বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

বাংলাদেশ

0

১.
: ‘সায়মন্ অ্যান্ড গারফাঙ্কেল’, ডি’কে উত্তরে জানাল রাতুল। ‘ওদের গানের লিরিক্সে ষাট দশকের নস্টালজিক একটা ভাইব্ আছে; জিমি হেনড্রিক্স আর জন্ লেননের মিশ্রণ। তবে বীটলস্ এর মতো সার্বজনীন নয়, পিংক ফ্লয়েডের মতো স্বতন্ত্র’। ডি’ এবার রাতুলের দিকে ফিরে ভুরু কুঁচকে বোঝাল যে সে বোঝেনি।
: একটু সহজ করে বলবে?
: ধরো, এই নর্থ বোস্টনে এবারের তীব্র শীতের মাত্রাটা; এমন সুঁই-ফোটানো ঠান্ডার মধ্যেও চারপাশের মানুষগুলো কেমন হাসিখুশি! তুমি নিজেই এখানে-ওখানে ঘুরতে যাচ্ছ, এটা-ওটা উপহার কিনছ, বন্ধু বান্ধবদের কাছে হলিডে-পোস্টকার্ড পাঠাচ্ছ। এর মধ্যে যে নস্টালজিক একটা ব্যাপার আছে, খেয়াল করেছ কখনো?
: বছর শুরুর সীজনে এসব খুব প্রেডিক্টেবল বিষয়— বাই ডিফল্ট। ছোটোবেলা থেকেই এগুলো দেখে আসছি।
: এটাই বলতে চাইছি ডি। যে জিনিস মানুষের স্মৃতিকে উশকে দেয়, তা তাকে ভেতরে ভেতরে বিহ্বল করে। গেল বছরের ক্রিসমাসে এখানে যদি তুষার পড়ত, নিশ্চয়ই তুমি একে বলতে ‘আদর্শ হলিডে’— একেবারে নির্ভেজাল ধ্রুপদী আবহ— তোমাদের অতি পরিচিত স্যান্টাক্লজীয় ঘরানার কালচারাল ক্লিশে। আমেরিকায় ক্ল্যাসিক ক্রিসমাস মানেই তো তুষারপাতের রোম্যান্টিক দৃশ্য। ধরে নাও ‘সায়মন অ্যান্ড গারফাঙ্কেল’-এর গানও আমার কাছে সেরকম বিশেষ কিছু।
: ড্যা-অ্যা-ম্ ডূড, এতো জটিল করে ভেবে দেখিনি; কিন্তু এগুলো তো সেকেলে বুড়োদের গান! একঘেয়ে! ঘ্যানর ঘ্যানর!

গত নভেম্বরে স্থানীয় এক অটোমোবাইল অকশান হাউজ থেকে কেনা রাতুলের লেক্সাস ই-থ্রী-ফিফটি সিডানে যেতে যেতে আলাপ হচ্ছিলো ডি’র সাথে। ডিনা রবার্টস্–কে রাতুল সংক্ষেপে ‘ডি’ নামে ডাকে। বন্ধু-বান্ধব-স্বজনদের প্রায় সবাই ওকে ঐ নামেই চেনে। অবশ্য ডি’র স্ত্রীব্রত স্বামী জাস্টিন ওর আরেকটা যুতসই নাম দিয়েছে। ‘ডেথ স্কোয়াড’! কারণ, কোনো ঘটনা-অঘটনা-দুর্ঘটনাবশত মেজাজ একবার চড়ে গেলে ডি’র সাথে কথায় কেউ পেরে ওঠে না। ওর সমস্ত যুক্তি, কু-যুক্তি আর অ-যুক্তি তখন হয়ে ওঠে সর্ব্বৈব যৌক্তিক, আর বাকিদের হাজার শক্তপোক্ত কথা খড়কুটোর মতো উড়তে উড়তে কোথায় গিয়ে যেন নিঃশব্দে আছাড় খায়। এই যেমন সেদিনের ঘরোয়া আড্ডায় বেচারা জাস্টিন কি এক কথা প্রসঙ্গে খুব নিরীহভাবে বলেছিল, মেয়েরা প্রকৃতিগত নিয়মেই খানিকটা আত্মকেন্দ্রিক আর খুঁতখুঁতে স্বভাবের হয়। মন্তব্যটি ধারে ভারে আপাত নির্বিষ, কিন্তু কথাটা বলেই সে খুব ঠা-ঠা-ঠা শব্দে হাসছিল। ব্যস্! আর যায় কোথায়! স্পষ্টতই প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ, উত্তেজিত ডি’ একসময় অলিখিতভাবে প্রমাণ করেই ছাড়ল, পুরুষ মানুষ সত্যিকার অর্থে মানুষই না! বড়োজোর খচ্চর প্রজাতির কিছু একটা হতে পারে— এবং এতে খচ্চরদের মান সম্মানও যথেষ্ট পরিমাণে নষ্ট হয়!

সকালে নিজের অফিস যাওয়ার পথে জাস্টিনই ডিনা’কে নিয়মিত ওর কাজের জায়গায় নামিয়ে দেয়। জরুরি কোনো কারণে আজ সে দায়িত্ব পড়েছে ওদের বাঙালি বন্ধু, প্রতিবেশি রাতুলের ওপর। আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস্ অঙ্গরাজ্যের আধা-শহুরে ছিমছাম মোলডেন্ অঞ্চলের বাসা থেকে বোস্টন বিশ-পঁচিশ মিনিটের ড্রাইভ। বোস্টন আর মোলডেন্-এর মাঝামাঝি চার্লসটাউনে ডি’কে নামিয়ে দিয়েই ওর দায়িত্ব শেষ। বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ নিয়ে বাংলাদেশ থেকে পড়তে আসা রাতুল এরপর যাবে নিজের অফিসে, ‘ইউম্যাস্-বোস্টন’-এর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবে। ইদানিং ড্রাইভিং-এর সময় স্লেটরঙা রাস্তার দু’পাশে পাতাহীন সারি সারি ম্যাপল আর পপলার গাছগুলো দেখতে দেখতে রাতুলের প্রায়ই মনে হয়, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে শীতের যে মায়াময় সৌন্দর্য, পৃথিবীর আর কোথাও এমন নেই। ছেলেবেলার কতো স্মৃতি এখনো সতেজ! স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে সবাই মিলে হৈ হৈ করে মামাবাড়ি যাওয়া, সকালবেলা কুয়াশার ভেতর তকতকে উঠোনে সোয়েটার-চাদর গায়ে জড়িয়ে গরম গরম ভাপা, সাথে জ্বাল-দেয়া টাটকা খেজুরের রস, কখনো-বা রস মেশানো দুধ-চিতই। আর ছিল ধোঁয়া-ওঠা ঘন কড়া দুধ-চা! এখন এই বিদেশ বিভুঁইয়ে রোজ সকালে খটখটে ব্যাগল্-বাটার আর পানসে ওটমীল চিবোতে চিবোতে জিভে যেন অঘোষিত অবরোধ লেগে গেছে। এসব ভাবতে ভাবতেই ও এতক্ষণ চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছিল। অন্তর্মুখী রাতুল তাই প্রথমটায় ডি’র প্রশ্নটা খেয়াল করেনি। গাড়ির এফ এম রেডিওতে বাজতে থাকা এড শেরিনে’র গানের সাথে গুনগুন করতে করতে ডি’ দ্বিতীয়বার জানতে চেয়েছিল, ‘তোমার প্রিয় আমেরিকান সঙ্গীতশিল্পী কে?’। রাতুল উত্তরে জানিয়েছিল, ‘সায়মন্ অ্যান্ড গারফাঙ্কেল’। এরকম তালকানা আর ব্যতিক্রমী উত্তরে কিছুটা যেন অসন্তুষ্ট ডি’র ধারণা ছিল সে হয়তো ‘লেডি গাগা’, ‘মেরুণ ফাইভ’, ‘এমিনেম’ কিংবা টেনেটুনে ‘মাইকেল জ্যাকসন’-এর নাম বলবে। এরাই মার্কিন সংগীত জগতের পরিচিত ক্রেইজ কিনা! যা হোক, একটা আলাপ শুরু করতে পেরে ডি এবার একটু সহজ হলো। ফস্ করে জিজ্ঞেস করল, ‘এই উইকেন্ডে তুমি ফ্রী আছো ?’ আমেরিকানরা সাধারণত সপ্তাহের সোম থেকে শুক্র এই পাঁচদিন প্রচণ্ড পরিশ্রম করে; শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় সপ্তাহান্তের ছুটি উদযাপন। বয়স আর সামাজিক স্তরভেদে উদযাপনটা ভিন্ন ভিন্ন ধরণ ও মাত্রার হলেও সোয়া-দুই দিনের এ সময়টুকু তারা মূলত পরিচিতদের সাথে ফুর্তি, বিশ্রাম করে কাটায়। বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ-তরুণীদের বেশিরভাগই মুখিয়ে থাকে ক্লাব-বার-লাউঞ্জে হই-হুল্লোড় করার জন্যে। শুক্র-শনিবার রাত বারোটার পর শহরের পাবগুলোর আশেপাশে সস্তা বিয়ার, কড়া জ্যাক-ড্যানিয়েল, টাকিলা-ভদকা-সিগারেটের ধোঁয়া মিশ্রিত উটকো গন্ধ আর রাস্তার ধারের বেসামাল মাতলামিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যতিব্যস্ত থাকে শহুরে পুলিশ আর নাইটক্লাবের পেশাদার বাউন্সার। রাতুলের প্রতিবেশিরা তুলনামূলক নির্ঝঞ্জাট হওয়ায় আমেরিকান উইকেন্ডের স্বাভাবিক ফুর্তির সামান্য যা ঢেউ ওর কাছে আসে তা শুধু পরিচিতজনদের নিমন্ত্রণ রক্ষা কিংবা বন্ধুদের সাথে হুটহাট মুভি দেখতে যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। রাতুল এ উইকেন্ডে আপাতত ফ্রী আছে জানতে পেরে ডি’ তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিল শনিবার রাতে সে জাস্টিনদের সাথে ওদের বাসায় ডিনারে যোগ দেবে। সেলফোনে চট করে ছোটো টেক্সট পাঠিয়ে জাস্টিনকেও নিজের একতরফা সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দিল। রাতুল তখনও জানতো না একটা ক্যাজুয়াল ডিনার পর্বের কিছু সাধারণ আলোচনা ওর অন্তর্মুখী স্বভাবকে কতোটা প্রভাবিত করতে পারে।

২.
ডি’কে চার্লসটাউনে ওর রিয়েল এস্টেট ব্রোকারের অফিসে নামিয়ে দিয়ে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে রাতুল পৌঁছে গেল নিজের অফিসে। সেলফোনের ঘড়িতে তখনো মিনিট বিশেক সময় বরাদ্দ। পার্কিং-লটে নিজের ছাইরঙা গাড়িটা জমা রেখে, ডিপার্টমেন্টের নিচতলার স্টারবাকস্ কফি আউটলেট থেকে একটা মাঝারি আকারের ব্লন্ড-রোস্টেড ক্যাফে এম্যারিকানো কিনে নিল। কিছুদিন হলো প্রায় সকালে রাতুল এই ছোটো বিলাসিতাটুকু করছে। একে বিলাসিতাই বলা যায়। তিন ডলার দিয়ে এক কাপ কফি কিনে খাওয়ার নতুন অভ্যাসটাকে সে এখনো স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হয়। কিন্তু পুরো সপ্তার একটানা খাটুনি আর ঘুমের স্বল্পতাকে সহনীয় করবার জন্যে সকালের কড়া ব্ল্যাক কফিটা ধীরে ধীরে যেন অপরিহার্য হয়ে উঠছে।

: গুড মর্নিং রাঠুল্’। পাশ থেকে পরিচিত রিনরিনে গলা শুনে রাতুল বুঝল আজও ক্রিস্টিনা ওর আগে পৌঁছেছে। মাস চারেক হতে চলল, ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত ক্রিস্টিনা লুকচ্চি নামের এই স্বর্ণকেশী ওর ডিপার্টমেন্টের রিসার্চ ল্যাবে জয়েন করেছে। কথাবার্তায় লেশমাত্র জড়তাহীন, ঈর্ষাতীত মেধাবী, আপাদমস্তক চৌকশ মেয়েটিকে প্রথম দেখায় যে কেউ ভুল বুঝবে। রাতুলও ভেবেছিল ক্রিস্টিনা হয়তো সুদূর মিলানের কোনো মডেলিং র্যা ম্পের রানওয়েতে বেঢপ-উঁচু হিলের জুতো পরে হাঁটতে হাঁটতে বেমক্কা হোঁচট খেয়ে ওর অ্যাকাডেমিক ডিপার্টমেন্টে ঢুকে পড়েছে। অনেকের মতোই রাতুলেরও ধারণা, অতিমেধাবী নারীরা চলতি অর্থে তেমন রূপবতী হয় না; আবার অসম্ভব রূপসী নারীরা সাধারণত বুদ্ধিতে খানিকটা দুর্বল হয়— কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ বোকাসোকা ধরণেরই হয়ে থাকে। কিন্তু রূপ আর শাণিত মেধার মিশেলে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম এই মেয়ে। অনেকটা যেন আধুনিক জেমস্ বন্ডের এক্সক্লুসিভ মহিলা সংস্করণ; গালে টোল-পড়া স্নিগ্ধ মোহময়ী হাসিতে শিকারকে যে আয়ত্তে এনে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাইলেন্সারের নিখুঁত নিশানায় বুকের বাঁ পাশটা নিথর করে দিতে পারবে। আর মোহগ্রস্থ শিকারটি মাটিতে লুটিয়ে পড়তে পড়তে মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে থেকে ঘোরের ভেতর অস্ফুট স্বগতোক্তি করবে, ‘আহা কি সুন্দর! আহা কি মনোরম!’
রাতুল প্রত্যুত্তরে ‘শুভসকাল’ জানিয়ে জিগ্যেস করল,
: এই ঠান্ডার মধ্যেও এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে?
: গত ক’দিনে প্রোটিন সিন্থেসাইজিং প্রজেক্ট-এর ডাটাগুলো ভালো আসেনি, ভাবলাম আগামী কিছু দিন ল্যাবে একটু বেশি সময় দেয়া উচিত। এজন্যেই সকাল সকাল আসা। আজকে বরং একটু দেরি-ই হলো।
: এতোটা সিরিয়াস হতে হবে না ক্রিস্টি। আমি আছি, প্রফেসর রথ আছেন।
: হুম্; এবারের প্রজেক্ট রিপোর্ট ‘আপ টু দ্যা মার্ক’ না হলে, ফান্ডিং–এর বরাদ্দে যখন টান পড়বে আমাকেই তখন ভুগতে হবে! কফিশপের ভেতরে স্বচ্ছ কাচের দেয়াল ঘেঁষে একটা চেয়ারে বসতে বসতে মন্তব্য করল ক্রিস্টিনা।
: তা ঠিক। তখন আর ‘লুকচ্চি! লুকচ্চি!’ বলে চেঁচিয়েও অযাচিত ভোগান্তি থেকে নিজেকে লুকোতে পারবে না!
: মানে? —সবুজ-ধূসর চোখজোড়া নাচিয়ে জানতে চাইল ক্রিস্টি।
: মানে তেমন কিছু না, মিস্ ক্রিস্টিনা লুকচ্চি। তোমার ইতালিয়ান নামের শেষাংশের মতো শুনতে বাংলা ভাষায় একটি শব্দ আছে— লুকোচ্ছি, হেঁয়ালিটা সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিয়ে হাসলো রাতুল।
: আচ্ছা? তাই নাকি! তোমার নামের ইংরেজী বানান R-A-T-U-L-এর প্রথম তিন অক্ষর দিয়েও অসাধারণ একটি শব্দ তৈরি হয়— র্যা ট; বলেই উল্টো খোঁচা দিয়ে মেয়েটিও কিছুক্ষণ ঝলমলিয়ে হেসে নিল।
: র্যা ট বলো আর ক্যাট বলো, পরের সেমিস্টারে তুমি আর আমাকে এখানে পাচ্ছ না মিসি।
: হুঁ?! কোথাও ট্রান্সফারড্ হচ্ছো?
: ওয়েস্ট কৌস্ট্। সু-দূ-র ক্যালিফোর্নিয়ায়। গতকাল ফ্রেজনো থেকে একটা ফোনকল পেয়ে নিশ্চিত হলাম,
তথ্যটি জানিয়ে রাতুল একবার নিজের হাতঘড়িতে সময় দেখে নিল। আর পাঁচ মিনিট পর অফিসে সাইন-ইন করতে হবে। দু’জনই শেষ না হওয়া কফির টেইক-আউট কাপদুটো হাতে নিয়ে উঠে পড়ল। কফিশপ থেকে বেরনোর সময় কি যেন ভেবে রাতুল ডি’র বাসায় উইকেন্ড-ডিনারের প্রসঙ্গটি তুলে ক্রিস্টিকে ওর সাথে যাবার জন্য অনুরোধ করল।

৩.
‘আজকের মেন্যুটা দেখেছ, রাঠুল?’ একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল জাস্টিন। ‘তোমার জন্য খাবারের বিশেষ পদও তৈরি হয়েছে। পি-লা-উ রাইস!’ ডি আর জাস্টিন বেশ খেটেই আয়োজন করেছে বোঝা গেল। রান্নাঘরের পুরো টেবিল-টপ কাউন্টার জুড়ে অ্যালুমিনিয়াম ট্রে আর ফয়েল বিছিয়ে বুফের মতো করে সাজানো হয়েছে সমস্ত ডিশগুলো। মেন্যুতে আস্ত-টার্কি, রোস্ট বীফ, স্যামন ফীলে, ম্যাশড পটেটোর মতো গতবাঁধা আমেরিকান পদের সাথে চমক হিসেবে আছে সাদা পোলাও আর ল্যাম্ব কারি। যদিও এই পোলাও-এর ঘ্রাণ বা স্বাদ কোনোটাই দেশীয় নয়, তবু রাতুল তার প্রতিবেশিদের আন্তরিকতায় বেশ অভিভূত হলো। আসছে সপ্তার দশ তারিখ ডিনা-জাস্টিনের তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী, কিন্তু ঐ সময়টায় দুই টোনাটুনি একান্তে ঘুরতে যাবে ক্যারিবিয়ান দ্বীপে। এজন্যে এই উইকেন্ডেই বন্ধুদেরকে নিয়ে এমন ঘরোয়া ফিস্ট। রাতুল ভেবেছিল ক্রিস্টি হয়তো এখানে এই অচেনা পরিবেশে ওর সাথে আসতে রাজি হবে না। নতুন লোকজনের সান্নিধ্যে এসে কিছুটা সংকোচ বোধ করবে। কিন্তু, উল্টো ক্রিস্টিনাই যেন আজকের অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। অতিথিদের মধ্যে দু’য়েকজন ওকেই হোস্ট ভেবে মন্তব্য করে বসল, ‘আয়োজনটা গৃহকর্ত্রীর মতোই গরজিয়াস!’ ডিনারের আগে এরই মধ্যে দু-তিন রাউন্ড গ্রে-গুজ, প্যাত্রন, অ্যাবসলুত-স্মিরনফের সদ্ব্যবহার হয়ে গেছে। রাতুল প্রতিবারই এটা ওটা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেল। ‘নো থ্যাংকস’ বলে যতবার সে কড়া-পানীয়ের ট্রে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে, ততবারই লক্ষ্য করল লিভিংরুমের ডানপ্রান্ত ঘেঁষে বসা শক্ত চেহারার এক প্রৌঢ়মতন ভদ্রলোক তার দিকে খুব ঔৎসুক্য নিয়ে তাকাচ্ছে। অবশ্য উৎসুক না হবার কোনো কারণ নেই। ঘরভর্তি মার্কিন ককেশীয়দের ভিড়ে একজন বাদামী চামড়ার ভিনদেশী যুবকের উপস্থিতি সহজাত কৌতূহল জাগাবে— এটাই স্বাভাবিক। এমন সময় ডি’ এসে আচমকা প্রশ্ন করল, ‘তোমার সাথে আসা বার্বি ডল-টা কে? নতুন প্রেমিকা বুঝি?’ উত্তরে রাতুল যতই বুঝিয়ে বলে ক্রিস্টি শুধুই তার অফিস কলিগ আর ভালো একজন বন্ধু, ততোই ডি’ খোঁচাতে লাগল, ‘পাপারাজ্জিদের ট্যাবলয়েডের ভাষায় কথা বলছ কেন? ডেইটিং কতদিন ধরে চলছে? বিয়ে করছ না কেন? কবে বিয়ে করবে? বিয়ে কি করেই ফেলেছো!’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠিক তখনই দূরে বসা ভদ্রলোকটি রাতুলের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে মন্তব্য করল, ‘শী ইজ ওয়েই আউট অফ হিজ লীগ’। রাখঢাকহীন কথাটার মোটামুটি বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, ‘কোনোভাবেই তুমি এই মেয়ের যোগ্য নও।’
: হ্যালো, আমি টীম। টিমোথি রীড। —নিজের পরিচয় দিয়ে লোকটি রাতুলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
: রাতুল। রাতুল চৌধুরী।
: ধারণা করছি তুমি জাস্টিনের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড?
