেয়ার ক্যামুর ‘আউটসাইডারের’ আদর্শে। জীবনের মূলে ছিল ‘Meaninglessness বা Hollowness’ এর দুশ্চিকিৎস্য সংকট! অনেকটা যেন সেই জীবনের প্রতীক বোদলেয়ারের সমকালে প্যারিসে যাকে বলা হতো ‘ড্যানডিইজম’ এর প্রতিনিধি। লেখক মুস্তাফা মহিউদ্দীন এই কবিকে এঁকেছিলেন এই ভাষায়, ‘কিন্তু আমার দেখা সত্যিকারের জাত বোহেমিয়ান ছিলেন কবি গোলাম সাবদার সিদ্দিকী। তার পাটের ছালা দিয়ে তৈরি কোট পরিধান, ক্যাম্পাসে নিউজ প্রিন্ট বিছিয়ে ঘুমানো, মদ্যপান থেকে আফিমসহ হেন নেশা ছিল না যা তিনি করতেন না। জীবনকে নিয়ে এরকম খেলেছেন তিনি। একমাত্র সিনসিয়ার ছিলেন পরীক্ষাধর্মী কাব্যচর্চায়। আর সবকিছুই ছিল তার কাছে গৌণ। প্রচলিত সমাজকাঠামোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আত্মবিধ্বংসী খেলায় যেন মেতে উঠেছিলেন সাবদার ভাই। শেষতক বেশি দিন বাঁচেননি। ঝরে গেছেন নীরবে।’
এছাড়া এই আড্ডায় ছিলেন শক্তিশালী কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম, ফিউরি খন্দকার। কবি রফিক আজাদ মধ্য ষাটে এমএ পরীক্ষা দিয়ে চলে যান টাঙ্গাইলে একটি কলেজে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে। গভীর হতাশা তাঁকে গ্রাস করেছিল, প্রায় পাঁচ বছর তিনি কলেজ থেকে বেতন গ্রহণের সময় স্বাক্ষর করা ছাড়া কলমের নিব খোলেননি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়। তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। শুধু কবিতা লিখবেন বলেই এই ফিরে আসা। কবি রফিক আজাদ সম্পর্কে মুস্তাফা মহিউদ্দীন লিখেছেন, ‘রেখায়নে ঝটিতি আড্ডা দেয়া প্রয়াত কবি রফিক আজাদ ছিলেন চলনে বলনে ‘রাফ এন্ড টাফ’, তবে ভেতরে তার অন্তরটা ছিল সাদা ক্যানভাসের মতো। কোনো ভণিতা পছন্দ করতেন না। যেকোনো অপ্রিয় কমেন্ট করতে দ্বিধা করতেন না তিনি। অবলীলায় বলে দিতেন। …প্রায়ই খিস্তি-খেউর করা কবি রফিক ভাই জানান, কলেজে ছাত্রদের কাছ থেকে স্যার সম্বোধন আর শ্রদ্ধা দেখতে দেখতে তিনি বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। তাই মাঝে মাঝে গভীর রাতে কলেজের নির্জন মাঠে গিয়ে একা একা চীৎকার করে গালিগালাজ করতেন। বুঝলা, এইটা করে কিছুদিন আমি মনে শান্তি এনেছিলাম।’ কবিদের, বিশেষ করে ষাটের আধুনিক কবিদের মনোজগৎ বোদলেয়ারের কবিতা ও ডানডিইজম দ্বারা কেমন প্রভাবিত হয়েছিল তা রফিক আজাদের সে-সময়ের বা ষাটের মাঝামাঝির জীবনাচার দেখলে কিছুটা বোঝা যেত।
