বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

নির্বাচিত দশ কবিতা

0

জল


আয় পাখি, পাখি আয় আজ যুদ্ধংদেহী,
হৃদয় চূর্ণের প্রতি আয়।
বলেছি সমুদ্রে সমর্পিত আমি, তবু
সুদূরের জল সঙ্গোপনে আমাকেই খায়।

মিথ্যে এ চাঁদের দেশে, চন্দ্রঘুঘু জানে
কতটা হৃদয় মরে গেছে, কতটা বা অবিনাশী,
তোর চোখে কোনো অক্ষর নেই
রক্তে নেই কনো নিঃসঙ্গ ঘটনা
তবু বারবার, অকারণে, আমি তোকে ভালোবাসি।


দ্বিরালাপ


রাত্রি গাঢ় হলে
তোমার শরীর নিয়ে আমি দ্বিমত পোষণ করি
আর বলি, তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে গেছে রাত,
চুল খোলো রাত্রি-পরিখা
যুদ্ধক্ষেত্র প্রসারিত হোক।

পরে তুমি ডানা মেলে দিলে
আমি তাতে মুখ গুঁজে থাকি
যেন মেঘের ভিতর ঢুকে গিয়েছে বিমান বাংলাদেশ।


অস্তিত্ব বিষয়ক


এসেছি শিরস্ত্রাণ পরে, দুটি চোখে পাখি,
চেনা যায়?
—কে গো তুমি?
আমি জাফরান, তোমার পশ্চাদভূমি
—কেন এলে?
আয়ুর কৌটায় দাঁত বসাতে এসেছি
—কিন্তু দাঁত তো ফেলে এসেছ বেদেনীর ঘরে


রূপান্ধ


কার রূপে অন্ধ তুমি?
এক পিঁপড়ের রূপে অন্ধ আমি
যার আছে প্রত্যেকটি রঙের একটি করে অন্তর্বাস।

কোনটি তোমার প্রিয় রঙ?
যে-রঙ এর জামা পরে মানুষ নিরুদ্দেশ হয়
সেই রঙ।

কোথায় যেতে চাও বলো?
যেতে চাই মৃতদের দুঃখমোচনের দেশে
দুঃখ বেঁচে যেইখানে ভালোবাসা কেনা যায়।

কবে যাবে সাধু?
ভরা পূর্ণিমায় তোমাকে উচিত শিক্ষা দেব বলে
যে-রাতে হৃদয়ে আমি ছুরিকা চালাব
অথচ জানালা খুলে দেখব বেজায় অমাবস্যা—
যাব সেই রাতে।


নীলাভ স্নায়ু


কী এক নীলাভ স্নায়ু দিয়ে
দেখছি তোমাকে,
পিঁপড়ের ডিমের মতো আমার দুঃখগুলো
তোমার কাছেও দেখি নিরাপদ নয়।
বাসনার চেয়েও মৃত্যুঞ্জয়ী হলো এই রাত—
রক্তের অধিক তুমি গন্তব্য পিয়াসী,
কিন্তু দেখো, না বলা কথার স্তূপে ভরে গেছে পথ,
কথা ফুরিয়ে যাওয়া রাতে যদি ডেকে ওঠে সাপ
নিষিদ্ধ গ্রন্থের চেয়েও সাবলীল কোনো ভাষায়,
যদি ঝিঁঝিঁর চোখের মধ্য দিয়ে দেখা যায় চাঁদ,
আর ধরো একটি বকুল গাছ যদি
উদ্যেশ্য প্রণোদিত হয়ে গন্ধ ছড়ায় চারিদিকে,
তবে আমি, এই আমি, তুমি বিনা, কোন দিকে যাবো?


আশ্চর্য তফাৎ


স্বপ্ন দিয়ে
দুঃখ দিয়ে
সম্পর্কের স্থবিরতা দিয়ে
আজ মিথ্যে মিথ্যে ভাত রান্না করি।
দেয়ালে জন্মেছে বটগাছ
তাকে বলি, আমি বেশ ভাল আছি,
তোমার অনেক দীর্ঘশ্বাসও
অক্সিজেন দিয়ে
আমাকে বাঁচিয়ে রাখে।
পিঁপড়ের পিঠে চড়ে সুখ আসে
তাকেও বলি, এই বেশ আছি আমি,
শ্যাওলা জন্মেছে দেখ পিঠে।
ফুল দিয়ে
অবিশ্বাস দিয়ে
সন্দেহের সব সম্ভাবনা দিয়ে
আজ মিথ্যে মিথ্যে আমি বাগান বানাই ।
ফুলদের বলি—
সুখ ও দুখের অন্ত্যমিল নিয়ে
বাবুরা, ঘুমিয়ে পড়ো,
কারণ আমি তো জানি
বাগান ও অরণ্যের আছে আশ্চর্য তফাৎ।


নিষিদ্ধ প্রোফাইল


এক নিষিদ্ধ ঋতুর নাম শীত।
যার গহ্বরে জমা থাকে পথভ্রষ্ট নক্ষত্রের ঘুম, বসন্তের হলুদ ট্রাউজার, আর সিঁদেল চোরের নিশুতি রাতের মান অভিমান।

এক নিষিদ্ধ ফলের নাম আপেল।
যার কোষে কোষে আত্মগোপনে আছে সভ্যতার চকচকে ছুরির তুহিন। আছে নারীদের তৈরি আদিম জানালা। সৃষ্টি ও ধংসের মধুচন্দ্রিমা।

জন্ম এক মনোলোভা নিষিদ্ধ প্রান্তর।
সন্দেহের উদ্রেক করে যা। যেখানে গরু ও গোয়েন্দা চরে। আর পাখিদের পাতা ফাঁদে পা দেয় হরিণ শাবক।

মৃত্যু? সে তো এক আবহমান হরিণের নদী।
যা ভীষণ ভবিতব্যময়। একদিন যা ফিরে আসতে পারে উৎসের দিকে।

প্রেম, ফুসফুসে সঞ্চিত দু’ফোটা হেমলক।
যা সুপেয়, রক্তে দ্রুত দ্রবণীয় বিষাদের নদী, নিগৃহীত সন্ধ্যার অক্ষরমালা, যা অভাবনীয়, যা ভাবতে গেলে পতঙ্গ ও প্রণয়ীর কোনো তফাৎ থাকে না।


গণতান্ত্রিক


ধরো আমি ইঁদুর
আর তুমি উদ্ধত বিড়াল
ধরো তুমি আমাকে ধরতে চাইছ
আমি লুকিয়ে আছি পালঙ্কের আড়ালে
বাগে পেয়েও আমাকে ধরছ না তুমি
এরকম খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে
একসময় আমার ওপর আছড়ে পড়লে তুমি
ধরো তোমার থাবায় আমার কপাল চিরে রক্ত বেরুল
এপর্যায়ে আরেকটি বিড়াল এল, আরও উদ্ধত,
তোমার বিরুদ্ধে
আমারই পক্ষে মাঠে নামল সে,
আমার দুঃখে দুঃখিত হলো
আমার কান্নায় তার চোখজোড়াও ভিজে এল
একদিন তোমাকে হটিয়ে সে আমার বন্ধু হল
ধরো তারপর একদিন খেলাচ্ছলে সেও হামলে পড়ল আমার ওপর
ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল আমার নাড়িভুঁড়ি
তখন তুমি এসে আমাকে অশ্রুজলে সমাধীস্থ করলে
অতঃপর, ধরো, আমার শোণিতের ধারা সমুদ্রে গড়ালো
আর সমুদ্রের নীল জলে ফুটে উঠল এক রক্তিম গোধূলি
ধরো, তোমরা দু’জন একসঙ্গে উপভোগ করছ সে-গোধূলি।


অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী


ফিরে এসো গুম হয়ে যাওয়া পাখি
বসন্ত-গোধূলি থেকে পালিয়ে আসা রমণিদের
পাড়ি দিতে হবে এক দীর্ঘতম কৃষ্ণচূড়া-সেতু।
হাতের তালুতে জাগে আগুন-সমাধি
ক্ষমা করো চাঁদ, আর শীতলক্ষ্যা নদী,
জলের একাকীত্বের মধ্যেও ঢুকে গেল এতগুলো পাখি!

ফিরে এসো অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী
ফিরে এসো অগ্নিদগ্ধ দেহমাদল,
যে কোনও নিদ্ৰাহরণের আগে
রক্তজলে শয্যা পাতার আগেই ফিরে এসো।

ক্ষমা করো নিখোঁজ মানুষ
ক্ষমা করো পুড়ে যাওয়া সবুজ শৈশব,
ঝিঁঝিঁ পোকাটিও আজ তার জানালা খোলেনি।
গভীর ঘুমের অভ্যন্তরে কে আছে সাপিনীসম
আমরা বুঝিনি, ক্ষমা করো অহেতু নির্দেশমালা,
আমরা শুনিনি কিছু, আমরা কিছুই দেখিনি।


বউ ও ভাতের গন্ধ


একটি শিশুর কিংবা একটি গাছের
প্রতি মুহুর্তের বেড়ে ওঠা দেখবার লোভে
দিনরাত অপলক চেয়ে থাকি।

পোকার প্রসব বেদনার শব্দে ঘুম আসে না আমার।

একবার অঙ্কুরোদগমের শব্দে ঘুম ভেঙ্গেছিল।
একদিন সমুদ্রের জলে কান পেতে শুনেছিলাম
মাছে ও ঝিনুকে কথোপকথন।

আজ ভাত রান্নার আদিম গন্ধে সাঁতার কাটছি।
বউ ও ভাতের গন্ধে আজ
পাহাড়ি গুল্মের মতো মনে হচ্ছে চারিদিক।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কুচাই গ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ ব্যাডফোর্ডশায়ার থেকে প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্টে  স্নাতকোত্তর। পেশায় বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। নেশা কবিতা ও গান। তাছাড়া ফটোগ্রাফিতেও মজে থাকেন নিরন্তর। অনুবাদ নিয়েও কাজ করেন সুযোগ পেলেই। প্রকাশিত বইসমূহ— কবিতা : ‘সমুদ্রপৃষ্ঠা’  ২০০৭, ‘নদী এক জন্মান্ধ আয়না’  ২০১৪, ‘অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী’  ২০১৫, ‘অন্ধের জানালা’  ২০২০, ‘নির্বাচিত কবিতা’  ২০২০, ‘জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়’ ২০২০, ‘পায়ে বাঁধা দুটি সর্বনাম’ ২০২১। অনুবাদ : ‘পাওলো কোয়েলহো এর আক্‌রায় পাওয়া পাণ্ডুলিপি’  ২০১৫ ।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।