ভূমিকা
আমাদের মিশর ভ্রমণের প্রথম পর্বে ছিল কায়রো এবং দ্বিতীয় পর্বে ছিল আলেকজান্দ্রিয়া। ভ্রমণ সূচির তৃতীয় পর্বে, অর্থাৎ আলেকজান্দ্রিয়ার পর্বের শেষে, আমাদের গন্তব্য ছিল লুক্সর। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে মেহেরুন ও আমি সড়ক পথে কায়রো যাই এবং সেখান থেকে মেহেরুনের বান্ধবী সিস্টার মাইকে নিয়ে আমরা তিনজন বিমানে করে লুক্সর গিয়েছি। অন্যদিকে সিস্টার মাইয়ের মা, মামী এবং ছোট তিন বোন আমাদের ভ্রমণ সঙ্গী হিসেবে যুক্ত হয়েছেন লুক্সরে। কয়েক ঘন্টা পরেই তারা আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ট্রেনে করে লুক্সর পৌঁছেন। লুক্সরে আমরা সবাই চার দিন ছিলাম। তারপর নীল নদের নৌবিহারে তিন রাত ও চার দিন কাটিয়ে অবশেষে আমরা পৌঁছেছি আমাদের শেষ গন্তব্য আসওয়ানে।
যাহোক, লুক্সরের বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপনা, নীল নদের নৌবিহার এবং আসওয়ান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে সাজানো হয়েছে ‘বাইরে দূরে মিশর ঘুরে’।
লুক্সর: প্রাচীন মিশের ধর্মীয় রাজধানী
একসময় লুক্সর ছিল প্রাচীন মেম্ফিসের ধর্মীয় রাজধানী এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানব সভ্যতার এক অনন্য সমৃদ্ধ ইতিহাস। আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগে মেম্ফিসের (বা আধুনিক মিশরের) প্রধান শহর এবং দীর্ঘ সময় ধরে প্রাচীন মিশরের রাজধানী ছিল থেবস, বর্তমানে যার নাম লুক্সর। ‘লুক্সর’ আরবি শব্দ ‘আল-উকসুর’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ‘দুর্গ’। লুক্সর নীল নদের পূর্ব এবং পশ্চিম তীর এলাকায় বিভক্ত। প্রাচীনকালে এই দুই এলাকা যথাক্রমে জীবন ও মৃত্যুকে বোঝাত। কেননা জনবসতি গড়ে উঠেছিল নীল নদের পূর্ব তীরে এবং সেখানেই ফারাওরা গড়ে তুলেছিল রাজধানী শহর, রাজমন্দির এবং অন্যান্য স্থাপনা। অন্যদিকে পশ্চিম তীরের বিরান পাহাড়ী জায়গায় নির্মিত হয়েছিল ফারাওদের সমাধি ও মর্গ মন্দির। আশ্চর্যের বিষয় যে, সেখানে ন্যূনতম বসতি গড়ে উঠেছে। যাই হোক, লুক্সরেই অবস্থিত মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম ধর্মীয় কমপ্লেক্স কারনাক মন্দির, যেখানে প্রাচীন মিশরের বিভিন্ন সময়ে অনেক দেবতার উপাসনা করা হতো।
লুক্সরে যাওয়ার দুটি প্রধান কারণ ছিল। প্রথম কারণ ছিল লুক্সরের প্রাচীন স্থাপনা দেখা। কেননা লুক্সরেই রয়েছে প্রাচীন মিশরের (ফারাওদের আমলের) উল্লেখযোগ্য অনেক স্থাপনা, যেমন কার্নাক মন্দির, লুক্সর মন্দির, ভ্যালি অব দ্য কিংক্স, ভ্যালি অব দ্য কুইনস্, হাতশেপসুত মর্গ মন্দির এবং মেনমনের বিশাল মূর্তি বা কলোসি অব মেনমন। এছাড়া শহরের মাঝে রয়েছে লুক্সর জাদুঘর এবং বেলুনে চড়ে আকাশ ভ্রমণ। দ্বিতীয় কারণ ছিল লুক্সর থেকে আসওয়ান পর্যন্ত নাইল রিভার ক্রুজে যাওয়া এবং এবং পথের মাঝে নীল নদের তীর ঘিরে গড়ে উঠা এডফু ও কম ওম্প মন্দির দর্শন। বলাবাহূল্য, উল্টো পথেও রিভার ক্রুজের ব্যবস্থা আছে। তারপর আসওয়ানে আমাদের ভ্রমণ সূচীতে ছিল আসওয়ান বাঁধ এবং ফিলাই মন্দির দেখা।
কারনাক মন্দির: প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় স্থান
[শুরুতেই বলা প্রয়োজন যে, লুক্সরের অদূরে কারনাক মন্দিরে আমরা তিনবার গিয়েছি। দিনের বেলা মন্দির দেখার জন্য প্রথমবার গিয়েছি সিস্টার মাইয়ের সঙ্গে এবং দ্বিতীয়বার গিয়েছি ‘নাইল রিভার ক্রুজ’ ট্যুর প্যাকেজের অংশ হিসেবে (নাইল রিভার ক্রুজ প্রসঙ্গে পরে আলাদা ভাবে বিস্তারিত আছে)। তৃতীয়বার গিয়েছি সন্ধ্যার পরে দৃষ্টিনন্দন ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’ দেখার জন্য। তাই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতি একাকার করে লিপিবদ্ধ করেছি। বলা বাহূল্য, মন্দির সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য ও পরিসংখ্যান সিস্টার মাই ও ট্যুর গাইডের কাছ থেকে জেনেছি এবং বাকিটুকু পরে বিভিন্ন পুস্তক পড়ে ও ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করেছি। লেখার ভেতর প্রাসঙ্গিকভাবে সব সূত্রের কথা উঠে এসেছে।]
