বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

নির্বাচিত দশ কবিতা : ফারুক সুমন

0

নির্জন প্রান্তিকে


তোমরা যারা কবিতা লেখ
অথবা শব্দ কারিগর
আমাকেও ডেকে নিও
চিনিয়ে দিও কবিতাঘর
আমার কোনো দশক নেই
জনহীন প্রান্তিকে—
আমি এক দলছুট কবুতর।

উঠে এসেছি হামাগুড়ি দিয়ে
কনুইয়ে কাদার দাগ
হাঁটুর বাটিতে কালো মতো কড়া
আমি তবে কোন দশকে যাব?
সত্তর, আশি, নব্বই?
না, তাও নয়। তবে শূন্য!

এভাবেই দশক বিচ্ছিন্ন হয়ে
ভেসে বেড়াই মহাশূন্যে
অবর্ণনীয় বর্ণমালায় বিবৃত জন্মবৃত্তান্ত
হে কবিতাদেবী! দশক চাইনা
কবিতার দান দাও; দাও অমরতা
দাও বিমূর্ত মিনারের শুভ্র অবয়ব।


ধূলিভায়োলিন


কবির মৃত্যুর পর
কিছু কবিতা মুখ্য হয়ে ওঠে
ভীতসন্ত্রস্ত হরিণের বনে
অনন্ত দুঃখ জমে থাকে।

এই যে নকশাকাটা লতাফুল
বাটালির মুহুর্মুহু আঘাতের দাগ
সুশোভিত দেয়ালের গায়
তবু মৃত্যুই যেন চিরন্তন ডাক।

এত যে অবারিত প্রীতি
কাজলটানা চোখ, চিকন সিঁথি
মিহি ডিজাইন চৌকাঠে, অবয়বে
এখানে কাঁদবে একদিন, ধূলিভায়োলিন।


ফসলকাটা মাঠে মাঠে বিরহ-নীরব


ঈর্ষার কলহাস্যের শিকার হয়ে
ভীষণ বিনীত দেখো ময়ূরের মুখ
ঝাঁপি থেকে উড়ে যায় অদৃশ্য পাখি
কিভাবে রুখবে তার আদরের সাখী!

বঁধুর আঁচলে বাঁধা প্রণয়ের ফুল
পাখি রূপে উড়ে যায় যদি হয় ভুল
একবার চোখে তার ভেঙেছে পাহাড়
তারপর কোনদিন নেয়নি আহার।

আহারে চর্যার নারী টিলাতেই বাস
আজন্ম করেছিলে দুঃখের চাষ
জলরেখা দেখে দেখে শিখেছ প্রণয়
জলবনে একা একা শুধু অভিনয়।

রক্তবর্ণ ফুল এনে দিয়েছ কসম
প্রণয়ের নাম করে দিও না জখম
এখন হেমন্ত ঋতু রিক্ত অনুভব
ফসল কাটা মাঠে মাঠে বিরহ নীরব।


মনে মনে পুষে আছো কাঁচের সিঁড়ি


মাটিতে হাতের তালু আদুরে মোকাম
পায়েতে পথের ধুলি ডাকে দূরগ্রাম।
নিরক্ষর ভালোবাসায় বেশি উল্লাস্বর
অবুঝ বেহুলা তাই খোঁজে লখিন্দর।

করাতকাঁটার খাঁজে খাঁজে বিচ্ছেদের সুর
কবিও করাতকাটা কষ্টে কষ্টে ভোর।
মনে মনে পুষে আছো কাঁচের সিঁড়ি
মনে মনে জনে জনে প্রণয়বাড়ি।

ঘোড়দৌড়ে ধুলি ওড়ায় বেজন্মা বাতাস
ধুলিকণার স্ফূলিঙ্গে আলোকোদ্ভাস।
খুরের দৃশ্যে ভাসে রক্তজবা চোখ
মুহূর্ত মিলিয়ে গেল তাই এতো শোক।

এতোটাই বেপথু হলে তিমিরের খোঁজে
বিবেক বিবস করে ভোগবিলাসে মজে।
বেঁচে দিয়ে সুরম্য আবেগের বাড়ি
মনে মনে পুষে আছো কাঁচের সিঁড়ি।


জালের জমিন জুড়ে ছেঁড়া হাহাকার


রক্তজলে ধোয়া এই ধীবর জীবন
ভালো লাগে না, পোড়ায় ভীষণ
জল নেই এখন আর জলের মতন
নদী মরে পড়ে আছে, সাপের জখম
কান পেতে শোনা যায় মাছের মাতম।

শৈশবে, পিতার পাতানো জালে
আমার হাতের ডুলা ভরে যেত
নানাপ্রকার মাছের আহ্লাদে।

সেই শখ ফুরিয়েছে এই আকালে
বেড়েছে দিনে দিনে দেনা ও দূষণ
জালের জমিন জুড়ে ছেঁড়া হাহাকার
তালি দেওয়া অজস্র চোখের কিনার।

ডুলা হাতে জাল নিয়ে ধীবর জীবন
পিতা, ওপারে ডেকে নাও- কসম
রক্তজলে ধোয়া এই ধীবর জীবন
ভালো লাগে না, পোড়ায় ভীষণ।


পাপ ও পতন


হয়তো মোহ, হয়তো মায়াজাল
হয়তো কন্দর্পকান্তির মতো
নিঃশব্দে সময় কাটে
কিছু মৌনমুখ, কিছু মুখরতা দেখে।

এই যে আমাকে দেখ—
কেমন হেসে উঠি গানের জলসায়
কেমন ঝলসে উঠি ধূসর পাতায়
দুধঢালা পর্বতের খাঁজে খাঁজে
হারানো হৃৎচিহ্নের খোঁজে।

মানুষ মূলত চিহ্নের অনুগামী
চিহ্নের খোঁজে উদ্ভিন্ন হয়ে
দিনশেষে ফিরে আসে
পাপ ও পতনের গল্প নিয়ে।


মগ্নগিরি, ঝিরিপথ


এই যে মগ্নগিরি, এই যে ঝিরিপথ
এই যে অতৃপ্তি, এই যে আয়ুরথ
তুষারাবৃত মন নিয়ে রয়েছ নিশ্চল
কেমন স্তব্ধতা অথচ শক্তি প্রবল
লুকিয়ে রেখেছ মোহের মোহর।

প্রতিদিন এখানে শতচোখ জুড়ে
আবেগপরায়ণ পাখির বিলাপ
হে হিমালয়, তুমি শুনতে পাও?
অনিকেত মন, অন্তরোৎসার।

এখানে নারীমন খুঁজে ফেরে ঘর
এখানে পুরুষ যেন নিঃস্ব যাযাবর
এখানে শিশু যেন আবেগের চাঁদ
এখানে বৃদ্ধ যেন অন্ধকার রাত।


জলধোয়া দেহ


অচঞ্চল জলের ভাষায় ডেকেছিলে কবে?
মনে নেই আঁকাবাঁকা ঢেউ
মনে নেই ডেকেছিল কেউ।

অচঞ্চল জলের ভাষায় ডেকেছিলে কবে?
মনে নেই জলের বুদবুদ
মনে নেই জলধোয়া সুখ।

অচঞ্চল জলের ভাষায় ডেকেছিলে কবে?
মনে নেই জলজ জোয়ার
মনে নেই জলজ বিহার।

তারপর জলবাসের আশায়—
ফেনায়িত দীর্ঘ ভ্রমণ
গাঢ়তর গভীর রমণ।
তবুও আঁকাবাঁকা সাপের সাঁতার
তবুও প্লাবন—

ডাকাতিয়ার ঘাটে ঘাটে জলধোয়া দেহ
আমাকে ডাকে না, ডাকে না কেহ।


জলপ্রেম


জলের শরীরে শয্যা পেতে
লিখে চলি জলপদাবলি
জলময়ী ফিরে এসো তবে
সিক্ত হোক মরুবুক বালি।

আমাদের কথা হোক
জলজ সুরে
আমাদের দেখা হোক
প্রণয় পুকুরে।

জলের তলদেশে
রতিশেষ পরিণতি নিয়ে
শয্যারচনা করে
ঘুমিয়েছে বারুণী বরুণ।

জলের নাভিমূলে
ভীষণ আহ্লাদে
ফুটেছে জলজ কুসুম।


তাবিজ পুরাণ


প্রতিদিন বাড়ি আসে ব্যর্থ ইতিহাস
অম্লজলে লিখে রাখি আফিমের চাষ।
উর্বর জমি জুড়ে ব্যর্থতার বীজ
ছড়িয়েছি বীজ নয়; বাঁচার তাবিজ।

কৃষকের গোলা ভরে তাবিজ পুরাণ
কৃষকের কানে বাজে শ্মশানের গান।
হাতের তালুতে আহা কষ্টের কড়া
অহোরাত অনশনে শুধু নড়াচড়া।

ক্ষেতের আইল ভাঙে অবুঝ ইঁদুর
কৃষকের মন ভাঙে স্তব্ধ দুপুর।
ঋণের হরিণ কভু ছাড়ে না তো পিছু
আমি যে চাষার বেটা জাতটাই নীচু।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১ মার্চ ১৯৮৫। শাহরাস্তি, চাঁদপুর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং উচ্চতর এম. ফিল. (২০১৪) ডিগ্রি অর্জন করেছেন। একাডেমিক কৃতিত্বের জন্য পেয়েছেন ‘নিপ্পন ফাউন্ডেশন অব জাপান’ (২০০৬)  শিক্ষাবৃত্তি। ২০১৯ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত 'সার্ক সাহিত্য সম্মেলন' এবং ‘নেপাল আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন’-এ যোগদান করেন। সম্পাদনা  করেছেন (যৌথ) লিটল ম্যাগাজিন 'অক্ষৌহিণী'। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক 'পোয়েম ভেইন বাংলা'। লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন 'রউফিয়ান রিদম সাহিত্য সম্মাননা-২০১৬' 'উচ্ছ্বাস প্রহর সাহিত্য সম্মাননা-২০১৯' এবং 'সমতটের কাগজ লেখক সম্মাননা-২০২০'।

বর্তমানে 'বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ' (রাইফেলস কলেজ, বিজিবি সদর, পিলখানা, ঢাকা)- এ বাংলা বিষয়ে অধ্যাপনায় নিয়োজিত আছেন। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: কাব্যগ্রন্থ:১. 'অচঞ্চল জলের ভিতর নিরাকার বসে' (২০১৭); 'আঙুলের ডগায় সূর্যোদয় (২০১৮); 'বিচঞ্চল বৃষ্টিবিহার' (২০২০)। প্রবন্ধগ্রন্থ: 'শামসুর রাহমানের কবিতা: নগর-চেতনা ও নাগরিক অনুষঙ্গ' (২০১৫); 'শিল্পের করতালিi' (২০১৯); 'শামসুর রাহমানের কাব্যস্বর' (২০২১)। ভ্রমণগ্রন্থ: ভ্রমণে অবাক অবগাহন (২০২১)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।