বলবার ভাষা নেই
এভাবে বলা যায় তাকে, যদি মেঘেরা ডাকে
নাক ফুলে রাখে চোখে মুখে অকস্মাৎ ঢেউ
খেলব না খেলব না বলে খেলতে এলে কেউ
তাকে নিয়ে ফেরা যায় আবাসিকে বারে বারে।
আবাসে থাকে আলোকোজ্জ্বল মন আবরণহীন
প্রণালী প্রণয়ণে প্রণতিরত থাকে সারাক্ষণ
মেঘ নাচে ঘনীভূত হয় বেড়ে যায় জলের ক্ষরণ
এতটা পথ এসেও— ভাবি, সেও জাতিকা মীন।
এভাবে বলব বলব করে না বলা মেঘ ডেকে যায়
মেঘের ডাক শুনে পীপিলিকা দিক হারায়।
আড়ায় বসে যত দেখি পুকুরে ডুব দিতে থাকা হাঁস
এ হৃদয় তত পীপিলিকা হয়ে শূন্যে ভরে তোলে আবাস।
মেঘেরা ডাকাবুকো ভাব লয়ে থাকে
থেকে থেকে এখানে সেখানে নাক ডাকে।
আমাকে মারতে তুমি মরো বারবার
তোমার সঙ্গে আমার তো হয় না আলাপ
আমি কাতলা মাছ তুমি অ্যানাকোন্ডা সাপ
মাছ গ্রাস করতে করো ফোঁস ফোঁস তুমি
তোমার আগ্রহে নদী জলহীন— বেলাভূমি…
এ এক বাহুল্য জীবন আমার কাছে বটে
আগুনে পুড়েছি হাত, বলি তাও অকপটে
অথচ আঁকড়ে ধরো, চাও মুখে পুরে নিতে
ফলে মাছ হয়ে ডুবোজলে রয়েছি সংগীতে
চাও মারি হোক দারুণ বাতাসের হুঙ্কার
মড়কের মোড়কে বিশ্বাস ভেঙে যাক তার
সংক্ষুদ্ধ হোক নিমজ্জিত চক্ষু যুগল; রাহু—
বন্ধ্যত্ব মাছের; গহন সংসারে উন্মুখ উদ্বাহু
হাঁসের পালকের মতো স্বচ্ছ সহস্র উচ্ছ্বাস
একাকী নিদ্রাহীন নিদ্রার ভেতরে এক লাশ
হয়ে পড়ে থেকে দাও বিষ ঢেলে অনির্বার
আমার কূল নাই দরিয়া নাই কিচ্ছু হারাবার
চোখ
পর-স্ত্রীকাতর চোখগুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে দেখছে ফল
একেকটা চোখ, একেকটা আগুনের গোলা— উজ্জ্বল;
পানিতে না নিভে পুড়তে থাকা কাঠ হয়ে আছে বাগানে
বাতাস এগিয়ে আসে, হাসে— করে যায় উল্লাস প্রতিক্ষণ
মিহি সকালে, পোড়া দুপুরে, উড়ু বিকালে গাঢ় সন্ধ্যায়Ñ
বাজারে যেতে যেতে ফল উন্মুখ চোখ কাছে টেনে আনে
চুপচাপ দেখে যাই চোখগুলো কী নিদারুণ শোকে দুর্বল
বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে খুঁজতে থাকে পর-স্ত্রীদের জংঘার দাগ;
ব্রায়ের ফিতে বসে যাওয়া লাল পিঠ বারবার কেবলই টানে।
নিশপিশ কারও হাত ফিসফিস করে মরতে থাকে তারল্যে
টসটসে ফলও প্রবল সংকোচে চোখে দেখে নেয় সারল্যে
তার পথে রঙ ছড়িয়ে বসে আছে কামনায়; ধানের সন্ধানে
যেন এই এলো কাছে চুমু দেবে ঠোঁটে বেহিসেবী রঙ মেখে
যেন প্রতিবার কলহাস্যে ঢলে পড়বে উত্তাপ বুক ঢেকে রেখে
সেইসব চোখের দুঃখগুলো বেড়েই যাচ্ছে নিয়ত ফলবাগানে।
কমলালেবুর হাওয়া
বেদনার কমলালেবু পুরে আছি মুখে
পুড়ে যাচ্ছে হৃদয়বাগান; হাসি নেই
কম্পিত ঠোঁটে নেই উষ্ণতার লাভা
আমাদের সাংসারিক সংঘর্ষের দিনে।
অনুজ্জ্বল আকাশ হয়ে ওঠে নামতা।
পাঠশেষে কার ছবি ভাসে একাকী
আকণ্ঠে ডুবে থাকে বাই ফোকাল
আয়না না দেখা এ বিরুদ্ধবাতাসে?
পাখিঠোঁট তবু নির্ভরতায় জেগে রয়।
চুপসানো বেলুন হয়ে আছি খুদঘুমে
বার্তা আসে আর ফিরে ফিরে যায়
পুরনো না হয়ে শুধু হৃদয়ে তড়পায়।
অন্ধকারে যেতে যেতে
এই যে সূর্য ডুবে গেল দিন ঢুকে পড়ল আঁধারে;
কানামাছির হাত ধরে আছি— বাড়ি ফিরে যেতে
ঘোর অন্ধকারে পথ যেন হারিয়ে ফেলছি বারবার!
বাড়িটা বড় কুয়ো হয়ে আছে মরা পোড়াবার পর।
কোথাও সারাশব্দ নেই; এতটুকু নেই শিশির পতন
বিন্দু বিন্দু ঘামে ভিজে উঠছে পায়ে মাড়ানো ঘাস
নদীতে স্থির হয়ে আছে নৌকা— মাছেদের খলবল
বাড়ি ফিরবার পথে কাঁটা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
আমার বাড়ি ফিরবার পথে অন্ধকার ঘন হয়ে আছে
তোমার ভেতরে আমি নেই
চোখে অসহ্য অন্ধকার এসে ডুবিয়ে দিলে তোমাকে
সবকিছু বের করে দেওয়র বাসনা মনে আসে বলে
বনফুল হয়ে পড়ে লতা, কুয়াশা ধূলি হয়ে মনে বসে
আর সব গাছ হাঁটতে হাঁটতে সাঁতরে বেড়ায় জলে।
এমন অন্ধকারে মাঠের সরল ঘাস আগুনের গান গায়
হাওয়ামুখ হেসে গাল বেয়ে পায়ে নামে পিঁপড়ার মতো
লাল শহরের বালিমুখে কালি মেখে উড়ে যায় নদ-নদী
এসব অগণন ঢেউ বুকে নেমে এসে হৃদয়ে বাড়ায় ক্ষত।
অন্ধকার ভালোবেসে বুকে নিয়ে পাহাড়ে উঠে যেতে চাই
আগুনের বেলুন উড়িয়ে তার ওড়ার বিভাব দেখে যেতে চাই।
ক্রীড়া
বৃষ্টি রাত্রির কলকব্জায় ঢুকে মধুবান ডাকে।
নদী হয়ে ভাসিয়ে দেয় উঁচু উঁচু ঘাসের মাঠ
ঢেউ তুলে আছড়ে পড়ে বজরায়, দেহপারে
সুগন্ধি মোম হয়ে পুড়ে তুমি নাও সরলপাঠ
একবিংশের হাড়ে ঢুকে ক্রমাগত বারে বারে!
মোম গলে শক্ত হয় আবার পুড়ে ওঠার আগে
একবার ভাসানোর পর পুনর্বার বান হয়ে ডাকে।
বহুদিন পর
বাঘটাকে বাগে পাওয়ার পর তার লেজ ধরে আছি
ডোরাকাটা দাগে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি দারুণ উচ্ছ্বাসে
পাখি কান চুলকিয়ে দিচ্ছে- গালে বসে নাচছে মাছি
নদীডাক শুনিনি; প্রজাপতির ডানাও ভাঙেনি বাতাসে।
চারপাশে গাছজুড়ে দোল খাচ্ছে বানর সজাতি মানুষ
কেউ মুখে আউষ-ঘ্রাণের চাপ নিয়ে মাতছে দিন-রাতে
কেউ বাঘের হুঙ্কার গান ভেবে আকাশে ওড়াচ্ছে ফানুস
মাছবনে তোলপাড় তুলে মাছদের কেউ-ই নেই হাভাতে।
বহু-বহুদিন পর এমন সলজ্জ অধর ছুঁয়ে দেখা হয় নাই
বহু-বহুদিন পর এমন করে ছুঁয়ে দেখতে কেউ কয় নাই!
অনাস্থা
যেন সন্ধ্যা, যেন সূর্যের ঝিমুনি— বাড়ি ফিরে যাওয়া।
অনাহুত শামুকপায়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ভর্তি হয়ে ওঠে
বাতাস, জারুলবন, সুললিত গান, পাখিমগ্ন পেঁপেফুল
জানালা গলে আসা দুধকুয়াশা— শীতের পালকে ক্রমে;
বন্ধুর পাহাড়— ম্লানমুখে নত হয়ে থাকে দূর নাবিক চাঁদ।
ওজনের হাতে পড়ে গভীর সমুদ্রে ডুবে থাকে ত্রস্ত হাঙর
মারমেইড; বর্শা না ছুঁড়ে প্রবল উত্তেজনায় দেখি পাথরÑ
গুঁড়ো হয়ে মিশে যাচ্ছে পাতায়— এই সন্ধ্যায় ঝিমুনি শেষে
যেমন জলের সংন্যস্তে শিথিল হতে থাকে আগুনের প্রতাপ।
তেমন হাওয়ার ভেতর নীলিমা কোনো নৈকট্যের রাফখাতা
কুয়াশার পেটে যত উজ্জ্বল ভোর হোক, কারো অনাস্থা তা!
যে জীবন দাড়ি-কমাহীন
এই যে সূর্য ডুবে গেল, দিন ঢুকে পড়ল আঁধারে;
কানামাছির হাত ধরে আছি- বাড়ি ফিরে যেতে
ঘোর অন্ধকারে পথ যেন হারিয়ে ফেলছি বারবার!
বাড়িটা বড় কুয়ো হয়ে আছে মরা পোড়াবার পর।
কোথাও সাড়াশব্দ নেই; এতটুকু নেই শিশির পতন
বিন্দু বিন্দু ঘামে ভিজে উঠছে পায়ে মাড়ানো ঘাস
নদীতে স্থির হয়ে আছে নৌকা— মাছেদের খলবল
বাড়ি ফিরবার পথে কাঁটা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
আমার বাড়ি ফিরবার পথ অন্ধকার; ঘন হয়ে থাকে!
শিশুসাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক। গত শতাব্দীর নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে লেখালেখি করে আসছেন। কর্মরত রয়েছেন দৈনিক আমাদের সময়ের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। প্রকাশিত বইগুলো হলো- ‘নিস্তরঙ্গের বীতস্বরে’ (কবিতা); ‘ভাল্লাগে না’ (শিশুতোষ ছড়া); ‘হাজার তারার আলো’ (শিশুতোষ ছড়া-কবিতা); ‘স্বর ভাঙার গান’ (কবিতা); ‘ভূত খেলে কুতকুত’ (শিশুতোষ গল্প); ‘রুকু টুকুর গাছবন্ধু’ (শিশুতোষ গল্প); ‘লাল পিঁপড়ার সেলফি মেয়ে’ (শিশুতোষ গল্প) ও ‘পাখিগাছ ও বুড়ো কাকের গল্প’ (শিশুতোষ গল্প)। এ ছাড়া ছড়া ও ছড়াবিষয়ক ছোটকাগজ ‘পাঁপড়’ ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সম্পাদনা করে আসছেন। ‘পাঁপড়’ সম্পাদনার জন্য পেয়েছেন আনওয়ার আহমদ স্মৃতি পুরস্কার। এছাড়া শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘দেশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার-২০১৫’ ও ‘লাটাই ছড়াসাহিত্য পুরস্কার-২০১৭’। এর বাইরেও নানাবিধ পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।