বুধবার, ফেব্রুয়ারি ১৯

‘নীল ইগুয়ানা’ প্রসঙ্গে : লায়লা ফারজানা

0

‘সেই কবে থেকে বুক চিরে বসে আছি!
হাত পা নেই। সবুজ আপেলে যেন অনাহূত
শুঁয়োপোকা। গুটিয়ে গুটিয়ে কেবল নিজেকে জড়াই। শরীরে হলুদ আভা! নরম সবুজে বেষ্টিত কোমল দেহ। কপালের ঠিক মাঝখানে ডুবন্ত হরিণ।’

Laila-Farzana_Cover

নীল ইগুয়ানা | লায়লা ফারজানা | প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ | প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স | মুদ্রিত মূল্য: ২৪০ টাকা | বইটি সংগ্রহ করতে এখানে ক্লিক করুন

আমি আমার কবিতায় জীবনকে খুঁজি। আমার কবিতা জীবনেরই প্রতীকী এবং রূপক-প্রকাশ। জীবনের নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব, প্রেম, বেদনা, প্রত‍্যাখান বিভিন্ন রূপে জলচিত্রের মতো ধরা দেয় আমার কবিতায়। জীবন রঙিন, জীবন পরিবর্তনশীল, জীবনের প্রতিটি অনুভূতির রং ভিন্ন। আমি আমার কবিতায় সেই রংগুলোকে ধরার চেষ্টা করি। ধ্রুপদী মিথ আর পরাবাস্তবতার মাধ‍্যমে আমি রাঙাতে চেষ্টা করি আমার কবিতার ক‍্যানভাস।

মাঝে মাঝে মনে হয় কেন লিখি। হয়তো আমার অনেক কিছু বলার আছে। আমি বলতে চাই বলেই লিখি। আমি লিখতে চাই বলে লিখি। আর কবিতাগুলি জমির মতো, অনুভূতি ভরা শব্দ, রং আর নীরবতা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হয়তো যা বলতে চাই এখনও বলতে পারিনি, যে কবিতাটি লিখতে চাই এখনও লেখা হয়নি তাই লিখেই চলেছি শেষ কবিতাটির অপেক্ষায়।

‘আমি চেয়েছি অদৃশ্য হতে—
দাঁড়িয়েছি অপরিচিত লোকটার গাড়ির সামনে।
ডিভোর্সি মরিচা পড়া হাতের রেখার
হলুদ দাগের সীমানা ছাড়িয়ে
নির্ধারিত প্লাটফর্মের পাশে।’

ভাষার দখল, ছন্দ এবং আবেগ নিঃসন্দেহে কবিতার জন‍্য অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তবে কবিতার ছন্দ বা ‘ফর্ম’-এর চেয়ে আমি বেশি প্রাধান্য দেই কবিতার ভাব, নির্জনতা আর তার নৈঃশব্দ্যকে। কবিতার সাথে পাঠকের যোগাযোগ কবিতার জন‍্য অত‍্যন্ত প্রয়োজনীয়। আর সেই যোগাযোগকে অর্থবহ করে তুলতে ঠিক কতটুকু নীরবতার প্রয়োজন তার পরিমাপ করতে জানা কবির জন‍্য অতি আবশ্যক; যাকে আয়ত্বে আনা ছন্দের চেয়েও জরুরি।

কবিরা বিভিন্নভাবে কবিতা লেখেন। কেউ কেউ আগে থেকেই বিষয় নির্ধারণ করেন, কেউ কেউ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে লেখেন, কেউ কেউ লিখতে লিখতে পরিণতির দিকে পৌঁছান। আমি অনুভূতি আক্রান্ত হয়ে কবিতা লিখি, আর স্পষ্টভাবে সেই অনুভূতির একটা বিশেষ রং এবং চিত্রকল্প টের পাই। সেই রং, চিত্রকল্প এবং দৃশ‍্যপাটকেই আমি বিমূর্ততায় ত্রিমাত্রিক রূপে প্রকাশ করি। হয়তো এর কারণ আমার স্হাপত‍্য পেশা এবং আমার তৈলচিত্রের প্রভাব। আসলে আমি বিশ্বাস করি কবিতাকে শুধুমাত্র শব্দে ধারণ করা যায় না। তার জন‍্য প্রয়োজন ভাব, উপমা, রূপক, রং, চিত্রকল্প এবং ত্রিমাত্রিক জগতের উপলব্ধি আর জ্ঞান। আমার অধিকাংশ কবিতা আত্মজৈবনিক এবং ছোটো। আমি দীর্ঘ কবিতার চেয়ে ছোটো কবিতায় বেশি সাচ্ছন্দ‍্য বোধ করি। আমি গতানুগতিক ভাবালু কাব‍্যিকতা এবং বর্ণনাকে বর্জন করে সরাসরি বক্তব্যে যেতে চাই। তবে যদি কবিতার জন‍্য সৃষ্টিশীল দীর্ঘ বর্ণনা অনিবার্য হয় আমি দীর্ঘ কবিতার পক্ষে দাঁড়াব। প্রতিটি কবিতারই তার নিজস্বতা প্রয়োজন। একমাত্র কবিতার পক্ষেই সম্ভব সেই দৃশ‍্যকে ফুটিয়ে তোলা, নিছক ক‍্যামেরায় যে আলোকচিত্র ধারণ করা সম্ভব নয়। কল্পনার খোরাক জোগানো কবিতার আরেক অবিচ্ছিন্ন বৈশিষ্ট্য। যদি চারটা লাইন আমাকে ভাবায়, আমাকে প্রশ্ন করে আমাকে অন্য কোন সময়ে নিয়ে যায়; কোনো অতীত বা কোনো অদেখা ভবিষ্যতে, আমাকে স্বপ্ন দেখায়, কিছু হতে বলে আমি মনে করি সেই চারটা লাইনই কবিতা।

‘চারণভূমিতে যেমন একটি বোবা বাইসন,

আর তার চোখে শহরতলির বাড়ি, পাশে আমার বিষণ্ন ছায়া। আমি একটা শহুরে বাড়ির, শহুরে বাগানে, শহুরে গাছের ছায়ায়, শহুরে রাস্তার ধারে হাঁটতে চেয়েছি। আমি রুপালি টর্চের সোনালি আলোর মতো কৃত্রিম নিজেকে ছুড়ে ফেলেছি বিছানায় আর ঘরের ফাঁটলে দেখেছি আগুন, অপেক্ষা করেছি লাল রক্তপাতের ওপারে নীল আকাশ ছোঁয়ার।

যে আকাশ অদৃশ্য হয় — প্রতিটি উত্থান আর প্রতিটি পতনে।’

আমরা যারা লিখি বা লেখার চেষ্টা করি তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে কিছু দায়িত্ব, প্রথমত যে ভাষায় লিখি সে ভাষার প্রতি, পাঠকের প্রতি এবং যে সময়ে বাস করি সে সময়ের প্রতি। যদি আমার লেখা আমার পারিপার্শ্বিকতা, আমার অবস্থান এবং সময়কে প্রতিনিধিত্ব না করে তাহলে মনে করি সে আমার ব‍্যর্থতা। আমার লেখায় মাঝেমধ্যেই কিছু অন‍্য ভাষার শব্দ এসে যায়, যা আমি খুব সচেতনভাবেই সযত্নে ব্যবহার করি। আমি আমার অনুভূতির প্রতি সৎ থেকেই তা করি। আমি জোর করে তা পরিবর্তন করি না। যদি আমি কোন কিছু ‘ফিল’ করি আমি ‘ফিল করি’-ই লিখি, আর যদি সে হয় আমার ‘অনুভব’ তাহলে ‘অনুভব’। কারণ বাংলা ভাষা এত সমৃদ্ধ যে এরকম দু’একটি বিদেশী শব্দের প্রয়োগ আমার বাংলা ভাষাকে অসম্মান তো করেই না বরং তার ঔদার্য এবং বিশালতারই প্রমাণ দেয়।

আবারও ফিরে আসি যেখান থেকে শুরু করছিলাম:

‘…জীবন অসীম সমস্ত অপ্রাপ্তি আর উত্তরহীন প্রশ্নে।
সবকিছুই ক্যামোফ্লাজ। কেবল রূপ ধরে থাকা।
মথ লার্ভা ফুলকি। অসম্পূর্ণ রূপান্তর।
ডানাহীন উইপোকার মতো।’

তবুও ‘নীল ইগুয়ানা’ বইটিতে আমি জীবনকে দেখতে চেয়েছি আমার মতো করে—

‘নীল ইগুয়ানা’ বইটি প্রকাশ করেছে স্বনামধন্য মাওলা ব্রাদার্স। চমৎকার প্রচ্ছদটি করেছেন প্রিয় শিল্পী ধ্রুব এষ। অমর একুশে বইমেলায় মাওলা ব্রাদার্স এর প‍্যাভিলিয়নে বইটি পাওয়া যাবে। তাছাড়াও মাওলা ব্রাদার্স এর নিজস্ব ওয়েবসাইট এবং রকমারি ডটকম থেকেও পাঠকরা বইটি সংগ্রহ করতে পারবেন।

এখানে উদ্ধৃত হলো বইটির ‘নীল ইগুয়ানা’ কবিতার কিছু অংশ।

‘আর তখনো আমার অপেক্ষায় কোনো
এক নীল ইগুয়ানা,
ধীর পায়ে, শ্লথ গতিতে এগুতে থাকে,
তার দেহের ভঙ্গিমা অমসৃণ ঘাসের ফলার মত
আমার পায়ের রক্ত চুষে নেয়,
আমার টিপসি চোখে মিলে যায় তার চোখ।
বিক্ষিপ্ত আলোয় আমি দ্রুত ছুটে যাই
নির্দিষ্ট এপিফ্যানির দিকে।’

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি লায়লা ফারজানা পেশায় স্থপতি। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন (আরবান ডিজাইন ও স্থাপত্যবিদ্যায়) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ টরেন্টো থেকে। তিনি নিউ ইয়র্ক সিটি স্কুল কনস্ট্রাকশন অথোরিটিতে স্থপতি হিসাবে কাজ করছেন। এর বাইরেও লায়লা ফারজানা একজন নাট্যশিল্পী এবং শিল্প ও সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায় রয়েছে তার সাবলীল যাতায়াত। নিউইয়র্ক-এর ডিস্টুডিওডি আর্কিটেক্টস এবং ইঞ্জিনিয়ার্স (দ্য স্টুডিও অফ ডিজাইন) তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান, যেখানে তিনি ‘সাসটেইনেবল-আর্কিটেকচার’ এর চর্চা করেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।