সন্ধ্যা
ওই ওই সূর্য ডাকে, আয় আয়, তার নমিত হৃদয় থেকে বাষ্প ওঠে— এই সন্ধ্যায় চুমুক দিয়ে বলি, কতকাল হলো আমাদের চেনাজানা, ঠোঁটও রয়ে গেছে অপ্রেমে; রিকশার গভীরে পেয়ে, খুলি এসো, ডালিমের রাজকীয়তা; তোমার আমার উদ্ভিদ ছেনে দিই চোখে; ওই ওই সূর্য ডুবে গেছে, গরু-মহিষের খোঁজ না পেয়ে, তাদের স্বর তবু শোনা যায় এমন সন্ধ্যায় এসো বিছানায় শুয়ে পড়ি;
তুমি যাও
তুমি যাও—যাও—যাও তার কাছে; পুরনো দরজার মতো খোলো তার বুক; জংধরা পাখি ওই তো, ওই তো, খুলছে পাখা; স্তন শুধু আর মথিত হতে নয়, তুমি যাও-যাও-যাও, তাকে বলো, বলার কিছু নেই তো? দাঁড়াও মুখোমুখি : পরস্পরের চামড়া খুবলে নাও, চাটো চাটো রক্ত চেটে খাও, হল্লা করো; পুরনো দরজার মতো খোলো নিজেদের বুক; হয়তো সেখানে কয়েক টুকরো সময় আধ-মরা অজগর হয়ে শুয়ে আছে; হয়তো সামান্য দূরত্বে থেকে একে একে বরফ হয়ে যাচ্ছে পা; তবু তাকে বলো, বহু মিথ্যের মতো, ঘৃণিত সত্যের মতো বলো; তুমি যাও—যাও—যাও তার কাছে, তাকে চেয়ে নাও; এই আমার সুঠাম অস্থি, গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলো ওড়ে, তুমি যাও—যাও, ধুলো হয়ে তবু যাও;
অসুখী গাছ
হে অসুখী গাছ, হে অসুখী গাছ, পাতা-পুষ্প ও ফলের চেয়ে তোমার কী চাই, হে অসুখী গাছ, তুমি চলো, শূন্য শুধুই শূন্য, ঘণীভূত তারারাও নয় কারো প্রতিবেশী, অসুখী গাছ, তুমি চলো, কিছু না করে চলো, অহেতুক চলো, যেভাবে ধুলোর দিকে যায় দেহ প্রেম ও সামান্য জ্যোৎস্না, চলো গাছ, অসুখী গাছ, শেকড়ের নিচে যে জল ও জলীয় তাতে তুমি তৃপ্ত নও, চলো গাছ, অসুখী গাছ; তুমি কী পারো, কী পারো, বরং থাকো অশরীরে, পাখি পাখি মন তুমি, পাখি পাখি মন তুমি পুঁতে রাখো তোমার মাটিতে, পাখি পাখি মন তুমি কোথাও যেও না, যেও কোথাও, এত এত পথ, এত এত পথ, কামিনীর ঝোপ, বৃদ্ধ মেশিনের চেয়ে নও তুমি বেশি পরিশ্রান্ত, কীসের শ্রান্তি তোমার? তুমি চলো, পাখি পাখি মন তুমি, তুমি চলো; হে অসুখী গাছ, হে অসুখী গাছ, তুমি কিছু করো বা না করো, ভাবো বা না ভাবো, যাও বা না যাও, হে অসুখী গাছ, হে অসুখী গাছ, তুমি ভাঙো বা না ভাঙো, তোমার হৃদয়ে যে পুষ্প ও পরিখা তা রাখো বা না রাখো; হে অসুখী গাছ, হে অসুখী গাছ…
দরজা
হাত রাখি, যেখানে হাত রাখি, শুধু দেয়াল, শুধু এই হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি, দেয়াল; কোথাও তো দরজা আছে, আছে নিশ্চয়ই, দরজা আছে, পালাবার; এখন পালাবো না, পালাবো না কোথাও, শুধু জানা থাকলো, না জানলেও চলে, তবু জেনে রাখা; এই দেয়ালের বৃত্তাকার চৌকোনা লম্বা হৃষ্টপুষ্ট দেয়ালের কোথাও, কোথাও না কোথাও দরজা আছে, আছে নিশ্চয়ই, পালাবার; কোথাও পালাবো না, পালাবো না, দরজা তবু আছে
শিরোনামহীন
জুতো সেলাই যে করে, ঘাড় তুলে কখনো কি দেখে চাঁদ?—এমন কাউকে পেলে জিজ্ঞেস করে নিতে পারি। সে যখন তার বাক্শো কাঁধে নিয়ে রাতের অজুহাতে নিরুদ্দেশ হয়; তাকে অনুসরণ করবো ভাবি, শঙ্কাও জাগে, না জানি মই বেয়ে বেয়ে উঠে যায় কোনো সরাইখানায়। আমি চিনি তো ওই সপ্তর্ষী আর সন্ধ্যা : এদের এড়িয়ে না জানি কোথায় গুলজার করে রাতের মনীষা।
অবদমন-০১
এবার বর্ষায় প্রেম দাও, নতুন, যেন লাল শার্ট ওড়ে কৈশোরোত্তর প্রেমিকের; আমি ঝমঝম শব্দের ভেতর, আরো একটা দুপুর তোমাকে নিঃশ্বাসে নিয়ে অনুভব করি : যাতে ওইসব মুহূর্তে থাকি স্বাভাবিক; এবার সন্ধ্যায় কোনো লাইটপোস্টের তলায় যেন রাস্তা থেকে লাফিয়ে না ওঠে ব্যাঙ : বরং ওইসব গলির ভেতর, রিকশার জঞ্জালে আটকে থেকে, একে অপরের লালা জিভ উদযাপন করি; এসো; আর এই প্রেম হোক বর্ষায়। শেষ হয়ে যাক বর্ষাতি খুলতে না খুলতে;
অবদমন-০২
নারীকে আমি কীভাবে চাই— প্রশ্ন করে দিনের কুহক; আমি উদ্যানের ভেতর সুরকি ফেলা রাস্তায় হেঁটে হেঁটে, সবে বেঞ্চে বসেছি। মাথার ভেতর ঝমঝম ঝরাপাতা। সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে হবে। টিস্যুতে ঘাম মুছে ফিরে তাকাই সামনে। ওইতো দুটি ছেলেমেয়ে হাত ধরাধরি করে, কখনো বাহু জড়িয়ে নেমে গেল বাঁশবনের সরু পথে। এরা হয়তো আড়াল বুঝে জাপটে ধরবে, মাংসপিণ্ডে অংশগ্রহণ বাড়াবে বা ঝটিকা চুম্বন শেষে শুকনো পাতার উপর হাঁটতে শুরু করবে। ওরা হয়তো সকালে এসেছে, শেষ বাঁশির পরেও আরো আরো পুনরাবৃত্তি শেষে ফিরে যাবে যার যার বাড়ি। রাতে দিনের ট্যাঙ্ক থেকে তুলে নেবে কয়েকগুচ্ছ শিহরণ। নারীর হাত ছুঁয়ে আমি কী পাই, বা শিরিষের আড়ালে অতর্কিত চুম্বনে? কেউ আমাকে এসবে প্রস্তাব করলে, অফিস থেকে কোনো এক ছুতোয় বেরিয়ে পড়বো কিনা ভাবছি। নারীর প্রস্তাব পেলে আমি নির্জন বিছানা দেখি। গনগনে দুপুরে যা এখনো শীতল, ঘুমানোর মতো।
আমার আঁধার
আমার রক্তের আঁধার তো গেলো না।
চিরপরিচিত রইলো কেবল ঘৃণা।
যারা আজ রাত্রে, রমনীয়, খুলতে দেবে পুরুষের সিম্ফনি। তাদের ঠোঁটে সিগারেটের আগুন, তৃপ্তি। পাতা তো কতই ঝরে। নিজের কঙ্কাল বিচ্যুত হলে, আরো আরো, মাংস ভালোবাসি। শুধু এই ফুটপাথে, পার্কে, ব্রিজে, আমি একা একা ঘুরে নিজের প্রণোদনা পাই না। আর দেখো, সুরভী শুয়ে আছে বৃক্ষের সাথে, কাঠ পাথর শুয়োর আর আমার কম পরিচিত বন্ধুদের সাথে। যে বন্ধুরা ঘরে মুখোশ টাঙিয়ে রাখে, বলে তারা নাটকের লোক— আমি তাদের নাটকে দেখি অজগর নিয়ে টানাটানি। শূন্যে লাফিয়ে কেউ ফেরে না মঞ্চে। থামের মতো আলো চাটে। চিবায়।
