বালিগঞ্জ প্লেসের গুহঠাকুরতা বাড়ির ছাদে ক্যালক্যাটা ইউথ ক্যয়ারের রিহার্সাল শুরু হলে প্রায় লাগোয়া বাড়ির জানালা দরোজা বন্ধ করে দেন মায়া সেন। তাঁর গানের ক্লাসের খুব অসুবিধে হয়। তাঁর কাছে আসা ছেলেমেয়েরা অবশ্য ওইসব গান শুনতে ভালোই বাসে। কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতের আবহে সমবেত কণ্ঠের ওইসব গান একটু বিঘ্ন ঘটায় বৈকি! সেদিনও ওখানে চলছে ধুম রিহার্সাল। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তাঁদের একটা বড়ো অনুষ্ঠান। একদিকে যন্ত্রীরা বসে আছেন। তাঁদের নির্দেশনার দায়িত্বে আছে পিয়ানো আকর্ডিয়ান হাতে ওয়াই এস মুলকি। অন্যদিকে গানের দল। ছেলেমেয়ে মিলিয়ে কুড়ি বাইশজন তো বটেই। আর আছেন নৃত্যশিল্পী সাধন গুহ ও পলি গুহ তাঁদের দলবল নিয়ে। গানের নির্দেশনায় রুমা গুহঠাকুরতা খুব ব্যস্ত।
সদ্য একটা গান এসেছে তাঁর হাতে, ভূপেন হাজারিকার সুরারোপিত সেই গানটাকে বাংলায় খুব সুন্দর রূপান্তর করে দিয়েছেন গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। গানটা নাকি পল রোবসনের ‘ওল্ড ম্যান রিভার’ দ্বারা অনুপ্রাণিত—বিস্তীর্ণ দু’পারের অসংখ্য মানুষের—অচিরেই যে গান জনগণের মুখে মুখে ফিরবে।
সদ্য একটা গান এসেছে তাঁর হাতে, ভূপেন হাজারিকার সুরারোপিত সেই গানটাকে বাংলায় খুব সুন্দর রূপান্তর করে দিয়েছেন গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। গানটা নাকি পল রোবসনের ‘ওল্ড ম্যান রিভার’ দ্বারা অনুপ্রাণিত—বিস্তীর্ণ দু’পারের অসংখ্য মানুষের—অচিরেই যে গান জনগণের মুখে মুখে ফিরবে। রুমা গুহঠাকুরতা গানটিকে খুব মনোযোগ দিয়ে নানাভাবে হার্মোনাইজ করে সাজাচ্ছেন। গুহ দম্পতি ভাবছেন কীভাবে তাকে নাচের দৃশ্যায়নে রূপান্তরিত করা যায়। সব মিলিয়ে একটা ধুন্ধুমার ব্যাপার। রুমা দেবী গানটা দলের সবাইকে গেয়ে শোনাচ্ছেন এমন সময় একজন এসে দলনেত্রীর কানে কী যেন বলে গেল। রুমা গুহঠাকুরতা তখন সব ফেলে নিচের বসার ঘরে যাবেন বলে সবার কাছ থেকে অনুমতি চেয়ে নিলেন। জানা গেল বম্বে থেকে একজন নব্যযুবক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। রুমা জানতেন সেই যুবক নিশ্চয়ই তাঁর ছেলে অমিত কুমার। গতকাল তাঁর জন্মদিন ছিল। আঠারো বছর বয়স হলো। এখন সে সত্যিকারের পূর্ণবয়স্ক যুবক। যেখানে ইচ্ছে যাবার ক্ষমতা সে অর্জন করেছে এতদিনে। প্রথম সুযগে এখন সে তো তাঁর মায়ের কাছেই তো আসবে! ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই রুমা দেখলেন হ্যাঁ অমিতই পিছন ফিরে বসে আছে। তার সঙ্গে অনর্গল কথা বলে চলেছে শ্রমণা—অরূপ আর রুমার সন্তান। দুই ভাই-বোনে তখন চলছে ধুম আড্ডা। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রুমার চোখে জল এসে গেল। অতি সন্তর্পণে ফ্রিজ থেকে বার করে আনলেন বাড়িতে তৈরি একটা বড়ো কেক, যার উপরে লেখা ‘অমিতের আঠারো পূর্তির দিনে’। কেকটা টেবিলে রাখতেই মা ও ছেলের দৃষ্টি বিনিময় হলো। অবিস্মরণীয় সেই দৃশ্য। নির্বাক নিশ্চল দুজনেই। নেপথ্যে যেন বাজছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই অবিস্মরণীয় গান—
