বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

নীল মলাটের ডায়েরি : সাবিরা শাওন

0

একটা সময় ভীষণ আশাবাদী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেওয়া আমি আজ ঠিক গোধূলির মরা আলোর মতোই নিষ্প্রভ। কেন, কীভাবে এই প্রশ্নগুলো অবান্তর। ভাবনার অতলে ডুবে যেতে যেতে হঠাৎ খাবি খায় অনুভূতিরা। আমি নড়েচড়ে বসি একটু। হাতে ধরা পুরনো ডায়েরির ধুলো ঝেড়ে পড়তে থাকি অন্য এক সময়ের গল্প। বহুবার পড়া তবুও আজকে না হয় শেষবার হোক।

এই কড়ইতলায় আসলে আমার কী ইচ্ছে হয়, জানিস? ভাবালু চোখদুটোয় অসীম আগ্রহ নিয়ে প্রশ্নটা করলেও সামনের জন কিন্তু নির্বিকার ভাবে বাদাম চিবুচ্ছেন। যেন এই গোটা পার্কটাতে সে আর তার বাদাম ছাড়া কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।

এই কড়ইতলায় আসলে আমার কী ইচ্ছে হয়, জানিস? ভাবালু চোখদুটোয় অসীম আগ্রহ নিয়ে প্রশ্নটা করলেও সামনের জন কিন্তু নির্বিকার ভাবে বাদাম চিবুচ্ছেন। যেন এই গোটা পার্কটাতে সে আর তার বাদাম ছাড়া কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। অবন্তীর বিরক্তি আঁচ করতে পেরে শেষে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, কী মরা ডাল আর পাতা কুড়ায়ে নিবার ইচ্ছা করেনি? বলেই ফিক করে হেসে উঠে আবার বাদামে মনযোগ দেয় অমল।

অথচ, অবন্তীর বলার ছিল, আমি আমৃত্যু এই গাছতলায় বসে তোর গল্পের মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে বাকি বিকেলগুলো কাটাতে চাই।

ক্যালেন্ডারের পাতায় বর্ষা তার আগমনের জানান দিলেও সূর্যের প্রখরতা বলছে অন্য কথা। ব্রহ্মপুত্রও যেন ঝিমিয়ে আছে রোদের প্রতাপে। দু’ফোটা ঘামের বিন্দু গা ছেড়ে ভিজিয়ে দিল কালো দু’টো অক্ষর।

অন্যান্য সব দিনের মতো, নদীর পাড়ে বসে অবন্তী ভাবছে, আজ নদী পার হয়ে ওইপাড়ে যাবে। অমলকে রাজি করাবেই। কী সুন্দর কাশফুল ফুটে আছে! রূপকথার সাদাচুলের মায়াবী বুড়ির মতোন মাথা দুলিয়ে যেন ডাকছে তাকে। কী মায়াময় সুন্দর!

অবন্তীর আবদার শুনে, অমল নিরাসক্ত মুখে জানিয়ে দেয়, ‘হেইপাড়ে যাওন যাইতো না। ঝামেলা আছে। এইনথে দেহো কাশফুল।’

অভিমানী অবন্তী সেদিন ঠোঁট ফুলিয়ে বলতে চেয়েছিল, তুই পাশে থাকতে আমার ভয় কী!

চা লাগবে? কচি কন্ঠের রিনরিনে আওয়াজে ঘোর ভাঙে আমার। ক্ষণেক হতবিহ্বলতায় ভুলে যাই কী উত্তর দেব। ছেলেটি কী বুঝতে পেরে চলে যায়। সে কি জানে, আমার সারা গায়ে প্রতিশোধের তেষ্টা,টলটলে রক্তের পিপাসা।

শ্রাবণের শেষ প্রায়। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে। আজ আর তাই ফয়জুল স্যারের কাছে পড়তে যাওয়া হলো না। বৃষ্টি শুরু হবার আগে অমল অবন্তীকে নিয়ে এসেছে কড়ইতলায় বাদাম খেতে। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে সমস্ত চরাচর। দু’জনে মিলে আশ্রয় নিয়েছে এক ছোট্ট চালার নিচে। যেখানে মাথা বাঁচানোই দায়, বৃষ্টির ছাট গায়ে লাগছে। দূরে কোথাও বাজ পড়ার শব্দে অমল টের পায় কোথাওবা আর্গল খুলে যাচ্ছে৷ আদিম প্রবৃত্তির প্রমত্ততায় গুড়িয়ে যাচ্ছে সব দেয়াল; ধর্মের, স্থান-কালের। হ্যাচকা টানে অবন্তীকে কাছে নিয়ে বলে, চল নৌকায় উঠে বৃষ্টিতে ভিজি৷ অবন্তীর চোখেও তখন বর্ষায় শরতের কাশফুল দেখার মতো গোলমেলে চাপা উচ্ছ্বাস। দু’জন সোমত্ত বয়সী ছেলে-মেয়ে প্রবল আনন্দে ডোবার নেশায় নৌকা ভাসায় ব্রহ্মপুত্রের বুকে৷

বৃষ্টি একটু ধরে আসায় অমল নৌকা ভেড়াতে বলে অন্যপাড়ের ঘাটে। অবন্তী কেঁপে উঠে খানিকটা; শিহরনে অথবা আনন্দে।

নদীর এধারটায় মানুষজনের আনাগোনা কম থাকায় সহজে কেউ আসে না। তাই ভয়ের অনেক গল্প-গুজব রটানো হয় নিত্য। কোনোকিছুকে তোয়াক্কা না করে অমল ডুবে যায় এক অনন্ত ঐশ্বর্যের ভাগ নিতে। ভুলে যায় এখানে তীব্র প্রেমের মূল্য চুকাতে হয় নিজের সর্বস্ব দিয়ে।

নদীর এধারটায় মানুষজনের আনাগোনা কম থাকায় সহজে কেউ আসে না। তাই ভয়ের অনেক গল্প-গুজব রটানো হয় নিত্য। কোনোকিছুকে তোয়াক্কা না করে অমল ডুবে যায় এক অনন্ত ঐশ্বর্যের ভাগ নিতে। ভুলে যায় এখানে তীব্র প্রেমের মূল্য চুকাতে হয় নিজের সর্বস্ব দিয়ে।

তিনজন হায়েনার মতো মানুষের কুৎসিত হাসিতে বাস্তবে ফিরলেও অনেকটা প্রহর তখন গড়িয়ে গেছে। বৃষ্টি শেষে নরম রোদের পৃথিবী তখন অসহ্য সুন্দর। হ্যাঁ, অসহ্য-ই বটে। নইলে, অনাঘ্রাতা অবন্তীফুলের সব পাপড়ি কেন একদিনেই দলে মুচড়ে যাবে? লৌহিত্যের ধারের নির্মল বাতাসে যার গায়ের ঘ্রাণ সে বাতাস ভারী হবে অসহ্য পাশবিকতায়।

বর্ষার প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্রে ডুবে যাওয়ার আগে অমল শুধু কানে নিয়েছিল অবন্তীর শেষ আর্তনাদ!

স্যার, উঠবেন না? মন্ত্রী সাবতো মঞ্চে উঠব। আপনি নাই দেখে আমি সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক করে দিছি। সপ্রশংস দৃষ্টিতে আমার সহকারির দিকে তাকিয়ে পা বাড়ালাম রক্তের খোঁজে।

মুহিব, আমার জানা অন্যতম শার্প শুট্যার। আশাকরি লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না। ঠিক যেভাবে বাকি দু’জনের ক্ষেত্রে আমার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি।

START 3 2 1… BANG

এই টেক্সটা সেন্ড করে আস্তে ধীরে সিগারেট ধরিয়ে বেশ লম্বা টান দিলাম। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে দেখলাম, সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত শুভ্রতার মুখোশে মোড়া মন্ত্রীর দেহটি কাটা কলাগাছের মতো পড়ে রইল মঞ্চের মাঝে। হুড়োহুড়িতে মন্ত্রী সাহেবের পুরো বিজয় সমাবেশ লণ্ডভণ্ড। সবাই ছুটছে দিকবিদিকশুন্য।

মা, তুমি খুশি হয়েছো তো? যেন সন্ধ্যাতারাটা আজ একটু বেশিই উজ্জ্বল! সোডিয়াম আলোয় চিকচিক করছে আমার মুখ, কপোল। দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের দিন-রাত পাড়ি দিয়ে আমাকে জন্ম দেওয়া আমার মায়ের আর্তনাদ আজ চাপা পড়েছে এক হিংস্র হায়েনার মরণ উল্লাসে।

আমি কে?

হবো, এক অপাপবিদ্ধ বৃষ্টি ভেজার মুহূর্ত অথবা ছিড়েখুঁড়ে খাওয়া জানোয়ারদের উল্লাসচিহ্ন।

হলদেটে নীল মলাটের ডায়েরিতে লেগে থাকা অতীতের ঘ্রাণ নিয়ে তাকে বিসর্জন দিলাম শান্ত ব্রহ্মপুত্রের বুকে। যাকে ঘিরে এত গল্প তার কাছেই হোক সমাপ্তি।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

বর্তমানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একটি প্রোগ্রামে অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। একাডেমিক পড়ালেখা শেষ করেছেন হিসাববিজ্ঞানে। ছোটোবেলা থেকেই লুকিয়ে-চুরিয়ে বই পড়ার অভ্যাসটা আজো রয়ে গেছে। নিজের অনুভূতি আর আর গল্প লেখার অনুপ্রেরণা সেখান থেকেই।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।