অনেক অনেক দিন আগের কথা।
প্রাচীন মিশরে রাজ্য পরিচালনা করতেন রাজারা। প্রাচীন সময়ের রাজাদের প্রথম রাজবংশ (সময়কাল: ২৯২০-২৭৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) থেকে ত্রিশ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান সাম্রাজ্য মিশর দখল না করা পর্যন্ত তৎকালীন মিশরের রাজাদের ফারাও হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। তবে পুরাতন রাজবংশে রাজাদের জন্য ফারাও উপাধি ব্যবহার করা হয়নি। তখন তাঁদের তিনটি উপাধি ছিল: হোরাস, সেজ ও বী, এবং নেবটি। পরবর্তীতে রাজাদের নামের সঙ্গে গোল্ডেন হোরাস, নোমেন এবং প্রিনোমেন খেতাব যুক্ত হয়। রাজা Merneptah (শাসনকাল: ১২২০-১২০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) শাসনামলের সময় থেকে রাজাদের জন্য ফারাও উপাধি চালু হয়।
মিশরের প্রাচীন অধিবাসীরা দেখেছে সূর্য পূর্ব দিকে উদয় হয়ে নীল নদ পাড়ি দিকে ক্রমশ পশ্চিম দিকে ঝুলে পড়ে। প্রতি সন্ধ্যায় সূর্যকে পশ্চিম আকাশে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া দেখে তারা ভাবতো আকাশ নিশ্চয়ই সূ্র্যটাকে গিলে ফেলেছে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে রাতের বেলা ডুবে যওয়া সূর্য পুনরুজ্জীবিত হয়ে পরের দিন পুনরায় পূর্ব দিগন্তে আবির্ভূত হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, প্রাচীনকালে মিশরীয় রাজারা নিজেদেরকে সূর্য্য দেবতার সন্তান ভাবতেন। সূর্য্য দেবতার প্রতি তাঁদের, এমনকি সাধারণ জনগণেরও, গভীর বিশ্বাস ছিল। এখানে বলা প্রয়োজন যে, পৃথিবীর সব নদ-নদীর উৎস উত্তরে এবং প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ দিকের সাগরে পতিত হয়। কিন্তু নীল নদ একমাত্র নদ, যার পানি সনাতন নিয়ম ভেঙে উল্টো পথে চলে, অর্থাৎ দক্ষিণ থেকে প্রবাহিত হয়ে উত্তর দিকে ভূমধ্যসাগরের পড়েছে। মিশরের প্রাচীন অধিবাসীরা দেখেছে সূর্য পূর্ব দিকে উদয় হয়ে নীল নদ পাড়ি দিকে ক্রমশ পশ্চিম দিকে ঝুলে পড়ে। প্রতি সন্ধ্যায় সূর্যকে পশ্চিম আকাশে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া দেখে তারা ভাবতো আকাশ নিশ্চয়ই সূ্র্যটাকে গিলে ফেলেছে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে রাতের বেলা ডুবে যওয়া সূর্য পুনরুজ্জীবিত হয়ে পরের দিন পুনরায় পূর্ব দিগন্তে আবির্ভূত হয়। প্রাচীনকাল থেকে মিশরীয়রা এই সহজ প্রাকৃতিক পর্যবেক্ষণ ব্যবহার করে উত্তর-দক্ষিণ এবং মহাজাগতিক পূর্ব-পশ্চিম অক্ষের ওপর ভিত্তি করে একটি সুন্দর বিশ্বের স্বপ্ন গড়ে তুলেছিল। সেই স্বপ্ন গড়ার ভিত্তি ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সূর্যকে তারা দেবতা মনে করতো।
দ্বাদশ রাজবংশের (সময়কাল: ১৯৯৪-১৭৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) শুরুর দিকে সূর্য্য দেবতা বিশ্বাসী এমনই এক ফারাও ছিলেন রাজা প্রথম সেনুসরেট (Senusret I)। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ১৯৬৪ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক। তাঁর সখ হয়েছিল তিনি সূর্য্য দেবতা ‘আমুন-রা’-কে উৎসর্গ করে একটা মন্দির নির্মাণ করবেন এবং সেখানে দেবতার জন্য পূজা-অর্চ্চনা করবেন। উল্লেখ্য, দ্বাদশ রাজবংশ থেকেই ‘আমুন-রা’ দেবতাদের দেবতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তবে প্রাচীন কালের অন্যান্য অনেক মিশরীয় দেবতাদের মতো ‘আমুন-রা’ সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। তবে তাঁকে প্রায়ই ‘গরীবের উজির’ (ভিজিয়্যার) বলে অভিহিত করা হতো।
