বুধবার, ফেব্রুয়ারি ১৯

পঁচিশের যত নতুন বই : মোস্তাক শরীফ

0

ফেব্রুয়ারি এলেই বই নিয়ে কথার ঝাঁপি খুলে বসতে হয়, যদিও সারা বছরই বই পড়া এবং বই নিয়ে কথাবার্তা হওয়া উচিত। তবু তো বছরের গোটা একটা মাস লেখক ও পাঁড় পাঠকের বাইরেও আমজনতা অন্তত আনুষ্ঠানিকতার খাতিরে হলেও বইয়ের কথা বলে, বই কেনে এবং পড়েও, কাজেই ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক এই বইমুখিনতাকেও উড়িয়ে দেওয়ার জো নেই।

আর সব লেখকের মতোই, প্রকাশকদের দিক থেকে বই লেখা নিয়ে যে চাপ, আমার ক্ষেত্রেও সেটি মূলত ফেব্রুয়ারিকে ঘিরেই। ব্যাপারটি শুরু হয় মেলা শেষ হওয়ার মাসকয়েক যেতে এবং সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে। লেখালেখির প্রতি স্বভাবগত ভালোবাসা থেকে, এবং অবশ্যই প্রকাশকদের চাওয়ার সাথে সঙ্গতি রাখতেও, অন্য যেকোনো বছরের চেয়ে বেশিই বই লিখে ফেলেছি এবার। মোট আটটা! সব বইয়ের কথা বড়ো মুখ করে বলতে পারব না, যদিও সন্তানের মতোই, লেখকের কাছে প্রতিটি বই-ই প্রিয়।

অনুবাদ বরাবরই আমার প্রিয় কাজ। এবার চারটি বই অনুবাদ করেছি, একটি লিখেছি বিদেশি কাহিনির ছায়াবলম্বনে, আরও একটিতে আছে বিদেশি কাহিনির অনুপ্রেরণায় রচিত কয়েকটি গল্প। ফলে এবার মোট প্রকাশনার সিংহভাগই অনুবাদ অথবা অনুবাদনির্ভর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটির কথা জানাতে চাই শ্রী-র পাঠকদের।

Mostak Sharif_Cover_ 1প্রথমেই যে বইটির কথা বলব সেটি অনূদিত নয়, মৌলিক। বইটির নাম ‘বাবর’। খ্যাতনামা মোঘল সম্রাটদের জীবনীভিত্তিক উপন্যাস লেখার একটা উদ্যোগ হাতে নিয়েছি, তারই অংশ হিসেবে ইতঃপূর্বে লিখেছি ‘আলমপনাহ’ ও ‘মসনদ’, যথাক্রমে সম্রাট জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানকে নিয়ে। এবার মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবরের ঘটনাবহুল জীবনকে উপজীব্য করেছি। বালকবয়সে ফারগানা রাজ্যের মসনদে বসা থেকে শুরু করে একের পর এক প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙিয়ে হিন্দুস্তানের বিস্তীর্ণ জমিনে বাবরের স্বপ্নসাম্রাজ্য গড়ার গল্প বলার চেষ্টা করেছি ইতিহাসের প্রতি যতটা সম্ভব নিষ্ঠ থেকে। বিশেষ করে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি বাবরের মধ্যে যে কবি আর প্রেমিকের মনটি বাস করত সেটিকে।

Mostak Sharif Cover 2২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কোরিয় লেখক হান কাং, আর বুকার পেয়েছেন ব্রিটিশ লেখক সামান্থা হার্ভে। হান কাং-এর ‘দ্য হোয়াইট বুক’ নামে নাতিদীর্ঘ একটি উপন্যাস অনুবাদ করেছি, যেটি আসলে জার্নাল আকারে লেখা টুকরো টুকরো গদ্য। লেখকের বড়ো বোন জন্মের পরপরই মারা গিয়েছিলেন মায়ের কোলে, অদেখা সেই বোনকে নিয়ে লেখকের বিচ্ছিন্ন ভাবনা বিভিন্ন সাদা জিনিসের মাধ্যমে (সাদা ফুল, নবজাতককে পেঁচানোর সাদা কাপড়, সাদা গজ-ব্যান্ডেজ ইত্যাদি) ফুটে উঠেছে। কবিতার সুষমামাখা এই লেখা গদ্যশিল্পী হিসেবে হান কাংয়ের শক্তিমত্তার পরিচায়ক। অন্যদিকে তরুণ লেখক সামান্থা হার্ভে-র অরবিটাল অনায়াসে জিতেছে এবারের বুকার, যেখানে তেমন কোনো প্রতিযোগিতার মুখেই পড়তে হয়নি বইটিকে। ভূপৃষ্ঠের আড়াইশো মাইল উপরে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পৃথিবী প্রদক্ষিণরত পাঁচ দেশের ছয় নভোচারীর গল্প ‘অরবিটাল’। প্রতিদিন ষোলোটি সূর্যোদয় দেখেন তাঁরা, ষোলোটি সূর্যাস্ত। দেশ-মহাদেশ, সাগর-প্রান্তর, মরুভূমি আর হিমবাহকে পাখির চোখে দেখেন তাঁরা, পৃথিবী নামের সবুজ গ্রহের প্রতি অনুভব করেন অনিঃশেষ মায়া। মহাবিশ্বে নিজেদের একমাত্র এই ঠিকানাকে

Mostak Sharif_Cover_ 3যে অবহেলায় ধ্বংস করছি আমরা, সেটি ভেবে কেমন অনুভূতি হয় তাঁদের? সব মিলিয়ে সামান্থা হার্ভের স্বাদু গদ্যে অসাধারণ এক লেখা। নিশ্চিত করেই বলা যায়, এমন বই এর আগে আর একটিও লেখা হয়নি। হান কাং ও সামান্থা হার্ভে দুজনের ভাষা ও লিখনভঙ্গির কথা আলাদাভাবে বলতে হবে। দুজনের গদ্যেই কবিতার ঘ্রাণ প্রবল। ভাষাকে ভেঙেচুরে পাঠককে নিয়ে যান মোহগ্রস্ততার এক জগতে। এমন গদ্যকে অনুবাদ করা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং, কতোটা সক্ষম হয়েছি পাঠক বলতে পারবেন, যদিও চেষ্টার ত্রুটি করিনি—এটা বলতে পারি। দুটো বই-ই প্রকাশ করেছে জ্ঞানকোষ প্রকাশনী।

বিজ্ঞানী, মহাকাশ প্রকৌশলী ও অবশেষে ভারতের রাষ্ট্রপতি—একসঙ্গে অনেক পরিচয় এপিজে আব্দুল কালামের। নিজের জীবনের গল্প নিয়ে ১৯৯৯ সালে লিখেছিলেন ‘উইংস অব ফায়ার’—আগুনডানা। আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার হয়েছিল বইটি, জয় করেছিল অগণিত পাঠকের মন। বহুলখ্যাত সেই বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছি আমি, প্রকাশ করেছে নবরাগ প্রকাশনী। বিপুল প্রতিভার সঙ্গে অবিশ্বাস্য সরলতার মিশ্রণ ঘটলে কেমন মানুষ তৈরি হন এপিজে আব্দুল কালামই তারMostak Sharif_Cover_ 4 প্রমাণ। রামেশ্বরমের দরিদ্র এক মুসলিম পরিবার থেকে উঠে এসে হাজার প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে কীভাবে খ্যাতির শিখরে আরোহণ করেছিলেন, নির্মোহ ভঙ্গিতে করেছেন সে গল্পই। আত্মমগ্ন এক মহাপ্রতিভার দেখা মিলবে বইয়ের পাতায় পাতায়।

আর্থার সি. ব্রুকস ও অপ্ রাহ উইনফ্রে-র লেখা নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর নাম্বার ওয়ান বেস্টসেলার বই ‘দ্য আর্ট অ্যান্ড সায়েন্স অব গেটিং হ্যাপিয়ার: বিল্ড দ্য লাইফ ইউ ওয়ান্ট’ অনুবাদ করেছি। প্রকাশ করেছে সূচীপত্র। জীবনে সুখী হওয়া কি সত্যিই সম্ভব, নাকি সুখ এক মোহন মরীচিকা? এমন জটিল প্রশ্নকে সামনে রেখেই জীবনে সুখী হওয়ার উপায় অন্বেষণ করেছেন লেখকদ্বয়। পরিবার, বন্ধু, কাজ আর ধর্মবিশ্বাস—এ চারটি ভিত্তিকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখিয়েছেন, জীবনে সুখী হওয়া আদৌ সম্ভব কি না। সুখকে নিয়ে দার্শনিক কচকচানি নয়, সুখী হওয়ার প্রায়োগিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায় প্রদর্শনের চেষ্টা করেছেন দুই লেখক। এ বিষয়ে আগ্রহীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বলে মনে করি।

Mostak Sharif_Cover_ 5সবশেষে বলব ‘আমার কিছু নাই’ বইটির কথা। এটি একটি উপন্যাস, প্রকাশ করেছে বাতিঘর। কাহিনিটা মোটামুটি সাদামাটাই। এক কবিবন্ধুর হাত ধরে চলে গেছে স্ত্রী আইরিন, মানসিক যন্ত্রণায় হাবুডুব খাচ্ছে বাদল। এর মধ্যেই সুদূর মার্কিন মুল্লুক থেকে আসে এক চিঠি, আশনা নামে এক মেয়ের কাছ থেকে, বহু আগে দেশে থাকার সময় ধর্ষিতা হয়েছিল যে। ধর্ষককে খুঁজে বের করার ব্যাপারে বাদলের সাহায্য চায়। ভালোবাসা এবং ঘৃণা—আপাতবিরোধী এ দুটো আবেগকে নেড়েচেড়ে দেখতে চেয়েছি বইটিতে, বোঝার চেষ্টা করেছি কোনটি বেশি শক্তিশালী। জীবন দিয়ে যাকে ভালোবাসা যায় তাকে ঘৃণা করা কি সম্ভব? নাকি ঘৃণা আসলে ভালোবাসারই অন্য এক রূপ? আর সেই ধর্ষক? খুঁজে পাওয়া গেল তাকে, নাকি সবই আশনার ঊর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা? বইটি লিখতে গিয়ে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সেই ঘোরের ভাগিদার পাঠকও হবেন, সেই আশা রাখি।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ফেনীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বর্তমানে একই বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। লেখালেখির শুরু নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, পত্রপত্রিকায়। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি ইতিহাস, তথ্যপ্রযুক্তি, ছোটোদের জন্য রূপকথা নানা বিষয়ে লিখেছেন। বিশেষ আগ্রহ অনুবাদে। সিলভিয়া প্লাথের ‘দি বেল জার’ ছাড়াও ইতিহাসভিত্তিক কয়েকটি বই অনুবাদ করেছেন। মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বাইশ।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।