সন্ধ্যাটির এরকম কৌতুক তৈরি হয়। আঁধারের মতো হাসি লুপ্ত করতে করতে, অলক্ষ্যে হরিতকি গাছের ছায়া বিস্তৃত হলে তখন মাথা দুলিয়ে গানের রাজ্যে ডুবে থাকা চটুইয়ের কথা হচ্ছিল। কুয়ার ভেতর দড়িদড়াবাঁধা ঝুলন্ত বালতির মতো তার মাথা দোলানোর কী অর্থ বুঝে উঠতে না পারলে হয়তো লোকেরা, মেহেরকুলের আঁটিআম গাছের তলায়, মুচকি হাসে। এই হাবাগোবা এতিম ছেলেটিকে নিয়ে রসিকতায় মেতে উঠলে সে আধখানা চাঁদের নিচে একটা গাছ তৈরি করে—সবুজ পাতার স্বপ্নে গাছটা বনভূমির অলৌকিক রাত ছড়িয়ে স্থির। গাছটাকে তার পা মনে হলে সে আঙুলশূন্য পায়ে উড়ালের বাসনা নিয়ে হয়তো ভিড়ের ভেতর দাঁড়ায়। দেখে ভুতুড়ে শীত নেমে আসছে হরিতকি গাছ বেয়ে। আবদুল, যে হয় তার বন্ধু, একদিন বলেছিল—মানুষ মরে গেলে হরিতকি ফল হয়ে যায়। কোথাও পাতা ঝরে পড়ার মৃদু কান্না উড়ে এলে চটুই ভাবল, পাতারা কেন আত্মহত্যা করে, জ্যোৎস্নায়! সে এইসব মৃত পাতা এবং খড়ের বিন্যাস নিয়ে ভাবছিল। অথবা কেউ তাকে ভিড়ের ভেতর ধাক্কা দিলে এইসব পাতার বিনীত সবুজ ছিঁড়ে গেল। এবং তখন হয়তো তার আকলিমার কথা মনে পড়ে।
এসব হারামজাদা ভেবে সে কি হেসেছিল? গোপনে? আর তার নামের মধ্যেই মেঘের উড়াল ছিল; তার গরু, গান স্থির করা গোয়াল, খড়বিচালি, চরাট আর গরুর চোখের ভেতর অস্ফুট জ্যোৎস্নায়। ভিড় লোকের চোখ ফাঁকি দিয়ে সে শিশুহস্তে আঁকা নীল জ্যোৎস্নায় গরুর চোখের ভেতর ঢুকে পড়ে।
চটুই ভাবে সবই এদের ভংচং। এই মুচকি গোঁফেহাসি, এতেই এদের মনের বিটকেলে শয়তানি! এসব হারামজাদা ভেবে সে কি হেসেছিল? গোপনে? আর তার নামের মধ্যেই মেঘের উড়াল ছিল; তার গরু, গান স্থির করা গোয়াল, খড়বিচালি, চরাট আর গরুর চোখের ভেতর অস্ফুট জ্যোৎস্নায়। ভিড় লোকের চোখ ফাঁকি দিয়ে সে শিশুহস্তে আঁকা নীল জ্যোৎস্নায় গরুর চোখের ভেতর ঢুকে পড়ে। গরুর চোখকে তার আয়না মনে হয়। আঁটি আমগাছের তলায় ভিড় বাড়তে থাকলে জড় হওয়া লোকদের ভংচং দেখতে দেখতে সে অন্যমনস্ক। তার হাবাগোবা বিস্ময়ের ঘোর কেটে গেলে প্রথমে বেশ কৌতুক হয়েছিল, আর পরক্ষণেই লোকের কথার হাড়গোড় ফেনিয়ে উঠলে গভীর শোকের হাতপা দীর্ঘ হতে থাকে। সে ভাবে শোক বা দুঃখ প্রকাশের কোনো গান আছে কি? কোনো সুর? অথবা কোনো বাদ্যযন্ত্র? দুঃখ অনুবাদের ভাষা মানুষ কখনো আয়ত্ব করেছে? এসব আলোছায়াময় ভাবনায় তার হাতপা ঘুমিয়ে পড়ে। চৈত্রের হাওয়ায় একটা মৃত পালকের মতো সে নিরুদ্দেশ হবে কি? মনে হয় তার বুক ঝাঁঝরা পাতা, রোদ ঢুকছে, ধুলো দৌড়ে যাচ্ছে। সড়কবাতি ঘিরে ঝিঁঝিপোকাদের মৃত্যুউৎসব শুরু হলে তার দুঃখ হয়। ভাবল শোক অথবা দুঃখের নিরাময় কী?
মেহেরকুল পৌরসভার চেয়ারম্যান সোলায়মান বিশ্বাস, বাগদিপাড়ার লোকেরা ছুলায়মান চিয়ারমেন উচ্চারণ করলে তারই অপভ্রংশ একদিন বা অনেক অনেকদিন পর সেসব গোপন ভাষাবিন্যাস শহরে বেশ বিনোদন হয়। আর চটুই, যে হয় রাখাল। লোকেরা, হয়তো একদিন চায়ের দোকানের আঁধার-আঁধার কোনাকাঞ্চিতে আবিষ্কার করে গঞ্জিকার বাঁশি অথবা পাতা। সেসব বাঁশি অথবা পাতা চেয়ারম্যানের সাঙ্গোপাঙ্গোদের হতে পারে। কেউ বলে শহরের ছেলেছোকরাদেরও হতে পারে। কেউ বলে বুইড়াগুলাই বা কম কিসে! চটুই অন্ধকারে ছুঁচো বা গন্ধমূষিকের কেত্তন দেখে। অন্ধকারে ছুঁচো, দিনের বেলা ইঁদুর। চটুইয়ের মনে হয় অন্ধকার এবং আলোর ভেতর বক্তিমায় পারদর্শীরা গন্ধইঁদুর। সে মুচকি হাসে। গোঁফেহাসির মৃদু কম্পনের ভেতর সে দেখে শহরজুড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ইঁদুরের তরঙ্গ বয়ে চলেছে— ধেড়ে ইঁদুর, বাচ্চা ইঁদুর, পাতি ইঁদুর, ছোকরা ইঁদুর, মাস্তান ইঁদুর, নেংটি ইঁদুর, জোলা ইঁদুর, ব্যাংকার ইঁদুর, ক্যানভাসার ইঁদুর, রাজনৈতিক ইঁদুর, চ্যালা ইঁদুর, চামুণ্ডা ইঁদুর…। দেখে একপাল ধেড়ে গন্ধইঁদুর কুয়াশা মোড়ানো মৃত নদীর ওপর ব্রিজের লোহার ভেতর বায়ুঝড়ের সুড়ঙ্গ তৈরি করছে। চারপাশে বালিয়াড়ির ঝিকমিক, মাছের কঙ্কালের ফসফরাস সন্ধ্যাতারার মতো জ্বলছে। সন্ধ্যায় ইঁদুরেরা গন্ধমূষিকের গান গাইছে শামসুজ্জোহা পার্কে। অন্ধ গন্ধমূষিকেরা বক্তিমা করছে। ঝাঁকে ঝাঁকে গন্ধমূষিক দৌড়াচ্ছে। বাড়িগুলো সব সুড়ঙ্গ। পৌরসভা, পুরোনো হাসপাতাল, ফুড গোডাউন, শিক্ষা অফিস, টাউন হল, আবাসিক হোটেল, মসজিদ, সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, কাঁচা বাজার, ওষুধ-জামাজুতো-প্রসাধনীর দোকানগুলো এক-একটা বিরাট সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গে গন্ধমূষিকেরা ঢুকছে, বেরুচ্ছে, কামড়াকামড়ি করছে। একটা গন্ধইঁদুরের পেছনে ছুটছে হাজার হাজার গন্ধইঁদুর। উলঙ্গ গন্ধইঁদুর দেখে চটুইয়ের হাসি পায়। মাথাশূন্য কাঁধসর্বস্ব ল্যাংটো গন্ধইঁদুরগুলো ন্যালাভোলা, হাসি হাসি। ধূলির ঘূর্ণি ল্যাংটো গন্ধইঁদুরগুলোর চারপাশে নাচের রাজ্য ছড়িয়ে দিলে চটুই দেখল কেউ কুট কুট কুট হত্যা করতে চাইছে গরুর ঘুম ঘুম মুখগুলো। এসব হত্যাঝড় ছুটে এলে সে চোখ বন্ধ করে। আয়না বন্ধ করে। মাথা দোলানো বন্ধ করে। গান বন্ধ করে। কান বন্ধ করে। তবু বন্ধ কানের নিঃশব্দ ছিঁড়ে বিবিধ শব্দ দৌড়ে আসে। ছবি দৌড়ে আসে। কেউ চিঁচিঁচিঁ চিঁচিঁচিঁচিঁচিঁ চিঁচিঁচিঁচিঁচিঁচিঁচিঁচিঁ চিৎকার করে। কেউ বলে, ছুঁচোপার্টি। আর তখনকার তখনই বিপুল রগড় হল। ছুলায়মানচিয়ারমেনপার্টিকে এমন বিলুপ্ত সংস্করণের আমোদ গোপন খবরের মতো শহরময় ছড়িয়ে পড়লে চটুই একদিন কিংবা দুইদিন অথবা তিনদিন বা অনেক অনেকদিন ধরে একপাল গরু নিয়ে, হয়তো ঘন সবুজ ঘাসের লোভে যায় শহরের মাঝখানে জনাকীর্ণ শামসুজ্জোহা পার্কে। শহরের পেট চিরে গাছের শুকনো ডালের মতো কালো রাস্তায় প্রায়শ ট্যুরিস্টের দল আসে, পনের কিলোমিটার দূরে আঁধার আমবাগানের ভেতর সমুজ্জ্বল স্মৃতিসৌধ দেখার কৌতূহলে, কিংবা লর্ড ক্লাইভের নীলকুঠির কাঠের পাটাতনের নিচে গোপন সমাধির খোঁজে। হয়তো বা এখানে, এই শহরের বিলুপ্ত ধূলির ভেতর শামসুজ্জোহা পার্ক তখন লোকের ভিড়ে হুমড়ি খেয়ে সংকীর্ণ। চটুই পার্কে ঢোকার মুখে পেল্লায় গেটের গ্রিলের সঙ্গে গরুগুলো একদিন বাঁধে। দুইদিন বাঁধে। তিনদিন বাঁধে। চারদিন বাঁধে। আর সে কখনো ট্যুরিস্টদের অনুগামী নয়, যারা শামসুজ্জোহা পার্কের সবুজ ঘাসের ভেতর যুদ্ধকালের গল্পে বিগলিত অশ্রুর স্বাদ আনে, ঢেঁকুর তোলে, পান চিবায়, অথবা নিছক আমোদফূর্তির জন্য নাটক বা গানবাজনায় ডুবে থাকে; এইসব ট্যুরিস্ট এবং অভ্যাগতদের নিয়ে সাদা কবুতর উড়ায়, বিকেল বা গোধূলির ভেতর—এত ভিড় চটুইকে হঠাৎ ভীত ও বিহ্বল করে। তখন, হয়তো ছুঁচোপার্টি আর পুলিশের দল আসে, চটুইকে বলে—এই হারামজাদা গরু, এইডা গরু বান্দার জায়গা, ভাগ এখান থেকি। ছুঁচোপার্টিপুলিশ গরুগুলোকে লাঠিপেটা করলে সবুজ ঘাসের স্বপ্নে বিভোর প্রাণীগুলো পার্কের ভিড়ের ভেতর ছোটাছুটি করে। তখন বেদম গরুদৌড় শুরু হয়। ট্যুরিস্টরা দৌড়াচ্ছে, গরু দৌড়াচ্ছে, ছুঁচোপার্টি দৌড়াচ্ছে, পুলিশ দৌড়াচ্ছে। কী করবে চটুই! ট্যুরিস্ট-গরু-ছুঁচোপার্টি-পুলিশ দৌড়াচ্ছে। চটুই গড়াচ্ছে। দৌড় গড়াগড়ি গোলকধাঁধা তৈরি করছে—গরু-ট্যুরিস্ট-ছুঁচোপার্টি-পুলিশ-ট্যুরিস্ট-গরু-পুলিশ-ছুঁচোপার্টি-গরু—গড়াতে গড়াতে চটুই দেখল গরু-ট্যুরিস্ট-ছুঁচোপার্টি-পুলিশদৌড়ের গোলকধাঁধা… গটুছুঁপু—টুছুঁগপু—পুগটুছুঁ… গরুর গলকম্বল লাফাচ্ছে… ছুঁচোপার্টিপুলিশের ভুঁড়ি লাফাচ্ছে… অভ্যাগতদের পাছা দৌড়াচ্ছে… গরুর চোখে গোপন অশ্রু ঝরছে… গরুগুলো ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ছে… সবুজ ঘাসের স্বপ্নে ঘুমের ভেতর ডাকছে মাঁআঁড়ঁড়ঁড়ঁড়ঁ… গরুগুলো ঘুম ঘুম… ঘুম ঘুম ক্লান্তির ভেতর ছুঁচোপার্টিপুলিশের লাঠিপেটা উদ্দাম হয়ে এলে চটুই দেখে তার পিঠে রক্তস্রোত দৌড়ে চলেছে… মাথার রক্তস্রোত গড়িয়ে নামছে আঙুলশূন্য পায়ের ভেতর…
তখন, হয়তো ছুঁচোপার্টি আর পুলিশের দল আসে, চটুইকে বলে—এই হারামজাদা গরু, এইডা গরু বান্দার জায়গা, ভাগ এখান থেকি। ছুঁচোপার্টিপুলিশ গরুগুলোকে লাঠিপেটা করলে সবুজ ঘাসের স্বপ্নে বিভোর প্রাণীগুলো পার্কের ভিড়ের ভেতর ছোটাছুটি করে। তখন বেদম গরুদৌড় শুরু হয়। ট্যুরিস্টরা দৌড়াচ্ছে, গরু দৌড়াচ্ছে, ছুঁচোপার্টি দৌড়াচ্ছে, পুলিশ দৌড়াচ্ছে।
লাঠিপেটানোর রাজত্ব শেষ হলে সে ঘন অন্ধকার দেখে। যেন দিনের আলো ভেসে যাচ্ছে রক্তগোধূলিতে। পথের চিহ্ন কোথায়, সে দেখে বিস্তীর্ণ কালো নদীর মতো পথের কিনার, চোখ ঝলসানো কালো সূর্যালোকের অন্ধকারে দূরে কোথাও মাথার ভেতর জ্বলছে নিভু নিভু লণ্ঠন। দেখে জমাট রক্তের ভেতর মেঘ উড়ে যাচ্ছে। গরুর আয়নাচোখগুলো তার কান্নার ভেতর ডুবে যাচ্ছে। গরুগুলো রক্তের ছবি হয়ে যাওয়া তার পিঠে মুখ ঘসে দিলে সে অশ্রুজলধৌত পথের ভেতর আশ্রয় পেল। দেখল গরুর চোখে জল। জলের ভেতর তার ব্যথার নিরাময় হয়। সে গরুগুলোর গলা জড়িয়ে ধরে। প্রাণী এবং মানুষের অন্তর্গত সম্পর্কের ভেতর গরুগুলো মাঁআঁ—ড়ঁড়ঁড়ঁ ডেকে উঠলে চটুই কান্নার ভেতর মাথা দুলিয়ে গান করে—আয়না নিবি/গয়না নিবি/হিমানি নিবি/চিরুনি নিবি… গাইতে গাইতে চটুই গরুর পাল নিয়ে তার গানের ভেতর পাখির উড়ালছায়ায় পার হয়ে যায় সরকারি বালক বিদ্যালয়, মসজিদ, কাঁসারিপাড়া, বিনিময় হয়ে যাওয়া মল্লিকবাড়ি, পরিত্যক্ত ভাঙা মন্দির। সরকারি বালক বিদ্যালয়ের কাছে এসে হয়তো সে তার কালসিটে রক্তপিঠ নিয়ে থেমেছিল। থেমেছিল কি? অশ্রুজলধৌত বিদ্যালয় মুছে গিয়েছিল। সে তখন চক্ষুরহিত। হয়তো সে বালকদের লেখাপড়ার ভেতর গরুর খুরপায়ের শব্দে উদাসীন। শিশুশ্রেণির বালকদের কণ্ঠস্বরের ভেতর ছোটো ছোটো অজস্র আয়না ঝিলমিল করতে দেখে। তৃতীয় শ্রেণি পাস দেওয়া চটুই ভাবল, তোমাদের জীবন অক্ষরময়, বইয়ের ভেতর পৃথিবীর দিকে তোমাদের চক্ষু ও মন। আমার চক্ষু গরুর অশ্রুময় দৃষ্টির মতো দুঃখী। আমি পড়া শিখিনি। আমার চক্ষু ও মনে পৃথিবীর সকলই কালো। কালো ছাড়া কোনো রং নেই। কালো, কালো, কালো এবং কালো এবং কালো এবং কালো। গরুর স্বপ্নের ভেতর খেলা করে আমার পুরো পৃথিবী। গরুর গভীর চক্ষু দিয়ে তোমাদের দেখি। তোমরা আমাকে দেখো না, দেখো কি? গরুর চক্ষু দেখো না, দেখো কি? খুরের জ্যোৎস্না দেখো না, দেখো কি? তবে কী দেখো তোমরা কালো কালো অক্ষরের ভেতর? ছুঁচোপার্টি কী দেখে রাতের অন্ধকারে? ছুঁচোপার্টিপুলিশ তো দিনের ভেতর মূর্তিমান চক্ষুরহিত। বিদ্যালয়ের সামনে ঘুঘনিওলা বইয়ের ছেঁড়া পাতায় ঘুঘনি মুড়িয়ে দিলে দেখল তাতে প্রাচীন গুহার দেয়ালে আঁকা একটা গরুর ছবি অক্ষর হয়ে আছে। গরুবিষয়ক বইটিকে তার পৃথিবী মনে হয়। ঘুঘনিওলাকে মনে হয় প্রাচীন জাদুকর। গরুবিষয়ক পৃষ্ঠাটি নিতে সে জাদুকরকে আয়না-চিরুনির গান শোনায়। বাইসনের দুর্বিনীত চিত্রকলা তার অশ্রুর শুকিয়ে যাওয়া চোখে অজস্র কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুলের পাপড়ি পাখা মেলে দেয় দূর দূর মেঘে মেঘে মেঘে মেঘে মেঘে
সে দেখে
নীল ফুল!
বেগুনি ফুল!
নীলবেগুনি ফুল!
বেগুনি ফুল! বেগুনি ফুল!
নীল ফুল! নীল ফুল!
