আপনি যখন একটি বড়ো শহরে পৌঁছান, তখন এতটাই উত্তেজিত থাকেন যে আপনি কোন হোটেলে থাকবেন, তা নিয়ে খুব বেশি সময় চিন্তা করেন না। কেননা আপনার পথ চলার জন্য রাস্তাগুলো তাদের উপর দিয়ে আপনাকে নিয়ে যায় এবং আপনি শহর সম্পর্কে প্রত্যাশার একধরনের হালকা অনুভূতি অনুভব করেন। আপনার মনে হয় যেন বিগত বছরগুলো ধরে সে আপনার সুবিধার জন্য নিজেকে সজ্জিত করে রেখেছে। আপনি তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে সবকিছু এক ঘন্টার মধ্যে দেখতে চান এবং আপনার স্বপ্নের দুঃসাহসিক অভিযান সেই এক ঘন্টার মধ্যে সংকুচিত হয়ে আছে। দীর্ঘ যাত্রাকালে এবং যাত্রার আগে দীর্ঘ প্রস্তুতির সময় আপনার মধ্যে যে আগ্রহ কাজ করেছে, তা অজানা ভবন এবং অপরিচিত মুখগুলো দেখার মতো এত আনন্দদায়ক নয়। বাগদাদ কী বড়ো শহর ছিল? আমি দামাস্কাসে একজনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ‘অবশ্যই,’ জবাবে লোকটি বলেছিল। ‘সেখানে চৌদ্দটি ক্যাবারে আছে।’
যাহোক, ১৯৪৮ সালের অক্টোবরের প্রথম দিন আমার আগমনের পর আমি স্বল্প পরিমানে উল্লসিত হয়েছি এবং সামান্য উত্তেজনাও অনুভব করেছি। তার কারণ এই ছিল না যে, আমি লন্ডন, প্যারিস, কায়রো এবং দামাস্কাস দেখেছি। আমি আমার ভ্রমণের কথা ভুলে গেছি এবং মনে করতে পারছি না বিশ্বের এমন কোন শহর আছে যা দেখতে অবিকল– একটা ছাড়া যেকোনো শহর। একটা শহর শুধু আমি স্মরণ করতে পারি এবং সব সময় আমার মনে পড়ে। সেই শহরের ধ্বংসস্তূপের নিচে, ভস্মীভূত গাছের তলায় এবং ধ্বসে পড়া ছাদের নিচে আমি আমার জীবনের একটা অংশ চাপা দিয়ে এসেছি। আমি বাগদাদে এসেছি এবং এখনো আমার চোখ সেখানে পড়ে আছে– জেরুজালেম।
আনুমানিক আঠারো মাস আগে আমরা নয়া জেরুজালেমের কাটামন পাহাড়ী এলাকায় সদ্য নির্মিত আমাদের বাড়িতে উঠেছি। বাড়িটি ছিল আমার বাবার স্বপ্নপূরণ এবং তার সারা জীবনের ঘাম ও সঞ্চয়ের ফসল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমি ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসি।
আনুমানিক আঠারো মাস আগে আমরা নয়া জেরুজালেমের কাটামন পাহাড়ী এলাকায় সদ্য নির্মিত আমাদের বাড়িতে উঠেছি। বাড়িটি ছিল আমার বাবার স্বপ্নপূরণ এবং তার সারা জীবনের ঘাম ও সঞ্চয়ের ফসল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমি ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসি। আমি নিজের জন্য এমন সুন্দর একটা জায়গা পছন্দ করেছিলাম। জায়গাটির এক পাশের সীমানা ছিল পাহাড় এবং অন্য পাশে ছিল সুন্দর সড়ক, যা শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে মিশেছে। কিন্তু জায়গা থেকে তাকালে রিহাভিয়ার ইহুদী বসতি দেখা যেত এবং আমি ঝুল-বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতাম বৈসাদৃশ্য দম্পতিরা এসে আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। তারা ঢোকার পথে খিলান প্রবেশদ্বার দেখে আকৃষ্ট হয়েছিল এবং তারা বলেছে, সফেদ পাথরের সিঁড়িতে জিরেনিয়ামের পাশে ও দোতলায় তিন স্তম্ভযুক্ত উঁচু জানালার পাশে, যা সূর্যের আলো স্পর্শ করতে পারত, উপত্যকার উপর যেন প্রজ্জ্বলিত শিখার মতো উঠে গেছে। ‘আপনি কী ঘরে প্রবেশের অনুমতি দেন?’ তারা জিজ্ঞেস করত। অনেক সময় আমি তাদের কফি খাইয়ে আপ্যায়ন করতাম এবং তারা আমার আসবাবপত্র ও বইপুস্তক দেখে প্রশংসা করত। তারা ‘আরব জীবনযাত্রা’-র জন্য মুগ্ধ হয়ে উচ্ছ্বাস দেখাত।
আমাদের বাড়ির পাশেই দ্বিগুণ বড়ো বাড়িতে শাহিন পরিবার বাস করত। তাদের ছিল পিতৃতান্ত্রিক পরিবার: দাদা-দাদী, বাবা-মা এবং ছেলেমেয়েরা সারা বাড়ি মুখরিত করে রাখত এবং সেই বাড়িতে সুখের ইঙ্গিত থাকার জন্য আমার ভাই ও আমি আমাদের শান্ত ঘর থেকে অবাধে মন্তব্য করতাম। কিন্তু বড়ো জোর দু’মাস কেটেছে, তারপরই সেই বাড়ির সন্তানদের মধ্যে বয়সে বড়ো লেইলা শাহিন এবং আমি একজন আরেকজনকে আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করতাম। প্রথম দিকে আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী গোপনে দেখা করতাম। কদাচিৎ নেড়ি কুত্তার ঘেউ ঘেউ অবজ্ঞা করে আমরা অন্ধকারে পাহাড়ের ঢালুতে অসমাপ্ত বাড়িঘরের আশেপাশে হাঁটতাম, যতক্ষণ না আমি বলেছি, ‘এদিকে তাকিয়ে দেখ, লেইলা, আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং বিষয়টা আমি আর বেশি দিন গোপন রাখতে চাই না।’
লেইলার ছিল বাদামি রঙের দীর্ঘ চুল, যা সবসময় এলোমেলো থাকত, পিঙ্গল চোখ, বড়ো মুখ এবং উজ্জ্বল গায়ের রঙ। আমার ছোট্ট মরিস গাড়িতে চড়ে আমরা দূরে কোথাও ঘুরতে যেতাম এবং অত্যন্ত সাবধানে থাকতাম যেন বেশি লোকজনের চোখে না পড়ি। দু’বার কিংবা তিনবার আমি তাকে রিহেভিয়ার এক ইহুদী ক্যাফেতে নিয়ে গিয়েছি, যেখানে আমরা নাচতে পারতাম। আমার জন্য সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা ছিল যে, কোনো এক অপরাহ্নে ওর মা আমাদের ডেকেছিলেন। তিনি নিজেকে পরিচয় করান এবং আমার মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করেন। আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সেখান থেকে ফিরে এসে আমি লেইলা সম্পর্কে মাকে বলেছি এবং মা বলেছেন, ‘আমাদের আড়ালে ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা কী দু’জনের জন্যই লজ্জাজনক নয়? ক্যামব্রিজে কী তুমি তাই শিখেছ?’
‘কিন্তু আমি ওকে ভালোবাসি,’ আমি বলেছি।
‘আমি এসব লজ্জাজনক কথা আর শুনতে চাই না? যদি তুমি ওকে সত্যি ভালোবাসো, তাহলে একটা কিছু করো। কিন্তু মনে রেখো, এই ব্যয়বহুল বাড়ি নির্মাণ করার পরে এ মুহূর্তে বিয়েশাদীর জন্য খরচ করার মতো অর্থকড়ি নেই। তার উপর তোমার বাবা মাত্র আট মাস আগে মৃত্যুবরণ করেছেন।’
তারপর থেকে লেইলা এবং আমি জনসম্মুখে মেলামেশার শুরু করি। আমাদের উভয় পরিবারের মধ্যে যাতায়াতও চালু হয়। যাহোক, তারা যখন আমাদের দেখতে পায়নি, তখন আমরা ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাৎ করেছি। একদিন লেইলা বলেছিল, ‘তুমি কি কখনো আমাকে অনেক চুম্বন করবে? এটা ভয়ঙ্কর।’
তারপর থেকে লেইলা এবং আমি জনসম্মুখে মেলামেশার শুরু করি। আমাদের উভয় পরিবারের মধ্যে যাতায়াতও চালু হয়। যাহোক, তারা যখন আমাদের দেখতে পায়নি, তখন আমরা ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাৎ করেছি। একদিন লেইলা বলেছিল, ‘তুমি কি কখনো আমাকে অনেক চুম্বন করবে? এটা ভয়ঙ্কর।’
আমি বলেছি, ‘আমি তোমাকে পাগলের মতো চাই। শীঘ্রই আমাদের বিয়ে করা উচিত। তুমি কী আসবে এবং আমাদের সঙ্গে বসবাস করবে?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ,’ উল্লসিত হয়ে লেইলা বলেছিল।
‘এটা প্রতিবেশীদের বাড়ি যাওয়ার মতো এবং তারপরে আর কখনো ফিরে না আসার মতো, তাই না?’ মন্তব্যের সুরে আমি বলেছি।
কয়েক রাত পরে পরপর ভয়ানক বিস্ফোরণে আমরা ঘুম থেকে জেগে উঠি, যাতে আমাদের বাড়ি কেঁপে উঠেছিল। অনেক বছর ধরেই সন্ত্রাসীরা ব্রিটিশদের হত্যা করছিল। এছাড়া তারা বোমা মেরে সরকারি ভবন গুড়িয়ে দিয়েছিল এবং সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ করেছিল, এমনকি অফিসার্স ক্লাবও ধ্বংস করেছিল। তারপর তারা আরবদের হত্যা করা শুরু করে। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দু’খণ্ডে বিভক্ত করার প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং রক্তক্ষয়ী দ্বিবিভাজন অর্জণে সন্ত্রাসীরা দৃঢ় প্রতীজ্ঞা করেছিল। বাজার এলাকায় বিস্ফোরক ভর্তি অসংখ্য বোমা ছোড়া হয়েছিল এবং প্রতিবার প্রায় পঞ্চাশ জন লোক মারা গিয়েছে। এখন সেই জায়গায় আরবদের সাদা এবং গোলাপি পাথরের তৈরি বাড়িঘর। কী ঘটেছে, তা দেখার জন্য আমরা যখন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাইরে গেলাম, তখন আমাদের চোখে পড়ে প্রায় তিন শ’ গজ দূরে তিনটি বিশাল স্তূপের মধ্য থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে এবং ভোরের ঠান্ডা বাতাসে মিশে যাচ্ছে। কয়েকজন ব্রিটিশ সৈন্য সেখানে ধ্বংসস্তুপ পর্যবেক্ষণ করছিল।
আমাদের বাসা ছিল শহরের এক প্রান্তে, যা ছিল সন্ত্রাসের নাগালের মধ্যে। সন্ত্রাসী আক্রমণ থেকে নিজেদের ঘরবাড়ি রক্ষার জন্য তিনজন বা চারজন লোক রিভলবার নিয়ে প্রস্তুত থাকত। একজন গ্রামবাসী আমাকে একটা বন্দুক সেঁধেছিল। বন্দুকটি ছিল পুরনো আমলের জার্মান তৈরি মৌসার এবং তাতে ঠিক পাঁচটা গুলি ছিল। তৎক্ষণাৎ আমার ভাই সেটি কিনেছিল। কিন্তু সেই বন্দুক থেকে সে বা আমি জীবনে একটাও গুলি ছুঁড়িনি। কিভাবে গুলি ছুড়তে হয়, তা গ্রামবাসী আমাদের শিখিয়েছিল। তবে মকশো করার উছিলায় আমরা কখনই কোনো তাজা গুলি ব্যবহার করিনি।
সেই রাতে আমরা ঘুমাইনি। সন্ত্রাসীরা আসেনি। তিন রাত পরে বজ্রপাতের সঙ্গে প্রচণ্ড ঝড় উঠেছিল। ভীষণ গর্জন করে ঘন্টার পর ঘন্টা তুমুল বৃষ্টি পড়েছিল। অকস্মাৎ বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল এবং সমস্ত এলাকা জঘন্য অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলকানি আমাদের পর্দাবিহীন জানালা গলিয়ে এক ঝলক পাহাড় দেখার সুযোগ দিয়েছিল। ঘরের এক কোণায় রাইফেল দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল।
ঝড়ের শব্দ এবং বজ্রপাত ছড়া আর কিছুই শোনা যায়নি। আমাদের গায়ে ওভারকোট ছিল এবং তা নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তখন ছিল ডিসেম্বর মাস। তারপর চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলক দেখা গিয়েছিল এবং ভূমিকম্পে যেভাবে প্রকম্পিত হয়, তেমনই পুরো বাড়ি কেঁপে উঠেছিল। জানালার কাচ ভেঙে মেঝেতে পড়েছিল। আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মা আর্তচিৎকার করেছিলেন। ইয়াকুব ঘরের কোণায় দাঁড়য়ে থাকা রাইফেলের দিকে ছুটে গিয়েছিল এবং কাচ ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে গুলি করার চেষ্টা করেছিল। সে বাইরের কোনো কিছুই দেখতে পায়নি এবং বিস্ফোরণের সঙ্গে একই সময় সে একটা গাড়ি দ্রুত গতিতে চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেয়েছিল। কিন্তু রাইফেল থেকে কোনো গুলি বের হয়নি। তাই সে পুনরায় ট্রিগার টিপেছিল। হয়তো খেলনা রাইফেল ছিল। নলের ভেতর জ্যাম ছিল।
আমি যখন বাইরের দিকে তাকালাম, তখন আতঙ্কিত হয়ে কেঁদেছিলাম। শাহিনদের বাড়ি ছিল স্থাপত্যের এক বিশাল দালান, যা অন্ধকার রাতেও অস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছিল। আমরা দৌঁড়ে নিচে নেমে যাই এবং শোঁ শোঁ বাতাসের মধ্যে বাইরে বেরিয়ে পড়ি। আমরা আর কী করতে পারতাম? কয়েক মিনিটের মধ্যে অন্যান্য লোকজন এসে জড়ো হয়। আমরা পাথর সরিয়ে দেখেছি নিচে কেউ চাপা পড়ে ছিল কি না। ‘ঈশ্বর, লেইলাকে বাঁচিয়ে রাখো, লেইলাকে বাঁচিয়ে রাখো।’ আমি আপন মনে বলেছি এবং পাগলের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ধ্বংসস্তুপ, বিশাল পাথর এবং লোহার ভাঙা কাঠামো অতিক্রম করেছি। তারপর আমি হাতে নরম কিছুর স্পর্শ অনুভব করি এবং সেখানে গর্ত খনন করি। সেটি ছিল কব্জি থেকে ছিঁড়ে যাওয়া একটি হাত। লেইলার হাত ছিল এবং তৃতীয় আঙুলে পড়ানো ছিল বাগদানের আংটি। আমি বসে পড়ে অঝোর ধারায় কেঁদেছিলাম।
পরদিন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা এগারোটি মৃতদেহের টুকরো উদঘাটন করে। লেইলার হাত তার ক্ষতবিক্ষত দেহে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরিবারের সব সদস্যের জন্য এক সঙ্গে একটি জানাজা যথেষ্ট ছিল। বর্বর বেনামী শত্রুদের আমি কী করতে পারতাম? আমাদের পুরুষত্বহীনতা, নিরস্ত্র এবং প্রতিরক্ষাহীন অবস্থার জন্য আমরা প্রতিশোধের কাছে মাথা নত করেছিলাম। কিন্তু চিৎ হয়ে শোওয়া অসহায় মহিলার মতো পাহাড়ের বাড়িটি নিশাচর সন্ত্রাসীদের কাছে উন্মুক্ত এবং উন্মোচিত ছিল। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সেই বাড়ি খালি করতে হয়েছিল। আমরা বেথেলেহেমের কাছে দুই কক্ষের একটা বাড়ি পেয়েছিলাম। সেই নতুন বাড়িতে তিন রাতও থাকতে পারিনি। কেননা আমাদের পুরো বাড়ি আরেকটি বিশাল ধংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। ইয়াকুব এবং আমি ঘরের লোহার কাঠামো দেখতে গিয়েছিলাম। ভাঙাচোরা কাঠামো দেখে আমাদের মনে হয়েছে যেন ধ্বংসাবশেষ থেকে বেরিয়ে এসে বাড়িটি যেন থমথমে নীল আকাশের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে আছে। দুঃস্বপ্নের মতো গুঁড়িয়ে দেওয়া ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়েছিল।
জেরুজালেম ছিল একটি অপ্রতিরোধ্য শহর। সবচেয়ে অসংগঠিত এবং নিরস্ত্র স্বেচ্ছাসেবকেরা একটি অত্যন্ত সংগঠিত, অস্ত্রসস্ত্রে সুসজ্জিত এবং নির্মম শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিল: অপরিমিত বিস্ফোরকের বিপরীতে কয়েকটি বুলেট মাত্র। যোদ্ধাদের তাদের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী চলে যায় এবং তার পরপরই সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করার জন্য নরক চলে আসে। জেরুজালেমের সঙ্গে আমদের সংযোগ বিছিন্ন হয়ে যায় এবং গ্রেট অটোম্যান দেওয়ালের আড়ালে আরবরা আশ্রয় নিয়েছিল। কেননা সেখান থেকে তাদের রাইফেলগুলো যেন ‘জুইশ স্কাল স্কোয়াড্রন’-র সাঁজোয়া গাড়ির বহরের যাতায়াত বন্ধ রাখতে পারে। রাত এবং দিন বন্দুকের গোলাগুলির শব্দে পুরো জায়গা মুখরিত ছিল।
আরব গ্রামবাসীরা বিশ্বাসঘাতী রাতের অন্ধকারে অচেনা লোকদের হাতে গণহত্যার শিকার হয়েছিল। তারা সেসব লোকদের কখনই দেখেনি। শুধু বেপরোয়া স্বেচ্ছাসেবক ছাড়া আমাদের খ্রিষ্টান শহরকে কিছুই রক্ষা করতে পারেনি। স্বেচ্ছাসেবকেরা শহরের চারপাশে পাহাড়ের ঢালুতে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছিল। তারা হিংস্রভাবে অপেক্ষা করেছিল, আড়াল থেকে গুলি করার জন্য অপেক্ষায় ছিল, আক্রমণ করেছিল এবং অবসর নিয়েছিল। আমরা সবাই আমাদের জন্য রাইফেল ক্রয় করেছি (আমাকে অবশ্য আরেকটা কিনতে হয়েছিল)। তবে রাইফেলের মূল্য ছিল অত্যধিক (কে জানে কারা জং ধরা পুরনো ধাঁচের অস্ত্রের ব্যবসা করত এবং ভয়ানক পরিমানে লাভ করত?) যতক্ষণ না আরব লীগ এসে উদ্ধার করে, ততক্ষণ শত্রুদের পথ রুখে দেওয়ার জন্য আমরা কৌশলগত স্থান হিসেবে যেসব জায়গা বিবেচনা করতাম, সেসব জায়গায় আমরা আমাদের অবস্থান নিতাম। আমরা স্বচ্ছ রাতে নিচে নেমে বেথলেহেমের উপত্যকায় অবস্থিত চাতাল বাড়িগুলোতে যেতাম। আমি অবাক না হয়ে পারতাম না যে, ঘন সবুজ জলপাই বৃক্ষ পরিবেষ্টিত এত সুন্দর জায়গা, যা আমাদের ঘৃণা করতে অপ্রস্তুত করেছে। দুই হাজার বছর আগে দেবদূতেরা যেখানে মেষপালকদের কাছে আনন্দ ও শান্তির গান গাইতে উপস্থিত হয়েছিলেন, সেখানে প্রতিদিন আমরা মৃত্যুর বার্তাবাহকদের মুখোমুখি হয়েছি।
সময় বয়ে যায় এবং কোনো নিস্কৃতি ছাড়াই দুঃখের পর দুঃখ এসে জমা হয়। আমাদের সমস্ত ভয় থাকা সত্ত্বেও আমরা মনের মধ্যে খানিকটা আশা ধরে রাখতাম। কিন্তু প্রতিটি নতুন দিনে সেই আশা থেকে ক্রমশ আমরা একটু একটু করে খরচ করতাম। সময়টা ছিল যুদ্ধের এবং আমাদের তাই বলা হয়েছিল। সেই যুদ্ধ ছিল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বাস্তব কৌতুক এবং সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। সেখানে সৈন্যবাহিনী ছিল, বন্দুক ছিল, জেনারেল ছিল, কৌশল ছিল এবং ছিল মধ্যস্থতাকারী। কিন্তু অপসারিত এবং বাস্তুচ্যুতদের সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছিল। যদিও এক পর্যায়ে সাময়িক যুদ্ধবিরতি হয়েছিল, তবুও শরণার্থীদের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। তারা তাদের ঝোলা এবং লটবহর বহন করেছে। তারা পথের মাঝে মৃত সন্তানদের আনুষ্ঠানিক জানাজা ছাড়াই জলপাই গাছের নিচে দাফন করেছে। বুনো ফুলের মধ্যে মানুষ এবং প্রাণীর মাংসের ছেঁড়া টুকরোগুলো অবিচ্ছেদ্যভাবে একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করে থেকেছে। ‘বাইজেন্টাইন চার্চ অব ক্রাইষ্ট’স ক্যাভিটি’-এর প্রশস্ত বারান্দায় ছিন্নমূল কৃষক, খচ্চর এবং উট একসঙ্গে জড়াজড়ি করে থেকেছে এবং সেখানে ক্ষুধার্ত শিশুর কান্নাকাটির চেয়ে গাধার ডাক জোরে শোনা যেত।
তারা তাদের ঝোলা এবং লটবহর বহন করেছে। তারা পথের মাঝে মৃত সন্তানদের আনুষ্ঠানিক জানাজা ছাড়াই জলপাই গাছের নিচে দাফন করেছে। বুনো ফুলের মধ্যে মানুষ এবং প্রাণীর মাংসের ছেঁড়া টুকরোগুলো অবিচ্ছেদ্যভাবে একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করে থেকেছে। ‘বাইজেন্টাইন চার্চ অব ক্রাইষ্ট’স ক্যাভিটি’-এর প্রশস্ত বারান্দায় ছিন্নমূল কৃষক, খচ্চর এবং উট একসঙ্গে জড়াজড়ি করে থেকেছে এবং সেখানে ক্ষুধার্ত শিশুর কান্নাকাটির চেয়ে গাধার ডাক জোরে শোনা যেত।
টাউন স্কয়্যারের এক ক্যাফের মালিক লাউডস্পিকারের সঙ্গে রেডিওর ব্যাটারি সংযোগ করেছিল। নয়া জেরুজালেমে বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে ফেলার পর থেকে তার বিহীন পুরো অব্যবহৃত আসবাবপত্রের মতো বোঝা হয়ে উঠেছিল। সুতরাং হাজার হাজার লোক খবর শোনার জন্য টাউন স্কয়্যারের ছোট আকৃতির ক্যাফেগুলোতে জড়ো হতো– দিনে তিন বার, সকাল আটটায়, দুপুর দুই ঘটিকায় এবং সন্ধ্যা ছ’টায়। যখন সংবাদ সম্প্রচার স্টেশন তার স্বাভাবিক ছয় বার পিপ পিপ শব্দ বাজিয়ে ঘন্টা ঘোষণা করত, তখন শ্রবণকারী লোকদের মধ্যে চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাসের আওয়াজ শোনা যেত। তারা সবাই একটা ভালো খবর শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে অসংখ্য মানুষ মনের মধ্যে একটা আশা নিয়ে জড়ো হতো এবং পনের মিনিট পরেই তাদের যন্ত্রণাগ্রস্ত মন থেকে সেই আশা উবে যেত। ‘কখন আবার জেরুজালেম খুলে দেওয়া হবে…’ সবার মুখে এই একটি কথাই উচ্চারিত হতো। ‘কখন আবার জেরুজালেম খুলে দেওয়া হবে…।’ তারা বেইত জালা পাহাড়ের উপর আরোহন করে দেখতো তাদের প্রিয় শহর, যে শহর ফ্যাকাশে বেগুনী কুয়াশায় উত্তর দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে আছে। তারা যেখানে আছে, সেখান থেকে শহরের দূরত্ব কোনোভাবেই ছয় মাইলের বেশি হবে না। কিন্তু লক্ষ মাইল দূরের স্বপ্নের শহর মৃত্যুর উপত্যকার বাইরে মরীচিকা হয়ে রয়ে গেছে।
গল্পসূত্র:
‘সরু রাস্তায় শিকারীরা’ গল্পটি জাবরা ইব্রাহিম জাবরার ইংরেজিতে ‘হান্টারস ইন অ্যা ন্যারো স্ট্রীট’ গল্পের অনুবাদ। উল্লেখ্য, গল্পটি লেখকের একই শিরোনামের বিখ্যাত উপন্যাসের চুম্বক অংশ। গল্পটি আতেফ আলশায়ের সম্পাদিত ‘অ্যা ম্যাপ অব অ্যাবসেন্স : অ্যা অ্যান্থোলজি অব প্যালেস্টিনিয়ান রাইটিং অন দ্য নাকবা’ সংকলনে রয়েছে। সেখান থেকে গল্পটি বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।
গল্পকার, ছড়াকার এবং অনুবাদক। লেখালেখির শুরু সত্তরের মাঝামাঝি। ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতায়, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তার মৌলিক এবং অনুবাদ গল্প। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে দুটি গল্পের সংকলন, চন্দ্রপুকুর (২০০৮) ও কতটা পথ পেরোলে তবে (২০১০)। এছাড়া, তার অনুবাদে আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৩), নির্বাচিত নোবেল বিজয়ীদের সেরা গল্প (২০১৩), ইরানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৪), চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প ও নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে।