কবিতা, প্রবন্ধ ও অনুবাদ— সাহিত্যের এই তিনটি শাখায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত কারুকার্যময় যে সৌধ নির্মাণ করেছেন, তার তুলনা বুদ্ধদেব বসু ছাড়া আর কারোর সঙ্গে হতে পারে কি না সন্দেহ। ভাবুকতার মৌলিক দীপ্তি আর বিষয়ের বিস্তারে তাঁর প্রবন্ধ বুদ্ধদেব বসুর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আর অনুবাদে মূলানুগতার প্রশ্নে তিনি আদর্শতম জায়গায় অবস্থান করছেন। কবিতায় তিনি পৃথিবীর সেই সব প্রধান কবিদের গোত্রভুক্ত, যাঁরা ঐতিহ্যকে শিল্পিত নবায়নে ভবিষ্যৎমুখী করে দিয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু একবার আপাত-অলঙ্ঘ্য এক নির্দেশিকার পতাকা উড়িয়ে এই বার্তা দিয়েছিলেন যে— ‘ইংরেজি যেমন আমাদের পক্ষে বিশ্বচেতনার মান্য প্রণালী, আমাদের ভাষাজ্ঞানের ভিত্তি তেমনি সংস্কৃত: এ দুয়ের রাজযোটক ঘটাতে পারলে, তবেই সম্ভব আধুনিক বঙ্গভাষায় নির্বস্তুক ভাবের যথোচিত অভিব্যক্তি।’ (আধুনিক কবিতার ইতিহাস, সম্পাদনা: অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১৬, পৃ-২৯৩) অলোকরঞ্জন তাঁর বর্ণিল প্রতিভাবলে বুদ্ধদেব-কথিত সেই সীমানা পেরিয়ে নিজের ‘অভিব্যক্তি’কে ত্রিভাষিক সংযোগ ও অভিজ্ঞতার রসায়নে বিস্তৃত ও প্রগাঢ় করেছেন। জার্মান ভাষায় প্রবেশাধিকার তাকে দিয়েছে ‘বিশ্বচেতনার মান্য প্রণালী’ পুনর্বিন্যাসের সুযোগ, কিন্তু তা দ্বিভাষিক নয়, ত্রিভাষিক ‘রাজযোটক’-এর ফলে। এই ভাষিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগ তাঁকে কেবল মনে ও মননে বিশ্ববিহারীই করে তোলেনি, দেশ বলতে ‘ধরিত্রীকে… অঙ্গীকার’-এর সিদ্ধান্তও প্রজ্বলিত করেছে তাঁর মনঃকোকনদে। ‘ধরিত্রীর নীবিবন্ধে’ নিজেকে যোজন করে তিনি শামুকের মতো ‘প্রেমের চোখে’ তাকিয়েছেন বস্তুপুঞ্জ থেকে শুরু করে বিমূর্ত বিষয়ের দিকে; দৃশ্য ও অদৃশ্য প্রপঞ্চে মাখা জীবনের পূর্ণ অবয়বে। শব্দকে তিনি সাঙ্গীতিক স্বাচ্ছন্দ্যে গাহন করাতে গিয়ে এমন ছন্দস্পন্দন সৃষ্টি করেন, যার অনুরণন পাঠকের শ্রুতিকে তৃপ্ত করে শব্দাতিরিক্ত ব্যঞ্জনায়। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে-র গদ্যের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে গিয়ে নিজেই একবার বলেছিলেন, ‘সংস্কৃত ভাষার অন্তর্লীন পৌরুষের ঐশ্বর্যকে’ উন্মোচনের কথা। কিন্তু এই কথাটিই যে একসময় তাঁরই ক্ষেত্রে আরও বেশি যথার্থ হয়ে উঠবে তা হয়তো তিনি কখনো ভাবেননি। তবে না ভাবলেও লেখকের মনোরসায়নই এমন-যে অন্যের সম্পর্কে বলতে গিয়ে কখনো কখনো অজান্তে নিজেরই কোনো কোনো বৈশিষ্ট্যের গোপন সূত্রগুলো বিছিয়ে রাখেন শব্দের ভূমণ্ডলে। ফলে তাঁর রচনায় বিলি কাটলেই আমরা পেয়ে যাই উদ্দীপক অনেক আভাস, যা তাঁর নিজের সৃষ্টিশীলতার আপাত-খামখেয়ালের অন্দরমহলে প্রবেশের চাবি হয়ে উঠবে।
শব্দকে তিনি সাঙ্গীতিক স্বাচ্ছন্দ্যে গাহন করাতে গিয়ে এমন ছন্দস্পন্দন সৃষ্টি করেন, যার অনুরণন পাঠকের শ্রুতিকে তৃপ্ত করে শব্দাতিরিক্ত ব্যঞ্জনায়। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে-র গদ্যের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে গিয়ে নিজেই একবার বলেছিলেন, ‘সংস্কৃত ভাষার অন্তর্লীন পৌরুষের ঐশ্বর্যকে’ উন্মোচনের কথা। কিন্তু এই কথাটিই যে একসময় তাঁরই ক্ষেত্রে আরও বেশি যথার্থ হয়ে উঠবে তা হয়তো তিনি কখনো ভাবেননি।
কবিতা, প্রবন্ধ আর অনুবাদের মাধ্যমে অলোকরঞ্জন কেবল বাংলাভাষার পুনর্বিন্যাসই করেননি, ভাবুকতাকেও তিনি বৈশ্বিক মাত্রায় উত্তীর্ণ করে বাঙালির সাহিত্যভাবনার প্রসার ঘটিয়েছেন। সামগ্রিক মূল্যায়নে তিরিশের দশকের পরে তিনি সেই লেখক, যিনি মনীষা আর সৃজণের আবেগে সবচেয়ে স্বতশ্চল, প্রাণবন্ত, এক প্রবাহ।
প্রবন্ধ: যাত্রা যার দিকে দিগন্তরে
অলোকরঞ্জনের কবিতা নিয়ে যতটা আলোচনা হয়েছে, প্রবন্ধ নিয়ে ততটা হয়নি। অথচ কবিতায় যেমন, তেমনই প্রবন্ধেও তিনি প্রথম সারিদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী। এই ব্যতিক্রম কেবল বাক্য ও শৈলীর স্বাতন্ত্র্যেই নয়, ভাবনার বহু ব্যঞ্জনকে একটি শলাকায় ব্রচেতার মতো গেঁথে দেওয়ার মুনশিয়ানাতেও। নানা ভাষার জ্ঞানভাণ্ডার থেকে তিনি জ্ঞাত ও অজ্ঞাত সূক্তিস্নানে মলিন ও নিশ্চল বিষয়কেও নতুন জীবন দান করেন নিজস্ব ব্যাখ্যা আর বিশ্লেষণের জাদুকাঠির স্পর্শে।
বাংলা গদ্যে যখন শৈলীর অনটন, পাণ্ডিত্যের প্রস্থান আর সংবেদনের সংকট ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর আবির্ভাব। তিনি আর শঙ্খ ঘোষ মিলে বাংলা গদ্যে, বিশেষ করে পাণ্ডিত্য ও শৈলীর সমন্বয়ে, স্বতন্ত্র দুই ধারা প্রবর্তন করেছেন, সমকালে কিংবা পরকালেও যার তুলনা খুব-একটা চোখে পড়ে না।
সাহিত্য-বিষয়ক প্রবন্ধে এই অনন্য অবস্থান কেবল সৃজনীশক্তি, মনন আর পাণ্ডিত্যের জন্যই নয়, এর সঙ্গে বুনন ও বয়ানের সম্মোহনী ভাষাশৈলীও প্রধান গুণ হিসেবে হাজির। তাঁর কবিতা এবং গদ্য যেন একই ভাবপ্রস্থানের ‘দুই রকম উৎসারণ’। দুই রকম, কেননা তারা পরস্পরের মধ্যে অভিন্ন আত্মারই অভিক্ষেপ ঘটিয়ে দুটি রূপে প্রকাশিত হয়। বাংলাভাষায় প্রবন্ধের জন্য এককভাবে যে অল্প কয়েকজন গদ্যভাষা তৈরি করেছেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। পৃথিবীর অন্য প্রান্তের প্রধান এক ভাষাশিল্পী হোর্হে লুইস বোর্হেস জেমস জয়েস প্রসঙ্গে আলোচনার সূত্রে এই মর্মে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে ‘ভাষা চায় নতুন নতুন শব্দ।’ El idioma requiere palabras nuevas. (Miscelanea, Jorge Luis Borges, Debolsillo, 2015, P-530)। বোর্হেসের এই প্রবিধান অলোকরঞ্জন আজীবন মান্য করে গেছেন। তিনি নিজেও এই কথাটিই একটু ঘুরিয়ে এভাবে বলেছিলেন যে, ‘ভাষার অভাবই কবির প্রধান অভাব।’ (শিল্পিত স্বভাব,পৃ-২৪) এই অভাব পূরণের দায় থেকেই অলোকরঞ্জনের প্রবন্ধ স্বনির্মিত শব্দ ও শব্দবন্ধ, কাব্যস্পন্দিত বাক্যগুচ্ছ ও বাক্যাংশ ধ্বনি-মাধুর্য নিয়ে এক বিপুল মৌচাক হয়ে উঠেছে। একেবারে সূচনা থেকেই যে তিনি এই স্বাতন্ত্র্য সজ্ঞানে নির্মাণ করে নিয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তাঁর গদ্যের উল্লেখ করেই যেহেতু শুরু করেছিলাম, তাই গদ্যের কারুকার্যময় দরবারে প্রবেশ করেই অন্য কক্ষগুলো আমরা ভ্রমণ করব। আমি একবার মনে মনে তাঁর গদ্য ও বুদ্ধদেব বসুর গদ্যের স্বভাবের তুলনা করতে গিয়ে দুটো বাদ্যযন্ত্র থেকে নিসৃত ভিন্ন দুই সুরধ্বনির কল্পনা করেছি। বুদ্ধদেবের গদ্য যদি হয় সেতারের কমনীয়তা, তাহলে অলোকরঞ্জনের গদ্যে রয়েছে সরোদের পৌরুষদীপ্তি। শুধু তাই-ই নয়, তাঁর গদ্যে রয়েছে অনেক বেশি কারুকাজ। অগ্রজ সুধীন্দ্রনাথ একাধিক শব্দ ও শব্দবন্ধ তৈরি করলেও, বুদ্ধদেব ওই অভিযানে বিমুখ থেকে বরং প্রচলিত শব্দগুলো অনেক বেশি লাবণ্যমধুর করেছেন প্রয়োগের মুনশিয়ানায়; শব্দকে তিনি দিয়েছেন এমন এক মসৃণতা ও স্পন্দন, যা পাঠকের শ্রুতিকে সম্মোহিত করে রাখে আগাগোড়া। বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধের ভাষার সম্মোহনী শক্তি শব্দের উদ্ভাবনায় নয়, বরং শব্দকে যথার্থে ও প্রয়োগের মিষ্টতায়, প্রচলিত শব্দের কাব্যিক সৌন্দর্য উন্মোচনে। এই অর্থে অলোকরঞ্জনের সহযাত্রী শঙ্খ ঘোষ বুদ্ধদেবের বিশ্বস্ত অনুচর, কেননা উভয়েই বিশ্বাস করতেন, ‘ইষৎ বিছিয়ে কথা বলতে পারলে পরিসরের সংগীতময় মুক্তির স্বাদ পাওয়া যায়।’ (বাঙলা গদ্য জিজ্ঞাসা, সমতট প্রকাশনী, তৃতীয় মুদ্রণ ১৯৯৩, কোলকাতা, পৃ-২৭৫)। তবে শঙ্খ ঘোষের ক্ষেত্রে সেটা আরও বেশি ধীরলয়ের পেলবতায় অথচ স্বগতভঙ্গির বৈশিষ্ট্যে স্বাতন্ত্র্য খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু অলোকরঞ্জন বুদ্ধদেবের ভাবাদর্শের বন্ধুত্ব গ্রহণ করলেও, ভাষিক বৈশিষ্ট্যে তিনি ওই সম্পর্কে চিড় ধরিয়ে ভিন্ন এক দীক্ষা নিয়ে এগোতে থাকেন অন্য এক প্রব্রজ্যায়।
এটা ঠিক যে অলোকরঞ্জনের কবিতার সিঁড়ি বেয়ে অনেকেই ভাবুকতার প্রাসাদে প্রবেশ করতে চেয়েছেন, কিন্তু তাঁর গদ্যের ভিত্তিতে যে চিন্তা ও ভাবনার অপ্রতিম সৌধ গড়ে উঠেছে, সেদিকে আমরা তাকিয়েছি অপেক্ষাকৃত কম। নিবিড় পাঠক মাত্রই এটা লক্ষ্য না করে পারে না যে, বহু ব্যবহারে জীর্ণ, মুমুর্ষ, প্রচলপিষ্ট শব্দগুলো এড়িয়ে এমন সব শব্দ অলোকরঞ্জন তৈরি করেছেন, যা তাঁর নতুন সংবেদনকে যথাযথভাবে প্রকাশের অনুকূল করে তুলেছে। কোনো কোনো শব্দকে তিনি সন্ধির মাধ্যমে নতুন অঙ্গ ও অর্থ দান করেছেন।
এক্ষুনি তাঁর কিছু শব্দ, শব্দবন্ধ আর বাক্যাংশের নমুনা প্রাসঙ্গিকগুণে গ্রাহ্য বলে পাঠকদের কাছে নিবেদন করতে চাই।
‘মৈত্রীঘনিম ত্বরান্বয়’, ‘তির্যক সার্থকতা’, ‘কিন্তু এই শোচনা শিলপীনিপুণ ছদ্মভাষণ’, ‘সমুচ্চকথনের কম্বুকন্ঠও’, ‘অজস্র কৌটিল্যে বিচ্ছুরিত’, (শিল্পিত স্বভাব), ‘শীর্ণ এই চয়ন’, ‘এই সমস্ত এষণা সর্বত্রই যে শ্রীমন্ত হতে পেরেছে সেরকম কোন উপপাদ্য আমার নেই।’, ‘সুন্দর অস্বস্তির’, ‘পুঞ্জিত অনাস্থা’, ‘গদ্যের প্রপঞ্চ-নিপুণ আয়োজন’, ‘তার গদ্যে ছায়াচ্ছন্ন শৈবালরাশির মতো উঠে আসে যুক্তিধর্মী উপমা এবং অব্যর্থ বিশেষণ। এদের তলে-তলে অবশ্যই থেকে যায় বাস্তব পাষাণখণ্ড, নিঃশব্দ কৌতুকে ধারণ করে রাখে উপরিতলের বাক্সময় তানবিস্তার। ‘কবিতাঘন সংবেদনটিকে’, (দিকে দিগন্তরে) ‘ধর্মসম্প্রদায়গত শীর্ণতা’, ‘লোকনিরুক্ত’, ‘তথ্যকোরক’, ‘নয়নসুভগ’, (ভ্রমণে নয়, ভুবনে) ‘শীলভদ্র সাহসিকতা’, ‘তার সৃষ্ট স্বর্লোকে তাঁরই সময়ের তহবিল থেকে শব্দ সংগ্রহ করেন। ‘তর্জনীতীক্ষ্ণ ইঙ্গিত’, ‘বিশ্বদেশের দিকে এগিয়ে গেছেন’, ‘সাদৃশ্যমৃগয়া’, ‘একটিমাত্র অর্থের স্বৈরাচার নেই।’, (জীবনানন্দ) ‘মিতালেখ্য’, ‘তীব্র নিখাদে ধিক্কার জ্ঞাপন করলেন’, ‘স্বর্ণিল সুযোগ’, ‘সশ্রদ্ধ মায়া হলো।’, (রিখিয়া থেকে অনেক দূরে) ‘অস্ফুট সেই বিরঙ্গায়’, ‘উদ্দীপক স্বরক্ষেপ’, ‘প্রত্যাশামদির সন্ধিক্ষণে বিশ্বাবর্তের ঘূর্ণ্যমান’, ‘আমিও সেই আকাট বাঙাল, উঞ্চ সেই আমন্ত্রণের সানন্দ কাঙাল’, ‘উন্মীলিয়মান’, ‘স্বগত-বিশ্বগত প্রস্বরপুঞ্জ’, (পুথিপট) ‘বিতত সময়বলয়’, ‘স্বরচিত পুঞ্জরচনা’, (রবীন্দ্র-আলোকবর্ষে) ‘পৌনঃপুনিক চর্চার মনোহীন মন্থরতা, এই বুঝি পাণ্ডুর হয়ে গেল।’, ‘পুনর্নব পেক্ষণীর সাহায্যে’, ‘রাবীন্দ্রিকতার অম্লান প্রাসঙ্গিকতা’, ‘সংবেদীজনের প্রশ্রয় পাবে।’, (গানের সুরে আমার মুক্তি), ‘মৈত্রীমমতা ও পরস্পরস্পর্শিতার যুক্তিতে’, ‘ঈর্ষামদির প্রতিযোগিতায়’, ‘শ্লাঘাসঞ্চারী সংগ্রামে।’, ‘অনীপ্সিত ঘটনাবলি মূল্যাঙ্কিত করে নিচ্ছেন।’, ‘যথার্থ বন্ধুত্বের রাগরাগিণীতে এই বিবাদী স্বর নিয়েই সুরসংগতি গড়ে ওঠে।’, ‘আত্মপ্রপঞ্চায়ন’, ‘দ্ব্যর্থদ্যোতকতা’, ‘সমীপকালের ফেনিল আবর্তের সঙ্গে’, (নাচের আড়ালে লুকিয়ে কে ছায়ানট?) ‘অভিমানের মিড়’, ‘কৌণিক বিষাদ’, ‘অনর্পিত বৈরাগ্যের ইস্পাতি আভা।’, ‘যার জড়োয়া (কেতাবি বা অনুষ্ঠানিক অর্থে ব্যবহৃত) নাম ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী।’, ‘অনির্ণেয় বিষাদযোগে আচ্ছন্ন’, (আড়ভাবুকের কড়চা)।
প্রিয় পাঠক, এই এলোমেলো চয়ন— এ কেবল তাঁর অল্প কয়েকটি প্রবন্ধের বই থেকে নির্গত। তাঁর সমগ্র রচনাকর্ম থেকে যদি আমরা সংকলন করতে যাই, তাহলে শীর্ণকায় হলেও, নিঃসন্দেহে একটি কিতাবের আকৃতি ধারণ করবে।
প্রিয় পাঠক, এই এলোমেলো চয়ন— এ কেবল তাঁর অল্প কয়েকটি প্রবন্ধের বই থেকে নির্গত। তাঁর সমগ্র রচনাকর্ম থেকে যদি আমরা সংকলন করতে যাই, তাহলে শীর্ণকায় হলেও, নিঃসন্দেহে একটি কিতাবের আকৃতি ধারণ করবে। মনে হয় না এই মুহূর্তে তার প্রয়োজন আছে। অন্তত এই চকিত-চয়ন থেকে যেকোনো বিদুষক পাঠকের পক্ষে অনুমান করা সম্ভব, তিনি নিজস্ব অভিব্যক্তিকে এইসব শব্দ-লহরীতে কতটা মর্মময় করে তুলতে চেয়েছেন।
ভাষা এবং ভাষাশৈলীই শিল্পীর ব্যক্তিত্বের স্মারকচিত্র। এই অর্থে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ এবং এর পরপরই শঙ্খ ঘোষ ও অলোকরঞ্জন গদ্যে এনেছেন দৃষ্টিগ্রাহ্য স্বনির্মিতি। সন্দেহ নেই যে এঁদের মধ্যে সর্বসাম্প্রতিক অলোকরঞ্জনেই সৃজনী ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য ও তীব্রতা অনেক বেশি।
কখনো কখনো হয়তো ভুলভাবেই মনে হয় সুধীন দত্ত তাঁর গদ্যের মেজাজের দূরবর্তী ভ্রূণ। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, ওই সংযোগ ছিন্ন করে অলোকরঞ্জন অন্য এক গোত্র রচনা করেছেন। তাঁর গদ্যে তৎসম গাম্ভীর্য থাকলেও, তাতে আছে ঘরোয়া বুনন আর আছে সুরাশ্রিত বর্ণময় স্ফূর্তি।
তাঁর গদ্যের কাব্যিক সৌন্দর্য্যের দিকে তাকালে হাইডেগারের সেই উক্তিতে আস্থা রাখা অনেক সহজ হয়ে যায়, যখন তিনি বলেন— ‘The opposite of the poem is not prose; pure prose is as poetic as many poetry… The speech of genuine thinking is by nature poetic.’ (Poetry, Language, Thought, Martin Heidegger, Translated by Albert Hofstadter, Herper Perennial, 2001, P-x) ঠিক এই কারণে তাঁর গদ্য পড়ার পর মনে হয়, এই গদ্য কবির হাত থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছে— যেমনটা তিনি বুদ্ধদেবের গদ্য সম্পর্কে বলেছিলেন। কাব্যবোধের সঙ্গে পরাগায়নের ফলই এই সুভাষিত গদ্য।
অলোকরঞ্জন একবার বাংলা সাহিত্য-সমালোচনা সম্পর্কে আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, ‘বাংলা সাহিত্য সমালোচনা আজ এভাবে রম্য জঞ্জালের সমারোহে পর্যবসিত’ (আড়ভাবুকের কড়চা, পৃ: ৬২) হয়েছে। এমনটা হওয়ার মূল কারণ যে চিত্তের মরুময়তা এবং সাহিত্য সম্পর্কে পাণ্ডুর ও পঙ্গু দৃষ্টি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সর্বোপরি, কাব্যবোধের মরতা ও জড়তা।
দিকে দিগন্তরে গ্রন্থে ‘ভাবুকের গদ্যচিন্তা: বুদ্ধদেব বসু’ প্রবন্ধে তিনি স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ‘কবিতার কাছ থেকে ঋণ না নিয়ে গদ্য যে কখনোই তার স্বাধিকারভূমি খুঁজে পাবে না’,— কথাটা বুদ্ধদেব প্রসঙ্গে বললেও তাঁর নিজের গদ্য এই স্বাধিকারে অনন্য, কেন না তা ‘কবিতাঘন সংবেদনটিকে’ বহন করে চলে নিরন্তর।
তাঁর যেকোনো প্রবন্ধের বইয়ে শিল্পিত স্বভাবের হাত ধরে যখন আমরা বিশ্বসংস্কৃতির বিচিত্র সব অলিগলি ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করি, তখন বিশ্বনাগরিকবোধের কল্লোলিত সমুদ্রতটে স্নানের গভীর আস্বাদে মন তৃপ্ত হয়ে ওঠে। মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সব দিগন্তই তিনি স্পর্শ করেছেন অসীম কৌতূহলে। গান, চিত্রকলা, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, রাজনীতি— সংস্কৃতির সব উপাদেয় উপাচারে উপচে পড়েছে প্রতিটি গ্রন্থ।
তাঁর প্রথম দিককার প্রবন্ধের বই ‘শিল্পিত স্বভাব’-এ অন্তর্ভুক্ত সূচিপত্রে তাকালে পাঠকের বুঝতে মোটেই কসরত করতে হয় না যে তিনি প্রায় সূচনাতেই দেশ ও ‘বিশ্বদেশ’কে একই করতলে তুলে নিয়েছেন। তাঁর একটি ডানা যদি হয় প্রাচ্য তবে অন্যটি প্রতীচ্য। তাই একই গ্রন্থে তিনি দান্তে, শেক্সপিয়র, ব্লেক, শিলার ও কার্ল মার্কসের পাশেই বসিয়ে দিয়েছেন ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, উপেন্দ্রকিশোর, অবনীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথকে। প্রচীত্যের লেখকদের সম্পর্কে যদি তাঁর একেবারেই নবীন কোনো উন্মোচন নাও থাকে, কিন্তু যখনই তুল্যমূল্যের প্রসঙ্গ এসেছে বাঙালি কোনো লেখকের সঙ্গে, তখন তা নতুন আবিষ্কারে উন্মীলক হয়ে উঠেছে। ঔপনিবেশিক সূত্রে বাংলা কবিতায় ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবের আত্মীকরণ ছিল অনিবার্য এক নিয়তি। কিন্তু ইতালীয় ভাষার দান্তে কিভাবে প্রবেশ করেছিলেন এই ইংরেজশাসিত ভূখণ্ডে? অলোকরঞ্জন নিজেই বলেছেন ‘উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যের আবহে দান্তের আবির্ভাব প্রকাশ্যে প্রবলরূপে অভিনন্দিত হয়নি।’ ( পৃ ১৬) কিন্তু তারপরও, দান্তে অভিনন্দিত না হলেও ইংরেজি ভাষার সূত্রেই প্রবেশ করেছেন উনিশ শতকের কোনো কোনো লেখকের অন্তরমহলে। দান্তে কিভাবে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত ছায়া বিস্তার করলেন, তারই প্রামাণ্য চিত্র তুলে ধরেছেন অলোকরঞ্জন, কিন্তু প্রায় সন্তর্পণ ভঙ্গিতে। আর এই ছায়াচ্ছন্নতা এতটাই প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে যে তা খুঁজে পেতে হলে নিপুণ গোয়েন্দার মতো অনুসরণ করতে হয় লেখকের রচনারাশি। অলোকরঞ্জন গভীর নিষ্ঠায় সেই কাজটি করে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সেই ইতালীয় সংযোগ, যা আগে আমাদের কাছে পুরোপুরি অজ্ঞাত ছিল। এমনকি যে শেক্সপিয়রকে আমরা ঔপনিবেশিক সূত্রে পেয়েছি, তিনিও যে আমাদের মধ্যে কতদূর পৌঁছেছিলেন তার হদিস কতটা জানতাম, অলোকরঞ্জনের অনুসন্ধানী প্রবন্ধ ‘শেক্সপিয়র ও আধুনিক বাংলা কাব্যজিঞ্জসা’ রচিত না হলে? এই অনুসন্ধানে তিনি যুক্ত করেন জার্মান ভাষায় শেক্সপিয়র-চর্চার উল্লেখও। এই উল্লেখ নিছক পাণ্ডিত্যের প্রদর্শন থেকে নয়, বরং অন্য একটি ভাষার সাথে তুলনা করে আমাদের চর্চার প্রবণতাকে বৈশ্বিক পরিসরে দেখার চেষ্টায়। ‘যদি কোন তুলনাশিকারী জর্মন কবিতায় শেক্সপীয়রের নববর্ষা পাশাপাশি আনতে চান, তাঁর সাদৃশ্যের মৃগয়া অচিরেই হয়ত ভ্রমাত্মক বলে প্রতিপন্ন হবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অন্য কোনো সুখদ ভ্রান্তিবিলাসে তিনি অপরূপভাবে আশ্রিত হতেও পারেন। ‘অলোকরঞ্জনের সাদৃশ্যের মৃগয়ায় আমরা দেখতে পাবো কিভাবে বিহারীলাল থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ এবং ‘রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিতায় দৃষ্টিকোণের বিন্যাসে… শেক্সপীয়রীয়তা দৃষ্টিগোচর’ হয়ে উঠছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিঞ্চু দে এবং জীবনানন্দ দাশে কিভাবে এবং কোন পথে শেক্সপীয়রীয় বিক্ষেপ ঘটেছে তার এক ‘মৈত্রীঘনিম’ আলেখ্য অলোকরঞ্জনের এই প্রবন্ধ।
ইংরেজদের পরপরই জার্মান ভাষার লেখক শিল্পী ও দার্শনিকরা তাঁর বৈশ্বিক আত্মার পুষ্টি যুগিয়েছিল অনেক বেশি। তিনি যখনই কোনো সূত্রে তাঁদের কারোর সম্পর্কে লিখেছেন, তখন কেবল তা সাধারণ পরিচিতিমূলক থাকেনি, তা নিজস্ব রসায়ন থেকে একদিকে যেমন আমাদের রুচির বিবর্ধক করে তুলতে চেয়েছেন, তেমনি তা হয়ে উঠেছে তার ব্যক্তিগত ভাবুকতার স্বতন্ত্র ফোয়ারা। জার্মান লেখক-কবিদের সম্পর্কে আমাদের কেবল অবহিতই করেন না, আমাদের অস্বচ্ছ ধারণাগুলোকেও তিনি বিশ্বস্ত পাণ্ডিত্যের কিরণে স্পষ্ট করে তোলেন। এরই এক উজ্জ্বল উদাহরণ এই গ্রন্থের ‘শিল্পাচার্য শিলার’ নামক প্রবন্ধটি। এই একই গ্রন্থে তিনি ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, উপেন্দ্রকিশোর, অবনীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে প্রবন্ধগুলো লিখেছেন, সেগুলোতেও আছে এদের প্রত্যেকের সম্পর্কে অলোকরঞ্জনের স্বকীয় মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ। তাঁর একক ব্যক্তিভিত্তিক গ্রন্থগুলো ছাড়া, যেমন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রবীন্দ্র-আলোকবর্ষে, গানের সুরে আমার মুক্তি কিংবা জীবনানন্দ বাদ দিলে, অন্য সব গ্রন্থই হয়ে উঠেছে তার বহুত্ববাদী মনেরই প্রতিফলন।
এরই এক উজ্জ্বল উদাহরণ এই গ্রন্থের ‘শিল্পাচার্য শিলার’ নামক প্রবন্ধটি। এই একই গ্রন্থে তিনি ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, উপেন্দ্রকিশোর, অবনীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে প্রবন্ধগুলো লিখেছেন, সেগুলোতেও আছে এদের প্রত্যেকের সম্পর্কে অলোকরঞ্জনের স্বকীয় মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ। তাঁর একক ব্যক্তিভিত্তিক গ্রন্থগুলো ছাড়া, যেমন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রবীন্দ্র-আলোকবর্ষে, গানের সুরে আমার মুক্তি কিংবা জীবনানন্দ বাদ দিলে, অন্য সব গ্রন্থই হয়ে উঠেছে তার বহুত্ববাদী মনেরই প্রতিফলন।
‘রিখিয়া থেকে অনেক দূরে’ গ্রন্থের অর্ধেকটা জুড়ে রয়েছে স্বদেশী মনীষা আর বাকি অর্ধেক জুড়ে রয়েছে বিদেশি লেখক ও মনীষা সম্পর্কে ‘মিতালেখ্য’, কিন্তু এই মিতালেখ্যতেই প্রতিটি ব্যক্তিত্বের সৃজনী আভা মনকে পরিতৃপ্ত করে তার অপূর্ব ব্যঞ্জনাময় ভাষার জাদুর কারণে, এবং নতুন নতুন তাৎপর্যের অভাবনীয় উন্মোচনের কারণেও। তার দিকে দিগন্তরে বইটির চরিত্রও এই মিশ্র স্বভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। অলোকরঞ্জনের একটি চোখ যদি থাকে প্রাচ্যের প্রতি, তো অন্যটি প্রায় অবধারিতভাবেই প্রতীচ্যের কোনো না কোনো মনীষার প্রতি, তা সে যে ক্ষেত্রেরই হোন না কেন। বাদ যায় না দূর-প্রাচ্য কিংবা অতিদূর লাতিন আমেরিকাও। যে শরৎচন্দ্র থেকে আজকের পাঠক আধুনিকতার অহমিকায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, অলোকরঞ্জন তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করেন, আর আমাদের মনে করিয়ে দেন ‘শরৎচন্দ্রের আধুনিকতা তাঁর গূঢ়ৈষণা গোপনচারিতার মধ্যে থেকে আবিষ্কার করে নিতে হবে, তাঁর এথিক্স-বন্দনা থেকে তো নয়ই, নীতিবিরোধী ঘোষণা থেকেও নয়। নিরাশ্রিত ব্যক্তিমানুষের অপরূপ অসহায়ত্ব ও অস্তিত্ব-বিবেক আধুনিক সাহিত্যের দর্পস্থল।’ (গদ্যসমগ্র-২, পৃ-৪৪) এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি আসলে আমাদের আধুনিকতার দেশজ দীক্ষায় স্নাতক করিয়ে নিতেই এগিয়ে আসেন। একই গ্রন্থে তিনি বুদ্ধদেব বসুর গদ্যের গরিমাকে চিহ্নিত করেন এমন সব আবিষ্কারের মাধ্যমে, যা আমরা অনুভব করেছি হয়তো কখনো কখনো। কিন্তু অলোকরঞ্জনের আগে কে এমন যথার্থ ভাষায় তুলে ধরতে পেরেছিলেন? ‘ভাবুকের গদ্যচিন্তা: বুদ্ধদেব বসু’ প্রবন্ধে তিনি এই লেখকের গদ্যের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে গিয়ে বলেন: ‘ভাবনা এবং চিন্তা, কবিতা ও গদ্যের মধ্যে কোনো কোনো দার্শনিক নির্মম যে ভেদরেখা আরোপ করেছেন সেটি বুদ্ধদেব স্বীকার করেননি।’ এই কারণে ‘সেই গদ্যে চিন্তানায়ক অনায়াসেই ভাবুকের সঙ্গে ভূমিকা-বদলে উৎসুক।’ এ তো গেল বুদ্ধদেবের মনোকাঠামোর একদিকের উন্মোচন। অন্যদিকে, পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টিকেও কিভাবে আমলে রেখেছেন বুদ্ধদেব বসু, সে সম্পর্কেও অলোকরঞ্জন আমাদের অভিহিত করতে ভোলেন না: ‘বুদ্ধদেবের গদ্যের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য অন্যমনস্কতার অভাব। তাঁর যেকোনো গদ্যরচনায় প্রস্তাবনা থেকে উপসংহার পর্যন্ত প্রখর চৈতন্যের জাগর উপস্থিতি কাজ করেছে। অথচ অদীক্ষিত পাঠকের চোখে সেই প্রবর্তনা ধরা না পড়াই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি এবং উত্তরকালে তাই তিনিই একমাত্র লেখক যাঁর রচনা এক হিসেবে সর্বসাধারণের কাছে বোধগম্য।’ কিন্তু অলোকরঞ্জন এও বিশ্বাস করেন, ‘বুদ্ধদেবের গদ্যের এই প্রাঞ্জলতা বা প্রসাদগুণ, প্রকৃত প্রস্তাবে, প্রতারক।’ কিন্তু কেন প্রতারক? কারণ ‘সুহৃদ সম্মিত’/‘কান্তাসম্মিত’ গদ্যের প্রপঞ্চ-নিপুণ আয়োজন ঘটিয়ে তিনি প্রথম মুহূর্তেই পাঠককে জিতে নেন, অতঃপর স্বীয় সিদ্ধান্তের আনুকূল্যে তাকে দীক্ষিত করেন।’ (গদ্যসমগ্র-২, পৃ- ৪৫)
বুদ্ধদেবের গদ্যে ব্যবহৃত শব্দের জোর দেখাতে গিয়ে কয়েকটি নমুনা তিনি তুলে ধরেন: ‘অগত্যা অনিবার্যকে’, ‘তরঙ্গাহত তরণীটির’ ইত্যাদি। এরপরই তিনি বলেছেন, ‘যদি ওই শব্দগুলির আলংকারিক আবেদন চূড়ান্ত বিস্মৃত হওয়া যায়, তাহলেও ভোলা যায় না গোটা অংশটির সামগ্রিক কবিতাঘন সংবেদনটিকে। বুদ্ধদেব এই পর্বে গদ্যকে কবিতার প্রতিস্পর্ধী অথচ অনুগ মাধ্যমে পরিণত করতে চেয়েছিলেন।’ এই গদ্যের চূড়ান্ত মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে আসেন: ‘ব্যাকরণের নিয়ম মেনে এত বিদ্রোহী গদ্য বুদ্ধদেব ছাড়া আর কারো পক্ষে লেখা সম্ভব হয়নি।’ (গদ্যসমগ্র-২, পৃ ৪৯-৫০)
বুদ্ধদেব সম্পর্কে এই মূল্যায়ন খানিকটা বিস্তারে দেয়ার একটা অঘোষিত লক্ষ্য এটাও, যাতে পাঠক তুলনা করার একটি সুযোগ পান— অলোকরঞ্জনের নিজের গদ্যকেও তার সাথে মিলিয়ে নেয়ার। বুদ্ধদেবের গদ্য সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, তার অনেকটাই প্রযোজ্য নিজের গদ্যশৈলীর ক্ষেত্রেও। কিছুক্ষণ আগেই তাঁর নিজের গদ্যসম্ভার থেকে অল্প যে-কটি নজির আমি তুলে ধরেছি, সেখানেই মনোযোগী পাঠক আমার এই বক্তব্যের সমর্থন খুঁজে পাবেন বলে মনে হয়।
বলেছিলাম দেশ ও বিশ্বদেশ অলোকরঞ্জনের সর্বদাই সঙ্গী হয়ে আছে অধিকাংশ প্রবন্ধের বইয়ে— কখনো কখনো বিভাজিত অধ্যায়ের বিন্যাসে, কখনো-বা স্বতন্ত্র প্রবন্ধের মধ্যে পরস্পর গ্রথিত রূপে, যেমন নাচের আড়ালে লুকিয়ে কে ছায়ানট? কিংবা রিখিয়া থেকে অনেক দূরে, কিংবা আড়ভাবুকের কড়চা গ্রন্থে। আবার ব্যতিক্রমও যে নেই, তা নয়— যেমন যে আছে অন্তরালে গড়ে উঠেছে প্রধানত রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র-পরবর্তী সুধীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মূল্যাঙ্কনের স্বকীয় স্বর্ণাভায়।
একক যে ব্যক্তিত্ব নিয়ে সর্বাধিক গ্রন্থ লিখেছেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ— যাঁকে তিনি ‘জীবনদেবতা’ বলে চিহ্নিত করেছেন। গানের সুরে আমার মুক্তি কিংবা রবীন্দ্র-আলোকবর্ষে ছাড়াও অগ্রন্থিত কিংবা অন্য কোনো কোনো গ্রন্থেও ছড়িয়েছিটিয়ে আছে রবীন্দ্র-বিষয়ক বহু প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর আত্মার সংযোগ সামগ্রিক বোধের দিক থেকে হলেও কখনো কখনো ইষৎ বেঁকে গেছে অলোকরঞ্জনের চলার পথ। তার মূল কারণ খানিকটা রাজনৈতিক প্রতীতী আর বাকিটা তাঁর কাব্যস্বভাবের ‘অলৌকিক’ অভিযান। অলৌকিক বলতে আমি তাঁর গোটা লেখকসত্তার স্বাতন্ত্র্যকে বুঝাতে চাই। এই স্বাতন্ত্র্যের কারণেই তিনি মাঝেমধ্যেই রবীন্দ্রনাথের হাত ছেড়ে হেঁটেছেন ‘কৌণিক স্বজ্ঞা’য় নির্মিত দ্বিতীয় ভুবনে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন এভাবে: ‘রবীন্দ্রনাথ অনেক বড় বিদ্রোহী, আমি স্বভাব-বিদ্রোহী। একটি শিলমোহর ছিল, আমি রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ আমার নন। আমাকে তাঁর থেকে আমার স্বরায়ণে স্বতন্ত্র থাকতে হবে, এই উপলব্ধি আমি করতে পেরেছিলাম। আমার পথ তখন থেকে বেঁকে গিয়েছে।’ ( নাচের আড়ালে লুকিয়ে কে ছায়ানট?, পৃ-১১১-১১২)
তবে এই বেঁকে-যাওয়া পথের পাশেই রবীন্দ্রনাথ প্রবহমান ছিলেন প্রায় ছায়াসঙ্গীর মতো— আজীবন। আর এ কারণেই তিনি কাব্যসঙ্গী শঙ্খ ঘোষের পাশাপাশি এমনই আরেক মল্লিনাথ হয়ে উঠলেন, যার অন্তরঙ্গ পাঠ আমাদের কাছে অতীতের ছায়াচ্ছন্ন রবীন্দ্রনাথকে পাঠ্য ও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
অলোকরঞ্জন বিষয়ে আমার একটা জিজ্ঞাসা অমীমাংসিতই থেকে যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে এই যে— গান এবং কবিতা ছিল তাঁর সৃজনী ব্যক্তিত্বের দুই ডানা। নজরুল ইসলাম তাঁর সোনালি দুই ডানায় কখনো উদ্দীপনা-সঞ্চারী ভূমিকা পালন করতে পেরেছিল কিনা কিংবা নজরুলের সৃষ্টিকর্মের কোনো প্রাসঙ্গিকতা তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন কিনা, তা আমাদের অজানাই থেকে গেল। যদিও নজরুল অলোকরঞ্জনের মায়ের জন্য পরপর দুটো গান রচনা করেছিলেন, নিজে স্বচক্ষে দেখেছেনও বলে তাঁর ‘পুরনো অ্যালবাম থেকে’ নামক এক স্মৃতিমধুর প্রবন্ধে জানিয়েছেন: ‘একদিন নজরুল ইসলামের স্টুডিয়োতে মায়ের ডাক পড়ল। হারমোনিয়ামটাকে বুকের দিকে টেনে এনে তিনি মায়ের জন্য পরপর দুটো গান বাঁধলেন: ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি’ আর ‘পাষাণ যদি হতে তুমি অনেক আগেই গলে যেতে’! কী-আশ্চর্য, অনাহত সৃষ্টির সেই আসরে আমার মতো একফোঁটা গ্রাম্য এক নাগরিকও উপস্থিত ছিল! আমি সেই প্রথম নজরুলকে দেখেছিলাম এবং সেই শেষবারের মতো। দেখলাম, না শুনলাম? শুনলাম, অবশ্যই, পুরবী রাগের ঠাটে নিবদ্ধ প্রথম গানটিতে আধুনিক কবির সত্তার নির্ভীক মুক্ত বিহার। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা, জীবনে সেই প্রথম গানের মাধ্যমে আমি স্বরবৃত্ত বা ছড়ার ছন্দেও চার-চলন ঘোড়দৌড়ের আভাস পেয়ে গেলাম। এখন ঠাহর করতে পারি, গানের সঙ্গে কবিতা মিলে গেলেই জন্ম নেয় ছন্দ, আর সেই মিলন ছাড়া আধুনিকতা ও স্বাধীনতার কোনো তাৎপর্যই নেই।
খুব সম্ভবত সেই বয়ঃসন্ধিক্ষণেই আমি গানের সঙ্গে আধুনিক কবিতার দ্বৈরথ যে কতো অনির্ণেয় এবং চ্যালেঞ্জসঞ্চারী, সে বিষয়ে ইষৎ অবহিত হতে পেরেছিলাম।’ (নাচের আড়ালে লুকিয়ে কে ছায়ানট?, পৃ ৯৬-৯৭)। তাঁর আরও দুএকটি প্রবন্ধে প্রসঙ্গক্রমে নজরুল সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পাদিত আধুনিক কবিতার ইতিহাস গ্রন্থে ‘আধুনিকতার সংজ্ঞা’ প্রবন্ধে তিনি আলোচনার সূত্রে বলেন:
‘১৮৯৯: নজরুল ইসলাম এবং জীবনানন্দের জন্মবর্ষ। শুধু এই সহকালীনতাই কি প্রথম-পর্বের জীবনানন্দের উপরে নজরুলের প্রভাবশালিতার জন্য দায়ী? তার চেয়েও গভীরতর কোনো প্রাথমিক সাযুজ্যসূত্র ছিল:
নজরুলের সাহায্য ছাড়া সে দিন মুক্ত যৌবন তার ভাষা খুঁজে পায়নি… নির্বাধ, উদ্দেশ্যহীন, যুক্তিহীন যৌবনের প্রাণচঞ্চলতায় নজরুল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আবেগঘন মন নিয়ে জীবনানন্দ যে নজরুলের দিকেই ঝুঁকে পড়বেন তাতে অবাক হবার কিছু নেই।
—সঞ্জয় ভট্টাচার্য, আধুনিক বাংলা কবিতার ভূমিকা’, পৃ ৩০।
নজরুলের বাকসংযম তাঁর যৌবনবিদায়ী গীতিগুচ্ছে, পদ্যবন্ধে নয়। ওই পদ্যভাষণগুলি মহতী জনসভার উদ্দেশে প্রদত্ত হলেও গানগুলি একান্তভাবেই স্বগতস্বনন। একযোগে ইমেজপুজারী ও নিহিতার্থনিষ্ঠ (Surrealist) ওই জীবনানন্দের কবিতা ওই স্বগতস্বনন বা অন্তর্লীন মনোকথনে আশ্রিত।’ (আধুনিক কবিতার ইতিহাস, পৃ ২২)
উপরোক্ত দুটো উদ্ধৃতিতেই অলোকরঞ্জন নজরুলের কাব্যপ্রতিভা ‘পদ্যবন্ধে’ উপেক্ষা করলেও ‘আশ্চর্য অনাহত সৃষ্টির’ নিদর্শন ‘গীতিগুচ্ছে’ পেয়েছেন। এবং এতদূর পর্যন্ত বলতে তিনি কার্পণ্য করেননি যে মূলত গানেই লক্ষ্য করেছেন ‘আধুনিক কবির সত্তার নির্ভীক মুক্ত বিহার।’ এও স্বীকার করলেন যে তিনি নজরুলের গানের মাধ্যমে ‘স্বরবৃত্ত বা ছড়ার ছন্দের চার-চলন ঘোড়দৌড়ের আভাস’ পেয়েছেন। তাঁর এই আশ্চর্য আবিষ্কারেও আমরা চমকে উঠি আধুনিকতার ভিন্ন কিন্তু খুবই অনিবার্য এক সূত্রের মুখোমুখি হয়ে: ‘গানের সঙ্গে কবিতা মিলে গেলেই জন্ম নেয় ছন্দ, আর সেই মিলন ছাড়া আধুনিকতা ও স্বাধীনতার কোনো তাৎপর্যই নেই।’ বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে নজরুলের গানের ভাবৈশ্বর্য আর আলংকারিক অবদান তার মতো ভাবুক ও রসজ্ঞকে কতটা আন্দোলিত করেছে তারই এক তুঙ্গস্পর্শী বিবেচনা অঙ্কুরিত হয়ে উঠল পরবর্তী এই ভাষ্যে: ‘গানের সঙ্গে আধুনিক কবিতার দ্বৈরথ যে কত অনির্ণেয় এবং চ্যালেঞ্জসঞ্চারী, সে বিষয়ে ইষৎ অবহিত হতে পেরেছিলাম।’ ‘অঙ্কুরিত’ শব্দটি ইচ্ছে করেই ব্যবহার করছি এই কারণে যে অলোকরঞ্জন নজরুলের ক্ষেত্রে এমন সব চমকে দেওয়া বিষয় আবিষ্কার করলেন, কিন্তু সেই আবিষ্কারকে অঙ্কুরিতই রেখে গেলেন, পুষ্পিত করার কোনো তাগিদ বোধ করেননি তাঁর সৃষ্টিশীল দীর্ঘ জীবনের কোনো বাঁকে। নজরুলের কাব্যপ্রতিভা আমাদের কোনো কোনো প্রধান লেখক কর্তৃক হয় উপেক্ষিত, নয়তো ভুলভাবে ব্যাখ্যাত কিংবা নীরবতার অন্ধকারে আচ্ছাদিত হয়ে আছে। ঠিক এরকম এক অন্ধকারে অলোকরঞ্জনের এইসব চোখধাঁধানো আবিষ্কার যখন জোনাকিপুঞ্জ রূপে জ্বলে উঠতে দেখি, তখন এক শ্রদ্ধাস্নিগ্ধ প্রত্যাশা জেগে ওঠে ওই অঙ্কুরকে পুষ্পের পূর্ণতায় দেখার। সেরকম হলে নজরুল ইসলামের কাব্যপ্রতিভা যোগ্যতম এক কবির হাতে কেবল নতুন ব্যাখ্যায় নির্ণিতই হত না, একই সঙ্গে আমাদের সাহিত্যের আধুকিতার নতুন আরেকটি রহস্যও উন্মোচিত হওয়ার সুযোগ পেত। তাছাড়া আমাদের প্রধান লেখকদের মধ্যে সংগীত সম্পর্কে তিনি যতটা ওয়াকিবহাল, অন্যরা ততটা নন বলে, নজরুলের সংগীতের এই তাৎপর্য আজও পর্যন্ত অনির্ণেয় রয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ নিয়ে গ্রন্থায়তনের না হলেও, অন্তত একটি স্বতন্ত্র পূর্ণ প্রবন্ধে যদি তাঁর ভাবনাগুলো জানিয়ে রাখতেন, তাহলে আধুনিকতা সম্পর্কিত আমাদের অস্বচ্ছতা এবং ভ্রান্তিগুলো থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ পেতাম।
বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে নজরুলের গানের ভাবৈশ্বর্য আর আলংকারিক অবদান তার মতো ভাবুক ও রসজ্ঞকে কতটা আন্দোলিত করেছে তারই এক তুঙ্গস্পর্শী বিবেচনা অঙ্কুরিত হয়ে উঠল পরবর্তী এই ভাষ্যে: ‘গানের সঙ্গে আধুনিক কবিতার দ্বৈরথ যে কত অনির্ণেয় এবং চ্যালেঞ্জসঞ্চারী, সে বিষয়ে ইষৎ অবহিত হতে পেরেছিলাম।’
সংগীত যাঁর সৃজনীব্যক্তিত্বের প্রবল ও দৃশ্যমান এক রূপ, যাঁকে এক কথায় সংগীতাবতার বললেও ভুল হবে না, সেই নজরুল সম্পর্কে অলোকরঞ্জন বিস্তারিত না বললেও, তাঁরই সমসাময়িক যে কবির কবিতায় সংগীতের অবস্থান অন্তর্লীন ও অস্পষ্ট, সেই জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে ১৯৮১ সালে জার্মান ভাষায় শ্যামল দাশগুপ্তর সঙ্গে Jibanananda Das [1899-1954]-Aus der Sicht der westlichen poetischen Aesthetik নামক বইটি প্রকাশের আট বছর পর এককভাবে নিজেই জীবনানন্দ শীর্ষক একটি বই প্রকাশ করেন। জীবনানন্দকে নিয়ে অনেকেই বই লিখেছেন, কিন্তু সংগীতের আঙ্গিকে পর্ববিভাজন করে তিনি অন্য এক জীবনানন্দকে আমাদের কাছে হাজির করলেন। জীবনানন্দকে এভাবে ব্যাখ্যা করার পেছনে তাঁর সংগীতজ্ঞানের পাশাপাশি জীবনানন্দের কবিতার সাংগীতিক পটভূমিও একটা কারণ হয়তো। এই গ্রন্থের ‘আস্থায়ী’ অংশে তিনি তার আবিষ্কৃত পটভূমি ব্যাখ্যার আগে পাঠককে জানিয়ে দেন জীবনানন্দের রচনার সাংগীতিক পরিমণ্ডল: ‘আমরা, আলোচ্য প্রসঙ্গে, জীবনানন্দকে ভারতীয় ও ইয়োরোপীয় সংগীতের মিলিত অনুষঙ্গে রেখে বুঝতে চাইছি। এক্ষেত্রে এটা বলা চলে, রচনার একেবারে গোড়ার দিকে তিনি কতগুলি সূত্র এঁকে নিয়েছিলেন। রচনার বিবর্তনের পর্বে-পর্বান্তরে তিনি, ক্রমশ পরিণত হয়ে ওঠার মুখে, প্রস্থানভূমিকার কোনো-কোনো আরোপিত নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন। কিন্তু যেখান থেকে তিনি শুরু করেছিলেন, তার প্রতি পিছুটান তাঁর কখনোই মুছে যায়নি।’ ( গদ্যসমগ্র-২, পৃ ৩২৮)
নতুন এই অবয়বে জীবনানন্দকে আবিষ্কারের চ্যালেঞ্জ তিনি ‘শীলভদ্র সাহসিকতা’য় ছুঁড়ে দিয়েছিলেন বাঙালি সাহিত্যরসিক ও রসজ্ঞদের মাঝে। শুধু সাংগীতিক প্রেক্ষাপটের কারণেই নয়, এই বইটিতে অলোকরঞ্জন জীবনানন্দের বাচনিক ও আলংকারিক স্বকীয়তাকে যেভাবে আবিষ্কার ও ব্যাখ্যা করেছেন, তা এক কথায় অভিনব।
অলোকরঞ্জনের অভিনবতা কেবল এই সব ব্যক্তিত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সাহিত্য বিষয়ে আমাদের কোনো কোনো সংস্কারকেও তিনি প্রশ্ন করেছেন। ‘মৌলতা, মৌলিকতা’ নামক এক প্রবন্ধে তিনি প্রবল এক বদ্ধমূল সংস্কারের বিরুদ্ধে আঘাত করে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ‘কবি যদি তার অন্বেষা এগিয়ে নিয়ে যাবার পথে কৃত্রিমভাবে একটি স্বারোপিত মৌলিকতার বলয়ে বন্দী থেকে যান, সেটা তাঁর ও কবিতাপ্রবাহের পক্ষে ক্ষতিকর।’ (দ্বিতীয় ভুবন)। এই বক্তব্যে তিনি এটাই দেখাতে চাইলেন যে প্রভাবের পরম্পরা কবির মৌলিকতার জন্য হানিকর নয়, বরং তা ঐতিহ্যকে নবায়নের এক উপায়।
অপেক্ষাকৃত লঘুচালে কিন্তু তাই বলে হেলাফেলাভাবে নয় মোটেই— এমন সব রচনাতেও অলোকরঞ্জনের স্বভাব ও ভাষার দীপ্তি একটুও ম্লান হয় না। তা সে ভ্রমণে নয়, ভুবনেই হোক আর পুথিপটই হোক। পুথিপট-এর অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রায়তনের মধ্যেই নানা বিষয়ে তিনি ঠেসে দিয়েছেন তাঁর ভাবনাগুলো। দেশ বিদেশের কত যে প্রসঙ্গ তাতে পুষ্পিত হয়ে উঠেছে!
তাঁর মতো আর কে একই সঙ্গে দেশি ও বিদেশি লেখক ও লেখার তাৎপর্য আবিষ্কারের ক্ষেত্রে সন্তোষজনক সংবেনশীলতা ও মননের চিহ্ন রেখে গেছেন? মননে ও মনীষায় অলোকরঞ্জন আমাদের অতুলনীয় এক ব্যক্তিত্ব।
ন্যানো কাব্যতত্ত্বের জনক কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিন জন্ম ৬ মে ১৯৬৫ সালে, শরীয়তপুর। কবি ও প্রাবন্ধিক হিসেবে তিনি লেখক ও পাঠক মহলে নন্দিত হয়ে আছেন সৃজনশীলতা ও মননের এক অনন্য ভুবন নির্মাণের কারণে। অনুবাদক হিসেবেও তিনি ভিন্ন পথের নির্মাতা। হোর্হে লুইস বোর্হেসসহ লাতিন আমেরিকার বহু লেখককে তিনি বাংলা ভাষায় ব্যাপকভাবে পরিচিত করে তুলেছেন অনুবাদের মাধ্যমে। দুই বাংলায় তিনি আমাদের একমাত্র বোর্হেস-বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। রাজু আলাউদ্দিন-এর কবিতা ও প্রবন্ধ ইতিমধ্যে ইংরেজি, সুইডিশ এবং স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ছাব্বিশ।