শনিবার, নভেম্বর ২৩

নির্বাচিত দশ কবিতা : মুক্তি মণ্ডল

0

পথভোলা


সবুজ নেশার পথভোলা আলো সিংহ
মেঘের ধ্বনিতে ঘরছাড়া
মহুয়ার উন্মুক্ত জগতে, খড়ের গাদায়, একা।

চারিদিকে খোলা, যেইদিকে নদী পথ সেইদিকে
মুখ করে গাঢ় এক আকাঙ্ক্ষায়
মানুষ দেখবে বলে ঠাঁয় বসে থাকে।

মানুষেরা আসে না, ঘাট ছেড়ে উঠে আসে ডাঙায়
একে একে হরেকরকম ভালুকেরা
তাদের মুখে মানুষের গন্ধ, মাংশের কণা।

এইসব দেখে আর দূরতম দিগন্তে অসম্ভব মেঘের
পিঠে উড়ে যায়, আর নাঙ্গাভুখা
আকাঙক্ষার সর্বস্ব খুলে রক্তবর্ণ তৃষ্ণার
সিংহিনীর খোঁজ করে।

সিংহিনীরা লুকিয়ে আছে মানুষের গায়ের গন্ধে, মাংশের
কণায়, পথভোলা তাই বসে থাকে,
যেইদিকে দৃষ্টির বক্ষ খোলা দুয়ার
সেইদিকে মুখ করে।

তোমার মুখের স্বদেশী পক্ষীকুল আর মেঘের ডাকে
আমাদের প্রচলিত বিধি-নিষেধের তীর ছেড়ে
ঝোপের গভীর মুখশ্রীতে পথভোলা ঘুমিয়ে রয়েছে।


নাচের স্কুল


ওইখানে নদীর শুকানো দাগ, কালোসংহার, মায়াসূচি খুলে একটা গাছের নিচে সবুজ সংরাগ
জড়িয়ে আছে, যার ভেতর তুঁতশিল্পের পোকাদের বেদনাসমূহ নীলজরি
তারা শিরার ভেতর কাল রাতে অনেক পাখি উড়িয়েছিল,
তাদের চোখের মৌচাকে মেঘলা আকাশ।
নেচে নেচে আজ আমার শরীর খুঁড়ছে, পাখি বিক্রেতার মুখে মিলিয়ে যাচ্ছে ঝুমঝুম বৃষ্টির শব্দ,
তারে জাগিও না।

হাতের মধ্যে দেখো বাঁশিওয়ালার ধড়, কালী মন্দিরের পাশে ঘুমানো পাগল দেখো মিটিমিটি
আকাশের তারা, তাকে জাগাও, তার
চুলের বাগানে খুন হয়ে যাওয়া শেফালী ফুলের মালায় আজ রোদ উঠেছে।

নদীহীন মুখের মানুষেরাও দেখো যেচে যেচে নাচের স্কুলে এসেছে, ওদেরকে তুমি নাচ শেখাও,
আমি এখন ঘুমাতে যাবো বংশীবাদকের চোখে,
আমাকে কেউ ডেকো না।


সহজ মানুষের হাটে


যে সব মানুষেরা এলাকা ছেড়ে কোথাও যায়নি
তারা যৎসামান্য আনন্দলোক দেখে জীবনের ক্ষুদ্র ভাঁড়ারে
অপ্রকাশিতই রয়ে যায় দেহখড়ের নিমগ্ন বেড়াঘর
চৌকির পাশে অবহেলায় পড়ে থাকে তাদের পানের বাটা।

গুটানো শীতল পাটির ভূপৃষ্ঠে
এইসব ক্ষুদ্র মানুষেরা মাটি লেগে থাকা ঘ্রাণ মুঠো করে
ঘুমায়, আবার জাগে।

আর নৈসর্গিক কাঁটায় যারা দাসানুদাস, তাদের হৃদয়
চমকিত হয় বিজলিতে, বৃষ্টি শেষে এরা ঘর থেকে বের হয়
দিগন্তের প্রলোভনে এরা সংসারের মায়া ত্যাগ করে
ছড়িয়ে পড়ে সহজ মানুষের হাটে।

এদের ভেতর প্রতারণা বলে কিছু নেই, এরা আওলানো
জীবনের খানা-খন্দে পরিভ্রমণে বের হয়
পুঁথিগ্রন্থের ময়লা ছেঁড়া পাতার কোণে এদের সংরাগ, বাসনা
মনোরীতির জঙ্গল হিসেবে স্থিতি পেয়েছে।