যাহোক, তৎকালীন সময়ে রাজা প্রথম সেনুসরেটের সখ বা ইচ্ছের বিরুদ্ধে মাথা তোলার মতো কেউ সাহসী ছিল না। আসলে রাজার ইচ্ছে বা সখ বলে কথা। তাই একসময় শুরু হয়ে যায় প্রাচীন মিশরের রাজধানী থেবসের অদূরে কারনাক নামক জায়গায় মন্দির নির্মাণের কাজ। মিশরের প্রাচীন হায়রোগ্লিফিস্ ভাষায় কারনাক শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘পছন্দনীয় জায়গা’। জায়গাটি বর্তমানের লুক্সর শহরের কেন্দ্র থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার উত্তরে এবং জায়গার নামেই মন্দিরটির নামকরণ করা হয় ‘কারনাক মন্দির’।
যেহেতু কারনাক মন্দিরটি দেবতাদের রাজা আমন রা-কে উৎসর্গ করা হয়েছিল, তাই মন্দিরটির আরেক নাম ‘গ্রেট টেম্পল অব আমুন’ (আমুনের মহামন্দির)। প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় কারনাক মন্দিরের নাম ছিল ‘Ipetisut’ (ইংরেজিতে ‘The Most Selected of Places’, বাংলায় অনেকটা ‘সর্বাধিক নির্বাচিত স্থান’)। কারনাক মন্দির মূলত: এক শ’ একর জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল মিডল্ কিংডমের সময়ে (২১০০-১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এবং শেষ হয়েছে টলেমিক যুগে (সময়কাল: ৩০৫-৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), অর্থাৎ মন্দির চত্বরের বিভিন্ন অংশ এবং স্থাপনা তৈরি করতে মোট সময় লেগেছে দেড় হাজার বছরের বেশি সময়। এই দীর্ঘ সময়ে ত্রিশজন ফারাও রাজ্য শাসন করেছেন। কয়েক হাজার বছরের পুরনো কারনাক মন্দিরকে প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় স্থান হিসেবে গণ্য করা হয়। বলা বাহূল্য, গিজার পিরামিড এবং স্ফিংক্সের পরেই কারনাক মন্দির হচ্ছে দর্শনার্থীদের কাছে সমগ্র মিশরের দর্শনীয় স্থান।
যাহোক, সাত-সকালে লুক্সরের হোটেলে পৌঁছার পরে কয়েক ঘন্টা গভীর ঘুমে ডুবেছিলাম। মধ্য দুপুরে ঘুম থেকে জেগে হালকা গরম পানিতে গোসল করি। তারপর নিচে নেমে আমরা লাঞ্চ করতে যাই। লাঞ্চ সেরে সিস্টার মাই, মেহেরুন এবং আমি একটা টেবিলে বসে গাল-গল্পের খই ভাজছিলাম। তখন আমার মনটা ফুরফুরে এবং শরীরটা চাঙ্গা লাগছিল। খাবার টেবিলে বসে মাই হয়তো কোনো ফাঁকে আপন মনে ভেবেছিল, রোদ ঝলমল দিনের বাকি সময়টুকু রুমে বসে অযথা গল্প করার কোনো মানে হয় না। তাই হুট করে মোবাইলে সময় দেখে সে প্রস্তাব করে, ‘চলো, তিনজন মিলে কারনাক মন্দির ঘুরে আসি। মাত্র আড়াইটা বাজে।’
আচমকা মাইয়ের প্রস্তাব শুনে আমি একপলক মেহেরুনের দিকে তাকাই এবং পরখ করার চেষ্টা করি তার চোখেমুখে ক্লান্তি-অবসাদের কোনো ধূসর মেঘ জমে আছে কি না। মেহেরুনও আমার দিকে তাকায়, হয়তো একই কারণে। আমাদের চোখেমুখে ছিঁটেফোঁটা চিহ্ন ছিল না। তাই রাজি না হওয়ার কোনো অজুহাত খাড়া করতে পারিনি।
একসময় আমি বৃষ্টি-ভেজা পাখির ডানা ঝাপটানোর মতো খানিকটা নড়েচড়ে শরীর থেকে আলসেমীর খড়কুটা ঝেড়ে মাইকে বললাম, ‘তবে তাই হোক।’ মেহেরুন আমার কথায় সায় জানায়।
আমরা রুমে ফিরে যাই এবং পনের মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়ি। বলতে হবে আমাদের প্রতি ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন ছিল। তাই হোটেলের গেইটের সামনে তৎক্ষণাৎ একটা খালি ট্যাক্সি পেয়ে যাই।
একসময় আমরা কাউন্টারের কাছে এলে আমি টিকেট কেনার জন্য এগিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেই, কিন্তু পরমুহূর্তেই পিছিয়ে আসি। সিষ্টার মাই এগিয়ে যায় এবং টিকেট কাটে। মেহেরুন এবং আমি যেহেতু বিদেশী, তাই আমাদের প্রত্যেকের জন্য টিকেটের মূল্য ছিল ঈজিপশিয়ান দুই শ’ পাউন্ড। অথচ মিশরীয়দের জন্য প্রবেশ টিকেট মাত্র দশ পাউন্ড।
