মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩

নিতাই মণ্ডলের মানিব্যাগ : সৈকত বিশ্বাস

0

Utsob-Songkha_Motifবাদামি রঙের ছোট্ট একটা মানিব্যাগের চাপে কাস্টম সুপারিন্টেন্ডেন্টের সামনে ধপাস করে বসে পড়ল নিতাই মণ্ডল। তার বসার চাপে চওড়া কাঠের চেয়ারটা আঁতকে উঠল যেন। একটা মানিব্যাগের আর কতইবা ওজন। তবুও চাপ নেওয়া কঠিন হয়ে পরেছিল তার।

দুদিন আগের কথা। টিউশনি খুঁজতে বেরিয়েছিল সে। অনুনয়ের সমস্ত চেনাজানা উপায় শেষ করে ধীর পায়ে ঘরে ফিরছে। তামাবিল বাজার পেরিয়ে উঁচু রাস্তা। ঢাল জুড়ে নুয়ে পরা পলাশ থোকা। বসন্ত ফিরে যাচ্ছে। তবুও কিছু শ্বেত পলাশ উঁকি দিচ্ছে বিনম্রতায়। একটা ছোট্ট মৌটুসী পাখি চিকন ঠোঁট ডুবিয়ে কি যেন খাচ্ছে। দেখে নিতাই মণ্ডলের নিজের খিদের কথা মনে পড়ল। শুকনো টোস্ট আর এক কাপ লিকার চায়ে এই বয়সে দিন কাটে না আর। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল বাসায় ঢুকলেই দেখতে হবে স্ত্রীর বিষণ্ণ মুখ। শুনতে হবে ঊনত্রিশ বছরের সংসার জীবনে নিজের মুরোদহীনতার চিৎকার। দিগন্তে আড়াল হয়েছে সূর্যটা। তবুও অনেক আলো দুপাশে মাঠের আকাশে।

বাজার-ফেরত মানুষের হাতে ব্যাগ উপচানো বাজার। দড়িতে ঝোলানো মাছ। মাথাভর্তি সওদা। নিতাই মণ্ডল তাকায় না ওদিকে। বরং পলাশভরা ডাল অথবা মাটিতে সবুজ দূর্বা ঘাস দেখতে শক্তিশালী লাগে। চ্যাঁ চ্যাঁ চ্যাঁ করে বিরতি দিয়ে দিয়ে একটা ব্যাঙ ডাকছে কাছেই। সাপে ধরেছে মনে হচ্ছে। কোনো কারণ ছাড়াই শেষ পঞ্চাশের নিতাই মণ্ডল ব্যাঙ খুঁজতে শুরু করল। আর তখনই বাদামী চামড়ার একটা মানিব্যাগ দেখল ঘাসের আড়ালে। প্রথমে ভেবেছিল ছেঁড়া বা পুরোনো। তাই ফেলে গেছে কেউ । আশপাশে তাকাল সে। পথচারীরা সব দূরে। প্রস্রাব করার ভঙ্গিতে রাস্তার পাশে বসে মানিব্যাগটা তুলে নিয়ে পাঞ্জাবির পকেটে ঢোকাল। বেশ মোটা। নেতানো পাঞ্জাবির পকেটটা ঝুলে থাকল ভারে। সেই পকেটে হাত রেখেই হাঁটা দিলো সে ।

প্রথমে ভেবেছিল ছেঁড়া বা পুরোনো। তাই ফেলে গেছে কেউ । আশপাশে তাকাল সে। পথচারীরা সব দূরে। প্রস্রাব করার ভঙ্গিতে রাস্তার পাশে বসে মানিব্যাগটা তুলে নিয়ে পাঞ্জাবির পকেটে ঢোকাল। বেশ মোটা। নেতানো পাঞ্জাবির পকেটটা ঝুলে থাকল ভারে। সেই পকেটে হাত রেখেই হাঁটা দিলো সে ।

বাড়ি পৌঁছুতে সন্ধে ঘোর। স্ত্রী শুয়ে। সারা দিন প্রায় উপোস। দুর্বল শরীর। তারচে বেশি মন। নিতাই মণ্ডল আস্তে করে পাশে বসল। তার স্ত্রী দেখছে নিতাই মণ্ডলের পকেটে ঢোকানো একটা হাত কাঁপছে।

‘কি হলো তুমার? কাঁপতিছ ক্যান?’

নিতাই মণ্ডল কাঁপা কাপাঁ হাতেই মানিব্যাগটা বের করে এগিয়ে দিলো স্ত্রীর দিকে।

‘ইডা কী?’

নিতাই মণ্ডল নিরুত্তর। তার স্ত্রী মানিব্যাগটা দেখে অবাক হলো। বলল, ‘মানিব্যাগ? ঊনত্রিশ বচ্ছর বিয়ে হয়ছে। তুমার হাতে তো কোনোদিন মানিব্যাগ দেখিনি? আজ এই অভাবের দিনে…’

নিতাই মণ্ডল অন্যদিকে তাকিয়ে বসে আছে। উত্তর দিলো না।

‘মুকে কতা নাই ক্যান? এই মানিব্যাগের মাহিত্মখান কী?’

নিতাই মণ্ডল তবুও চুপ করে আছে।

‘বুবা হয়ে গেলে যে? শ্যাষ পর্যন্ত কি তুমি পকেটমারা শুরু করলে?’

‘না না না, ওইসব করতি যাব ক্যান? ঈশ্বর মিলায়ে দিলো আর কি।’ বলে কাচুমাচু মুখে মৃদু আশা জাগানো চোখে স্ত্রীর দিকে তাকাল।

‘ঈশ্বর? তিনি আইসে তুমার হাতে মানিব্যাগ দিয়ে গুঁজে দিয়ে গেল?’

‘ফিরার সুমায় কুড়োয়ে পাইছি।’

‘কুড়োয় পায়ছো? এরোম ট্যাকা ভরা মানিব্যাগ?’

‘বিশ্বেস কর। আমি পকেট মারি নাই।’

‘শোনো নির্মলের বাপ, আমি কপাল পুড়া। তাই মল্লিক বাড়ির মিয়ে হয়েও তুমার সাতে সুংসার করতিছি। আমাগের বাড়িত চার চারডে কাজের লোক সারা বচ্ছর কাম করত। গুয়ালে বাইশখান গাই। মাঠে বিঘে চল্লিশেক সম্পত্তি। বাপের সুনাম ছিল দশ গিরামে। সেই বাড়ির মিয়ে হয়ে আমি পকেটমারের বউ পরিচয় দিতি পারব না।’

‘আরে সত্যি বলতিছি। আমি পকেট মারি নাই। তুমি আমাক এত্তবচ্ছর ধরে দেকতিছ না? মাস্টার মানুষ হয়ে আমি কি পকেট মারার মতো কাম করতি পারি?’

‘শুনে রাকো। ওই ব্যাগ আমি ছোঁবো না। তুমি যাও, যার ট্যাকা তারে ফিরায়ে দিয়ে মাপ চায়ে আসো।’

 

‘মা মা এই নেও’ বলেই ভেজা শরীরে ছেলে নির্মল দুটো কুড়ি টাকার নোট ওর মা’র দিকে বাড়িয়ে দিলো।
‘তুই ট্যাকা পালি কুথায় বাবা? ওমা, এই ভর সন্ধেবেলা তোর গাও ভিজা ক্যান?’

‘স্কুলের পর পিয়াইন নদীতি ডুবোয়ে ডুবোয়ে পাত্থর তুলে দিছি। চল্লিশ ট্যাকা দিলো। কাল আবার যাতি বলিছে।’

‘খুব ভালো করিছিস বাবা। এখন আগে গা মাতা মোছ। ঠান্ডা লাগাইসনে।’

ছোট্ট স্থলবন্ধর ঘিরে গড়ে ওঠা জনপদে ছেলেমেয়েরা একটু বড়ো হলেই কাজে নেমে পরে। অবস্থাপন্নরা সন্তান পাঠিয়ে দেয় দূরে। যারা আছে তারা নিজ স্কুলের শিক্ষকদের কাছে পড়ে। তাই আইএসসি পাশ বয়স্ক নিতাই মণ্ডলের বাড়ি বাড়ি ঘুরে টিউশনি কমতে কমতে আজ শূন্য।

 

রাতে জলে চুবিয়ে একটা শুকনো রুটি খেয়ে শুয়ে পড়ল নিতাই মণ্ডল। প্রায় সারা রাত ঘুম এলো না। নিজের কথা বাদ থাক। কিন্তু স্ত্রীর ওষুধ কেনা হচ্ছে হচ্ছে এক মাস। বড়ো মেয়েটাকে বাপের বাড়ি আনতে যেতে পারছে না। তার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা কথা শোনাচ্ছে। ছোটো ছেলে মেয়ে দুটোর স্কুল ড্রেস নেই। স্কুলের বেতন বাকি নয় মাস। প্রধান শিক্ষক একসময় তার ছাত্র ছিল বলে স্কুলটা বন্ধ হয়নি ওদের। সবচে বড়ো সমস্যা প্রতিদিনের খাবার জোটানো। বয়স হয়েছে। এখন তার কাছে আর প্রাইভেট পড়তে চায় না কেউ। ছোট্ট স্থলবন্ধর ঘিরে গড়ে ওঠা জনপদে ছেলেমেয়েরা একটু বড়ো হলেই কাজে নেমে পরে। অবস্থাপন্নরা সন্তান পাঠিয়ে দেয় দূরে। যারা আছে তারা নিজ স্কুলের শিক্ষকদের কাছে পড়ে। তাই আইএসসি পাশ বয়স্ক নিতাই মণ্ডলের বাড়ি বাড়ি ঘুরে টিউশনি কমতে কমতে আজ শূন্য। কিন্তু একসময় তিনিই একমাত্র আইএসসি পাশ শিক্ষক ছিলেন। গড় গড় করে অঙ্ক করাতেন। তার কাছে পড়ে পড়ে কতজন আজ দাঁড়িয়ে গেছে!

সকাল হলো বউয়ের চিৎকারে। ঘরে আজ চা পাতাটুকুও নেই। নিতাই মণ্ডলের স্ত্রী নির্মলকে সেই চল্লিশ টাকা দিয়ে পাঠাল পাড়ার দোকানে। বাকির খাতায় জমা রেখে চলার মতো কিছু অন্তত আনুক। মানিব্যাগটা দেওয়ালের তাকে রাখা। নিতাই মণ্ডল খোলেনি এখনো। শুধু তাকিয়ে দেখেছে কয়েকবার। একবার ভাবল খুলে দেখাই যাক না আসলে কী আছে। এসময় তার স্ত্রী ঢুকল।

‘আবার তুমি ওই ব্যাগে হাত দিইছো? শুনে রাকো, আমার যদি মিরিত্তুও হয় তবুও ওই পকেটমারা টাকা আমি পেটে ঢুকাব না। যাও, যার ব্যাগ তাকে ফিরায়ে দিয়ে আসো।’

‘আরে বিশ্বেস করতিছো না ক্যান? আমি তো কুড়োয়ে পাইছি। কার ব্যাগ জানব কীভাবে?’

মেয়েকে ডাকল নিতাই মণ্ডলের স্ত্রী।

‘মা কনক, এদিকে আয় তো। ওই মানিব্যাগটা খোল। দেখ, ওর মদ্দি কুনো নাম ঠিকানা আছে কি না।’

তার মেয়ে মানিব্যাগটা নিয়ে বিছানায় বসল। প্রতিটি অংশ খুলে খুলে সব বের করে রাখল বিছানায়। অনেকগুলো পাঁচশ টাকার নোট।

‘বাবা, গুনব কত টাকা?’

‘গুনবি, গোন। গুনতি তো দোষ নাই। গোন গোন।’

কনক গুনে গুনে দেখল মোট বাইশ হাজার পাঁচশো কুড়ি টাকা।

‘ও মা, এতো অনেক টাকা!’

‘কোনো নাম ঠিকানা আছে কি না তাই দেখ।’

‘ছোটো ছোটো কাগজে অনেক হিসাব। কয়লা, পাথর, সিমেন্ট, শীলপাটা এইসবের হিসাব। একটা কার্ডও আছে।’

‘কার্ড? কার কার্ড?’

কনক শব্দ করে পড়ল, ‘মো. শমসের আলী, কাস্টম সুপারিন্টেন্ডেন্ট। আরে, এ তো আমাদের কাস্টম কাকুর কার্ড। বাবা, তুমি তার ছেলে মেয়েকে পড়াতে না আগে?’

‘আমিও তার কতাই ভাবতেছিলাম। আমাগের এই ইলাকায় তার চাইতে ধনীলোক আর কেউ নাই।’

‘ওই তো ঠিকানা পাওয়া গিইছে। যাও ফিরায়ে দিয়ে বলো যে তুমি পতে খুঁজে পায়ছিলে। মা কনক, সবগুলো যেরকম ছিল গুছোয়ে ভরে রাক।’

নিতাই মণ্ডল বলল, ‘কনকের মা শোনো, মাতা ঠান্ডা করে শোনো। ধরো, আমাগের এই যে অভাব, এতো কষ্ট, কোনো কুল কিনারা করতি পারতিছি না। তাই দেখে ঈশ্বর আমাগের একখান উপহার পাঠায়ছেন।’

‘তিনি পাঠালে তো একটা নির্দেশ থাকবি। অন্যকোনো লোকের নাম ঠিকানা থাকবি না। তার দয়া দেখানোর কত পথ খোলা আছে। বলে কপালে হাত ঠেকাল।’

‘আমি অন্যের টাকায় লোভ করতিছি না। সারা জীবনে তা পারলামও না। কিন্তু এখন আমাগের ম্যালা অভাব। তাই ভাবতিছিলাম কুড়োয়ে পাওয়া জিনিস….’ বলে নিতাই মণ্ডল স্ত্রীর সমর্থন পাওয়ার আশায় উজ্জ্বল চোখে তাকাল।

‘তবু অন্যায় টাকা আমার গলা দিয়ে নামবি না। নির্মলের বাপ, তুমি আরও দূরে গিরামের দিকে খোঁজো। টিউশনি তুমি পাবাই। তুমার মতো অঙ্কের মাতা আর কয়জনের আছে ইলাকায়? তুমি নিজির ওপর বিশ্বেস রাকো, ঠাকুর মুখ তুলে তাকাবিই।’

 

এরপর নিতাই মণ্ডল আর কথা বলল না। শুয়ে পড়ল। খিদের কষ্ট সামলে সারা দিন আরও কয়েকবার মানিব্যাগটার দিকে তাকিয়ে থাকল। পেটে ক্ষুধা রেখে দ্বিধা আর সংকোচ নিয়ে ঘর উঠোন ঘর করল বিকেল পর্যন্ত। তারপর বের হলো পাড়ার দোকানে আবার বাকির অনুরোধ করতে। এভাবে ওইদিন কেটে গেল। পরের দিনও বার বার মানিব্যাগটার দিকে চোখ পরছে আর একটা অপরাধবোধ পেঁচিয়ে ধরছে তাকে। মনের ওপর চাপ বাড়তে বাড়তে সন্ধ্যার আগে দিয়ে সে গাঢ় ঘামের গন্ধযুক্ত ময়লা পাঞ্জাবিটা পরে নিলো গায়ে। পকেটে ঢুকিয়ে নিলো মানিব্যাগটা। তারপর ধীরে ধীরে পা বাড়াল সীমান্ত পোস্টের কাস্টম অফিসের দিকে।

একটু দূরে পাহাড়ের গায়ে গায়ে তৈলচিত্রের মতো আলো জ্বলে উঠেছে। ডাউকি শহর। লাল নীল হলুদ ছোটো ছোটো আলোগুলো ঘন হয়ে ওঠা অন্ধকারে স্বপ্নদানার মতো জ্বলছে। সমস্ত দিনের কাজ শেষ করে নিয়েছে শমসের আলী। তারপর ড্রয়ার টেনে বের করেছে বিচিত্র ভাঁজের অনেকগুলো নোট।

নিতাই মণ্ডলকে এই সন্ধেবেলা অফিসে ঢুকতে দেখে শামসের আলী বিরক্ত। ওপার থেকে কয়লা আর পাথরটানা ট্রাক লরিগুলো আজকের মতো কাজ গুটিয়ে নিয়েছে মাত্র। একটু দূরে পাহাড়ের গায়ে গায়ে তৈলচিত্রের মতো আলো জ্বলে উঠেছে। ডাউকি শহর। লাল নীল হলুদ ছোটো ছোটো আলোগুলো ঘন হয়ে ওঠা অন্ধকারে স্বপ্নদানার মতো জ্বলছে। সমস্ত দিনের কাজ শেষ করে নিয়েছে শমসের আলী। তারপর ড্রয়ার টেনে বের করেছে বিচিত্র ভাঁজের অনেকগুলো নোট। ঢোলা প্যান্টের দু-পকেট উলটেও জড়ো করেছে সব। শৈশবের পাতা কুড়িয়ে বনভোজনের উনুন জ্বালানোর প্রস্তুতির মতো ছোট্ট একটা ঢিবি হয়ে গেছে টেবিলে। ভাঁজ খুলে সমান করে মান অনুযায়ী সাজিয়ে রাখছে সে। গোনা হবে পরে। এরই মধ্যে নিতাই মণ্ডল ঢুকে পড়ল। কাস্টমস সুপার মুখ তুলে তাকিয়ে রেগে গিয়ে বলল, ‘এই সাঁঝকালে আবার আইছাওন? তুমরারে আমি আর ধার দিবার পারুম না মাস্টের।’

সে কথায় ভাবান্তর হলো না নিতাই মণ্ডলের। বরং হাসিমুখে বলল, ‘আইজকার কামাই মন্দ হইনি স্যার। টেবিল ভরে উঠিছে।’

‘তয় তুমরার পুতের কী, শালা মাউরা? তুমরার কী?’

নিতাই মণ্ডল হাসি হাসি মুখটাকে এবার নির্বিরোধ ক্যাবলার মতো করে ফেলল। কথার উত্তরে পালটা আক্রমণ না করে শুধু হে হে হে করতে লাগল।

‘হাসতিছুইন ক্যারে? এইবার যেমুন নাটক থেটার করছুইন তুমরারে আর লোন ন দিছুইন মাস্টের।

নিতাই মণ্ডল এবার আরেকটু রহস্য করে বলল, ‘আইজক্যা লোন নয় গো স্যার, লোন নয়, পুরুস্কার দিতি হবি, পুরুস্কার। পিরাইজ।’

‘যেমুনই কইছুইন, তুমরার আর লোন ন দিছুইন।’

অদূরে পাথরভাঙা মেশিনগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ছোটো বড়ো অসংখ্য ট্রাক লরির ঘটাং ঘটাং শব্দ আর নেই। এই সুযোগে একদল ঝিঁ ঝিঁ পোকা নিয়মিত কণ্ঠ সাধনা শুরু করে দিয়েছে। সীমান্তের ওপার থেকে থেমে থেমে ভেসে আসছে খাসিয়া গানের সুর। নিতাই মণ্ডল নেতানো পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে মানিব্যাগটা বের করে সামনে এগিয়ে দিলো। কাস্টম সুপার তাকাল। টাকা গুছানো থামিয়ে মানিব্যাগটা চট করে তুলে নিয়ে খুলে ফেলল। উলটে-পালটে দেখে নিজের কাছে রেখে দিয়ে টাকা গোছানোয় মন দিলো।

নিতাই মণ্ডল এখন ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে।

‘বৈলিচি না স্যার, লোন নয়, আইজকা পুরুস্কার দিতি হবি। গুনে গাতে দেখি নেন। সব ঠিকঠাক আছে কি না দ্যাখেন।’

কাস্টম সুপার টেবিলের টাকা নিয়ে ব্যাস্ত।

নিতাই মণ্ডল ক্যাবলা মুখে হাসি ধরে রেখে বসে বসে টাকা গোনা দেখছে। শমসের আলী গুনতে থাকা টাকার ভেতর থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে তার দিকে ছুড়ে দিলো। আর নিতাই মণ্ডল হে হে করে হাসতে হাসতে নোটটা তুলে নিয়ে পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, ‘আমি তাইলে উঠলাম। আর একটা কতা, দু-একখান টিউশনি না পালি যে বউ পুত নিয়ে না খাতি পায়ে মরব। আপনার কাছে কত্ত লোকে আসে, ইট্টু বলে দ্যান না স্যার।’

শমসের আলী কোনো উত্তর দিলো না।

সেই রাতে মসুরির ডাল, আলু ভর্তা আর চা বাগানের সুগন্ধি লেবু চিপে পেট ভরে ভাত খেলো নিতাই মণ্ডলের পুরো পরিবার। ওদের খাবার থালা, ডান হাতের কব্জিগুলো আর খেতে বসার পুরো জায়গাটা লেবুর ঘ্রাণে বুঁদ। গন্ধটা আরও বেশি লাগছে অনেকদিন পর পেট ভরে ভাত খাবার তৃপ্তিতে। অসংখ্য তারা উঠেছিল সেদিন। মাথার ওপর গোল হয়ে নেমে আসা আকাশভরা তারা। দূরে পাহাড়ের দিক থেকে ভেসে আসা বাঁশির করুণ সুর রাতটুকু নরম করে দিচ্ছে যেন। নিতাই মণ্ডল শুনল তার নবম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে কনকলতা মণ্ডল ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে বেড়াচ্ছ রাত্রির উঠোনে।

‘আসবে শ্যাম কালিয়া, কুঞ্জ সাজাও গিয়া, কেন যে রাই কাঁদিতেছো পাগলিনী হইয়া, ও রাই পাগলিনী হইয়া, কুঞ্জ সাজাও গিয়া’ —এই গান শুনিয়ে সে স্কুল থেকে একবার পঞ্চাশ টাকার পাঁচটা প্রাইজবন্ড পুরস্কার পেয়েছিল। প্রতিমাসে ড্র হলে জৈন্তা ফার্মেসি থেকে পুরোনো খবরের কাগজ চেয়ে এনে পুরো পরিবার একসঙ্গে বসে হারিকেনের হলুদ আলোয় নম্বর মেলাতো। অনেকবার এরকম হয়েছে যে, সবগুলো নম্বর মিলে গেছে, লাফিয়ে উঠেছে ছেলে মেয়েরা। কিন্তু পরে দেখা গেল সেটা অন্য কোনো সিরিজ অথবা শেষের নম্বরটা ভিন্ন। এভাবে লটারির স্বপ্ন ধরা দিতে দিতে ফস্কে গিয়েছে বহুদিন একটা অভাবী শিক্ষিত পরিবারে।

শমসের আলী অফিস থেকে বাজার ঘুরে বাসায় ফিরল বেশ রাত করে। গুনে শেষ করা বান্ডিলটা স্টিলের আলমারির মধ্যে রেখে খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু এপাশ-ওপাশ করতে করতে তার মনে পড়ল নিতাই মণ্ডলের কথা। লোকটা গরিব, অভাবী। ধার দেনা করে চলে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছোটো বাচ্চাদের অঙ্ক শেখায়। কোনোমতে চলে সংসার। কিন্তু সেই নিতাই মণ্ডল একটা মানিব্যাগ কুড়িয়ে পেয়ে একটা টাকাও খরচ করল না। বরং শমসের আলীর ভেবে দিয়ে গেল। একবার যাচাই পর্যন্ত করল না সেটা তারই কি না। মানুষ কত সরল। কেমন অদ্ভুত। নিজের পেটে তীব্র ক্ষুধা রেখেও টাকাভর্তি মানিব্যাগ একজনের অফিসে ছুটে এসে দিয়ে গেল। বসে থাকল সামান্য বকশিশের আশায়। চারিদিকে এতো সব চিট-বাটপারদের মধ্যে এখনো এরকম লোক আছে? পাশ ফিরে শুলো সে। ঘুম আসছে না আজ। তাকে আর কিছু বেশি বকশিশ দিলেই হতো আজ। সকালে ওর মেয়েকে স্কুলে যেতে দেখেছে। খালি পা। পাথর ক্রাশার মেশিনগুলোর সামনে টুকরো টুকরো ইট-পাথরের ওপর দিয়ে যেতে যেতে তার পা দুটো ব্যথা পেয়ে সরে সরে যাচ্ছিল। তার নিজের মেয়েও একই ক্লাসে পড়ে। ঘুম আসছে না আজ শমসের আলীর।

চাবি দেওয়া টেবিলঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা একমনে ঘুরছে টিক টিক টিক। তার রেডিয়াম পয়েন্টগুলো অন্ধকার ঘরে জ্বলজ্বল করছে। সাদা রঙের নরম আলোর আভা পড়েছে সামনে রাখা সেই মোটা মানিব্যাগটার ওপর। শামসের আলী সেই দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। ভাবছে নিতাই মণ্ডলের কথা। হটাৎ মনে হলো মৃদু সাদা আলোয় বাদামী মানিব্যাগটা হাসছে। তার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে কথা বলতে শুরু করেছে। বলছে, ‘শমসের আলী, আমি তো তোমার না। আমার ভেতরে এই টাকাগুলানও তো তোমার না। তাহলে তুমি নিতাই মণ্ডলের কাছ থেকে কেন নিলা? কেন তাকে বললা না তোমার মানিব্যাগ হারায় নাই? একটা অভাবী লোক লোভ নিয়ন্ত্রণ করতে পারল আর আলমারি ভরা ঘুসের টাকা রেখেও তুমি আমাকে নিয়ে নিলা? শমসের আলী, তুমি তো নিতাই মণ্ডল হতে পারলা না।’

শমসের আলী ভালো করে চোখ রগড়ে নিয়ে আবার তাকাল। নিজেকে বোঝাল, আরে মানিব্যাগ কি কথা বলতে পারে নাকি? কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে আবার চোখ পড়ল তার। ঘড়িটা চলছে টিক টিক টিক। সীমান্তের ওপারে পাহাড়ি পথে ঘ্যা ঘ্যা শব্দ করে ভারী ভারী ট্রাকগুলো যাচ্ছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। উঁচুতে ওঠার শক্তি জোগাতে ওদের ইঞ্জিনের বিকট শব্দ রাত্রির নিস্তব্ধতা খান খান করে দিচ্ছে। আবার তাকাল মানিব্যাগটার দিকে। এখন মনে হচ্ছে ওটা হাসছে। খিক খিক করে হাসছে। আর বলছে শমসের আলী, তুমি তো নিতাই মণ্ডল হতে পারলে না।

একটা চটের ব্যাগ নিয়ে খুব সকালে বাড়ি থেকে বার হলো শমসের আলী। সোজা চলে গেল বাজারে। টিনের ঝাঁপ ফেলা বন্ধ একটা জুতা স্যান্ডেলের দোকানে বাড়ি দিয়ে দিয়ে দোকানদারকে ঘুম থেকে তুলল। বলল, ‘আট নয় সাইজের কয় জোড়া স্যান্ডেল আছে তুমরার দুকানে?’

‘দশ বারো জোড়া হইতে পারে, স্যার।’

‘ব্যাবাকগুলান এই ব্যাগে ঢুকাও। তারপর ওগুলো নিয়ে হন হন করে ছুটল।’

‘বাবা বাবা শিগগির ওঠো, কাস্টম কাকু আইছে।’

‘কাস্টম স্যার? আমাগের বাড়িতে?’ ঘুমের ঘোর ছুটে গেল নিতাই মণ্ডলের। তিন ফুটো হওয়া একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে এসে বারান্দায় দাঁড়াল।

‘স্যার, আপ্নে? আমি তো মানিব্যাগের কুনো টাকা খরচ করি নাই। বিশ্বেস করেন, একটা পয়সাও ধরি নাই।’

সেই কথার উত্তর দিলো না শমসের আলী। বলল, ‘মা কনক, এই ব্যাগটা নেও। আর কুনোদিন খালি পায়ে স্কুলে না যাইবা।’

‘আর মাস্টের, ধরো, এই মানিব্যাগটা তুমরারই।’

‘মানে? কী বলতিছেন স্যার?’

‘জি, আমরার কুনো মানিব্যাগ হারায় নাই।’

‘আপ্নের মানিব্যাগ হারায় নাই? কিন্তু তার ভেতর আপনার কার্ড ছিল।’

‘কুনুলোক মনে হয় আমরার কার্ড রাখছিল। তাছাড়া আমার তো কুনো মানিব্যাগ নাই।’

‘মসিবতে পরলাম, হেই ব্যাগের মালিকের তাইলে পাবো কুথায়?’

শোনো মাস্টের, তুমি মানুষ ভালা। আমার কাছে পিরাইজ চাইছিলে না কাইল? মনে করো আল্লায় তুমরারে সেই পিরাইজখান পাঠাইছে।’ বলেই নিতাই মণ্ডলের চিমসানো বিশুষ্ক হাতে মানিব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে ঘুরে হাঁটা শুরু করে দিলো। মানিব্যাগটা এখন আগের চাইতে আরও বেশি ভারী।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম মুক্তিযুদ্ধের আগুনঝরা দিনগুলোতে, যুদ্ধরত দেশের অভ্যন্তরে। কৈশোরে লেখালেখি শুরু কবিতা, গান দিয়ে। পরবর্তী সময়ে পত্রিকায় লেখালেখি; সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনে সংযুক্তি এবং সাপ্তাহিক পত্রিকায় চাকরি। অর্থনীতি এবং উন্নয়ন অধ্যয়ন বিষয়ে পৃথক স্নাতকোত্তর। কিন্তু তাঁর আগ্রহের বিষয় সাহিত্য, ইতিহাস ও দর্শন। পেশাগতভাবে বহুদিন ধরে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতিসংঘভুক্ত সংস্থায় কর্মরত।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।