অফিসের কাজে ভীষণ ব্যস্ত। নিশ্বাস ফেলার সময় পাচ্ছি না। এমন সময় অচেনা নম্বর থেকে কল। পাশেরজনের কথা বিবেচনায় রেখে সব সময় রিংটোন অফ রাখি। ভাইব্রেশন হচ্ছে। রিসিভ করছি না। আবার কল। তবু ধরছি না। এবার মোবাইল সাইলেন্ট মুডে রাখি। কল বন্ধ নেই। বিরতিহীনভাবে আসছে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে প্রশ্ন— কল ধরছেন না কেন? আপনার সমস্যাটা কী?
নারীকণ্ঠ শুনে চমকে উঠি। কোনো ছেলে এভাবে ফোন দিয়ে এমন প্রশ্ন যদি করত, নির্ঘাত ঝাড়ি দিতাম। শত হলেও আমি তো পুরুষ।
মনে কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দেয় তৎক্ষণাৎ। মেয়েটি কি আমার পূর্বপরিচিত? যদিও মেয়ে না মহিলা, বুঝতে পারছি না। এমন কণ্ঠস্বর কখনো শুনিনি। কেন জানি মনে হলো, মেয়েটি সুন্দরী হবে। রেগে গেলে সুন্দরী মেয়েদের কণ্ঠস্বর এমন শোনায়।
মনে কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দেয় তৎক্ষণাৎ। মেয়েটি কি আমার পূর্বপরিচিত? যদিও মেয়ে না মহিলা, বুঝতে পারছি না। এমন কণ্ঠস্বর কখনো শুনিনি। কেন জানি মনে হলো, মেয়েটি সুন্দরী হবে। রেগে গেলে সুন্দরী মেয়েদের কণ্ঠস্বর এমন শোনায়।
পুলিশ নয় তো! আজকাল অনেক মেয়ে পুলিশে চাকরি করে। কেউ আবার আমাকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা করছে নাকি! কেন ফোন করল অচেনা সুন্দরী!
মুহূর্তের মধ্যে সাতপাঁচ অনেক কিছু ভেবে ফেললাম। একটু ভয়ও পাচ্ছি। ঘাবড়ে গেলেও একটু সাহস সঞ্চয় করে পাল্টা প্রশ্ন করি— কে আপনি? কাকে চাচ্ছেন?
আমি আপনাকে চাচ্ছি। মেয়েটির কণ্ঠস্বর তীব্র শোনায় আমার কানে।
আমার মনে হয়, আপনি কোথাও ভুল করছেন। কার কাছে ফোন দিয়েছেন স্পষ্ট করে তার নাম বলুন। নইলে লাইন কেটে দেব। একটু সাহসী হলাম আমি।
আমি নিশ্চিত হয়েই আপনোকেই ফোন করেছি। অনেক কষ্ট করে আপনার ফোন নম্বর জোগাড় করেছি। মেয়েটির নিশ্চিন্ত গলার আওয়াজ।
এবার আমার গায়ে ঘাম দেওয়া শুরু হয়। কী করেছি আবার! কেউ কি আমাকে বিপদে ফেলার চক্রান্ত করছে! মেয়েটিকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে না তো। এমন বিভিন্ন রকম ভাবনা মাথায় আসে।
আপনি কে বলছেন, প্লিজ? নামটা বলুন। অনুনয় আমার কণ্ঠে।
আমি যে হই না কেন, আপনি আমার জীবন নিয়ে গল্প লিখেছেন কেন? আপনাকে কে বলেছে আমার জীবনকাহিনি।
মানে? আমার কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময়।
আপনি এবারের ঈদে ‘শ্রী’তে আমাকে নিয়ে গল্প লেখেননি? পরে সেই গল্পটি আবার ফেসবুকে পোস্ট করেননি?
হায়, গল্পটির কথা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কত গল্প লিখি। সেসব কত পত্রিকায় ছাপা হয়। কোন পত্রিকায় কোনটা লিখেছি, পরে মনেও থাকে না। এই ঈদে তো প্রায় পাঁচটি পত্রিকা ও লিটল ম্যাগে গল্প লিখেছি। ভাবতে লাগলাম, ‘শ্রী’তে কোন গল্পটি লিখেছি!