মিনিট দশেকের মধ্যে ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদের মেইন গেইটের সামনে নামিয়ে দেয়। সেখানে ট্যাক্সি, বাস এবং অন্যান্য যানবাহন জটলা বেঁধে আছে। সত্যি কথা বলতে কি, আমি এতো পর্যটক কায়রো অথবা আলেকজান্দ্রিয়ার কোনো দর্শনীয় জায়গায় দেখিনি। মেইন গেইটের একপাশে রয়েছে টিকেট কাউন্টার। সেখানে দর্শনার্থীদের দীর্ঘ লাইন। মাথার ওপর দুপুরের রোদ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের কাছে শর্টকাট কোনো পথ না থাকার জন্য আমরা লাইনে দাঁড়াই। একসময় আমরা কাউন্টারের কাছে এলে আমি টিকেট কেনার জন্য এগিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেই, কিন্তু পরমুহূর্তেই পিছিয়ে আসি। সিষ্টার মাই এগিয়ে যায় এবং টিকেট কাটে। মেহেরুন এবং আমি যেহেতু বিদেশী, তাই আমাদের প্রত্যেকের জন্য টিকেটের মূল্য ছিল ঈজিপশিয়ান দুই শ’ পাউন্ড। অথচ মিশরীয়দের জন্য প্রবেশ টিকেট মাত্র দশ পাউন্ড। যাহোক, আমরা বাইরের গেইট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করি। মন্দির চত্বরে ঢোকার পশ্চিম দিকের প্রবেশ পথ বেশ খানিকটা দূরে। সেই পথের দু’পাশে স্যুভেনির ও হালকা খাবারের দোকান।
দোকান পেরিয়ে কিছুটা পথ হেঁটে গেলে সামনেই রয়েছে প্রথম পাইলন এবং সেখানেই প্রবেশদ্বারের দু’পাশে রয়েছে উঁচু দেওয়াল বা প্রাচীর। আমাদের দ্বিতীয় দফা ভ্রমণের সময় ট্যুর গাইড বলেছে, ত্রিশতম ডাইনেষ্টির (সময়কাল: ৩৮০-৩৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রাজা প্রথম নেকটানেবো (রাজত্বকাল: ৩৮০-৩৬২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) দেওয়াল দুটি নির্মাণ কাজ শুরু করেন, কিন্তু তিনি তা জীবিত থাকাকালীন সময় সমাপ্ত করতে পারেননি। আজো দেওয়াল দুটি অসমাপ্ত রয়ে গেছে। বাম (উত্তর) এবং ডান (দক্ষিণ) দিকের দেওয়ালের উচ্চতা ভিন্ন (নিচের ছবি দ্রষ্টব্য)। বর্তমানে উত্তর দিকের প্রাচীরের উচ্চতা প্রায় একাত্তর ফুট (আনুমানিক বাইশ মিটার) এবং দক্ষিণ দিকের প্রাচীর এক শ’ তিন ফুট (প্রায় বত্রিশ মিটার)। যদি কাঠামো সম্পন্ন হতো, তাহলে দেওয়াল দুটির উচ্চতা সম্ভবত এক শ’ চব্বিশ ফুট (আটত্রিশ মিটার) থেকে এক শ’ একত্রিশ ফুটের (চল্লিশ মিটার) মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো। যাহোক, অনেক পুরাতত্ত্ববিদ গবেষকরা মনে করেন যে, প্রথম নেকটানেবোর শাসনামলের আগে সেখানে অসমাপ্ত দেওয়াল দুটির অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু প্রমাণ করার মতো কোথাও কোনো শিলালিপির হদিস পাওয়া যায়নি।
মন্দিরে ঢোকার আগে, অর্থাৎ উঁচু দেওয়ালের সামনে, পথের দু’ধারে সারি সারি ভেড়ার মাথার (র্যাম-হেডেড) স্ফিংক্স। জানি না, সেদিন প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম হওয়ার কোনো বিশেষ ঘটনা ছিল কি না। যাহোক, আমরা সেই পথ ধরে মন্দির চত্বরে ভেতরে প্রবেশ করি। কারনাক মন্দিরের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর দশটি বড় পাইলন (উঁচু টাওয়ারের মতো স্থাপনা), গ্রেট হাইপোস্টাইল হল, পবিত্র হ্রদ, একাধিক উপমন্দির, অসংখ্য মন্দির এবং কয়েকটি ওবেলিস্ক (পাথরের তৈরি উঁচু স্মৃতিস্তম্ভ)। এসব স্থাপনাগুলো আলাদা নাম আছে। প্রাচীন মিশরীয় রাজাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্দির ছিল। বর্তমানে কারনাক মন্দির চত্বরের মধ্যে মাত্র এক-চতুর্থাংশ দর্শকের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। বাকি জায়গায় সাধারণ দর্শকদের জন্য প্রবেশের সুযোগ নেই। মন্দিরের অভ্যন্তরে এখনো তিন ফারাওয়ের আলাদা জায়গা চিহ্নিত করা আছে।
কারনাক মন্দিরের সবচেয়ে নান্দনিক স্থাপনা ‘গ্রেট হাইপোস্টাইল হল’, যা টেম্পল অব আমুন-রে (সূর্য দেবতা আমুন-রে) প্রাঙ্গণে অবস্থিত। হলের উত্তরের প্রাচীর নির্মাণ করেন উনিশতম রাজবংশের (সময়কাল: ১২৯১-১১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রাজা প্রথম সেটি (রাজত্বকাল ১২৮৯-১২৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। পরবর্তীতে তাঁর ছেলে দ্বিতীয় দ্বিতীয় র্যামসেস দক্ষিণের প্রাচীর তৈরি করেন এবং সেই প্রাচীরের গায়ে হিটিতদের সঙ্গে তাঁর শান্তি চুক্তির দলিল লেখা আছে। পরবর্তীতে তৃতীয় র্যামসেস, চতুর্থ র্যামসেস এবং ষষ্ঠ র্যামসেস সহ অন্যান্য ফারাওরা প্রতিটি দেওয়াল ও স্তম্ভের গায়ে খোদাই করে প্রাচীন ভাষায় (হায়রোগ্লিফিসে) শিলালিপি যোগ করেন। সেই সব শিলালিপির নিঁখুত কারুকাজ আজও দেখা যায়। গ্রেট হাইপোস্টাইল হলের মধ্যে ষোলটি সারিতে এক শ’ চৌত্রিশটি বিশাল স্তম্ভ রয়েছে। এই স্তম্ভগুলির মধ্যে এক শ’ বাইশটির উচ্চতা দশ মিটার করে এবং বাকি বারোটি স্তম্ভ একুশ মিটার উঁচু ও ব্যাস তিন মিটার।
গ্রেট হাইপোস্টাইল হলের মাঝে বৃহদায়কার স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে আমি রীতিমতো হা করে ওপরে দিকে তাকিয়ে স্তম্ভগুলো বিশালতা অনুভব করার চেষ্টা করি। তখন আমি হারিয়ে যাই স্কুল জীবনে। স্মৃতির জোনাকিরা যেন চোখের সামনে ঝলমল করে ওঠে। বিশ্বনন্দিত আইরিশ লেখক জোনাথান সুইথট্ (১৬৬৭-১৭৪৫)-এর উপন্যাস ‘গালিভার’স্ ট্রাভেলস্’ আমাদের পাঠ্য ছিল। স্কুলে বিনোদ বিহারী চক্রবর্তী স্যার আমাদের এত সহজ এবং সাবলীয় ভাষায় ‘গালিভার’স্ ট্রাভেলস্’ পড়িয়েছেন যে, আমরা ক্লাশে প্রায় সবাই একটা অলৌকিক ঘোরের মধ্যে বুঁদ হয়ে থেকেছি। পঞ্চাশ বছর পরেও আমার স্পষ্ট মনে আছে লিলিপুট এবং ব্রবডিংনাগের কাহিনি। দৈহিক গড়নে লিলিপুটের মানুষজন ছিল খর্ব এবং সেখানে গালিভার ছিল রীতিমতো দৈত্য। অন্যদিকে ব্রবডিংনাগের মানুষদের আকৃতি ছিল বিশাল এবং সেখানে গালিভার ছিল খর্বাকৃতির। গ্রেট হাইপোস্টাইল হলের মাঝে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছে, স্তম্ভের পাশে আমি লিলিপুট শহরের খর্বাকৃতি মানুষ আর স্তম্ভগুলো গালিভারের মতো বিশাল।
চোখেমুখে একটা ঘোর নিয়ে আমরা গাইডকে অনুসরণ করি। একটা বৃহদায়কার মূর্তির সামনে গিয়ে সে থমকে দাঁড়ায়। আমরাও দাঁড়াই। তখন ওখানে প্রচন্ড ভীড়। কয়েকটি দল সেই মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছে তাদের নিজেদের গাইডের ধারাবিবরণী। ভীড় খানিকটা পাতলা হওয়ার জন্য আমাদের গাইড অপেক্ষা করে।
ভদ্রতার খাতিরে সে আমাদের সঙ্গে বিশাল দেহী দ্বিতীয় র্যামসেসের পরিচয় করিয়ে দেয়। রাজা দ্বিতীয় র্যামসেসের মাথায় আপার ও লোয়ার মিশরের দ্বৈত মুকুট এবং তাঁর বাহু দুটি ক্রস করা, যা রাজত্বের প্রতীক। তাঁর দু’পায়ের মাঝে রাজকুমারী বেন্ট’আন্তা একটি ফুল ধরে আছে এবং তাঁর মাথায় ইউরেয়াস মুকুট পরে যেখানে কোবরা সাপ রয়েছে।
মিনিট কয়েকের মধ্যে ভীড় হালকা হয়। তারপর আমাদের গাইডের মুখে অনর্গল কথার খই ফোঁটে। কয়েকটা খই অবশ্য ধরতে পারিনি, কানের পাশ দিয়ে ফসকে গেছে। যাহোক, ভদ্রতার খাতিরে সে আমাদের সঙ্গে বিশাল দেহী দ্বিতীয় র্যামসেসের পরিচয় করিয়ে দেয়। রাজা দ্বিতীয় র্যামসেসের মাথায় আপার ও লোয়ার মিশরের দ্বৈত মুকুট এবং তাঁর বাহু দুটি ক্রস করা, যা রাজত্বের প্রতীক। তাঁর দু’পায়ের মাঝে রাজকুমারী বেন্ট’আন্তা একটি ফুল ধরে আছে এবং তাঁর মাথায় ইউরেয়াস মুকুট পরে যেখানে কোবরা সাপ রয়েছে। তাঁর মা ছিলেন ইসেটনোফ্রেট, র্যামসেসের দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্ত্রী। ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রথম স্ত্রী ফারাও রানী নেফারটারি ছাড়াও দ্বিতীয় র্যামসেসের আরও সাত জন স্ত্রী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ঔরশজাত কন্যা রাজকুমারী বেন্ট’আন্তা ছিলেন পঞ্চম স্ত্রী এবং তাঁদের ঘরে কম হলেও এক সন্তানের জন্ম হয়েছিল। এছাড়া তিনি আরও দুই কন্যাকে (মেরিটামেন ও নেবেট-টাউই) বিয়ে করেছিলেন। আসলে সেই সময় প্রাচীন মিশরে সেটাই ছিল স্বাভাবিক নিয়ম।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল মন্দিরের ভেতরের দুটি বিশাল স্মৃতিস্তম্ভ (ওবেলিস্ক)। পাথরের তৈরি বৃহত্তর ওবেলিস্ক, যা প্রাচীন মিশরের দ্বিতীয় স্মৃতিস্তম্ভ, নির্মাণ করেন রাণী হাটসেপসুট (রাজত্বকাল ১৪৭৩-১৪৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। স্মৃতিস্তম্ভটি উচ্চতা প্রায় ত্রিশ মিটার এবং ওজন ৩৪৩ টন। তবে অবাক করার বিষয় যে, মাত্র একটি গোলাপী গ্রানাইট পাথর কেটে স্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় স্তম্ভটি ছোট এবং পঁচাত্তর ফুট উঁচু ও আনুমানিক এক শ’ পঞ্চাশ টন ওজন। এটি নির্মাণ করেন প্রথম তুথমোজি (রাজত্বকাল: ১৫০৪-১৪৯২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। উভয় স্তম্ভের গায়ে খোদাই করা কারুকাজ। এছাড়া মন্দির চত্বরে আরও বেশ কয়েকটি ওবেলিস্ক ছিল, কিন্তু সেগুলো হয় ধ্বংস করা হয়েছে অথবা ভেঙে ফেলা হয়েছে।
প্রাচীন মিশরে ফারাও রাজারা সূর্য ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য ওবেলিস্ক নির্মাণ করতেন। তাঁরা নিজেদের সূর্যের পুত্র হিসেবে চিহ্নিত করতো। তাঁদের বিশ্বাস মতে, পিরামিড আকৃতির উপরের অংশ পৃথিবীতে পতিত সূর্যের রশ্মির প্রতিনিধিত্ব করে, যা সাধারণত স্বর্ণ, ব্রোঞ্জ বা ধাতুর শঙ্কর দিয়ে আবৃত থাকতো। কেননা তাতে সূর্যের আলো পড়ে উজ্জ্বল দেখায়। এছাড়া তাঁরা কোনো বিশেষ ঘটনার সম্মানার্থে কিংবা কারোর প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য ওবেলিস্ক নির্মাণ করেছেন। ওবেলিস্কের চারপাশে খোদাই করে ফারাওদের শৌর্য-বীর্যের কাহিনি লিপিবদ্ধ করে গৌরবান্বিত করা হতো। বলা হয়, ওবেলিস্ক স্থিতিশীলতা এবং স্থায়ীত্বের প্রতীক।
কারনাক মন্দির চত্বরের শেষ দিকে হাতের ডানে রয়েছে পবিত্র হ্রদ (সেকরেড লেইক), যা আরবিতে ‘বিরকেট এল-মাল্লাহ’ (লেক অফ দ্য সল্ট প্যান) নামে পরিচিত। কারণ হ্রদের পানি সামান্য লবণাক্ত (অবশ্য চেখে দেখিনি)।
আমি যখন প্রথম নিজের চোখে দেখি, তখন আমার কাছে হ্রদ হিসেবে মেনে নিতে পারিনি। বরং আমাদের দেশের বড় পুকুর কিংবা দীঘি বা বড়সর জলাশয় বলা যেতে পারে। যাহোক, হ্রদ, বড় পুকুর কিংবা দীঘি বা জলাশয় – যে নামেই সম্বোধন করি না কেন, সেকরেড লেইকের তাতে কিছু যায় বা আসে না।
পবিত্র জলাশয়টি খনন করা হয়েছিল রাজা তৃতীয় তুথমোসির শাসনামলে (১৪৭৩-১৪৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এবং খননের পরে নীল নদের পানি দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছিল। জলাশয়টি আয়তক্ষেত্রাকার এবং দৈর্ঘে ৪২৩ ফুট (১২৯ মিটার) ও প্রস্থে ২৫২ ফুট (৭৭ মিটার)। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, জলাশয়টির প্রকৌশলীগত নকশা, যা রীতিমতো ফ্যারাওনিক সভ্যতার অন্যতম রহস্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কথিত আছে, খননের পরে নীল নদের পানি দিয়ে একটা নির্দিষ্ট উচ্চায় পূর্ণ করার পরে বিগত প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরেও জলাশয়ের পানি শুকিয়ে যায়নি, এমনকি নীল নদের বন্যায়ও পানির স্তর উপরে ওঠেনি। অলৌকিক, নাকি কাকতালীয়— কেউ জানে না।
কথিত আছে, সারাদিন হাঁস এবং অন্যান্য পাখিরা জলাশয়ে সাঁতার কাটতো এবং সন্ধ্যায় রাজার ভোজের জন্য রাজপ্রাসাদের খাবার টেবিলে পরিবেশন করা হতো।
মূলত: জলাশয়ের পানিতে মন্দিরের পুরোহিতরা পবিত্র হতো এবং ধোয়ার কাজে ব্যবহার করতো। এছাড়া জলাশয়টি ছিল দেবতা আমুনের পবিত্র ‘হাঁস’ (বলা বাহূল্য, হাঁস আমুনের আরেকটি প্রতীক) এবং এটি ছিল প্রাচীন মিশরীয় সৃষ্টির ধারণায় জীবনের উৎপত্তি হওয়া প্রাথমিক পানির প্রতীক। জলাশয়ের চারপাশে ছিল পুরোহিতদের বাসস্থান এবং জিনিসপত্র মজুদ করার জন্য ঘরবাড়ি। এছাড়াও জলজ পাখিদের জন্য একটি ‘পাখিমহল’ (এভিয়ারি) ছিল। কথিত আছে, সারাদিন হাঁস এবং অন্যান্য পাখিরা জলাশয়ে সাঁতার কাটতো এবং সন্ধ্যায় রাজার ভোজের জন্য রাজপ্রাসাদের খাবার টেবিলে পরিবেশন করা হতো। গাইডের মুখে এসব গল্প-কাহিনি শোনার পর চট করে আমার মনে পড়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘একটি মোরগের কাহিনি’, যেখানে অবশেষে মোরগটির স্থান হয় ‘ধবধবে দামী কাপড়ে ঢাকা খাবার টেবিলে, অবশ্য খাবার খেতে নয়— খাবার হিসেবে।
পবিত্র জলাশয়ের এক কোণে রয়েছে গুবরে পোকার ভাস্কর্য। আমি মনোযোগ দিয়ে ভাবছিলাম দুনিয়াতে এত জন্তু-জানোয়ার এবং পশু-পাখি থাকতে একটা গুবরে পোকার মূর্তি, তা-ও ফারাও রাজাদের ইচ্ছে মাফিক তৈরি? গাইড বললো যে, ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেমের রাজত্বকালে (১৩৮৭-১৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মূর্তিটি তৈরি করা হয়। প্রাচীন মিশরীয়রা সূর্য দেবতা আমুন-রা-এর প্রতিনিধি হিসেবে গুবরে পোকাকে পূজা করতো। কেননা গুবরে পোকার গড়িয়ে চলা এবং আকাশের বুকে সূর্যের চলার মধ্যে একধরনের সাদৃশ্য রয়েছে। আমি আপনমনে বললাম, লজিকটা ছেলেমানুষী হলেও, কিন্তু মন্দ নয়।
পবিত্র জলাশয় সম্পর্কে একাধিক মিথ বা পৌরাণিক কাহিনি চালু আছে। যেমন: জলাশয়ের পানির স্তর নেমে যাওয়া শুরু হলে দুনিয়া থেকে মানব অস্তিত্ব মুছে যাবে; যদি কোনো নারী বন্ধ্যা হয় কিংবা গর্ভধারণে সমস্যা থাকে, এমনকি যারা দ্রুত সন্তান প্রসব করতে চায়, তাদের জন্য জলাশয়ের পানি সব সমস্যার মুশকিল আছান; জলাশয়ের পানি অনেক রোগের চিকিৎসা করে, যার ঔষধ এখনো উদ্ভাবন করা হয়নি এবং লুক্সরের অনেক লোক বিশ্বাস করে যে জলাশয়ের কাছে সে তার স্বপ্নের কথা বা ইচ্ছে প্রকাশ করলে তা সত্য হবে।
আসলেই কারনাক মন্দির এক অদ্ভূত সুন্দর জায়গা, দৃষ্টিনন্দন এবং মনে রাখার মতো। স্মৃতির পাতায় অনেকদিন সমুজ্জ্বল থাকবে। উল্লেখ্য, কারনাক মন্দির চত্বরে আংশিক শুটিং হয়েছিল আগাথা ক্রিস্টির ‘ডেথ অন দ্য নাইল’ মিস্ট্রি থ্রিলার উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন। ছবিটি পরিচালনা করেন বিখ্যাত পরিচালক ও অভিনেতা স্যার কেনেথ ব্র্যানা। এছাড়া জেমস্ বন্ড মুভি ‘দ্য স্পাই হু লাভড্ মী’ এবং ‘দ্য মামি রিটারনস্’ চলচ্চিত্রের বিশেষ অংশের চিত্র ধারণ করা হয়েছে কারনাক মন্দির চত্বরে ।
তবে যারা পুরনো স্থাপত্য দেখতে ভালোবাসেন এবং প্রাচীন ইতিহাস জানতে আগ্রহী বা ইচ্ছুক, তাদের অনুরোধ করবো যেন সময় ও সুযোগ পেলে যেন একবার দেখে আসেন কি অবাক করা জিনিস তৈরি করেছিল ফারাওরা। বর্তমানে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে কারনাক মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।
যদিও বর্তমানে বয়সের ভারে নুব্জ্য, তবুও ভগ্ন শরীর নিয়ে কারনাক মন্দিরের স্থাপনাগুলো কয়েক হাজার বছর ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো আগামি আরও কয়েক হাজার বছর এমনই ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে লক্ষ কোটি দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করবে।
পর্যটকদের জন্য লুক্সরের নিশি ভ্রমণের সবচেয়ে জনপ্রিয়, আকর্ষণীয় এবং পছন্দনীয় জায়গা হল কারনাক মন্দিরের ‘আলো এবং শব্দ’ (লাইট অ্যান্ড সাউন্ড) অনুষ্ঠান। তাই লুক্সরে দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় আমাদের গন্তব্য ছিল কারনাক মন্দিরের ‘আলো এবং শব্দ’ শো দেখা । প্রতিদিন ইংরেজিতে ধারাবিবরণী শুরু হয় সন্ধ্যা সাতটায় এবং অনুষ্ঠানটির মেয়াদ প্রায় দেড় ঘন্টা । ইংরেজি এবং আরবী ছাড়াও অন্যান্য ভাষায় ধারাবিবরণী দেওয়া হয় । যাহোক, সিস্টার মাই, মেহেরুন এবং আমি যথারীতি ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি । সেই শো-র প্রবেশ মূল্য ঈজিপশিয়ান তিন শ’ পাউন্ড। আশ্চর্যের বিষয়, একমাত্র দর্শনীয় জায়গা যেখানে দেশি এবং বিদেশি দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রবেশ মূল্যের কোনো তারতম্য নেই । সবার জন্য সমান ।
লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখার জন্য যেতে হয় মন্দির চত্বরের শেষ মাথায়। সেখানে দর্শনার্থীদের বসার জন্য সিমেন্টের তৈরি সিনেমা হলের সিটের মতো কয়েক সারি টানা বেঞ্চ আছে। মাথার ওপর হা করা খোলা আকাশ। বলতে হয় সেদিন আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। সেই সোনালি সন্ধ্যারাতে কোথাও বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা ছিল না এবং চারপাশে ছিল হালকা বাতাসের ছড়াছড়ি। শো দেখতে প্রচুর দর্শকের সমাগম হয়েছিল। একসময় গমগম আওয়াজের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। ব্যাকগ্রাউন্ডে হরেক রঙের লাইটের বিচিত্র ব্যবহার। সবাই খানিকটা নড়েচড়ে বসে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সবার মধ্যে নেমে আসে নিস্তব্ধতা। সবার দৃষ্টি সামনের দিকে প্রসারিত এবং তাদের মনোযোগ গাঢ় হয় ভরাট কন্ঠের ধারাবিবরণীতে। এতে রয়েছে ফারাও রাজাদের কর্মকাণ্ডের বিবরণী এবং কারনাক মন্দিরের ইতিহাস ও স্থাপনার বিবরণ। মন্দিরের দেয়ালে ফারাওদের কাল্পনিক ছবি দেখানো হয়, তার সঙ্গে লুক্সর এবং মন্দিরের ইতিহাসের বর্ণনা দেওয়া হয়। সেই আলোকিত বিশাল মন্দিরের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়েছিল যে, আমরা যেন কিছু সময়ের জন্য শত শত বা হাজার বছর আগে ফিরে গিয়েছি।
শো শেষে ফেরার পথে সিস্টার মাই ও মেহেরুনের পেছনে আমি একধরনের মুগ্ধতা নিয়ে হাঁটছিলাম। একসময় সিস্টার মাই বলল, ‘জানো, ওরা হয়তো বিদেশি দর্শক ভেবে একটা কথা বলেনি। প্রাচীনকাল থেকে নীলনদ খাবার পানি সরবরাহ এবং দুপাশের জমিতে ফসলাদি উৎপন্ন করার জন্য পানি ব্যবহার করে আসছে। তাই পানি ব্যবহারের প্রতিদান হিসেবে অতীতে প্রতি বছর একজন করে তরুণীকে অর্ঘ্য হিসেবে নীলনদে বিসর্জন দিত।’
আমি কিছুই বললাম না । কি-ই বা বলব ।
কিছুক্ষণ হাঁটার পরে আমরা মূল গেটের বাইরে এসে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা হোটেলে ফিরে যাই ।
ফেরার পথে অলস মনে ভাবতে থাকি, আসলেই কথাটি শতভাগ সত্যি। কথাটি ছিল এরকম: কারনাক মন্দির কমপ্লেক্স পরিদর্শন ছাড়া লুক্সরের কোনো ভ্রমণই সম্পন্ন হয় না ।
গল্পকার, ছড়াকার এবং অনুবাদক। লেখালেখির শুরু সত্তরের মাঝামাঝি। ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতায়, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তার মৌলিক এবং অনুবাদ গল্প। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে দুটি গল্পের সংকলন, চন্দ্রপুকুর (২০০৮) ও কতটা পথ পেরোলে তবে (২০১০)। এছাড়া, তার অনুবাদে আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৩), নির্বাচিত নোবেল বিজয়ীদের সেরা গল্প (২০১৩), ইরানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৪), চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প ও নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে।