অ্যালাবাস্টার শপ: যেখানে ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’
হাটশেপসুট মর্গ মন্দির এবং ভ্যালি অব দ্য কিংক্স দেখার পর আমাদের ভ্রমণসূচিতে ছিল কলোসাই অব মেমনন বা মেমননের বিশাল মূর্তি দেখা। ভ্রমণসূচিতে অ্যালাবাস্টার শপে যাওয়ার কথা ছিল না। অথচ ট্যুর গাইড আমাদের সেখানে নিয়ে যায়। তার ভাষ্য অনুযায়ী বুঝতে পারি যে, অ্যালাবাস্টার শপে না গেলে আমরা, অর্থাৎ পর্যটকরা, ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা অর্জনের অপূর্ব সুযোগ হারাব। সত্যি কথা বলতে কি, অ্যালাবাস্টার শপের ভেতর যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। কেননা এধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছি কায়রোর পারফিউম শপ, ঈজিপশিয়ান কটন শপ, প্যাপিরাস শপ এবং কার্পেট ফ্যক্টরিতে। তাই অ্যালাবাস্টার শপের অভিজ্ঞতা বলার আগে কায়রোর পারফিউম শপের অভিজ্ঞতার কথা বলা প্রয়োজন বলে মনে করছি।
আরও পড়ুন : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-১ম পর্ব
কায়রোতে ট্যুর গাইড ভ্রমণসূচির বাইরে আমাদের পারফিউম শপে নিয়ে গিয়েছিল। তখন সময় ছিল সন্ধ্যা। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে বেশ ক্লান্ত ছিলাম এবং মেজাজের পারদ সামান্য উঁচুতে ছিল। আমার ইচ্ছে ছিল হোটেলে ফিরে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বাইরে কোনো এক রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেতে যাব। যাহোক, আমরা যেহেতু গাইডের জিম্মায় ছিলাম, তাই মনের বিরুদ্ধে ভেতরে ঢুকতে বাধ্য হয়েছি। কেননা প্যাকেজ ট্যুরে গেলে অবশ্যই গাইডের কথা শুনতে হয়। নইলে উটকো ঝামেলা হতে পারে।
পারফিউম শপের ভেতরে ঢোকার পরেই কেন জানি মনে হয়েছিল আমরা অদৃশ্য একটা ফাঁদে পা দিয়েছি। দোকানের ভেতর উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। বিভিন্ন ধরনের পারফিউমের সুঘ্রাণ মৌ মৌ করছিল। কাচের শো-কেসের ভেতরে সাজানো বিভিন্ন আকৃতির হরেক রকম সুগন্ধি। গাইড আমাদের দোকানের মালিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে উল্টোদিকের একটা টেবিলে গিয়ে বসে। মালিকের নূরানী চেহারা। অনর্গল ইংরেজি বলে। আমাদের কোনোরকম সুযোগ না দিয়ে তিনি প্রায় পনের মিনিট তার সুগন্ধির প্রশংসা করেন, এমনকি কোন সুগন্ধি কোন ধরনের পরিস্থিতি বা পরিবেশে ব্যবহার করতে হয়, তা-ও বলতে কসুর করেননি। তার নিজের বিশাল ফুলের বাগান আছে এবং সেখান থেকেই তিনি সুগন্ধি তৈরি করেন। বোতলের আকৃতি এবং কোন সুগন্ধি, তার উপর নির্ভর করে মূল্য। অবশ্য বেশি পরিমান কিনলে স্পেশাল ডিল বা ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়। শুরু আমি উশখুশ করছিলাম। তাকিয়ে দেখি মেহেরুন নিবিড় মনে শুনছে। আমরা কেউ সুগন্ধি ব্যবহার করি না এবং আমাদের আগ্রহও নেই। এছাড়া আমি ভ্রমণে আসার আগে বিভিন্ন পর্যটকদের মতামত এবং তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পেরেছি যে, এসব জায়গাগুলো ‘ক্রেতাদের পকেট ফাঁকা করার অদৃশ্য ফাঁদ’। দোকানের মালিক কিংবা কর্মচারীরা চা-কফি বা কোমল পানীয়, এমনকি বিদেশি সিগারেট পরিবেশন করে ক্রেতাদের আপন করে নিতে চায়। এছাড়া তারা দীর্ঘ সময় নিয়ে পণ্য দেখানোর ফাঁকে ক্রেতাদের মনে এক ধরনের অপরাধবোধ সৃষ্টি করে, যাতে ক্রেতারা লজ্জায় পড়ে কিছু কিনে নেয়। আসলে স্থানীয় ব্যবসার সঙ্গে ট্যুর গাইডদের এক ধরনের অলিখিত চুক্তি থাকে এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে দু-পক্ষই লাভবান হয়। দোকান মালিক বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করে এবং ট্যুর গাইড সেই মুনাফার এটা নির্দিষ্ট অংশ পায়, যার অর্থ ক্রেতাদের জন্য উচ্চতর দাম।