: এবং প্রতিবেশি— তুমি?
টীমের হয়ে এবার ডি’ উত্তর দিল— মি. রীড আমার শ্বশুরের ছেলেবেলার বন্ধু। বহুবছর ডিপ্লোম্যাট ছিলেন, এশিয়া-ইউরোপ ঘুরে বেড়িয়েছেন। বছর কয়েক আগে রিটায়ার করে এখন বোস্টনেই থিতু। আর এ হচ্ছে রাতুল। একজন পারফেক্ট জেন্টলম্যান। বাংলাদেশ থেকে এসেছে কি-সব গবেষণা-টবেষণা করার জন্য। কথা আরো এগোতে পারত, কিন্তু ততক্ষণে ডিনারের সময় হয়ে গেছে। সবাই এক এক করে নিজ নিজ প্লেটে খাবার নিয়ে বিশাল ডাইনিং টেবিলের চারপাশে বসে গেল। বয়সে যারা একটু ছোটো, তাদের সবাই টিভির সামনে বসে হৈ চৈ করতে করতে প্যাপারনি-পিৎজা আর কোল্ড-কাট স্যান্ডউইচ চিবোতে লাগল। ডাইনিং টেবিলে আলাপ খুব একটা জমল না। যদিও কাঁটাচামচ, ছুরির সাথে কাচের প্লেটের টুংটাং আওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে সবাই ডি’র বৈচিত্র্যময় রান্নার খুব প্রশংসা করে গেছে। মাঝে একবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মি. রীড রাতুলের কাছে নিচুস্বরে জানতে চেয়েছে, আমেরিকায় এসে কাঁটাচামচ দিয়ে খাবার খেতে ওর কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। প্রশ্নটার ভেতর লুকোনো ইঙ্গিতকে পাশ কাটিয়ে রাতুল বলেছিল— শুনেছি, ডিপ্লোম্যাসিতে ট্যাবল্-এটিকেট ছাড়াও অনেক কিছু শেখার আছে।

খাবারের মূলপর্ব শেষে ডেজার্ট-প্লেটে তিরামিস্যু কেকের টুকরো নিয়ে অতিথিদের অনেকেই লিভিং রুমে এসে বসেছে। মুখোমুখি সোফায় বসে কেউ কেউ এন্-এফ-এল্ ফুটবল মৌসুমের ওপর আলাপ শুরু করেছে, দু’য়েকজন আবার নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেন-এর বর্তমান ইকোনমিক পলিসি নিয়ে বিশেষজ্ঞ-প্রস্তাব পেশ করছে। কেউ বা সদ্য অস্কার পাওয়া হলিউডি সিনেমা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। মি. রীড চিড়িয়াখানায় কোনো রংচঙা অ্যাগজটিক্ জন্তু দেখার মতো দৃষ্টিতে রাতুলকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বেশ আয়েশি ভঙ্গিমায় কেকের ছোটো একটা টুকরো মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে জিগ্যেস করল, ‘সো! মি. চাওডুরী! ভ্যালেন্টাইনস ডে সম্পর্কে তোমার কী অভিমত?’ রাতুল বুঝতে পারছে না এই লোক এতো উৎসাহ নিয়ে ওর সাথে আলাপ করছে কেন! এর মধ্যে টুকটাক যা কথাবার্তা হয়েছে তাতে তো প্রাথমিক সহজিয়া কৌতূহল মিটে যাবার কথা। আরো বিরক্তিকর ব্যাপার হলো— টীমের কথা বলার ধরণটাই এমন যে, অতি সাধারণ বক্তব্যকেও কিভাবে যেন সে নেতিবাচক শ্লেষ মিশিয়ে ছুঁড়ে দেয়। তার ওপর রাতুল একটু চুপচাপ, অন্তর্মুখী স্বভাবের। পরিচিত বা কাছের মানুষ না হলে আলাপ বেশিদূর গড়ায় না। ভ্যালেন্টাইনস ডে নিয়ে টীমের প্রশ্নের উত্তরে ও নির্বিকারভাবে বলল,
: ভালোই; মুক্ত বাণিজ্যের একটি সম্ভাবনাময় খাত’।
: কাম-অন্ সান্, ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র মতো রোম্যান্টিক একটা ধারণার মধ্যে বাণিজ্য আসছে কোত্থেকে? অবশ্য অনুন্নত, দরিদ্র দেশগুলোতে যেখানে মানুষের বেঁচে থাকার মূল উপাদানই অনুপস্থিত, তাদের কাছে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র মর্ম বোঝা কঠিন। তোমাদের গায়ে পরনের কাপড়ই যদি না থাকে, ফুল কেনার বিষয়টা তো তখন মোটা দাগে অবান্তর হয়ে পড়ে। —কথাগুলো যেন ওর দুইপাটি দাঁত দিয়ে পিষে, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল টীম। আমেরিকার সাধারণ মানুষজন প্রকাশ্যে বর্ণবাদী না হলেও, ওর এই কথায় যেন প্রাচীন ইউরোপীয় ভাইকিংদের ঔপনিবেশিক প্রেতাত্মার আঁচ পাওয়া গেল।
: মি. রীড, বৈশ্বিক আর্থ-সামাজিক প্যারামিটার অনেক জটিল বিষয়। এর পক্ষপাতহীন ইতিহাস খুঁজতে গেলে তোমার হয়তো নিজেকেই দোষী মনে হবে। কিন্তু ফুল কেনার সামর্থ্যের সাথে মানবিক উৎকর্ষতার সমীকরণটি আমার কাছে খুব স্থূল মনে হলো। মনুষ্যত্বের সমস্ত গুণকেই যদি বাজারদরে বিক্রির যোগ্য হতে হয়, তাহলে বুঝতে হবে অ-মানুষেরাই সেই বাজারের উদ্ভাবক এবং নিয়ন্ত্রক।
: ইয়াংম্যান, মনটাকে একটু প্রসারিত করো। একটু উদার হয়ে ভাবো। একটি বিশেষ দিনে কোনো ব্যাক্তি তার প্রিয় মানুষের কাছে নিজের একান্ত অনুভুতিকে ফুল দিয়ে প্রকাশ করছে, এই সহজ বিষয়টার মধ্যে যে আন্তরিক শৈল্পিক সৌন্দর্য আছে— এটা তুমি অস্বীকার করবে?
: দেখো, মানুষের সহজাত স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতির মতো অমূল্য এবং নাজুক সাবজেক্টিভ ইস্যুগুলোকে নিজের সুবিধামতো অবজেক্টিভিটির ছাঁচে ব্যবহার করে অনেক লাভজনক ব্যবসা করা যায়, যে ব্যবসাকে প্রায় পুরো পৃথিবীই স্বীকার করে। কিন্তু এতে মানবিক হৃদয়ের সংযোগ নেই; প্রাণীজ বুদ্ধির উদযাপনই এখানে আসলকথা, মি. রীড। এটা হলো, স্বপ্ন দেখার ওপর ট্যাক্স বসানোর মতো ব্যাপার। স্বপ্নটা এখানে মুখ্য নয়, কিন্তু ট্যাক্স দিতে যেন কেউ না ভোলে। তাছাড়া প্রেম-ভালোবাসার কনসেপ্ট এখন অনেকক্ষেত্রেই কাঁচাবাজারের সস্তা আলু-বেগুনের মতো। কথায় কথায় সীজনাল প্রেম হয়, কথায় কথায় ছাড়াছাড়ি— অ্যাডজাস্টমেন্টে সমস্যা হচ্ছে? ছেড়ে দাও! পরে সময়-সুযোগ-স্বার্থ হিসেব করে নতুন একটা প্রেম জোগাড় করে নিও।
: সান্, আমার ধারণা তুমি সহজ একটা জিনিসকে অযথা জটিলভাবে দেখছ। এটি শুধুমাত্রই একটি দিবস, যেমনটা জন্মদিবস, বিজয়দিবস, বিবাহবার্ষিকী, সো অন এন্ড সো ফর্থ। তেমনই ভালোবাসা দিবস। আধুনিক অগ্রসর বিশ্বের চিন্তার সাথে তোমার বক্তব্য যায় না। আবারো বলি, একটু উদার মুক্তমন নিয়ে ভাবো।
