ক্রুশকুসুম
আমিই আনন্দম, ক্রুশের মিনার। আকাশেরও মগডালে থেকে দেখি কোথায় তুমি—চোরাগোপ্তা ফুল। তুমি তো কাননে নও। কবরখানায় নৃত্যরত লাবণ্যপ্রেত। তোমাতে প্রেম ঢালি। তুমি আজ হাড়ে গলা মোম। আর এমতে কৃষ্ণনিখিল চুরমার। আয় ধ্বংস, আয় সবুজ। চাঁদ ডুবে যায় করুণ রসধারায়। আবার তুমি মা মেরিতে ছেয়ে গেছ; জেরুজালেমে, খড়ের গাদায়। রাত গাঢ় হলে তুমি সোনালি রক্তের জতু। যখন বনভূমি দগ্ধ শৈত্যে—জল ডুবন্ত ঘৃণায়। এই পথ কাঁটাশোভা, এই পথ যিশু। আজ ঝরে পড়ে সব সিডারের গাছ। তুমি তবে নবরূপে রোপিত বিষাদ। তার ছায়ামূলে আমি সংগীতের রিমঝিম জলশা বসাই। সেথা দ্যাখো কেমনে অসুর ঘনায়।
কবি
তমসা মিনার ফেটে
বেরিয়ে গেছ।
আরও উঁচু আঁধারের
উড়ন্ত চুম্বনের
পিছু পিছু গেঁথে
এখন শুনছ
ফুলের স্বর।
নিরক্ষর তুমি;
এই গন্ধভাষায়
জরিপ করো স্বপ্ন।
রাত্রিভর
নক্ষত্রকল্লোলে
নিহত তুমি
আবার জ্বালাও মোম
সমূহ শবের উপকূলে।
যেহেতু,
যুক্তাক্ষরময় পৃথিবীতে
তুমিই একমাত্র
সোজাসাপ্টা ব্যথা।
তারায় পাওয়া
স্বপ্নের ভেতর কত জলাভূমি, দাহপথ।
বিজন স্বপনমহলে নিত্য আসা-যাওয়া
তবু পাইনি অগ্নি
পাইনি ভেলা
খিড়কি আর সিংহদরোজায় দিনরাত বাঁধা থাকে
শুধু এক রক্তরথ।
এই উড়ন্ত নাও দিগ্বিদিক ঘুরেফিরে থামে যেখানে
তা তো নীলিমার রেশমি সমাধি।
সে সমাধির এককোণে ফুটে আছি ফুল;
বাস্তুচ্যুত, স্বপ্নহীন।
দূর সমুদ্রও ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না
আমার অপজন্মের ঢেউ।
স্বপ্নমৃত্যুপ্রসারণ
এই গ্রীষ্মেও
মুষলধারে কাঁদছে আকাশ;
কান্নাপ্রণালি
কোনো ঋতু মানে না।
দিগন্তপাতালে
রন্ধনশালার বিস্তার তার।
এর মাঝে আমি এক
ঋজুরেখ নক্ষত্রবাদি,
এই ক্রন্দনসিম্ফনির
কারুকাঠামো ভেদ করে
শুক-স্বাতী-অরুন্ধতীর
হৃৎমহলে যাই;
দেখে আসি
এক একটি নক্ষত্রের
নির্মাণশেষে
তোমার চোখের জল
কত যুগের
বর্ষা হয়ে
ঝুলে থাকে
অনন্ত
অন্তহীনে!