এরা কোনও সংহত শৃঙ্খলে আটকে থাকতে চায় না
দীপ্তির ভাষা তাদের চোখে-মুখে সমুদ্রস্নান।


আমি ঘুমাবো


বাজো পাতার টুকরো শব্দ
ভেঙে যাওয়া কালো সোহাগ শাদা সোহাগ সাঁইজির চরণেতে বাজো
বাসনার তারে বেজে ওঠো ঘুমহীন জানালার ধ্বনি

কলুদের তৈল কারখানার কাছে এসে একটু ডাকো আমাকে
ফিসফিস, আমি তোমার কাছে যাবো
সমুদ্র ঢেউয়ে ডুবে যাওয়া রোদের সাথে চোখের পৃষ্ঠাগুলো তলিয়ে দেবো

কালো শাদা ডোরা কাটা লেনে আলো কেটে কেটে
তোমাকে খণ্ড-খণ্ড দেখবো
খণ্ডাংশের ভিতর আলোক সাঁইজির চরণ দেখবো
দেখবো লোহার পুলে মানবিক চোখ

ঢেলে দিও আজকে সবটুকু অন্তর, কালকে থাকবে না এই আঁচ
আমার ঘাড়ের কাছে
পুরনো ঘ্রাণের মুখগুলো ভেসে উঠছে

আজ তুমি দেখো টেবিলের উপর আলো কার স্পর্শ চাচ্ছে
ফুরিয়ে যাওয়া শলাকার দিকে এগিয়ে এসে
হৃদপিণ্ডটা খুলে রাখো লালনের পাশে, আমি ঘুমাবো


শহর ছাড়ার নোটিশ


বুনোফুলের দেহের কোণে উড়ে যাওয়া সৌরভে ঘাটি গেড়ে চুপ করে বসে থাকা মৌদলে বার্তা পাঠাই, তরুবক্ষের কোটর থেকে বের হয়ে আসা ছায়া আর তেরনদীর সঙ্গম দেখে যারা পথভুলে ঢুকে গেছে— অগ্নিকুণ্ডের সর্পিল গুহার ভিতর, তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে পাঠিয়েছি তির চুম্বনে ভরা পায়রাদের মেঘলা প্রহর।

শহরের বর্ষণ শেষের আকাশে যেসব বিজ্ঞাপন ওড়ে, যেসব কুকুর-বেড়াল, কবি-শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, ঝাড়ুদার, গলাবাজ; মাথানিচু করে ঘুমিয়ে পড়েছে শীর্ণ দেয়ালের মধ্যে তাদের নিকটেও দূত পাঠাতে চাই।

অগণিত দেশি কাঠবেড়াল আর হুতুম পেঁচাদের বর্ষা উৎসবে নিমন্ত্রণ পেয়ে যাচ্ছি উন্মূল করিডোগুলো সঙ্গে নিয়ে, অবশিষ্ট চেয়ারের হাতলে কামনার সবগুলো ভালুক নখের দাগ রেখে গেলাম।

কয়েকদিন যে শহরে থাকবো না, তা জানান দেবার কৌশল হিসেবে সমস্ত দৈনিকগুলোতে পাঠিয়েছি শহুরী পাখিদের বিষ্ঠা। প্যাকেটের গায়ে লিখে দিয়েছি ‘সাবধান’। রোদভরতি ডুমুর গাছের তলে পাঠিয়োনা কোন মিথ্যাবাদী প্রতিবেদক, সুশীল জাহাজ।


অনন্ত স্পর্ধার ব্লেড


আসবে না লৌহফলকের জ্বর, নিদ্রিত চোখের চারিদিকে
ঠিকই ভেসে উঠবে স্পন্দিত অন্তরাল।

আমি ও মেঘ, সমুদ্র ঢেউয়ে ও হাওয়ায় বার্তা পৌঁছেই
ফিরে আসবো অনন্ত স্পর্ধার ব্লেডে, ফালি করা আপেলে
হিংসা ও কাচবৃষ্টির দৃষ্টি নিক্ষেপ চিরে
ফুটে উঠবে হাঙরের ছায়া, পাশ ফেরানো চুলের ঝুঁটি।

অজস্র পরাজিত ডানা থেকে উড়ে আসবে অনুগত শিরা–
ঝড়ের পূর্বাভাস। অধীর তৃষ্ণা।

নিঃসঙ্গ পাপড়ির নিচে অতৃপ্ত পিপাসার বর্ণচোরা শিস
বেজে যায়, বধিরতাও চুপ করে থাকে খুনিদের বাহুতে।

আমি ফিরে যাবো ফুল তোলা মুখোশের বাঁকানো হরফে।


টোটেম প্রফেসর তোমার ঘড়ির কাঁটায়


অংশগ্রহণমূলক রৌদ্দুর বিতরণে
টোটেম প্রফেসর তোমার ঘড়ির কাঁটায় ম্যাটিনি শো

আমার চুম্বন দৃশ্য রুদ্ধশ্বাস গোলাপি ট্রেনের
খোলা জানলায় লুম্পেন শহর
লাজুক বিষণ্ন মানুষেরা বোতাম ছেঁড়া জলপাই রঙের
জামার কলার দিয়ে
চোখ মুছতেছে

তুমি মৃত দেহ কাঁধে নিয়ে কত দূরে যাবে?
সৌন্দর্যের পর্যটনে গভীর মমতা
রিলিফ মুডে দেখো হাতাগুটিয়ে বসে আছে

আমি শহরের ভিউ পয়েন্টে
নতজানু রিকসার স্পোকের সঙ্গে ঘুরতেছি
নির্দলীয় সরকারের
দূপুরের নির্জন খোঁপায় বেদনারা লুকালে আমার
মগজের মধ্যে ভাইরাস অপ্রতিভ হয়ে ওঠে

আমি তাকে ফিল করি
রিসাইকেল বিনে রাখা সমস্ত রোদ্দুর একটিভ করে দেখি
ট্রাক ড্রাইভারের শক্ত বাহুতে সূর্য লটকে যাচ্ছে
টোটেম প্রফেসর তোমার ঘড়ির কাঁটায় গার্মেন্টসকর্মীদের

টোল পড়া গালের রূপকথারা
শস্য সুনামের গন্ধ ছড়াচ্ছে… গন্ধ ছড়াচ্ছে…


তুমি তো দূরের ভাটি


তুমি তো দূরের ভাটি উজানে রেখে যাওয়া
মশলার ঘ্রাণ
এখন প্যাকেটে প্যাকেটে ছড়ানো
…………………….নীলট্রেনও চিনেছে
পাখিও ডাকে মস্তিস্কের উঠোনে যোগিনীর
হাত এসে নিলো না হাতপাখা নিলো না
…………………….আপেল
…………………….নেবে
না সূচ ফোড়ের ‘মনে রেখো’ হৃৎপিন্ড নেবে
সেলাই এসে গেছে বলে দুপুর গড়িয়ে যায়
এস্ট্রের ভেতর
………. বাঁকা চাহনির
সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে মেঘ শিলালিপি হলে না
তবুতো লেগে আছো পালের হাওয়া
………. আঙুলের
বিদ্যুৎ তারে তারে তারে খোপার তারাগন্ধ রয়ে
………. গেছে
কাছের জানালা খুব স্পর্শ
গেঁথে রাখি রক্ষণশীল হলুদ বাড়ি
ছায়া নেমেছে শেফালী গাছে গাছে
এলিয়েনেশান খুব জড়িয়ে আছে দরোজার
নেমপ্লেট দেখো দেয়াল
ঘড়ির ডায়ালের ভেতর কেমন অঝোর বৃষ্টিপাত
নাচো তো বালি নাচো
হারিয়ে যাওয়া ময়না তোমার কোটপিনে
দেখো
দূরের কেউ
পাশে এসে জড়িয়ে ধরেছে


যে বাঁকে


যে বাঁকে ঝুঁকে পড়েছে রোদ
……..তীর থেকে উঠে আসা মাঝির মাথায়
লালগামছার রঙটা হেলে গেছে
পাল গুটানো
উঁচু পাড়ের ভুট্রা ক্ষেতের সবুজ চাহনি
শহর থেকে লরির শব্দ ভাসিয়ে আনে বিধ্বস্ত
……….ঘাটে
ব্রিজ এসে গেছে সেলফোন কথা বলে যাচ্ছে
মাছ বিক্রেতা তাঁর মুখে কোন শোকের চিহ্ন
……….নেই
যে ঘাটটা ভাঙা
……….ওখানে পুরনো নথের টুকরো
খাপড়ায় ছ্যাদলা জমেছে নীলচে নাকি সেভেন আপ?
মাতাল হলে এইসব নিয়ে ড্রেন উপচিয়ে
………..গড়ায় ভোর
পুলিশের গাড়ি থেকে নেমে যায় ব্রোথেল ফেরত
………..রাত
আমি ভাবি…………….যে কোন রাতই
আত্মহত্যার জন্য প্রস্তুত
পাখির ডানায় ফিরে যাওয়া সম্ভব
শুধু লরির শব্দ ঘুরিয়ে দেয় ঘাড়
………..কাছেই সড়ক পথের রেস্টরুমে
অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে
তোমার নথের কিনার থেকে এবার
নেমে যাবো
………লরির শব্দে পুরনো হেঁশেলের
কোণ ছেড়ে শহরের বেসিনে বেসিনে


ভেল্কিবাজের আনন্দধাম


ক্ষুদ্র মানুষের দাপটে দিশেহারা আধ-পাগলা সাঁই
ভদ্র লোকেদের কামড়ে কামরাঙা স্বাদে তুলছে হাই!

অতি সূক্ষ্ণ, বর্ণচোরা, নিঝুম রাতের তরঙ্গের সাথে ভেসে আছে যেই কমলাস্নানের দৃশ্য, সেতো আমারই গভীর উপলব্ধির আয়ু– কালো মুকুটের পাশে পড়ে থাকা চূর্ণ বালুকণা। বৃষ্টির গন্ধ দুয়ার খুলে তুমিই তো পালিয়েছিলে, আমাকে দর্পণে আপেলের পাশে বসিয়ে রেখে, মায়া তিরের মুখশ্রীতে ফিরে এসো নগ্নবেশে– দুই হাতের আঙুল, এসো ঘষে ঘষে ধুয়ে ফেলি ধুলো ও প্রেতলোকের সিঁড়ি…


একাকীত্বের দিনগুলি কটা পুষ্পখোল, এর ভেতর হারিয়ে যেতে থাকে কাছের মানুষ, নভোদৃশ্যের ঢেউ, কারও কারও দরোজায় ফুল শুকায়, একটু টোকা দিলেই ঝরে পড়ে বাদামি প্রহর, সুহাসিনীর নদীবন্দর ছেড়ে গেলে কেউ কেউ গুম হয়ে যায়। বিদূষী করুণাময়ীর চোখের পাতায় নেচে যায় কাঠঠোকরাদের গ্রাম; নিঝুম উলুবনের হাওয়া এসে জড়িয়ে ধরে, বদহাওয়া শরীরে লেপে দেয় উষ্ণ খোড়লের মায়া, দেহাসনে উড়ে আসে বাসনার ছাই, রাত্রিমূর্তি চিরে একা একা বসে বসে তাই দেখে মনকানাই! অঙ্গমালায়ও হেসে ওঠে ইতরপনা, মনের অতলে রঙ্গমেলায় ফুঁসে কি তারই ভূজঙ্গনা? কাঁপছে মধুভাণ্ড, কাঁপছে মাটির নিমাই।

বিমূর্ত পূজারীর দিকে ছুঁড়ে দেওয়া তরুবালার হাসি কুড়াতে কুড়াতে ঘরে ফিরতেও ভোর হয়, কটাক্ষ করে কামভাষাবিদ, যেন কূটাভাস, যেন শশীকর বিলে কাত হয়ে থাকা মাথা, স্বীকার করি আমি ঠগবাজ, প্রাণহরণ বিরোধী, চরিত্রাকাশে সারাক্ষণ ওড়ে ভোমর ও চিল, ভালো লাগে সাদা কাগজ, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, ভোলানাথের ময়লা ধুতির গিট। পড়ে থাকে সন্দেহভরা চোখ, কুঁচকানো ভ্রু। ও কি হিপোক্রাট!

সকল প্রশংসা দেহভাণ্ডর তলে রোশনি ছড়ায়, অল্পকাল তাঁর প্রতিবিম্বে নেচে নেচে চলে যেতে চাই, ভানু প্রণীত স্বল্পায়ুর নদে যে মেঘমালা স্মিত হাসে, তাতে সর্বদা ক্ষণিকা তাঁর নিরীহ চক্ষু ভাসায়। নিন্দা নাই, স্নিগ্ধ তাঁর নাভিতলে দেখি ষাড়ের লড়াই।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২২ জুলাই ১৯৭৬, চুয়াডাঙা। সমাজ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা : গবেষণা। প্রকাশিত বই : ‘ঘড়ির কাঁটায় ম্যাটিনি শো’ (কৌরব ২০০৮), ‘পুষ্পপটে ব্রাত্য মিনতি’ (জোনাকরোড ২০০৯), ‘উন্মাদ খুলির পৃষ্ঠাগুলি’ (আবহমান ২০১১), ‘ভেল্কিবাজের আনন্দধাম’ (এন্টিভাইরাস ২০১৫), ‘যাচনার বাঞ্ছাধ্বনি’ (ছোটো কবিতা, ২০১৮)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।