ইরান! এক অনুরণন.. রিনিরিনি ঝংকার!
‘ইরানি বালিকা যেন মরু-চারিণী
পল্লীর-প্রান্তর-বনমনোহারিণী
ছুটে আসে সহসা গৈরিক-বরণী
বালুকার উড়নী গায়’
পারস্য! পারস্য দেশের রূপকথা! প্রিন্স অভ পারসিয়া, ম্যজিক কার্পেট, রুমী, খৈয়াম, পরিব্রাজক ইবনে বতুতার বিস্ময়, খোমেনী.. সুফিইজম, সুফি-সংগীত, আর্ট, অর্কিটেক্চার, চলচ্চিত্র, রাজনীতির করুণ উপাখ্যান… কী নেই ইরানে!
আমি কী নিয়ে লিখব! সেই ইরান নিয়ে! আমার নামের আগে ‘স্থপতি’ খেতাবটি যেখানে-সেখানে ‘সুপ্রাচীন মাস্তুল’ গেড়ে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু, আজ ইট-পাথর-কাঠ নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছা করছে রুপালি পানি আর ইরানি গোলাপের কথা বলতে।
‘গোলাপ ফোটে একবার, ফুটে চিরকালের জন্য মরে যায়।’ —ওমর খৈয়াম
পরম কথাটি বলার পরে আর কিছু বলার থাকবে না জেনেও নিজেকে গোলাপের মত প্রস্ফুটিত করে ঝরে যাওয়ার সাহসই তো প্রেম।
আচ্ছা, এমন একটি তাজমহল কি ভাবা যায় যেখানে আবিস্তৃত ঘাসের প্রান্ত ছুঁয়ে, পায়ে পায়ে, বঁধুয়ার হাতে হাত রেখে, ঝিলমিল করা পানির পাশ ধরে বহু পথ হাঁটা নেই! সবুজ ঘাসের বুক চিরে এক ফালি পানির নিরুদ্দেশি যাত্রা! পায়ে চলার পথ দুধারে উন্মুক্ত, চিরায়ত প্রেমের শুভ্র-সফেদ নিদর্শনের পানে! প্রিয়ার সাথে ক্ষণিকের সেই পথচলা যেন শাশ্বত, অশেষ!
নিরঙ্কুশ তৃষ্ণা— ‘এই পথ যদি না শেষ হয়!’
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তিগুলোর সাথে অবিচ্ছেদ্য প্রেমের মতোই ছড়িয়ে আছে একটুখানি নয়নাভিরাম প্রকৃতি, কোনো এক অতুলনীয় পার্সিয়ান বাগান (Persian Garden/ Iranian Garden)! ফার্সি সাহিত্যে বাগান মানে ‘paradise’, যার উৎপত্তি ’paridaiza’ শব্দটি হতে, এর অর্থ ‘প্রাচীর-বেষ্টিত উদ্যান’ (walled garden)।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তিগুলোর সাথে অবিচ্ছেদ্য প্রেমের মতোই ছড়িয়ে আছে একটুখানি নয়নাভিরাম প্রকৃতি, কোনো এক অতুলনীয় পার্সিয়ান বাগান (Persian Garden/ Iranian Garden)! ফার্সি সাহিত্যে বাগান মানে ‘paradise’, যার উৎপত্তি ’paridaiza’ শব্দটি হতে, এর অর্থ ‘প্রাচীর-বেষ্টিত উদ্যান’ (walled garden)। আশ্চর্যভাবে ‘paradise’ শব্দটির শেকড় আছে পৃথিবীর অনেকগুলো ভাষায়: Pardis (ফার্সি), Paradeisos (গ্রীক), Pardes (হিব্রু), Perdose (আরবী), আর স্বয়ং Paradise ইংরেজিতে। পার্সিয়ান উদ্যান বা বাগানগুলো আক্ষরিক অর্থেই মাটির পৃথিবীতে যেন ভূস্বর্গ!
মরুভূমির দেশ ইরান । অবিশ্বাস্য মনে হলেও ইরানের অর্ধেকেরও বেশি ভূখণ্ড খর মরুর দখলে। গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহ, শীতের তীব্র ঠান্ডা—এই দুই থেকে একটু শান্তি পাওয়ার অভিলাষে চোখ-জুড়ানো, পানি টলমল, ঝিরিঝির বাতাসে ঘেরা বাগান নির্মাণ তাই ইরানের প্রাচীনতম ঐতিহ্য। আদিগন্ত বাগিচা আর প্রাসাদের সমন্বয়ে তৈরি পার্সিয়ান বাগান (Persian Garden/ Iranian Garden) শুধু মাত্র বাগান নয়, ইরানি স্থাপত্যের এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন। অসাধারণ নকশা আর সৃজনশীলতার নিদর্শন এই বাগানগুলো সমগ্র পৃথিবীর স্থাপত্য, ইতিহাস আর সংস্কৃতির ঐশ্বর্য, পরম সম্পদ।
পার্সিয়ান বাগানগুলোর মূল নকশা চারটি সমান অংশে (quadrant) বিভক্ত একটি আয়তাকার কাঠামো। চারটি স্বর্গীয় জলধারা একীভূত হয় মূল বাগানের আধ্যাত্মিক কেন্দ্রবিন্দুতে, সৃষ্টি করে চারটি ভিন্ন বাগ (Chaharbagh,) যা স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতীকী উপস্থপনা। বিভাজিত অংশগুলো পরিপূর্ণ অসংখ্য চিরসবুজ গাছ (evergreen trees), সুবাসী ফুলের বাগান, ফোয়ারা আর পায়ে চলা সরু পথের সমন্বয়ে। কেন্দ্রীয় অক্ষপথ ঘিরে প্রাচীর-বেষ্টিত বাগিচা (walled garden) এগিয়ে নিয়ে যায় মূল আকর্ষণ এর দিকে, যা হতে পারে প্রাসাদ, অপরাপর স্থাপনা, নদী, সরোবর বা অন্য কোনো কিছু অথবা এদের সমন্বয়।
ইরানি বাগান মূলত দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত। প্রথমত দুটি সমান্তরাল অক্ষবিশিষ্ট বাগান: অক্ষগুলো যেখানে পায়ে চলার পথের সাথে নব্বই ডিগ্রিতে ইন্টারসেক্ট করে। যেমন দৌলতাবাদ বাগ, ঈয়াজদা ইরান। আর দ্বিতীয়ত দুই থেকে চারটি সমান্তরাল অক্ষবিশিষ্ট বাগান: অক্ষগুলো যেখানে বাগানের আধ্যাত্মিক কেন্দ্রকে ( Spiritual Center) নব্বই ডিগ্রিতে ইন্টারসেক্ট করে। যেমন নজর বাগ, সিরাজ ইরান। কিছু দেয়াল, কিছু সবুজ, কিছুটা সূর্যালোকে বিমূর্ত স্রোতধারা, তারপর আবার কিছু দেয়াল, কিছু সবুজ, বিমূর্ত স্রোতধারা— স্রষ্টার সৃষ্টি আর মানব সৃষ্টির এক অপূর্ব সমন্বয়, মায়াবী কারচুপি। চিরসবুজ গাছগুলো তীক্ষ্ণ সূর্যের আলোকে নিয়ন্ত্রণ করে, জলের প্রবাহ পরিবেশকে শীতল করে এবং সেন্ট্রাল প্যভিলিয়ন নিয়ে আসে আলো-ছায়া, দৃঢ়তা আর আভিজাত্য।
দীর্ঘদিনের পানিস্বল্পতা বা ঘাটতির কারণে পানি ইরানি সংস্কৃতিতে ডিভাইন (divine) আর পবিত্র (sacred)। ভূ-গর্ভস্থ পানি (ground water) ব্যবহারের প্রযুক্তি আবিষ্কারের সাথে সাথে ‘পানি’ তাই ইরানি স্থাপত্যে এক শক্তিশালী জায়গা তৈরি করে নেয়। আর তারই প্রতিফলন দেখা যায় ইরানি বাগানগুলোতে। স্ফটিকস্বচ্ছ পানির বুকে আলো, গাছ আর কেন্দ্রিয় কাঠামোর প্রতিবিম্বকে আধ্যাত্মিক ও নান্দনিকতার সাথে উপস্থাপন করা পার্সিয়ান বাগানগুলোর ডিজাইন-প্রিন্সিপালের অন্যতম উদ্দেশ্য। পার্সিয়ান বাগানগুলো তাই মরুভূমির শুষ্ক-রুক্ষ প্রকৃতির প্রতিবাদ স্বরূপ।
পার্সিয়ান উদ্যানের ফিলোসফি নানা সময়ে বিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়েছে। সাইরাস দি গ্রেট (6th B.C.) এর শাসনামলে পাশারগাদে প্রাচীন উদ্যানের পরিকল্পনা (the ancient garden) দিয়ে যার যাত্রা শুরু; ভিত্তি ছিল সাধারণ স্থাপত্যিক জ্যামিতিক প্যাটার্ন আর অন্তরনিহিত মানসিক, শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক মুক্তি। পরবর্তীতে, সাসানাদের আমলে পার্সিয়ান উদ্যানগুলো জোরোস্ট্রিয়ানিজম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, বাগানের চারটি আলাদা অংশ বা কোয়ারডেন্ট বছরের চারটি মৌসুম বা ঋতুকে প্রতিনিধিত্ব করে আর বাগানে প্রবাহিত জলধারার গুরুত্ব প্রাধান্য পায়। ইসলামিক যুগে উদ্যানগুলোতে নান্দনিকতার গুরুত্ব বাড়তে থাকে। ইসলামিক ধারণায় পার্সিয়ান বাগান কোরআনে বর্ণিত স্বর্গের অনুরূপ। স্বর্গের প্রতিচ্ছবি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইরানি বাগানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত জলধারা চার স্বর্গীয় স্রোতের (heavenly streams) প্রতীকী প্রকাশ।
পার্সিয়ান উদ্যানের ফিলোসফি নানা সময়ে বিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়েছে। সাইরাস দি গ্রেট (6th B.C.) এর শাসনামলে পাশারগাদে প্রাচীন উদ্যানের পরিকল্পনা (the ancient garden) দিয়ে যার যাত্রা শুরু; ভিত্তি ছিল সাধারণ স্থাপত্যিক জ্যামিতিক প্যাটার্ন আর অন্তরনিহিত মানসিক, শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক মুক্তি।
পার্সিয়ান উদ্যানের ঐতিহ্য, নির্মাণশৈলী (tradition and style) আর আধ্যাত্ম্যবাদ আন্দালুসিয়া তথা স্পেন, ভারতসহ সারা পৃথিবীর বিভিন্ন গার্ডেন ডিজাইন আর ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনকে প্রভাবিত করেছে। আলহামরা থেকে শালীমার গার্ডেন, মুঘলরাজের তাজমহল থেকে আধুনিক স্থাপত্যের অনন্য কীর্তি লুই আই কানের সল্ক ইনস্টিটিউটের কেন্দ্রীয় প্লাজা ডিজাইনেও এর দার্শনিক প্রভাব দেখা যায়।
ইরানি শিল্প-সাহিত্য, পার্সিয়ান গালিচা, মৃৎশিল্প, ক্যালিগ্রাফি, সংগীত এবং কবিতার মতো অন্যান্য সব শিল্পমাধ্যম পার্সিয়ান বাগানের শৈলী দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত। বিশ্বজনবিদিত বহুপ্রশংসিত পার্সিয়ান গালিচা যখন পার্সিয়ান বাগানের আদলে গড়ে ওঠে, মনে হয় যেন গাছ, ফুল এবং পাখি সমেত একটি দ্বি-মাত্রিক (2-D) পার্সিয়ান বাগান।
‘শিরাজের নওরোজে ফাল্গুন মাসে
যেন তার প্রিয়ার সমাধির পাশে
তরুন ইরান-কবি কাঁদে নিরজনে
ঝরা বনগোলাপের বিলাপ শুনে’
সত্যি বলতে পার্সিয়ান বাগানের স্বতন্ত্রতা কেবল তার জ্যামিতিক নকশা এবং আর্কিটেকচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রতীকবাদ ( symbolism) এবং বিমূর্ততাবাদ একে আরো অনন্য করেছে।
পার্সিয়ান উদ্যানে স্রষ্টার সৃষ্টি প্রকৃতি আর মানুষের সৃষ্টি স্থাপত্য যেন পরাবাস্তবতা ও বাস্তবতার সহাবস্থান।
পার্সিয়ান উদ্যানে স্রষ্টার সৃষ্টি প্রকৃতি আর মানুষের সৃষ্টি স্থাপত্য যেন পরাবাস্তবতা ও বাস্তবতার সহাবস্থান। পার্থিব ভূ-স্বর্গের চারটি কোয়ার্ডেনট যাদের বলা হয় ‘চার-বাগ’— স্রষ্টার চার ভূবনের বিমূর্ত প্রকাশ, স্বচ্ছ জলধারা মানব-মানবীর শুভ্রতা আর পবিত্রতার নিদর্শন, আর চিরসবুজ বৃক্ষরাজি (সাইপ্রেস) অমরত্বের প্রতীক। মাঝে এক অপরূপ অতিন্দ্রিয় পথ নিয়ে যায় কোনো মহাজাগতিক সত্যের সন্ধানে। যে সত্য আমাদের শান্ত করে।
আজকের পৃথিবী বড়ো কঠিন, বড়ো অশান্ত । কবিতা-গল্প-প্রেম-উপাসনা হারিয়ে যাচ্ছে। ইরানের শুষ্ক মরুর বুকে একবিন্দু জলপিপাসার মতোই কমনীয়তার হাহাকার-বিরাজিত এই সাইবার পৃথিবীতে আমরা সবাই যেন বিকলাঙ্গ। কিন্তু, হারিয়ে যাওয়া মানে তো ফুরিয়ে যাওয়া নয়! জালাল উদ্দিন রুমী বলেছেন— ‘হারিয়ে না গেলে কিছু কিছু সুন্দর পথের খোঁজ পাওয়া যায় না।’ ঠিক সেরকমই, পার্সিয়ান-বাগিচার বিমূর্ত সেই সুন্দর পথে, রুপালি পানির পরাবাস্তবতায় হারানোর মধ্যে হয়তো আছে কোনো এক অসীম চেতনার মহাসমুদ্রের সন্ধান, আছে সীমার মাঝে অসীম।
কবি লায়লা ফারজানা পেশায় স্থপতি। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন (আরবান ডিজাইন ও স্থাপত্যবিদ্যায়) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ টরেন্টো থেকে। তিনি নিউ ইয়র্ক সিটি স্কুল কনস্ট্রাকশন অথোরিটিতে স্থপতি হিসাবে কাজ করছেন। এর বাইরেও লায়লা ফারজানা একজন নাট্যশিল্পী এবং শিল্প ও সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায় রয়েছে তার সাবলীল যাতায়াত। নিউইয়র্ক-এর ডিস্টুডিওডি আর্কিটেক্টস এবং ইঞ্জিনিয়ার্স (দ্য স্টুডিও অফ ডিজাইন) তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান, যেখানে তিনি ‘সাসটেইনেবল-আর্কিটেকচার’ এর চর্চা করেন।