এরপর লেখক সত্তর দশকের গোঁড়ার দিকে শাহবাগের দুপুরগুলোর একটা চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। অধিকাংশ দিনই দুপুরের দিকে শাহবাগের বিপণিবিতানগুলোতে খুব নিরিবিলি শুনসান অবস্থা বিরাজ করত। এমনিতেই সেখানে বনেদী ধনী মহিলারা বাজার করতেন, অধিকাংশই বিদেশী প্রসাধনী। কিন্তু দুপুরের দিকে খুব সামান্য সংখ্যক খদ্দের দেখা যেত। শুধুমাত্র মৌলীর দোতলায় আলো-আঁধারি পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ তরুণীরা নিরিবিলি প্রেম করতেন। কিন্তু মুস্তাফা মহিউদ্দীন যেহেতু সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আবাসিক ছাত্র ছিলেন খাতা কলমে, বৃত্তির টাকা তোলার শর্ত হিসেবে, তাই থাকতেন না হলে। দুপুরে বাসায় না ফিরে শাহবাগে কিছু বার্গার জাতীয় কুইক লাঞ্চ করে তিনি ‘জিরাজ’ আর্ট গ্যালারিতে চলে যেতেন। সেখানে বসতেন ‘জিরাজের’ মালিক আফতাব সাহেব। তিনি বিখ্যাত নাট্যকার ও আমলা সাইদ আহমেদের ভাই। ছিলেন পাকিস্তান রেডিও সংবাদ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। শিল্পী হামুদুর রোমানের ভাই, তাই আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের অধিকাংশ বড়ো মানুষদের চিনতেন। ভীষণ রসিক ও সুদর্শন ছিলেন এই আফতাব আহমেদ। আমার সঙ্গে আফতাব আহমেদের পরিচয় হয় ৭৩-৭৪ সালের দিকে। এই পরিচয় হয়েছিল যতদূর মনে পড়ে নাট্যকার, কথাশিল্পী ও আফতাব ভাইয়ের সহকর্মী আরেক রেডিও সংবাদের বড়ো কর্মী আনিস চৌধুরীর মাধ্যমে। ছাত্রজীবন থেকে আনিস চৌধুরীকে চিনতাম তাঁর লেখা পড়ে, এবং জানতাম তিনি রেডিওতে সংবাদ বিভাগে কাজ করেন। চাকরি জীবনে আমি আনিস চৌধুরীকে বেশ কিছুদিন টেলিভিশন নিউজে উপমহাপরিচালক হিসেবে পাই। সরাসরি তাঁর অধীনে কাজ করি। ছাত্রজীবনের সম্পর্কটি নতুন করে ঘনিষ্ঠতা লাভ করে। মনে পড়ে রেডিওর একজন বন্ধুর মাধ্যমে আনিস ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, বয়সের বিপুল পার্থক্যকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে তিনি একেবারে বন্ধুর মতো আচরণ করতেন। সিগারেট ও পানীয় অফার করতেন। তাঁর ধানমণ্ডির বাসভবনে অনেকদিন সন্ধ্যায় আমি তাঁর পানের সঙ্গী হয়েছি। তিনি সাহিত্য ও রাজনীতি নিয়ে বিরামহীনভাবে স্মৃতিচারণ করে যেতেন। এই আনিস ভাইই আমাকে ‘জিরাজে’ প্রথম নিয়ে গিয়ে আফতাব ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আফতাব ভাই ও আনিস ভাই দুজনেই অনেকদিন করাচী রেডিওতে পোস্টেড ছিলেন এক সময়ে। সে-সব দিনে করাচীর নৈশজীবন সম্পর্কে দুজনেই অনেক আদিরসাত্মক গল্প শোনাতেন।
মুস্তাফা ভাইয়ের এই অধ্যায়ের বর্ণনা পড়তে গিয়ে আফতাব ভাইয়ের স্মৃতি মনে পড়ে গেল। তিনি আমার ছাত্রজীবনে তাঁর গ্যালারিতে গেলে দামী বিস্কুটসহ চা খাওয়াতেন। তবে শাহবাগে প্রায় প্রতিদিন দেড় দশকের কাছাকাছি সময় ‘সিনোরিটা’তে আড্ডা দিলেও আফতাব ভাইয়ের গ্যালারিতে কম যেতাম। আফতাব ভাই সম্পর্কে বলতে গিয়ে মুস্তাফা ভাই জীবনের কিছু মূল্যবান সিদ্ধান্তের বিষয়ে আফতাব ভাইয়ের বাস্তববুদ্ধির প্রশংসা করেন। হয়তো তরুণ বয়সে বিষয়গুলো খুব একটা বোঝা যায় না। সময়ের দীর্ঘ পরিসরে যে সব নতুন বিচারবুদ্ধি জীবনকে প্রাজ্ঞ করে তোলে তাতে এসব বাস্তব জ্ঞান খুব কাজে দেয়।
মুস্তাফা ভাই এমএ পড়ার সময় রেডিও নিউজে খণ্ডকালীন অনুবাদকের কাজ নেন। তখন আফতাব ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রেডিও ও টেলিভিশন নিউজে একটা বিষয় প্রায় পশ্চিমা সমাজের মতো। সময়ের কাজ একেবারে মিনিট সেকেন্ড ধরে করা। আটটার সংবাদ আটটার এক মিনিট পরেও দেয়া সম্ভব নয়, তাই যারা রেডিও বা টেলিভিশনে কাজ করতেন সে-সব দিনে তারা ভীষণ সময়ানুবর্তী ডিসিপ্লিনড মানুষ হতেন। আফতাব ভাইও তেমন সময়ানুবর্তী মানুষ। এ বিষয়ে কোনো আপসই সেকালের রেডিও সংবাদকর্মীরা অনুমোদন করতেন না। দুপুরে ‘জিরাজে’ আফতাব ভাইকে পেলে মুস্তাফা ভাই খুব খুশি হয়ে গল্প করতেন। আফতাব ভাই তাকে চা ও বিস্কুট সহযোগে আপ্যায়ন করতেন। মুস্তাফা ভাই লিখেছেন, ‘আমি তখন ছাত্রত্ব পার না হওয়া এক তরুণ আর তিনি চাকুরীর শেষভাগে চলে যাওয়া এক পৌঢ়। তিনি আমাকে ক্যারিয়ার প্ল্যানিং এবং নারী ও প্রেমের অনুষঙ্গ নিয়ে, আমরা ইনফরমাল হওয়ায়, কিছু কথা আমাকে বলেছিলেন, যা আমার কাছে তখন গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। আজ তিনি বেঁচে নেই, আর আমার ষাটোর্ধ্ব বয়সে মনে হয়, হায়, কী যথার্থ কথা তিনি বলেছিলেন, আমি কেন তাঁর কথা বুঝতে ভুল করলাম? কেন ক্যারিয়ার নির্বাচনে আর রমণীদের ক্ষেত্রে তাঁর উপদেশ নিলাম না!’
এই অধ্যায়ে শাহবাগের নীরব দুপুরের বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক তাঁর আরেকজন শিল্পী-বন্ধুর কথা মনে করিয়ে দিলেন যিনি ছিলেন আমাদের কৈশোর-উত্তীর্ণ সময়ে অত্যন্ত প্রিয় গল্পকার সৈয়দ আহমাদ তারেক। তিনি ভালো গল্প ও কবিতা লিখতেন, কিন্তু তিনি যে ভালো ছবি আঁকতেন তা আমরা অনেকেই জানতাম না। ‘রেখায়ন’-এ বসে বসে নীরবে সে-সব দুপুরে ছবি আঁকতেন বিভিন্ন কার্ডের ওপর, যা ঈদে বা পহেলা বৈশাখে বিক্রি হতো। অধিকাংশ কার্ডে ছবির সঙ্গে কবিতার পঙ্ক্তি থাকত, তাঁর মুক্তোর মতো সুন্দর হাতের লেখায়। সে-সব পঙ্ক্তি অধিকাংশই থাকত সুনীল বা শক্তির জনপ্রিয় কবিতাগুলো থেকে! সত্তর দশকের পর পরই সৈয়দ আহমাদ তারেক নিজের বাড়ি কুমিল্লায় ফিরে যান। হয়তো লেখেন মাঝে মাঝে, কিন্তু আমরা পাঠকরা তাঁর কথা একেবারে বিস্মৃত হয়ে আছি!
এই বইতে লেখক কবি মুস্তাফা মহিউদ্দীন বাংলা ভাষার উজ্জ্বল লেখক শিল্পীদের নিয়ে স্মৃতি-তর্পণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ও মননশীল লেখক আহমদ ছফা। তাঁর মৃত্যুর এতদিন পরও তাঁকে নিয়ে আমাদের লেখকরা অনেক আলোচনা করেন। তিনি স্বাধীনতার পর পর আমাদের সমাজে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পাবলিক ইনটেলেকচুয়াল। সত্যিকার বুদ্ধিজীবীর যে-ভূমিকা থাকা প্রয়োজন, অর্থাৎ নিয়মিত শক্তি বা ‘প্রতাপকে’ ক্রিটিক করা, রাষ্ট্রের অনাচার বা বেআইনি দুরাচারী স্বভাবকে বিরামহীন আঘাত করে যাওয়া, তার অনেকটাই আহমদ ছফা করেছেন। তিনি ছিলেন স্বাধীন লেখক, পেশা হিসেবে বা জীবিকা বা আয়ের একমাত্র উৎস ছিল তাঁর লেখা বা মননচর্চা। তাঁর লেখা নিয়ে অনেকের সমালোচনা থাকতে পারে, কিন্তু তিনি রাষ্ট্র বা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দাক্ষিণ্যে বেঁচে ছিলেন না। একমাত্র জার্মান বা লিবিয়া সরকার দূতাবাসের আনুকূল্যে সামান্য কিছু কাজ অর্থের বিনিয়ে করে দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। তবে দীর্ঘ প্রায় ছয় দশকের জীবনে তা একেবারেই কিঞ্চিৎ সময়ের বিষয়। কিন্তু তাঁর সমাজচিন্তা ছিল প্রখরভাবে দায়িত্ববান বুদ্ধিজীবীরই বলা যায়! তাঁর জীবন ও সৃষ্টিকর্ম নিয়ে গত প্রায় দুই দশক ধরে অবিরাম লিখে ও বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। আহমদ ছফাকে বুঝতে বা তাঁর সময়ের চিন্তা ও সমাজকে বুঝতে অধ্যাপক খানের একাধিক গ্রন্থ রচনা ও বক্তৃতাগুলো বিশেষভাবে সহায়ক। লেখক মুস্তাফা মহিউদ্দীন লিখেছেন, ‘তাঁর উপস্থিতি রেখায়নে আড্ডারত তরুণ লেখক-কবিদের ভেতর অন্য এক আবহ সৃষ্টি করত। তাঁকে সবাই শ্রদ্ধা ও সমীহ করত। … পোশাক-পরিচ্ছদ বিষয়ে ছিলেন উদাসীন। চলাফেরা ও কার্যকলাপে তাঁর একান্ত নিজস্ব আচরণ (idiosyncrasy) কাজ করত। … তবে তাঁর চূড়ান্ত অবশেসন ছিল সংগীতে। তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীতের অনুরাগী ছিলেন।’
সংগীত ছাড়া চিত্রকলা নিয়েও তাঁর এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করত সব সময়। আজ বাংলাদেশের বৌদ্ধিক সমাজের প্রায় সকলেই জানেন শিল্পী এস এম সুলতানকে দিয়ে তিনি অনেকগুলো ছবি আঁকিয়েছিলেন এবং এই শিল্পীকে নিয়ে অসাধারণ একটি প্রবন্ধ তিনি রচনা করেছিলেন। এর ফলে প্রায় কয়েক দশকের নীরবতার পর এস এম সুলতানের একটি জাতীয় পর্যায়ের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় ঢাকায় এবং এর পেছনে প্রধান প্রাণপুরুষ ছিলেন আহমদ ছফা। ব্যক্তি ছফাকে নিয়ে মুস্তাফা মহিউদ্দীন লিখেছেন, ‘ছফা ভাই আমার ও আমার মতো অনেকের নমস্য ছিলেন। এরকম স্নেহবৎসল, স্পষ্টবাদী এবং সর্বক্ষণ মুক্তচিন্তা নতুন বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্নে বিভোর লোক আমি কমই দেখেছি। আদর্শবাদ ও প্রগতিশীল সংস্কৃতির ধ্বজাধারী ছফা ভাই প্রগতিশীল মানবিকতার মহান আদর্শে নতুন প্রতিভাবান