বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

ফজল হাসানের ধারাবাহিক ভ্রমণগদ্য : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-৪র্থ পর্ব

0

হাটশেপসুটের মর্গ মন্দির: প্রাচীন মিশরের বিস্ময়কর স্থাপনা ও অকল্পনীয় শিল্পকর্ম


‘যা ধ্বংসস্তূপে ছিল, আমি তা উথ্থিত করেছি। আমি পুনরুদ্ধার করেছি, যা ধ্বংস করা হয়েছিল… আমি আদেশ করেছি যে, আমার খেতাব থাকবে পাহাড়ের মতো দৃঢ়; যখন সূর্য উজ্জ্বল হয়ে আলো ছড়াবে, তখন তার রশ্মি এসে আমার মহিমাকে আলোকিত করবে এবং দেবতা হোরাস আমার রাজার ব্যানারের উপরে থাকবে… চিরদিনের জন্য।’

সাড়ে তিন হাজার বছর আগে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাগুলো বলেছিলেন পঞ্চম ফারাও রানি হাটশেপসুট (রাজত্বকাল: ১৪৭৯-১৪৫৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)।


আরও পড়ুন : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-১ম পর্ব


রানি হাটশেপসুট ছিলেন নতুন রাজত্বের (নিউ কিংডম) আঠারোতম রাজবংশের (সময়কাল: ১৫৫০-১২৯১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) রাজা প্রথম তুথমোজিস (রাজত্বকাল: ১৫০৪-১৪৯২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ও রানি আহমোজের কন্যা। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার কোনো ভাই না থাকার কারণে বাবা বুদ্ধিমতি কন্যাকে রাজ্যভার দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ফারাও রাজা হওয়ার সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কোনো নারী তখতে তাউসে আরোহণ করে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করার সুযোগ ছিল না। তাই রাজা সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি তার রক্ষিতা মুতনেফার্তের গর্ভজাত পুত্র দ্বিতীয় তুথমোজিসের সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দেবেন। তখন হাটশেপসুটের বয়স চব্বিশ বছর এবং দ্বিতীয় থুতমোসিসের বয়স একুশ বছর। যাহোক, স্বামী দ্বিতীয় তুথমোজিসের (রাজত্বকাল: ১৪৯২-১৪৭৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) মৃত্যুর পর সেই যুগে তিনি পুরুষ শাসিত সমাজে নারী হয়ে রাজকার্য চালিয়েছিলেন। তার রাজত্বকাল নিয়ে ঈজিপ্টোলজিষ্ট এবং গবেষকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কারোর ধারণা তার রাজত্বকাল ছিল ১৫০৪-১৪৮২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ কিংবা ১৪৯০/৮-৪৬৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ, আবার অনেকে অনুমান করেন যে, তার শাসনকাল ছিল ১৪৭৯-১৪৫৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ অথবা ১৪৭৩-১৪৫৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। তবে শাসনকাল যা-ই হোক না কেন, তিনি সৎ পুত্র তৃতীয় তুথমোজিসের সঙ্গে যৌথভাবে সাত বছর রাজ্য পরিচালনা করেন। একসময় তিনি নিজেকে ফারাওয়ের ‘পূর্ণ রাজকীয় নামধারণ’ করেন এবং সৎ পুত্রকে বঞ্চিত করে নিজেই রাজ্য পরিচালনার পুরো দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং দক্ষতার সঙ্গে দুই দশকেরও বেশি সময় রাজ্য শাসন করেন। তিনি ছিলেন বুদ্ধিমতি এবং আত্মপ্রত্যয়ী নারী। হাটশেপসুট নামের অর্থ ‘ফরমোষ্ট অব দ্য নোবেল লেডিজ’ বা ‘সম্ভ্রান্ত মহিলাদের অগ্রগামী’।

শুধু তাই করে তিনি ক্ষান্ত থাকেননি, বরং তিনি নিজের নামও পরিবর্তন করেছিলেন। আমাদের দেশে এমন কিছু নারীদের নাম আছে, যেগুলোর শেষে ‘আকার’ বাদ দিলেই পুরুষদের নাম হয়ে যায়, যেমন রহিমা থেকে রহিম, আনিসা থেকে আনিস, সুলতানা থেকে সুলতান, নাবিলা থেকে নাবিল ইত্যাদি।

