শব্দ
ছায়ার নিচে সে যদি রোদ কুড়ায়
তবে সেলাইকলের টানাটানা শব্দও বাদ যাবে কেন
কলঘরের একটানা শব্দও কুড়াক
নৈঃশব্দ্য জানে না সোনামুখী সুইয়ের ছিদ্রকথা—
সুতোহীন দীর্ঘশ্বাসে যতটা থেকে যায়
ওড়াই শুকনো পালক জ্বররুগ্নতা…
সেও যদি উড়তে পারে বালুচরে না-হেঁটেও
চোখের ভেতর জেগে উঠবে চর—তারপর
নিঃশ্বাসের মশলাঘ্রাণে লোভ বাড়ে
কলকব্জা-হাড়ে
দগ্ধ পাঁজর জুড়ে পাবে হাসি, চুম্বনের
পাথরস্মৃতি
আমি পাথর কুড়াতে জানি
পাথর খোদাই করতে জানি না
পাথরের মতো দুঃখকে শক্তপোক্ত করে রাখি
দুঃখকে পাথর বানাতে পারি না
শুনেছি পাথর ঘষলে নাকি পাথরও ক্ষয় হয়ে যায়
কিন্তু পাথর থেকে আগুন তুলে নেয়া যায় না
পাথর-অন্তরে আছে অগ্নি নিরবধি—
যারা অগ্নিভীত, ভুলেও যেও না তারা পাথরখনিতে
আমিও যাব না আর পাথর কুড়াতে
আবছায়া
জলে ভাসে জল, চোখ হয় লীন
রহস্য ঘিরে রাখো সব
স্থির থাকে মায়া
রাত্রি গভীর হলে ঘুরে আসে যে-মুখ
সে কি তুমি?
দক্ষিণে সমুদ্রমহাল, উত্তরে আবহাওয়া
স্তুতি
বেদনার পাশে দীর্ঘ পথ হাঁটা যায়
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নির্বিঘ্নে কথা বলা যায়
অভিমান করে কয়দিন কথা না-বলে থাকা যায়
বেদনাকে পাশে নিয়ে ঘুমানো যায় না
শীত
এখন,
অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি প্রায়
শীত আসিতেছে আস্তে-আস্তে
আমার শরীরে।
তারপর,
নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে
চামড়ার নিচে, রক্তকোষে শীতের
অস্থিরতা ছোটাছুটি করে।
নিরীহ এই আমি,
শীতে রোদ পোহাই আত্মার ভিতরে
মা
এই নিঃসঙ্গ রাত্রি খুব সুন্দর, কিন্তু ঠিক তোমার মতো নয়
নিরুপায় আমার দুটিহাত, তবুও এই বেদনাহত চেহারায়
দেখো, একবার স্ত্রী দিকে তাকাই, একবার মেয়ের দিকে
তাকিয়ে দেখি এ-দেহভাণ্ডে কামনা যত হয়ে গেল ফিকে
ভিনদেশে আমার মনটা ডুকরে কাঁদে মা ও মাটির টানে
মা তো স্বর্গসুখ, আরো সুখ ডুবে থাকা যত কবিতাগানে
জানিনা কবে মাথা রেখে আমি ঘুমাব মা তোমার কোলে
কখনো কী বসা হবে আম্বরখানা কাপড়ের দোকান খুলে
আমার প্রাণ উড়ে যায় বহুদূরে ঐ কামিনী গাছের তলায়
মাগো, তোমাকে দূরে রেখে পরবাসে মন কেবল পোড়ায়
ধাবন
সেও জানে কার জন্য তাড়া প্রতিদিন
কার ইশারায় গোপনতমা বাঁক পেরোলেই বন
শব্দের গর্জন
সারাদিন আমাকে জড়ায় স্বপ্ন ও মন
কার তাড়া আমার পিছে করছে ধাবন!
নিদ্রাপোশাক
প্রতি ভোরে সূর্যটা চুমু খায় পৃথিবীর ঠোঁটে। ইচ্ছে হয়সূর্যকে টেনে আনি; তুলে রাখি শোবার ঘরে; যেন অন্ধকার লালন হয় চোখে; ধীরে-ধীরে সরোদ চোখ হাসে। এই রোদে যদি আমার অর্ধেক হাড় খুলে ফেলা যেত, যদি অর্ধেক হাড় ছুঁড়ে ফেলা যেত শকুনের ঠোঁটে! আমার ধারণা থেকে জেগে উঠছে ব্যথা, নিদ্রাপোশাক। দেহের ভার থেকে দশগুণ বেশি ব্যথার ভার! পৃথিবী কি জানে ছায়ার ওজনটা ঠিক কত? ছায়াহীনভাবে হাঁটতে পারি না বলে দূরে হাঁটি;দূরপথে হাঁটলে স্বস্তি পাই পৃথিবী কি জানে, ছায়াভরে আমিও দাঁড়িয়ে আছি!
দাদাকে মনে পড়ছে
পুকুরপাড়ে সুপারি গাছটা দেখলেই দাদার কথা মনে পড়ে আমার। পয়মন্ত বিকেলে পুকুরপাড়ে প্রায়ই বসতেন দাদা। শৈশবে একদিন সুপারি গাছটা ধরে আমায় বল্লেন, ‘এই যে আধামরা পুকুরের তলাটা আমার দাদা দেখেছেন, আমার বাবাও দেখেন নি, তোর বাবাও দেখার সম্ভাবনা কম, তুই দেখবি বইলা মনে হয় না, তোর সন্তানের দেখাটেখাও ভাগ্যের ব্যাপার। এমন ভাগ্য নিয়া ক’জন জন্মায়।’—অনেকদিন পর একটা বিকেল সুপারিগাছের সঙ্গে মনগপে্ কাটলো পুকুরটাও আগের মত আছে…শুধু দাদা নেই, তাঁর চশমার ফাঁক দিয়া নিবিড় চাহনিটা বারবার মনে পড়ছে
মা-বাবা
এই ব্রহ্মাণ্ডে নাড়ি ছিঁড়ে আসা একটা শব্দ মা।
তাঁর মায়াভরা হাসিমুখটাই আচ্ছন্ন করে আমায়।
মন খারাপ হলেই আমি, মায়ের মুখটি কল্পনা করি আর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি। ভাবি—কীভাবে জন্মের পূর্বে মায়ের চেহারাটা চুরি করলাম আমি?
এই ব্রহ্মাণ্ডে প্রিয়বন্ধু একজনই। অতিসাধারণ জীবনযাপন তাঁর, আমার বাবা। শৈশবকাল থেকে অদ্যাবধি বটগাছের মতো মাথার উপর ছায়া হয়ে আছেন। আমার মধ্যে মা-কে খুঁজে পান বলেই কী বাবা আমাকে এত ভালোবাসেন?
এই ব্রহ্মাণ্ডে মা-বাবা আপন, ভালোবাসা-বন্ধন
একজন্মেও সুদ হবে না জানি আমার জন্মঋণ
জন্ম সৈয়দ পুর, জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ। গত দেড়দশকের বেশি সময় ধরে দেশের প্রতিনিধিত্ব পর্যায়ের সাহিত্যপত্রিকাগুলোতে লিখছেন, সমানতালে সক্রিয় আন্তর্জালিক বাংলা বর্ণমালা ভুবনেও, মূলত কবিতায় তার অভিনিবেশ ও অধিবাস। প্রায় দুইযুগ ধরে সম্পাদনা করেছেন পত্রিকা এক, কবিতাকেন্দ্রী, অর্কিড নামে। গদ্য লেখেন অনানুষ্ঠানিক, ব্লগস্পট ও ওয়েবপত্রগুলোতেই প্রধানত। গদ্যবই ১টি ‘ব্লগাবলি’ নামে। প্রকাশপ্রাপ্ত কবিতাবই এ-যাবৎ ৬টি। ৩টি কবিতাবই যন্ত্রস্থ।