প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধকরণে সচেষ্ট থাকতেন। …ছফা ভাই ছিলেন জার্মান কবি গেটের একনিষ্ঠ ভক্ত। গেটের কালজয়ী গ্রন্থ ‘ফাউসট’ (প্রথম খণ্ড) এর অনুবাদ তিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে করেছিলেন। মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন আমাদের বন্ধু রেখায়নের কর্ণধার রাগীব আহসান। ছফা ভাই রাগীবকে প্রচ্ছদের দায়িত্ব দিলে রাগীব প্রচ্ছদ করে ছফা ভাইকে দেখালে তিনি ধীরে সুস্থে চা খেতে খেতে অনেকক্ষণ প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপরে একটানে প্রচ্ছদটা ছিঁড়ে ফেলে বললেন, আবার করো। এভাবে ছফা ভাই রেখায়নে আসেন, চা খান, রাগীব প্রতিবারই তাঁকে নতুন প্রচ্ছদ দেখায় আর তিনি তা ছিঁড়ে ফেলেন। তেরোটি প্রচ্ছদ ছিঁড়ে ফেলার পর চৌদ্দবারের প্রচ্ছদের সময় রাগীব ভয়ে ভয়ে বলল, ছফা ভাই, এটা খসড়া যদি আপনার মনঃপুত হয়, তবেই এর ওপর আরও কাজ করব। ছফা ভাই অনেকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেন খসড়া প্রচ্ছদের দিকে, তারপর মৃদু হেসে বললেন, খসড়া না, এটাই ফাইনাল। তুমি শুধু আমার নামটা সুন্দর করে লিখে দাও। এরকম একই সঙ্গে নিখুঁতপিয়াসী (Perfectionist) ও হেঁয়ালিপূর্ণ ছিলেন ছফা ভাই।’
ব্যক্তি আহমদ ছফার হেঁয়ালিপূর্ণ মন ও গভীর দরদী হৃদয়ের এই বর্ণনা লেখক দিয়েছেন একেবারে নিখুঁতভাবে!
মুস্তাফা মহিউদ্দীনের এই বইয়ের অত্যন্ত মূল্যবান লেখা দুজন কবি সম্পর্কে। তাঁরা দুজনেই আমার সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ। একজন কবি আবিদ আজাদ ও অন্যজন মুস্তাফা আনোয়ার। তিনি ছিলেন এক নীরব মানুষ। ’৭১ সালে ২৫ ডিসেম্বরের পাকবাহিনীর আক্রমণের পর যে তিনজন রেডিও কর্মকর্তা মিলে জীবন বাজী রেখে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র চালু করেন তিনি তাদের একজন। বাকী দুজন ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ ও আবুল কাশেম সন্দীপ। এই কবি এতটাই স্বল্পভাষী ছিলেন যে আড্ডায় তাঁর উপস্থিতি কম বোঝা যেত। কিন্তু তিনি খুব মনযোগী শ্রোতা ছিলেন। শাহবাগ রেডিও অফিস থেকে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে হেঁটে হেঁটে এসে যোগ দিতেন, অনেক সময় সঙ্গে থাকত কেউ কেউ। বেশির ভাগ সময় কবি আবিদ আজাদ ও আবদুল মান্নান সৈয়দ। মুস্তাফা মহিউদ্দীন লিখেছেন, ‘মুস্তাফা আনোয়ারকে আমি প্রথম দেখি শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে সম্ভবত ১৯৭৩ কি ১৯৭৪ সালে এক বিকেল বেলা। পাশে ছিল প্রয়াত কবি আবিদ আজাদ। আবিদ পরিচয় করিয়ে দিলো─এই হচ্ছে মুস্তাফা আনোয়ার। রেডিওতে অনুষ্ঠান প্রযোজক। আমি চেয়ে দেখলাম ফর্সা টকটকে ভরাট মুখ। ভারী গুল্ফরেখা দুপাশে কিছুটা ঝোলানো। কালো-লালচে মিশেলে ঘন কোঁকড়া চুল, ব্যাকব্রাশ করা প্রায়-কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছ। কিছুক্ষণ আলাপের পর মনে হলো তিনি স্বল্পভাষী ও অন্তর্মুখী চরিত্রের। তাঁর তখন মাত্র একটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে ‘কোথাও কোন ডাকঘর নেই’─এই শিরোনামে।’ কিন্তু মুস্তাফা আনোয়ারের সঙ্গে আশির দশকে লেখকের অনেকটা সময় কাটানো হয়, তখন তাঁরা দুজনেই চাকুরি সূত্রে রাজশাহীতে। এই বইয়ের লেখক বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়েছেন, কবি মুস্তাফা আনোয়ার রেডিওতে। লেখক জানিয়েছেন, তাঁর কলেজ জীবনের দুই বন্ধুও রাজশাহীতে। তাঁরা হলেন ফিরোজ ও আসাদ। একজন অতিরিক্ত কাস্টমস কমিশনার ও আরেকজন বাংলাদেশ ব্যাংকের জিএম। মুস্তাফা মহিউদ্দীন লিখেছেন, ‘আমরা চারজন ছুটির দিনগুলোতে জিপে বেরিয়ে পড়তাম গোদাগারী না হয় নাচোল। কখনও চলে যেতাম চাঁপাইনবাবগঞ্জ। মনে আছে নাচোলে এক টুকরো মাটি তুলে কপালে ঠেকিয়ে মুস্তাফা ভাই বললেন, প্রণাম তোমাকে হে ইলা মিত্রের নাচোল! গোদাগাড়ীতে পথের পাশে চা-দোকানে বাঁশের মাচায় বসে মহিষের ঘন দুধে বানানো চা খেতে খেতে গল্পে মেতে উঠেছি আমরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ গিয়ে বর্ডার স্টেশনে কোনো সাধারণ দোকানে বসে অসাধারণ পরোটা-মাংস খেয়েছি। ঘুরে দেখেছি আম বাগানগুলো, ফ্রেস আম পেড়ে ঝুড়িভর্তিআম কিনেছি। কখনও চলে গেছি চারঘাট আম উৎসব আনন্দে। ওখানকার নিবাসী তরুণ কবি মোস্তাক রহমানের আতিথেয়তা মুগ্ধ করেছে।’ স্বল্পভাষী কবি মুস্তাফা আনোয়ারের সঙ্গে এমন হৃদয়ঘন সময় কাটিয়েছেন লেখক, যেখানে শুধু এই দুই কবি হৃদয়ের ভাবনা-বিনিময়টা বোঝা যায় শুধু নিজেদের হৃদয়ানুভূতি বিনিময়ের মাধ্যমেই, একান্ত নীরবে!
’৭১ সালে ২৫ ডিসেম্বরের পাকবাহিনীর আক্রমণের পর যে তিনজন রেডিও কর্মকর্তা মিলে জীবন বাজী রেখে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র চালু করেন তিনি তাদের একজন। বাকী দুজন ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ ও আবুল কাশেম সন্দীপ। এই কবি এতটাই স্বল্পভাষী ছিলেন যে আড্ডায় তাঁর উপস্থিতি কম বোঝা যেত। কিন্তু তিনি খুব মনযোগী শ্রোতা ছিলেন। শাহবাগ রেডিও অফিস থেকে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে হেঁটে হেঁটে এসে যোগ দিতেন, অনেক সময় সঙ্গে থাকত কেউ কেউ।
এই বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি, বিশেষ করে হৃদয়ের উষ্ণছোঁয়া দিয়ে জড়ানো অর্থে এবং কবিতা বিষয়ে একটি ‘চিরায়ত’ অমোঘ উক্তি উচ্চারণার্থে, সেটি কবি আবিদ আজাদকে নিয়ে লেখা! সত্তর সালের কিছু আগে আবিদ আজাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয়, তিনি কিশোরগঞ্জ থেকে এসেছেন, বাংলা বিভাগে পড়েন। দৈনিক বাংলার ‘সাত ভাই চম্পা’য় লিখে সম্পাদক আফলাতুনের বিশেষ প্রিয়পাত্র। নাম হাবিবুর রহমান, ডাকনাম রেণু। কবিতা লেখেন সুমন আল ইউসুফ নামে। খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে ওঠেন এই কবি মুস্তাফা মহিউদ্দীনের সঙ্গে। এক ছুটির দিনে কবি আবিদ আজাদ ও আরেক বন্ধু লেখকের বাসায় এসেছিলেন দেখা করতে, লেখকের মা তাদের দুপুরে খেতে দেন। কয়েক ঘণ্টা আড্ডা দিয়ে খেয়ে দেয়া যখন ফিরে যাচ্ছিলেন তখন লেখক তাদেরকে পীরজঙ্গি মাজার পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যান বাস স্টেশনে। যেতে যেতে কবি আবিদ আজাদ, যাকে লেখক সুমন বলেই লিখেছেন, হঠাৎ বললেন, ‘দোস্ত, এই প্রথম বাড়ি ছাড়ার পর মাতৃস্নেহছায়ায় ঘরোয়া দুপুরের আহার করলাম। কতদিন এভাবে খাইনি ঢাকায় এসে!’ খুব সহজেই লেখকের সঙ্গে আবিদ আজাদের একটি বন্ধুত্বের অতীত ভিন্ন সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। আবিদ আজাদের অধিকাংশ কবিতা প্রকাশের আগে শ্রোতা ছিলেন কবি মুস্তাফা মহিউদ্দীন।
কবি আবিদ আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঘাসের ঘটনা’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। সত্তর দশকের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে চীৎকার করে ঘোষণা করার মতো ছিল কবি আবিদ আজাদের কাব্যসৌন্দর্য। এত মিষ্টি কিন্তু গভীর ব্যঞ্জনাময় কবিতা ছিল কবি আবিদ আজাদের। নিজেদের আড্ডা, তারুণ্যের উদ্দামতা সবই ছিল কবি আবিদ আজাদ, তাঁর কাব্যসঙ্গী শিহাব সরকার ও বন্ধু কবি মুস্তাফা মহিউদ্দীনের, কিন্তু এর মাঝেও তাঁদের সবারই সাহিত্যরুচি, কাব্যভাবনা ও মননশীলতা ছিল বেশ উঁচু তারে বাঁধা!
নিজে কবি হয়েও এই বইয়ের লেখক কবি আবিদ আজাদের কবিতাকে ভালোবাসতেন একেবারে ভিন্নভাবে। তিনি লিখেছেন, ‘আমার কাছে আবিদের কবিতা মানেই হৃদয়ের উত্তাপে মননকে শানিত করা। তাঁর অনেক কবিতাই সত্তর দশকের স্মৃতিকে ধারণ করে একুশ শতকেও সমান হৃদয়গ্রাহী। মনে আছে একবার সরকারি কাজে কিশোরগঞ্জ যেয়ে রেলস্টেশন ঘুরে ঘুরে দেখেছি মোরগফুল দেখার লোভে তাঁর ‘শুকনো হাওয়ায়’ কবিতাটা পড়ে। কিন্তু পাইনি। স্টেশন মাস্টারকে বলেছি এখানে কিছু মোরগফুল গাছ লাগিয়েন তো। পরে শিল্পতরুতে এক আড্ডায় তাকে জানাতে সে বলেছিল, দোস্ত সত্যিই বলছি আমাদের কিশোরবেলা রেলস্টেশনে কীরকম থরে থরে মোরগফুল ফুটে থাকত স্টেশন আঙিনায়, আমি দেখেছি।’
কবি আবিদ আজাদের মতো স্মৃতিতাড়িত কবি সত্তর দশকে হয়তো দ্বিতীয়জন পাওয়া কঠিন। নস্টালজিয়া এই কবিকে সারাক্ষণ মুহ্যমান করে রাখতো। তাঁর কবিতা সম্পর্কে লিখেতে গিয়ে কবি মুস্তাফা মহিউদ্দীন লিখেছেন, ‘আবিদের কবিতা মানে আমার কাছে উজান বেয়ে যাওয়া, নস্টালজিয়ার ভেতর থেকে আত্মার অমর-দ্যুতি বের করে আনা। তাঁর ছেলেবেলার স্মৃতিকথা ‘কবিতার স্বপ্ন’ পড়ে মনে হয়েছে, এমন বয়ঃসন্ধি যার সে কবি না হয়ে আর কি হবে? এই স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থে আবিদ অকপটে বলে গেছে তাঁর ছেলেবেলার কথা, শুনসান মফস্বল শহর কিশোরগঞ্জের কথা, তার স্কুলজীবন, প্রথম হস্তমৈথুনের অনুভূতি, জীবনে প্রথম চুম্বনের স্মৃতি, স্টিম ইঞ্জিনের সান্টিং চলাকালে সুমনের কৈশোরক চোখে দেখা কয়লাকুড়ানোবালিকার সঙ্গে ড্রাইভারের ফষ্টিনষ্টির দৃশ্য, পথে পথে হেঁটে বিভিন্ন ডিজাইনের খালি ম্যাচবাক্স জমানোর গল্প, তার কবি হওয়ার পেছনের ছোট ছোট ঘটনাবলি। তার চোখে দেখা চারপাশের জগত তাকে টেনে নিয়ে গেছে কবিতার দিকে। দশকের বিচারে কবির কবিতা বিচার্য নয়। তবু যদি বলতে হয় সত্তর দশক কবিতাকে কী দিয়েছে? আমার সোজাসাপটা উত্তর─ হ্যাঁ, সত্তর দশক কবিতাকে আবিদ আজাদ উপহার দিয়েছে।’
এর চেয়ে সুন্দর মূল্যায়ন আবিদ আজাদের কবিতার, সম্ভবত খুব একটা পাওয়া মুশকিল হবে। কবি মুস্তাফা মহিউদ্দীন নিজে একজন কবি, কিন্তু কেন জানি না, হয়তো ভুল পেশা এই মানুষটিকে সাহিত্যের জগতে তাঁর প্রাপ্য মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত করেছে। কিছুটা স্বল্পভাষী, প্রচারের বাইরে থাকার কারণে, কিছুটা অতিরিক্ত উঁচু শিল্পরুচিতে বাঁধা মননের জন্যই হয়তো তিনি আড়ালে রয়ে গেছেন!
‘কিছু মায়া রয়ে গেল’ সত্তর দশকের উদ্ভ্রান্ত সময়ের কিছু কবি শিল্পীর জীবন-নির্ভর রচনা হলেও এটি আসলে আমাদের সেই সময়ের সাহিত্যজগতের এক ভিন্নরকম ইতিহাস, যা সাধারণ কোনো পোশাকি ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই শীর্ণকায় গ্রন্থটির ভাষাও স্মৃতিচারণের ভাষা নয়, বরং একজন কবির ভাষা। এই সময়কাল ও আমাদের সাহিত্য ও জীবন নিয়ে আরেকজন লেখক দুটি গ্রন্থ লিখেছেন সম্প্রতি, একটি ‘পাতার কুটির’, অন্যটি ‘আকাশের ঠিকানা’। অধ্যাপক মোবাশ্বেরা খানমের সেই বই দুটি পড়তে গিয়েও বার বার মনে পড়েছে আমাদের সমাজ ও জীবনের এমন কিছু অজানা ও অকথিত দিক, যা কবি মুস্তাফা মহিউদ্দীনের বইটি পড়তে গিয়ে একেবারে নতুন করে মনে হলো। ‘কিছু মায়া রয়ে গেল’ সত্যিই একটি অসাধারণ লেখা!
১৯৫৫ সালে শরীয়তপুরের জাজিরায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক (সম্মান) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে তথ্য ক্যাডারে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৯৩ সালে পড়াশোনার জন্য নিউইয়র্ক যান। নিউইয়র্কের সিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Communications-এ এমএ এবং নিউ স্কুল থেকে Political Sociology-তে এম.ফিল এবং পিএইচডি ডিগ্রি নেন। ২০০১ সাল থেকে নিউজার্সির এসেক্স কলেজে সমাজবিজ্ঞান পড়ান। এছাড়া খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে সমাজবিজ্ঞান পড়ান। নিউইয়র্কের সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৫ সাল থেকে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে লেখা শুরু। মূলত প্রবন্ধ লেখেন গবেষণা, পড়াশোনা এবং আগ্রহের বিষয় সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞান। তিনি সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ এবং ইমদাদুল হক মিলনের ‘পরাধীনতা’ উপন্যাস দুটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। এছাড়া দেশের কয়েকজন লেখকের গল্প ও কবিতাও ইংরেজি অনুবাদ করেন। ‘বড় বেদনার মতো বেজেছ’ ছাড়াও তার আরও একটি প্রবন্ধের বই ‘দ্বীপান্তরের গান’। ইংরেজি প্রবন্ধের বই একাধিক। এ-বছরের নতুন ‘Media Power and other Essays’. তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তেরো। ১৯৯৩ সাল থেকে আবেদীন কাদের নিউইয়র্ক প্রবাসী।