এতক্ষণে আমি বাস্তব জগতে ফিরে আসি। হায়, গল্পটির কথা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কত গল্প লিখি। সেসব কত পত্রিকায় ছাপা হয়। কোন পত্রিকায় কোনটা লিখেছি, পরে মনেও থাকে না। এই ঈদে তো প্রায় পাঁচটি পত্রিকা ও লিটল ম্যাগে গল্প লিখেছি। ভাবতে লাগলাম, ‘শ্রী’তে কোন গল্পটি লিখেছি!
কাকে নিয়ে লিখেছেন গল্পটি? প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়ে কণ্ঠস্বরে। তার ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরে আমার সম্বিৎ ফিরে আসে।
ও। এটা তো আমার এক বান্ধবীকে নিয়ে; তবে গল্পের সত্তর ভাগই আমার বানানো। ভার্সিটিতে পড়ার সময় আমাদের ক্লাসে ‘সারা’ নামে এক সুন্দরী মেয়ে ছিল। সে কোনো ছেলের সঙ্গে কথা বলত না। পরে লন্ডনে গিয়ে সে পুরোপুরি পাল্টে যায়। মানিক নামের আমাদের এক বন্ধু তার কাহিনি আমাকে বলেছিল।
বিশ্বাস করি না আপনার কথা। আপনি আস্ত একটা মিথ্যুক। সত্যি করে বলুন, আমার কথা আপনাকে কে বলেছে? মেয়েটির কথাগুলো বেশ ঝাঁঝালো শোনায় আমার কানে।
এদিকে পাশের ডেস্কে বসে কাজ করছে সহকর্মী সৌরভ। আমি নিশ্চিত সে আমাদের কথোপকথন শুনছে। সেই কথা ভেবে অনুরোধ করি, বাসায় গিয়ে আপনাকে আমি রাতে কল দেব।
কেন? এখন কথা বলতে অসুবিধা কোথায়? মেয়েটি সরাসরি প্রশ্ন করে।
আমি এখন অফিসে। কাজের অনেক চাপ। তাই বেশি কথা বলা যাচ্ছে না। এখন রাখছি। খুব চাপা স্বরে আমি বলি যেন সৌরভ বুঝতে না পারে।
অপর প্রান্ত আমার কথা কিছুতেই শুনতে রাজি নয়। একদম নাছোড়বান্দা দেখছি। উপায়ান্তর না পেয়ে কল কেটে মোবাইলের সুইস অফ করে দিই।
টেবিলের ওপর অনেকগুলো ফাইল পড়ে আছে। আজকের মধ্যে সব চেক করতে হবে। আগামীকাল জমা দিতে হবে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট। একটি ফাইল খুলে পড়ার চেষ্টা করি; কিন্তু মন বসাতে পারি না। অস্বস্তির মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ছে। মনের মধ্যে কী যেন খচখচ করে।
মাত্র তিনটা বাজে। অফিস ছুটি হবে পাঁচটায়। কী করব ভেবে পাই না। সৌরভ আমার উদ্বেগ টের পেয়ে বলে— চলেন দাদা, নিচে থেকে একটু ঘুরে আসি। মনে হচ্ছে আপনি খুব টেনশন করছেন। ঘুরে আসলে চাপ কমতে পারে।
সহকর্মী হলেও সৌরভ আমার খুব কাছের মানুষ। বন্ধুর মতো। ভার্সিটিতে ও আমার ডিপার্টমেন্টে পড়ত। সে হিসেবেও জুনিয়র। আমার সঙ্গে ওর রসায়ন বেশ ভালো। ওর কথায় সায় দিয়ে বলি— চলো তাহলে। চা-কফি কিছু খেয়ে একটু হেঁটে আসি।
নামতে নামতে সৌরভ আমাকে প্রশ্ন করে— দাদা, কে ফোন দিয়েছে? কোনো সমস্যা হয়নি তো? ফোন পাওয়ার পর আপনার চেহারা এমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল কেন?
দ্বিধা না করে ওকে গল্পটির কথা বলি। গল্পের সঙ্গে এই ফোনের সম্পৃক্ততাবিষয়ক কথাটিও সংক্ষেপে শেয়ার করি।
অবাক হয়ে সৌরভ বলে— গল্পটা তো আমি পড়েছি। আমার স্ত্রীও পড়েছে। দারুণ লিখেছেন। আপনাকে প্রশ্ন করব ভেবেও করা হয়নি পাছে আপনি কিছু মনে করেন। এটা কি আসলে সত্য ঘটনা? আমার তো মনে হয় শতভাগ সত্য।
উত্তর না দিয়ে মনে মনে হাসি। সৌরভ গল্পটির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলাপে মেতে ওঠে। ধীরে ধীরে আমি কিছুটা স্বাভাবিক হই। একপর্যায়ে সৌরভ বলে, আপনার অনেক গল্প পড়লেও এমন ধাঁচের গল্প আর কখনো পড়িনি। বিশেষত যেভাবে শেষ করেছেন। পড়া শেষে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। প্রায় এক ঘণ্টা কিছু ভাবতে পারিনি। সেই সঙ্গে মনের মধ্যে জন্ম নিতে থাকে অনেকগুলো প্রশ্ন। আমি যদি গল্প লিখতে জানতাম, গল্পটির শেষ থেকে লিখে ফেলতাম আরেকটি গল্প।
ওর কথায় সায় দিয়ে বলি— জানো, অনেক পাঠক গল্পটির পরবর্তী পর্ব লিখতে অনুরোধ করছে। কয়েকজনকে কথা দিয়ে বলেছি, চেষ্টা করে দেখব। জানি না পারব কি না।
সৌরভকে কফি খেতে খেতে বলি— এই প্রসঙ্গ এবার বাদ দাও। ভালো লাগছে না আর। অফিসের বিষয় বা অন্য কোনো কিছু নিয়ে কথা বলো।
সৌরভ ম্যানেজার আনোয়ার সাহেবের পরকীয়া প্রেমের কথা বলে আমাকে হাসানোর চেষ্টা করে; কিন্তু আমি ওর কথায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিতে ব্যর্থ হই। তবু জোর করে মুখে হাসি ফোটাই। কিছুতেই সেই ফোনের কথা মাথা থেকে নামাতে পারছি না। আমার সঙ্গে এভাবে কেউ কখনো কথা বলেনি। বারবার মনে হচ্ছে, গল্পটা যেখানে শেষ হয়ে গেল, সেখান থেকে আবার শুরু হতে যাচ্ছে নতুন কোনো গল্প।
গল্পের পরও গল্প থাকে। একটি গল্প জন্ম দিতে পারে আরেকটি গল্পের। কিংবা এক গল্পের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকে অন্য গল্পের বীজ।
০২.
বাসায় ফিরেও মোবাইলের সুইস অন করি না। কুঁকড়ে থাকি। আমার লেখা পড়ে অনেকে সাহসী ভাবলেও আমি আসলে ভিতু। রাতে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতে হয়। ভূতের ভয় আমার তীব্র। তেলাপোকাকে ভয় পাই। বসের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি না। শোভা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে বিয়ের তিন মাস পরে; ভিতুর সঙ্গে সংসার করবে না বলে। এত দিনে একা একা থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। নিঃসঙ্গতাই আমার সঙ্গী।
লাবণ্য দাশ হয়তো সংসার ছেড়ে যাননি, তবে কবিকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। কেবল কবির নির্লিপ্ততার জন্য। এ যুগের মেয়ে বলে শোভা সব ছেড়ে যেতে পেরেছিল। হয়তো এখন সে অনেক ভালো আছে। শোভাও আমার মনে উঁকি দিচ্ছে।
চাকরির বাইরে বাকি সময়টুকু লেখালেখি আর বই নিয়ে পড়ে থাকি। আমার চলাফেরা অনেকটা কবি জীবনানন্দ দাশের মতো। লাবণ্য দাশ হয়তো সংসার ছেড়ে যাননি, তবে কবিকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। কেবল কবির নির্লিপ্ততার জন্য। এ যুগের মেয়ে বলে শোভা সব ছেড়ে যেতে পেরেছিল। হয়তো এখন সে অনেক ভালো আছে। শোভাও আমার মনে উঁকি দিচ্ছে। শোভা আবার কাউকে দিয়ে ফোনটি করায়নি তো!
সত্যি বলতে কি, ভয়ের কারণে কখনো প্রেম করতে পারিনি। ফিরিয়ে দিয়েছিলাম কিশোরী প্রেমিকা অর্পিতাকে। ভার্সিটিতে চুমকি নামের একটি মেয়ে চার বছর আমার পেছনে লেগে ছিল। শেষ পর্যন্ত সাড়া না পেয়ে ও ধুম করে বিয়ে করে ফেলে মা-বাবার পছন্দের পাত্রকে। ছোটোবেলা থেকে ভয় আমাকে সব সময় বেঁধে রাখত। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে খোলস থেকে বের করতে পারিনি। জগতের জটিল বিষয়ের প্রতি মনোসংযোগ করতে ব্যর্থ হয়েছি সব সময়।
চুমকির কথা মনে হলে এখনো অপরাধবোধ জাগে, ওর প্রতি আমি অবিচার করেছি। বন্ধুদের কাছে শুনেছি, চুমকি বিসিএস দিয়ে পুলিশে যোগ দিয়েছিল। এদিকে আমি হয়েছি সরকারি অফিসের এক কেরানি। তবে নিজেকে অসুখী ভাবি না। সাহিত্যচর্চা আর চাকরি নিয়ে মেতে আছি। আর কোনোদিকে আমার খেয়াল নেই। সব সময় ডুবে আছি নিজের মধ্যে।
হঠাৎ অযাচিত উপদ্রবের আভাস পাচ্ছি। কেন জানি মনে হচ্ছে, আমার শান্তি শেষ করে দেবে এই মেয়ে। চুমকির কথাও মনে ভাসছে। এই ফোনটা চুমকির নয় তো! ওর সঙ্গে আমি কখনো ফোনে কথা বলিনি। তাই ফোনে ওর কণ্ঠস্বরের সঙ্গেও পরিচিত নই।
ভয়ে ভয়ে মোবাইলের সুইস অন করতেই খুদেবার্তার ঝড়। রীতিমতো হুমকি। তিনটা বার্তা পড়তে না পড়তেই কল। ওই নম্বর থেকে। পরপর তিনবার দেওয়ার পর কল রিসিভ করি। সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়ি— ফোন বন্ধ রেখেছেন কেন? আপনার দেখছি আক্কেল জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব। মেয়েদের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই?
না। যা ভাবছেন তা নয়। অফিসে কাজের অনেক চাপ ছিল। কিছু মনে করবেন না। এইমাত্র বাসায় এলাম। এবার বলুন কী বলতে চান। কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব নিরাবেগ রাখার চেষ্টা করি।
গল্পটি তো আমার। একটুও এদিক-ওদিক হয়নি। একশভাগ মিলে গেছে। আপনি জানলেন কী করে? প্রশ্ন ছুড়ে দেয় মেয়েটি।
আমি একদম হতভম্ব। কী বলে মেয়েটা? কোনো ভণিতা ছাড়া বলি, গল্পের বেশির ভাগই আমার কল্পনা। সত্যি বলছি, আমার সহপাঠী এক মেয়ের জীবনের কিছু অংশ আমি তার মধ্যে আরোপ করেছি মাত্র।
না। আমি বিশ্বাস করি না। মেয়েটি খুব উচ্চ স্বরে বলে। অনেকটা চিৎকারের মতো শোনায়।
কোনো কূলকিনারা না পেয়ে বলি— আচ্ছা, মানলাম আপনার সব কথা। তো আমি এখন কী করব? সেটা বলুন।
আপনাকে তেমন কিছু করতে হবে না। শুধু আমার সঙ্গে একবার দেখা করবেন।
কীভাবে? কোথায়?
আমার বাসায়। মেয়েটা বলে।
আপনার বাসায় কে কে আছে? আমি জানতে চাই।
আমি এখন একা থাকি। হাজবেন্ডের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে।
ওনার নাম কী? জানতে চাই আমি।
তার নাম ছিল অপূর্ব। সে আমার সহপাঠী ছিল।
আর আপনার প্রাক্তন প্রেমিক কি শিমুল নামের কেউ? সে কি ডাক্তার ছিল? প্রশ্ন করি আমি।
একদম।
আমি তো পুরাই তাজ্জব। কী বলব, ভাষা খুঁজে পাই না। কীভাবে এই দজ্জাল মেয়ের হাত থেকে বাঁচব! একটু অনুনয় করে বলি— রাত অনেক হয়ে গেছে। আমার অফিস আছে আগামীকাল। রাত জাগলে দিনে কোনো কাজ করতে পারি না। এবার ফোনটা রাখি।
প্রশ্নই আসে না। আপনাকে বলতে হবে। তবে ফোন রাখতে পারি এক শর্তে।
কী শর্ত? জানতে চাই আমি।
আগামীকাল আপনাকে আমার বন্ধুর বাসায় আসতে হবে।
শর্তের কথা শুনে মনে মনে আরও ভয় পাই। আজকাল কত ধরনের ঘটনা ঘটছে। যদি ব্ল্যাকমেইল করে। আটকে রেখে মুক্তিপণ চায়। অগত্যা ছাড়া পাওয়ার জন্য সান্ত্বনার সুরে বলি— ঠিক আছে। কখন আসব?