প্রাচীন মিশরে ফারাও রাজাদের স্ত্রী হিসেবে অনেকেরই হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাদের মধ্যে নেফারতেরি (রাজা দ্বিতীয় রামজিসের স্ত্রী) এবং নেফারতিতি (চতুর্থ আমেনহোটেম বা আখেনাতের স্ত্রী) অন্যতম। কিন্তু রানি হাটশেপসুট ছিলেন নিজের গুণেই মহিলা রাজা। তাই তিনি নারী থেকে পুরুষের বেশভূষায় রাজা হিসেবে রাজকার্য পরিচালনায় বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন। কেননা তৎকালীন সময়ে আদেশ, ন্যায় বিচার এবং সম্প্রীতির দেবী মাত-এর সঠিক আদেশ বজায় রাখার জন্য ফারাওকে পুরুষ হওয়ার শর্ত ছিল। নারী ফারাওয়ের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। তাই তিনি রাজকার্যের সময় পুরুষের পোশাক পরতেন এবং পুরুষের মতো নিজের থুতুনিতে নকল দাড়ি লাগাতেন। তিনি আদেশ দিয়েছিলেন যে, তাকে যেন দাড়ি এবং মাংসল পেশীর পুরুষ ফারাও হিসেবে চিত্রিত করা হয়। শুধু তাই করে তিনি ক্ষান্ত থাকেননি, বরং তিনি নিজের নামও পরিবর্তন করেছিলেন। আমাদের দেশে এমন কিছু নারীদের নাম আছে, যেগুলোর শেষে ‘আকার’ বাদ দিলেই পুরুষদের নাম হয়ে যায়, যেমন রহিমা থেকে রহিম, আনিসা থেকে আনিস, সুলতানা থেকে সুলতান, নাবিলা থেকে নাবিল ইত্যাদি। হয়তো সেই একই রকম ভাবে রানি হাটশেপসুট যখন রাজা হিসেবে নিজেকে উন্মোচিত করেছিলেন, তখন তিনি তার নিজের পুরুষ নাম রেখেছিলেন হাটশেপসু, অর্থাৎ তিনি নামের শেষে ‘ট’ অক্ষরটি খারিজ করেছিলেন।

‘ভ্যালী অব দ্য কিংক্স’-এর পরে আমাদের ভ্রমণ সূচির দ্বিতীয় পর্বে ছিল ফারাও রানি হাটশেপসুট মর্গ মন্দির (ম্যরচুয়্যারি টেম্পল) পরিদর্শণ করা। বলা হয়, মন্দিরটি তৎকালীন সময়ের অন্যতম সেরা বিস্ময়কর স্থাপনা, অকল্পনীয় শিল্পকর্ম।


আরও পড়ুন : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-২য় পর্ব


যখন ফারাওরা তাদের সমাধিস্থলগুলো লুকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তাদেরকে একটি পৃথক স্থান নির্মাণ করতে হয়েছিল, যেখানে যাজকরা তাদের স্মৃতিকে দীর্ঘ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্মান জানাতে পারে। সেই উদ্দেশ্যকে লক্ষ্য করে রানি হাটশেপসুট খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৭৯ সালে নীল নদের পশ্চিম তীরে কারনা পাহাড়ের পাদদেশে মর্গ মন্দির নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন এবং মন্দিরটির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করতে প্রায় পনের বছর সময় লেগেছিল। জানা যায়, সূর্য্য দেবতার কাছ থেকে শক্তি এবং কর্ম ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য রানি হাটশেপসুট মর্গ মন্দিরে যেতেন। মন্দিরটি নকশা করেছিল সেই আমলের বিখ্যাত স্থপতি সেনেমুট (বা সেনেনমুট)। সে একই সঙ্গে রানির প্রধান উজিরের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। মন্দিরটির তিনটি স্তর রয়েছে এবং প্রতিটি স্তরে রয়েছে আলাদা বিশাল স্তম্ভ। সিঁড়ি বেয়ে এক তলা থেকে অন্য তলায় যেতে হয়।


EP_4_1

হাটশেপসুটের মর্গ মন্দির (ম্যরচুয়্যারি টেম্পল)


ধূ ধূ ফাঁকা জায়গার মাঝখানে এতিম রাস্তা শুয়ে আছে। আশেপাশে কোনো লোকালয় নেই । তবে দূরে মানুষের বসতির চিহ্ন দেখা যায়, কিন্তু সবুজ গাছ-গাছালীর উপস্থিতি দেখা যায় না । জনমানবহীন রাস্তা ধরে মিনিট কুড়ি চলার পরে মর্গ মন্দিরের প্রবেশ গেইটের কাছে নির্ধারিত পার্কিং জায়গায় গাড়ি থামে। ইতোমধ্যে সেখানে দশ কিংবা বারোটা বাস, অনেকগুলো মাইক্রোবাস এবং কয়েকটি প্রাইভেট গাড়ি থেমেছিল। মাইক্রোবাস থেকে নেমে আমরা মূল প্রবেশদ্বারের দিকে যাই। সেখানেও পর্যটকদের ভিড়। যাহোক, গাইড আমাদের একপাশে দাঁড় করিয়ে রেখে ভিড়ের মাঝে ঢুকে কাউন্টার থেকে টিকেট কিনে আনে। বিদেশীদের জন্য টিকেটের মূল্য মিশরীয় এক শ’ চল্লিশ পাউন্ড এবং মিশরীয়দের জন্য দশ পাউন্ড।

গাইড টিকেট নিয়ে ফিরে এলে আমরা তাকে অনুসরণ করি। কেননা গাড়ি পার্কিং থেকে কিছুটা পথ হাঁটতে হয় এবং তারপর বিশেষ ধরনের গাড়ি (বা সড়ক ট্রেন) করে মন্দিরের সিঁড়ি কাছে যেতে হয়। হাঁটা পথের দুপাশে সারি বাঁধা স্যুভেনিরের অসংখ্য দোকান। দোকানীরা রাস্তার খানিকটা জায়গা দখল করে বিভিন্ন ধরনের স্যুভেনির বিছিয়ে রেখেছে। কেউ আবার হাতে নিয়ে ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। পর্যটকরা যাওয়া ও আসার পথে থেমে স্যুভেনির জাতীয় জিনিসপত্র নেড়েচেড়ে দেখছে এবং কেউ কেউ পছন্দ মতো স্যুভেনির কিনে নিয়ে যাচ্ছে।


EP_4_2

মেইন গেইট থেকে মন্দিরের সিঁড়ি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য সড়ক ট্রেন


যাহোক, গাড়িগুলো দেখতে অনেকটা বিমানবন্দর টার্মিনাল থেকে প্লেনে লাগেজ তোলার ট্রেনের মতো তিনটা কম্পার্টমেন্ট আছে। তবে সেগুলোতে ছাদ এবং বসার জায়গা আছে। অবশ্য অনেকে দাঁড়িয়ে থেকে চতুর্দিকের নান্দনিক দৃশ্যাবলী উপভোগ করেন। গাইড আমাদের সবাইকে একটা কম্পার্টমেন্টে তুলে দেয় এবং আমার বসতে পেরেছিলাম। এক মিনিটের মধ্যে আমরা মন্দিরের সিঁড়ির কাছাকাছি পৌঁছি। খামের উপর ডাকটিকেট যেন আটকে থাকে, তেমনই আমার দৃষ্টি আটকে ছিল দূরের মর্গ মন্দির ভবনের সঙ্গে। বিশাল পাহাড়ের ঢালুতে নির্মিত মন্দির সত্যি অবাক করার মতো স্থাপনা, মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার মতোই।


আরও পড়ুন : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-৩য় পর্ব


সড়ক ট্রেন থেকে নেমে আমরা গাইডকে খুঁজে পাইনি। সিস্টার মাইয়ের আন্টি গাইডকে ফোন করে এবং জানতে পারেন যে, সে আমাদের সঙ্গে একই গাড়িতে আসতে পারেনি। পরের গাড়িতে আসছে। সেই ফাঁকে আমরা কয়েক কদম এগিয়ে যাই। সেখানে রয়েছে দুটি সুগন্ধি গাছের শুকিয়ে যাওয়া অবশিষ্টাংশ। পাশে ইংরেজিতে লেখা আছে, ‘দিস ট্রী ওয়াজ ব্রট ফ্রম পান্ট বাই হাপশেপসুত’স এক্সপেডিশন হুইচ জ ডিপিক্টেড অন দ্য টেম্পল ওয়ালস’, যা বাংলায় তরজমা করলে এ রকম দাঁড়ায়: ‘এই গাছটি হাতশেপসুটের অভিযানের সময় পান্ট থেকে আনা হয়েছিল, যা মন্দিরের দেওয়ালে অঙ্কিত করা হয়েছে।’ জানা যায়, মন্দিরের কাছ রোপন করার পরে গাছ দুটি প্রায় তিন হাজার বছর বেঁচেছিল।

পাশে ইংরেজিতে লেখা আছে, ‘দিস ট্রী ওয়াজ ব্রট ফ্রম পান্ট বাই হাপশেপসুত’স এক্সপেডিশন হুইচ জ ডিপিক্টেড অন দ্য টেম্পল ওয়ালস’, যা বাংলায় তরজমা করলে এ রকম দাঁড়ায়: ‘এই গাছটি হাতশেপসুটের অভিযানের সময় পান্ট থেকে আনা হয়েছিল, যা মন্দিরের দেওয়ালে অঙ্কিত করা হয়েছে।

কথিত আছে যে, অন্য সব ফারাও রাজাদের মতো সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য এবং শত্রুপক্ষকে পরাজিত করার নেশায় হাটশেপসুট পান্টে অভিযান চালাননি, বরং তিনি সেখানে থেকে বিলাসবহুল পন্য এবং বিদেশি দ্রব্যসামগ্রী, যেমন আবলুস কাঠ, হাতির দাঁত, চিতাবাঘের চামড়া, স্বর্ণ এবং সুগন্ধি গাছ, এনেছেন। বলা হয়, পান্ট (সম্ভবত বর্তমানের ইরিত্রিয়া) অভিযান তার জীবনের অন্যতম সফলতা। তবে এ কথা সত্যি যে, হাটশেপসুট তার আগে মিশরের যে কোনো পুরুষ শাসকের চেয়ে বেশি স্থাপনা তৈরি করেছেন।


EP_4_3

মন্দিরের সিঁড়ির সামনে শুকিয়ে যাওয়া সুগন্ধি গাছ, যা পান্ট বাণিজ্য অভিযানের সময় আনা হয়েছিল


একসময় নিচের তলায় ডান ও বাম পাশে বিদেশি গাছগাাছালি ঘেরা বাগান এবং জলাধার ছিল, কিন্তু বর্তমানে কোনো কিছুই নেই। উঠানের পিছনে বর্গাকার স্তম্ভ ছিল। তবে সাজসজ্জার মধ্যে রয়েছে আমুনের সামনে তৃতীয় তুথমোসিসের নাচের ভঙ্গি এবং দক্ষিণ মিশরের জলাভূমি চিত্রিত কিছু দৃশ্য। সেখানের দেখার মতো তেমন কিছুই নেই। আমরা প্রথম তলা পেরিয়ে তোরণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় তলায় যাই। সেখানে বাম পাশে রয়েছে দেবী হাথোর এবং ডান পাশে আনুবিসের জন্য তীর্থ মন্দির। দেবী হাথোরের তীর্থ মন্দিরের দেওয়ালে হাথোরকে চিত্রিত করা হয়েছে একজন মহিলার মুখ, কিন্তু গরুর কান এবং তার হাতে ধরা আছে বাদ্যযন্ত্র। সিঁড়ির ডান পাশে রয়েছে ‘বার্থ কলোনেড’ (বিশাল স্তম্ভ), যা ঈশ্বর আমুনের সঙ্গে হাটশেপসুটের সৃষ্টির গল্প জড়িত। এছাড়া বাম দিকে রয়েছে ‘পান্ট কলোনেড’, যেখানে অভিযানের কাহিনী চিত্রায়িত করা হয়েছে।

তৃতীয় তলার সামনের দিকে মুখ করে সারি বাঁধা একটি পোর্টিকো দেখতে পেলাম। এছাড়াও উঠানের পিছনের দিকে আমুনের পবিত্র স্থান দেখেছি। জানা যায়, সেই পবিত্র স্থানটি টলেমীর আমলে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল এবং ইমহোটেপকে পুনরায় উৎসর্গ করেছিল। সাড়ে তিন হাজার বছর পরেও দেওয়ালের গায়ে অঙ্কিত চিত্রকর্মের রং উজ্জ্বল।

তৃতীয় তলার সামনের দিকে মুখ করে সারি বাঁধা একটি পোর্টিকো দেখতে পেলাম। এছাড়াও উঠানের পিছনের দিকে আমুনের পবিত্র স্থান দেখেছি। জানা যায়, সেই পবিত্র স্থানটি টলেমীর আমলে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল এবং ইমহোটেপকে পুনরায় উৎসর্গ করেছিল। সাড়ে তিন হাজার বছর পরেও দেওয়ালের গায়ে অঙ্কিত চিত্রকর্মের রং উজ্জ্বল। এছাড়া তৃতীয় তলার দেওয়ালে অঙ্কিত উল্লেখযোগ্য চিত্র হলো উড়ন্ত শকুন, যার পাহারায় রয়েছে সারিবাঁধা কোবরা। উল্লেখ্য, প্রাচীন মিশরে কোবরা ছিল সার্বভৌমত্ব, রয়্যালটি, দেবতা এবং ঐশ্বরিক কর্তৃত্বের প্রতীক।

আমরা গাইডকে অনুসরণ করি। সে আমাদের তৃতীয় তলার ডান দিকে নিয়ে যায়। সেখানে মাঝারি আকৃতির একটা আলাদা কক্ষ রয়েছে, যেখানে ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে পশু জবাই করা হতো। কক্ষের মধ্যে যে জায়গায় জবাই করার জন্য জন্তু-জানোয়ারদের শোয়ানো হতো, সেখানে অবকাঠামোর চিহ্ন এখনো টিকে আছে।


EP_4_4

মর্গ মন্দিরের দেওয়ালে অঙ্কিত চিত্র – হাশেপসুট (পুরুষ বেশে, ডান দিকে) অর্ঘ্য দিচ্ছে বাজপাখির-মাথা দেবতা হোরাসকে (বাম দিকে)


হাটশেপসুট একমাত্র নারী ফারাও, যার সৎ ছেলে তৃতীয় টুথমোসিস ভীষণ চটেছিল। কেননা বাবা দ্বিতীয় তুথমোজিসের মৃত্যুর পরে তার সঙ্গে যৌথভাবে রাজ্য পরিচালনা করলেও একসময় তাকে সরিয়ে হাটশেপসুট নিজেই পূর্ণ ক্ষমতা দখল করেন। বলা হয়, সেই ক্ষমতা দখলের নেপথ্যে ছিল বহির্বিশ্বের আক্রমণের আশংকা এবং সেই সময় তৃতীয় টুথমোসিস ছিল নেহায়েত বালক। যাহোক, হাটশেপসুটের মৃত্যুর পর তৃতীয় তুথমোজিসের রাজত্বের শেষের দিকে তৃতীয় টুথমোসিস হাটশেপসুটের স্মৃতির নিদর্শণ ধ্বংস করার আদেশ করেছিল। হাটশেপসুটের মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছিল, দেওয়ালে অঙ্কিত তার ছবিগুলো নষ্ট করা হয়েছিল, এমনকি কারনাক মন্দিরে তার বিশাল ওবেলিস্ক লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেই ধ্বংসাত্বক কাজ ছিল নির্দিষ্ট এবং সীমিত পরিসরে। জানা যায়, শুধুমাত্র রাজা হিসেবে হাটশেপসুটের চিহ্নগুলো লক্ষ্য করা হয়েছিল। মর্গ মন্দির এখনো সেই সব ধ্বংসাত্বক চিহ্ন বহন করে চলেছে। তবে ফারাও রাজার স্ত্রী হিসেবে হাটশেপসুটের ছবি এবং স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে রক্ষা করা হয়েছিল এবং পরর্তীতে তা থেকে এখনকার মর্গ মন্দিরটি পুনঃনির্মিত হয়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা যে, তৃতীয় তুথমোজিসের ব্যক্তিগত আক্রোশ নয়, বরং রাজা হিসেবে হাটশেপসুটের নাম মুছে দেওয়া ছিল প্রধান কারণ। কেননা তৃতীয় টুথমোসিস চায়নি যে, রাজা হিসেবে হাটশেপসুটের নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা থাক। তাই পরবর্তী রাজাদের তালিকা থেকে হাটশেপসুটের নাম বাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হাটশেপসুটের স্মৃতিস্তম্ভ এবং তার খ্যাতি আজও একজন অসাধারণ মহিলা হিসেবে টিকে আছে।


EP_4_5

মর্গ মন্দিরের তৃতীয় তলায় হাটশেপসুটের ধ্বংসপ্রাপ্ত মূর্তি


ফারাও রানি হাটশেপসুটের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে মুখরোচক গল্প চালু আছে। কথিত আছে, রানি হাটশেপসুট এবং স্বামী দ্বিতীয় থুতমোসিসের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক বেশি ভালো ছিল না। একদিকে রানি হাটশেপসুটের ছিল স্বামীর চেয়ে বেশি এবং অন্যদিকে দৈহিক গড়নে দ্বিতীয় থুতমোসিস ছিল দূর্বল। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, রাজ স্থপতি সেনেসুটের সঙ্গে তার প্রণয় সম্পর্ক ছিল এবং তাদের সে সম্পর্কে নমুনা পাওয়া যায় মর্গ মন্দিরের দেওয়ালে খোদাই করা একটা বিশেষ চিত্রকর্মে। ঈজিপ্টোলজিষ্ট (যারা প্রাচীন মিশরের ভাষা, ইতিহাস এবং সংস্কৃতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও পন্ডিত), গবেষক ও পুরাতত্ত্ববিদদের মতে দেওয়ালের সেই চিত্রকর্মটি হাটশেপসুট এবং তার প্রেমিক মন্দিরের স্থপতি সেনসুটের শারীরিক মিলনের দৃশ্য। এছাড়া হাটশেপসুট স্পষ্টতই সেনেমুটকে মর্গ মন্দিরের মধ্যে তার নিজের নাম এবং চিত্র লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। মর্গ মন্দির থেকে বেরিয়ে আসার পরে সড়ক ট্রেনের দিকে যাওয়ার সময় বাম দিকের পাহাড়ের দিকে আঙুল তুলে একটা দরজা দেখিয়ে গাইড বলেছে যে, সেখানে আছে সেনসুটের কবর। আমরা অবশ্য সেখানে যাইনি, তবে নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছি।

ঈজিপ্টোলজিষ্ট (যারা প্রাচীন মিশরের ভাষা, ইতিহাস এবং সংস্কৃতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও পন্ডিত), গবেষক ও পুরাতত্ত্ববিদদের মতে দেওয়ালের সেই চিত্রকর্মটি হাটশেপসুট এবং তার প্রেমিক মন্দিরের স্থপতি সেনসুটের শারীরিক মিলনের দৃশ্য। এছাড়া হাটশেপসুট স্পষ্টতই সেনেমুটকে মর্গ মন্দিরের মধ্যে তার নিজের নাম এবং চিত্র লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দিয়েছিলেন।

তবে ফেরার পথে গাইড মন্দির সম্পর্কে যে একটা ঘটনার কথা বলেছে, তা শুনে আমি রীতিমতো হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৯৭ সালের ১৭ নবেম্বর। সেদিন সকাল পৌনে ন’টায় ছয়জন চরমপন্থী স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র এবং ছুরি দিয়ে বাটষট্টিজনকে হত্যা এবং ছাব্বিশজনকে আহত করেছিল, যাদের বেশিরভাগই ছিল পর্যটক। চরমপন্থীরা ছিল ইসলামী দল ও জিহাদ তালাত আল-ফাথের সদস্য।

একজন বিচক্ষণ মহিলার পরিকল্পনা বলেই হয়ত মর্গ মন্দিরের গঠন অন্য সব মন্দির থেকে ভিন্ন রুচির এবং মেজাজের। ফিরে আসার সময় একবার পেছন দিকে তাকাই। নিঃসন্দেহে প্রাচীন মিশরের অতুলনীয় মন্দিরগুলোর মধ্যে শিল্প নৈপুন্য, সুরক্ষিত এবং সৃষ্টিশীলতায় অনন্য স্থাপনা হাটশেপসুটের মর্গ মন্দির, যা আজো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মুগ্ধ করে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

গল্পকার, ছড়াকার এবং অনুবাদক। লেখালেখির শুরু সত্তরের মাঝামাঝি। ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতায়, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তার মৌলিক এবং অনুবাদ গল্প। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে দুটি গল্পের সংকলন, চন্দ্রপুকুর (২০০৮) ও কতটা পথ পেরোলে তবে (২০১০)। এছাড়া, তার অনুবাদে আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৩), নির্বাচিত নোবেল বিজয়ীদের সেরা গল্প (২০১৩), ইরানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৪), চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প ও নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।