*
আবার শীতের গান গলা খুলে গাই—
গুচ্ছ গুচ্ছ গাছে দ্যাখো শুদ্ধ জলপাই
ঝুলতেসে ওলিভ গরিমা নিয়া তার;
স্বতঃস্ফূর্ত অন্ধকারে বসে থাকবার
এ-ই তো সময়, সখে, এসো বসে থাকি—
উষ্ণদেশে আসা শ্রান্ত পরিযায়ী পাখি।
*
শহরে শীতের দেরি, সইছে না তর
উত্তুরা হাওয়া বয়ে এনেছে খবর :
গারো পাহাড়েতে ঝুম শীত পড়িয়াছে;
ওইখানে যেয়ে দেখি, যদি পাই কাছে
খুয়ায়াছি যাহা-কিছু গ্রীষ্ম-অবকাশে—
খুঁজিয়া বেড়াই তীর্থ, বনফুলে, ঘাসে;
*
সহজ শীতের মতো আমাদের মন—
খড়ের গাদার পাশে বসেছি যখন;
মিঠে রোদ পিঠে তুমি দেখছিলে কাছে
গাভির ওলানে রাঙা ওম মাখা আছে;
অদূরে চড়াইগুলা আকাশিয়া-শাখে
উড়ে যেয়ে এসে ফের জোড়ে বসে থাকে।
*
অব্যক্ত কথার কুঁড়ি গত শীত থেকে
চলতেসি দু-জনেই বুকে চেপে রেখে
এবার কুসুম হয়ে ফুটুক না-হয়—
কেবলি কুসুম হবে? ফল কেন নয়?
এই শীতে এসো বলি সেই কথাগুলো
বলি বলি করে কত বর্ষা গত হলো!…
*
দুনিয়ায় রয়েছেন সিদ্ধাচার্য কত
এ-মুহূর্তে তারাও কী আমাদের মতো
শীতের আমেজ নিয়া সুখে ও সহজে
বারান্দার ইজিরোদে রয়েছেন মজে?
নাকি তারা স্বভাবত কঠিন ও মেকি!—
সে-ভেবে কী লাভ, এসো প্রজাপতি দেখি;
*
চিলতে রোদের ফিতা আমার দু-পায়ে
জানালা গলিয়ে এসে বসে টায়ে-টায়ে;
ঘুলঘুলি দিয়া ঢোকা ডিমাকার ফুল
সোনার হাঁসের নয়, রোদের মুকুল!
এমন মুহূর্তে দেখি আতাফলগাছে
এই শীতে বেশুমার রোদ ফলিয়াছে!
*
বিছায়া রাখসে কারা ক্ষেত-কাটা ধান
খোলতাই হয়েছে তাতে মেঠো অঘ্রান;—
সারানিশি শিশিরের দুধ পান করে
সকালে রোদের পুষ্টি শস্যে পড়ে ঝরে।
বিকেলের দিকটায় নিয়া যাবে তুলে
এই ধান, নাড়াপাতা— নগরভূগোলে—
*
শিমের মাচাঙ ভরে রয়েছে সকাল
পাখসাটে উড়ে যায় শাদা বকপাল
শহরতলির জোলো ক্ষেতজমি জুড়ে
শাদাডানা পাখিঝাঁক দৃশ্য রাখে মুড়ে
শিমপত্রে ভাসমান শিশিরের সর
ত্বকে মেখে স্বাস্থ্য পায় আমার শহর।
*
ওই তো অশ্বত্থগাছ, বাঁ-দিকে বকুল
পায়ের পাতার কাছে চড়ায়ের চুল—
কোথা থেকে এল উড়ে!— উপরে তাকাই :
দয়াল চড়াই তুমি কই গেলা ভাই!
এখানে আকাশ নীল— রৌদ্রপ্রসাধিত
এ-ধারা বিস্ময়ভ্রম শীতেই প্রার্থিত।
*
কাঁটা দিয়া ওঠে দেহ শীতের শিহরে
অরণ্যের পোস্টম্যান ঘোরাফেরা করে—
এখানে বাঁশের বনে, বাতাসবাগানে
গতানুশোচনাছাড়া বার্তা বয়ে আনে;
কেমন কোমল এই অপরাহ্নহ্রদ—
পাখিরা ঝরায়া যায় কুয়াশাপারদ।
*
বিকেলের বিলে কিছু কেঁচো ও শামুক;
অল্পজল অন্ধকারে অতীব উৎচোখ
নীরবে ঘাঁটছে কাদা ক-টি শীতহাঁস :
ঠোঁটের নাগালে এলে শামুকের শাঁস
অথবা কেঁচোর স্বাদু শরীরের ছাল
আপাত সুরাহা হয় আহার্য-আকাল।
*
নগরের মোড়ে মোড়ে বাতিগাছগুলো
টিমটিমে কুপি যেন; শিমুলের তুলো
যেমন বরন হয় দীপ্র চোতমাসে
কুয়াশাবাহিতা আলো তদরূপ ভাসে;
এখানে যখন রাতে সকলে ঘুমায়
বাতিগাছ জেগে থেকে কুয়াশা ছড়ায়।
*
ঘন শীত জমে আছে চালতাপাতায়
সকালবেলার রোদ পুকুরঘাটায়
নেমেই দেখতে পায় পাতার কাঁপন :
চালতার গাছ ভারি শীতপরায়ণ!
অতঃপর আলগোছে জল থেকে উঠে
রোদ যেয়ে বসে গাছে— পাতার মুকুটে।
*
কুকুরের ধ্বনি আসে শীতভারাতুর;
থেকে থেকে কেঁপে-ওঠা ঝাঁকড়া পাকুড়—
পুকুরের গায়ে ফেলে বিষটিশিশির,
সেই পতনের গানে টুটিছে তিমির;
এইবার পায়ে পায়ে নামিতেসে ভোর
রজনী রাঙায়া আসে সকালের সুর।
*
একাকী শীতের ভোর একলা দুপুর
জানালার জামগাছ সঙ্গী বড়জোর;
পরিস্থিতির প্রকার এমন যখন
কাটা ঘুড়িটির শোকে বালকের মন
স্তব্ধবাক চায়া রয় আকাশের পানে—
কুয়াশাঝাপসা স্মৃতি রাখি এইখানে…
*
রোদের মাদুরে বসে কমলালেবুটি
শীতের সুঘ্রাণে ভরে দেয় এই ছুটি—
সকালের অবকাশ, দ্বিপ্রহরকাল
দোরে-ঘরে দিনভর বিষাদ বহাল;
বেড়ালের লোম থেকে উঠে-আসা ওম
সারায়া তুলতে পারে হিমের জখম!
*
পাহাড়ে উঠতে যেয়ে দেখি কত কাছে
আগায়ে এসেছে দূর, দু-ধারের গাছে
ধরেছে পাখির প্রিয় প্রসূন ও ফল
ঋষিধ্যানে থম ধরা আকাশমহল;
শীতের অরণ্যে সন্ধ্যা নেমে আসে ত্বরা—
বিঘৎ দূরত্বে বসে নক্ষত্রপসরা।
*
সমস্ত দিবস জুড়ে শীতের প্রবাহ—
টের পাই দেহে তার অপরূপ দাহ!
বহিছে ভুবনে-বনে রতিঋতুসুর
লেপমুড়ি কেটে যায় নিরাই দুপুর।
তুমি কোথা তুমি কোথা তুমি কোথা, হায়!
এহেন অঘোর ঘন শীতকুয়াশায়!
*
কুয়াশাকুহকে ঘেরা শীতরাত্রিগুলো
গাছেরা গা-ঝাড়া দিলে নক্ষত্রের ধুলো
ঝুরঝুর ঝরে পড়ে ঢেউটিনপিঠে
জোছনাশিশিরে ভেজে উঠোন ও ভিটে;
প্রভাতে উঠিয়া— এ কী!— মরি হায় হায়
পৃথিবী প্লাবিয়া যায় মধুকুয়াশায়!
*
শীত যেন অন্তরালে লুকনো অসুখ
কবেকার মৃত সেই আত্মীয়ার মুখ!—
সারাদিন সঙ্গ দেয়, পাশাপাশি হাঁটে
রাত্তিরে বেড়ায় ভেসে নক্ষত্রতল্লাটে।
এহেন আবহে রচি এক দুই তিন…
নিছক শীতের গান— গিমিক বিহীন।
**
নিছক শীতের গান (অংশ) ২০০৭
কবি, গদ্যকার, অনুবাদক