গোলাপের অভিঘাত
একটি গীতিময় মৃত্যুর মোহে
কাটাই গদ্যধূসর জীবন
শীতার্ত ঝংকার, কুয়াশাকণ্ঠের পর আছে
রংধনুর নদী।
কৃষ্ণবসন্তের হাওয়া
এলোমেলো করে দেয় স্বপ্নসব।
পথে পথে কত লালগালিচা ভর্ৎসনা
তবু সন্তপ্ত নক্ষত্রের
রক্ত ঝরে টুপটাপ;
একলা এই বেঁচে থাকার ঢেউয়ে।
নিকষ রাত্রির কালো কালো প্রকল্পনা
সমুদ্রের স্বরগ্রামে রূপ নিলে
অথৈ জলমর্মরের কাছে
রখাসুখা আমি
রক্তে-মাংসে ফাঁস হয়ে যাই।
অস্তগামী শেফালির ন্যায়
ফিকে হয়ে আসে জীবন
সমুদ্রে ঘনীভূত জলসংগীতে
আর আকাশের আঙ্গিকে আঙ্গিকে
আছড়ে পড়ে চাঁদ।
নিখিল নিদ্রার কালে
জাগ্রত বিবিধ রক্তের ছন্দ।
বুকের মধ্যে বেঁচে থাকা
কোনো গহীন গ্রানাদা
লোরকার চেয়েও বেশি বেদুঈন করে তোলে
অদূরে কুলু কুলু আমার মৃত্যু বয়ে চলে
বেহালায় ভেঙে পড়ে
নিঃসুর সব মহাশূন্য-মহল।
নদী হৃদয় খুলে
গল্প করতে বসে
কতো গল্প, কতো গান!
নিরন্ন নীলিমার নিচে
এতো এতো ভোজসভার ঘ্রাণ শুঁকে
স্বপ্নগোলাপ গুটিয়ে নেয়
পাপড়ি তার।
দশদিকে এইমতো
ধ্বংসের টোন সত্ত্বেও
ডেসপারেট হয়ে
খুঁজছিলাম গভীর নির্জন পথ।
কিন্তু আমাদের সময় ছিল
জনারণ্যময়,
একপাল মৃত গদ্যের কারবারি
আর প্রসাধিত অথচ ভীষণ বিকলাঙ্গ কবিতার নালা
বিস্তীর্ণ ছিল শস্যক্ষেত্রের মতো,
সবাই জানতো এইকালে
খাদ্য থেকে শিল্প
প্রেম থেকে স্পার্ম
সকল শস্যই ছিল ফরমালিনমণ্ডিত
তবু পুষ্পগ্রস্ত স্মৃতির সৌন্দর্যে
মরে যেতে গিয়েও বেঁচে ওঠতে হয়।
এই বেঁচে থাকা শুধু বেঁচে থাকা নয়,
মরণকে একহাত নেয়াও বটে
যদিও মৃত্যুঝরোকার জন্ম হয় প্রতি রাতে
স্বপ্নের বিরামহারা চোরাস্রোতে।
বস্তুত মৃত্যুর ছলে
আবিষ্কার করে চলি
জীবনেরই ভাবসম্প্রসারণ।
মৃত্যুগ্রস্ত জীবন বা জীবনগ্রস্ত মৃত্যুর পর্বে
চাই ঘূর্ণি অনিবার;
নদীনৃত্যের মুদ্রা শুষে
শ্যামল হয় মরুময় পরিগণ।
ফের আলোকপাত শুরু
অন্ধকার টেক্সটের প্রতি
পাহাড় ঘুমিয়ে ছিল যদিও
গিরিমালঞ্চের বিপুল প্রবাহে
সমুদ্রের ভেসে যাওয়ার দশা;
পাতালহাওয়া ক্ষয় করে ফেলে
সমুদয় দিগন্ত।
রূপান্বিত ইত্যাকার মরণের মন্দ্র সত্ত্বেও
দেখে চলেছি
নেহায়েত একটা পুষ্পের শ্রম
প্রশাখা থেকে পাপড়ির রক্তিমে গিয়ে
ওড়ায় কেমন জয়ের কেতন!
তার ঝরে পড়া
গোধূলিকে ঘন হতে ঘনতর করে তোলে।
বিলয়ের অভূত রঙ লেগে
জন্ম হয় আমার;
শত শত নতুন গোলাপ।
অবশেষ
খুন হয়ে যাওয়ার কালেও নীল নূপুরে ছেয়ে আছে পা; সব কর্দমের ভেতরেও পৃথিবী এমনই নন্দনের মেয়ে। শীতে কুঁকড়ে গিয়েও কথা কয় কুয়াশার ভাষায়। লোভের লাভা জ্বলমান; তার আঁচ গায়ে লাগে— অঙ্গার আর ছাইয়ের ডাঁইয়ে পড়ে থাকে মেয়েটার কম্পিত ক্রন্দন। জীবন থেকে নিয়ে মরণের দিকে যাওয়া— এই-ই তো ছিল সোজাসাপ্টা রাস্তা৷ তবু ভুল করে যে মধুপথ বেছে নিল সে; লোকে সেই সন্দেহজনক সন্দর্ভকে ‘কবিতা’ বলে ডাকে।
পরিস্থিতি
মৃত্যু আর মৃত্যুর গুজবে
এখন কতটুকু পার্থক্য!
বেঁচে যে আছি আজও
এটা আসলে
বেঁচে থাকার গুজব নয়তো?
আত্ম-অপ্রতিকৃতি
নীল নৈঃশব্দ্যের নন্দন
কোথায় আছে যেন,
কৃষ্ণ কোন গহন কল্লোলে?
ঘৃণার মুকুট মাথায়
প্রেমের পায়েল পায়ে
কতদূর যাওয়া যেতে পারে—
মধুর পাতাল থেকে
একঝাঁক মহুয়া-মিনারে!
এই শীত সাঁতরে সাঁতরে
রোদের রুহতে করে
ঠিকঠাক যাব পৌঁছে
দিগন্তদালানের সেই
মেঘলা কুটিরে।
তুমি তার তনুর তরু
বুকের বিতানে
কেনাবেচা রদ রেখে
জপতে থেকো
অরণ্যের সবুজ আয়াত,
ধূসর দ্বীপের স্মৃতি
রঙের বাক্স হাতে
কোনো এক মায়ামেয়ে
অন্ধের আয়োজনে
প্রয়াত চোখের
শোকসভা ডেকে থাকে।
খয়েরি খাতায়
রোদের রূপরীতি,
বেঁচে থাকাই
মৃত্যুর প্রগাঢ় স্বীকৃতি
ও আমার প্রাণপরি,
আগুনের অন্তরে
হারানো জলের ধারাধ্বনি।
বুনো ঘাসের ঘাটে
থেমেছে জানি
হলুদ হেমন্তনদী।
এত রঙিন রান্নাবান্না
জীবন এক রসুইখানা
তবু কবিতায় যায় না ছোঁয়া
পাহাড়ের লাল কান্না।
পৃথিবী-গতির গ্রামে
স্তব্ধতার শোভাছায়া
পেরিয়ে-মাড়িয়ে
অনন্তের চুরমার
এই তবে বসন্তবাহার।
বেঁচে থাকার বাস্তবে
বিক্ষত বর্ণের নীচে
আমি এক ফিরোজা ফুল;
দ্যাখো, তুমি তার
সুবাসের নগ্নতায়
পেলেও পেতে পার
তোমার পছন্দের ড্রেস;
পার্পল কালার।
মৃত্যু মূলত মিউজিক
বাবা আমাকে
পাতাল থেকে তুলে
পৃথিবী দেখিয়েছিল,
সেই বাবাকে আজ
পাতালে রেখে এসে
ব্যাকরণ-অজ্ঞ আমি বুঝি
সকল অমল
ধবল হয়
কবরের কালো পরিভাষায়।
পৃথিবীতে তারাদের তহবিল
খালি হয়ে এলে
সন্তানের বুকের ভেতর
প্রয়াত পিতার সমাধি জ্বলে।
থেকে থেকে
এই পাষাণপ্রহর
জানায় আমাকে,
মৃত্যু মূলত মিউজিক
প্রতিটি কফিনে
কিছু সুর লেগে থাকে।
ভাষা
তোমার কাছে আসার পথের শত্রু—
আমার নড়বড়ে ভাষার সেতু।
প্রেম তো কিছু
অলীক অক্ষর।
জন্ম ২১ ডিসেম্বর, ১৯৮৪ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, বাংলা একাডেমিতে কর্মরত। কবিতার বই আছে বেশ কিছু। লেখালেখির সূত্রে পেয়েছেন কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মাননা, ঘুরেছেন বিশ্বের বেশ কিছু দেশ। piasmajid@yahoo.com