আরও পড়ুন : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-২য় পর্ব
যাহোক, অধৈর্য্যের সঙ্গে ক্ষুধা এবং অন্য সব কিছু মিলিয়ে একসময় আমি মালিককে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে দাঁড়াই এবং মেহেরুন আমাকে অনুসরণ করে। তবে মালিক আমাকে আশ্বস্ত করেন যে, আমার কাছে কিছুই বিক্রি করতে না পারার জন্য তিনি মোটেও দুঃখিত বা আহত নন। আমাদের দেখে গাইড এগিয়ে আসে এবং আমরা খালি হাতে দোকান থেকে বেরিয়ে আসি।
আরও পড়ুন : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-৩য় পর্ব
হাটশেপসুট মন্দির থেকে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যালাবাস্টার ফ্যাক্টরি ও দোকানের সামনে এসে গাড়ি থামে। সেখানে সারিবদ্ধভাবে বেশ কয়েকটা দোকান। দোকানের সামনে গাড়ি থামার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা আছে। কেনাকাটায় পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য দোকানের সামনে অ্যালাবাস্টার থেকে জিনিসপত্র তৈরি করার প্রাকটিক্যাল ডেমোনেস্ট্রেশনের ব্যবস্থা রয়েছে। গাড়ি থামার পরে আমরা ছাড়া সব যাত্রীই হুড়মুড় করে নেমে যায়। অ্যালাবাস্টার শপে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। তবুও অন্যদের পেছনে গাড়ি থেকে নেমে আসি।
কার পার্কেই গাইড আমাদের সবাইকে জড়ো করে অন্য একজন স্থানীয় গাইডের হাতে তুলে দেয়। কীভাবে অ্যালাবাস্টার জিনিসপত্র তৈরি করা হয়, তা নতুন গাইড ইংরেজিতে আমাদের বর্ণনা করে এবং সেখানে নিয়ে যায়। ক্রেতা বা পর্যটকদের সামনে কারিগররা এমন ভাবে অ্যালাবাস্টারকে পুরানো পদ্ধতিতে কেটে এবং ঘষামাজা করে সুন্দর, স্বচ্ছ প্যানেল, ফুলদানি, ল্যাম্পশেড ইত্যাদি তৈরি করে যে, যা দেখলে অনেকেই সেই কষ্টকর অভিজ্ঞতার চিত্র অনুভব করতে পারে। ফলে তাদের মনের মধ্যে অপরাধবোধ জমতে থাকে।
তারপর দোকানের ভেতর নিয়ে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতে ফেলে যে, অর্ধেকের বেশি পর্যটক ওদের ট্র্যাপে আটকা পড়ে। দোকানের ভিতরে একাধিক কর্মচারী দর্শকদের আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে। এছাড়া অ্যালাবাস্টারের তৈরি জিনিসপত্রের আসল-নকল পরীক্ষা করে দেখানোর জন্য একজন অ্যালাবাষ্টারের তৈরি ফুলদানি বাতির নিচে এমনভাবে ধরে যেন ফুলদানির উজ্জ্বলতা এবং আধা-স্বচ্ছতা স্পষ্ট দেখা যায়, যাতে প্রমাণিত হয় যে, জিনিসটি খাঁটি অ্যালাবাস্টার দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তাতে ক্রেতাদের মনে বিশ্বাস জমে এবং কিনতে আগ্রহী হয়। যাহোক, আমি এক কোণে দাঁড়িয়ে লক্ষ করেছি যে, আমাদের গাইড আমাদের অন্য সব জায়গায় একটি সময় ব্যয় করেছে। কিন্তু এখানে সে আমাদের নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়নি। এখানে গাইডকে স্বাগত জানানো হয়েছিল এবং বিনামূল্যে খাবার, চা এবং সিগারেট দিয়েছে। অবশ্য অন্যদের সঙ্গে আমাকেও সেসব অফার করেছিল।
আরও পড়ুন : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-৪র্থ পর্ব
