সাতপুরুষের ঘড়া
শ্যাম অঙ্গে তোলো নারী দ্বিধাকাঞ্চন ভরা
সঙ্গোপনে মেলে ধরো সাতপুরুষের ঘড়া।
পানপাতা মহুয়া নারী চন্দ্রাবতী কলা
ধানদুর্বা বিন্নিনিধির মঙ্গাজল তোলা।
শ্রাবণে সে ঘোরলাগা রহস্য শহর
কোশা নৌকায় ধ্যান করে তোমার নাগর।
অনিয়ম পায়ে এসো মৎস্যগন্ধা মায়া
নুন্নির মূলে খাড়া ভাটি গাঙ্গের নাইয়া।
নিদারুণে আশা এই লগ্নির ভাগ লৈয়ো
শস্যবতী হাতের কড়ি দুঃখসমান আয়ু।
আকালের হাওয়া বসে বিরান খামার
আনো ঘরে দুধভাত কিষাণী আমার।।
লকডাউন
আমি তো ভুখের কাছে সারাজনমই লকডাউন, আমারে মারতে বন্দুক দাগাও— কিন্তু আমি কই— আমি কেউ না, কিছু না— আমি খালি একটা ক্ষুধার নাম!
আমি ভূমিহীন, আমি রাস্তার ছেলে— হাড়ের ভিতরে মজ্জা।
আমি রক্তাক্ত স্নেহ, আমি দিনমজুর মেয়ে— মরতে চাই—
কিন্তু মরি না, আমি সাফা মারওয়া,
ক্ষুধার চোটে আল্লার আরশের দিকে দৌড়ে যাই শনশন হাওয়া, আগুন লাগানো সুন্দরবনে আমি বাঘ— তোমার লকডাউনের ক্ষুধা!
সঞ্জীব দাস
নীরবতা নীরবতা সঞ্জীব দাস,
ঘোড়াউত্রা খলবল ভাঙা রাজহাঁস।
হাওয়া থরোথর ওই কাল মহাকাল,
গাঙ বয় পায়ে পায়ে মায়ের কপাল।
বুক পেতে কেন হও নিরাশ নিরাশ,
নীরবতা নীরবতা সঞ্জীব দাস।
ঘোর লাগে মেঘে মেঘে চিতার পাশে,
দেবতা বরুণ নাচে পানির ত্রাসে।
ঘর ভাসে দোর ভাসে শাবাশ শাবাশ,
নীরবতা নীরবতা সঞ্জীব দাস।।
কামরাঙা গুণাগুণ
প্রত্নের অধিক উয়ারি বটেশ্বর তোমার দেহভ্রমর,
কাজলমাটির নকশাকাটা বাঁক প্রতিমার কোমর।
মেঘ পরিধান কেমন ম্যাজিক ফুটিয়া থাকো টগর,
তোমার মায়ায় টলমল করে শত পুণ্ড্রের নগর।
চকিতে নিথর পুরা ইতিহাস বিনাশের ডালপালা,
নিদয়া হও ক্রিয়াবতী নারী গাঙ্গের ছলাকলা।
প্রথম মোহে মেলিয়া ধরো অবিশ্বাসের ময়ূর,
ফোটাও পরাণ তামা রৌদ্রে নিত্য আগুনপুর।
শস্যগন্ধা পাখির প্রথা দূর নিশানার দিক,
পানরাঙানি ঢেউয়ের সমন ফুলের কসম নিক।
ভাঙন দিনের রাজহংসী নৃত্যবতী আকার,
ডুবো ডুবো সঙ্গোপনে মৌনপুরে যাবার।।
ফিনকি দিয়ে গল্পটি দরজার মুখে আসে
কৌরাল কাঁদিয়া ডাকিছে তিনপ্রহর নিশীথিনী বনে
নিঃসহায় রেখাপাত তার নয়নকোণে!
পদকমলে নিঙারি নিঙারি ঝরে,
আহা জলমোচর বসন্ত!
নক্ষত্রতারাদের সহমর্মসহ বিহবলতা দাঁড়ায়
কোজাগরি রাত্রির দুহিতাসকল,
পুত্ররা অবধি- কন্যাকুমারী বরুণ শাখার নরম সংবেদনায় হলাহল;
সহদূরাভিগামী মা দুর্গা, জননী ফাতেমা— মাতৃধারা,
ও আমার আকনমেন্দি পাতা!
বৃক্ষতল আর কুয়াশাআঁধির এক সঙ্গীন অতল
বল্কলপরা অনাদিকাল মোহনায় হাসানের ঘোড়ার পিঠে দেখো দেখো আশাস্থির অর্জুন আসে!
পুত্র তোমার- কাদা আর পাটফুলের মর্মে,
মৃত্তিকামূলে বোবাধরা জ্যোৎস্নাওড়া কালে!
ওম বিলীয়মান স্মৃতির শিমূল— আভূমি পদচিহ্ন,
পূর্বপুরুষের রক্তপাতের নামে কথা দেবার চিঁহি।
ওম শোনিত লৌ রক্তকল্যাণধারা; কে জানে আবার
কোথায় কোন গঞ্জের কলরব মাথায় একাত্তর
গল্পআকুতির হারানো অ্যাগোনি: ফিনকি দিয়ে গল্পটি
দরজার মুখে আসে;
ওম গর্ভবতী পাথর কাতরায় শিহরন লাগি।
নির্বিকার বিন্দুটি
কৃষ্ণ মাত্র ১৬বছর বয়সে বাঁশি বাজানো ছেড়ে দেন। তিনি যখনই বোঝেন রাধার মন তমাল গাছের একটি পাতা বুঝি কেঁপে উঠেছে, তখনই বাঁশিটি রাধার হাতে তুলে দিয়ে একটি দূরত্বের রঙে লুকিয়ে যান। এভাবেই লীলাবান কৃষ্ণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণে রূপান্তর লাভ করেন।
আবদুল হাই বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে জলের ঢেউয়ে মিশে মৃগেল মাছের চোখের মণিতে সিদ্ধ হন; মৃত্যুকে পরিধান করে আবদুল হাই মেঘের ধামে বিদ্যুতের পদ্মহেমে লোকান্তরে মেশেন। রঙমালা বেগম প্রতিদিন গণক ডেকে দিশা গুণিয়ে দেখেন— কবে আহা, তার সাধু হাই বাড়ি ফিরবেন! চুলার আগুন একাএকা তরকারি পুড়ে ফেলে, কিন্তু তার আঁচ তাকে ঘুনাক্ষরে স্পর্শও করে না। এভাবে রঙমালা একটি স্থিরবিন্দু, নির্বিকার ঈশ্বর হয়ে ওঠেন।
সন্ধ্যা গড়িয়ে ঢালুতে নামতেই প্রতিদিন নিরুপমা পিসিমার জ্যোৎস্নার ডালি সাজাতে ইচ্ছা করে। দুধেদুধে অন্ধ দুনিয়া দেখতে নিরুপমা পিসিমা ঝামায় কাসার থালাটি ঘষেন- ফলে থালা ঝকমক করে ওঠে। কাহার তরে জানি মায়াপাত্রে জ্যোৎস্না তুলতে দরজার দিকে যান। পিসিমা ভুলে যান, কবেই ওই দরজা আদিঅন্ত কালের জন্য বন্ধ হয়ে গ্যাছে!
পিসিমা নির্বিকার। নিরুপমা পিসিমা এভাবেই ভগবান হয়ে ওঠেন।
আনার দানা
তামাম দুনিয়া বুঝি একটা আনার ফল, হঠাৎ ফেটে গিয়ে আকাশ ভরে ফুটে উঠেছে তারা- আনার ফলের দানা।
এতো তারার ঝিলমিল নীরবতার নিচে, নক্ষত্রখচিত কোটি শিশুর মহল্লায় ঘোর লাগে— নিজের বুকের ভিতর সাত তবক আসমানের শিবনাথ ইশকুলে কখন যে অনূদিত হয় সরিষাপুর গ্রাম, ঢাকা শাহবাগ উপন্যাসের মোড়, আর ফিলাডেলফিয়া লিবার্টি বেল অঞ্চলে তুমুল জেনট্রিফিকেশনের উন্নয়ন উচ্ছেদ।
এতো হৈ-হুল্লোড়, ঝকমারির ভিতর আমার ভুবনপুরে এসে ছাউনির ঘর তোলে আমার নানু— সূর্যের মা— একাত্তরের যুদ্ধ থেকে যার ছেলে আর কোনদিন ফিরে আসেনি; কৌরালের সঙ্গে তার রাত্রিদিন জেগে থাকা সংসার- ঘুম নাই, জমজমের পানি নাই : জীবন বুঝি পলিথিনের ব্যাগ- কান্নায় গলে না, অপমানে টলে না।
নির্ঘুম নানুকে দেখি- কী অপার মমতায় জায়নামাজের পাটি ভাঁজ করে রাখে; মনে হয়— যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া তার ছেলে মিজু বুঝি জায়নামাজের ভাঁজে ভাঁজে মিশে আছে!
নানু কী আমার উপর এসে ভর করে? না হয় আমিও কেন পালা কেটে কেটে জমা রাখি লাটিমের ঘুন্নি, উষ্ণা বাড়ির পিছনে খালের করচনা ঢালুতে পড়ে থাকা ভূতলবাসী হামিদের বুকে জমাট রক্তজবা, সেই খালের ঢালুর উপরেই হঠাৎ দুইবেণী কিশোরী এক আমার ইনসমনিয়ার ভাঁজে ভাঁজে আজও ফুটে থাকে!
এতোদিন পর আমি হই আম্বিয়া খালা— ভাসতে থাকি আশার জাজিমে; আমারও চারপাশে স্তুপ হয়ে জমে ওঠে ইসিমের দানা- রইন্না গুডা, বুড়ি দাদী আয়নার মা’র এক প্যাঁইচ্চা শাড়ি- মৌলাধুনিক এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম; ও আমার অন্তর কানা, আকাশভরা সূর্য-তারা, আনারদানা।
রক্তকরবী
যূথিকা হতে চেয়েছিল মানুষ ও বনের চিত্রাহরিণ,
মোফাক্কর প্রকল্প করেছিল— তেঁতুলগাছের ভুত হবে,
হাতে রাখতে চেয়েছিল লাল রামদার ভাষাগুণ;
ময়ূর পাখিটি বৃষ্টিতে ভিজে হতে চেয়েছিল রোদ।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার ভেবেছিল—
আর কতো বনে বনে আনালে বিনালে ঘুরি!
এবার তাহলে বাঙলাদেশের সংবিধানের কেন্দ্রে
ছাউনি বানিয়ে থাকি, গপশপ করি,
এমনই কথা তো পণ ছিল উনিশ শ’ একাত্তরে;
দুনিয়া থমথম, নৈঃশব্দ্যের মৃদঙ্গে কেঁপে ওঠে
প্রচণ্ড ঝড় আসবে বলে- সব ভেঙে মায়া হবে—
কী জগৎ ওঙ্কার তুলবে তীব্র ভূমিকম্পে—
ভাবি, এই বুঝি আমাদের নন্দিনী আসে!
সড়ক ভরে যক্ষপুরীর শিশু শ্রমিকেরা
মাথা নিচু হেঁটে যায়—
হাতে পায়ে পিঠে বই, বই আর জ্ঞানের সিন্দাবাদ,
সামনে পিছনে অধ্যাপক।
ভরা শস্যের মরশুম এলো না-কী,
অন্ধ হাওয়া বাড়ি বাড়ি বিলি করে আগামী বর্ষার ঠুলি
নন্দিনী, নন্দিনী- রঞ্জনের ডাকে তুমি কেমন অবিচল—
হাতে ধরে না ঘোরাও গন্ধমের ফল।
পিতাপুত্র
আকাশে জানলার বাইরে বজ্রপাত হয়
জীবনসংহারি আর রোমাঞ্চকর।
বাবা বহুদূর থেকে বাড়ি আসবেন।
দিনের আলোয় বেরিয়ে যান, রাতে বাড়ি ফেরেন।
অনেক পথ হেঁটে আসেন।
তাঁর হাতে টর্চলাইট থাকে না
চোখেও অতো ভালো দেখেন না আজকাল।
বাবাকে বৃষ্টি বিদ্যুৎসংকুল রাতে
আলো দেখিয়ে ঘরে আনবো বলে
কুপিবাতি হাতে বেরুই।
মিকাইল ফেরেশতার এক ধমকে
বাতি নিভে ছারখার।
ভাঙা হারিকেন খুঁজে বের করি
চিমনির নিচে ছোট একফোঁটা আগুন
দিগন্তজুড়ে জ্বলে।
হারিকেন হাতে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকি
আমি— এইটুকু এক বালক
বজ্রপাত হয়— জীবনসংহারি গমক!
দূরে মনামারা পুলের কাছে একজন লোক দেখা যায়
বজ্রপাতের আলোয় বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে ভারি অন্ধকার!
ঠাডার শঙ্কার ভিতর বাবা বাড়ি ফেরেন
আমি ভাঙা হারিকেন হাতে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকি!
বজ্রপাতের আশায় আমরা দুজন
অপেক্ষা করি— আমি আর বাবা।
বীজ ফোটে
খুলে যাচ্ছে নক্ষত্রের বীজ এককোটি একশো দরোজায়
বীজ ফোটে গন্ধে বিভায় আদি ওঙ্কারে
আশিকল করাতকলের চেরায়।
ফেটে যাচ্ছে দ্বিধা ও পরম্পরার ফসিল
সভ্যতা আর ভোটাভুটি নয় কেবল,
সভ্যতা আঁচিল মোরগ, সভ্যতা কর্মজীবী মানুষের
ছিন্ন, ফাটা ভাঙা কররেখা।
তুমি কিছু বলে যাও উড়ন্ত কেশর আমার ঘামে ও কামে
আমি শুনতে না পাই
আমি যে চারুগ্রন্থের বোবা আর বধির দেয়াল
তুমি বলো চিত্রকল্পে উপমায় তামিল ও হিব্রু ভাষায়।
আমার নিশিপাওয়া গাঁথুনি কেবল আদিবাসী কৃষকের লিথুয়ানিয়ান খনন
ঢেউয়ের পাকে ডুবতে শিখি একহারা সাম্পান
ভেঙে ভাসো ডুবে হাসো তিনসন্ধ্যার গা ছমছম শঙখিনী রাধা।
মাছের আঁশছাড়ানো তিনসন্ধ্যায় আলগোছে খুলে পড়ে ধাঁধা
সেলাই করো কালবেলা, হৈহৈ জেগে ওঠে প্রথাহীন শ্যাওলার দিঠি
মহাকালের বিচলিত আর্তনাদ ও ধ্বনি
সেলাই কলে নকশা আঁকো মায়াবী সর্পিণী।
নক্ষত্রের বীজ খুলে যাচ্ছে এককোটি একশো দরোজায়
আদি-অন্ত জংলী রাতে গহীন ঢালুর চূড়ায়।
কবি, নাট্যকার, অনুবাদক। জন্মেছেন ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। পড়াশোনা বাজিতপুরে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বহুদিন দেশের বাইরে— যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় থাকেন। বাংলাদেশে নাটকের দল— গল্প থিয়েটার-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য; নাট্যপত্রের সম্পাদক। নানা পর্যায়ে আরও সম্পাদনা করেছেন— সমাজ ও রাজনীতি, দ্বিতীয়বার, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পূর্ণপথিক, মর্মের বাণী শুনি, অখণ্ডিত। প্যানসিলভেনিয়ায় কবিতার আসর– সংবেদের বাগান-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। প্রকাশিত বই: আখ্যান নাট্য : নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে। আবের পাঙখা লৈয়া। প্যারাবল : হৃদপেয়ারার সুবাস। কবিতা: পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর। নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো। দূরত্বের সুফিয়ানা। ভাষান্তরিত কবিতা: ঢেউগুলো যমজ বোন। ছিন্নগদ্য : সঙ্গে প্রাণের খেলা। প্রকাশিতব্য নিবন্ধ : আশ্চর্য বতুয়া শাক ও কাঁচা দুধের ডিসকোর্স।