আমি জেলেদের জাল দড়িদড়া ফেলে নৌকায় শুয়ে আছি। পাটাতনের নিচে নদীর শিরদাড়া, অস্থির। আমি যতটুকু দেখি ততটুকুই আকাশ। আকাশও আমাকে যতটুকু দেখে। আমি সময় কাটাতে না পেরে নেমে যাই। ঢেউয়ের স্তনে দোল খাই। নৌকা আমার উপর চিৎ হয়ে শোয়। আর তার লগি দিয়ে আমাকে নির্দেশ করে তার দিক।
তবু ভালো। আমি আমার মস্তিষ্ক দুহাতে ছেনে খেতে দেই মাছকে পাখিকে— যেন তারা বিরোধীতা করে। নিজেদেরে শিকড় আর ঘরে ফেরায় আস্থা রাখে। আমার আবার এসব কই! আমি আপোষের পথে, রাজানুগত, আমাকে স্পষ্টতই চিহ্নিত করে দাও। যার শ্বাস টানারও শক্তি মেপে দেয়া।
সুরভী এইসব জানে। সে নিজেকে বহু ছেপে। ব্যয়িত হয়ে হয়ে। জীবন ভালোবাসে। আমি নিজেকে নিভিয়ে ফেলে নিজের ভেতর ঝাঁপ দিই
বিপ্লবের শতবর্ষে
বন্দুকের ওজন পুলিশের কাঁধে রেখেই অনুমান করি, নিজে বহন করতে পারবো কিনা ভাবি, আর ভাবি, যদি আমার হাতে ট্রিগার আসে— আমি ওড়াবো কার খুলি? নাকি সকালের সহজলভ্য কাক? এই ভেবে ভেবে পুলিশি পাহারা পার হই। পুলিশের গা থেকে প্রস্রাবের গন্ধ আসে। ওরা বেলুনের ভেতর প্রস্রাব করে, আর বাচ্চাদের মায়েরা বারন করে ওসব নিয়ে খেলতে; এইসব টুকরো কথা আমার কানে আসে। বেলুনে বেশি পানি ভরলে বিলকিসের স্তনের মতো থলথলে… ওহ্ এসবের ভেতর ঢুকছি কেনো? আজ বিপ্লবের শতবর্ষে, আমি, একটা বন্দুক কাঁধে নিতে চাই। সে বন্দুক হোক খুনি বা লুটের পাহারাদার, নপুংশক হলেও ক্ষতি নেই-বরং বন্দুকের নল দিয়েই মৈথুন হোক।
শীত
ওই শীতের কথা মনে আছে, দেয়ালঘেরা উদ্যানে ওই শুষ্ক রেখাগুলো যেন শূন্যে চেয়েছে প্রার্থনা; মেঘবৃষ্টি, ঝুমঝুম, আর কেকা মিলনের অস্পষ্ট ধনি, বা এমনও হতে পারে, তার হৃদয়ে ফুল ফোটার ঋতুতে ফুল ফোটে; আমরা দু’জন হেঁটে হেঁটে চলি, ছায়ারৌদ্রে পাতাঝরা পথে, কথা হয় সামান্যই, যার যার কথা বেশিরভাগ নিজের সঙ্গেই বলা; আমি কি আশ্চর্য হতে পারি মৌতাত ছাড়া? বা জুয়ার কোর্ট ছাড়া মুঠোয় নিতে পারি উত্তেজনা? সঙ্গিনী এইসব জানে না— এই অরণ্যে, তার কামিনী ফুটতে দেব?—সে তলপেটে ঘুমন্ত রেখেছে করতালি; ওই শীতের কথাই মনে আছে—এরপর তো বসন্ত, চড়ুইস্নানের জলও পেয়েছে রেখাগুলো, হাতে হাতে পেয়ে গেছে হলুদ খাম, ফুলআঁকা কাগজ উড়ছে হাওয়ায় হাওয়ায়, এমন একটা চিঠি অসতর্কে ধরে ফেলবে তুমিও— না জানি আবার ভুল প্রেমিকার ভর্ৎসনা কি না!
এই ভেবে ভেবে, যাই যাই বসন্ত, ওষুধ খেয়ে খেয়ে শুধু ঢুলছি
জন্ম মাদারিপুর জেলা সদরের কুলপদ্বি গ্রামে। বাংলাভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। কবিতার বই : আর্তনাদও এক বায়বীয় ঘোড়া, অসুখের শিরোনাম, দুপুর, ব্যক্তিগত পরিখা, নামহীন, ব্যটারি-চালিত ইচ্ছা, অহেতু বুদ্বুদ। গল্পের বই : বড়দের মাছমাংস। সম্পাদনা : তিন বাঙলার শূন্যের কবিতা।