নাটুয়ারপাড়া কোনো মিথ নয়; মহাবিশ্বের অনন্ত ভ্যাকুয়ামের ভেতর জাজ্জ্বল্যমান এক আলো। একটা চর। কেউ কেউ মায়াবী বিভ্রম বলেন বটে, কিন্তু এ এক আস্ত রঙিন প্যরাসুট। শোনা যায়, অনেক গল্প জমে আছে এখানে। তবে, কিছু পূর্ণিমার রাতেই জানা যায়— গল্পের বেশ ধরে যা-কিছু আছে, তা কেবলই সত্য।
বিষণ্ন যমুনা পেরোলেই সকলে প্লে করেন একেকটা সত্য ক্যারেক্টারের রোল। হয়ে ওঠেন জাত অভিনেতা। এখানে মানুষের চোখ পড়া যায়— কারো চোখে ভেঙেছে নদী। নাম দিয়েছে সর্বনাশ। কারো চোখে ভেঙেছে ঘর, মন। কারো চোখে মারিজুয়ানার ঘোর। ধরে রেখেছে সমস্ত লাল। বৃষ্টি লেগে আছে কোনো কোনো চোখে— কারণ অজানা। কারো চোখ চলে গেছে বন্ধ হয়ে যাওয়া গানঘরে— সে শিল্পী হতে চায়। এসেছে প্রতিবেশী চর থেকে।
নাটুয়ারপাড়া কোনো মিথ নয়; মহাবিশ্বের অনন্ত ভ্যাকুয়ামের ভেতর জাজ্জ্বল্যমান এক আলো। একটা চর। কেউ কেউ মায়াবী বিভ্রম বলেন বটে, কিন্তু এ এক আস্ত রঙিন প্যরাসুট। শোনা যায়, অনেক গল্প জমে আছে এখানে। তবে, কিছু পূর্ণিমার রাতেই জানা যায়— গল্পের বেশ ধরে যা-কিছু আছে, তা কেবলই সত্য।
খানিক এগোলেই বিস্তর সূর্যমুখী-খেত। পাশ দিয়ে মাথা উঁচুর চেষ্টারত হাতিশুঁড়, ঢ্যাপ্পা, ভ্যান্না গাছ, ঐপাশে লাল পাতাবাহার, করবী। আরেকটা গাছের গায়ের রং লাল, পাতারা সবুজ; নাম জানি না। ওর শরীরজুড়ে ফুল। ফুলের রং জল। খেত পেরোলে পাড়া। পাড়া থেকে খেত ঘুরতে ঘুরতে ভুলে যাওয়া যায় গত হওয়া কাল।
এখানে ফড়িঙেরা দাপটের সাথে দিয়ে যায় বৃষ্টির খবরা-খবর।
০২.
মন ভালো করার লোভে নদীপাড়ে গেলে যমুনার করুণ দশা দেখে মন ভারও হয়ে যায়। পেয়ে বসে নদীর বিষণ্নতা। এই যমুনাই সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছিল। হয়ে উঠেছিল সর্বনাশা। নিজের গর্ভে টেনে নিয়েছে নাটুয়ারপাড়ার সিংহভাগ। দোতলা কলেজ ভবনের কিছু ফার্নিচার আর পানির ট্যাঙ্ক ছাড়া রক্ষা করা যায়নি কিছুই। আশেপাশের পাড়ার বাসিন্দারা নৌকায় করে পার করেছে বাড়িঘর। নিঃস্ব হয়েছে সম্পূর্ণ জেলেপাড়া। সংখ্যালঘুর দল চুপ হয়ে গেছে পূর্বেরও অধিক। ভেস্তে গেছে কত কত পরিকল্পনা! লোকমুখে শোনা যায়— পলিটিশিয়ানের মুদ্রা বোঝাই রঙিন বস্তা ডুবে গেছে কথিত কালো জলে!
নদীতে নৌকা আছে হিসেব ছাড়া। মানুষ পার করে। নিয়ে আসে মালামাল। সারাদিন ঘাটে বসে থাকে এক রহস্যময় চেইন মাস্টার; যার ব্যাগ ভর্তি খুচরো টাকা। মনভর্তি বিষাদ। অনেকে মাছ ধরে। শখের বশে না, জীবিকার তাগিদে। যাদের ঘর খেয়ে গেছে যমুনা— নদী-ই তাদের বাড়ি; নৌকা ঘর। নদীর শিশুরা স্কুলে যায়, মাদ্রাসায় থাকে কেউ কেউ।
সংগ্রাম ওদের নিকটাত্মীয়। একদিন সব ছেড়েছুড়ে ফিরে আসে নদীতে। লুঙ্গির ভাঁজে সস্তা বিড়ির প্যাকেট গুঁজে রেখে মাছ ধরে। বেশি দামের আশায় বেচতে যায় ওপারে। কেউ কেউ টাকা জমিয়ে মাচার উপর দোকান সাজায়। এক নিষঙ্গ সাউন্ডবক্স বেজে যায় দিনরাত। বিরামহীন।
ওরা যমুনার সন্তান। নদী ওদের ছাড়তে চায় না।
০৩.
নাটুয়ারপাড়ায় চাঁদ নিশ্চিন্তে আলো দিতে পারে। এখানে নেই কোনো চোর-ডাকাতের ভয়। আজান ও শঙ্খধ্বনি এখানে রেললাইনের মতো পাশাপাশি চলে। এখানে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না বাবরী-মসজিদ কেন্দ্রিক সহিংসতা কিংবা গুজরাটের দাঙ্গা।
দলবেঁধে পুজোর প্যান্ডেল সাজানো হয়৷ এক অন্যরকম আবহ সৃষ্টি করে রঙিন আলো। বাড়ির বাগান ঘুরে ঘুরে ফুল সংগ্রহ করে ঝলমলে কিশোরীরা। নাচে-গানে মেতে থাকে পুরো মহল্লা। প্রতিদিন পাঁচবার পালিত হয় আজানের বিরতি। উৎসবের আনন্দে আত্মগোপনে থাকে অশুভশক্তি। ভাগাভাগি হয় আনন্দ, দেবীর আগমন, স্বর্গীয় নাড়ু, সবশেষে বিসর্জনের মনখারাপ। প্রায়-বন্ধ-হওয়া বৈশাখী মেলার অপেক্ষায় থাকে পুরো গ্রাম।
রোজায় খাবারের দোকান ঢেকে যায় কালো পর্দায়। এক অদ্ভুত কোমলতা ভর করে সবার মননে।
মানুষেরা বিশ্বাস করে, এদেশ অলি-আউলিয়ার দেশ। সম্প্রীতি, সহনশীলতা সকলের মজ্জাগত। যমুনায় স্রোত বয়ে যায়।
০৪.
সবুজের ছায়ায় এগোতে এগোতে চোখে পড়ে এক পরিত্যক্ত ঘর। ধুলোয় ঢেকে গেছে নামফলক। এখানে রোজ সন্ধ্যায় গান হতো। গানে গানে উন্মত্ত হয়ে উঠত সবাই। সুরের মূর্ছনায় এখান থেকে বহু দূরে থাকত অন্ধকার।
একশ্রেণির মানুষ গানঘরকে অপছন্দ করে। ব্যঙ্গ করে ন্যাকাসুরে ডাকে— গানের মাদরাসা। তাতে নাকি একটু পবিত্র হয়! ছড়াতে থাকে নানান কুৎসা। এসবের মাঝেও তারা গান গায়, আগ্রহী দর্শকেরা আসে। খুশি হয়ে শিল্পীদের হাতে তুলে দেয় সম্মানী। রিউমার তাদের পিছু ছাড়তে চায় না।
চলতে চলতে একদিন থেমে যায় গানঘর। একমাত্র পৃষ্ঠপোষকের অকস্মাৎ মৃত্যুতে। ঘরজুড়ে এখন আরশোলার বাস। অক্ষরের বিষ ঝাড়তে না পেরে ওরা কেটে ফেলে দোতারার স্ট্রিং।
চলতে চলতে একদিন থেমে যায় গানঘর। একমাত্র পৃষ্ঠপোষকের অকস্মাৎ মৃত্যুতে। ঘরজুড়ে এখন আরশোলার বাস। অক্ষরের বিষ ঝাড়তে না পেরে ওরা কেটে ফেলে দোতারার স্ট্রিং।
এইভাবেই একে একে এখানে থেমে গেছে যাত্রাপালা, সার্কাস, বিচিত্রানুষ্ঠান, থিয়েটার। এসবে মেতে থাকাদের বিকেল ও সন্ধ্যারা চলে গেছে এন্ড্রয়েডের স্ক্রিনে।
এসবের মাঝেও এখন পর্যন্ত পিঠ বাঁচিয়ে টিকে আছে আরেকটা গানঘর। ওখানে মুক্তির শ্বাস ফেলা যায়।
০৫.
প্রতারক ঘুম পালালে দাঁড়ানো যায় ইনসমনিয়াক রাস্তায়। হঠাৎ হঠাৎ যে হয়ে ওঠে তুমুল সুইসাইডাল। যেখানে দিনভর চলে মার্বেল খেলা। সিগারেটের টিন পাশে রেখে পাটের বস্তা বিছিয়ে তাস খেলা। দুইএকটা ঘোড়ার গাড়ি যায় আসে নদীর দিকে। ঘোড়ার গাড়ি— শহুরে ঠেলার সাথে এক অভিশপ্ত ঘোড়াকে জুড়ে দেওয়া হয় যেখানে। হাটবারে ধকল যায় খুব।
রাত বেশি নামলে জেনে নেওয়া যেতে পারে রাস্তার গোপন। গভীর রাতে এপথে বহুদূর যায় যাত্রীবিহীন একলা ঘোড়ার গাড়ি। আপাতদৃষ্টিতে তেমন কিছু মনে হয় না। মায়া লাগে। সারাদিন খেটেখুটে বেচারাদের রেহাই নেই রাতেও। একটু খেয়াল করলে চোখ এড়ায় না চালকের উদভ্রান্ত চোখ, এলোমেলো পা ফেলা। এড়িয়ে যায় অশ্বের শরীরে লুকিয়ে থাকা বয়ামভর্তি ক্যাপসুল, খুশবু গাছের মাফিয়া পাতা, কাশির দাওয়াই, তবলা বাজানোর পাউডার কিংবা সিনেমার নায়িকা।
উদগ্রীব অন্ধকার দশদিকে। স্তব্ধ সুন্দর। বাঁশঝাড়ের আশেপাশে জোনাকির আলো দেখা যায়। হুটহাট ডেকে ওঠে নাম না-জানা পাখি, স্থানীয় কুকুর, শেয়াল ও এই ধরনের যা-কিছু। বুকের ভেতর প্রিয় কোনো গান নিয়ে যেতে হয়। তা-না হলে, রাস্তা জেনে যাবে আপনার সমস্ত গোপনতা।
রাত বেশি নামলে জেনে নেওয়া যেতে পারে রাস্তার গোপন। গভীর রাতে এপথে বহুদূর যায় যাত্রীবিহীন একলা ঘোড়ার গাড়ি। আপাতদৃষ্টিতে তেমন কিছু মনে হয় না। মায়া লাগে। সারাদিন খেটেখুটে বেচারাদের রেহাই নেই রাতেও। একটু খেয়াল করলে চোখ এড়ায় না চালকের উদভ্রান্ত চোখ, এলোমেলো পা ফেলা। এড়িয়ে যায় অশ্বের শরীরে লুকিয়ে থাকা বয়ামভর্তি ক্যাপসুল, খুশবু গাছের মাফিয়া পাতা, কাশির দাওয়াই, তবলা বাজানোর পাউডার কিংবা সিনেমার নায়িকা।
কোনো এক অমাবস্যায় নাঙ্গা হয়ে খোকশার ফুল দেখা যায় যদি, নিশ্চিত পাওয়া যাবে অঢেল ধনসম্পদ, চিরযৌবন— সাক্ষী যমুনা নদী!
জন্ম ২০০৮ সালের ২৬ মার্চ, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া গ্রামে। পড়াশোনা করছেন ঢাকার সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণিতে। লেখালেখি করেন; পাশাপাশি বন্ধুদের নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বিষয়ক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। স্বপ্ন দেখেন একদিন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করবেন।