বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

ফেরিওয়ালা : জাকিয়া শিমু

0

আশ্বিন মাসের পড়ন্তবেলায় ঢাকা-মাওয়াগামী লক্কড় ঝক্কর ‘ইছামতী’ নামের বাস, নিমতলা বাসঘাটে এসে খানিকক্ষণ থামল। গালকাটা আব্দুল মতিন কাঁধের ঝোলা শক্ত হাতে চেপেধরে অন্য হাতে বাক্সপেটরা নিয়ে সাবধানে বাস থেকে নেমে এলো। ঢাকার অদূরের স্থান হলেও এখানকার বায়ু শহরের মতো ধোঁয়া-ধুলোয় মাখামাখি নয়, বেশ হালকা, গায়ে লাগতে তা বেশ টের পাওয়া গেল। শীতল বায়ু নীরবে বইছে, শীত আগমনের পূর্বাভাস। বুকপকেটে কুঁচকানো কাগজটায় আরও একবার চোখ রাখল গালকাটা আব্দুল মতিন।

নীল বলপয়েন্টে অভিজ্ঞ ডা. প্রেসক্রিপশনের আদলে দুর্ভেদ্য হস্তাক্ষরে ঠিকানা লেখা। গালকাটা আব্দুল মতিন কাগজের ভাঁজ খুলে কপাল যৎসামান্য কুঁচকে, সামনের দিকে ঝুঁকে মনোযোগে পড়ে ঠিকানা উদ্ধারে চেষ্টা চালায়।

বাসঘাট থেকে মাইল দুয়েক উত্তর দিকে এগোতে পথ তিন ভাগে ভাগ হয়ে সাপের দেহের মতো এঁকেবেঁকে সবুজ মাঠের ভেতর দিয়ে অজানায় গিয়ে ঠেকেছে। হাতের ডান-বাঁয়ের পথ রেখে নাক বরাবর আরও মাইলখানেক হেঁটে নজরে পড়বে প্রাচীন বয়োঃবৃদ্ধ এক বটবৃক্ষ। বটবৃক্ষের তলায় দাঁড়ালে সমুখে দেখা মিলবে বহু পুরোনো আধভাঙা মাথা নিয়ে দাঁড়ানো এক মঠ। মঠ দাঁড়িয়ে আছে সেকেলের এক মজা দিঘিরপাড় ঘেঁষে। গালকাটা আব্দুল মতিন এ পর্যায়ে এসে দম ফুরিয়ে যাওয়া নিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে লম্বা একটা দম ফেলে। এরপর আবার কাগজে চোখ বুলায়—দিঘিরপাড়ের উত্তর কোনার বাড়িটি তার গন্তব্য।

গালকাটা আব্দুল মতিনের কাছে ‘ঠিকানা’ অনেকটা স্কুলের শেষবর্ষের পাটিগণিতের মতো কঠিন লাগছে। মস্তিষ্কের খোঁদলের নিউরনগুলো কেমন যেন নড়েচড়ে উঠল। কপালে দুধের সরের মতো কুঁচকানো ভাবটা কাটল তো না-ই, আরও একপ্রস্থ যেন বেড়ে গেল। এখনো ঠিকানা ঠিকঠাক বুঝা গেল না। পুরোটাই যেন মাথার ওপর দিয়ে গেল। সে আবার শুরু থেকে ভাঁজ-কাগজ পড়তে শুরু করল।

ওদিকে তার একহাতে লেইস ফিতার চৌকোনা ভারী কাচ-কাঠের বাক্স, অপর হাতের কাঁধে ঝুলানো গোপন জিনিসপাতিতে ঠাসা সাদা কাপড়ের ঝোলাটা বড্ড যন্ত্রণা ধরিয়ে দেয়। মনে হয় যেন কেউ তার দুবাহু ধরে বানরের মতো ঝুলে আছে। সে বারকয়েক দুহাতের জিনিস অদলবদল করে, তারপরও স্বস্তি মেলে না। গালকাটা আব্দুল মতিনের পেটে ভুখ লেগেছে। সকাল সকাল তার খাওয়ার অভ্যাস নাই। বাসঘাটের দুপাশে নানান পদের দোকানপাট। দু-একখানা খাবারের দোকান চোখে পড়তে ভুখের মাত্রা চৈত্রমাসের রোদের মতো তেতিয়ে ওঠে। গ্রামাঞ্চল, পথঘাট গাছগাছরায় ছাওয়া। বড়ো বড়ো গাছের ছায়ে দোকানগুলো অন্ধকারে ডুবে আছে।