‘তোমার আমার কারো মুখে কথা নেই।
বাতাসেও নেই সাড়া।
জেগে জেগে কথা বলে ওই
দূর আকাশের তারা।’
ততক্ষণে দলের লোকজন সবাই নিচে এসে জড়ো হয়েছে। সবাই একমনে দেখছে দীর্ঘকাল বাদে মা ও ছেলের এক দুর্লভ মিলনদৃশ্য। হঠাৎ করে ওয়াই এস মুলকি তাঁর আকর্ডিয়ান যন্ত্রে সুর তুললেন। তাঁর বাজনার তালে তালে নেচে উঠলেন সাধন গুহ আর পলি গুহ। ঘরভর্তি সবাই একসঙ্গে গেয়ে উঠলেন—‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থ ডে টু অমিত, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।’ বালিগঞ্জ প্লেসের ওই বাড়িতে তখন রীতিমতো চাঁদের হাট। জন্মদিনের কেক কাটা হলো। অমিত তার মাকে প্রথম কেকটা খাওয়াল। অন্যেরাও একটু একটু করে খেল। কোথা থেকে দু’তিন রকমের মিষ্টি এসে হাজির। হৈ হৈ করে সবাই খেতে শুরু করল। কীভাবে যেন খবর পেয়ে মায়া সেন ওখানে এসে হাজির। কারো কোনো অনুমতির তোয়াক্কা না করে তিনি গান ধরলেন, ‘ও হে সুন্দর মম গৃহে আজি পরমোৎসব রাতি।’ গানের কথা ও সুরে এক ধরনের বিহলতা ছিল। সমগ্র ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে সেই গান যেন ছড়িয়ে পড়ল বাড়ির উঠোনে এবং উঠোন থেকে সমস্ত বালিগঞ্জ প্লেসে। ওই গানের পরে শুরু আরও অনেক গান। শিল্পীর অভাব নেই। একটা শেষ হতে না হতেই আরেকটা গান শুরু হয়ে যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে তখন কেবল গান এবং গানে গানে নতুন অতিথিকে বরণ করা যেন। অমিত তো রীতিমতো অবাক। সে বম্বেতে বসেই ইউথ ক্যয়ারের কথা শুনেছে। কিন্তু এঁদের কর্মকাণ্ডের বিশালতা দেখে সে সত্যি সত্যি স্তব্ধবাক। একমনে সব শুনছে। আর মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছে গুহ দম্পতির নাচ।
সলিলদা আর সত্যজিৎ রায়ের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় রুমা যেন পেয়েছিলেন পায়ের তলায় জমি। কিন্তু ঘর ভেঙে গেলে তো সব অন্ধকার হয়ে যায়। আভাস ততদিনে কিশোর কুমার হয়ে বম্বের হিরো হয়েছেন আর হয়েছেন গানের জগতের যুবরাজ।
অশ্রুসজল রুমার চোখে ভাসছে পঞ্চাশ দশকের সেই গোড়ার দিনগুলোর কথা। কী করে করে যেন জড়িয়ে পড়েছিলেন বম্বের বিখ্যাত গাঙ্গুলী পরিবারের ছেলে আভাস কুমারের সুখ-দুঃখের সঙ্গে। তিনি তো আবার নামী অভিনেতা অশোক কুমারের ভাই। মাত্র ষোলো বছর বয়সে ’৫০-এ বিয়ে, ’৫২-তে অমিতের জন্ম। তারপর টেনেটুনে ’৫৮ অব্দি একসঙ্গে থাকা। ওখানেই শুরু বম্বে ইউথ ক্যয়ারের জয়যাত্রা। আহা কী আনন্দময় ছিল সেই সুমধুর দিনগুলো! সলিলদা আর সত্যজিৎ রায়ের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় রুমা যেন পেয়েছিলেন পায়ের তলায় জমি। কিন্তু ঘর ভেঙে গেলে তো সব অন্ধকার হয়ে যায়। আভাস ততদিনে কিশোর কুমার হয়ে বম্বের হিরো হয়েছেন আর হয়েছেন গানের জগতের যুবরাজ। সিনেমায় যত না, তার চেয়ে বেশি মগ্ন গানে। তারপর মধুবালার সঙ্গে প্রণয় ও পরিণয়। কিশোর থেকে কাশেম হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত সবই রুমার দূর থেকে দেখা। মধুবালার মৃত্যুর পরে যোগীতা বালী এবং অবশেষে অভিনেত্রী লীনা চন্দ্রভরকর। ততদিনে রুমার পায়ের তলায় অন্য জমি। বম্বে থেকে কলকাতা। অরূপ গুহ ঠাকুরতার সঙ্গে নতুন জীবন শুরু। টালিগঞ্জের সিনেমাপাড়ার হাতছানি। বেনারসী, পঞ্চশর, নির্জন সৈকতে, পলাতক—আরও কত ছবি! কিন্তু রুমার মন পড়ে আছে গানে। সে তো ভালো করে গান গাইবে। গানই তো তাঁর ধ্যান জ্ঞান। গানের ডালি নিয়ে পৌঁছাতে হবে জনতার হৃদয়ে।
অবশেষে বম্বে ইউথ ক্যয়ারের নাম বদলে হলো ‘ক্যালকাটা ইউথ ক্যয়ার’। তার পরের ইতিহাস সবার জানা। শুধু নিজের দেশে নয়, বিদেশেও তাদের খ্যাতি পৌঁছে গেছে একসময়। একটার পর একটা রেকর্ড বেরোচ্ছে। অজস্র অনুষ্ঠান। মঞ্চ আলো করে থাকতেন রুমা গুহঠাকুরতা। তাঁর ওজস্বী কণ্ঠের গান যারা শুনেছেন, তাঁরা জানেন কী অসামান্য আকর্ষণ ছিল সেইসব গানে। অমন অসাধারণ মঞ্চমায়ার সৃষ্টি, খুব কম দলই করতে পারত তখন।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে রুমা দেবী আবার ফিরে এলেন বাস্তবে। ছেলে এসে মাকে প্রণাম করতে চাইলে মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ক্যামেরা ছিল না কারো কাছে। সেই অসাধারণ দৃশ্য তাই ধরা রইল সেদিনের সেই কতিপয় প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে। মা তাঁর ছেলেকে নিয়ে গিয়ে বসলেন সোফায়। একদিকে শ্রমণা আর অন্যদিকে অমিত। সাধন গুহ হঠাৎ গান গাইবার প্রস্তাব দিলেন অমিতকে। সে তো অনিচ্ছুক। এবার সবাই মিলে ধরে বসল তাকে। না, এমন একটা সুন্দর দিনে গাইতেই হবে তাকে। অমিত এবার রাজি হলো। তবে শর্ত একটাই, মাকেও তার সঙ্গে গাইতে হবে। অগত্যা মা রাজি হলেন। অমিত খুব আস্তে আস্তে ধরল সেই কবেকার লুকোচুরি ছবির সেই বিখ্যাত গান। বাবা ও মায়ের সেই অসাধারণ যুগলবন্দি।
‘এই তো হেথায় কুঞ্জছায়ায় স্বপ্ন মধুর মোহে
এই জীবনে যে কটি দিন পাব
তোমায় হেসে খেলে কাটিয়ে যাব দোঁহে
স্বপ্ন মধুর মোহে।
কাটবে প্রহর তোমার সাথে তোমার সাথে
হাতের পরশ রইবে হাতে
রইব জেগে মুখোমুখি মিলন আগ্রহে
স্বপ্ন মধুর মোহে।
এই বনেরই মিষ্টি মধুর শান্ত ছায়া ঘিরে
মৌমাছিরা আসর তাদের জমিয়ে দেবে জানি
গুঞ্জরণের মীড়ে আসর জমিয়ে দেবে জানি।
অভিসারের অভিলাষে রইবে তুমি আমার পাশে—
জীবন মোদের যাবে ভরে রঙের সমারোহে
স্বপ্ন মধুর মোহে।’
এমন মধুর দৃশ্য দেখে চোখের জল আটকাতে পারছিল না কেউই। গৃহস্বামী অরূপ গুহঠাকুরতা এসে বললেন না, না এমন অসামান্য একটি দিনে কান্না নয়, শুধু হাসি আর হাসি। গান হোক গান। সবাই মিলে গান ধরো। ততক্ষণে মুলকির পিয়ানো আকর্ডিয়ানে সুরের ঝঙ্কার উঠেছে।
গানের সঙ্গে কখন বাজনা বেজে উঠেছে। ঘরের গ্র্যান্ড পিয়ানোয় হাত পড়েছে মুলকি সাহেবের আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে গুহ দম্পতি কখন যে নাচ শুরু করেছেন, কেউ টের পায়নি। সবার চোখের সামনে ভেসে উঠল ছবির কিশোর কুমারের সঙ্গে অনিতা গুহর সেই দ্বৈতগান। তবে অনিতার পিছনে ছিলেন রুমা দেবী, অন্তত কিশোর কুমারের বিস্ময়ভরা চোখ বলে দিচ্ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি। এক দশক পেরিয়ে এসে এখন সেই গান যেন হয়েছে মা ও ছেলের গান। এমন মধুর দৃশ্য দেখে চোখের জল আটকাতে পারছিল না কেউই। গৃহস্বামী অরূপ গুহঠাকুরতা এসে বললেন না, না এমন অসামান্য একটি দিনে কান্না নয়, শুধু হাসি আর হাসি। গান হোক গান। সবাই মিলে গান ধরো। ততক্ষণে মুলকির পিয়ানো আকর্ডিয়ানে সুরের ঝঙ্কার উঠেছে। সবাই মিলে কোরাসে ধরেছে ক্যয়ারেরই একটি গান—
‘তোমার আমার ঠিকানা
পদ্মা মেঘনা যমুনা
মেকং ভল্গা ঘুরে গঙ্গার স্রোত ধরে
পেয়েছি চলার নিশানা।’
সবাই বুঝলেন আজ আর রিহার্সাল হবে না। একে একে সবাই ফিরে যাবার উদ্যোগ নিলেন। রুমা দেবী সবাইকে বললেন আগামীকাল আসার জন্যে। ঘর খালি হয়ে গেল। ঘরে তখন শুধু রয়ে গেলেন চারজন—রুমা দেবী, অরূপবাবু, শ্রমণা আর অমিত। তাঁদের মধ্যে তখন কী কী কথা হলো, সেসব এখানে নিতান্তই অবান্তর।
কলমের ডগায় যা এলো লিখে ফেললাম। প্রশ্ন জাগল মনে, আসলে ঘটনাটা কি সত্যি সত্যিই সেদিন ওখানে ওইভাবে ঘটেছিল! কে জানে!
জন্ম (১৯৪৭) খুলনায়। লেখক ও সম্পাদক হিসেবে তিনি সুপরিচিত। দীর্ঘকাল সম্পাদকীয় সহযোগী হিসেবে যুক্ত ছিলেন ‘বিজ্ঞাপন পর্ব’ এবং ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকার সঙ্গে। সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩০। প্রিয় বিষয় সংগীত, নাটক ও নৃত্য। তাকে ‘দুই বাংলার নিরর্গল সেতু’ আখ্যা দিয়েছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। বর্তমান বাসস্থান পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগনার হৃদয়পুরে। পেশায় ছিলেন গ্রন্থাগারিক। ‘একটি গৃহের কথা’ শিরোনামে স্বল্পদৈর্ঘ্যের একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন।