সত্যিকারের শিল্পীরা বাইরের প্রভাব গ্রহণ করতে পারে
নাগিব মাহফুজের এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আর্জেন্টিনার লেখক ও দার্শনিক ভিক্টর মাসুহ, যিনি একসময় ইউনেস্কোর নির্বাহী বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এই সাক্ষাৎকারে নাগিব মাহফুজ মিশরীয় সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং আরও সাধারণভাবে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বাইরের প্রভাবের সৃজনশীল শিল্পীদের ওপর প্রভাব তুলে ধরেছেন। তিনি ধর্ম এবং শিল্প নিয়েও কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি ‘দ্য ইউনেস্কো কুরিয়ার’-এ ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
মিশরের দীর্ঘ ইতিহাসে দেশটি অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্কৃতির—গ্রীক, রোমান, বাইজেন্টাইন, আরব এবং তুর্কি—মুখোমুখি হওয়ার জন্য উদ্ভূত অনেক প্রতিবন্ধক পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়েছে। বোনাপার্টের অভিযানের পর থেকে এবং বিশেষ করে ব্রিটিশদের দখলের পর থেকে মিশর আধুনিক পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সর্বশেষ প্রভাবটি তার পূর্ববর্তী সমস্ত প্রভাবের চেয়ে আরও বেশি গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়। এই মুখোমুখি পরিস্থিতি থেকে মিশরীয়দের পরিচয় কীভাবে উদ্ভূত হয়েছে? তা কি দূর্বল, শক্তিশালী, নাকি পরিবর্তিত হয়েছে?
নাগিব মাহফুজ : পাশ্চাত্যের সঙ্গে মিশর বা আরব বিশ্বের জন্য সাংস্কৃতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নতুন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। আপনি ঠিকই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন, মিশরে ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশের আগে দেশটি ভারত, পারস্য, গ্রীস এবং ভূমধ্যসাগরীয় সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের সংস্কৃতি থেকে সুদূরপ্রসারী প্রভাবের সম্মুখীন হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে প্রাচীন মিশরের কথা উল্লেখ না করলেও চলে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে এ সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমাদের ঐতিহ্যগত পরিচয় এবং ধ্রুপদী সংস্কৃতিকে পুরস্কৃত ও সমৃদ্ধ করেছিল। তারা আমাদের মধ্যে জীবিতদের দারিদ্র্যমুক্ত কিংবা তাদের বিকাশকে বাধা দেওয়ার পরিবর্তে শক্তি যুগিয়েছিল।
বিগত দুই শতাব্দী ধরে পাশ্চাত্যের সঙ্গে এক নতুন যোগাযোগের মুখোমুখি হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এই যোগাযোগ নেতিবাচক। তবে আমরা যদি মনোযোগ দিয়ে সামগ্রিকভাবে ফলাফল পর্যালোচনা করি, তবে বলা যেতে পারে যে, ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো বাকিদের ছাড়িয়ে গেছে। দেখুন, সাহিত্যের কি হয়েছে। পাশ্চাত্য ধারণা ও লেখা আমদানি করা হয়েছিল এবং আমরা তা গ্রহণ করেছি। তাদের ধন্যবাদ যে, আমরা উপন্যাস, ছোটোগল্প ও প্রবন্ধের নতুন এবং বিশেষ করে মিশরীয় আদল তৈরি করতে পেরেছি। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের আখ্যান এবং শৈলীর উৎপত্তি আরব অতীতের গভীরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে আমরা বলতে পারি যে, ইউরোপ থেকে উদ্ভূত চিন্তার স্রোতের মাধ্যমে মিশরীয় সাহিত্যের শেকড় নবায়ন করা হয়েছে এবং এক নতুন জীবন দেওয়া হয়েছে। এগুলো আমাদের পরিবেশ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে এতটাই মিলেমিশে গেছে যে, এখন আর আলাদা করা যায় না। তারা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে যে, মনে হয় তারা চিরকাল এখানেই ছিল।
অনেক উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে পশ্চিমা দেশের সভ্যতার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। এই যোগাযোগের কারণে এসব উন্নয়নশীল দেশের কিছু বুদ্ধিজীবী এমন মনোভাব গ্রহণ করে, যা ইউরোপীয়দের চেয়েও বেশি ইউরোপীয়। সুতরাং তারা এমন কাজ করে, যা শুধু ইউরোপীয় মডেলের অনুকরণ। মিশরীয় বুদ্ধিজীবীরা কী এক ধরনের প্রলোভনের শিকার?
নাগিব মাহফুজ : এ বিষয়ে আমরা বেশ অনেকগুলো পর্যায় অতিক্রম করেছি, যার মধ্যে প্রথমটি ছিল আমাদের ভাষায় ইউরোপীয় সাহিত্য কর্মের অনুবাদ। দ্বিতীয় পর্যায়টি ছিল সেই অনুবাদ কাজগুলো আমাদের উপযোগী করে তোলা এবং আমাদের পরিবেশে সঙ্গে একত্রীকরণ করা, যা অন্যভাবে বলা যায় একটি ভিনদেশি অপরিচিত সাংস্কৃতিক পণ্যের ‘মিশরীয়করণ’। তৃতীয় পর্যায়টি হলো পরিপক্কতা, যখন একজন লেখকের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব তার পরিপূর্ণ আত্মপ্রকাশ অর্জন করে।
ইউরোপ আমাদের অত্যন্ত গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, যেমন আপনি বলছেন যে, অনুকরণকারী রয়েছে। কিন্তু অনুকরণ কোনো শিল্প নয়, এমনকি সাংস্কৃতিক পরিপক্কতার লক্ষণও নয়। আমার মতে সত্যিকারের শিল্পীরা বাইরের প্রভাব গ্রহণ করতে পারে। এছাড়া তাদের নিজেদের মধ্যে থাকা সত্যকে আরও ভালো এবং সুন্দরভাবে প্রকাশ করার জন্যও গ্রহণ করতে পারে। আমি মনে করি, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকার ক্ষেত্রে একই রকম কিছু ঘটেছে। শুরুর দিকে সম্ভবত অনুকরণ করা হয়েছিল, তবে পরবর্তীতে একটি নির্দিষ্ট সাহিত্যের ধারা সৃষ্টি হয়েছিল, যা ইউরোপীয় লেখকদের প্রভাবিত করেছে। সংক্ষেপে বলা যায়, একটি সাংস্কৃতিক অভিঘাতের পরে বাহ্যিক মডেলগুলো প্রথমে অনুলিপি করা যেতে পারে, তবে এ পর্যায়টি অতিক্রম করে যাওয়া এবং কারো সৃজনশীলতার প্রকাশের জন্য আরও সমৃদ্ধ খোলা পথের সন্ধান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে, সেই আন্দোলন ভিন্ন পথ অনুসরণ করেছিল। এ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আমেরিকায় আরবি ভাষায় বেশ কয়েকজন লেখকের আবির্ভাব ঘটেছিল। তারা ১৯১০ সাল থেকে নয়া বিশ্বে অভিবাসনের তরঙ্গের একটি অংশ খুঁজে পেয়েছিল এবং তারা মাজহার (অভিবাসন বা প্রস্থান) লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। সেই উদীয়মান আরব সাহিত্য আন্দোলন কী আরব বিশ্বের ওপর কোনো প্রভাব ফেলেছিল?
নাগিব মাহফুজ : সেই আন্দোলনের যথেষ্ট প্রভাব ছিল এবং আরবি ভাষা ও সাহিত্যের পুনরাবৃত্তিকরণে অবদান রেখেছিল। আমি মাজহার লেখকদের, বিশেষ করে কবিদের, অগ্রগতির প্রশংসা করেছি এবং তারা আমার ওপর গভীর ছাপ রেখে গেছেন। তারা যে আমাদের নিজের ভূমি থেকে অনেক দূরে বসে লেখালেখি করতেন, তা আমাদের প্রতি তাদের গভীর আকর্ষণকে হ্রাস করেনি। অন্য মহাদেশে জন্ম নেওয়া তাদের সাহিত্যের এক বিশেষ ধরনের রুচি এবং অনুরণন রয়েছে, যা আমরা আরব বিশ্বে খুবই প্রশংসা করি। তারা যে পরিবেশে বাস করতেন, তাদের সাহিত্যকর্ম তাই প্রতিফলিত করেছে। তারা নয়া বিশ্বের ল্যান্ডস্কেপ এবং সমাজের মাধ্যমে বিকশিত ও প্রসারিত হয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা হৃদয় জুড়ে ‘আমেরিকান’ লেখক। তাদের মাধ্যমে আমার নিজের কাজের মধ্যে আমেরিকা একটি নির্দিষ্ট স্থান অর্জন করেছিল এবং সাধারণভাবে বলা যায় যে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাম্প্রতিক সাংস্কৃতিক নবায়নকরণকে চিহ্নিত করেছে।
আপনার লেখার চরিত্রগুলো এমন এক ধরনের আবেগ দ্বারা অনুপ্রাণিত বলে মনে হয়, যা কায়রোর পুরনো সব মহল্লা ক্লান্তিহীনভাবে তাদের অনুসরণ করে। আপনি তাদের জীবনের আবেগকে অসাধারণ ভালবাসার সঙ্গে চিত্রায়িত করেছেন, তবুও তারা একই সঙ্গে গভীর প্রশান্তি ধারণ করে। তাদের মাধ্যমে আমরা অনুভব করি যে, আপনি নিজের মধ্যে পুরোপুরি শান্তিতে আছেন এবং তার ওপর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে অতিক্রম করেছেন।
নাগিব মাহফুজ : তা অবশ্য সত্যি। আমি সব সময় এ শহরের মানুষকে ‘শনাক্ত’ করতে সক্ষম হওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছি, যা আমি খুব ভালো করেই জানি এবং অত্যন্ত ভালোবাসি। আমার চারপাশে যে সব জীবন চলাফেরা করে, তারা যখন আমার দৃষ্টির সীমানায় প্রবেশ করে, তখন তারা চরিত্র হয়ে ওঠে। অন্য কথায় তারা আমার নিজের মাংস এবং রক্তের মানুষ হয়ে ওঠে। আমার কৃতজ্ঞতা সৃজনশীল শিল্পে পরিণত হয়।
আপনার ‘মিডাক অ্যালি’ উপন্যাসে ধর্মীয় পরিবেশের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তা কী আপনার ব্যক্তিগত জগতের প্রতিফলন বা বাস্তবতার একটি দিক, যা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছিল?
নাগিব মাহফুজ : আমার বেশ কয়েকটি লেখায় সেই ‘আবহাওয়া’-র উপস্থিতি রয়েছে, তবে তা কোনো সাহিত্যিক কৌশল বা সম্প্রদায়গত পছন্দ নয়। আমি যে বাস্তবতার বর্ণনা করেছি, তার অংশ এবং কায়রোর পুরনো মহল্লাকে আখ্যান হিসেবে ব্যবহার করেছি। আমি মনে করি যে, একজন শিল্পীকে সেই বাস্তবতাকে বিকৃত না করে বরং তা চিত্রিত করতে হবে। ধর্মান্ধতা বা মতাদর্শগত অঙ্গীকারের দিকে না গিয়ে এবং এক বা অন্য বিশ্বাসের পক্ষে কথা না বলে তা করা উচিত।
প্রশ্ন: প্রযুক্তির বর্তমান বিকাশ এবং প্রযুক্তিকে কখনো ধ্বংসাত্মক উদ্দেশে ব্যবহৃত হয় এবং সমস্ত গ্রহজুড়ে প্রকৃতির জন্য হুমকি হিসেবে গণ্য করা হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে কোন যোগ্যতা অবশিষ্ট রয়েছে? আপনি কী মনে করেন যে, ধর্ম এসব চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে পারে এবং অমানবিকতার ঝুঁকি সীমিত করতে পারে?
নাগিব মাহফুজ: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে যে অগ্রগতি, তা সবসময় নেতিবাচক ছিল না। তবে মানবজাতির জন্য অপরিসীম সেবা করেছে। অবশ্যই কিছু ধ্বংসাত্মক দিক রয়েছে। তবে আমি মনে করি যে, অমানবিকতার এ প্রক্রিয়াটি দুটি শক্তির সহায়তায় লড়াই করা যেতে পারে: ধর্ম এবং শিল্প। এ দুটি শক্তির মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে মানুষের উপকারে পরিণত করা সম্ভব। আমি জোর গলায় বলছি যে, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তাদের নিজেদের ভুল সংশোধন করতে সক্ষম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অ-দূষণকারী শক্তি উত্পাদনের বর্তমান প্রচেষ্টা। অগ্রগতি থামানো যাবে না, তবে আতঙ্কের কাছেও আত্মসমর্পণ করা উচিত নয়। আমি আশাবাদী যে, সচেতনতার অনুভূতির মাধ্যমে পরিচালিত বিজ্ঞান ক্রমশ তার গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। সেই গতিপথকে আলোকিত করার জন্য রয়েছে শিল্প এবং ধর্ম।
গল্পকার, ছড়াকার এবং অনুবাদক। লেখালেখির শুরু সত্তরের মাঝামাঝি। ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতায়, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তার মৌলিক এবং অনুবাদ গল্প। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে দুটি গল্পের সংকলন, চন্দ্রপুকুর (২০০৮) ও কতটা পথ পেরোলে তবে (২০১০)। এছাড়া, তার অনুবাদে আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৩), নির্বাচিত নোবেল বিজয়ীদের সেরা গল্প (২০১৩), ইরানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৪), চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প ও নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে।