শুক্রবার, নভেম্বর ২২

ফারশিদ মেসঘালির প্রবন্ধ : ইরানের সমসাময়িক গ্রাফিক ডিজাইন ।। অনুবাদ: মুহসীন মোসাদ্দেক

0

একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি বা পরিচয় ছাড়া ইরানের গ্রাফিক ডিজাইনাররা ভিজ্যুয়াল কমিউনিকেশনের মাধ্যমে কীভাবে জাতিকে উপস্থাপন করতে পারবেন? ফারশিদ মেসঘালি ইরানের গ্রাফিক ডিজাইনের বিকাশ ও বিবর্তনের বিভিন্ন উপাদান এবং কীভাবে এই পেশার প্রতি সতেজ দৃষ্টিভঙ্গি নতুন প্রজন্মকে সত্যিকার অর্থে এই দেশের ঐশ্বর্য সন্ধানে সহায়তা করবে সে দিকে নজর দিয়েছেন।


ইরানের সমসাময়িক গ্রাফিক ডিজাইনের সমজাতীয় কোনো কাঠামো নেই। একদিকে, অনেক বড়ো একটি ডোমেইন রয়েছে, যা নির্দিষ্ট তথ্য চিত্রিত করে ভিজ্যুয়াল কমিউনিকেশনের মাধ্যমে জনসাধারণকে অবহিত করে। অন্যদিকে, ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে গ্রাফিক ডিজাইনের একটি রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা, উদাহরণস্বরূপ, প্রদর্শনী এবং অভিজাত দর্শকদের প্রদর্শনের জন্য উপযোগী। আমার দৃষ্টিতে, ইরানে উদ্ভূত সমসাময়িক গ্রাফিক ডিজাইন, সমগ্র ইরানি গ্রাফিক ডিজাইনের কার্যকলাপের অখ- পরিসর হিসেবে বিবেচিত হয়।

একটি একক সংস্কৃতির ভেতরে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুনিয়ন্ত্রিত সামাজিক প্রবৃদ্ধি একটি যৌক্তিক কাঠামো ও শৈলীর অভিন্ন স্তর সহযোগে নিজস্ব গ্রাফিক ডিজাইন তৈরি করে। আমাদের সমাজ সমত্বরণ সংস্কৃতি লালন করে না। সমাজের একটি অংশ গ্রামীণ; অন্য একটি অংশ গ্রামীণ পটভূমি থেকে উঠে আসা নবাগত শহরবাসী। কিছু মানুষ ছোটো শহর-কেন্দ্রিক সংস্কৃতি লালন করে এবং কিছু মানুষ বড়ো শহর বা মহানগর-কেন্দ্রিক সংস্কৃতি ও জীবনধারা উপভোগ করে। আমাদের গ্রাফিক ডিজাইনের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি, যা সাধারণত জনসাধারণের তথ্য উপস্থাপন করার কথা, তা আসলে গ্রাফিক ডিজাইন স্কুল ও কলেজ দ্বারা গঠিত; এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভিজ্যুয়াল কমিউনিকেশনকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয় না। এই স্কুলগুলো গ্রাফিক ডিজাইনার তৈরির পরিবর্তে গ্রাফিক আর্টিস্ট তৈরিতে বেশি মনোযোগী।


Iran_1

বামে: ঘোবাদ শিবের ‘পোস্টার ফর মিউজিক’; ডানে: ফারশিদ মেসঘালির ‘পোস্টার ফর অ্যানিমেশন মুভি’


আমাদের ডিজাইনারদের যে কোনো গ্রাফিক ডিজাইনের কাজই তাদের শৈল্পিক রুচি, অনূভূতি ও লক্ষ্য প্রকাশের এক ভিত্তি। বাণিজ্যিক গ্রাফিক ডিজাইন অথবা তথ্যের জন্য গ্রাফিক, উভয়ই একই সমস্যায় ভুগছে—যোগাযোগ স্থাপনের চেয়ে বেশি মনোযোগী শৈল্পিক পদ্ধতির দিকে। আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, গ্রাফিক ডিজাইনের সমস্ত শাখার মৌলিক সমস্যাটি হলো যোগাযোগহীন দৃষ্টিভঙ্গি (নন-কমিউনিকেটিভ এ্যাপ্রোচ)।

উদাহরণস্বরূপ, খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের একটি অংশে, যোগাযোগের তাৎপর্যের ভিত্তিতে তাদের অগ্রাধিকারগুলোকে নির্ধারণ করা হয় না। এটি ডিজাইনারের রুচি যা কাজের কোন অংশটি আরও সুস্পষ্ট হওয়া উচিত তা নির্দেশ করে। এছাড়া সামগ্রিক বিষয়টি প্রাসঙ্গিকতা অনুসরণ করে না এবং যোগাযোগসম্বন্ধীয় যুক্তির অনুপস্থিতি দেখা যায়। পরিবর্তে, এটি ডিজাইনারের পুরোপুরি ব্যক্তিগত রুচির সাপেক্ষ বিষয়।

কিছু দোকানের প্রতীকে দেখা যায় তাদের কন্টেন্টগুলো দোকানে বিক্রিত পণ্যের ভিত্তিতে এবং সর্বসাধারণের পাঠযোগ্যতার নীতির প্রেক্ষিতে উপস্থাপিত। কিছু বিলবোর্ড দেখা যায় যেখানে মূল লক্ষ্য হলো পাশ কাটিয়ে যাওয়া দর্শকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে বিজ্ঞাপনী পণ্য বা পরিষেবার প্রতি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করা।

সাধারণ দর্শকদের জন্য উপযুক্ত বেশ কিছু জার্নাল আমাদের আছে, যেগুলোতে যৌক্তিক ও আকর্ষণীয় বিন্যাস রয়েছে। এগুলো পাঠযোগ্যতা ও জনসাধারণের রুচির বিবেচনায় বোধগম্যতা ও দর্শকদের প্রয়োজনীয়তার সাথে সমানুপাতিক।

সাধারণ দর্শকদের জন্য উপযুক্ত বেশ কিছু জার্নাল আমাদের আছে, যেগুলোতে যৌক্তিক ও আকর্ষণীয় বিন্যাস রয়েছে। এগুলো পাঠযোগ্যতা ও জনসাধারণের রুচির বিবেচনায় বোধগম্যতা ও দর্শকদের প্রয়োজনীয়তার সাথে সমানুপাতিক। বেশিরভাগ লোগো এবং এমনকি জার্নালের শিরোনামগুলো, যা জনসাধারণকে অবহিত করার লক্ষ্যে ডিজাইন করা হয়েছে, তা পর্যাপ্ত পাঠযোগ্য নয়। এর বাস্তব ফলাফল হলো আমাদের দুই ধরনের গ্রাফিক ডিজাইন; একটি হলো দেশের অভ্যন্তরে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে নির্মিত স্থানীয় নকশা যা আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিবেচনা, অধ্যয়ন এবং প্রচারে অবহেলা করি। এবং অন্যটি গ্রাফিক ডিজাইনের এমন একটি রূপ যা মূলত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য নির্মিত এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলোই ইরানের সমসাময়িক গ্রাফিক ডিজাইন হিসেবে অভিহিত হয়।

 

আমাদের ব্যক্তিগত ও সাংস্কৃতিক গ্রাফিক ডিজাইন
এটা মনে হয় যে আমাদের সাংস্কৃতিক ও ব্যক্তিগত গ্রাফিক ডিজাইন সুস্পষ্ট, আধুনিক এবং পুনর্নির্মাণের প্রবণতাময়। আমার দৃষ্টিতে, সুস্পষ্ট ও স্বতন্ত্র হওয়ার প্রবণতাই হলো আজকের ব্যক্তিগত গ্রাফিক ডিজাইনের মূল বৈশিষ্ট্য। আধুনিকতা এবং পুনর্নির্মাণ এরপরে আসে। আসলে আধুনিকতা এবং পুনর্নির্মাণ স্বাতন্ত্র্য ও সুস্পষ্টতাকে ফুটিয়ে তোলে। কেন আমি আমাদের গ্রাফিক ডিজাইনের মূল দিক হিসেবে স্বাতন্ত্র্যকে বিবেচনা করব? এবং কেন আমি আধুনিকতাকে দ্বিতীয় স্থানে শ্রেণিভুক্ত করব? কারণ আমরা সহজাত কোনো আধুনিক সমাজ নই। সুতরাং, স্বাভাবিকভাবেই আধুনিকতা ভেতর থেকে আসতে পারে না। অন্যদিকে, নতুন তত্ত্ব ও চিন্তাশীল ভিজ্যুয়াল অভিব্যক্তি পুনর্নির্মাণ ও প্রতিস্থাপন করার মতো সুসঙ্গত কাঠামো ও তত্ত্ব আমাদের গ্রাফিক ডিজাইনে কখনো ছিল না।


Iran_2

বামে: সাদেক বারিরয়ানির ‘পোস্টার ফর ড্যান্স’; ডানে: মোর্তেজা মোমায়েজের ‘পোস্টার ফর ফেস্টিভাল’


এটা পরিষ্কার যে, ইরানে এই ধরনের শৈল্পিক গ্রাফিক ডিজাইন বেশ প্রগতিশীল, স্বতন্ত্র এবং আধুনিক। এই দুটি বৈশিষ্ট্য আকর্ষণীয় মানের ব্যক্তিগত গ্রাফিক্সের বিকাশে অবদান রেখেছে। আমরা যখন বিপুল সংখ্যক গ্রাফিক ডিজাইনার এবং তাদের নির্মিত ব্যাপক পরিমাণ কাজগুলো দেখি, বিস্মিত হয়ে সক্রিয়তার এই বিস্তৃত স্তরের প্রশংসা আমরা করতে পারি না।

আমরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ইরানের গ্রাফিক ডিজাইন উপস্থাপন করতে পারি:

 

যোগাযোগ (কমিউনিকেশন)
যোগাযোগ হলো গ্রাফিক ডিজাইনের মূলনীতি। গ্রাফিক ডিজাইনের পুরোটাই হলো দর্শকদের কাছে, আরও ভালোভাবে বললে—নির্দিষ্ট দর্শকদের কাছে বার্তা, মর্মার্থ বা তথ্য প্রেরণ করা। বার্তা ও দর্শকদের মাঝে দৃশ্যরূপে (ভিজ্যুয়ালি) যোগাযোগের সেতু হলো গ্রাফিক ডিজাইন।

এই মৌলিক ও প্রয়োজনীয় সংজ্ঞাটি কীভাবে আমাদের দেশে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করা যায়? আমরা কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানাব?

আমরা যখন এই পদ্ধতির কথা বলি, সাংস্কৃতিক গ্রাফিক ডিজাইন ব্যাপক হারে ব্যবহারের সময় আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধ করি না। আমরা আসলে সম্পূর্ণ বর্ণালী বাস্তবায়ন করি, যার মধ্যে সাংস্কৃতিক গ্রাফিক্সও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

আমার দৃষ্টিতে, আমাদের গ্রাফিক ডিজাইনের কাজগুলোর সামগ্রিক সংস্থার (বাণিজ্যিক বা সাংস্কৃতিক) অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্যের অভাব রয়েছে—যদি তা যোগাযোগের উদ্দেশ্যে না হয় তবে অনিশ্চয়তাও বিদ্যমান বা যোগাযোগ করতে অসমর্থ, বা যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা বৈধ কিনা তা অনিশ্চিত, এমনকি যোগাযোগ কী তা তারা জানে না। এবং সবচেয়ে বড়ো কথা, এই পরিকল্পনাগত যোগাযোগের দর্শক বা শ্রোতা কে?


Iran_3

বাম থেকে ডানে: অনিশ আমিনেলাহির ‘অ্যাডভাইজমেন্ট ফর অ্যাডহেসিভ’; আব্দুলকরিম মোসাবির ‘কভার ফর বুক’; পারিসা তাশাকরির ‘পোস্টার ফর চিলড্রেন’


যোগাযোগের দুটি উপাদান রয়েছে: তথ্য বা বার্তা হলো প্রথম এবং দর্শক বা শ্রোতা হলো দ্বিতীয় উপাদান। সমসাময়িক গ্রাফিক ডিজাইনের বেশিরভাগ কাজগুলোতে (বা গ্রাফিক ডিজাইনের সমস্ত ক্ষেত্রে) কোনো বার্তাই স্বচ্ছ নয় বা পর্যবেক্ষণকৃত বার্তাটি অস্পষ্ট এবং প্রতিবন্ধী। যাইহোক, এই প্রতিবন্ধী বার্তাটি কেমন দর্শকের উদ্দেশে প্রেরণ করা হয়েছে তা অস্পষ্ট। খবরের কাগজ এবং সাময়িকীর বেশিরভাগ বিজ্ঞাপন এবং সাংস্কৃতিক গ্রাফিক্সগুলো যা দৃশ্যত আকর্ষণীয় এবং আধুনিক তা এই ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত। যদি আলাদা কোনো বিবরণ সংযুক্ত করা না হয় বা কোনো আতস কাচের নিচে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা না হয়, আপনি অনুধাবন করতে পারবেন না যে বার্তাটি বা পোস্টারটি কী সম্পর্কিত এবং কাকে উদ্দেশ করছে। বার্তাটির বোধগম্যতা এবং বিশ্বস্ততার বিকাশ গ্রাফিক ডিজাইনের মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে পড়ে।

যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে গ্রাফিক ডিজাইনের ব্যবহার এই ক্ষেত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। গ্রাফিক স্কুলগুলোতে এবং আমাদের ডিজাইনারদের সম্মিলিত চৈতন্যে এই মৌলিক বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়।

যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে গ্রাফিক ডিজাইনের ব্যবহার এই ক্ষেত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। গ্রাফিক স্কুলগুলোতে এবং আমাদের ডিজাইনারদের সম্মিলিত চৈতন্যে এই মৌলিক বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়। আমাদের স্কুলগুলোতে গ্রাফিক ডিজাইনকে ‘গ্রাফিক আর্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় যদিও এটি একটি প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক শিল্পমাধ্যম, পেইন্টিংয়ের মতো কেবল আঁকাআঁকি নয়। গ্রাফিক ডিজাইন স্থাপত্যবিদ্যার মতো ব্যবহারিক শিল্প। প্রথমত, একটি স্থাপত্যের কার্যকারিতা ও উদ্দেশ্য থাকে, যেমন স্কুল, বাড়ি অথবা হাসপাতাল। এরপর, নান্দনিক ও বিমূর্ত মাত্রা যোগ করা হয়। স্থাপত্যবিদ্যায়, ফর্ম ফাংশন অনুসরণ করে এবং তা স্বনির্ভর। স্থাপত্যের বেশিরভাগ আধুনিক কাজে কার্যনীতি সর্বদা বর্তমান। স্থাপত্যটি যদি অ্যাম্ফিথিয়েটার হিসেবে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয় তবে মঞ্চের দৃশ্য, দর্শক-শ্রোতার আসন এবং যোগাযোগের মাধ্যমগুলোকে ডিজাইনে কখনোই উপেক্ষা করা হয় না। কেবল যখন এই সংগতিগুলো সমাধান হয়, এরপর একজন স্থপতি সামগ্রিক নকশায় নতুন ফর্ম, এমনকি বিমূর্ত ভাবও ফুটিয়ে তুলতে পারেন।

ষাট এবং সত্তরের দশকে যখন উত্তরাধুনিকতাবাদ, পুনর্নির্মাণ এবং প্রচলিত রীতিনীতি ও কাঠামোর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং পরে নব্বই দশকের সময় পাশ্চাত্যে তরুণ গ্রাফিক ডিজাইনারদের অন্যতম মনোযোগের বিষয় হয়ে উঠেছিল গ্রাফিক ডিজাইনের তত্ত্ব ও যোগাযোগ। বিজ্ঞাপনের গ্রাফিক্স এরইমধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এবং কাজের মূল বিধান হিসেবে বিবেচিত হয়ে উঠেছিল। পুনর্নির্মাণের তত্ত্বগুলো পাশ্চাত্যের ধারাবাহিক কাঠামোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। পুনর্নির্মাণের সমর্থক একজন অগ্রদূত বলেন, ‘নিয়মগুলো ভাঙার কথা ভাবা হয়েছিল, তবে নিয়ম ভাঙার সক্ষমতা অর্জন করতে হলে আপনাকে প্রথমে নিয়মটিকে ভালোভাবে জানতে হবে।’

আমরা কি কখনো আমাদের স্কুলে ডিজাইনের অর্থ শিখিয়েছি? এ জাতীয় তত্ত্বকে অস্বীকার করতে ইচ্ছুক আমাদের গ্রাফিক ডিজাইনাররা কি কখনো ‘গ্রাফিক ডিজাইন: ভিজ্যুয়াল বিষয়গুলোর সৃজনশীল সমাধান’ ধারণাটি জানতে পেরেছিলেন?

 

পাশ্চাত্য
গ্রাফিক ডিজাইন চর্চার সবচেয়ে সংবেদনশীল পর্বগুলোর একটি হলো পাশ্চাত্যের গ্রাফিক ডিজাইনের সাথে আমাদের সম্পর্ক—একইসঙ্গে ভালোবাসা ও ঘৃণার এক সম্পর্ক। গ্রাফিক ডিজাইনের আজকের দিনের সংজ্ঞা হলো গণযোগাযোগের জন্য একটি পশ্চিমা মাধ্যম। ইরানে যখন মুদ্রিত বই, ট্রেডমার্ক, বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন, ব্রুশিয়ার অথবা পোস্টার উৎপাদন শুরু হয়েছিল, তখনও এটি থেকে পাশ্চাত্যকে বাদ দিতে পারে নি। আমাদের গ্রাফিক সংস্কৃতি উদাহরণস্বরূপ অবিরামভাবে পাশ্চাত্যের দিকে তাকিয়ে আছে। সকল প্লাস্টিক আর্টের ক্ষেত্রেই এটি ঘটেছে। এই অনুকরণমূলক সংস্কৃতি¬—যা সর্বজনীন পথের বাইরের সমাজে প্রচলিত—আমাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলোকে নিজস্ব পরিস্থিতির পরিবর্তে দূর থেকে আমরা যা দেখি তার সাথে সমন্বয় করে। সত্য বলতে, অন্য কোনো উপায়ও নেই। সুতরাং, আমাদের সমাজ ও অস্তিত্বের সাথে আমাদের শৈল্পিক পথের কোনো সাংগঠনিক ও ধারাবাহিক সম্পর্ক নেই, তবে পশ্চিমা দেশগুলোতে যা ঘটছে এটি তার পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন। এ যেন গাছের প্রতি মনোযোগ না দিয়ে আমরা কেবল ফল উপভোগ করাকে বেছে নিয়েছি। আমরা কেবল ফল সম্পর্কে জানি এবং তা চাই।


Iran_4

বাম থেকে ডানে: নাঘমেহ জাবিহির ‘কভার ফর ম্যাগাজিন’; তাহামতান আমিনিয়ানের ‘অ্যাডভারটাইজমেন্ট ফর ভেহিকেল পার্টস’; সাদাফ ফাদাইয়ানের ‘অ্যাডভারটাইজমেন্ট ফর কপিয়ার’


পাশ্চাত্যে প্লাস্টিক আর্টগুলো প্রতিটি যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থার ফলাফল। পাশ্চাত্যের ইতিহাস সাধারণভাবে শিল্পকলা এবং বিশেষত প্লাস্টিক আর্টের শিল্পগুলোতে দেখা যায়। পাশ্চাত্যের গ্রাফিক ডিজাইন ধাপে ধাপে বিকশিত হয়েছে এবং বর্তমানের সামাজিক অবস্থা ও পূর্ববর্তী পদক্ষেপগুলোর অবস্থার ওপর দৃঢ়ভাবে নির্ভরশীল। পশ্চিমা গ্রাফিক ডিজাইনের প্রতিটি পর্যায় সে সময়ের সমাজের প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া ও সাড়ার মাধ্যমে গঠিত। আমরা যদি পশ্চিমে পুনর্নির্মাণ ও বিদ্রোহী ধরনের গ্রাফিক ডিজাইনের মুখোমুখি হয়ে থাকি, তবে তা সেই নির্দিষ্ট যুগে পুনর্নির্মাণ আন্দোলন থেকে উদ্ভূত প্রতিক্রিয়া। তদুপরি, পুরো প্রক্রিয়াটি পশ্চিমা সমাজ, শিল্পী, অভিজাত শ্রেণি, দার্শনিক এবং সংস্কৃতির কাঠামোর সাথে পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত।

এই ঘটনাগুলো পাশ্চাত্যের সামগ্রিক কাঠামো থেকে আলাদা কিছু নয়। পাশ্চাত্য সমাজ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে একে অপরের সাথে সাংগঠনিক সম্পর্ক বিদ্যমান; প্রতিটি উপাদান প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্য উপাদানকে প্রভাবিত করে। সমস্ত বিষয়টির মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ামূলক সম্পর্ক বিদ্যমান।

পাশ্চাত্যের পোস্টারগুলো পশ্চিমা সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। বিপরীতে, আমাদের পোস্টারগুলো নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে কোনো প্রকার সম্পর্ক স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে, কারণ তাদের সাথে আমাদের সমাজের কোনো সম্পর্ক নেই।

আমরা যখন পাশ্চাত্যের পোস্টারের পাশাপাশি ইরানি সাংস্কৃতিক পোস্টারগুলো রাখি, তখন কাজগুলোর বাহ্যিক রূপে খুব একটা পার্থক্য নজরে পড়ে না। তবে এই সাদৃশ্যে একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয় উপেক্ষিত। পাশ্চাত্যের পোস্টারগুলো পশ্চিমা সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। বিপরীতে, আমাদের পোস্টারগুলো নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে কোনো প্রকার সম্পর্ক স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে, কারণ তাদের সাথে আমাদের সমাজের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের উপাদানগুলো ইরানি নাকি না, কথা তা নিয়ে নয়, মূল বিষয়টি হলো তাদের ভেতরে প্রয়োজনীয় ইরানি নির্যাসের অভাব রয়েছে। বেশিরভাগ ডিজাইন কেবল একটি সাধারণ নকশা।

এছাড়াও, আমাদের বিজ্ঞাপনধর্মী কাজের একটা বড়ো অংশের সাথে সমাজের কোনো সম্পর্ক নেই। ঠিক কোন গোষ্ঠী বা শ্রেণির জন্য বিজ্ঞাপনগুলো নির্মিত তাও নির্ণয় করা যায় না। আমরা দর্শক বা কাক্সিক্ষত গোষ্ঠী নিয়ে অনুশীলন করি না। কোনো সন্দেহ নেই, আমরা যদি সমাজ বা কাক্সিক্ষত গোষ্ঠীর সাথে গ্রাফিক ডিজাইনের সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হতাম, আমাদের কাজগুলোর আলাদা একটা রূপ ফুটে উঠত।

Iran_5

বাম থেকে ডানে: জয়নব শাহিদির ‘পোস্টার ফর থিয়েটার’; ফারশিদ মেসঘালির ‘পোস্টার ফর ফেস্টিভাল’; আরিয়া কাসেইয়ের ‘পোস্টার ফর আভেসিনা’

ইরানের গ্রাফিক ডিজাইনগুলো পাশ্চাত্যের গ্রাফিক ডিজাইনেরই প্রতিচ্ছবি, তবে তা পাশ্চাত্যের গ্রাফিক ডিজাইনের পরিপূরক হতে পারে নি বা ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারে নি। গ্রাফিক্সের জগতে এগুলো কিছুই যোগ করতে পারে নি, অর্থাৎ কোনো ভূমিকাই রাখতে পারে নি। বড়োজোর বলতে পারি যে, গ্রাফিক্সের জগতে আমাদের গ্রাফিক্স ডিজাইন কেবল একটা প্রকার বা রূপ। ইরানের গ্রাফিক ডিজাইনে ব্যবহৃত উপাদানগুলো ইরানি চিরাচরিত সংস্কৃতি দ্বারা উদ্বুদ্ধ হলেও এর বাহ্যিক-প্রকাশ-রূপ (আউটলুক) পশ্চিমা ধাঁচের। বরং এভাবেই বলা ভালো যে, এই বাহ্যিক-প্রকাশ-রূপ—তা যাই হোক না কেন—এই ভূখ-ের কোনো কিছু বা কারও সাথে যোগাযোগ স্থাপনে উপযোগী কোনো ভঙ্গি নয়। যোগাযোগের চেয়ে অনুভূতি জাগাতেই এগুলো বেশি কার্যকরী।

 

অতীত বা পূর্ব
এটি নির্দিষ্ট করে দেয়া উচিত যে গ্রাফিক ডিজাইনে পরিচয়ের (আইডেন্টিটি) বিষয়টি কেবল সাংস্কৃতিক গ্রাফিক্সের জন্যই প্রযোজ্য, কারণ তথ্য এবং বিজ্ঞাপন-কেন্দ্রিক গ্রাফিক্সগুলো তাদের বিষয়বস্তু, তথ্য, বার্তা এবং দর্শকদের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। পরিচয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তার কোনো স্থান নেই। আমাদের সাংস্কৃতিক গ্রাফিক্স সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অতীত এবং আমাদের দৃশ্যমান ঐতিহ্য বা ইরানি পরিচয়ের সাথে ডিজাইনারের সম্পর্ক। যখন আমরা ইরানি গ্রাফিক্স সম্পর্কে বলি, তা মূলত গঠন (ফর্ম), যা মর্মার্থ এবং বাহ্যিক-প্রকাশ-রূপের চেয়ে বেশি আলোচিত হয়। এবং এই বিষয়টি কেবল আমাদের ব্যক্তিগত এবং সাংস্কৃতিক গ্রাফিক্সের ক্ষেত্রে আলোচনা করা হয়।

আমি বলতে পারি, ইরানের দৃশ্যমান (ভিজ্যুয়াল) ঐতিহ্যের সাথে আমাদের অধিকাংশ গ্রাফিক ডিজাইনারের কম-বেশি সংস্পর্শ হয়েছে। ইরানি ডিজাইনারদের পূর্ববর্তী প্রজন্মগুলো প্রতীক ও লিথোগ্রাফে মনোযোগী ছিল এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ডিজাইনাররা ফার্সি লিপি, ক্যালিগ্রাফি বা মুদ্রণের ধরন ব্যবহারে ঝুঁকেছে। আমাদের সমসাময়িক গ্রাফিক ডিজাইনের ইতিহাসে আমরা প্রতীক ও সংকেত, লিথোগ্রাফিক চিত্র, মিনিয়েচার এবং ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার প্রত্যক্ষ করি। কার্যত, আমরা অতীতের সাথে আমাদের সম্পর্ক বজায় রেখেছি, তবে অতীতের ধারাবাহিকতা আমরা ধরে রাখতে পেরেছি কিনা সেটা অন্য বিষয়।

অতীতের ব্যবহার এবং অতীতের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা দুটি ভিন্ন বিষয়। অতীতের দৃশ্যমান ভা-ারের ব্যবহার এবং অতীতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার সম্পর্ক কি একই?


Iran_6

বাম থেকে ডানে: মজিদ আব্বাসির ‘পোস্টার ফর এক্সিবিশন’; কউরোশ পারসানেজাদের ‘কভার ফর বুক’; ইব্রাহিম হাঘিঘির ‘কভার ফর বুক’


আমাদের সংস্কৃতি বিবেচনায়, গ্রাফিক ডিজাইনগুলো অতীতের ধারাবাহিকতা অথবা অতীতের বিবর্তিত রূপ হওয়া উচিত। অতীতে, আমাদের লোকেরা বিভ্রান্ত ও বিচ্ছিন্ন বোধ করে নি, এই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগটি স্বাভাবিকভাবেই আজকের দিনেও হওয়া উচিত। এমন সময় কি কখনো এসেছিল যখন লোকেরা গালিচা বা মাদুরের ডিজাইনে বিভ্রান্তি অনুভব করেছিল? যদি এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কটি গ্রাফিকগুলোতেও ঘটতে পারে তবে আমাদের আধুনিক অথচ নিজস্ব কাজগুলো করা উচিত ছিল।

এছাড়া, আমলে নেয়ার মতো আরেকটি বিষয় রয়েছে এবং তা হলো আন্তর্জাতিক ডিজাইন কমিউনিটি দ্বারা আমাদের গ্রাফিক শিল্পের বিচার এবং যা ইরান থেকে উদ্ভূত গ্রাফিক ডিজাইন সম্পর্কে তাদের মনোভাব ও প্রত্যাশা। তাদের প্রত্যাশা এবং বিচারগুলো আমাদের ইরানি হয়ে ওঠার একটি নতুন সংজ্ঞা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে আমাদের কাজগুলো বিচার করি এবং নন-ইরানীয়দের কাছ থেকে ইরানি হওয়ার মানদ- ধার করি। ইরান এবং চারুকলা সম্পর্কে পশ্চিমা সংজ্ঞা সাধারণত একটি প্রথাগত পদ্ধতি। তারা জানত ভিজ্যুয়াল উপাদানগুলো যদি কাজে উপস্থিত থাকে তবে কাজটি স্বাভাবিকভাবে তাদের গতানুগতিক ধারা থেকে আলাদা হবে এবং ইরানি হিসেবে বিবেচিত হবে।

আমাদের গ্রাফিক ডিজাইন আসলে অতীতের ভিজ্যুয়াল গ্রাফিক্সের প্রাকৃতিক ধারাবাহিকতা হওয়া উচিত। এই ধারাবাহিকতাটি তখনই বাস্তব হতে পারে যখন অতীতের সবকিছু অবিচল থাকে এবং যখন সমস্ত উপাদান সমানভাবে বিবর্তিত হয়।

আমাদের গ্রাফিক ডিজাইন আসলে অতীতের ভিজ্যুয়াল গ্রাফিক্সের প্রাকৃতিক ধারাবাহিকতা হওয়া উচিত। এই ধারাবাহিকতাটি তখনই বাস্তব হতে পারে যখন অতীতের সবকিছু অবিচল থাকে এবং যখন সমস্ত উপাদান সমানভাবে বিবর্তিত হয়। হঠাৎ করে আধুনিক সময়ে ঢুকে পড়া, যা গত ১০০ বছরের মধ্যে ঘটেছিল, অতীত থেকে আমাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। বিগত ১০০ বছরে, যখন আমরা বহির্বিশ্বের সংস্পর্শে এসেছি, পৃথিবীর প্রতি আমাদের বেশিরভাগ মনোভাব বদলেছে। আমাদের ঘরবাড়ি, শহর, জামাকাপড়, খাবার, শিক্ষা, যোগাযোগ সমস্ত কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। অধিকন্তু, এই পরিবর্তনগুলো সমপর্যায়ের নয় এবং প্রতিটি তার নিজস্ব পথে চলেছে। অতীতের সাথে আমাদের সম্পর্ক আংশিক-সংযুক্ত ধরনের এবং আমাদের নিজস্ব সময়ের সাথে সম্পর্কটি অসঙ্গত এবং অনিশ্চিত। সুতরাং, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমাদের দৃশ্যমান (ভিজ্যুয়াল) ঐতিহ্যের বাহ্যিক-প্রকাশ-রূপ প্রাকৃতিক পদ্ধতির চেয়ে বরং সমাজ থেকে সংযোগ-বিচ্ছিন্ন একটি অমীমাংসিত প্রথাগত পদ্ধতি।

পরিচয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে। দৃষ্টিভঙ্গি হলো একজন একক ব্যক্তির নজরে যা ধরা দেয়। সমস্ত উপাদান, যা কোনো ব্যক্তির মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং এই উপাদানগুলোর তাৎপর্যের ক্রমানুসারে আসে, সেই ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। আমার মানসিক কাঠামোতে উপস্থিত বিভিন্ন উপাদান থেকে আলাদা উৎস থাকতে পারে?

দৃষ্টিভঙ্গির ধরন, এর কাঠামো, আমি কী দেখি এবং আমি কী বেছে নিই তা আমার ইরানি পরিচয় প্রকাশ করে যা কোনো সাধারণ বা ঐচ্ছিক বিষয় নয়। আমার অবচেতনে অতীতের কী রয়ে গেছে? আমার মানসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অতীতের যা রয়ে গেছে তার সাথে আমার সম্পর্ক কতটা ঘনিষ্ঠ এবং অন্তরঙ্গ? আমরা কি এই উপসংহারে আসতে পারি—অতীতের সাথে আমাদের বিপর্যস্ততার ভিত্তিতে—আমাদের দৃশ্যমান (ভিজ্যুয়াল) ঐতিহ্যের সাথে আমাদের সম্পর্কের ধরনটি একটি বিপর্যস্ত প্রথাগত সম্পর্ক?

অতীতের সাথে আমাদের সম্পর্ক সুস্পষ্ট এবং ঘনিষ্ঠ হওয়া উচিত এর উপাদানগুলোকে অন্তরঙ্গভাবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। অতীতের দৃশ্যমান (ভিজ্যুয়াল) ঐতিহ্য এবং এই ঐতিহ্যে আমাদের পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যস্থতায় আমাদের প্রথাগত পদ্ধতির ফলে সীমিত সংখ্যক কাজে কিছু সংস্কারের অভিজ্ঞতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। আমাদের সমসাময়িক কাজগুলোতে আমি অতীতের দৃশ্যমান (ভিজ্যুয়াল) উপাদানগুলোর যথেষ্ট সংখ্যক অন্তরঙ্গ ব্যবহার দেখেছি এবং এখনো দেখছি। তবে আমাদের গ্রাফিক ডিজাইন এবং সমাজের বাস্তবতার মধ্যে চূড়ান্ত বিপর্যয় বিদ্যমান।

শেষে, বলতে দ্বিধা নেই যে, গ্রাফিক ডিজাইনগুলো ইরানীয় হতে পারে যদি তা জনসাধারণ এবং এখানকার বর্তমান সংস্কৃতির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। এমন নয় যে, গ্রাফিক ডিজাইনার নিজেরাই বা বিদেশি দর্শকদের দ্বারা তা ইরানি হিসেবে আখ্যায়িত হয়। গ্রাফিক ডিজাইন যা এই সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত নয় এবং যা সমাজের কিছু গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে না তা একটি বিমূর্ত এবং বিদেশি গ্রাফিক ডিজাইন ছাড়া আর কিছু নয়।

 

প্রযুক্তি
১৯৫১ সালের পর থেকে গ্রাফিক ডিজাইনের কাজগুলো পর্যবেক্ষণ করে আমরা দেখতে পেলাম যে আমাদের গ্রাফিক ডিজাইন সেই সময়ের প্রযুক্তি এবং প্রযুক্তিগত সুবিধাগুলোর সাথে গভীরভাবে মিশে গেছে এবং প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে সাথে গ্রাফিক ডিজাইনের পদ্ধতির অবকাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে। সাধারণভাবে, আমাদের গ্রাফিক ডিজাইন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দুটি প্রধান বিষয় প্রভাব ফেলেছে। প্রথমটি হলো সামাজিক এবং ঐতিহাসিক পরিবর্তন ও পশ্চিমাদের সাথে আমাদের লড়াই এবং দ্বিতীয়টি প্রযুক্তিগত পরিবর্তন।

প্রতিটি সময়কালেই আমাদের গ্রাফিক ডিজাইন প্রযুক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এবং প্রতিটি সময়ের প্রযুক্তিগত সুবিধাগুলো এটিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।


Iran_7

বাম থেকে ডানে: বিজন সাইফৌরির ‘পোস্টার ফর টাইপোগ্রাফি এক্সিবিশন’; ফরহাদ ফোজৌনির ‘পোস্টার ফর মিউজিক’; পেদ্রাম হার্বির ‘কভার ফর বুক’


ষাটের দশকের আগের সময়ের সাংস্কৃতিক এবং বিজ্ঞাপনধর্মী কাজগুলো যখন পর্যবেক্ষণ করি তখন আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাই, কেবল আঁকতেই ডিজাইনারদের প্রচুর কর্মশক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছিল। প্রতিটি গ্রাফিক কাজে প্রধান কর্যনির্বাহী বিষয়গুলো হলো লিখন, চিত্রকলা বা ফটোগ্রাফি। ষাটের দশকের আগে, ফটোগ্রাফগুলোর মডেলিং যথাযথ মানের না থাকায় নকশাগুলো দক্ষ শিল্পীরা আঁকতেন। লেখাগুলো ছিল ক্যালিগ্রাফি যা ক্যালিগ্রাফার বা ডিজাইনার নিজেই করতেন। সমস্ত বইয়ের কভার ডিজাইন এবং পোস্টারগুলোতে চিত্রালঙ্করণ ব্যবহৃত হতো। এমনকি একজন গ্রাফিক ডিজাইনারকে ‘বিজ্ঞাপনী চিত্রশিল্পী’ হিসেবে অভিহিত করা হতো। সৃজনশীল চিন্তাভাবনা বা গ্রাফিক ডিজাইন খুব কম দেখা যেত। গ্রাফিক ডিজাইনের মূল বিষয় ছিল ম্যানুয়াল কাজের দক্ষতা।

ষাটের দশকে আমরা প্রযুক্তির ব্যবহারে দ্রুত বিকাশ লক্ষ্য করি। ফটোগ্রাফে ম্যানুয়াল দক্ষতার পরিবর্তে কন্ট্রাস্টসহ মডেলিংয়ের কৌশল ব্যবহার করা এই সময়ের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি। লেখার জন্য, সংবাদপত্রের শিরোনামগুলো থেকে অক্ষর কেটে কেটে ব্যবহার করা হতো। ওই সময়কালে টাইপোগ্রাফির ধারণা আমাদের ছিল না।

ষাটের দশকে আমরা প্রযুক্তির ব্যবহারে দ্রুত বিকাশ লক্ষ্য করি। ফটোগ্রাফে ম্যানুয়াল দক্ষতার পরিবর্তে কন্ট্রাস্টসহ মডেলিংয়ের কৌশল ব্যবহার করা এই সময়ের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি। লেখার জন্য, সংবাদপত্রের শিরোনামগুলো থেকে অক্ষর কেটে কেটে ব্যবহার করা হতো। ওই সময়কালে টাইপোগ্রাফির ধারণা আমাদের ছিল না।

সত্তরের দশকে শিরোনাম, বইয়ের কভার লিখন এবং পোস্টারগুলোতে পরিবর্তন দেখা যায়। এই সময়ের মধ্যে মুদ্রাক্ষর ধীরে ধীরে ক্যালিগ্রাফির জায়গা নেয়। যদিও ষাটের দশক এবং তার আগে, লেটারপ্রেস মেশিনে মুদ্রণ পরিচালিত হতো, তবুও কাজগুলো মূলত সাদা-কালো ছিল। এই দশকের শেষের দিকে, অফসেট মেশিনের মাধ্যমে রঙিন মুদ্রণ সম্ভব হয়েছিল। ফটোগ্রাফি তার জায়গা বিজ্ঞাপনে খুঁজে পেয়েছিল; তবুও, সাংস্কৃতিক গ্রাফিক কাজগুলো মূলত চিত্রালঙ্করণের মাধ্যমে নির্মিত হতো। প্রযুক্তিগত কারণে বর্ণের নকশা এবং আকার হ্রাস/বৃদ্ধি এত সহজ বা সাধারণ ছিল না।

ষাট এবং সত্তরের দশকে গ্রাফিক কাজের নির্মাণ প্রক্রিয়া খুব সহজ ছিল না। প্রযুক্তিগত সুবিধার অভাবকে পূরণ করতে সৃজনশীল ধারণা এবং চিন্তাভাবনা ব্যবহার করা হতো। মাত্র সামান্য কিছু কাজ ফর্ম হিসেবে নির্মিত হয়েছিল তখন। এই সময়ের দৃষ্টিভঙ্গির ভেতরে প্রভাবশালী ছিল ধারণা-ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি।

আশির দশককে প্রযুক্তিতে নতুন মোড় হিসেবে বিবেচিত হয়। ব্যক্তিগত কম্পিউটার এবং তাদের সর্বজনীন ব্যবহার ইরানের গ্রাফিক ডিজাইনে নতুন সুবিধাদির যোগান দিয়েছিল যা গ্রাফিক্সের সামগ্রিক উপলব্ধিকে রূপান্তরিত করে। সফটওয়্যারের উপর দক্ষতার সাথে প্রাথমিক স্তরের অভিজ্ঞতার মিলিত ন্যূনতম শক্তি প্রযুক্তিগতভাবে সবচেয়ে জটিল গ্রাফিক কাজের জন্য যথেষ্ট ছিল। এই সহজ কর্মক্ষমতা বিভিন্ন সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও বয়ে আনে। সীমাহীন পরিবর্তন এবং নির্দিষ্ট কাজে দ্রুত পারদর্শিতার সম্ভাব্যতা, বর্ণ নির্ধারণ এবং ফন্টের পরিবর্তন নতুন সম্ভাবনা হিসেবে চিহ্নিত হয়। সহজ কর্মক্ষমতা এবং অসীম ও দ্রুত পরিবর্তনের সম্ভাবনা দৃষ্টিভঙ্গিতে ও গ্রাফিক ডিজাইনারদের সামগ্রিক পদ্ধতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনে। এই সময়কালে, গ্রাফিক ডিজাইনারদের দৃষ্টিভঙ্গি একটি কার্যোদ্ধারমূলক পদ্ধতির হয়ে ওঠে।

পঞ্চাশের দশকের মতো কার্যোদ্ধার পুনরায় মূল ভূমিকায় এসেছিল তবে ভিন্ন সামর্থ্য নিয়ে। এই নতুন ঘটনার ইতিবাচক বিষয় হলো গ্রাফিক ডিজাইনারদের নান্দনিক রুচির বিকাশ। এই পরিবর্তনগুলো প্রথাগত নতুনত্ব সম্ভব করেছে। কাজগুলো খুব পরিষ্কার এবং নির্ভুলভাবে সম্পাদন করা যেতে পারত। রঙের ব্যবহার এবং নতুন মিশ্রণ তৈরিতে গ্রাফিক শিল্পীদের দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে গ্রাফিক ডিজাইনকে উপেক্ষা করা হয়েছিল এবং এমনকি গ্রাফিক ডিজাইনারদের কেউ কেউ একে অপ্রয়োজনীয় হিসেবে বাতিল করেছিল।


Iran_8

বাম থেকে ডানে: সায়েদ মেশকির ‘কভার ফর বুক’; পোওয়া আহমাদির ‘পোস্টার ফর এক্সিবিশন’; ইমান রাদের ‘পোস্টার ফর এক্সিবিশন’


এই বিশাল এবং দ্রুত সম্ভাবনার আর একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো গ্রাফিক ডিজাইনাররা গঠন, রঙ এবং ফন্টের পরিবর্তনের জগতে নিমজ্জিত হয়েছিল। বার্তা, তথ্য এবং যোগাযোগের উপাদানগুলোর যথার্থতার প্রতি আনুগত্য থেকে এটি ডিজাইনারদের সহজেই দূরে রাখে। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, মর্মার্থ এবং যোগাযোগের বিষয়টি নান্দনিকতার কাছে উৎসর্গ করা হয়। শেষ পর্যন্ত, আমরা কাজগুলোতে পুনরাবৃত্তির মুখোমুখি হয়েছি।

 

শেষ কথা
আমরা নতুন প্রজন্মের গ্রাফিক ডিজাইনারদের মধ্যে শক্তি, উৎসাহ এবং আগ্রহের একটি তরঙ্গ প্রত্যক্ষ করেছি। এই পুরনো জমিতে অনেকগুলো কুঁড়ি অঙ্কুরিত হয়ে উঠছে। আমার দৃষ্টিতে, এখন গ্রাফিকের সম্ভাবনা প্রচুর, গ্রাফিক ডিজাইনে গভীরতা, চিন্তাশীলতা এবং তাত্ত্বিক কথোপকথনের উপর আলোচনার সময় এসেছে যেন এই তরুণ প্রতিভা পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে।

আমাদের এখন সঠিকভাবে জানা দরকার যে আমরা কী করছি এবং কেন করছি। এটা প্রতীয়মান হলো যে, আমাদের গ্রাফিক ডিজাইন স্বতন্ত্র এবং সুস্পষ্ট হতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সক্রিয়। আমরা সম্ভবত হালনাগাদ ও যোগাযোগযোগ্য দেশজ গ্রাফিক ডিজাইন যোগান দিতে প্রস্তুত।


farshid mesghaliফারশিদ মেসঘালি ১৯৪৩ সালে ইসফাহানে জন্মগ্রহণ করেন। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে চিত্রাঙ্কন (পেইন্টিং) বিষয়ে পড়ার সময় তিনি ১৯৬৪ সালে ‘নেগিন ম্যাগাজিন’ দিয়ে গ্রাফিক ডিজাইনার এবং চিত্রালঙ্কারক হিসেবে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন।

তিনি ১৯৬৮ সালে তেহরানের শিশু ও তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশের কাজে নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন, সেখানে তিনি শিশুদের জন্য বইয়ের চিত্রালঙ্করণ এবং বাচ্চাদের জন্য অ্যানিমেটেড ফিল্ম তৈরি করেছিলেন। ১৯৭০-১৯৭৮ সালের মধ্যে তিনি তার বেশিরভাগ পুরস্কার বিজয়ী অ্যানিমেটেড ফিল্ম, সিনেমার পোস্টার এবং শিশুদের বইয়ের জন্য চিত্রালঙ্করণ তৈরি করেছিলেন।

তিনি ১৯৭৯ সালে প্যারিসে চলে আসেন। পরের চার বছরে তিনি শিল্পী হিসেবে বেশ কয়েকটি চিত্রকর্ম এবং ভাস্কর্য তৈরির কাজ করেছিলেন, যা প্যারিসের সামি কিং গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়েছিল।

১৯৮৬ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে আসেন এবং লস অ্যাঞ্জেলেসে তাঁর গ্রাফিক ডিজাইনের স্টুডিও, ‘ডেস্কটপ স্টুডিও’ খোলেন। ১৯৯০-১৯৯৪ সালের মধ্যে তিনি স্ন্যাপশটের উপর ভিত্তি করে একাধিক ডিজিটাল ছবি তৈরি করেছিলেন, যা লস অ্যাঞ্জেলেসের কিছু গ্যালারি এবং পরে এলএ কাউন্টি মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টস-এ প্রদর্শিত হয়েছিল।

১৯৯৪ সালে তিনি সান ফ্রান্সিসকোতে মাল্টি-মিডিয়া সংস্থা ওয়ার্ল্ডস, ইনক.-এর পক্ষে কাজ শুরু করেন এবং আইবিএম ও এওএল সহ অনেক ক্লায়েন্টের জন্য ইন্টারনেটে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির পরিবেশ তৈরি ও ডিজাইন করেছেন।

বর্তমানে তিনি তেহরানে বসবাস এবং কাজ করছেন। তিনি বেশিরভাগ সময় ভাস্কর্য এবং চিত্রালঙ্করণের কাজ করছেন। তাঁর সৃষ্টিগুলো বিশ্বজুড়ে মিউজিয়াম, সংগ্রহশালা এবং গ্যালারিতে উপস্থাপিত হয়ে আসছে এবং তিনি ১৯৬৮ সাল থেকে অনেক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও লাভ করেছেন।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮; রাজশাহী। মূলত গল্প লিখেন। কলম চলে শিশুসাহিত্যেও। ২০১০ সালে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ঘন অন্ধকারের খোঁজে’ এবং ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘ঘি দেয়া গরম ভাত আর চিতল মাছের পেটি’। মাঝে ২০১৩ সালে কিশোর গল্পগ্রন্থ ‘মগডাল বাহাদুর’ প্রকাশিত হয়। প্রকাশের অপেক্ষায় আছে কিশোর উপন্যাস ‘লাবুদের দস্যিপনা’ ও কিশোর গল্পসংকলন ‘রাজুর ভুতুড়ে ম্যাজিক’। প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেন ব্যবস্থাপনা শিক্ষায়। বর্তমানে দেশের স্বনামধন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ বিভাগে কাজ করছেন। জীবিকার স্রোতে ব্যস্তজীবন পেরিয়ে সাহিত্যপাঠের ফাঁকে ফাঁকে লিখেন খুব অল্পই। প্রত্যাশা এতটুকুই, লেখাগুলো কেবল যথাযথ পাঠকের নাগালে পৌঁছে যাক।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।