মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩

নির্বাচিত দশ কবিতা

0

বিরুদ্ধপথ


জড়বস্তুর সাথে কথা বলি।
খাতায় টুকে রাখি অযুত হরিণ।
নিঃশ্বাসের ছাই।
দ্যাখো যৌনবেদনা,
এই পরাস্ত এঞ্জিন
আজ নুয়ে আছে কার কাছে!
আহা করুণ প্লাসটিকের নল—

এইসব কিছু আজ
খুব ঘাসে ঢেকে আছে।
শুধু আমার চলার পথ
বিরুদ্ধ, অসবুজ—
এক আসফল্ট পাহাড়ের দিকে
বেঁকে গেছে।


স্নেহ


তোমাকে রেখেছি স্নেহে, সঙ্গোপনে। বাদামি
ত্বকের নিচে, মেদ ও মাংসে। যত দূর দেখি
এনজিওশাসিত গ্রাম। তোমার আঁকাবাঁকানো
হেরিংবন রাস্তা ঘুরে শেষ হয়ে গেছে টেকসই
উন্নয়নের কাছে এসে। তোমার মৌনতাপীড়িত
ফিশারিতে আজ চাষ করেছে কারা এমন
গভীর জলের মাছ! তোমার কলহাস্যমুখর
পোল্ট্রি ফার্মগুলো যেন দপ্ করে নিভে গেছে।
তোমার ভোগ্যপণ্যের গ্রাফ স্খলনপ্রবণ।
স্নেহের মতো নিম্নগামী, পরান্মুখ এমন! তোমার
স্বনির্ভরতার ইতিহাসে ‘ক্ষুদ্র ঋণ’ বলে যেন
আর কিছু নেই! তোমার কাচ-ভাঙা-হাসি
বন্ধক রেখে কিনে নেব লাল হন্ডা আজকেই।


ট্রিগার-হ্যাপি


এত কেন ঘোড়া দাবড়াচ্ছো হে তর্কবাগীশ?
তোমার দিকেই চেয়ে আছে যখন আগ্নেয়াস্ত্র সুন্দর!
ওই টোটাবন্দুক হাতে যারা শিকার করছে খরগোশ,
ঘন-ঘন নিশানা পাল্টাচ্ছে;
তারা ছড়াচ্ছে কপট ত্রাস।
স্যাংচুয়ারিতে নির্মম শুরু হচ্ছে মৃগয়াপর্ব।
কিছু দেখলেই লোকে বলছে— ফায়ার!


চিল


যুগ প্রস্তর হীন দূরবীণ
মনে অদ্ভুত সংকল্প
যেন চুপচাপ বসে পড়ছেন
গৃহী-যাযাবরে ভরা গল্প

রোদে চক্কর মেরে এক চিল
দেখে মসৃণ জঙ্গলটা
নামে তারপর ভেবে তিনবার
কিছু নির্ভার হলে দলটা

হাতে বল্লম নিয়ে ঝোপঝাড়
ভেঙে চলতেই অশ্বত্থ
যেন গাছটায় সন্ন্যাসটায়
ডানা ঝাপ্টায় উন্মত্ত

আজ সেই চিল জানে আসবেই
তার শিকারের সে মুহূর্ত
তাতে অস্থির হলো চারপাশ
ক্রুর বল্লম যেন মূর্ত

পথ বন্ধুর তায় কোন্দল
গতি সকলের গড়পড়তা
তবু আগুয়ান হলো নিশ্চুপ
থাকা শিকারীর নির্ভরতা

গাঢ় মাংসের রং রক্তিম
হলো শিকারেই হলো সিদ্ধি
ওড়ে সেই চিল খোঁজে মঞ্জিল
তার হয়নি তো ক্ষতি বৃদ্ধি

ঘন উত্তাপ বাতাসের চাপ
সারাদিনমান খর রোদ্র
দ্বিধাচঞ্চল গোটা অঞ্চল
ফেলে চিল ওড়ে অন্যত্র


অপুষ্পক-৪


ফিরিয়ে নাও ফুল
এই মত্ত ঢালাইমেশিন
যে রকম উগরায় ক্লিংকার
শ্রমঘন দুপুরের পাশে
এসে বসে মৃদু
বিকেলবেলার হাওয়া

চূর্ণ হীরক আর
ঘাসের জঙ্গল থেকে
অনাবৃষ্টির ছাট আসে
উদ্ধত বাবেলের চূড়া থেকে
দেখা যায়—
অধঃপতনের দিকে সামান্য
এগিয়ে এসেছে ফুল


পিপুল


পিপুল গাছের ডালে উঠে গেছে চাঁদ
মেঘ নেই কাছে ত্রস্ত হরিণ আছে
মসের বাগানে রাখা ক্যানোপির ফাঁদ
যেন বুবি-ট্র্যাপ মুদে গেছে খুব কাছে

রুকস্যাক ফেলে পাহাড়ের দিকে গেলে
চেনা যাবে ছায়া এই সংগত ট্যুর
পিপুলের ডাল ধরে সুবাতাস খেলে
কস্তুরী ঘ্রাণ আনে দূর বহু দূর

যেন আগুয়ান মেঘ বস্তুত তুলো—
ভেসে চলে এই বিদীর্ণ অবকাশে
থিতিয়ে আসার পর কার দিকে ধুলো
ওড়ে পিপুলের উপশাখাদের পাশে

তবু চাঁদ তার ডালে লুকিয়েছে আলো
আজ সব থেকে ভালো ট্রাভেলার জানে
ব্যাহত বাতাস হায় কতটা পৌঁছাল
উপনিবেশিক যত শব্দের মানে


মন্টেজুমা


ধসেই গেল মস্ত প্রাসাদ আজটেকার,
হিস্পানীয় ব্যান্ডানাময় দস্যুটার।
লুটতরাজে করল এমন সর্বনাশী,
কাটল মাথা যোদ্ধা দলের দাস ও দাসী।

সঙ্গে নিল রক্তরুবির মূর্তিখানি,
ঝিকমিকিয়ে ওঠার আগেই দৈববাণী—
নাজেল হলো ইউরোপিয়ান ধর্ম মতে,
ইভানজেলি মর্মকথার নর্ম হতে।

রুবির চোখে চোখ পড়তেই আস্তে থামি,
টোটেম-গুরু আজকে এমন মুক্তিকামী!
বস্তু ছেড়ে যাচ্ছেন উড়ে অবস্তুতে,
একেশ্বরী ধর্মাচারের এ খুঁতখুঁতে—

স্বভাবটিতে যারপরনাই আনন্দিত
হলেন গুরু সূর্য তখন অস্তমিত।
বাগানখানি মন্টেজুমার যেই ফুরাল,
কোত্থেকে যে আকাশ-পাতাল তীব্র আলো—

ছড়িয়ে গেল দৃষ্টি সীমায় অভ্রভেদী,
উঠল কেঁপে সিংহাসনের পাষাণবেদী।
সেই আলোতে মন্টেজুমার ঘুম ভাঙাল—
বন্ধুবেশী শত্রু-জাহাজ নিকষ কালো।

রাতের শুরু পরিত্রাণের নেই হদিশ,
ছোট্ট পাখি রাজার কাছেই অহর্নিশ —
গান শুনিয়ে বলল— ‘এরাই দখলদার।’
‘যা দিন গেছে, ফিরবে না আর আজটেকার।’


রাবার পাতায় লেখা এলিজি


রাবার পাতা ঝরল বলেই শুনতে পেলাম হঠাৎ—
বিকেল কোথায় গড়িয়ে গেল, শৈলনদীর প্রপাত
বেয়ে অস্ফুট এক শব্দ এলো, সঙ্গোপনী সুর—
তাতে জাগল আবার বনভূমি, অনেকটা পথ দূর।

সন্ধ্যের আগেই য়্যুকালিপের বাকল খুলে দেখি—
গাছের ভেতর অপার্থিব এক সুগন্ধি আছে কি?
রাবার বনের মধ্যে তখন অনুচ্চ সরসর,
যেন চপল কিছু কাঠবিড়ালী আজ পলায়নপর।

যার ছটফটানি আছে লেখা বনস্থলীর পাতায়—
স্মৃতির মতন জমিয়ে রাখা অদৃশ্য এক খাতায়।
যত লোধ্ররেণু যায় উড়ে ঐ বিকেল বেলার কাছে
যেন বন-বনানীর মধ্যখানে শান্তি রাখা আছে।

নির্জনতার ওপাশ থেকেই তখন বুনো ফুলের—
প্রায়ান্ধকারে গন্ধ আসে শূর্পনখার চুলের।
হাঁটতে-হাঁটতে ভাবছি যখন রাক্ষুসিদের রূপ,
তখন রক্তে মাখামাখি আকাশ। পৃথিবী নিশ্চুপ।


একটা খুনের ঘটনা


একটা খুনের ঘটনা
আমরা খুব আনমনে শুনব—
যেন কিছু ঘটে নাই এমন ভঙ্গিতে
পাতা উল্টাব কোনো গৌণ পত্রিকার
আর ভাবতে চাইব
কোন বিষয়গুলো আমাদের
নিস্তরঙ্গ রেখেছে

একটা ভাঙা রিস্টওয়াচ
ক্রাইমসিনের ছবি
ঘাঁটতে-ঘাঁটতে আমরা দেখব—
ভিকটিমের নিষ্কম্প চোখ থেকে
কী করে জাগতিক
বেদনা মুছে গেছে

আর আমরা দেখব—
খুনের আলামত হারিয়ে
অনুদঘাটিত রহস্যের ভেতর
একে-একে ডুবে যাচ্ছেন
দুঁদে গোয়েন্দারা


কনে-দেখা-আলো


কপিশ রঙের মেঘের ভেতর দিয়ে
যাচ্ছে দেখা সূর্য ডোবার ছবি
কনে-দেখা-আলোতে ভর করে
সত্য হলো মিথ্যে লেখা সবই

গভীর কোনো জীবন-বোধের স্মৃতি
হাতড়ে দেখি পড়ছে না যে মনে
বিপর্যাসে হারিয়েছে তারা
সঙ্গোপনে বনের নিরজনে

সেখান থেকে স্বয়ম্ভু এক আলো
ঠিকরে আসে চকমকি পাথরে
যেসব কথা বৃন্দ ঋষি জানে
লোকের মুখে ফসিলে-মর্মরে

যন্ত্রযুগের সূচনাতে ছিল
রহস্যতে আটকে পড়ার জ্বালা
কপিশ রঙের মেঘের ভেতর দেখি
ডানা-ভাঙা জেপলিনের জানালা

এসব কিছু ঘটতে থাকে প্রবল
সূর্য ডোবার অল্প কিছু আগে
রহস্যটা ছলকে পড়তে দেখি
কনে-দেখা-আলোর অগ্রভাগে

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

বাংলাদেশী কবিতা-লেখক। ঢাকায় একটি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। জন্ম ১ অক্টোবর ১৯৭৮। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ। ‘বিদূষিকার লন্ঠন’ (২০২১), ‘অপুষ্পক’ (২০১৮), ‘বৃশ্চিকসূর্যের নিচে’ (২০১৬), ‘টোটেম সংগীত’ (২০১১) , ‘ফ্রস্টেড গ্লাসের ওইপাশে’(২০০৮) ।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।