আজ বিকেলটা যেন অন্য সব দিনের চেয়ে আলাদা। রাস্তাটা কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছিল। গাড়ি থেকে নামতে যাচ্ছি, হঠাৎ মাথার কাছে ওয়েদার অ্যালার্ম বিপ বিপ করে বেজে উঠল। আমি বিল্ট-ইন ড্রাইভারের কাছে জানতে চাইলাম, ‘কী সমস্যা শোফার?’
‘স্যার এই মুহূর্তে বাইরের বাতাসে কার্বন পার্টিকেলের মাত্রা তিন শতাংশ বেড়ে গেছে,’ যান্ত্রিক কন্ঠে ড্রাইভার জানাল,‘আপনি যদি একটু অপেক্ষা করতেন তো ভালো হতো। রোড স্ক্যানারে দেখতে পাচ্ছি আট নম্বর রাস্তায় একটা এয়ার পিউরিফায়ারের গাড়ি চলে এসেছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ওটা এখানে পৌঁছে যাবে।’
সরকারি এইসব পিউরিফায়ারের গাড়ির ওপর আমার কোনো দিনই আস্থা ছিল না। ‘একটা অক্সি-মাস্ক দাও আমাকে। ’
মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে উচ্চ পদের চাকরির সুবাদে আমি একটা প্রথম শ্রেণির গাড়ি পেয়ে গেছি। নির্দেশ অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা এইসব গাড়ির নেই। অন্য কোনো গাড়ি হলে পালটা যুক্তি দেখাত। ড্যাশ বোর্ডের একটা অংশ খুলে মাস্ক বেরিয়ে এলো।
মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে উচ্চ পদের চাকরির সুবাদে আমি একটা প্রথম শ্রেণির গাড়ি পেয়ে গেছি। নির্দেশ অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা এইসব গাড়ির নেই। অন্য কোনো গাড়ি হলে পালটা যুক্তি দেখাত। ড্যাশ বোর্ডের একটা অংশ খুলে মাস্ক বেরিয়ে এলো। তবে শোফার আমার স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার দিকটা এড়িয়ে যেতে পারে না, বিনীতভাবে তার যান্ত্রিক কন্ঠে সে অনুরোধ করল, ‘স্যার অক্সি-মাস্ক সব সময় পুরো নিরাপত্তা দিতে পারে না। আপনি অপেক্ষা করলে পারতেন।’
‘তুমি কি বাড়ি স্ক্যান করে বলতে পারো অনী এখন কোনো ঘরে আছে?’ আমি প্রসঙ্গ পালটাতে চাইলাম।
‘স্যার, ম্যাডাম এখন ঘরে নেই। পেছনের উঠোনে ইউক্যালিপটাস গাছ দুটোর নিচে বসে আছেন।’
এই গাড়িটাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে আমার শারীরিক সুবিধার কথা মাথায় রেখে, আমার মেয়ের নিরাপত্তার কথা মাথামোটা ডিজাইনাররা ভাবেনি। আমি ক্রুদ্ধ স্বরে নির্দেশ দিলাম, ‘গাড়ি গ্যারেজে ঢোকাও।’ মাস্ক মুখে লাগিয়ে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। বাতাসে বিষাক্ত পদার্থের মাত্রা যদি বেড়ে গিয়ে থাকে তো আমার প্রাপ্ত বয়স্ক শরীরে সইতে পারে, কিন্তু অনীর বয়স আট বছর মাত্র— ওকে দ্রুত ঘরে নিয়ে যাওয়া দরকার।
অন্য কোনো দিন হলে অনী ‘বাবা-বাবা’ বলে ছুটে এসে আমার কোলে লাফিয়ে পড়ত। আজ বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে পা দিয়ে আমার শরীর শিউরে উঠল। কিছু হয়েছে কি? সিকিউরিটি সিস্টেম সমস্যায় পড়েছে কোনো? প্রধান দরজায় হাত দিতেই সেটা কড়কড় শব্দে খুলে গেল।
আমি চটপট সবগুলো ঘর পার হয়ে পেছনের উঠোনে এসে নামলাম। বিকেলের রোদ চিরে চিরে দিয়ে চলে যাচ্ছে উন্মক্ত বাতাস। ইউক্যালিপটাস গাছের পাতা উড়ে চলে যাচ্ছে এদিক ওদিক। আমার দিকে পেছন ফিরে মাথা নুইয়ে উঠোনের মাঝখানে বসে আছে অনী। আমি এসেছি এটা বুঝতে পারেনি এখনও? এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলাম, ‘ওঠো মা, এখানে বসে কেন?’
চুলের ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকাল মেয়েটা, ঘড়ঘড়ে পুরুষালী কন্ঠে বলে উঠল, ‘যখন বলছিলাম তখন তো কথা কানে ঢোকে নাই। এখন কথা বইলা লাভ কী?’
চুলের ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকাল মেয়েটা, ঘড়ঘড়ে পুরুষালী কন্ঠে বলে উঠল, ‘যখন বলছিলাম তখন তো কথা কানে ঢোকে নাই। এখন কথা বইলা লাভ কী?’
আমি হাত সরিয়ে ছিটকে উঠে দাঁড়ালাম। এ কন্ঠ কার? অনীর হতেই পারে না— সে কখনোই আমার সাথে এই ভাষায় কথা বলবে না। কিছুক্ষণের জন্য বোধহয় কথা বলতেও ভুলে গেলাম আমি।
‘আমারে তুই চিনিস না,’ আমার দিকে একটা আঙ্গুল তুলে লাল চোখজোড়া বড়ো করল অনী, ‘নিজের ব্যবস্থা আমি নিজেই করতে পারি।’
শেষ বিকেলের তীব্র হাওয়ায় অনীর মাথার চুলগুলো এদিক ওদিক উড়ছে। তার মুখে ফুটে উঠেছে শীতল এক টুকরো হাসি। তীব্র আতংক নিয়ে আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ডা.জিশান শা’নজর মিনিট পাঁচেক মাত্র আমার কথা শুনলেন তারপর এমন ভঙ্গিতে অন্য দিকে তাকাতে লাগলেন যেন আর কিছুই বুঝতে বাকি নেই। টেবিলের ওপর কলিং সুইচে চাপ দিতেই একজন পুরুষ নার্স এসে চেম্বারে ঢুকল। তার দিকে ফিরে চাপা গলায় ডা বললেন,‘কেস নাম্বার নাইন— ফাইল সেভেনটি সেভেন।’ নার্স লোকটা নির্বিকারভাবে বায়বীয় স্ক্রিনে আঙ্গুল বুলিয়ে কেসটা লিখে ফাইল সেভ করে বাইরে বেরিয়ে গেল।
পুরো ব্যাপারটা তাহলে কোডিঙের অন্তভুর্ক্ত। নয় নম্বর কেস কোনো বিশেষ রোগের নাম আর অনীর নম্বর এখানে সাতাত্তর। এর আগে কি ছিয়াত্তর জন রোগি এই অসুখে এখানে ভর্তি হয়েছে? আমি হুইল চেয়ারে বসানো অনীর দিকে তাকালাম। ওর হাত দুটো স্ট্র্যাপ দিয়ে চেয়ারের হাতলের সাথে বাঁধা। গভীর অভিমান নিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ঠোঁটদুটো নড়ে উঠল। আমি শুনতে পেলাম না, তবে দেখলাম, ‘বাবা, খুলে দাও।’
ডা.জিশান অনীর দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ থুতনী চুলকালেন, ‘মেয়ের মা কোথায়?’
বছর তিনেক আগে অনীর মায়ের সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে যায়। ত্রয়নার অভিযোগ ছিল আমি আমার ক্যারিয়ারের কথা ভেবে পরিবারকে বেশি সময় দেই না। পারিবারিক বন্ধন ব্যাপারটা আজকাল আর তেমন জরুরী কিছু নয়, তাই দিন পনেরোর মধ্যেই সব শেষ হয়ে যায়। ত্রয়নাকে যেতে দিলেও আমি অনীকে যেতে দেইনি। অনী নিজেও আমাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না। শুনেছি ত্রয়না এখন কোনো এক ছন্নছাড়া আর্টিস্টের সাথে থাকে। আমি সংক্ষেপে ডাক্তারকে ব্যাপারটা খুলে বললাম। তিনি সব শুনে মাথা নাড়লেন,‘মেয়ের মাকে আসতে বলুন। আপনাদের দুজনেরই ডিএনএ পরীক্ষা করতে হবে।’
‘এটা কি কোনো জেনেটিকাল মানসিক রোগ ডাক্তার সাহেব?’
ডা. জিশান তার চেয়ারে হেলান দিলেন, ‘দেখেছেন তো, একই পরিবারের পাঁচটা বাচ্চা পাঁচ রকমের আচরণ করে? কেন করে? কারণ, এই পৃথিবীর বাস্তবতা— পাঁচজনের কাছে পাঁচ রকম। ইয়ে, আপনি এসকেপিজম বোঝেন?’
‘মানসিক রোগ তো নিশ্চয়ই। তবে জেনেটিকাল কি না তা এখনই বলা যাবে না। আপনি একজন মহাকাশবিজ্ঞানী, আপনি জানবেন— মানুষ মহাকাশ সম্পর্কে এত কিছু জেনে ফেলেছে অথচ মানুষের মন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। আসলে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ মানসিকভাবে আলাদা।’ ডা. জিশান তার চেয়ারে হেলান দিলেন, ‘দেখেছেন তো, একই পরিবারের পাঁচটা বাচ্চা পাঁচ রকমের আচরণ করে? কেন করে? কারণ, এই পৃথিবীর বাস্তবতা— পাঁচজনের কাছে পাঁচ রকম। ইয়ে, আপনি এসকেপিজম বোঝেন?’
‘বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বাঁচার কথা বলছেন?’
‘ঠিক তাই। আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনীর এই অসুখটা হয়েছে এসকেপিজম থেকে। ছোটোবেলা থেকে তো আপনি আপনার মেয়েকে দেখেছেন। আমি বলব, আপনি নিজেই হিসেব করে বের করুন আপনার মেয়ে ঠিক কোন কোন ক্ষেত্রে আঘাত পেয়ে শেষে বাস্তব পৃথিবী থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে।’
আমি অবাক হলাম,‘ওর এই উদ্ভট আচরণের সঙ্গে এসকেপিজমের সম্পর্ক কী?’
ডা.জিশান উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। জানালার কাচে কার্বন জমে কালচে হয়ে গেছে। হাত দিয়ে সেটা মুছতে চেষ্টা করলেন। ‘এই অসুখটাকে বলে মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার। ধরুন, পৃথিবীটা যেভাবে সাজানো আছে তা আপনার পছন্দ নয়। নিজের জীবনটাকে নিয়ে আপনি সুখী নন। এই অবস্থায় আপনার ভেতরে জন্ম নিতে পারে আরেক সত্তা। আপনার সচেতন মন হয়তো জানেই না, কীভাবে কখন নিজেকে ভেঙ্গে আপনি আরেকটি সত্তাকে নিজের ভেতরে স্থান দিয়েছেন।’
এক রাশ অবিশ্বাস নিয়ে আমি মাথা নাড়লাম,‘এটা কীভাবে সম্ভব?’
‘আপনি ব্যস্ত মানুষ, হয়তো এসব নিয়ে পড়াশুনা করার সময় আপনি পাননি। গত চার শ বছরের হিসেব ঘেঁটে সারা পৃথিবীর হাসপাতালগুলো থেকে আমরা কয়েক হাজার এমপিডি রোগীর রেকর্ড যোগাড় করেছি। কেন জানেন?’ ডা জিশান টেবিলে ভর দিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে পড়লেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের হাতে অনী সাতাত্তর নম্বর রোগী। এবং এই সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছে।’
‘কেন ডা.জিশান? হঠাৎ এই রোগের প্রকোপ এত বেড়ে গেল কেন?’
ভয়াল কন্ঠে হেসে উঠল অনী। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, ‘যা বলতেছি কর ব্যাটা, আমার বান্ধন খুইলা দে!’
আমি ডাক্তারের দিকে তাকালাম। তার কপালে ফুটে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তিনি পানির গ্লাসের দিকে হাত বাড়ালেন।
তখনই বুঝতে পারলাম বাচ্চার বাবা-মা ছাড়া আর অন্য কেউ এই এসাইলামের খবর জানে না। একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি দাঁড়িয়েও যে বাচ্চার অসুস্থতা নিয়ে বাবা-মায়েরা এমন হীনমন্যতায় ভোগে তা আমার ধারণারও বাইরে ছিল। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কী বলবে এই নিয়ে অভিভাবকেরা এতই চিন্তিত যে তারা কাউকে এই বিষয়ে কিছুই বলেন না। তার ওপর সরকার থেকে পরোক্ষভাবে ওই সব বাবা-মায়েদের জানানো হয়েছে যে এ ব্যাপারে মুখ খোলা হলে সব রকম আধুনিক সুযোগ সুবিধা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হবে।
নবীনগরের প্রায় পঁচিশ একর জায়গা নিয়ে তৈরি হয়েছে চাইল্ড সাইকো এসাইলাম নামের আধুনিক এক মানসিক হাসপাতাল। দ্বৈত সত্তা নামক উদ্ভট এই অসুখটি বাচ্চাদের মধ্যে ক্রমেই বাড়তে থাকায় সরকার বাধ্য হয়েছে আলাদা করে একটা হাসপাতাল স্থাপন করতে। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা কোন হাসপাতাল। আরও ছিয়াত্তর জন বাচ্চার সাথে অনীকে রেখে আমি বাসায় ফিরছিলাম, তখনই বুঝতে পারলাম বাচ্চার বাবা-মা ছাড়া আর অন্য কেউ এই এসাইলামের খবর জানে না। একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি দাঁড়িয়েও যে বাচ্চার অসুস্থতা নিয়ে বাবা-মায়েরা এমন হীনমন্যতায় ভোগে তা আমার ধারণারও বাইরে ছিল। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কী বলবে এই নিয়ে অভিভাবকেরা এতই চিন্তিত যে তারা কাউকে এই বিষয়ে কিছুই বলেন না। তার ওপর সরকার থেকে পরোক্ষভাবে ওই সব বাবা-মায়েদের জানানো হয়েছে যে এ ব্যাপারে মুখ খোলা হলে সব রকম আধুনিক সুযোগ সুবিধা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হবে। অসুস্থ এক বাচ্চার বাবা এসাইলামের গেট থেকে ফিরছিল। আমি তাকে এই নিয়ে প্রশ্ন করলাম। লোকটা কেমন আমতা আমতা করতে লাগল।
‘আপনি তো সব জানেন। আপনি তো সব জানেনই।’
‘দেখুন, আমার মেয়েকে আমি এখানে রেখে চলে যাচ্ছি,’ আমি ভিন্ন পথ ধরলাম, ‘যাদের সঙ্গে সে এখন আছে তাদের কেউই নিজের স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। আমাকে তো নিজের মানসিক স্বস্তির একটা ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। সরকার কেন এ ব্যাপারটা চাপা দিতে চাইছে তা আমার জানা দরকার।’
ভদ্রলোক কিছুটা ভয় পেয়েছেন বলে মনে হলো। আমাকে তিনি সরকার-বিরোধী দলের বড়ো কোনো সদস্য ভেবেছেন কি না বুঝলাম না। তার সাথে কথা বলে জানলাম ক্রমবর্ধমান এমপিডি রোগীদের নিয়ে সরকার এখন বেশ ঝামেলায় পড়েছে। বাচ্চাদের শারীরিক এবং মানসিক নিরাপত্তার বিষয়টি বিরোধী দলের হাতে একটা বড়ো ইস্যু। মওকা বুঝে মানবাধিকার এবং শিশু অধিকারবিষয়ক সংগঠনগুলোও সরকারকে আরও চাপের মধ্যে ফেলবে। সর্বোপরি, জাতিসংঘের শিশুনিরাপত্তা বিষয়ক সংগঠনগুলো নতুন সব নিয়ম-নীতি তৈরি করেছে। তারা আবার বিপত্তিকর কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ না করে বসে তাই নিয়ে সরকারের ভেতরমহলে কানাঘুষা চলছে। সুতরাং যে কোনো মূল্যে এই প্রসঙ্গ জনসাধারণের কাছ থেকে আড়াল করতে হবে। আমার মনে হলো রোগটা ছড়িয়ে পড়ার পেছনে পরোক্ষভাবে সরকারের কোনো কমর্কাণ্ড জড়িত কি না সেটাও খতিয়ে দেখার বিষয়।
আমি বাসায় ফিরে প্রথমেই অফিসে ভিডিও মেইল করে জানিয়ে দিলাম মেয়ের অসুস্থতার জন্য পাঁচ দিনের ছুটি চাই। ফিরতি মেইল আর ফোন করার সব রাস্তা বন্ধ করে দিলাম। নইলে এখনি অফিস থেকে চার-পাঁচজন ফোন করে মেয়ের খবর জানতে চাইবে। আমি আসলে মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার নামক এই বিশ্রী রোগের মূলে পৌঁছাতে চাইছি। এখন কেউ আমাকে বিরক্ত করুক তা চাই না।
অন্তর্জালের মহাসমুদ্র ঘেঁটে জানতে পারলাম এমপিডি মোটেই বর্তমান কালের কোনো রোগ নয়। গত কয়েক শতক ধরেই মেডিকেল সায়েন্স এই রোগের সাথে মোকাবেলা করে আসছে। এবেরহার্ট গেমলিনকে বলা হয় এই রোগের প্রথম রোগী যাকে নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কিছু নথিপত্র পাওয়া যায়। উনিশ শতকে লুইস ভিভে নামক এক লোককে নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা করা হয়েছিল কিন্তু সেই সময় উল্লেখযোগ্য কোনো ফলাফল আসেনি। ১৮৪০-এ এসেলস নামের এগারো বছরের এক সুইস মেয়ের কথা জানা যায় যে ছিল প্যারালাইসিসের রোগী, কিন্তু প্রতিবার দ্বিতীয় সত্তার আবির্ভাবে সে হাঁটাচলা করতে পারত। ঘন্টা তিনেক পড়াশুনো করে বুঝতে পারলাম এখন অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সহায়তা নিতে হবে। পারসোনাল ই-সেক্রেটারি রোহিনীকে বললাম পৃথিবীর খ্যাতনামা চিকিৎসকদেরকে আমার পরিচয় জানিয়ে একটা মিটিঙের আয়োজন করা যায় কি না দেখতে।
সেদিনই রাত এগারোটার সময় আমার ভিডিও কনফারেন্স হলো শ্রীলঙ্কার চাইল্ড সাইকোলজিস্ট ডা. মৃদুলানাভন, হাঙ্গেরির নিউরো ফিজিশিয়ান ডা. এন্ড্রু বয়লার আর রাশিয়ার ব্রেন সার্জন ডা. ভ্লাদিমির তিখভের সাথে।
সেদিনই রাত এগারোটার সময় আমার ভিডিও কনফারেন্স হলো শ্রীলঙ্কার চাইল্ড সাইকোলজিস্ট ডা. মৃদুলানাভন, হাঙ্গেরির নিউরো ফিজিশিয়ান ডা. এন্ড্রু বয়লার আর রাশিয়ার ব্রেন সার্জন ডা. ভ্লাদিমির তিখভের সাথে। রোহিনী পুরো কনফারেন্সটা রেকর্ড করে নিতে শুরু করল আমার হলো-রেকর্ডারে। তিনজন চিকিৎসকের সাথে আমার বক্তব্য সাজাতেই ব্যাপারটা দাঁড়াল এরকম:
১.ছোটোবেলায় আমাকে আর ত্রয়নাকে লেখাপড়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ দেওয়া হতো। ভোরবেলা ঘুমভাঙা চোখে দেখতাম আমাকে স্কুলের পোশাক পরানো হচ্ছে। বাবা আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন। লেখাপড়ার এই চাপ থেকে বাচ্চারা আজও মুক্তি পায়নি। জিনগতভাবে অনী এখন মানসিক অসুস্থতা বয়ে বেড়াচ্ছে। কয়েক প্রজন্ম ধরে তৈরি করা এই চাপ এখন ফল হয়ে বেরোতে শুরু করেছে।
২. বাবা-মায়ের দ্বন্দ কোনো সন্তানই মেনে নিতে পারে না। এই সময়ের শিশুরা বাবা অথবা মা যে কোনো একজনকে বেছে নিতে গিয়ে নিজের ভেতরে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে তারা বাস্তব পৃথিবী থেকে ছুটি চায়।
৩. আধুনিক যন্ত্রসভ্যতা অন্ধভাবে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে বিষাক্ত গ্যাস। মস্তিস্কে ঠিকভাবে অক্সিজেন না পৌঁছালে যে কোনো ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। শুধু এমপিডি রোগীর সংখ্যাই যে বাড়ছে তা নয়, নিশ্চিতভাবে অন্যান্য মানসিক বিকারে জনসাধারণ পড়তে শুরু করেছে।
আমি রোহিনীকে বললাম সকালে একটা সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করতে। রোহিনীর স্বচ্ছ হলোগ্রাফিক চোখে কৌতুহল ফুটে উঠতে দেখলাম,যদিও মুখে কিছুই বলল না।
সকাল হতেই জনা পনের সাংবাদিক আমার বসার ঘরটা দখল করে নিল। আমি সবার সামনে আমার প্রাপ্ত তথ্য ও মতামতগুলো তুলে ধরলাম। তাদের তরুণ চোখে রাজ্যের প্রশ্ন। ‘স্যার,আপনি কি মনে করেন আপনি যা বলছেন তাই সত্যি?’
আমি একটু হেসে বললাম,‘সব ধারণা তো আমার একার নয়।’ ভিডিও কনফারেন্সের রেকর্ডটা চালিয়ে দিলাম। পুরোটা দেখে সবাই অবাক! অন্য দিকে সরকারি গোপনীয়তা কিভাবে ধরে রাখা হয়েছে দেখে আমিও অবাক হলাম। নবীনগরের চাইল্ড সাইকো এসাইলামের ব্যাপারটা একজন সাংবাদিকও জানেন না! মিনিট দশেকের মধ্যেই সংবাদ মাধ্যমগুলো বিষ্ফোরণ ঘটানোর নাটকিয়তা মিশিয়ে পরিবেশন করল খবরটা । আমি যথাসম্ভব দ্বিতীয় দফা সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়াটা এড়িয়ে গেলাম। দুপুর নাগাদ পেশাদার সাংবাদিক, দাঙ্গা পুলিশ আর কৌতুহলী সাধারণ মানুষের বন্যায় ভেসে গেল নবীনগর এলাকা।
বিকাল পাঁচটার দিকে একটা ভিডিও মেইল পেয়েছি। মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের এডমিন সেক্রেটারি আমাকে জানাচ্ছেন ‘কাজে অসামর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে’ আমাকে আমার পদ থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আমার লোভনীয় সরকারি চাকরির এখানেই ইতি।
আমি প্রাণ খুলে হাসতে লাগলাম। আমার খুব ইচ্ছে হলো এই হাসিটার ভিডিও মেইল করে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেই। কিন্তু সেটা ঠিক হবে না, গবেষণা কেন্দ্রের হর্তাকর্তারা সেটাকে গণ-মাধ্যমে প্রকাশ করে দেখাবেন যে আমি আসলে মানসিকভাবে অসুস্থ। কথাটা আমি অস্বীকার করি না। বিষাক্ত পৃথিবী আমাদের সবাইকেই একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে। সুস্থ থাকাটা এখন কতটাই বা সম্ভব?
আজ বিশ্বজুড়ে এমপিডির বিরুদ্ধে এই সামাজিক আন্দোলন ‘মুভমেন্ট সেভেনটি সেভেন’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার উদিয়মান শিল্পী সন্ডি সালেমের আঁকা অনীর হাসিমাখা মুখটা এই আন্দোলনের লোগো হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই তো সেদিন মন্ট্রিয়ল থেকে পাঁচ তরুণ আমাকে ফোন করে বলল, ‘কোনো চিন্তা করবেন না স্যার। ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাঁচানোর লড়াইয়ে আমরাই জিতব।’
আমি হেসে বলি,‘জিততে আমাদের হবেই। হেরে যাওয়ার কথা আমরা কখনো ভাবব না।’
শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকায় ও রংপুরে। লেখাপড়া করেছেন ইংরেজি সাহিত্য, বিপণন বাণিজ্য ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায়। কিশোর পাঠকদের জন্য তিনি নিজস্ব ধারার গল্প লিখছেন। বাংলাদেশের শিশু-কিশোর সাহিত্যকে বিশ্বমানে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন লালন করছেন দীর্ঘ দিন ধরে। অবসরে তিনি বই সংগ্রহ করেন। বিশ্বচলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। তাঁর উপন্যাসের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত হতে যাচ্ছে চলচ্চিত্র। নিলয় দীর্ঘ দিন ধরে একটি স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থার শিশু-কিশোর শাখার প্রধান হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, পুনর্লিখন মিলিয়ে তাঁর এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা এক ডজন। প্রাপ্ত পুরস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: কিশোর উপন্যাসে অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার, প্রিন্ট মিডিয়ায় মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ডস এবং রণজিৎ-অভিষেক স্মৃতি সম্মাননা।