তৃতীয় পর্ব
তারপর আষাঢ় মাস
এইভাবে এইভাবে বৈশাখ মাস গেছে, জ্যৈষ্ঠ মাসও! বৈশাখ মাসে বাড়ির লোকের হাতে তেমন বিশেষ কোনো কাজ ছিলো না বলে, সকলে শান্তিহালেই জুলহাসকে চোখে চোখে রাখতে পেরেছে! জেরা-জিজ্ঞাসাও তারা একেকজনে কিছু কম করেনি! ইস্কুলে যাওয়ার রাস্তা ছেড়ে সে কেনো গিয়েছিলো অই বটগাছঅলা মাঠে? কেমনে গিয়েছিলো? আচ্ছা! যেতে ইচ্ছা হয়েছিলো, তাই না হয় গেছে! কিন্তু ওখানে সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো কোন বুদ্ধিতে? কেমনে সে তখন বাড়ির কথা ভুলেছিলো? মায়ে তার জন্য চিন্তায় চিন্তায় আধামরা হয়ে যেতে পারে, সেই কথা তার কী জানা নেই? তারপরেও সে অমনটা করলো কীভাবে?
এমন কতো কতো কথা! সারাদিন সকলে জিজ্ঞেস করে! রাতে সে শুয়ে পড়ার পরেও জিজ্ঞাসা শেষ হয় না! কেউ বলে দেয়নি, কিন্তু নিজে থেকেই জুলহাসে বোঝে, আসল কথাটা কিছুতেই কাউকে বলা যাবে না! সন্ন্যাসী বাবার কথা তো বলা যাবেই না; জুলায় যে সন্ন্যাসী বাবার সাথে ছেফ ফলের দেশে যাওয়ার জন্য রওনা করেছিলো, সেটাও না! একেবারেই না!
ওইকথা শুনলে বাড়ির সকলে তো ভয়েডরে একশেষ হবেই! মায়ের আর বুজির কান্দাকাটিও তখন একদণ্ডের জন্য থামবে না! থাক থাক! আসল কথাটা একদম জুলহাসের মনের ভেতরেই থাকুক! কাউকে কিচ্ছু জানান্তী দেওয়ার দরকার নেই!
তবে একদিন কী অই কথাটা সে মা-কে বলে দেবে না? একদিন সে বলে দেবেই! যখন সে বড়ো হয়ে যাবে, একেবারে বাবার মতন বড়ো! তখন সে সবটা বলে দেবে! ততোদিনে জুলহাসের বাঁচামরা নিয়ে মায়ের ডরগুলো অনেক কমে যাবে না? কমে যাবে। তখন শুনলে, মায়ে আর বেশী কিছু ডরাবে না! কাঁদবেও না!
কিন্তু একটা কথা জুলহাসের মনের ভেতরে কেবল কুটকুট করতে থাকে! কেবলই কুটকুটায়ে কুটকুটায়ে পিঁপড়া-কামড় দিতে থাকে! আচ্ছা! কেমনে কী হলো? সে তো সেই কোন এক অজানা মাঠের মধ্য দিয়ে সন্ন্যাসী বাবার পেছন পেছন যাচ্ছিলো! তাহলে সে ঘুমালো কীভাবে? কখন ঘুমালো? আর, তাকে অমন ঘুমের মধ্যে রেখে সন্ন্যাসী বাবা কখন চলে গেলো? কেনো চলে গেলো!
বৈশাখ মাস ভরে মনে মনে এইকথা নাড়েচাড়ে জুলহাস! আর, একেকবার তার ইচ্ছা হতে থাকে; একদৌড়ে সে চলে যায় সেই পুকুরের পাড়ে! সন্ন্যাসী বাবা কী সেই রাস্তা দিয়ে আর হাঁটেচলে? নাকি সেই দূরের মুল্লুক থেকে সে আর ফিরে আসেনি! যদি আর একটাবার তাকে দেখতে পায় জুলহাস, তবে পাহাড়ের দেশে যাওয়ার রাস্তাটার খোঁজটা সে নিয়ে রাখবে!
বৈশাখ মাস ভরে মনে মনে এইকথা নাড়েচাড়ে জুলহাস! আর, একেকবার তার ইচ্ছা হতে থাকে; একদৌড়ে সে চলে যায় সেই পুকুরের পাড়ে! সন্ন্যাসী বাবা কী সেই রাস্তা দিয়ে আর হাঁটেচলে? নাকি সেই দূরের মুল্লুক থেকে সে আর ফিরে আসেনি! যদি আর একটাবার তাকে দেখতে পায় জুলহাস, তবে পাহাড়ের দেশে যাওয়ার রাস্তাটার খোঁজটা সে নিয়ে রাখবে! বড়ো হলে কী সে আর একা একাই ওখানে যেতে পারবে না? পারবে!
জ্যৈষ্ঠ মাসের সবসময়ই, অই ইচ্ছাটা তার মনের মধ্যে দাপাদাপি করতে থাকে! একা একা একবার সে যাবে, অই পুকুরের পাড়ে! সন্ন্যাসী বাবাকে একবার সে একটু খুঁজে দেখবে! কিন্তু সেটা করার একটু কোনো সুযোগই পায় না জুলহাস! কেউই তার ওপর থেকে একটুও চোখ সরায় না!
জ্যৈষ্ঠ মাস আসার আগেই তাদের বাড়িতে অনেক হইহই, অনেক দৌড়-ছুট শুরু হয়! ওই মাসেই তো জুলহাসের জন্য, নতুন মানত পালনের কাজকর্ম শুরু করতে হবে! অমনই তো কথা আছে! কথা আছে, জ্যৈষ্ঠ মাসের গোড়াতেই একটা মা পাতিহাঁসকে ডিমে তা’দিতে বসিয়ে দিতে হবে! ডিম ফুটে তারপর যতোগুলো বাচ্চাই জন্মাক, এগারোটা হাঁসের বাচ্চা কিন্তু ঠায়ঠিক হালে পাওয়া চাই! ওটা না-পেলেই বিপদ!
কাজেই জ্যৈষ্ঠর মাস-পয়লাদিনেই কুড়িটা ডিমে তা’দেওয়ার জন্য, পাঁতিহাসটাকে বসায়ে দেওয়া হয়! ফুটুক এখন ডিমের নিয়মে ডিম!
আষাঢ় মাসে দেশদুনিয়ার সবকিছু চলে যাবে বন্যার পানির নিচে! তখন জুলহাসকে ইস্কুলে যেতে দেওয়ার কোনো উপায় নেই! সে একা একা কোষা নাওটা বেয়ে বেয়ে ইস্কুলে যেতে পারবে ঠিক! কিন্তু অতোটা পানির পথ একা একা যাবে! অইটুক পোলাপান! বাড়ির লোকে তখন বাড়িতে থাকবে কেমন করে! চিন্তায় চিন্তায় না তারা জানেপ্রাণে ধড়ফড়াতে থাকবে! ওদিকে আবার মানত পালনের ঠেকাটাও তো আছে! পুরোটা আষাঢ় মাসই তো জুলহাসকে হাঁসের বাচ্চাগুলার ভালোমন্দ দেখে রাখতে হবে! এবারের মানতে, অমনটা করার কথাই যে বলে গেছে দরবেশ হুজুর! তাহলে তখন সারাটা আষাঢ় মাস আর ইস্কুলের দিকে পা-বাড়াতেই দেওয়া যাবে না জুলহাসকে!
আরও পড়ুন : পানিডাঙা গ্রামে যাকিছু ঘটেছিলো-১ম পর্ব ও ২য় পর্ব
সেই কথা স্মরণে রেখে, জ্যৈষ্ঠমাসটায় জুলহাসের বাবা, প্রায় প্রায়ই তার কর্মে কামাই দিয়ে দিয়ে, জুলহাসকে ইস্কুলে নিয়ে যায়। সেই একই পথ! ভোরসকালে বাবার সাথে সাথে হেঁটে হেঁটে যেতে যেতে সেই পুকুর পাড়টাকে পেরোয় সে। কোথাও সন্ন্যাসী বাবাকে দেখা যায় না! সেই বউন্না গাছতলাটাও পেরিয়ে যায়! একটা দিনও, সেই গাছতলায় সন্ন্যাসী বাবা নেই!
এইভাবে দিন যায় দিন যায়! তারপর আষাঢ় মাস আসে! দুনিয়ার সকল মাঠঘাট তখন বন্যার পানির নিচে ডুবে যায় ঠিকই, কিন্তু কয়দিনের মধ্যেই ওই ডুবে-থাকা মাঠঘাটগুলো একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটিয়ে দেয়! তারা শাপলা ফুলদের পাঠায় পানির উপরে মাথা উঁচোতে! কতো যে শাপলা! খলখল শাপলা!
এবারের আষাঢ় মাসটা নিয়ে মায়ের মনে অশান্তির শেষ নেই! একটা দিনও আকাশে সূর্যের জাগনা দেওয়া-দেওয়ির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না! দিনগুলো আর রাতগুলো একদম ভেজা ভেজা, আর মেঘ কালো, আর বৃষ্টি ছপছপা! সারাদিন বৃষ্টি। হয় ঝমঝম, ঝুম বৃষ্টি! নয় তো প্যাচর প্যাচর টিপি টিপি বৃষ্টি!
ওর মধ্যেই রোজ সকালে, জুলহাসকে নিয়ে নিজেদের পুরানো বাড়িতে চলে আসে মা! এসে পুবের ঘরের শেকল নামায়। দরোজা খোলে! মাটির মস্ত খোরাটাতে ফেন আর খুদ-কুঁড়া মাখায়! পানিতে নেমে যাবার আগে, বাচ্চাগুলো আর মা পাতিহাঁসটাকে তো পেটভরে খাদ্যখাওয়া দিতে হবে! তারপর সারাদিন তারা কই কই ভেসে বেড়াবে, কোনদিকে কোনদিকে যাবে, কী না কী খাবে, সেইসবের ঠিকঠিকন্তী তো নেই! সেইসব করার জন্য শরীরে শক্তি থাকা লাগবে না? তাই সকালবেলায়ই তাদের মুখের সামনে অনেক খাবার দেওয়া লাগেই লাগে!
প্রথম প্রথম কয়দিন, সকাল বেলার খুদ-কুঁড়া আর ফেন মাখানোর কাজটা মায়েই করে! তারপর সেই কাজ জুলহাসে নিজেই, খুব ভালো করে শিখে ফেলে! রোজ সকালে সে নিজে নিজে একা একাই, নিজেদের পুরানো বাড়িতে চলে আসতে চায়! অমন বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মায়ের আসার আর কী দরকার! কোনো দরকার নেই! জুলহাসে একলাই সবকিছু গুছায়ে নিতে পারবে! পারে তো সে!
তাও মায়ে তাকে একা ছাড়তে সাহস পায় না! পোলাপান মানুষ! এমন আন্ধার, মেঘ-ঘুটঘুট্টা দিনে, এমন নিরালা বাড়িটাতে, একা একলা এসে যদি ডর পায়! আতকা ডর পায়! কী সর্বনাশা কারবার হবে তাহলে সেটা! ‘মানে মানে এই একটা মাস পার করতে দেও মাবুদ!’ মা মনে মনে কেবল এই দোয়া করে যায়!
তবে মায়ে তো জানে না, জুলহাসে এখানে একেবারেই একা থাকে না! ছানাপোনাদের নিয়ে পাতিহাঁসে গপাগপ খুদ-ফেন খেয়ে থলথলাতে থলথলাতে গিয়ে পুবের পানিতে নামে একদিকে, আরেকদিকে অমনি জুলহাসের নয়া দোস্তে এসে হাজির হয়! সে সেই পুবের দিক দিয়েই আসে! বন্যার পানি তো বরাবরই পুরানো বাড়ির পুব কিনার ঘেঁসেই চ্ছল্লাত চ্ছল্লাত করতে থাকে! সেই দিকের পানি থেকে, রোজ সেই নয়া দোস্ত, টুপুস করে মাথা জাগনা দিয়ে দেয়!
তার শরীর থাকে ভেজা জুবজুবা! তার পিঠেকাঁধে কতোমতো শেওলা-পানা যে লেগে থাকে! সেগুলো সে নিজ হাতে ধরে একটুও সরায়ে দেয় না! আবার জুলহাসে যদি সেগুলো সরায়ে দেওয়ার জন্য একটুও আগায়, অমনি সে ছিটকে পানিতে নেমে যায়! আর বলতে থাকে, ‘এট্টুও ধরবা না আমারে!
অনেক দূর থেকেই, সম্ভব, সে সাঁতরে সাঁতরে আসে! তার শরীর থাকে ভেজা জুবজুবা! তার পিঠেকাঁধে কতোমতো শেওলা-পানা যে লেগে থাকে! সেগুলো সে নিজ হাতে ধরে একটুও সরায়ে দেয় না! আবার জুলহাসে যদি সেগুলো সরায়ে দেওয়ার জন্য একটুও আগায়, অমনি সে ছিটকে পানিতে নেমে যায়! আর বলতে থাকে, ‘এট্টুও ধরবা না আমারে! কইতাছি খবরদার! ধরবা না!’
‘এমুন পানা-হেওলা শইল্লে থাকলে শইল কুটকুটায়! তোমার অসুখ অইবো কইলাম!’ জুলহাস তাকে বুঝ দিতে চায়!
‘আমার আর কিচ্ছু অইবো না! আর কিচ্ছু অইবো না!’ বলে সে হাসতে থাকে, খিটির খিটির!
কী যে তার নাম, জুলহাস সেটা জানে না! যখনই জিজ্ঞেস করে, সে চুপমুখে কিছুক্ষণ মাটির দিকে চেয়ে থাকে। তারপর বলে, ‘আমারে তুমি দোস্ত কইয়া ডাকো? আমরা দুস্তী করছি না? তাইলে আবার নাম লাগে নি?’
আচ্ছা, নামটা না-বললো তো না-ই! কিন্তু সে থাকে কোনখানে! সেকথা জানতে চাইলেও মুখে সে কিছুই বলে না! শুধু বাম হাতটা লম্বা করে পেছনের কোন দূরকে যেনো দেখাতে থাকে! ওটা দেখে জুলহাসে কীভাবে কী বুঝবে! কতো কতো দূরে, কতো কতো গ্রাম আছে! জুলহাস সেসব গ্রামের নামও কী জানে! জানেই না!
তবে, জুলহাসের খুব মনে হয়, এই তাদের পানিডাঙা থেকে, অই যে অনেকটা দূরের ছোটো গ্রামটাকে দেখা যায়! তার এই নয়া দোস্ত সেইখানেই থাকে! অই গ্রামের নাম দেওভোগ! পানিডাঙা আর দেওভোগের মাঝখানে আছে কেবল— ক্ষেত আর ক্ষেত। সেই ফসলী ক্ষেতরাই তো এখন পানি টুবটুবা সায়র হয়ে গেছে! নয়া দোস্তে সেই সায়রে সাঁতার দিয়ে দিয়েই জুলহাসের সাথে দেখা করতে আসে! সব সময়ই তাই তার শরীরটা এমন ভেজা থাকে! ইস!
‘তোমাগো বাইত কোষা ডিঙা নাই? তুমি ডিঙা বাইয়া আইতে পারো না?’ জুলহাসের এই কথারও কোনো উত্তর করে না সে!
আরো কী অদ্ভুত একটা কারবার যে করে! সে সাঁতরে সাঁতরে এইখানে চলে আসে ঠিক, কিন্তু কখনো সে উঠানে উঠে আসে না! আধাটা শরীর সে পানির ওপরে তোলে, আধাটা রাখে পানিতে! বানের পানিতে দুই পা ডুবিয়ে, কিনারের ভেজা মাটিতে বসে থাকে সে সর্বক্ষণ!
‘এমনে ভিজার মিদে বইয়া থাইক্কো না দোস্ত! লও, আমাগো ঘরে আহো!’ জুলহাস ডাকে।
‘নাহ! অইনে যাওনের কাম নাই! আমার শইল ভরা পেঁক! এইনেই ভালা!’ নয়া দোস্ত কিছুতেই রাজি হয় না!
তাহলে আর জুলহাসে কী করবে! একটা কোনো কথাও যদি এই নয়া দোস্তে মানতে না চায়, তাহলে আর জুলহাসে কী করবে! তার মন খুব বেজার হয়ে যায়! আবার একটু একটু গোস্বাও হতে থাকে তার! নয়া দোস্তরে এতো আপন মনে করে জুলহাস! কিন্তু নয়া দোস্তে যেনো কেমন! জুলহাসের একটা কোনো কথা সে রাখে না! একটা কোনো কথার সোজা কোনো জবাব দেয় না! আসে নিজের ইচ্ছামতো, হঠাৎ করে! চলেও যায় হঠাৎ করে! জুলহাসকে কিছু বলার ফুরসতও দেয় না!
আচমকাই পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, সাঁতার কাটা শুরু করে সে! একটাবার ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখেও না, পেছনে জুলহাসে দাঁড়ায়ে আছে, না নেই! এসেও তো জুলহাসকে কোনো একটা ডাক দেয় না! চুপ করে এসে, কখন যে সে বাড়ির কিনারের মাটিতে উঠে বসে আছে! পা দুটো সেই পানিতেই রাখা আছে! জুলহাস হয়তো তখন আছে ঘরের ভেতরে, বা হয়তো একটু গেছে মায়ের কাছে; নয়া দোস্ত কাদামাটিতে লেটকে বসে আছে তো আছেই!
নয়া দোস্তের সাথে বড়ো অদ্ভুতভাবে দেখা হয়েছিলো জুলহাসের! সেটা তখন আষাঢ় মাসের দশ বা বারো দিনের দিন! সকাল থেকে কী যে বাদলা সেদিন! পুরানো বাড়ির উঠানটা ভেজা। গাদলা গাদলা, চপচপা, পিচ্ছিল! সেদিন অমন ঢল মাথায় করে মায়ে আর দুপুরের কালে জুলহাসকে দেখতে আসতে পারেনি!
তাতে আর সমস্যা কী! জুলহাসে তো ততোদিনে হাঁসদের সামলানোর নিয়মগুলো শিখেই নিয়েছে! দুপুরে, পাতিহাঁসেরা পারতে উঠানে ফেরে না! তারা ফেরে একেবারে সেই সন্ধ্যার মুখে! সন্ধ্যা গহীন হতে থাকে একদিকে, অন্যদিকে কোন দূর থেকে যেনো হাঁসের বাচ্চাগুলোর চি চুই চি চুই আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে! বাড়ির পুবের কিনারে এসে জুলহাসেও তখন ডাকতে থাকে, ‘আহ আহ আহ! চুই চুই! আয় আয়!’
অমনিই সব কয়জন ছানাপোনা আর মা এসে পৌঁছে যায়! জুলহাসে তাদের ঘরে তুলতে তুলতেই দেখে, মায়ে এসে উঠানে খাড়া! তখন আর চিন্তা থাকে কোনো!
কিন্তু সেদিন অই থকথকা গাদলা-বাদলার দুপুরে; ঘরের ভেতরে জুলহাসে, একা বসে বসে আর কী করে! এক দৌড়ে যে সে মায়ের কাছে যাবে, তার উপায় নেই! সে তখন তার গুলতির ডাটি দুটাতে রবারের ফিতা বাঁধাবাধির কাজটা শুরু করে দেয়! পোক্ত রকমে সেখানে তার প্যাচাতে প্যাচাতে সে শোনে, ও মা! উঠানে তো চি চুই চি চুই চুই চুই আওয়াজ শোনা যায়! আরে! হাঁসেরা তাহলে আজকে দুপুরের সময়েই বাড়ি ফিরে এসেছে!
উফ! খুব ভালো তো! আজকে তাহলে এই দুপুরের কালেই সে বাড়িতে চলে যেতে পারবে! হাঁসদের গোছাতে আর কতোক্ষণই বা লাগবে! জুলহাস হাঁসগুলোকে সিজিলমিছিল করতে ছোটে! কিন্তু কী মুশকিল! হাঁসেরা কেউই ঘরের দিকে পা বাড়াতেই রাজি হয় না! তারা সব কয়জন কেবলই খুদ-কুঁড়ার খোরাটাকে ঠোকরাতে থাকে! ঠোকরাতেই থাকে!
‘বুঝছি বুঝছি! তোমাগো ভোক লাগছে! অনেক ভোক লাগছে! খাড়াও, অক্ষণ খাওন বানাইয়া দিতাছি! অক্ষণ!’ হাঁসের বাচ্চাদের এমনে-সেমনে বুঝ দিয়ে দিয়ে জুলহাসে তাদের সামনে খাবার ধরতেও দেরী করে না! ‘যেই গপগপাইয়া খায় অরা! খাওন ফুরাইতে আর কতখোন! হেইর পরেই অগো ঘরে নিমু গা!’ এইটুক কথা ভাবতে ভাবতেই জুলহাসে দেখে, আরে!
ওদের যে বিরাট খিদে পেয়েছে, সেটা তখন আর জুলহাসের বোঝার বাকি থাকে নাকি! ‘বুঝছি বুঝছি! তোমাগো ভোক লাগছে! অনেক ভোক লাগছে! খাড়াও, অক্ষণ খাওন বানাইয়া দিতাছি! অক্ষণ!’ হাঁসের বাচ্চাদের এমনে-সেমনে বুঝ দিয়ে দিয়ে জুলহাসে তাদের সামনে খাবার ধরতেও দেরী করে না! ‘যেই গপগপাইয়া খায় অরা! খাওন ফুরাইতে আর কতখোন! হেইর পরেই অগো ঘরে নিমু গা!’ এইটুক কথা ভাবতে ভাবতেই জুলহাসে দেখে, আরে! খাওয়া শেষ করে, অই যে হাঁসেরা সব কয়জন, আবার যাচ্ছে পানির দিকে! আরে! আর যায় না! আউজকা আর না! আর যাইয়ো না তোমরা!
জুলহাসের পিছুডাক, পিছু ছুট, কোনো কিচ্ছুর দিকে ফিরেও তাকায় না তারা! বরং হুড়দুড় করে করে পানিতে নেমে গিয়ে, কোন দূরের দিকে যেনো ভেসে যেতে থাকে!
সন্ধ্যার মুখে সেদিন আরো তেজী হয়ে বৃষ্টি আসে! আকাশের মেঘ কতো যে কালো! দাড়কাকের মতো ছমাছমা কালো কালো মেঘের নিচে নিচে তখন, পাতিকাকের মতো ছাইছাই কালো মেঘেরা এসে জমা হয়েই চলছিলো! আর তারা বৃষ্টি হয়ে নামছিলো। ঝুমাজ্ঝুম বৃষ্টি । ওই মেঘ আর বৃষ্টির নিচে, একা দাঁড়ায়ে থেকে থেকে জুলহাসে হাঁসদের ডেকে ডেকে কাহিল হচ্ছিলো, ‘আয় আয় আয়! আয় আয় চই চই! চুই চুই চুই!’
কোথাও কোনোদিকে হাঁসদের ফিরতি ডাক শোনা যায় না! শুধু বৃষ্টির শন শন শুধু মেঘের ঘম ঘম আওয়াজ! আর কিছু না! “হায় হায়! মায় ক্যান অহনও এইনে আইতাছে না! হাঁসে গো না-জানি কী অইছে! অরা তো জব দিতাছে না! ইসসি রে! আমি কী করমু অহন!” হাঁসদের চিন্তায় জুলহাসের শরীরটা ঝিলকি দিয়ে দিয়ে কেঁপে উঠতে থাকে! ‘এটি না মানতির হাঁস! হারানী গেলে যে সব্বনাশ অইবো! মায় না কইছে! চই চই! আয় আয়!’
হাঁসদের কোনো সাড়া পাওয়া যায় না! ‘তাইলে অখন জুলহাসে কী করবো! হাঁসেরা যে খোয়ানী গেছে, এইটা তো জুলহাসেরই দোষ! সেয় তাইলে অখন কী করবো! মায়েরে সেয় কী জব দিবো!’ আপনা থেকেই জুলহাসের চোখেরা পানি হয়ে ঝরঝরাতে শুরু করে!
তখন আচমকাই বিজলি চমকে ওঠে! মেঘও ডেকে ওঠে, ঘম ঘঙ ঘঙ ঘঙ! জুলহাস দেখে, তার সামনের কোমর সমান বানের পানিতে কে একজন জানি দাঁড়ায়ে আছে! একদম তার সমান বয়সের! কে একটা অচিন ছেলে! তার দুই হাত দিয়ে সে হাঁসের বাচ্চাগুলাকে বুকের সাথে জাবড়ে ধরে আছে! আর অই যে, মা হাঁসটা! ছেলেটার মাথার উপরে বসে আছে!
‘তোমাগো হাঁসগিলিয়ে আটকা পইড়া গেছিলো! মাছ ধরোনের লেইগা যে টেপা জাল পাতছে মাইনষে, হেই জালে আটকা পড়ছিলো! অগো হেইন তেনে ছুটাইতে দেরী হইয়া গেছে! কাইন্দো না!’ কাদের বাড়ির অই কোন অচেনা ছেলেটা জুলহাসকে বলে! তারপর জুলহাস তাকে কিছু বলার আগেই সে বলে, ‘আউজকা যাই গা! আবার আমু নে! দেইক্ষো, আমু!’
পানিতে তক্ষণ-তক্ষণ ছল্টাস করে আওয়াজ ওঠে! অই তো! ছেলেটা সাঁতার কাটার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লো!
সে কিন্তু কথা রেখেছে! রোজ সে জুলহাসকে দেখতে আসে। বাড়ির কিনারের পানি-ঘেঁসা মাটিতে লেটকা দিয়ে বসে থাকে, আর একটু একটু করে করে কাঁঠালবীচি ভাজা খায়!
একা একলা জুলহাসে এমন ছাড়াবাড়িতে পড়ে থাকে, সমস্তটা দিন পড়ে থাকে! তারে তবে কী খেতে দেয় মায়ে! ‘কিছু না-খাইতে পাইলে কেমনে ভালা থাকবো, জুলহাসে! অট্টুক ছোটো পোলাটায়!’ মায়ের মনে এমন কতো ভাবনা আসে! মা তখন যতন দিয়ে দিয়ে তাওয়ায় কাঁঠালবীচি ভাজে, নাইলে চাল ভাজে!
তারপর, এক ছুটে সেইসব দিয়ে আসে জুলহাসের সামনে! সেই খাবার জুলহাস আর কট্টুক খায়! নয়া দোস্তের হাতেই না বেশীটা দিয়ে দেয় সে! তবে, দোস্তের কথাগুলো যেনো একটু কেমন কেমন লাগে! কেমন করে করে যেনো সে কথা বলে! অমন করে কথা বলতে জুলহাসে জানেই না!
নয়া দোস্তে ভাজা কাঁঠালবীচিতে একটা করে কামড় দেয়, আর বলে; ‘ইস! গরম ভাতের খুশবু পাইতাছি! এক্কেরে হেমুন খুশবু! লাগতাছে য্যান, গরম ভাত খাই! গরম ভাত!’
তাওয়ায় টালা কাঁঠালবীচিকে গরমভাতের মতন লাগে নাকি? কেমনে! জুলহাসে কিছুই বুঝে পায় না! ‘আইচ্ছা! অরে তাইলে একদিন, দুগা ভাত খাইতে দেই যুদি?’ মনে মনে এই কথা সাব্যস্ত করে সে! আর বলে, ‘আমার লগে আমাগো বাইত যাইবা তুমি? দেখবা, মায়ে তোমারে ভাত খাইতে দিবো! গরম গরম, ভাঁপ উঠাইন্না ভাত! যাইবা?’
সে কথার কোনো জবাব না-দিয়েই নয়া দোস্তে, আচমকাই, পানিতে ঝম্প দিয়ে পড়ে। তারপর ডুব সাঁতারে কোনদিকে যে চলে যায়, হদিস পাওয়া যায় না!
মা এসে দেখে, তিন সন্ধ্যার কালে জুলহাসে কিনা কাঁঠালবীচিগুলো নিয়ে, পানির কাছে এসে বসে আছে! ‘এইটা কী কারবার রে পোলা! এমুন আজায়গায় আইয়া তুই পোড়াভাজা খাইতে বইছস! হায় হায়! যা, ঘরে যা!’ মায়ের রাগী রাগী চোখমুখ দেখে জুলহাস আর তাকে নয়া দোস্তের কথাটা বলতেই পারে না! কী জানি, আরো যদি রেগে যায় মা!
তারবাদে একদিন আষাঢ় মাসের শেষদিনটা আসে। আজকের পরে আর হাঁসদের চরাতে আনার নিয়ম নেই! কাল সকালেই ওদের নিয়ে দরবেশ হুজুরের কাছে যাবে বাবা! মানতের সকল কর্মই অতি সুন্দররকমে শেষ করা গেছে! মায়ের মনটা সেকারণে খুব ফুরফুরা!
জুলহাসের জন্য মায়ে সকালে এক খোরা চালভাজা দিয়ে গেছে। সঙ্গে দিয়েছে নারকেল কোরা! তাও দুপুরটা একটু হেলে যেতেই মায়ের মনে হয়, আজকে বরং আরো অন্য কিছুও ছেলেটাকে খেতে দিয়ে আসি! মা তখন সরষের তেল দিয়ে মুড়ি মাখায়, তাতে কাঁচা মরিচ দেয়, অল্প কয়টা চিনা বাদামও রাখে! তারপর জুলহাসের আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে!
জুলহাসের জন্য মায়ে সকালে এক খোরা চালভাজা দিয়ে গেছে। সঙ্গে দিয়েছে নারকেল কোরা! তাও দুপুরটা একটু হেলে যেতেই মায়ের মনে হয়, আজকে বরং আরো অন্য কিছুও ছেলেটাকে খেতে দিয়ে আসি! মা তখন সরষের তেল দিয়ে মুড়ি মাখায়, তাতে কাঁচা মরিচ দেয়, অল্প কয়টা চিনা বাদামও রাখে! তারপর জুলহাসের আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে! এমনিতে অন্য অন্য দিন, জুলহাস যখনতখন এই এক ছুটে মায়ের কাছে যায়; এই এক ছুটে তাদের পুরানো বাড়িতে ফিরে আসে! আজকে তার হলো কী! দুপুরের পরে একটাবারও বাড়ির দিকে পা বাড়ালো না!
মাখানো মুড়ি না নেতাপেতা হয়ে হয়ে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যাবে! কাজেই মুড়িমাখা নিয়ে মাকেই জলদি পায়ে নিজেদের পুরানো বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করতে হয়! বাড়িতে ঢোকার মুখেই আছে বেড়ার একটা দরোজা! ওই দরোজা ঠেলে, তবেই উঠানে আসা যায়!
বেড়ার সেই দরোজাটা ঠেলতে গিয়ে মায়ে দেখে, অই দেখো! আবারও ওটা কী কারবার করছে বেয়াদ্দব পুতে! মায়ের নিষেধ অমান্যি করে, আবার সেই পুব কিনারের পেক-কাদায় গিয়ে বসে আছে ছেলে! আবার দেখো! একা একলাই যেনো কথাও বলছে সে!
কী বলে? কী বলে জুলহাস!
‘দোস্ত, দেহো দেহো! চাইল ভাজাটি খাইতে কতো মজা! এটিরেও কী তোমার কাছে গরম ভাতের মোতন লাগতাছে? এটিও গরম ভাত?’
কিন্তু নয়া দোস্তের মুখের কথাটা আর জুলহাসে শুনতে পায় না! বরং তার মায়ের কান্নার দমগম আওয়াজটা এসে জাবড়ে ধরে তাকে!
জুলহাসকে একা একা কথা বলতে দেখে কী, মায়ের পরান ডরে ছাঁৎ করে না-উঠে পারে! ‘মাবুদ গো! একলা থাকতে থাকতে আমার পোলার নি মাথায় দোষ পইড়া গেলো!’ ধড়ফড়াতে থাকা পরানটা নিয়ে মায়ে জুলহাসের দিকে ছুট লাগায়! ‘অই পোলা! অই! তুই আবার এইনে আইয়া ভাজাপোড়া খাইতাছস! নিষেধ দিছি না তরে? নিষেধ দিছি না?’ মায়ে জুলহাসকে জাবড়ে ধরে হাউমাউ কাঁদন কাঁদতে থাকে!
তখন, পানিতে নিত্যির মতো ছল্টাস করে আওয়াজটা উঠেছিলো কিনা, জুলহাস জানে না!
[লেখকের নিজস্ব বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।]
বাংলা ভাষার একজন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। আকিমুন রহমানের গ্রন্থসমূহ হলো : ‘আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ (১৯২০-৫০)’, ‘সোনার খড়কুটো’, ‘বিবি থেকে বেগম’, ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’, ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’, ‘এইসব নিভৃত কুহক’, ‘জীবনের রৌদ্রে উড়েছিলো কয়েকটি ধূলিকণা’, ‘পাশে শুধু ছায়া ছিলো’, ‘জীবনের পুরোনো বৃত্তান্ত’, ‘নিরন্তর পুরুষভাবনা’, ‘যখন ঘাসেরা আমার চেয়ে বড়ো’, ‘পৌরাণিক পুরুষ’, ‘বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার দলিল (১৩১৮-১৩৫০ বঙ্গাব্দ)’, ‘অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী’, ‘একদিন একটি বুনোপ্রেম ফুটেছিলো’, ‘জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ’, এবং ‘নিরুদ্দেশের লুপ্তগন্ধা নদী’।
আকিমুন রহমান ভালোবাসেন গন্ধরাজ আর বেলীফুল আর হিজলের ওড়াভাসা! আর তত্ত্বের পথ পরিক্রমণ! আর ফিকশন! ঊনবিংশ শতকের ইউরোপের সকল এলাকার গল্পগাঁথা আর এমিল জোলার কথা-বৈভব! দূর পুরান-দুনিয়ায় বসতের সাথে সাথে তিনি আছেন রোজকার ধূলি ও দংশনে; আশা ও নিরাশায়!