প্রথম বইয়ের স্মৃতি মনে করা বেশ শক্ত। প্রথমবার একা একা দাঁত মাজার মতন বা একা একা স্কুলের জুতার ফিতা বাঁধার মতন সুদূর অতীতের কথা। বানান করে পড়তে শেখার আগেই ছবিওয়ালা রূপকথার বইয়ের কথা মনে পড়ে, টকটকে লাল একটা ফুলের ছবি, একটা অন্ধকার প্রাসাদের ছবি, এক অসহায় বাবা মেয়ের জন্য ফুল তুলে আনতে গিয়ে মেয়েকেই রেখে আসতে বাধ্য হলো যে দৈত্যপুরীতে, ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্টের’ বাংলা ভার্সনের সেই বইটা সম্ভবত আমার জীবনের প্রথম বই। এরপরে ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ কিংবা ‘ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ’, হাশেম খানের আঁকা ছবিতে ভরা সেই বইগুলো যেন বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া বন্ধু।
অফিসের বাসে যেতে যেতে এগারো বছর ধরে একই রাস্তার সবকটা শিমুল গাছের অবস্থান মুখস্ত হয়ে যাওয়াতে, ঘন্টাখানেকের যাত্রাকে সহনীয় করার উপায় বই। অনেকেই গাড়িতে বই পড়তে পারেন না, মাথা ধরে। আমার মাথাটি নানাভাবেই আমাকে বিস্তর যন্ত্রণা দিয়েছে ঠিক, কিন্তু বই পড়তে গেলে সেটা রাস্তা হোক, রান্নাঘর হোক, ডাক্তারের চেম্বারের সামনে ঠেলেঠুলে কোনোমতে বসতে পারা শক্ত চেয়ার হোক, কখনোই বিগড়ে যায়নি, প্রতিবাদ করে বসেনি।
বই এখনো আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। অফিসের বাসে যেতে যেতে এগারো বছর ধরে একই রাস্তার সবকটা শিমুল গাছের অবস্থান মুখস্ত হয়ে যাওয়াতে, ঘন্টাখানেকের যাত্রাকে সহনীয় করার উপায় বই। অনেকেই গাড়িতে বই পড়তে পারেন না, মাথা ধরে। আমার মাথাটি নানাভাবেই আমাকে বিস্তর যন্ত্রণা দিয়েছে ঠিক, কিন্তু বই পড়তে গেলে সেটা রাস্তা হোক, রান্নাঘর হোক, ডাক্তারের চেম্বারের সামনে ঠেলেঠুলে কোনোমতে বসতে পারা শক্ত চেয়ার হোক, কখনোই বিগড়ে যায়নি, প্রতিবাদ করে বসেনি। এমনকি বাথরুমের কমোডের ঢাকনা ফেলে তার উপরে বসেও বই পরেছি একবার। তখন রমজান মাস, বোনের বাড়ি গেছি বেড়াতে। সবাই গাদাগাদি করে ঘুমাবে, সেহেরির সময় উঠতে হবে বলে দ্রুত বাতি নিবিয়ে ফেলতে হবে। বসার ঘরেও সম্ভবত কেউ না কেউ ঘুমাচ্ছে, বাতি জ্বালানোর একমাত্র উপায় তখন বাথরুমে যাওয়ার উছিলা তৈরি করা। ক্লাস নাইন বা টেনে পড়ি, হাতের বইটা ছিল সম্ভবত মুহাম্মদ জাফর ইকবালের কোনো কিশোর উপন্যাস।
মেয়ে যখন সাড়ে চার বছরের, কিন্ডারগার্টেনে দুই ঘন্টার স্কুল তার। স্কুলে বসিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে আসতে আসতেই আবার আনতে যাবার সময় হয়ে যায়। চাকরি বাকরি নেই তখন, ডাবল টাকা রিকশাভাড়া খরচ না করে একটা বই নিয়ে যেতাম সঙ্গে, স্কুলের সামনের চায়ের দোকানে বসে এভাবে পড়ে ফেলেছিলাম অমিতাভ ঘোষের ‘গ্লাস প্যালেস’। আরও মজার ঘটনা হয়েছিল বিউটি পার্লারে। ঈদের আগে শ্বশুরবাড়ির এলাকায় ননদের সঙ্গে গেছি ফেসিয়াল আর প্যাডিকিওর করাতে। যথারীতি বেজায় ভিড় সেখানে। আমার হাতব্যাগে কোনো না কোনো বই থাকেই। সিরিয়াল আসতে আসতে বিরক্ত না হবার আর কোনো পথ নেই, বইটা খুলে পরতে ধরা ছাড়া। তো তাই করছিলাম। প্যাডিকিওর শুরু হবার পরে মেয়েটি জিজ্ঞেস না করে পারলেন না, আপা, আপনার কি সামনে পরীক্ষা? আমি বিস্মিত হলেও খুশি হলাম, দুই বাচ্চার মা হয়ে যাওয়ার পরেও আমাকে ছাত্রী ছাত্রী দেখাচ্ছে!
আর কোনো কিছুকে আমি এত বিশ্বাস করি না যত করি বইকে। প্রথমবার রান্না করতে হলো যখন, ইন্টামিডিয়েটের ছাত্রী আমি। আম্মা কোনো কারণে বাসায় নেই, রেঁধে খেতে হবে। আম্মার দেওয়া ইন্সট্রাকশন মনে রাখার চেষ্টা না করে কিনে আনলাম সিদ্দিকা কবিরের রান্না খাদ্য পুষ্টি। কুরুশ বোনা শিখতে শুরু করেছি ইউটিউব দেখে, কিন্তু কুরুশের পুতুল বানাবার শখ মাথায় চাপার পরে ইউটিউবের ভিডিও আর আমার কোনো কাজে এলো না। ইংল্যান্ডে পিএইচডি করতে যাওয়া সহকর্মী ডক্টর তারিকুল ইসলামকে ছবি পাঠালাম, উনি কিনে আনলেন কেরি লর্ডের লেখা ‘এডওয়ার্ড’স মিনেজারি’।
মাইকেল পোলানের লেখা ‘হাউ টু চেইঞ্জ ইয়োর মাইন্ড’। বইটি মাদকবিষয়ক, মূলত সাইকাডেলিক ড্রাগ কীভাবে এলো, কীভাবে কাজ করে এসব নিয়ে। আমি নিজে কোনো হার্ড ড্রাগ নেওয়ার সাহস জন্মে পাইনি আর পাবোও না। কিন্তু নেশা করে এমন কাউকে জিজ্ঞেস করার চেয়ে বই পড়ে জানাটা আমার কাছে ভালো পদ্ধতি মনে হয়েছে।
রান্না, বেকিং আর কুরুশ ছাড়াও আরও উদ্ভট বিষয়ের বই আছে আমার সংগ্রহে। যেমন, মাইকেল পোলানের লেখা ‘হাউ টু চেইঞ্জ ইয়োর মাইন্ড’। বইটি মাদকবিষয়ক, মূলত সাইকাডেলিক ড্রাগ কীভাবে এলো, কীভাবে কাজ করে এসব নিয়ে। আমি নিজে কোনো হার্ড ড্রাগ নেওয়ার সাহস জন্মে পাইনি আর পাবোও না। কিন্তু নেশা করে এমন কাউকে জিজ্ঞেস করার চেয়ে বই পড়ে জানাটা আমার কাছে ভালো পদ্ধতি মনে হয়েছে। নিজে নাস্তিক না হয়েও ‘গড ডিলিউশনের’ মতন বই কিনে উল্টেপাল্টে দেখেছি, নাস্তিকেরা কী ভাবেন, যুক্তিগুলো কী তা বোঝার জন্য। সেলফ হেল্প ধরনের বই নাকি পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয়, আমার পাঠ্যতালিকায় সবার উপরে থাকে ফিকশন, নানান দেশের উপন্যাস— তারপরেও ‘ইফ ইউ মিট দ্য বুদ্ধ অন দ্য রোড’, ‘কিল হিম’ কিংবা ‘গার্ল ওয়াশ ইয়োর ফেইস’ এর মতন বই আমার কাছে আছে।
বই পড়া আর বই কেনা যে দুটো আলাদা নেশা সেটাও আমি আবিষ্কার করেছি সম্প্রতি। ছাপোষা মাস্টারের চাকরি করতে করতেও এক পর্যায়ে ফ্রিজ টিভি ওয়াশিং মেশিন সবই কেনা হয়ে গেল, অতটা টিপে টিপে খরচা করার দরকার আর নেই যখন, মনের সুখে বই কিনতে ধরলাম। ছাত্রজীবনে অন্যের বই পড়ে পরীক্ষা দেওয়ার, বই ধার চেয়ে না পাওয়ার, দোকানে নেড়েচেড়ে দেখে মূল্য দেখে শ্বাস ফেলে রেখে আসবার সকল গ্লানি অপমান আর আফসোসের বদলা নিতে থাকলাম বই কিনে কিনে আর লোককে বই ধার দিয়ে দিয়ে। জীবনের সকল হতাশা আর ক্ষোভের উপশম করতে পারে বই, কোনো না কোনোভাবে পারেই।
বইকে আমি বন্ধুই মনে করি, কোনো ভাবগম্ভীর গুরু বলে ভাবি না। আমার কাছে বই জ্ঞান অর্জনের বা আলোকিত হওয়ার উপায় নয়, বরং আনন্দের উৎস। বই পড়ে বিলক্ষণ জ্ঞান অর্জন করা যায়, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তেমন বহু জ্ঞান বই না পড়েও অর্জন করা সম্ভব। তাই বইকে আমি মহাপবিত্র কিছু বলে ভাবি না। বইয়ের যত্ন করি ঠিকই, সেটা শখের যে কোনো জিনিসের যত্নই মানুষ করে থাকে। যেভাবে কুরুশ বোনার কাঁটাগুলোকে বা গান শোনার ব্লুটুথ স্পিকারটাকে যত্ন করে রাখি সেভাবে বইগুলোকেও করি, কেউ বইয়ের পাতা ভাঁজ করলে মেজাজ চড়ে যায়।
ফেইসবুকে বেশ কয়েকটি বই পড়ুয়াদের গ্রুপের আমি সদস্য। অদ্ভূত সব পোস্ট নিয়মিত আসে আমার নিউজফিডে। যেমন, আমেরিকা কিংবা ক্যানাডার কেউ একজন লিখলেন, তোমার বাসায় আগুন লাগলে আর যে কোনো তিনটা বই বাঁচানোর অপশন দেওয়া হলে তুমি কোন বইগুলোকে বাঁচাবে? এমন আরও আজব পোস্ট, আমার এখন কান্নাকাটি করতে হবে, পড়ে ভীষণ কান্না পাবে এমন বইয়ের নাম রেকমেন্ড করো।
বইকে বন্ধু ভাবার মানুষ যে পৃথিবীতে অনেক আছে তা বোঝা যায় এই সকল গ্রুপের পোস্টগুলো দেখলে। হাসতে চাইলে বই, কাঁদতে চাইলে বই, বাস্তবতা থেকে পালাতে চাইলে বই। হতাশ হলে বই, সফলতা চাইলে বই— যে কোনো কিছুর জন্যই বইয়ের সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। অন্তত বইপ্রেমীরা তাই চান, তাই খোঁজেন।
বইকে বন্ধু ভাবার মানুষ যে পৃথিবীতে অনেক আছে তা বোঝা যায় এই সকল গ্রুপের পোস্টগুলো দেখলে। হাসতে চাইলে বই, কাঁদতে চাইলে বই, বাস্তবতা থেকে পালাতে চাইলে বই। হতাশ হলে বই, সফলতা চাইলে বই— যে কোনো কিছুর জন্যই বইয়ের সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। অন্তত বইপ্রেমীরা তাই চান, তাই খোঁজেন।
ছোটোবেলায় পড়া প্রথম বইয়ের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। শেষ যে বই পড়েছি আর পড়ছি সেগুলোর কথাও একটু বলি। সালমান রুশদির ‘ল্যাংগুয়েজেস অব ট্রুথ’ আমার সম্প্রতি পড়া প্রবন্ধের সংকলন। এখন পড়ছি রোহিনটন মিস্ত্রির প্রথম উপন্যাস ‘সাচ আ লং জার্নি’। উপন্যাসের মূল চরিত্র গুস্তাদ নোবলের বাবার বইয়ের দোকান ছিল। পারিবারিক প্রতারণার শিকার হয়ে সেই ব্যবসা লাটে উঠেছে। ব্যাংকার গুস্তাদ এখনো মাঝে মধ্যে বাবার বইয়ের দোকান থেকে রক্ষা করতে পারা কয়েকটি বই যক্ষের ধনের মতন আগলে রেখেছেন। বম্বে শহরের সেটিং, ১৯৭১ সালের ঘটনা। বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু চলে এলেও আখ্যান মূলত একটি পরিবারকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে।
বই সম্পর্কে সবচেয়ে প্রিয় উক্তি দিয়ে শেষ করতে চাই। আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক টনি মরিসন বলেছেন, ‘যদি কোনো বই তোমার পড়তে ইচ্ছা করে যেটি এখনো লেখা হয়নি, তুমি সেটি লিখে ফেলো’। আমাদের সবারই নিশ্চয়ই এমন কোনো বই পড়তে মন চায় যা আসলে লেখা হয়নি। আমরা সবাই লিখে ফেলতে পারি না বলেই হয়তো আরও অনেক অনেক বই পড়ি। বইয়ের মধ্যে সান্ত্বনা খুঁজি, আনন্দ খুঁজি, না বলা কথার প্রকাশ খুঁজি।এজন্যই বই আমাদের বিশ্বস্ত বন্ধু, যে বন্ধু কখনোই ধোঁকা দেবে না।
কথাসাহিত্যিক