অজপাড়াগাঁ, সবেমাত্র পল্লিবিদ্যুতের নাগাল পেয়েছে। যদিও বিদ্যুতের তেজ দিনের বেলায় তো থাকেই না রাতে ঘনঘন যাওয়া-আসা করে। তারপরও সব দোকানে তা পৌঁছেনি। যাদের দোকানে পল্লিবিদ্যুতের নামকাওয়াস্তে ফ্যান-বাল্ব ঝুলছে তাদের বেচাবিক্রি একটু বেশিই বাড়তি বলতে হয়। ‘মায়ের দোয়া’ ভাতের হোটেলের দুয়ারে দাঁড়িয়ে এক ছোকরা বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার বাহাদুরি হাঁকিয়ে খদ্দের ডাকছে। আব্দুল মতিন ‘মায়ের দোয়া’ নামের লাল হরফে লেখা ভাতের হোটেলে ঢুকে পড়ে। দুই হাতের বোঝার জেরে তার শরীর ঘেমে উঠেছে। বৈদ্যুতিক পাখার হাওয়া যদি একটু কপালে জোটে। হোটেলে ঢুকে অসহায় চোখে মাথার ওপর ঝুলে থাকা অ-ঘুরা ফ্যানের দিকে সে তাকিয়ে থাকে। বাঁ-পাশে খদ্দেরদের হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। সেখানে লাগোয়া আয়নায় নিজের ছদ্মবেশী প্রতিবিম্ব দেখে সহসা কেমন আনমনা হয়ে ওঠে আব্দুল মতিন।

ছিপছিপে গড়নের বারোমাস্যা অম্বলরোগী গালকাটা আব্দুল মতিনের পক্ষে ভারী বাক্সপেটরা নিয়ে হেঁটে এত খানি পথ পেরোনো চাট্টিখানি কথা নয়। তাও সোজাসাপটা পথ হলে কথা ছিল। এবড়ো-খেবড়ো, বন্ধুর মেটেপথ। সবে বর্ষাকাল গত হয়েছে। রাস্তার ফাঁকে ফাঁকে বর্ষাকালের জমাপানির গর্ত শুকিয়ে মাটি শক্ত পাথর হয়ে আছে। হাঁটতে গেলে খালি পায়ে তীব্র আঘাত লাগে।

তারপরও পথের দু’ধারের দৃশ্যপটে চোখ রাখতে সমস্ত ধকল যেন পুষিয়ে দেওয়া যায়, অনায়াসে। দু’ধারের ঢোলকলমির ঝোপ। ঝোপের ফাঁকফোকরে নানান পদের গাছগাছড়া-বনফুলে ঠাসা। ঘন কালচে সবুজে কলমির এলানো ডাল ধরে বাদুড়ঝোলা হয়ে ঝুলে আছে সতেজ সাদা-বেগুনি কলমির ফুল। ওদিকটায় চোখ পড়তে আব্দুল মতিনের মনটা প্রচ্ছন্নতায় ভরে ওঠে। ঢোলকলমির শরীর জুড়ে সোনালি আঁকশিলতা জড়াজড়ি করে ধরে আছে মায়ের আঁচলে যে রূপে আটকে থাকে অবুঝ সন্তান, সে রূপে।

আব্দুল মতিনের মনে পড়ে যায় মৃত মায়ের মুখখানা, তার শৈশবকাল—তাদের দখিনের উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা কুলবরই গাছটার কথা। কণ্টকযুক্ত গাছটার শাখা-পাতায় জড়িয়ে থাকত গুচ্ছগুচ্ছ স্বর্ণলতা। স্বর্ণলতায় দেহ মুড়িয়ে বন্ধুরা দিনভর ছুটে বেড়াত মাঠে-ঘাটে, বনবাদাড়ে কিংবা নদীরপারে।

আব্দুল মতিনের মনে পড়ে যায় মৃত মায়ের মুখখানা, তার শৈশবকাল—তাদের দখিনের উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা কুলবরই গাছটার কথা। কণ্টকযুক্ত গাছটার শাখা-পাতায় জড়িয়ে থাকত গুচ্ছগুচ্ছ স্বর্ণলতা। স্বর্ণলতায় দেহ মুড়িয়ে বন্ধুরা দিনভর ছুটে বেড়াত মাঠে-ঘাটে, বনবাদাড়ে কিংবা নদীরপারে। এসবের কিছুই আজ আর নেই—শৈশব, মা কিংবা কুলবরই গাছটি! নদীটাও মরে গেছে! শুধু ধূসর স্মৃতিরা মাথার খোলের ভিতরে নীরবে লুকিয়ে আছে। সময়ে-অসময়ে বেরিয়ে এসে মনঃকষ্টের জোগান দেয়।

অতীত স্মৃতি রোমন্থনে কি না কে জানে! এতক্ষণের মাথায় বাজ-পড়া ধরনার সমস্যাটা তার মাথা থেকে সহসাই উড়ে চলে গেছে। বাকি পথটুকু হাঁটার দম সবলে সে ফেরত পায়। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে ফেরিওয়ালা রিকশায় চড়ে সদাইপাতি বিক্রি করে না। তাতে গাঁয়ের সহজসরল লোকের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়ার কথা। হেলাল ব্যাপারীর সাথে সে নিজে বুদ্ধিতে এ পথ বাতলেছে। প্রস্তাবটা তার নিজের পক্ষ থেকেই ছিল। গালকাটা আব্দুল মতিন ধান্দাবাজ লোক এবং চতুর তো বটেই! যদিও বাতচিৎ তেমন একটা করে না, মেপে ঝুঁকে কথা বলা তার অভ্যাস।

দাড়িগোঁফে জঞ্জাল মুখখানায় গাম্ভীর্যের কঠিন আচ্ছাদন। লালচে কমলারঙের চোখজোড়ায় দৃষ্টি পড়লে রাজ্যের আতঙ্ক এসে ভর করে মনে। কাজ কম করে তবে যে কাজটা সে হাতে নেয় সেটা বেশ চতুরতার সাথে এবং নাটকীয়ভাবে করে। নিজে ইচ্ছেমতো নাটক সাজিয়ে সুনিপুণ অভিনয় অবলীলায় করে যায়। এ অবধি জাঁদরেল পুলিশ-দারোগাও তার কাজের হদিস খুঁজে পায়নি। হেলাল ব্যাপারী বহু চেষ্টা তদবিরের পরে তাকে পেয়েছে। এসব কাজে নির্ভরতার অভাব হলে কঠিন ঝামেলায় পড়তে হয়। কাজেই কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে পাকা দস্তুর ফেরিওয়ালা’র পাঠ করে যেতে হবে। চুক্তির অর্ধেক টাকা তার পকেটে জমা হয়ে আছে, বাকিটা কাজ শেষে পাওয়া যাবে। এত সবের পর হাত গুটিয়ে নেওয়া যায় না।

হেলাল ব্যাপারীর ক্রিয়াকলাপ বেশি জলের জলজপ্রাণীর ন্যায়। বাহির দেখে তার ভেতর বুঝা মহা মুসিবতের কাজ। তার খুব কাছের মানুষও তার গতিবিধি বুঝতে পারে না। সারা দিন ঘুরেফিরে, নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ায়। সে অবশ্য তার এহেন ভবঘুরে স্বভাবচরিতের দায়, বেশ গর্ব ভরে তার বংশের পূর্বপুরুষের ওপর চাপিয়ে দেয়। পূর্বপুরুষ এই ঘরানার ছিল বলেই তার চরিত্রে এই স্বভাব বহমান। এটা দোষ কিংবা গুণ যাই হউক তা সে নিজের নয়, বংশধারা থেকে এসেছে।

হেলাল ব্যাপারীর যুক্তি অবশ্য একবাক্যে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মতোও নয়। বংশপরম্পরায় এমন আমলও বেশ রয়ে গেছে। তার বড়ো দাদা একদিন বলা নাই কওয়া নাই, একতারা হাতে সেই যে গানের দলের সাথে দেশছাড়া হলো আজঅবধি তার আর কোনো হদিস মিলল না।

হালের ছোটো চাচা, সেও একই কাজ করল। বয়েস ষাট পেরিয়ে গেছে তাও বছর দুই হলো। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যাত্রাদলের সাথে দেশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা অবধি ঘুরে বেড়িয়েছে। গান-বাজনা জীবনের ব্রত করেছেন।

একটা সময়ে এ দেশে যাত্রাপালার সুসময় ছিল, দাপটও ছিল। গাঁয়ে-গঞ্জে অহরহ যাত্রাপালা হতো। ছোটো চাচার চেহারাসুরত দেখবার মতো ছিল। শরীরের গঠন সুপারিগাছের মতো লম্বা-পাতলা মেদশূন্য। চোখ-নাক খাড়া খাড়া। কবি কাজী নজরুলের ইসলামের মতো একগুচ্ছ ঝাঁকড়া চুল কাঁধ অবধি এসে ঝুলে পড়েছে। গলার স্বরে গাম্ভীর্যের কমতি নেই। পুরোদস্তুর নায়কের প্রতিচ্ছবি। দুর্দান্তভাবে যাত্রাপালায় নায়কের পাঠ করে বেরিয়েছেন যুগের পর যুগ। মাঝেমধ্যে বছর ঘুরতে একবার বাড়ি এসে ঘুরে যেতেন বটে কিন্তু ঘরসংসারে তাকে বাঁধতে পারে নাই।

শেষমেশ গত প্রায় বছরপাঁচেক হয় ছোটো চাচা বাড়িতে পাকাপোক্তভাবে ফিরে এসেছেন। যাত্রাপালার সেই সুদিন আর নেই। এখন দেশের মানুষ যাত্রাপালায় আকৃষ্ট হতে পারছে না। নানান পদের সস্তা বিনোদনের বিপরীতে যাত্রাপালার মতো ঐতিহ্যবাহী বিনোদন অতীত ইতিহাসের অংশ হয়ে ইতিহাসের বইয়ে জায়গা করে নিয়েছে। বলতে গেলে খুব দ্রুত প্রেক্ষাপট, পালটে গেল। নতুন প্রজন্ম জানবেও না যাত্রাপালা নামক একপ্রকার বিনোদনে এককালে তার পূর্বপুরুষগণ আনন্দ-উৎসবে ডুবে ছিল।

যাহোক এবার ছোটো চাচার বর্তমান অবস্থার দিকে ফেরা যাক। ছোটো চাচা যখন বাড়ি ছাড়েন তখনকার বাড়ির চিত্র এখনকার মতো ছিল না। দাদা-দাদি, চাচা-ফুফু এবং তার নিজের মা-বাবা ভাইবোন তো ছিলই, আশেপাশের পড়শিদের সাথেও সেকালে নিজ পরিবারের মতো অতিশয় ঘন সম্পর্ক থাকত। যাত্রাপালার মতো এখানেও ঢের পরিবর্তন এসেছে।

তার এই দীর্ঘ অনুপস্থিতির সময়ের মাঝে একে একে প্রায় সবাই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। হেলাল ব্যাপারীর বাবা-মাও বেঁচে নেই। বাবার পক্ষের একমাত্র ছোটো চাচা ছাড়া হেলাল ব্যাপারীর ধরাধামে আর কেউ নেই। মানুষগুলো না থাকলেও তাদের বিষয়-সম্পদ ওয়ারিশ মাফিক ভাগ-বাটোয়ার হয়েছে। চাচা ফিরে এসে অবধারিতভাবে হেলাল ব্যাপারীর বউ-বাচ্চাসহ সংসারে সাদরে যুক্ত হয়েছেন।

হেলাল ব্যাপারীর বাবার কর্কট রোগ ছিল। নিশ্চিত মৃত্যুরোগ। এ রোগে মানুষটা যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়, অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরিবারের অন্যান্যদের পথে বসিয়ে, বিষয়-সম্পত্তি নিঃশেষ করে তবেই সে চলে যায়। তদ্রূপ তার বাবাও চিকিৎসায় নিজের অংশের জমিজিরত প্রায় সবই খুইয়ে গেছেন। হেলাল ব্যাপারীর নিজের বলতে কিছুই নেই। ভোগ-দখলে যা-কিছু আছে এসবই ছোটো চাচার। চাচা যখন ফিরে এলো তার মধ্যে সম্পদ হারানোর একটা ভয় ছিল। কিন্তু আজঅবধি ছোটো চাচা তার বিষয়আশায় স্বেচ্ছায় বুঝে নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি। এমনকি কখনো তার সম্পদের হিসাবটা পর্যন্ত জানতে চাননি। জীবনভর এসব দূরে সরিয়ে গানবাজনা নিয়েই পড়ে থেকেছেন। সে অভ্যাস এখনো থেকে গেছে। নিজের মনে গানবাজনা করেন, ঘুরে বেড়ান, মন চাইলে বাড়ি ফিরেন নয়তো ফেরেন না। এত দিন সব কিছু ঠিকঠাক এমনভাবেই চলছিল।

কিন্তু গত বছর হুট করে ছোটো চাচা এক হুলস্থূল কাণ্ড বাঁধিয়ে বসল। শুধু হেলাল ব্যাপারী নয় গাঁয়ের সকলে তার এই কাণ্ডে তাজ্জব বনে গেল।

বাড়িতে চাচার যাত্রাদলের এক পুরোনো বন্ধু বেড়াতে আসে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। প্রায়ই চাচার বন্ধুবান্ধব বেড়াতে আসে, একত্রে তারা গানবাজনা করে, মনের আনন্দে ঘুরেফিরে আবার চলেও যায়। চাচাও হরহামেশা এমনভাবে বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া-আসা করেন। বন্ধুরা তার সমমনা—সমস্ত ধ্যানজ্ঞান ওই গানবাজনার পরে। তো সে রূপ চাচা একসময় বন্ধুর সাথে বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর মাস ঘুরে মাস আসে কিন্তু চাচা ফিরে আসেন না। বাড়ির কেউ বন্ধুর ঠিকানা জানত না তাই চাচার খোঁজ করা হয়ে ওঠে না।

প্রায় পাঁচ মাস পর আশ্বিন মাসের এক ভর সন্ধ্যাবেলায় হেলাল ব্যাপারী দাওয়ায় বসে আছে। হাতে আকিজ বিড়ির প্যাকেট, বুকপকেটে ম্যাচের বাক্স। রাতের খাওয়ার পর নিরালায় বসে আয়েশ করে একখানা বিড়িতে সুখটান দেওয়া তার বহুকালের অভ্যাস। তো রাত বাড়তে রাতের গাঁয়ে আঁধারের প্রলেপ বেশ গাঢ় হয়ে পড়তে শুরু করে। বাড়ির উত্তর সীমানাঘেঁষা ঝোপজঙ্গল হতে দলে দলে জুনিপোকারা বেরিয়ে আসে। অন্ধকার গাঢ় হতে এদের আনন্দ যেন আর ধরে না। দলবেঁধে হাওয়ায় উড়ে উড়ে বেড়ায়। রাত যত বাড়ে ঝিঁঝি পোকার গলার আওয়াজ সমান তালে বাড়ে। বাড়ির সম্মুখের কদম গাছটায় বাদুড় ঝুলে আছে। ওরা কালো চকচকে চোখে হেলাল ব্যাপারীর দিকে তাকিয়ে থাকে। হেলাল ব্যাপারী সারা দিন উঁচিয়ে থাকে রাতের এসব নিখুঁত সৌন্দর্য উপভোগ করতে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম ছিল না।

হেলাল ব্যাপারী আয়েশি মেজাজে বিড়ি ধরায়। মনের সুখে বিড়িতে লম্বা টান দেয়। মুখ থেকে একদলা অশুদ্ধ-ধোঁয়া, আশ্বিনী হালকা কুয়াশা-ভরা হাওয়ার সাথে মিলেমিশে একাকার হতে, অন্ধকার রাতের মুগ্ধতায় অমাবস্যার চাঁদের মতো সেও ডুবে যায়। এমন সময়ে তার খুব নিকটে দুজন মানুষের ফিসফাস আওয়াজে তার ধ্যান ভাঙে।

হেলাল ব্যাপারী আয়েশি মেজাজে বিড়ি ধরায়। মনের সুখে বিড়িতে লম্বা টান দেয়। মুখ থেকে একদলা অশুদ্ধ-ধোঁয়া, আশ্বিনী হালকা কুয়াশা-ভরা হাওয়ার সাথে মিলেমিশে একাকার হতে, অন্ধকার রাতের মুগ্ধতায় অমাবস্যার চাঁদের মতো সেও ডুবে যায়। এমন সময়ে তার খুব নিকটে দুজন মানুষের ফিসফাস আওয়াজে তার ধ্যান ভাঙে। বিড়ির আগায় জমে থাকা আগুনের ফুলকি আর জুনিপোকার মৃদু আলো ছাড়া চারপাশে কোন আলো নেই।

হেলাল ব্যাপারী আচমকা উঠে দাঁড়ায় কিন্তু তাদের ঠাহর করতে পারে না। একসময় ছোটো চাচা নিজের উপস্থিতি জানাতে মৃদু শব্দে কাশি দেওয়ার ভান করলে, হেলাল ব্যাপারী চাচাকে ফিরে পেয়ে খুশিতে তাকে ঝাপটে ধরে। চাচা অবশেষে ফিরে এসেছেন, তবে, তিনি একা নন। নিজের বয়সের অর্ধেক-বয়সি এক কন্যা তার সাথে। কন্যা, লাল বেনারসির ভেতর জড়োথরো হয়ে ছোটো চাচার গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। চাচা স্বভাবতই এহেন কর্মে অনভ্যস্ত। সেও বউর সাথে লজ্জাবনত চোখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

হুট করে এমন অকল্পনীয় দৃশ্য দেখে হেলাল ব্যাপারী প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়ে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো, মাথায় তার আস্ত আকাশ ভেঙেচুরে আছড়ে পড়েছে। চাচির বয়েস অল্প, তা সে যদ্দুর ঘোমটার আড়াল থেকে দেখতে পেয়েছে তাতে বয়স আন্দাজ করতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি। তার নিজ বউয়ের চেয়ে কম করে হলেও বছর দশকের ছোটো হবে, তা সে নিশ্চিত। ভবিষ্যৎ ভাবনায় হেলাল ব্যাপারী চূড়া ভেঙে পড়া পাহাড়ের মতো ভগ্ন-হৃদয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

নির্ঘুম রজনি শেষে ভোরসকালে হেলাল ব্যাপারী দাওয়ায় পরে বাঁশেরমুড়া পেতে চুপচাপ বসে থাকে। মাথার ওপর তার বিশাল বড়ো চিন্তার বোঝা। ঘুম তার চোখ থেকে উবে গেছে। সারা রাতের ধকল চোখের নিচে গাঢ় আঁধার করে বসে গেছে। অবশ্য হেলাল ব্যাপারীর ভাবনা মোটেও অবান্তর ছিল না। রাত পোহালে তা সবার নজরে পড়ল। চাচির শরীর জুড়ে গর্ভধারণের পরিস্ফুট ছাপ-চিহ্ন টের পাওয়া গেল। তার চোখের সামনে সিনেমার দৃশ্যের মতো তার নিজের ভবিষ্যতের করুণ পরিণতি একের পর এক চোখের কোনায় ভেসে উঠছে। আশ্বিনের ভোরবেলাকার হাওয়ায় শীতের আমেজ বেশ চনমনে হলেও দুশ্চিন্তায় হেলাল ব্যাপারী ঘেমে ওঠে। এতকাল চাচার বিষয়সম্পদ নিজের ভেবে হাঁটুভাঁজে বসে-বসে খেয়েছে। চাচা অবধারিতভাবে সম্পদ ফিরিয়ে নিবেন, কারণ তার নিজের একটা সংসার হয়েছে। কিন্তু হেলাল ব্যাপারীর সংসারের কী হবে!

আগামী সময়ের ভাবনায় সে অতিশয় অস্থির-দিশেহারা হয়ে ওঠে। রাতে ঘুমাতে পারে না। দিনের বেলায় চুপচাপ বসে ঝিমোয়। সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে মরিয়া হয়ে দিনরাত ভাবনায় ডুবে থাকে। কিন্তু কোনো পথই তার ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার সুরাহা দিতে পারে না। এরইমাঝে একদিন হুট করে বহু দিন আগের এক ঘটনা মনে পড়ে যায়। সে খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। একমাত্র এই পথই পারে তাকে বিপদের সাগর থেকে টেনে তুলতে।

চৈত্রমাসের ফকফকা এক চাঁদনি রাতে হেলাল ব্যাপারী পাশের গাঁয়ে বন্ধুর এক পরিচিতের বাড়ি বেড়াতে যায়। পরিচিত শহুরে-মানুষ, মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়িতে আসে। বিশাল জমিদার বাড়ি। একসময়ে তার দাদা নামেমাত্র টাকায় দলিলপত্র নিজের নামে করিয়ে নিয়েছিল। পৈতৃকসূত্রে বিশাল সেই সম্পদের মালিক এখন সেই লোক। ভোগদখল ঠিকঠাক রাখতে মাঝেমধ্যে সে আশপাশের অকর্মা ছেলেপুলেদের ডেকে নিয়ে আমুদ-ফুর্তির সুযোগ করে দেয়।

শহরের নানান বর্ণের নানার স্বাদের পানীয়ের স্বাদ হেলাল ব্যাপারী প্রথম সেই বাড়িতে পায়। তার অবশ্য আগে থেকেই দেশীয় নেশা-ভাংয়ের এক-আধটু অভ্যাস ছিল। এর মধ্যে এমন আস্কারা পেয়ে সে বেজায় খুশি হয়। তারপর থেকে সে নিয়মিত সেই লোকের আখড়ায় যেত। একসময়ে ঘনঘন যাতায়াতের সুবাদে সেই লোকের সাথে তার বেশ সখ্য তৈরি হয়। একদিন কী মনে করে কে জানে, মাতাল অবস্থায় সে গালকাটা আব্দুল মতিনের খোঁজ, হেলাল ব্যাপারীকে দেয়। সেদিন তার কাছে গালকাটা আব্দুল মতিনের ঠিকানা অপ্রয়োজনীয় মনে হলেও আজকের পরিস্থিতিতে তার কাছে এই একটিমাত্র পথকেই যথোপযুক্ত মনে হলো। এবং তিনি গালকাটা মতিনকে ভাড়া করে আনতে মনস্থির করলেন।

গালকাটা আব্দুল মতিন হেলাল ব্যাপারীর সাথে পথিমধ্যে বারকয়েক ফোনালাপে গোপন কথা সেরে নেয়। গ্রামাঞ্চলে ফোনের লাইনঘাট থাকে না, কথা স্পষ্ট নয়। তারপরও যতটুকু বুঝা গেল তাতে অবশ্য নির্দ্বিধায় কাজটা সম্পন্ন করতে মুশকিল হবে বলে মনে হলো না। হেলাল ব্যাপারী চতুর লোক, দস্তুরমতো পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে রেখেছে।

গালকাটা আব্দুল মতিনের চোখে-মুখে প্রশান্তির একটা প্রচ্ছন্ন-ছায়া লক্ষ করা গেল।

হেলাল ব্যাপারীর বাইর বাড়িতে দাদার-কালের একখানা আধভাঙা-পলেস্তারা-খোয়া বাংলা ঘর, বাড়ির অতীত আভিজাত্য ধরে কোনোমতে আজও দাঁড়িয়ে আছে। সে আমলে অবশ্য অবস্থাপন্ন প্রায় সব বাড়িতে মূল বাড়ির বাইরের অংশে বাংলা ঘর থাকার প্রচলন ছিল। মূল ঘরের চেয়ে বাংলা ঘরের গঠনশৈলী উন্নত করা হতো।

আগের দিনে উন্নাকালে এ অঞ্চলের মানুষের একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম ছিল হাঁটাপথ। বহুপথ হেঁটে এসে পথিক ক্লান্ত হয়ে এসব বাড়ির বাংলা ঘরে বিশ্রাম নিত। তাদের মেহমানের মতো সম্মান এবং খাদিমদারী করা হতো। দূরদেশের পথিক নির্ভয়ে বাংলা ঘরে গৃহস্থের আপ্যায়নে রাত কাটাত। হেলাল ব্যাপারীর বাড়ির সে প্রথা আজও রয়ে গেছে। যদিও এখন প্রকৃত পথিকের দেখা মেলা ভার। শহরের মতো গ্রামাঞ্চলেও মানুষ পায়ে হাঁটার অভ্যাস ভুলে গেছে। তারপরও হকার, ফকির ধরনের লোক প্রায়ই তাদের বাংলা ঘরে রাত কাটায়। হেলাল ব্যাপারী কৌশলী লোক। গালকাটা মতিনকে সে হকার সাজিয়ে তার বাড়িতে ঢোকানোর ব্যবস্থা করে।

ওদিকে গালকাটা আব্দুল মতিনের মূল অভিনয় শুরু হয়। ঠিকানা মোতাবেক সে হেলাল ব্যাপারীর বাড়ি পৌঁছে যায় এবং তা বেশ বেলা থাকতেই। সারা দিনের বিক্রিবাট্টায় মেহনত করে অতিশয় ক্লান্ত হয়ে হেলাল ব্যাপারীর বাড়ি ঢুকে। বাংলা ঘরের খোলা বারান্দায় কাঁধের ঝোলায় শিথান পেতে আধশোয়া হয়ে শুয়ে পড়ে। সে অবশ্য আসলেই ক্লান্ত। এত দূরের পথ পদব্রজে তারওপর হাতে-কাঁধে অনভ্যস্ত বোঝার ঝক্কি শরীরটাকে কাহিল করে দিয়েছে। ঘর্মাক্ত দেহে বারান্দার পাকা মেঝের শীতলভাব শরীরটাতে কেমন আরাম-স্রোত বয়ে যায়। আরামে গালকাটা আব্দুল মতিনের চোখ বুজে আসে।

ছোটো চাচা শেষবেলায় গোসল সেরে বাইরবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে প্রতিদিনকার অভ্যাসমতো ভেজা গামছা নিংড়ানো জল পায়ে ঢালতে ঢালতে চোখে রাখে, বাংলা ঘরের বারান্দায়। তিনি আব্দুল মতিনকে গা-হাত-পা ছড়ায়-ছিটায়ে পড়ে থাকতে দেখেন। ছোটো চাচাই সচরাচর এসব পথিকের দেখাশোনা করেন। তিনি অভ্যাসমতো পথিকের যত্নআত্তিতে তৎপর হয়ে পড়েন। হেলাল ব্যাপারী অন্দরবাড়িতে ছিল। সে বেরিয়ে এসে ছোটো চাচার এহেন কাজকারবার নিয়ে বরাবরের মতো বিরক্ত হওয়ার ভান করে। সে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে চড়া গলায় বলতে শুরু করে—‘অচিন মানুষ, এত যত্নআত্তি করতে নাই। দিনকাল ভালো না! সুঁই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরিয়ে যাবে।’ ছোটো চাচার কানে এসব কথা ঢুকলেও বরাবরের মতো তাতে সে তেমন পাত্তা দেয় না।

ওদিকে ছোটো চাচাকে দেখামাত্র গালকাটা আব্দুল মতিন একঝটকায় শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়। পথিকের এহেন আচরণে ছোটো চাচা যারপরানই ভড়কে যান। অবশ্য দ্রুত আব্দুল মতিন নিজেকে শান্ত করে আবার তার অভিনয়ের খোলসে ফেরত যান।

ঘটনাকাল প্রায় কুড়ি বছর পেছনকার। আব্দুল মতিনের বাবা হুট করে একদিন বিয়ানবেলায় নাশতা খেতে বসে সহসা মাটির ’পরে ঢলে পড়েন। তার কিছুক্ষণ পর তিনি মারা যান। লোকে বলল, সন্ন্যাস রোগ, এ রোগে ডাক্তার-বদ্দি ডাকার সুযোগ হয় না। বাবার মৃত্যুর পর অল্পবয়সের পিঠাপিঠি চার ভাইবোন নিয়ে তার মা পড়লেন মহা মুসিবতে।

ছোটো চাচা সে সময়ে তাদের অঞ্চলে বেশ দাপটের সাথে যাত্রাদলে নায়কের পাঠ করে বেড়ান। গালকাটা আব্দুল মতিনের বাবাও সে-পালায় ছোটোখাটো এক চরিত্রের পাঠ করত। নাশতা সেরে ছোটো চাচার সাথে একত্রে বাবার সেই পালায় যাওয়ার কথা ছিল। সে সূত্রে ছোটো চাচার সাথে তাদের বাড়ির একটা সম্পর্ক ছিল। তার বাবা ছিলেন ভবঘুরে। ঠিকঠাক মতো পরিবারকে দু’বেলা ভাতের জোগান দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। মা ছুটা কাজ করে বাবার সাথে সংসারের হাল ধরেছিলেন। বাবা চলে যাওয়ায় মায়ের সংসার অবধারিতভাবে পড়ল চরম দুঃসময়ে।

সে সময়ে মায়ের পাশে আপন মায়ের পেটের ভাইয়ের ভূমিয়ায় ছোটো চাচা এসে দাঁড়ান। প্রায় চারপাঁচ মাস তিনি অত্র এলাকায় ছিলেন। বাবার ভূমিকা পুরোটাই সে একহাতে করেছেন। এবং এরপর সে তাদের এলাকা ছেড়ে যাওয়ার পরও বহুকাল পোস্টাফিসে মায়ের নামে টাকা পাঠাতেন। লোকটা মানুষ না, সাক্ষাৎ ফেরেশতা। গালকাটা আব্দুল মতিনের ছোট্টবেলার সেসব স্মৃতিতে ছোটো চাচার মুখটা আজও শুকতারার মতো জ্বলজ্বল করে দ্রুতি ছড়াচ্ছে। মানুষটা দেখতে সেই আগের মতোই আছেন। ভালো মানুষ নষ্ট হয় না। মন্দ লোকের চেহারা দ্রুত ভেঙেচুরে খাটাশের মতো রূপ নেয়। তার নিজের চেহারা আয়নায় দেখলে তার নিজের কাছেই বড়ো অচেনা ঠেকে।

চুক্তি মোতাবেক মানুষটাকে আজ রাতে গালকাটা আব্দুল মতিন নিজ হাতে খুন করবেন।

নিশুতি অমাবস্যার রাত। চারপাশ কালো আঁধারের প্রলেপ। গুটিকয় জুনিপোকা টিমটিম আলো জ্বেলে এদিক-ওদিক অকারণ ছোটোছুটি করছে। দূরের কোনো ঝোপঝার থেকে রাতজাগা পাখির ভয়ধরানো কাঁপাকাঁপা কণ্ঠের আওয়াজ কানে ভেসে আসে। শিয়াল কিংবা খাটাশ ক্ষণে ক্ষণে ডেকে উঠে রাতের প্রহরের জানান দেয়। বাংলা ঘরের দুয়ারে বাড়িরসীমানা ঘেঁষা ঝাঁকড়া-মাথায় নির্ভীক দাঁড়িয়ে থাকা কদমগাছটায় বাদুড় ঝুলে আছে। আব্দুল মতিন ধীরপায়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়। বাদুড়ের চোখে চোখ পড়তে কেমন যেন একটা ভয়ের স্রোত পুরো-দেহটাকে অসাড় করে দেয়। চোখগুলো মানুষের চোখের মণির মতো কুচকুচে কালো, এর আগে বাদুড় এমন পরখ করে দেখা হয় নাই। রাতের এত সব নিস্তব্ধ রহস্যময়তার মাঝে, নিজেকে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলে গালকাটা আব্দুল মতিন। আদতে আজ পূর্ণিমার তিথি, কৃষ্ণপক্ষ নয়। সে গভীর ভাবনার-ঘোরে পুরোপুরি আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

হেলাল ব্যাপারী পূর্বপরিকল্পনা মতো ছোটো চাচাকে চোখমুখ বেঁধে নদীর পাড়ে কাশবনের ঝোপে এনে দাঁড় করায়। ছোটো চাচার বন্ধ-গলা দিয়ে গড়গড় আওয়াজ বের হয়ে আসে। তার কপালে সারিসারি ভাঁজের রেখা অতিশয় স্পষ্ট হয়ে জেগে উঠেছে। শেষরাতে ছোটো চাচার বাহ্যে করার অভ্যাস আছে। সে সময়ে কৌশলে হেলাল ব্যাপারী তাকে বাড়ির শেষপ্রান্তে ডেকে নিয়ে আসে। এবং হুট করে চোখ-মুখ গামছা দিয়ে শক্ত আঁটে বেঁধে ফেলে। টেনেহিঁচড়ে নদীর দিকে নিয়ে আসে।

গালকাটা আব্দুল মতিন জায়গা মতো এখনো এসে পৌঁছেনি। হেলাল ব্যাপারী অপেক্ষা করে। অপেক্ষার সময় বড়ো দীর্ঘ হয়। হেলাল ব্যাপারী ঘেমে উঠেছে।

এ সময়ে গালকাটা আব্দুল মতিন ধীরপায়ে নদীর তীরে এসে দাঁড়ায়। মৃদু ঢেউয়ের শান্ত-নদী রাতের মতো ঢিলেঢালা শব্দে বয়ে চলেছে। নদীর দু-কূলজুড়ে রাজহংসের পালকের মতো ধবধবে সাদা কাশফুল হালকা হাওয়ায় তিরতির করে দুলছে। আকাশ থেকে রূপালি ধারায় চন্দ্রকিরণ ঝরছে, ভাসিয়ে দিচ্ছে পুরোজগৎ সংসার। রূপালি জোৎস্নাধারা নদীর নরম স্রোতের জলে মিশে ঝলমল করছে। গালকাটা আব্দুল মতিন উদাস হয়। সহসা তার হাতেধরা ধাঁরালো ড্যাগার ছুরিটা প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে।

ভোর সকালে কাশবনে কে বা কারা বাহ্যে সারতে গেলে, হেলাল ব্যাপারীর পেটকাটা মড়া পড়ে থাকতে দেখে। এবং নদীর অদূরে শিমুলগাছের তলা থেকে ছোটো চাচাকে হাত-মুখ বাঁধা কিন্তু অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

পেশায় শিক্ষক। লিখছেন দীর্ঘদিন ধরেই। জন্মগ্রহণ করেছেন বাংলাদেশের বিক্রমপুরে। এখন আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।