আগামীকাল সন্ধ্যা সাতটায়। ধানমণ্ডি চারের একুশ নম্বর বাড়ির ফ্ল্যাট নাম্বার…। আচ্ছা, ঠিকানাটা টেক্সট করে দিচ্ছি। আসছেন তো?
আসছি। দেখা হবে।
০৩.
রাতে দুই চোখের পাতা এক করতে পারি না। বারবার নিজেকে ধিক্কার দিই, কেন এমন গল্প লিখতে গেলাম। আবার ভাবি, গল্প লিখে আমার মতো এমন বিপদে কোনো লেখক কি কোনোকালে পড়েছে!
জীবনে একটা প্রেম করতে পারলাম না। স্ত্রীকেও ধরে রাখতে পারিনি। লেখা ছাড়া তো আর কোনো যোগ্যতাও আমার নেই। আস্ত একটা অথর্বের জীবন পার করে দিচ্ছি।
এপাশ-ওপাশ করতে করতে নানা বিষয়ের সঙ্গে গল্পটার বিভিন্ন দিক নিয়েও ভাবি। আবার কল্পনা করি, মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে গেলে কী বলব! কীভাবে রক্ষা পাব তার খপ্পর থেকে! গল্প লিখলেও আমি তো কথার পিঠে কথা বলতে পারি না।
কখন ভোর হয়েছে, টের পাইনি। নিচে নেমে ভোরের নরম আলোয় জোরে জোরে হাঁটি। আমি হাই প্রেশারের রোগী। হার্টেও একটু সমস্যা আছে। টেনশন করলে সমস্যা বেড়ে যায়। হাঁটলে অনেকটা উপশম হবে মনে করে রমনা পার্কে কয়েক চক্কর দিই।
কখন ভোর হয়েছে, টের পাইনি। নিচে নেমে ভোরের নরম আলোয় জোরে জোরে হাঁটি। আমি হাই প্রেশারের রোগী। হার্টেও একটু সমস্যা আছে। টেনশন করলে সমস্যা বেড়ে যায়। হাঁটলে অনেকটা উপশম হবে মনে করে রমনা পার্কে কয়েক চক্কর দিই। পার্কের বেঞ্চেও কিছুক্ষণ বসে বসে ভাবি।
প্রায় দেড় ঘণ্টা পর বাসায় ফিরি। পেটে প্রচণ্ড খিদে অনুভব করছি। মনে পড়ে, কাল রাতে কিছু খাইনি। অথচ কিছু মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না। কফি বানিয়ে খেতে খেতে ফেসবুকে চোখ বুলাই। একজন পাঠক ওই গল্পটি নিয়ে বড়ো একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে। সামান্য সমালোচনা করলেও বেশির ভাগই প্রশংসা। অন্য সময় হলে মনটা ভরে যেত। ধন্যবাদ দিতাম। ভালোবাসা জানাতাম। এখন বিরক্ত লাগছে। ফোনটা টেবিলের ওপর ছুড়ে ফেলি। রাগ হচ্ছে গল্পটির ওপর। আমার আজকের সমস্যার মূল তো এই গল্প। মুখে একটা তেতো ভাব অনুভব করি। কী করতে পারি!
কোনো বন্ধুকে ফোন দিয়ে সহযোগিতা নেব কি না, ভাবি। পরক্ষণে ভাবনাটা উড়িয়ে দিই। কাউকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। গল্প লিখে বিপদে পড়ার কথা শুনলে সবাই হাসবে। আমাকে নিয়ে ইয়ার্কি করবে। হয়তো বলবে, মেরুদণ্ডহীন লেখক।
০৪.
অফিস আমার বাসার কাছে। হেঁটে যেতে পাঁচ মিনিট লাগে। লেখালেখিতে সময় দেব বলে অফিসের কাছে বাসা নিয়েছি। অফিস শেষে কোনো দিকে যাই না। সোজা বাসায়। লেখকমহলেও আমার তেমন সার্কেল নেই। মুখচোরা স্বভাবের বলে সবাই আমাকে এড়িয়ে চলে। এতে বরং আমার বেশ সুবিধা হয়েছে। আড্ডা দিই না বলে অনেক সময় বেঁচে যায়। মিসরীয় লেখক নাগিব মাহফুজের সঙ্গে আমার অদ্ভুত মিল। ঘড়ি ধরে সব কাজ করা।
অফিসে এসে দেখি, কেউ নেই। ঘড়িতে মাত্র আটটা। এত তাড়াতাড়ি আসার জন্য জিব কাটি। ভয়ে আর উত্তেজনায় আমি যেন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য।
গতকালের ফাইলগুলো নিয়ে বসি। মনোযোগের অভাবে কাজে ভুল করি। একই লাইন বারবার পড়তে হয়। দিনের শুরু বসের বকাঝকা দিয়ে। ভুল না করে করব কী! মাথায় তো ঘুরছে কেবল আজকের সন্ধ্যার সম্ভাব্য পরিস্থিতি। কীভাবে সামাল দেব!
শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে দুপুরে বাসায় চলে আসি। সামান্য ভাত মুখে দিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করি। কিছুতেই ঘুম আসে না। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাই।
সেগুনবাগিচা থেকে ধানমণ্ডি যেতে দুই ঘণ্টা তো লাগবে। রাস্তায় যে জ্যাম। যদি দেরি হয়ে যায়। তখন তো কথা শোনাবে। এ রকম ভাবতেই ফোন, আপনি রওনা হয়েছেন তো?
ভয়ে ভয়ে বলি, আমি পথে আছি।
সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়ি— এত মিথ্যা বলেন কীভাবে? আপনি তো এখনো বাসা থেকেই বের হননি। বের হলে গাড়ির আওয়াজ শোনা যেত।
না। মানে বের হচ্ছি আর কি। আমতা আমতা করে বলি আমি।
তাড়াতাড়ি বের হন। আমার সাতটা মানে ঠিক সাতটা। এক মিনিট দেরি হলেও সহ্য করব না। কাটা কাটা কথা মেয়েটার।
প্লিজ আমার কথা শুনুন। আজ না এলে হয় না। পরে কোনো সময় দেখা করব। খুব নরম সুরে কাঁদো কাঁদো গলায় আমি বলি।
আমার কথা পুরোটা শুনেওনি। অপর প্রান্ত লাইন কেটে দেয় তড়িৎ গতিতে।
এই মেয়ে আসলে কে? কেন আমার পেছনে লেগেছে? থানায় যাব নাকি। মোবাইল নম্বরটি পুলিশকে দিয়ে জিডি করলে কেমন হয়। বলব, গল্প লেখার জন্য এক মেয়ে আমাকে হুমকি দিচ্ছে এই নম্বর থেকে। আবার ভাবি, পুলিশ শুনলে নিশ্চিত হাসবে।
এমন কণ্ঠে অনুরোধ করলে পাষাণেরও হৃদয় গলে। এই মেয়ে আসলে কে? কেন আমার পেছনে লেগেছে? থানায় যাব নাকি। মোবাইল নম্বরটি পুলিশকে দিয়ে জিডি করলে কেমন হয়। বলব, গল্প লেখার জন্য এক মেয়ে আমাকে হুমকি দিচ্ছে এই নম্বর থেকে। আবার ভাবি, পুলিশ শুনলে নিশ্চিত হাসবে। বলবে, এত ভিতু হলে লেখেন কেন। লেখা বাদ দিয়ে অন্য কাজ করেন। গান করুন। গিটার বাজান। নাটক করেন। নাচেন। কুদেন। যা খুশি তা করেন। লিখতে হলে মেরুদণ্ড সোজা রাখতে হয়।
০৫.
ধানমণ্ডি এলাকাটা আমার মোটামুটি চেনা। তিন নম্বর রোডে একটা সময় অনেক আসতাম। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। তখন ফরাসি ভাষা শেখার নেশা চেপেছিল। সতীনাথ ভাদুড়ি আমার প্রিয় লেখক। কমলকুমার মজুমদারও। তাঁরা দুজনেই ফরাসি সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। তাঁরাই আমার ফরাসি শেখার প্রেরণা। মূল ভাষায় ফরাসি সাহিত্য পড়ব এই আশায় ভর্তি হয়েছিলাম আলিয়ঁসে। বছরখানেকের মতো শিখেছিলাম। এত কঠিন ভাষা কেউ শেখে! এমন দুর্বোধ্য আর বিদঘুটে! অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দিই।
না শিখতে পারলেও আমার ফরাসি প্রেমটা কিন্তু উবে যায়নি। মনে মনে তখন বলতাম, কোনো ফরাসি রমণী আমার প্রেমে পড়লে আমি নিশ্চিত আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসতাম। হায়, সেই ভাগ্য আমার কপালে জোটেনি। হয়তো সেই আশায় ক্যাফেতে বসে থাকতাম। একা একা কফি খেতাম। তা ছাড়া ক্যাফেতে সময় কাটাতে আমার খুব ভালো লাগত।
সেই পরিচিত স্থানে বসে পরপর দুই কাপ কফি খাই। পাশে একটি ছোটো মেয়ে পিয়ানো বাজানো শিখছে। পাশের গ্যালারিতে চলছে ছবি প্রদর্শনী। আমাকে এসবের কিছুই টানছে না। পুরোনো দিনের কথা মনে করার চেষ্টা করি। সে যেন গত জন্মের ব্যাপার। তখন লেখালেখি করতাম না; কেবল পড়তাম। নির্বিঘ্ন ছিল দিন। পাঠকের নিরুপদ্রব ভূমিতে ইচ্ছেমতো বিচরণ করতাম। লেখক হয়ে এখন কত জ্বালা!
ঘড়িতে প্রায় সাড়ে ছয়টা। ভাবি, মেয়েটিকে অনুরোধ করে বলি এই ক্যাফেতে চলে আসেন; এখানেই আমরা প্রাণ খুলে আড্ডা দেব। এখান থেকে ওই বাড়িটি তো মাত্র দুই মিনিটের পথ। এই কথা ভেবে ওই নম্বরে কল দিই। একবার দুবার তিনবার।
রিং হচ্ছে। কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না।
আবার কল দিতে বুঝতে পারি নম্বরটি বন্ধ।
তারপর যতবার কল দিই একই কথা আমার কানে আসে। এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
মেয়েটি মনে হয় ইচ্ছে করে মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে, যদি আমি কল দিয়ে অপারগতা প্রকাশ করি। আবার ভাবি, না গেলে যদি সাতটার পর আমাকে কল দিয়ে তুলোধুনো শুরু করে। আতঙ্ক গ্রাস করে আমাকে। আরও দশ মিনিট সময় হাতে আছে।
অগত্যা ধীরে ধীরে হেঁটে বাড়িটির দিকে এগিয়ে যাই। বুকের ভেতর দুরুদুরু করছে। কী হবে কে জানে! নির্ধারিত ফ্ল্যাটে উঠে কলিং বেল চাপি। কেউ দরজা খোলে না। একবার। দুইবার। তিনবার। এভাবে প্রায় দশ মিনিট কেটে যায়।
অগত্যা ধীরে ধীরে হেঁটে বাড়িটির দিকে এগিয়ে যাই। বুকের ভেতর দুরুদুরু করছে। কী হবে কে জানে! নির্ধারিত ফ্ল্যাটে উঠে কলিং বেল চাপি। কেউ দরজা খোলে না। একবার। দুইবার। তিনবার। এভাবে প্রায় দশ মিনিট কেটে যায়।
ফেরার জন্য লিফটের দিকে এগোতেই দরজাটা ঠাস করে খুলে গেল। চোখ ফিরিয়ে দেখি এক বৃদ্ধা। বয়স কম করে হলেও সত্তর হবে; তবে বয়সের তুলনায় বেশ শক্ত। জানতে চান— কে আপনি? কার কাছে এসেছেন?
একটু অপ্রস্তুত হয়ে যাই আমি— এখানে কি স্নিগ্ধা থাকে? ওনাকে একটু ডেকে দিন। উনি আমাকে আসতে বলেছেন।
বৃদ্ধা যেন আকাশ থেকে পড়েন— এখানে তো স্নিগ্ধা নামে কেউ থাকে না।
জন্ম ১৯৭৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ফেনীর পরশুরাম উপজেলার কোলাপাড়া গ্রামে। বসবাস ঢাকায়। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: ‘দিব্যপুরুষ’ (উপন্যাস), ‘হরিশংকরের বাড়ি’ (গল্প), ‘বাংলা দেশে বাঙালির দেশে’ (ভ্রমণকাহিনি)। প্রধান সম্পাদক : সম্প্রীতি সাহিত্য পত্রিকা।