শুরু থেকেই আমি ছিলাম নির্লিপ্ত, কিন্তু মেহেরুনকে থামাতে পারিনি। সিস্টার মাইয়ের সঙ্গে দোকানে গিয়ে সে নিজের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বেশ কিছু জিনিস ক্রয় করে। বাসে উঠে দেখি অনেকেরই হাতে দোকানের প্যাকেট। উল্লেখ্য, অযথা অ্যালাবাস্টার শপে অত্যধিক সময় কাটানোর জন্য আমাদের নির্ধারিত সময়ে টান পড়ে। কেননা দুপুরের পরেই ক্রুজশিপ আসওয়ানে উদ্দেশ্যে লুক্সর ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল।
প্রচলিত প্রবাদ আছে যে, আলাবাস্টারের কথা উল্লেখ না করে কেউ মিশর সম্পর্কে কথা বলতে পারবে না। কেননা আলাবাস্টার হাজার হাজার বছর ধরে সেই ফারাওদের সময় থেকে মিশরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রাচীন ফারাও রাজারা গৃহস্থালির জিনিসপত্র, মন্দির এবং সমাধিতে সার্কোফাগাস (ভাস্কর্যশিল্পে অলংকৃত পাথরের তৈরি শবাধার) এবং ক্যানোপিক সরঞ্জামের জন্য ব্যবহার করেছে। মিশরীয় জাদুঘরের তুতানখামুন সংগ্রহে অ্যালাবাস্টারের তৈরি কিছু সেরা প্রাচীন নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। মিশরীয় শৈল্পিক হস্তশিল্পের অন্যতম পণ্য আলাবাস্টারের তৈরি হস্তশিল্পের ঐতিহ্য নিয়ে আজো মিশরীয়রা গর্ব করে।
শেষ করার আগে বলা প্রয়োজন যে, কায়রোর ঈজিপশিয়ান কটন শপ এবং প্যাপিরাস শপের অভিজ্ঞতা অনেকটা লুক্সরের অ্যালাবাস্টার শপের অভিজ্ঞতার মতোই ছিল। তবে পার্থক্য হলো অ্যালাবাস্টার শপে আমাকে টানেনি। অন্যদিকে অন্য দোকানগুলোতে মেহেরুন এবং আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে গিয়েছি এবং জিনিসপত্র কিনেছি। উল্লেখ্য, প্যাপিরাস শপের ভেতর প্রবেশ করার পরই দোকানের একজন এসে এমনভাবে সাদরে গ্রহণ করবে যে, সে দর্শণার্থী এবং ক্রেতার অত্যন্ত আপন মানুষ। তারপর সে দেখাবে প্যাপিরাস গাছের ছাল পানিতে ভিজিয়ে রাখার পরে কেমন করে কাগজ তৈরি করতে হয়। প্রাচীনকালে সেই কাগজের উপর লেখা বা চিত্রাঙ্কন করা হত, যা এখনো করা হয়।
আরও পড়ুন : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-৫মপর্ব
যাহোক, শুরুতে উল্লেখ করেছি, প্যাকেজ ট্যুরে গেলে অবশ্যই গাইডের কথা শুনতে হয়। নইলে উটকো ঝামেলা হতে পারে। এছাড়া কে এমন আছে যে ইচ্ছে করে অযথা নিজের বিপদ ডেকে আনে বা আনতে চায়। আমিও চাইনি, কিন্তু মনের বিরুদ্ধে আমাকে খানিকটা ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। তাই জীবনানন্দ দাসের ভাষায় বলতে হয় ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’ তবে অনেকেই কিন্তু অ্যালাবাস্টার শপে ট্যুর গাইড এবং দোকানীদের বিভিন্ন ধরনের ফাঁদে পড়ে ‘পকেট’ খুঁড়ে বেদনা কিনে নিয়ে যায়।
গল্পকার, ছড়াকার এবং অনুবাদক। লেখালেখির শুরু সত্তরের মাঝামাঝি। ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতায়, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তার মৌলিক এবং অনুবাদ গল্প। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে দুটি গল্পের সংকলন, চন্দ্রপুকুর (২০০৮) ও কতটা পথ পেরোলে তবে (২০১০)। এছাড়া, তার অনুবাদে আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৩), নির্বাচিত নোবেল বিজয়ীদের সেরা গল্প (২০১৩), ইরানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৪), চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প ও নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে।