শনিবার, সেপ্টেম্বর ৭

নগ্নকাল : শামীম হোসেন

0

লম্বা গলা বাড়িয়ে চুপচাপ বসে আছে এক নিরাসক্ত কচ্ছপ। কোনো হেলদোল, কম্পন নেই ওর শরীরে। শুধু তার গলাটা আগ বাড়িয়ে দেখছে কাচের বয়ামে গুঁজে রাখা মানিপ্ল্যান্টের শাদা শাদা শেকড়। আমার দৃষ্টি আটকে ছিল ফুলদানিতে রাখা কলমটার দিকে। ওর দেহের রক্ত-কালি শুকিয়ে গেছে কি না তা একটু পরখ করে নেওয়া দরকার।

তোমাকে তো কচ্ছপটার কথা বলেছিলাম, না কি বলিনি? এই মুহূর্তে তা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। তোমার মনে থাকা না-থাকা হয়তো এই গল্পে প্রয়োজন নেই। পরের কোনো হাঁটন্ত বেলায় তোমার সঙ্গে কচ্ছপ নিয়ে ঘটানো যাবে মহাবিস্ফার।

গভীর রাত্রিবেলায় স্নানঘরে আমার দারুণ মুহূর্ত কাটে। বালতিতে ভরে রাখা ঠান্ডা জল আমি যখন আঙুলে স্পর্শ করি তখন মন শান্ত হয়ে আসে। দেহটা পবিত্র অনুভূতির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে।

স্নানঘরে একে একে পোশাক খুলতে থাকি। নগ্ন হই। ধীরে ধীরে মেঝেতে বসি। একমগ জল নিয়ে মাথায় ঢালি। আমার শান্তি লাগে। শান্তির অলৌকিক পরশে আমি কাঁপতে থাকি। আস্তে আস্তে জল গড়িয়ে কাঁধে নামে। তারপর পিঠ গড়িয়ে, বুক গড়িয়ে নাভি ছুঁয়ে নিচে নেমে যায়। আমি জল ঢালতে থাকি। ঢালতে থাকি। শরীর বেয়ে জল গলগলিয়ে নিচে নামতে থাকে। জলের সঙ্গে গড়িয়ে যায় আমার সকল অনুতাপ। বোধের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে একজন নগ্ন মানুষ।

একমগ জল নিয়ে মাথায় ঢালি। আমার শান্তি লাগে। শান্তির অলৌকিক পরশে আমি কাঁপতে থাকি। আস্তে আস্তে জল গড়িয়ে কাঁধে নামে। তারপর পিঠ গড়িয়ে, বুক গড়িয়ে নাভি ছুঁয়ে নিচে নেমে যায়। আমি জল ঢালতে থাকি। ঢালতে থাকি। শরীর বেয়ে জল গলগলিয়ে নিচে নামতে থাকে।

‘পোশাক কেবল আমাদের কৌতূহল জাগিয়ে রাখে’ জানো তো?

নগ্ন হয়েই আমি ঘরের মধ্যে পায়চারি করি। বসি। জল খাই। ফোর স্কয়ার প্যাকেট থেকে একটা আগরবাতি বের করে তাতে আগুন ধরাই। সুগন্ধী ধোঁয়া দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আমার নাকে এসে জমা হয়। আমি আবার উঠি। পায়চারি করি। পায়ে পায়ে আরশিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তখন নিজেকে আদিম আদমি মনে হয়। দুই পৃথিবীর আয়নাদেয়াল ভেদ করে একটা চিকন সাঁকোর ওপর পা রাখি। সাঁকোটা দুলে ওঠে। দোলায়িত সাঁকো পার হবার জন্য আমার মনের আকুতি বাড়তে থাকে। আমি এক পা বাড়াই, অপর পায়ে থরথর কম্পন জেগে ওঠে।

সাঁকোটা পেরিয়ে আসি। পাথুরে পথের চিহ্ন ধরে সামনে এগিয়ে যাই। নগ্ন মানুষের সন্ধানে আমার চোখ ইতিউতি ঘুরতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে আমার স্নানঘরের মতো একটা ঘর চোখে আটকে যায়। ভেতরে ঢুকি। জল নেই। পাথরের দেয়ালে রক্তমাখা কয়েক জোড়া হাতের স্মারক ও খোদাই করা পশুর শিং আমার দিকে তেড়ে আসে। একটা বাইসনের চিত্র আমার মুখোমুখি দাঁড়ায়। তাকে দেখি। এমন শিল্পনৈপুণ্য আমি আগে দেখিনি।

তুমি কি দেখেছ?

আমার স্নানঘরের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে আরও পথের খোঁজ করি। সামনে আগাই। যেতে যেতে একদল অর্ধনগ্ন মানুষ এগিয়ে আসতে থাকে। তাদের কারো হাতে হাড়ের অস্ত্র, পাথরের কুড়াল, কারো হাতে মৃত হরিণ আর একজন পেটমোটা মহিলার হাতে একগুচ্ছ ফল ঝুলতে থাকে। তারা আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আরেকটু সামনে এগুনোর পর একটা টেপি থেকে একজন মানুষ বেরিয়ে আসে। আমার পথ রোধ করে দাঁড়ানোর ইশারা করে এবং পুনরায় টেপিতে প্রবেশ করে। আমি দাঁড়িয়ে থাকি।

পাথুরে পথে অনেকক্ষণ চলার ফলে পা ছুড়ে গেছে। চামড়া ফেটে রক্ত জমাট বেঁধেছে। খানিক সময় পর মানুষটা টেপি থেকে বেরিয়ে একখণ্ড পশুর চামড়া আমার লজ্জাস্থানে বেঁধে দেয়।

তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গম করতে চেয়েছিলে পাথুরে কোনো পাহাড়ের গুহায়। যার কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া ঝরনার জল। মনে আছে?

স্ফীত স্তন নিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক রমণী। আমার রক্ত জমাটবাঁধা পা টেনে টেনে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। প্রবল আবেগ নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরি। দুই হাতে তার শক্ত স্তনজোড়া ধরে ঝাঁকাতে থাকি। কানের লতির নিকটে গরম নিশ্বাস ছাড়ি। তার নাভিতে চুমু দেবার মুহূর্তেও আমার দেহমনে কোনো শিহরনের রেখা টের পাই না। আমি তার গর্ভাশয় পৃথিবীর আলো-অন্ধকার, জল ও হাওয়ার মধ্যে প্রবেশ করে আমার স্নানঘরের রাস্তাটা তালাশ করতে থাকি।

তুমি কি আমার স্নানঘরের রাস্তাটা একটু বাতলে দেবে?

 

২.
রাতে একটা বেড়ালের বাচ্চা কীভাবে যে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে খেয়াল করিনি। ওর ‘মিঁউ মিঁউ’ ডাকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মনের ভ্রম ভেবে চোখ কচলে আবার শুয়ে পড়লাম। আবার ডাকটা কানে এলো। কোথা থেকে যে ‘মিঁউ মিঁউ’ শব্দের উৎপত্তি তা ঠাওর করতে পারছি না। চরম বিরক্তি নিয়ে আবারও বিছানা ছেড়ে তাকে তালাশের প্রস্তুতি নিলাম।

খাটের নিচে আলো ফেলে দেখি, নেই। শুধু কয়েক বছর পুরোনো চটিজোড়া আয়েশে একে অপরের শরীর জাপটে শুয়ে আছে। এঘর থেকে ওঘর খুঁজেও তার হদিস পেলাম না। আবারও গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আনার কৌশল হিসেবে মুরাকামির বেড়ালটার কথা স্মরণ করলাম। ওর চোখের মণির মধ্যে নিজের চোখ বিলীন করতে করতে চোখের পাতা সবে পড়তে শুরু করেছে অমনি ‘মিঁউ মিঁউ’ ডাকটা কানে বিঁধল। মনে হলো হারামজাদার বাচ্চাকে পাইলে তিনতলার বারান্দা থেকে নিচে ছুড়ে মারব। সে মরুক না বাঁচুক আমার তাতে কিছু যায় আসে না।

‘বেড়ালের বাচ্চার মতো মানুষের বাচ্চাও কি এভাবেই বিরক্ত করে?’ এই কথা ভাবতে ভাবতে বেড়ালকে নজরে আনার চেষ্টা করি। তার আগে ভাবলাম স্নানটা সেরে নিই। নগ্ন হয়ে স্নান করলে নতুন নতুন চিন্তা মাথায় আসে। রুটিনমাফিক স্নান সেরে আরশিটার সামনে দাঁড়াতেই একপলক শাদা লেজ দেখা গেল। তবে লেজটা দেখা দিলো আরশির মধ্যে নয় পাশের টেবিলের কোনায়। বেড়ালটাকে বাগে পেয়ে লেজ ধরে বাইরে আনলাম। বারান্দায় গিয়ে নিচে ছুড়ে ফেলব অমনসময়ে সে করুণভাবে ‘মিঁউ মিঁউ’ করে আমার চোখের দিকে তাকাল। আমার মধ্যে কোত্থেকে যে একখণ্ড মায়াপিণ্ড উদয় হলো বুঝতে পারলাম না। ওকে নিচে ফেলতে ফেলতেও ফেলা হলো না। ভাবলাম আমিও তো সেই বেড়ালের বাচ্চাই। যে কোথাও না কোথাও ‘মিঁউ মিঁউ’ করি।

তবে লেজটা দেখা দিলো আরশির মধ্যে নয় পাশের টেবিলের কোনায়। বেড়ালটাকে বাগে পেয়ে লেজ ধরে বাইরে আনলাম। বারান্দায় গিয়ে নিচে ছুড়ে ফেলব অমনসময়ে সে করুণভাবে ‘মিঁউ মিঁউ’ করে আমার চোখের দিকে তাকাল।

ভোর থেকে সকাল হয়ে গেল। ঘুম হলো না। সবজিওয়ালার কাছে আজও কিছু বাকি নিতে হবে। অর্ধেক লাউ, একপোয়া পটল, সামান্য করলা, আধাপোয়া পেঁয়াজ, দশবারোটা কাঁচামরিচ হলেই দু-চারদিন পেট শান্তিতে থাকবে। সবজি বহনের ব্যাগে বেড়ালের বাচ্চাকে আরাম করে বসিয়ে নিলাম। দোলনার মতো ব্যাগটা দুলিয়ে আয়েশ করে রাস্তায় নামলাম।

বেড়াল দুলছে, আমি হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে একটা শপিংমলের সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। কী চিন্তায় পড়লাম সেটাই উদ্ধার করতে পারছি না। মলের মুখেই আমাকে আটকে দিলো সিকিউরিটি গার্ড। সে ট্যারাচোখে এসির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অসভ্য মানুষের মলে প্রবেশ নিষেধ।’ আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। মাটি ফুঁড়ে তার উদ্দেশে বললাম, ‘লে ল্যাওড়া, মানুষ সভ্য হলো কোনকালে?’ গার্ড কোনো জবাব দিলো না। গেটের উপরে এসির দিকে তাকিয়ে রইল।

সবজিবাজারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে খেয়াল করলাম বহু মানুষই আমার দিকে ‘কেমন করে’ তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ দেখামাত্রই রিকশার হুড তুলে মুচকি হাসছে। কেউ পাশ ফিরে অন্যদিকে মুখ করে চলে যাচ্ছে।

ব্যাগের ভেতর থেকে বেড়ালের বাচ্চাটা ‘মিঁউ মিঁউ’ করছে। ওকে ট্রাফিক ঘরের মধ্যে ছেড়ে সবজির দোকানে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখেই দোকানি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার দিলো, ‘এই মিয়া এইটা কী করছেন, এমন নেংটা হয়ে বাজারে ঢুকছেন।’ আমি নিজের দিকে দেখতেই চমকে উঠলাম। নগ্ন একজন মানুষ কীভাবে বাজারে ঢুকে পড়ল। আমি ওকে বললাম, ‘তাড়াতাড়ি সবজিগুলা দাও।’ দোকানি চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল, ‘যা লিবেন লিয়ে তাড়াতাড়ি ভাগেন।’

সবজির ব্যাগ নিয়ে বাজার থেকে বেরোতেই দেখি রাধাচূড়া রঙের পোশাকপরা এক তরুণীর কোলে বেড়ালের বাচ্চাটা দোল খাচ্ছে। আমি অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলাম। আহারে বাচ্চাটা!

হঠাৎ করে এক অচেনা লোক আমার সামনে এসে দাঁড়াল। কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই চটাস চটাস করে আমার গালে চড় বসিয়ে বলল, ‘শালা মেয়ে মানুষের বুকের দিকে তাকাস ক্যান?’ আমার হাত থেকে সবজির ব্যাগ এক ঝটকায় টেনে ছুড়ে মারল রাস্তার ওপরে। ব্যাগ ছিঁড়ে রাস্তায় গড়িয়ে পড়ল অর্ধেক লাউ, একপোয়া পটল, সামান্য কয়েকটা করলা, আধাপোয়া পেঁয়াজ, দশবারোটা কাঁচামরিচ… আমি সভ্য মানুষগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে সবজিগুলো কুড়াতে লাগলাম এবং পোশাকপরা একেকটা মহান নগ্ন-মানুষ আমার দিকে চেয়ে রইল।

তুমি হয়তো আমাকে মাথা বিগড়ে যাওয়া লোক ভাবতে শুরু করেছ। ভাবছ এ নগ্নকাণ্ডের পর উঁচুস্তরের স্নাতক সমাজে মুখ দেখাবে কীভাবে? তোমার ‘সপাং সপাং’ কথায় সেই কবেই তো আমার পিঠে ফুটে উঠেছে চাবুকের দাগ। কালশিরার নগ্ন ইশতেহার।

আমি শত শত পোশাকপরা নগ্ন মানুষের মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘরে ফিরলাম। পোশাক পরলাম। গভীর রাত নামতেই স্নানঘরে গিয়ে পোশাক খুলে মাথায় জল ঢাললাম। জলের সঙ্গে ধীরে ধীরে ধুয়ে গেল সকল অনুতাপ, অপমান, লাঞ্ছনার ফেনা।

ঘরের ভেতর কয়েক মিনিট পায়চারি করে আরশিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিজের নগ্নরূপ দেখে শিহরিত হলাম। আরশির দেয়াল ভেঙে এক আদিম শহরে নগ্ন আদমি রূপে বসবাস শুরু করলাম।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবিতা ও গল্প লেখেন। লেখালেখির ঝাউবাংলোয় মগ্ন থাকাই তার আরাধ্য। জন্ম ও বেড়েওঠা পদ্মাপারের রাজশাহীতে। জীবন-নির্বাহের জন্য কাজ করেন গণমাধ্যমে। ‘ধানের ধাত্রী’ কবিতাগ্রন্থের জন্য ২০১৫ সালে কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার এবং ২০১৭ সালে ‘ডুমুরের আয়ু’ গ্রন্থের জন্য বিশাল বাংলা সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। তার প্রকাশিত গল্পের বই ‘সান্ধ্য মাংসের দোকান’।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।