চারপাশ কচুরিপানা ফুলের নীলচেবেগুনি আলোয় ভেসে গেলে তখন গরুর পাল নিয়ে সে মাঠে যেতে যেতে ধুলো উড়ছে। ধুলো মনে হয় দিনের জ্যোৎস্না। সে গরুর আয়নাচোখের ভেতর রাত সন্ধান করে, চাঁদতারা খোঁজে। দেখে গরুর আয়নাচোখে জমে আছে শিশিরের সমুদ্র। সে সেই শিশির আঙুলে মুছে তার রক্তপিঠে ছোঁয়ায়। শিশিরের অনুভূতি তার পিঠের ভেতর দিয়ে রক্তে ছড়িয়ে গেলে তার শরীর যেন শস্যখেত, তার শরীর তখন খড়ের শীর্ষে। তার রক্তপিঠ দেখে আবদুল হয়তো কান্না করে। যে তার বন্ধু, আর এক রাখাল। সে বলে—শালা তুই একটা গাছ ভুদাই, পাগলের গুষ্টি, লোকে অ্যামনেই তোকে পাগল বলে! আর সত্যিই, চটুই হাসে হাবাগোবা; আর সত্যিই যে তার পায়ের আঙুল নেই। আঙুল নেই, তার পা তবে গরুর খুরের মতো গোল—এই সাদৃশ্য আবিষ্কারে সে বিস্ময়ে আনন্দে মাটিতে গড়াগড়ি দেয়। গড়িয়ে গড়িয়ে তার শরীর আধখানা চাঁদ। আর সে দেখে, তার আঙুলশূন্য পায়ের ভেতর গরুর খুরের শব্দে পৃথিবীর ধুলো উড়ছে। গড়াগড়ির ভেতর সে মাটিতে গরুর খুরের গন্ধ পায়। খুরের ধূলিগন্ধ তার রক্তপিঠে ছড়িয়ে গেলে সে দেখে গোধূলির ভেতর পৃথিবীর লুব্ধ মুখ ঝরে পড়ছে। আর তার ভেতর গান ক্রমশ আসছে, গান ক্রমশ উড়ছে, ধ্বনিময় গান ক্রমশ দৌড়ে চলেছে, অশ্রুময় গান প্লাবিত হচ্ছে—গরুর খুরের ধ্বনিময় ধূলি… ধূলিগোধূলি… গোধূলিধূলি… ধূলিগোধূলিধূলি… ধূলিগো ধূলি ধূলি… সে গানের স্বরলিপি সাজাতে থাকে
আয় না নিবি
ধূলি গো ধূলি
গয় না নিবি
ধূলি গো ধূলি
চি রু নি নিবি
গো ধূ লি ধূলি
হি মা নি নি বি
ধূ লি গো ধূ লি
সে দেখে গরুর খুরের ধূলিগোধূলির ভেতর শস্যের শব্দ, পাকা ফসলের ঝনঝনা গান, পাখিরা ধ্বনিময় মেঘ হয়ে যাচ্ছে দূরে; তারা তারা হয়ে যাচ্ছে দূরে। তখন, পৃথিবীর সকল গরুর খুরের ধূলি এবং ধ্বনি চটুইয়ের শরীরে ছড়িয়ে গেলে সে খুরপায়ে শিং উঁচিয়ে আচমকা ক্রোধোন্মাদ হয়ে পড়ে। নির্দয় ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে সে কি তাড়া করবে ছুঁচোপার্টিপুলিশদের? গরুর শরীরে গোপন পশুর শক্তি তাকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে? পৈশাচিক উল্লাসে সে তার গোলাকার খুরপায়ে পিষ্ট করতে থাকে ছুঁচোপার্টিপুলিশেদের। ক্রোধোন্মাদ এবং পৈশাচিক। পৈশাচিক এবং দুর্দমনীয়। দুর্দমনীয় এবং ক্লান্ত। তারপর সে শান্ত হয়। তারপর তার গানের ভেতর অশ্রু মুছে যায়। তারপর তার রক্তপিঠে ব্যথার নিরাময় ঘটে। তখন তার হয়তো আকলিমার কথা মনে পড়ে এবং হয়তো শুকিয়ে যাওয়া মৃত ভৈরবের প্যাককাদা পর হয় অবলীলায়। তার খুর পা কোথাও ডুবে গেলে শীত শীত অনুভব হয়। শীতকে তার হৃদয় মনে হয়, তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ে মৃত নদীর শীত। নদীর মৃত শরীরজুড়ে ময়ূরের খসেপড়া পালকের গৌরব নিয়ে কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুলগুচ্ছ তাকে অভাবিত করে। শুকনো নদীর ভেতর সামান্য যে জল, জলকে তার গরুর চোখের আয়না মনে হয়। সেখানে ফুটেছে কচুরিপানার নীলচেবেগুনি স্বপ্ন। কচুরিপানা ফুলের ঘুম ঘুম পাপড়ি চোখের পাতায় জড়িয়ে গেলে সে হয়তো ফুলগুচ্ছ তোলে। আকলিমার নামে ফুলগুচ্ছের নীলচেবেগুনি হৃদয় উড়িয়ে দেয়।
এইসব বিবিধ ধূলি গায়ে মেখে সে ফুলগুচ্ছ কোথায় রাখবে এই নীরব নরম সন্ধ্যায় বুঝে উঠতে না পারলে আবদুল বলে, ফুল নিয়ে তারা যাবে সরকারি বালক বিদ্যালয়ের মাঠে, মাঠের নির্জন প্রান্তে, অন্ধকারে। আবদুল বলে, অন্ধকার আসুক, তাহলে তারা দেখবে চাঁদের শরীর থেকে ঝরে পড়ছে সুগন্ধ জ্যোৎস্নার বুদবুদ।
কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুল হাতে সে কতদূর যাবে? কোথায় যাবে? কতদূর পৃথিবীর ধূলিগোধূলিপথে হাঁটলে সে ফুলগুচ্ছ রাখার মতো জ্যোৎস্না পাবে, আয়না পাবে, কতদূরে পাবে জোনাকিরাতের চাঁদতারা! হয়তো তখন সন্ধ্যা নামে পৃথিবীতে, ছায়া ছায়া আলপথে বিকেল ঘুমিয়ে গেলে তার শরীরে শস্যের ধূলি, খুরের ধূলি। এইসব বিবিধ ধূলি গায়ে মেখে সে ফুলগুচ্ছ কোথায় রাখবে এই নীরব নরম সন্ধ্যায় বুঝে উঠতে না পারলে আবদুল বলে, ফুল নিয়ে তারা যাবে সরকারি বালক বিদ্যালয়ের মাঠে, মাঠের নির্জন প্রান্তে, অন্ধকারে। আবদুল বলে, অন্ধকার আসুক, তাহলে তারা দেখবে চাঁদের শরীর থেকে ঝরে পড়ছে সুগন্ধ জ্যোৎস্নার বুদবুদ। অথবা আবদুল বলে, ফুল নিয়ে তারা যাবে প্রাচীন ভাঙা মন্দিরের উঠানে, ভাস্কর্যের ভেতর। ফুল নিয়ে তারা যাবে হরিতকি গাছের নীলাভ ছায়ায়, অনাঘ্রাত ফলের ভেতর। যেন ফুলগুচ্ছের হৃৎপিণ্ড ও যকৃতের ক্রিয়া থেমে না যায়, কিংবা গলগল রক্ত বেরিয়ে মস্তিষ্ক মারা না পড়ে। তারা এক সন্ধ্যায় যায়। তারা যায় দুই সন্ধ্যায়। তারা তিন সন্ধ্যায় যায়। হয়তো তারা অনেক অনেক সন্ধ্যায় যায়। দূরে। শব্দের দূরে। আলোর দূরত্বে। আঁধারে জোনাকি জ্বলে উঠলে সন্ধ্যায় সাঁজালের ধোঁয়ায় তারা ক্রমশ যেতে থাকে সরকারি বালক বিদ্যালয়ের মাঠের প্রান্তে, প্রাচীন মন্দিরের ভাস্কর্যে নিষ্প্রদীপ গুহার ভেতর এবং হরিতকি ফলের গর্ভকেশরে। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। তাদের জানা ছিল না—বিদ্যালয়ে পৃথিবীর কত কত জোনাকি, প্রাচীন মন্দিরের ভাস্কর্যে কত কত চাঁদতারা, গুহার দেয়ালে কত কত গরুর ধ্বনিময় উড়াউড়ি, কত কত গাছগাছালির মৃত ফুলপাতা, কত কত আকাশের উড়াল এপিটাফ হয়ে আছে। এসব জোনাকি, পাখি, ফুলপাতার ভেতর কত মার্কো পোলো, কত কলম্বাস, কত লর্ড ক্লাইভ গোপন ঘুম নিয়ে জেগে আছে। চটুই ভাবল—এতকিছু না জেনে তারা কীভাবে বাঁচে! মাঠজুড়ে তখন বিবসিত সাদা গন্ধের নীরবতা দৌড়ে যায়। অথবা ছুঁচোপার্টিপুলিশের গোপন এক গন্ধের সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়ে। আবদুল বলে—বাঁশি। তখন নীরব ঠান্ডা স্রোত নামে অথবা বাঁশির গন্ধসাম্রাজ্য তাদের ঘিরে উড়তে থাকলে চটুইয়ের ভয় হয়। বাঁশির গন্ধে আচ্ছন্ন হতে হতে সে ছুঁচোপার্টিপুলিশের গন্ধদৌড় দেখে, রক্তাক্ত গরু আঁধার হয়ে যেতে দেখে, লাঠিপেটা কালসিটে গলকম্বল দেখে, ছুঁচোপার্টিপুলিশের ধাতব চোখ দেখে… দেখে ভয়ের ভেতর রাত, ভয়ের ভেতর ঝাঁঝরা পাতা, ভয়ের ভেতর পাখিজীবন, ভয়ের ভেতর খড়ের বন, ভয়ের ভেতর পুকুরের জল, ভয়ের ভেতর মাছের ভ্রুকুটি, ভয়ের ভেতর আমাবাগানের ছায়া, ভয়ের ভেতর রোদের টুকরো পয়সা, ভয়ের ভেতর আকলিমা, ভয়ের ভেতর আয়না, ভয়ের ভেতর আকাশ, ভয়ের ভেতর ভাঙা মন্দির, ভয়ের ভেতর মেঘ, ভয়ের ভেতর বিকেল, ভয়ের ভেতর বৃষ্টি, ভয়ের ভেতর মুথা ঘাস, ভয়ের ভেতর পাতার বাজুবন্দ আর সিতাপাটি কণ্ঠহার, ভয়ের ভেতর জিহ্বা, ভয়ের ভেতর অভ্যুদয়, ভয়ের ভেতর দাঁত, ভয়ের ভেতর মান্দার কাঁটা, ভয়ের ভেতর লর্ড ক্লাইভের বন্দুক, ভয়ের ভেতর একটা শরীর ঢুকে যাচ্ছে সুড়ঙ্গে, ভয়ের ভেতর একটা সুড়ঙ্গ ঢুকে যাচ্ছে শরীরে, ভয়ের ভেতর চুম্বন, ভয়ের ভেতর বাঁশের কঞ্চি, ভয়ের ভেতর শামসুজ্জোহা পার্ক, ভয়ের ভেতর কেউ তাকে আমগাছে ঝুলিয়ে দিচ্ছে, ভয়ের ভেতর ক্রুশকাঠে কেউ গজাল ঠুকছে, ভয়ের ভেতর চিৎকারের ফিনকিরক্ত ছুটছে, ভয়ের ভেতর ঘাসের উপর রক্তফোঁটা, ভয়ের ভেতর একটা মানুষ ছুরি হয়ে যাচ্ছে, ভয়ের ভেতর ছুরি গেঁথে যাচ্ছে চাঁদতারায়, ভয়ের ভেতর পার্কের মঞ্চে রংবেরঙের বিদ্যুৎবাতির অত্যুজ্জ্বল আলো মৃদু চন্দ্রালোককে ভেংচি কাটে, একটা বক্তিমার আলোকবাতি, একটা শহরপ্রশাসক আলোকবাতি, একটা পৌরপ্রসাশক আলোকবাতি, একটা ছুঁচোপার্টিপুলিশ আলোকবাতি শহরের অলিগলির ভেতর আঁধার চালান করে, আঁধার সুড়ঙ্গ থেকে ধেড়ে ধেড়ে ছুঁচো দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসে, ছুঁচোপার্টিপুলিশের দৌড়ের ভেতর চটুইয়ের বুকের ভেতর ভয়ের হিম হিম রক্তলালা জমতে থাকে। বুকের ভেতর সে শীত শীত মৃত ভৈরব আবিষ্কার করে। মাথার ভেতর ফিনকি দিয়ে রক্তপতঙ্গ উড়ছে অথবা হত্যা হয়ে যাচ্ছে। মাথার ভেতর গরুর রক্তঘণ্টা বাজছে ক্রমাগত, ছুঁচোপার্টিপুলিশ গরুর খণ্ডিত মাথা নিয়ে দৌড়াচ্ছে। ভয়ের ভেতর সে ডুবে যাচ্ছে… ডুবে যাচ্ছে… ডুবে যাচ্ছে… ভয়ের ভেতর ডুবতে ডুবতে সে গরুর খুরের গন্ধে আবদুলকে জড়িয়ে ধরে। তার জ্ঞান হয়, ভয়ের অতল থেকে উঠে এলে আবদুল তাকে পুনরায় বলে—গাছ ভুদাই। চটুই কেবল আঁধার দেখে।
আবদুলের হাতের ভেতর আমপাতা, লতাগুল্ম এবং খড়ের জঙ্গল পাড়ি দিতে দিতে বিবিধ ভয়ে ঘুম না এলে চটুই গোয়াল ঘরে যায়, গরুর গলকম্বলে মাথা গুঁজে দেয়। গরুর ঘুমের ভেতর সে যতদূর সে যায়, ততদূর তার ভালো লাগে। যত যতদূর সে যায়, তত-ততদূর মেঘের ভেতর রোদের ভেতর সে দেখে জ্যোৎস্নার জাদুঘর—হাজার হাজার বছরের হারানো চন্দ্রালোক ঘুমিয়ে আছে। তত-ততদূর আয়নার ভেতর একটা মুখ দৌড়ে যাচ্ছে। তখন, রাতের আঁধার প্রহেলিকায়, তার পুনরায় আবদুলের কথা মনে পড়ে এবং শরীরে সোনালি খড়ের নির্জন মাঠের অনুভূতি নিয়ে সে দাঁড়ায় ভাসমান মেঘের ভেতর। খড়ের মাঠে একদিন, হয়তো অনেক অনেকদিন, গরুর গলকম্বল ছুঁয়ে আবদুল মেয়েদের বুকের ঘুম ঘুম জ্যোৎস্না অনুভব করে। সেসব ঘুমজ্যোৎস্না গরুর খুরের ভেতর বেজে উঠলে তার নুনু খাড়া হয়। তখন হয়তো সে একদিন বিকেলের ধূলি উড়ে গেলে চটুইকে দেখায় শরীরের বিস্ময়। শরীরের আগুন কেমন। হয়তো আগুনের শব্দে চটুই ভোদাই, হেসেছিল সে, লাজুক। আর ভোদাই হয়ে সে গরুর গলা জড়িয়ে ধরেছিল, তখন হয়তো সে উড়ে যাচ্ছে গরুর চোখের ভেতর, উড়ে যাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে। আর সোনালি খড়ের ঝোপ তাদের আড়াল তৈরি করলে তারা দেখে সেই অগ্নিক্ষরা শরীরের উত্থান। যেন তা দুটি ধাতব মুদ্রা, সেই স্বর্ণাভ মুদ্রায় প্রাচীন সাম্রাজ্যের গোপন চিহ্ন অঙ্কিত। গোপন সোনার মুদ্রা অগ্নিগোলক হয়ে ফেটে পড়েলে চটুই দেখে তার পায়ের নিচে ঘাস। ঘাসের গন্ধে সে দেখে আকলিমার মুখ ছড়িয়ে আছে, তার চুলে ঘাসের গন্ধ উড়ছে, তার আঁচলে ঘাসের ছায়া, তার চোখদুটো ঘাসের জ্যোৎস্নার মতো। তখন টুকরো টুকরো মেঘের ভেতর ঘাসের জ্যোৎস্নায় লেগে থাকা আকলিমার পায়ের গন্ধ ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়ে।
চাঁদ কী বলে তাকে, আকলিমাকে? চাঁদ কী বলে রাতে, আঁধারে? আকলিমা বাইরে এলে তারা গরুর খুরপাচাঁদের দিকে তাকায়, আর দুজনেই হাসে নীরবে, আর দুজনেই তারা তাদের আয়নাচোখের ভেতর শিশির ঝরতে দেখে। তখন, অনেক অনেকদিন পর তারা তাদের শিশিরচোখের ভেতর গরুর খুরপাচাঁদের জ্যোৎস্নায় জীবনের এক অবলম্বন গড়ে তোলে।
টুকরো টুকরো গান উড়ে যায় চাঁদ ভেঙে পড়া একটা উঠানের মতো—উঠান হচ্ছে তাই, মান্দার গাছের কাঁটাঝোপ থেকে একটা কাচপোকা উঠানের কোনায় হেঁটে গেলে সেখানে হেঁসেলের সঙ্গে আকলিমার ঘর—কঞ্চির বেড়ার ফাঁকফোঁকড়ে আধখানা চাঁদ ঝোলে; যেন সে কপাল মেলে দিয়েছে আঁধারে। চটুই হাঁটে, কপালচাঁদ হাঁটে তার সাথে। চটুই দূরে যায়, কপালচাঁদও যায় দূরে। তখন, আধখানা চাঁদকে চটুইয়ের মনে হয় গরুর খুর। সে দূরে বা কাছে গেলে কপালচাঁদও গরুর খুরপায়ে যায় দূরে বা কাছে। সে গরুর খুরপায়ে কপালচাঁদের সঙ্গে হাঁটে, আকলিমার ঘরের বেড়ার ফাঁকে হয়তো একদিন, হয়তো দুইদিন, হয়তো তিনদিন, হয়তো কত-কতদিন আয়নাচোখ ধরলে চাঁদ চলে যায় ঘরের ভেতর। চাঁদ কী বলে তাকে, আকলিমাকে? চাঁদ কী বলে রাতে, আঁধারে? আকলিমা বাইরে এলে তারা গরুর খুরপাচাঁদের দিকে তাকায়, আর দুজনেই হাসে নীরবে, আর দুজনেই তারা তাদের আয়নাচোখের ভেতর শিশির ঝরতে দেখে। তখন, অনেক অনেকদিন পর তারা তাদের শিশিরচোখের ভেতর গরুর খুরপাচাঁদের জ্যোৎস্নায় জীবনের এক অবলম্বন গড়ে তোলে। তাদের মনে হয়, তারা তাদের চারটি শিশিরচোখের সেই দৃশ্যাবৃত আহ্বান, সেই দৃষ্টিবিন্দু বিস্ফারিত, সজীব, প্রশ্নকাতর, উজ্জ্বল, সুদূর—অপরিমেয় তার আকর্ষণ, দুর্বার তার সমর্পণ। তারা তখন শিশিরচোখে খুরপাচাঁদের জ্যোৎস্নার ভেতর পুকুরপাড়ে বসে। ঘাসে ঘাসে শিশিরের অনুভূতি তাদের শরীরে ছড়িয়ে গেলে চটুই লুঙ্গির ট্যাঁকে গোঁজা ছোট্ট আয়না বের করে। সে আয়না ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুকুরের স্থির পানির অতল থেকে চাঁদের প্রতিফলন তুলে আনে আকলিমার মুখে, চিবুকে। আর চটুই কী যে অবাক! আকলিমার মুখে চিবুকে আধখানা চাঁদের প্রতিফলনে সে দেখে মৃদু জ্যোৎস্নায় সেই মুখ ভাঙা মন্দিরের দেয়ালে প্রাচীন ভাস্কর্য হয়ে আছে। সেখানে আকলিমার নীলাভ চোখনাকমুখে আশ্চর্য মুথা ঘাসের গন্ধ নিশ্চুপ। চটুই চুপেচুপে একপা একপা প্রবেশ করে মন্দিরে। আলো নীরব। বাতাস নীরব। ভাস্কর্য ফুঁড়ে ঘাসলতাপাতা নীরব। ধুকধুকে ধূসর টিকটিকি নীরব। মনে হয়, তার পায়ের চাপে নীরবতা ভেঙে যাচ্ছে, ভাস্কর্য হারিয়ে যাচ্ছে; তখন চাঁদতারার আলো অচেনা মনে হয়। সে বেরিয়ে আসে মাঠে, দেখে তাদের জীবনে গরুর খুরপাচাঁদের ধূলিজ্যোৎস্না ঘাসের গন্ধে গোধূলি হয়ে আছে। এত বিকেল, এখন, এই রাতের ভেতর বিস্তীর্ণ! এত গোধূলিধূলি এই সমুজ্জ্বল রাতে জ্যোৎস্না হয়ে ঝরে! এত খড় এই খুরপায়ের ভেতর নিথর হয়ে আছে! এখন তারা, তবে, এই খুরপাচাঁদের গোধূলি নিয়ে বিকেল নিয়ে রাত নিয়ে আয়নার ভেতর নিশ্চুপতা নিয়ে চৈত্রের ভেতর অঘ্রানের ভেতর আষাঢ়ের ভেতর সম্পর্কিত হচ্ছিল। চাঁদতারা কুড়িয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ রাতের আবছা আঁধার কুড়িয়ে আয়নার ভেতর তাদের নিশ্চুপতা সমস্ত কথার অন্তহীন উৎস হয়ে থাকে। তখন, একদিন আকলিমা জানতে চায়, এই আয়না সে কোথায় পেল? এই প্রশ্নকাতর দৃশ্যে চটুই কী বলবে, সে হাসে মেঘের নিঃশব্দে, সে ঘাসের ফুল ছেঁড়ে রাতের গন্ধে। চটুই ভাবে, তাই তো! এই আয়না সে কোথায় পেল? তখন সে আয়নায় গরুর খুরপাচাঁদের আলোছায়ার তরঙ্গ থেকে কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুলের গুচ্ছ তুলে এনে আকলিমাকে দেয়। তার ভালো লাগে এই খেলায়।
কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুলের ঘুম ঘুম ছায়ার ভেতর চটুই গরুর পাল নিয়ে মাঠে যায়। মাঠ তার পায়ের নিচে, মনে হয় পৃথিবী তার খুরপায়ের নিচে। গরুর খুরপায়ে মাঠের ধূলি উড়ে উড়ে চলে যায় তার আঙুলশূন্য গোল পায়ের ভেতর। এইসব ধূলির অনুভূতি নিয়ে গরুর পালের সঙ্গে ঘাসের ভেতর সোনালি খড়ের ভেতর সে গড়াগড়ি দেয়। গড়াগড়িতে তার ভালো লাগে। আর ভাবে, তাই তো! এই আয়না সে কোথায় পেল? কোথায় পেল সে এই আয়না? এই প্রশ্নকাতর দৃশ্যের ভেতর কৌতুক তৈরি হলে সে ভাষা হারিয়ে ফেলে, তার পায়ের ভেতর দু-একটি শব্দ বাক্যের ব্যাকুলতায় উৎপাত করে; চটুই এই ব্যাকুলতার ভেতর গড়াগড়ি খায়, গড়াগড়ি হাসে। ট্যাঁকে গোঁজা আয়নার ভেতর সে উড়তে থাকে।
তখন, সে গরুর চোখের দিকে তাকালে, তার বন্ধু আবদুল দেখে যে, চটুই গরুর আয়নাচোখের ভেতর উড়ছে আকাশে। চটুই আকাশে ওড়ে আর নীল নীল মেঘ উড়ে ছায়া ছায়া নরম নীল আলো ছড়িয়ে পড়ে। চটুই আকাশের অনেক দূর উড়ে গেলে তাকে একটা নীল পাখির মতো দেখায়। গরুর আয়নাচোখের ভেতর চটুইকে এভাবে উড়তে দেখে আবদুল তাকে ডাকে, বলে—ভুদাইয়ের হলু কী, নেইমি আয় ভুদাই! চটুই নেমে আসে, আর তারা দেখে তাদের গরুগুলো সোনালি খড়ের ভেতর গোল হয়ে হেঁটে চলেছে অন্তহীন। চলমান গরুদের গোল নাচ যেন প্রাচীর। গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে তারা পৃথিবীর আড়াল তৈরি করে নাচের প্রাচীরে। সেটা যেন গরুদের রাষ্ট্র, তাদের উপনিবেশ। গরুপ্রাচিরের ভেতর চটুই কোনো ছুঁচোপার্টিপুলিশ দেখে না; দেখে অজস্র রঙিন প্রজাপতি মুগ্ধ পাখা দুলিয়ে উড়ছে দূর নীলাভ্রে, তাদের রংবেরঙের পাখার ঢেউ মেঘ থেকে নেমে আসছে গরুপ্রাচিরের উপর, আবার উড়ে যাচ্ছে দূরে। বাইরে তারা, দুই বন্ধু। তারা চায় গরুদের গোল প্রাচীরের ভেতর ঢুকতে। তাদের মনে হয়, গরুদের এই নাচপ্রাচীরের ভেতর লুকিয়ে আছে নদী, পাহাড়, বনবাদাড় আর জ্যোৎস্নার জাদুঘর।
গরুদের গোল নাচ চটুইয়ের শরীর ও আঙুলশূন্য পায়ের ভেতর ঢুকলে সে পৃথিবীর প্রাচীন জনপদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুরপায়ে সে হাঁটে অন্তহীন বনবাদাড়ে; নদী, পাহাড় আর ঝিকিমিকি তারার ভেতর। আবদুল তখন চটুইকে ধাক্কা দিলে সে আকাশ থেকে গড়িয়ে পড়ে একটা শুকনো খড়ের অভিমান নিয়ে। আয়নার ভেতর থেকে নেমে আসে নিস্তব্ধ দুপুরে। সে বলে, স্বপ্ন দেখা কি দুষের? তার কথা শুনে আবদুল হেসে গড়াগড়ি—স্বপ্ন দুষের কী রে ভুদাই। আবদুল এক খেলা আবিষ্কার করে; স্বপ্নদোষ শব্দটি সে কত কত বার উচ্চারণ করে যে, এই খেলার কৌতুকে চটুই স্বপ্নের ভেতর আকলিমার কথাই ভাবছিল—সোনালি খড়ের গন্ধে আকলিমা ভরপুর, তাকে দুপুরের ঝাঁঝাঁ রোদের মতো মনে হয়, অথবা সে যেন গরুর ডাকের মতো হাসি হাসি। খেলার ভেতর এইসব স্বপ্নের রাজ্য বিস্তৃত হলে চটুই দেখে ঘুরতে থাকা গরুদের গোল প্রাচীরের ভেতর সোনালি খড়ের জঙ্গলে একটা গাভিন গরু চার পা টানটান করে মাঁআঁড়ঁড়ঁড়ঁ—আঁড়ঁড়ঁড়ঁড়ঁ ডাকে; আর তার শরীরের ভেতর থেকে বের করে দেয় তুলতুলে একটা বাছুর। চটুই দেখে আকলিমাকে নিয়ে তার স্বপ্নের ভেতর জন্ম নেওয়া ধূসর ধূলি রঙের বাছুরটা টলমল উঠে দাঁড়াচ্ছে। দেখে আনন্দ হয়, সে গড়াগড়ি দেয়, তখন, আবদুল বলে—সে কীভাবে ওড়ে আকাশে? চটুই এইসব প্রশ্নকাতর দৃশ্যে নির্বিকার; এবং সে ভাবে, তাই তো! কীভাবে সে ওড়ে আকাশে? সে কি ওড়ে গরুর ডাকের ভেতর, গরুর খুরের ভেতর? সে কি ওড়ে আকলিমার বুকের ভেতর, বুনো গন্ধের ভেতর? সে কি ওড়ে কচুরিপানা ফুলের ভেতর? আবদুল উড়তে শেখেনি কেন? কেউ কি উড়তে পারে? মানুষ কেবল দৌড়ায়। ছুঁচোপার্টিপুলিশ দৌড়ায়। এমন একটা ছবি বিবিধ গন্ধের ভেতর দৌড়ে গেলে দেখল বিকেল ফুরিয়ে যাচ্ছে। ধুলোর ভেতর ফুলপাতা আঁধারের গান গাইছে।
সোনালি খড়ের মাঠে বিকেল নেমে এলে চটুই আর তার বন্ধু আবদুল গরুর পাল নিয়ে বাড়ি ফেরে। চটুইয়ের কোলে মানবশিশুর মতো নতুন বাছুর। তার চোখেমুখে ধূলিজ্যোৎস্নার আনন্দ হলে সে রাতের পুকুরে স্থির পানির ভেতর চাঁদতারার ছবি অনুভব করে। রাতের সকল আঁধার ছুঁয়ে পুকুরের জলে চাঁদতারা ফুটলে সে বলে—এই নাও চাঁদফুল আকলিমার কপালে, এই নাও চাঁদফুল বাছুরের কপালে। অতঃপর তাদের দুজনের রাতের ভেতর নতুন বাছুর অনিবার্য এক সম্পর্ক গড়ে তোলে। হয়তো একদিন, দুইদিন, তিনদিন অথবা অনেক অনেকদিন ধরে কলপাড়ে বাসনমাজার শব্দ তৈরি হচ্ছে, বাছুর লাফিয়ে ভোরের অদ্ভুত ধ্বনি উন্মোচন করছে। অথবা পুকুরে আকলিমার স্নানের শব্দ আসছে, বাছুর দৌড়ে এল ধ্বনিগুঞ্জনের আনন্দে। চটুই তখন হয়তো দেখছে জলের শব্দের মতো বাছুরের শিশু মাথা টলমল করছে কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুলের শীর্ষে। তখন হয়তো আকলিমা কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুলের গুচ্ছ বাছুরের গলায় স্পর্শ করে আর বাছুর নাচে তিড়িংবিড়িং। তার নাচের বিন্যাস দৌড়ে যাচ্ছে আকন্দ কিংবা বনতুলসীর ঝোপে। তার নাচের ছন্দ দুলছে চাঁদের শীর্ষে। চটুই বলে বাছুর তুমি গান হও, সুরের শীর্ষে। আকলিমা বলে বাছুর তুমি চাঁদ হও, আয়নার শীর্ষে। বাছুরকে চটুইয়ের বাড়ি মনে হয়। বাছুরের লাফে সে স্থাপত্যবিদ্যার শব্দকোষ শিখছে। বাছুরকে তার বাড়ি মনে হলে সে সেসব বাস্তুকলার ভেতর নিরাপদ ঘুম দেখে, বাসনমাজার শব্দ দেখে, ভাতের উষ্ণ সানকি দেখে। এসব মুগ্ধতার ভেতর গোপন এক গ্রাম তৈরির চোখধাঁধানো উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তখন তাদের মনে হয়, নির্বাক পশুর চঞ্চল জীবনের ভেতর তাদের স্বপ্নকল্পনার বিস্তার ঘটে চলেছে আর তারা এই পশুর আচরণের ভেতর বসবাসে ক্রমশ সহজ ও স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছে। দিনের আলোয় পুকুরপাড়ে আমকাঁঠালজামতালের ঝোপজঙ্গলে বাছুর লাফিয়ে লাফিয়ে গেলে আকলিমা হাড়িপাতিল মাজা ফেলে ছুটে যায়, বাছুরের গলা জড়িয়ে ধরে; সে যেন চাঁদবালিকা—কোমল চাঁদতারাফুলের মালা ঝুলছে বাছুরের গলায়। সেখানে গাছের ডালপাতার ছায়ায় কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুলগুচ্ছকে, ফুলের হাসির ভেতর পতঙ্গ ও প্রজাপতিকে, পতঙ্গ ও প্রজাপতির রঙের ভেতর ফুলের প্রস্ফুটিত রেণুসমূহের উদ্ভবে নীল নীল নীল নীল ছায়াকে গাছগাছালির সবুজ নিস্তব্ধতা দেয়। মেহেরকুলের লোকের এইসব দৃশ্যে বিস্ময় হলে তাদের মনে হয়, গরুর জীবনই এক সৌন্দর্য বটে। এবং একদিন চটুই নারকেল পাতার সিতাপাটি কণ্ঠহার বানিয়ে বাছুরের গলায় বেঁধে দিলে লোকেরা দেখে ওই সবুজ পাতার ফাঁকে জেগে থাকা জ্যোৎস্নায় আকলিমার হাতে গলায় নারকেল পাতার বাজুবন্দ আর সিতাপাটি কণ্ঠহার। তখন তাদের ঈর্ষা হয়। তাদের বিস্ময়ের ঘোর কেটে গেলে তারা গরুর বাছুরের সঙ্গে এই যুবক-যুবতীর সম্পর্ক আবিষ্কার করে।
গল্পের হাড়গোড় বিস্তৃত হতে থাকলে চটুই হয়তো তখন খড়ের বিন্যাস নিয়ে ভাবছিল, অথবা দেখছিল বাছুরের নাচের ছন্দ। এবং তখন সে দেখে তার আয়নার ভেতর কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুলের গুচ্ছ তার আর আকলিমার মুঠোর বাইরে চলে যাচ্ছে। দূরে। ভাসছে। হাওয়ায়।
মেহেরকুলের লোকেরা দ্বিতীয় অথবা চতুর্থ অথবা পঞ্চম দিন ছুলায়মানচিয়ারমেনের কাছে তাদের আবিষ্কারের গল্পগাছা বলে, তাদের বিস্ময়ের কথা বলে এবং গল্পের হাড়গোড় বিস্তৃত হতে থাকলে চটুই হয়তো তখন খড়ের বিন্যাস নিয়ে ভাবছিল, অথবা দেখছিল বাছুরের নাচের ছন্দ। এবং তখন সে দেখে তার আয়নার ভেতর কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুলের গুচ্ছ তার আর আকলিমার মুঠোর বাইরে চলে যাচ্ছে। দূরে। ভাসছে। হাওয়ায়। ফুলগুচ্ছ ধরতে গেলেই সরে যাচ্ছে। দূরে। হাতের বাইরে। ভাসছে। হাওয়ায়। ফুলগুচ্ছ ছুঁতে গেলেই উড়ে যাচ্ছে। দূরে। ছায়ায়। ভাসছে। হাওয়ায়। ভাসমান ফুলগুচ্ছের নীলচেবেগুনি ছায়া তাদের শরীরের সঙ্গে তখন ফুলগুচ্ছ ছোঁয়ার অধিকার হারালে আকলিমা অশ্রুজলধৌত চোখে দেখে সে পৃথিবীর বিলুপ্ত আলোর শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। আর চটুই নীলচেবেগুনি ছায়ার স্তিমিত অন্ধকারে চলে যাচ্ছে আয়নার ভেতর কঠিন জ্যামিতিক জগতে। তাদের ভয় হয়। চাঁদতারা মরে যায়।
মৃত নক্ষত্রের অভিমান দৌড়ে গেলে চটুই দেখে কোথাও কেউ ঘুম ঘুম গান গাইছে কান্নার সুরে। ঘুম ঘুম গানের কুয়াশা তাকে জড়িয়ে ধরে। তার মন আর্দ্র হয়ে আসে। সে কি কান্না করবে? বাছুরের নাচের ছন্দে আকলিমা না এলে নারকেল পাতার বাজুবন্দ আর সিতাপাটি কণ্ঠহার সে কোথায় রাখবে? সে ভাবল, পাতারা কেন আত্মহত্যা করে জ্যোৎস্নায়? কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুলও কি আত্মহত্যা করে ছায়া হয়ে গেছে চাঁদের আলোয়? নিজের শরীরটাকে তার মনে হয় অশ্রুজলধৌত পুকুর। সেখানে অজস্র অশ্রুর ফোঁটা সমুদ্র হয়ে আছে। সে তার শরীরপুকুরে দেখে মৃত প্রজাপতি, মৃত জোনাকি, মৃত চাঁদতারা আর তার শিশুকালে মরে যাওয়া মায়ের জলজ চোখ—তাকে ডাকে। কিন্তু সে একা কীভাবে নামবে পুকুরে, আঙুলশূন্য পায়ে, চাঁদতারার ঢেউয়ে। তৃতীয় শ্রেণি পাস চটুই পৃথিবীর এত আঁধার ঠেলে কতদূর যাবে—বহু দূর দূর পথ-পুকুর-মাঠের প্রাচীন সময়ের ভেতর একা যাওয়া-আসা এবং খুরপায়ের ধূলিগোধূলির নরম ছায়া ছায়া অস্তিত্বের সঙ্গে সে দূরত্ব অনুভব করে। তার ভয় হয়। আঙুলশূন্য খুরপায়ে ধূলিজ্যোৎস্না ভ্রমণে গরুদের সভ্যতা তার মাথার ভেতর বিবিধ কান্নার গান তৈরি করল। কান্নার ছায়ায় ছায়ায় চুরমার বাজুবন্দ আর সিতাপাটি কণ্ঠহার সে ভাসিয়ে দেয় শরীরপুকুরে। অথবা সে হয়তো দেখে নিশিবাদুড়েরা উড়ে যাচ্ছে তার নিদ্রাহীনতার ভেতর। দেখে শরীরপুকুরের ঢেউ ভেঙে দিচ্ছে চাঁদতারাফুল।
ঘুম ঘুম বিষাদ নিয়ে সে আজ মাঠে যাবে, কাল মাঠে যাবে, পরশু যাবে মাঠে, অনেক অনেক কাল সে যাবে মাঠে। আলো না ফুটতেই। আঁধার-আঁধার। আজ আঁধার থাকুক এখানে। এই উঠানে। শরীরপুকুরে। ঘাসে। সে ভাবল, আঁধারের প্রহেলিকা ছড়িয়ে যাক পৃথিবীর ধূলিপথে, মাঠের চাঁদতারায়। সে চায়—আঁধার থাকুক সরকারি বালক বিদ্যালয়ে আর তার বন্ধু আবদুলের চোখে। দুঃখগুলো নারকেল পাতা মনে হয়। বিষাদগুলো কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুলের গুচ্ছ মনে হয়। আর আবদুলের চোখ নির্দয় অন্ধ হয়ে যাক। যদি সে বন্ধু, তবে সে কেন জানে না তার মন; সে যদি বন্ধু, তবে কেন জানে না তার দুঃখ। এখন চটুই ভাবল—আঁধারে সে কুড়াবে খড়ের গন্ধ, শিশিরের পথ ভেঙে সে যাবে দূরে। আর সে আঁধারে তুলে নেবে চাঁদের প্রতিফলন, নারকেল পাতার বাজুবন্ধ আর সিতাপাটি কণ্ঠহার। আঁধার থাকুক আঁধারে, আঁধারে সে কুড়াবে আঁধারের নিঃশব্দ—একা। তবু একা একা ভীষণ দুঃখের অনুভূতি তার পায়ে জড়িয়ে গেলে সে পুনরায় দেখে কঞ্চিঘেরা চাঁদতারা—নিস্তব্ধ। তবে সে আজ মাঠে যাবে বিষাদ নিয়ে, ভাতের সানকি সে ছোঁবে না। গরুর খুরের বিস্ফারিত চাঁদ পড়ে থাক কঞ্চির গায়ে।
তখন নাতিশীতোষ্ণ একটা দিন চলে যায়, দুইটা দিন চলে যায়, তিনটা দিন চলে যায়, অনেক অনেক দিন লুপ্ত হলে বিকেলের খুরপাধূলির গোধূলিদিগন্তে রাত আসে। প্রতিদিন রাত, তখন এবং এখনও। এখনও, কেবল এখনই বা কেন, তখন রাত্রির গভীরে পৃথিবীর নিশ্চুপ নক্ষত্রেরা দেখে চটুইয়ের নতুন বাছুর তিড়িংবিড়িং নাচতে নাচতে ভেঙে দিচ্ছে পৃথিবীর তিন ভাগ জলে চাঁদের শরীর। বাছুরের পায়ের ছোটো কচি খুরগুলো নেচে নেচে ঘাসের জ্যোৎস্না ভেঙে চাঁদতারা ভেঙে আকলিমার পায়ের গন্ধ ছুঁয়ে ছুঁয়ে কঞ্চির বেড়ার কাছে যায়। সে মাথা নাড়ে চটুইয়ের মতো। বাছুরের গলায় নারকেল পাতার সবুজ সিতাপাটি কণ্ঠহার মৃদু বাজে ঝু-ম-ঝু-ম। বাছুর চটুইয়ের শোক ভুলিয়ে দেয় ঝুমঝুম, বাছুরের তিড়িংবিড়িং নাচ তাকে নিয়ে যায় জ্যোৎস্নায় ঝু-ম-ঝু-ম। কচি খুরপায়ে বাছুর লাফায় ঝুমঝুম, চটুই মন খারাপ নিয়ে নেমে আসে জ্যোৎস্নায়। রাত বাছুরের খুব প্রিয়—সে জাগে চাঁদের সাথে সাথে। জ্যোৎস্নায় সে নাচে—চটুই চোখ মেলে বসে থাকে বাছুরের নাচের ছায়ায়। বাছুর একবার নাচে, দুইবার নাচে, তিনবার নাচে—তার নাচের শব্দে তবু চাঁদ নির্বাক। সে চারবার নাচে, পাঁচবার নাচে—তার নাচের শব্দে তবু কঞ্চির বেড়ার ফাঁকে চাঁদ ওঠে না। তখন আঁধারপ্রহেলিকায় চটুই দেখে বাছুরের নাচের শব্দে কান্নার অবিরাম ধ্বনিপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বাছুরের কচি খুরের নাচ চটুইয়ের আঙুলশূন্য পায়ের অনুভূতির ভেতর দেখে লাল খুরপাচাঁদের আর্তনাদ। তখন, বাছুর দূরে যায়, দূরে দূরে ঘুরে আসে পৃথিবীর সকল চাঁদ নিয়ে; দূরে যায়, দূরে দূরে রেখে আসে সোনালি খড়ের বিন্যাস। একদিন সে যায় দূরে, দুইদিন সে যায় দূরে দূরে, তিনদিন সে যায় আরো দূরে দূরে দূরে। দূর তার কচি খুরপায়ে সহস্র ধূলিকণা জড়িয়ে দিলে পৃথিবীর সকল দূর চটুইয়ের আয়নার ভেতর আঁকা হয়ে যায়। তবু পৃথিবীর সকল দূর বাছুরের কচি খুরপা শোনেনি, বোঝেনি। দেখেনি সে পৃথিবীর দূরতম রক্তস্রোত। বাছুর তখন পৃথিবীর দূরতম আঁধারে তিড়িংবিড়িং নাচে গেলে চটুই তাকে দেখে না, সে তখন ঘাসের জ্যোৎস্নায় আকলিমার পায়ের গন্ধ ছুঁয়ে ছুঁয়ে কঞ্চির বেড়ার কাছে যায় বাছুরের খোঁজে। না কি সে গিয়েছিল দূরতম কোনো অস্ফুট শব্দের খোঁজে? কঞ্চির বেড়ার ফাঁকে আয়নায় চাঁদের প্রতিফলন ফেলে সে তাকায়। বেড়ার ফাঁকফোঁকড় দিয়ে ভেতরে চলে যায় বিন্দু বিন্দু চাঁদতারার শুকনো জমাট রক্তের মতো কালচে লাল জোনাকি, আর চটুই দেখে বিন্দু বিন্দু আলোয় বঁটির মতো আকলিমার ঝকঝকে শ্যামলা শরীর ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে আঁটিআম গাছের ডালে ঝুলন্ত একটা কালো বাদুড়।
বাদুড়ের কী গৌরব যে সে হয় নাচ হত্যার অন্ধকার, বাদুড়ের ডানায় কী সুরের প্ররোচনা যে সে হয় ছুঁচোপার্টিপুলিশের বাঁশির গন্ধসাম্রারাজ্য, বাদুড়ের বাক্যে কি অদ্ভুত ছায়া যে সে হয় একটা তীব্র ধর্ষণ।
চটুই ভিড়ের কথায় ভাবছিল। আর তখন রক্তাক্ত চাঁদতারার মোমদানি শিশিরচোখে জমা হলে তার মাথা রক্তে ভেসে যাওয়া শামসুজ্জোহা পার্ক হয়ে গেছে। সেইসব রক্তমাখা ছবি আড়াল করতে সে ভাবল দুঃখ নিরাময়ের কোনো গান আছে? বুকের ভেতর সে আয়না নিবি/ গয়না নিবি/ হিমানি নিবি/ চিরুনি নিবি গানের সুর খুঁজল। নিস্তব্ধতা। অন্ধকার। তার মনে হল, সুর কি আমাদের শোক নিরাময়ের চিকিৎসা! সুর খুঁজে না পেয়ে সে চোখ বন্ধ করে। নিস্তব্ধতা। অন্ধকার। অন্ধ মন এখন আলো দেখুক। আয়নার সুর দেখুক। অন্ধের পৃথিবী কেমন? অন্ধ মানে কি তবে নিñিদ্র রাত; সূর্য নেই, কেবল অন্ধকারের স্থির স্তব্ধতা? আয়নাকে তার আশ্চর্য মোমদানি মনে হল। আকাশজুড়ে হাজার হাজার মোমদানি নিভে যাচ্ছে। আমগাছের নিচে যেন হাওয়ার ঘূর্ণি পাক খেয়ে খেয়ে বালিঝড় উড়িয়ে আনছে। হাওয়ার ঘূর্ণাবর্তে শুকনো পাতা তার চোখেমুখে চাবুকের মতো আছড়ে পড়লে মাথার ভেতর ছবির পর ছবি টুকরো টুকরো আগুনের ফুলকি জ্বলে ওঠে। তখন আয়নার ভেতর মোমদানির আলো প্রতিফলিত হলে ছাইভস্ম হয়ে যাওয়া মেঘে মিশে যাওয়া রাতের ঘুম ঘুম ছবির হাড়গোড় জাগ্রত হচ্ছিল। দেখল অন্ধের নিরাময়হীন অন্ধকার বাছুরের কচি কচি খুর ছুরির তীব্র এক কোপে কেটে দুই টুকরো করছে।
মাথার ভেতর একটা রাত ভেঙে পড়ে। সে দেখল ছুঁচোপার্টিপুলিশ দুড়–মদাড়াম ধ্বংস করে চলেছে বইপত্র ঘুমিয়ে থাকা বড়ো বড়ো ঘরবাড়ি, প্রাচীন স্থাপত্যবিদ্যার শব্দকোষ, চিন্তার বিবিধ হাড়হাড্ডি, গুহাশিল্পের লুব্ধ দেয়াল, জ্যোৎস্নার জাদুঘর, উদ্বাস্তু নদীর ধুলোবালি, পথঘাটের গল্পগাছা, আত্মীয়প্রবণ জড়াজড়ি বৃক্ষ, অথবা গোপন অশ্রুর মতো গরুর স্বপ্নের ভেতর ডুবে থাকা পৃথিবী। এতসব ধ্বংসযজ্ঞের ভেতর ভীত জোনাকিরা উড়ে আসে ঝাঁক বেঁধে। এক ফুৎকারে মোমদানি-নেভা অন্ধকারে বাদুড়ের কালো কালো ডানা চাঁদতারা খেয়ে ফেলে। মর্তলোক, সৌরলোক, রাষ্ট্রলোক, পরলোক, আপনলোক, আলোলোক, আঁধারলোক ঢেকে যায় কালো কালো ডানার ঘূর্ণিতে। কালো বাদুড়েরা আকলিমাকে ছিঁড়ে খেয়ে পালালে পুকুরের চারপাশে যজ্ঞডুমুর, মান্দার, শেয়ালকাঁটা আর ধুন্দল ঝোপের ভেতর চটুই পথ হারিয়ে ফেলে। বাসনমাজার শব্দ হারিয়ে ভয়ের ভেতর সে কতদূর যাবে পৃথিবীর পথে? আঙুলশূন্য পা নিয়ে সে কীভাবে যাবে বাছুরের স্থাপত্যবিদ্যায়? আঙুলশূন্য পায়ের লাফে সে কতদূর যাবে ছিন্নভিন্ন ছেঁড়াখোঁড়া শরীরের রক্তপাত থেকে দূরে? কারা পালিয়ে গেল চাঁদতারা ভেঙে, চাঁদতারা খেয়ে, কালো ডানার আগুন উড়িয়ে। তার তন্দ্রা এসেছিল অথবা কেবলই নিরবচ্ছিন্ন জাগরণ। হয়তো অনেক অনেক দিন সে তন্দ্রা ও জাগরণের মধ্যে। ঝুলছে। একটা মৃত ফড়িং। সে এসব ছায়ারক্তের ভেতর হারিয়ে ফেলে সকল কথা, সকল গান, সকল কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুল। এই প্রথম তার মাথার দুলুনি স্তব্ধ। সে চিৎকার করেছিল শুধু। চিৎকার করেছিল। চিৎকার করেছিল।
চিৎকারে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ উন্মাদ একপাল সিংহকে সে যেন দাবড়ে চলেছিল। কালো ঘাসের ভেতর তীব্র উদগীরণে ফুটছিল বাছুরের খুরপায়ের টাটকা রক্ত। চামড়া ছাড়ানো লাল টকটকে বাছুরটা একটা রক্তাক্ত চাঁদতারার অগ্নিকু-, আকলিমার শরীর ছিঁড়ে আছড়ে পড়ে। দুর্দমনীয়। দুদ্দাড়। অথবা চটুইয়ের মনে হল সেই দুর্দম আগ্নিরক্তশিখা মাংসপিণ্ডটাই আকলিমা। তারা করা, কারা তারা—চিবিয়ে খেয়েছে কচি খুরগুলো, গর্দানের নরম হাড়গোড়!
চটুইয়ের শরীর তখন বাতাসের শূন্যতায়, আলোর মতো হালকা। নিস্তব্ধ। সে হয়তো কিছুই দেখেনি। তখন, সে হয়তো অন্ধ ছিল কি? অন্ধের পৃথিবী কেমন? অন্ধ, তবুতো তার শ্রবণ জেগে আছে, তার কণ্ঠ জাগরণের উত্তেজনায় কাঁপছে। তার ঘুঘনিওয়ালার কথা মনে পড়ে, সে তো জাদুকর। তার বন্ধু আবদুলের কথা মনে পড়ে, সে তো শরীরের বিস্ময়। তার বুকে তিতকুটে লালা জমতে থাকে, অচিন ব্যথা হয়। লালা উঠে আসে জিহ্বায়। হয়তো বমির তীব্র বেগ উপেক্ষা করে শীত শীত ঠান্ডা স্রোতে কারো দরগলমান পায়ের আওয়াজ শোনে। লোক জড় হয় ঘুটঘুটে মেঘ চিরে। লোকেরা তাকে জিজ্ঞেস করে ঘটনা কী? কী করছিল সে এই অন্ধকারে? সে কি ছুঁয়েছে চাঁদের শরীর? ছুঁয়েছে তার দাঁত, জিহ্বা, রক্ত? আয়না কোথায় পেল? কার আয়না? আয়না কি শাড়িব্লাউজ হত্যার স্মৃতিফলক? সে কি ঢুকেছিল সুড়ঙ্গে? সে কি কেটে ফেলেছে পুকুর? ঘাসের ভেতর কার পায়ের খুর? কিসের রক্ত লেগে? কোথা থেকে আসে এমন আগুনের ফুলকি? তার চোখের ভেতর আগুন কেন? ছুঁচোপার্টিপুলিশ বলে, ভং ধরো, তাই না! লোকেরা বলে তার পাপ ক্ষমাহীন, বিচারে তার কঠিন শাস্তি হোক।
কী উত্তর দেবে তবে ভেবে না পেলে কোটরের শূন্যগর্ভ চোখে তার কিছুই ঢোকে না এইসব জিজ্ঞাসার। এই প্রথম সে এত এত প্রশ্নের ভেতর হুমড়ি খেয়ে দিশেহারা বোধে সংকীর্ণ। সে অস্ফুটে কিছু বলে, অথবা সে কিছুই উচ্চারণ করে না, হয়তো ঠোঁট দুটো মৃদু অনুকম্পায় থরথর কেঁপে নিথর, হয়তো চটুইয়ের কণ্ঠার হাড়ের ভেতর যন্ত্রণাকাতর বীভৎস আর্তনাদ নিদারুণ আতঙ্কে ফিসফিসিয়ে ওঠে। মেহেরকুলের লোকেরা চটুইয়ের ফিসফিস উচ্চারণের অত্যন্ত নিকটে গিয়ে শোনে, কিন্তু তারা কিছুই শুনতে পায় না, শোনে ঝিঁঝির পাখার ফিসফিস। ছুঁচোপার্টিপুলিশ চটুইকে ধমকে জিজ্ঞেস করে, ধাক্কা মারে এবং তখন, তারা পুনরায় তার ঠোঁটের কাছে শ্রবণ আবিষ্কারে যায়—এতেই তাদের বাহাদুরী। কিন্তু তারা দেখে চটুই নিদারুণ চুপ। তখন, তাকে মারতে মারতে নিয়ে যায়, বেঁধে রাখে গোয়াল ঘরে।
তার হাতের বাঁধন সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং গোয়ালের দরজায় তালা ঝুলিয়ে চলে যায়। চারদিকে আঁধার শরীর ছড়িয়ে দিলে চটুই চোখ খোলে। তার চোখের ভেতর গরুর ঘুমের শব্দ ঢুকে গেলে, চোনা ও গোবরের গন্ধ ঢুকে গেলে গরুর জীবন তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
গোয়ালে চটুইকে বাঁধা হলে সে দেখে ভেতরে ছায়া, ভেতরে আঁধার। সে ছায়াকে বলে, পথ দেখাও। আঁধারকে বলে, শরীর হও। চারদিকে আঁধার শরীর বিছিয়ে দিলে লোকেরা তার হাতের বাঁধন সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং গোয়ালের দরজায় তালা ঝুলিয়ে চলে যায়। চারদিকে আঁধার শরীর ছড়িয়ে দিলে চটুই চোখ খোলে। তার চোখের ভেতর গরুর ঘুমের শব্দ ঢুকে গেলে, চোনা ও গোবরের গন্ধ ঢুকে গেলে গরুর জীবন তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর চোখ বন্ধ করে গরুর মুতের গন্ধ তার শরীরের ভেতর, আর গরুর শরীর থেকে নেমে ঝাঁকে ঝাঁকে এঁটুল তার বুকের পশম খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর উস্কোখুস্কো চুলের ভেতর উঠে এলে চটুই একবার মাঁআঁ—আঁ—আঁ—ড়ঁ-ড়ঁ-ড়ঁড়ঁড়ঁড়ঁ ডাক দেয়। তারপর দল বেঁধে আঙুলশূন্য পায়ে সে চলে গিয়েছে খুরপাচাঁদের ধূলিধূসরিত গোধূলিদিগন্তের পথে মেঘের ওপারে, তাদের নতুন বাছুরের কচি কচি খুরের নাচের শব্দ ও গন্ধের ভেতর সোনালি খড়ের অন্তহীন বিকেলে।
সারাদিন নিরবচ্ছিন্ন ও মন্থর সময়ের ভেতর ধ্বসে পড়া পুরোনো বাড়ির জানালার মতো শূন্যগর্ভ চটুই গোয়ালে দড়িতে বাঁধা গরুর অনুভূতি নিয়ে, তখন, সারাদিন কত কত লোক উঁকি দিয়ে গেছে—একাকী একটা গরু দড়িবাঁধা হাতের কনুইয়ের ভেতর মাথা গুঁজে ঘুমে। অথবা হয়তো কেবল তন্দ্রার নিরবচ্ছিন্ন ঘোর। তখন দুপুরে নিস্তব্ধ রোদে, তখন দিনের ঘুমের ভেতর, তখন দিনের ক্লান্তির ভেতর, তখন দিনের অন্ধকারের ভেতর তার বন্ধু আবদুল আসে—চুপে চুপে। সে নীরবে বন্ধুর পাশে বসে সোনালি খড় আর গরুর গন্ধ নিয়ে। বলে, কী কইরলি ভুদাই। আর বন্ধুর চোখে এখন আয়নাশিশিরের ভেতর চটুইয়ের কান্না আসে, ভীষণ কান্নার বিভীষিকা মর্মে মর্মে তার সমস্ত অনুভূতি ও স্বপ্নকল্পনা ছিঁড়েফুঁড়ে আতঙ্কবিস্ফারিত। এই প্রথম সে কান্নার ভেতর ভিড়ের কথাই ভাবছিল। ভাবছিল কি? না কি, মাঝে মধ্যে নির্বিকার আড়ষ্টে দেখছিল ভিড়ের মুখগুলো। কত কত মুখের জঞ্জাল, কয়টা মুখ সে দেখবে? কত মুখ সে চেনে? সে কি দেখে চাঁদ খেয়ে পালিয়ে যাওয়া মুখ চেয়ারের খোলের মধ্যে উবু হয়ে বসে? সে চিনতে পারে না। মনে হয় চেয়ারে বসা মুখগুলো অনেক দূরের। মুখগুলো ঝড়। বালিঝড়। কালো কালো বিন্দুর ঘূর্ণাবর্ত কুট কুট কাটে তাকে। সে ভিড়ের ভেতর দেখে একজন ধর্মযাজক, একজন বিদ্যালয়-ফেরত বালক, একজন দাঁতের পোকা হত্যার মাজন বিক্রেতা, একজন জুতা সেলাইয়ের কারিগর গোপনে কান্না করছিল। জাদুকর ঘুঘনিওলা চোখে অচিন কোনো অদৃশ্য পোকার অযাচিত প্রণয় ঢাকতে সোনালি খড়ের বিন্যাস দেখছিল সবার দৃষ্টির আড়ালে। চটুই এসব দেখছিল, অথবা সে কিছুই হয়তো দেখছিল না। হয়তো কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুলের গন্ধ অনুভব করছিল আর অস্ফুটে তার বন্ধু আবদুলের মুখ খুঁজছিল। তার বন্ধু আবদুল! আবদুল তার বন্ধু! তার মনে হয় এই একটি মুখই তাকে নিয়ে যেতে পারে পৃথিবীর খুরধূলিপথে। অথবা, হয়তো যারা তাকে নিয়ে যেতে পারে দিগন্তধূলিজ্যোৎস্নার দিকে—দুটি মুখ মনে পড়ে তার। তার মা। আর তার আকলিমা। এবং সে বিস্ময়ে এখন ভাবে আকলিমার নামের ভেতর তার মা মিশে আছে। আকলি মা। আনন্দে তার গড়াগড়ি দিতে ইচ্ছে করে। তখন, সারাদিন মন্থর ও নিঃশব্দে কেটে গেলে, এখন, চটুই মাথা দোলায়। আর ভিড়ের ভেতর আঁধারে তার বন্ধু আবদুল শিশিরচোখে শুনতে পায় চটুইয়ের আয়না নিবি গয়না নিবি গান। অস্ফুট গানের ভেতর চটুই আমগাছের শুকনো স্ফটিক আঠার ঘ্রাণ নিল, উস্কোখুস্কো চুলের ভেতর আকলিমার বাসনমাজার শব্দ পাচ্ছিল আর একটা বিষণ্ন চড়–ই আচমকা ডেকে উঠলে তার ব্যথা নিরাময়ের সুর মনে পড়ল। দেখল ভিড়ের মুখগুলোর ভেংচিকাটা হাসি হারামজাদা হয়ে আছে। তারা ভেংচি কেটে চটুইকে শাস্তি দেয়, আঁধার-আঁধার বাঁশঝাড় থেকে কেটে আনা হলদেসবুজ কঞ্চিগুলো দেখে তাদের অপার আনন্দ হয়। হলদেসবুজ কঞ্চির কী গৌরব যে সেগুলো অলৌকিক বিদ্যুতের জিহ্বায় হাওয়ার ঘূর্ণি লেহন করে। কঞ্চির কী আনন্দ যে রাষ্ট্রের মূঢ় চিহ্নগুলো চটুইয়ের শরীরে গভীর ঘুম আনে। সে কি বাতাসে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে নেবে কিছুক্ষণ? অথবা সে কি এরই মধ্যে ঘুমিয়ে গেছে নীলচেবেগুনি বাতাসের মৃদু তরঙ্গে? আর তার শরীর দুলছে বিচ্ছিন্ন একটা আমপাতার মতো? বাতাসও কি দুর্দমনীয়, পাষাণ? না কি তার চারপাশের ঘণায়মান অন্ধকার পৃথিবী একটা লৌহরোলারের মতো সবকিছু চ্যাপ্টা করে দিতে উদ্যত? জীবন তবে কি অর্থহীনতার মর্মস্পর্শী গোলকধাঁধা? সবকিছু অর্থহীন ও পৈশাচিক মনে হয় তার। অর্থহীন ও ক্রুর। ক্রুর ও বিকট হাস্যোন্মাদ। পৈশাচিক ও বিপন্ন। ঘুম ঘুম চক্ষুরহিত রাষ্ট্রসীমার ভেতর কোথাও জলের মৃদু শব্দ হচ্ছে তখন। অথবা দূরে কোথাও শহরের বেওয়ারিশ ষোলটি নিশিকুকুরের অস্ফুট গোঙানি ভেসে আসে। একান্নটা ঘুম গন্ধমূষিকের অনর্গল বক্তিমা করে, একাশিটা ঘুম ঘুম কুট কুট নখ কর্তনের আনন্দে বাসনমাজার শব্দে ডুবে যায়, একানব্বইটা ঘুম ঘুম ঘুম ঘুম কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুলের গুচ্ছ নিরবচ্ছিন্ন আঁড়ঁড়ঁড়ঁ ডাকে, একশ একটা ঘুম ঘুম ঘুম ঘুম ঘুম ঘুম অতল গভীর আঁধারের উপনিবেশ পাহারা করে।
গরুর খুরপাধূলিজ্যোৎস্নায় আকলিমার মুখ জমা রাখতে রাখতে আবদুল দেখে ঘুম ঘুম চটুইকে নিয়ে যাচ্ছে আঁটিআম গাছের সঙ্গে বাঁধার জন্য। আব্দুলের কী যে হয়—তার বাল্যকাল, তার কৌশোরকাল, তার যৌবনকাল মুহূর্তে তীব্র শীত হয়ে গেল। সে তখন এই প্রাচীন হরিতকি বৃক্ষকে বলে, গাছ আমাদের আশ্রয় দাও। গুছ নুয়ে এলে সে দেখে ঘুম ঘুম চটুই আঙুলশূন্য গরুর খুরপা নিয়ে উবু হয়ে ভিড়ের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার হঠাৎ এই ঘুরে দাঁড়ানো এবং মাথা দোলানো দেখে ভিড় লোকেরা অবাক। তারা দেখে চটুই ধীরে ধীরে তার দুই হাত শরীরের দুই দিকে পাখির ডানার মতো প্রসারিত করছে, তারপর ট্যাঁক থেকে ছোট্ট আয়নাটি উন্মোচন করে চাঁদের প্রতিফলন আনে। এ যেন তার খেলা। তাকে জ্যোৎস্নার জাদুকর মনে হয়। ভিড় লোকেরা দেখে চাঁদের আলোর প্রতিফলনে তাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন। অতঃপর তারা চোখের ধাঁধাঁ কাটিয়ে দেখে চটুই নেই, পড়ে আছে আয়না।
লোকেরা আয়নার ভেতর উঁকি দিয়ে দেখে, প্রাচীন আঁটিআম গাছের শাখাপ্রশাখা আর পাতার নিসর্গে উদ্ভাসিত আধখানা চাঁদের আলোয় উড়ছে অদ্ভুত ধূলিজ্যোৎস্না। এমন ধূলিজ্যোৎস্না মেহেরকুলের লোকেরা আগে কখনো দেখেনি। তারা দেখে, আয়নার ভেতর থেকে ওই নীলাভ ধূলিজ্যোৎস্না শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে, অতঃপর শহর পেরিয়ে সোনালি খড়ের মাঠের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যায় অন্তহীন পথে, দিগন্তের দূরে। আর ওই মৃদু আয়নার ভেতর চটুই মাথা দুলিয়ে গান গাইতে গাইতে হেঁটে চলেছে, আকলিমার হাতে কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুলের গুচ্ছ। তাদের শরীর থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে নরম ঝলমল ধূলিগোধূলির কুয়াশা। আর একটা ঘুম।
কথাসাহিত্যিক, সাহিত্যসমালোচক। জন্ম ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে, মেহেরপুর শহরে। লেখাপড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে। ‘ক্রুশকাঠের খণ্ডচিত্র অথবা অভাবিত শিল্পপ্রণালী’ [২০০৫] প্রথম গল্পগ্রন্থ। ২০১০ সালে প্রকাশ হয় দ্বিতীয় গল্প সংকলন ‘নির্জন প্রতিধ্বনিগণ’। তারপর ‘প্রাণেশ্বরের নিরুদ্দেশ ও কতিপয় গল্প’ [২০১১], ‘জোনাকিবাবুই’ [২০১৮] এবং উপন্যাস ‘ক্রনিক আঁধারের দিনগুলো’ [২০১৪]। সম্পাদনা : ‘মাহমুদুল হক রচনাবলি’ [বাংলা একাডেমি, ২০২০] সমালোচনামূলক বই ‘মাহমুদুল হক : সৃষ্টি ও শিল্প’ [২০২১]।