: মি. রীড, পাশ্চাত্যের উন্নত সমাজে আজকাল মা-দিবস, বাবা-দিবস ইত্যাদি যেমন ধুমধাম করে পালন হচ্ছে, তেমনি বৃদ্ধাশ্রমের চাহিদাও কিন্তু একইসাথে বাড়ছে তাল মিলিয়ে। ফাস্টফুড-চেইনের নতুন নতুন স্থাপনার মতো। আমি সত্যিই জানি না বানিজ্যিক ভূমিকার বাইরে এই দিবসগুলোর অন্য কোনো উপযোগিতা আছে কি না। যদি থাকেও বা, সমাজের মানবিক কাঠামো নির্মাণে তার অবদান কতোটা? আমেরিকায় গত দশ বছরে মোট বিবাহ-বিচ্ছেদের পরিসংখ্যানটা জানো তো? —চল্লিশ শতাংশের কিছু বেশি। যে সমাজে ভালোবাসা দিবসকে প্রায় রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়, যেখানে প্রতিটা গিফট শপে বিভিন্ন পন্যের গায়ে কারণে-অকারণে ভালোবাসা শব্দটিকে সাঁটা হয়, সেই ভালোবাসার ‘বাসা’-ই তো ভালো নেই!’—একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে রাতুল খেয়াল করল ঘরে উপস্থিত লোকজন এবার নিজেদের মধ্যে কথা থামিয়ে ওদের দু’জনের আলাপ শুনছে। সেদিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ না করে টীমের মন্তব্য,
: তোমাদের সমাজের মেয়েরা যদি স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের পরিবেশ পেতো, তবে ওখানেও হয়তো একই ধরণের পরিসংখ্যানই পাওয়া যেত। কঠোর পুরুষশাসিত অনুন্নত সমাজব্যবস্থার ভেতরে বন্দী নিরুপায় নারীরা মুখ বুজে সব অন্যায় সহ্য করে বলেই সেখানকার বিয়ে-সংসারকাঠামো টিকে থাকে— দারিদ্র্যও এর পেছনে ইন্ধন দেয়।
: টীম, দারিদ্র্যের অনেক ধরন হতে পারে। আবার ‘উন্নত’ শব্দটিও ঠিক অ্যাবসলিউট নয়। কেউ অর্থসম্পদে ধনী হলেই যে সে মনুষ্যত্বের দিক থেকে দরিদ্র হবে না, এমন কোনো কথা নেই। আর পারিবারিক কাঠামো রক্ষার ক্ষেত্রে সম্পর্কের স্থায়ীত্ব প্রসঙ্গে তোমার যে অভিমত, আংশিকভাবে হয়তো তা-ও সত্য। কিন্তু, সে অর্থে পৃথিবীর প্রায় কোনো সম্পর্কই তো নিখুঁত নয়। এজন্যে কি কথায় কথায় সম্পর্ক ছেদ করতে হবে? তাহলে ভালোবাসা দিবস-এর ধারণাই তো বিরাট এক প্রহসন হয়ে দাঁড়ায়।
: কোনো বিষয়ে তোমার নিজস্ব মনগড়া মতামত থাকতেই পারে, ইয়াংম্যান। তবে এসব ধারণাকে ফ্যাকচুয়াল সত্য মনে করলে ভুল হবে। ডিপ্লোম্যাসির কল্যাণে বুঝেছি, জাতি হিসেবে তোমরা বাঙালিরা অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ। তাই সব কিছুতেই ইনিয়ে বিনিয়ে মা-মাটি, চোখের জল, ট্যাগোরের কবিতা, ধর্মীয় ভাবালুতাকে নিয়ে অতিরিক্ত টানাটানি করো; আবার মেজাজ সামান্য চড়ে গেলেই রীতিমতো খুনোখুনি। এখনো নিজেরা নিজেরাই মারামারি করে মরছ। শেষ বাক্যটায় ঝাঁজ মিশিয়ে বলল রীড।
: কথাগুলো কি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল না, টীম? ধরে নিলাম, তোমার মন্তব্যগুলো সত্য। কিন্তু তুমি তো এটাও জানো, যে কোন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পুঁজির ভিত গড়ার সময়টা অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যায়। ইতিহাস অন্তত তাই বলে। এই পুঁজির সঞ্চয় হতে পারে বাইরে থেকে লুট করে অথবা রাষ্ট্রের ভেতরে যারা দুর্বল, তাদেরকে ঠকিয়ে। ইউরোপ, আমেরিকার যে সভ্যতা তার পুঁজির ভিত তৈরি হয়েছে সমস্ত পৃথিবীকে লুট করে। আজ আমেরিকা নামের যে ‘সভ্যরাষ্ট্রে’ তুমি বসবাস করছ, তার জমিটাও অন্যের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নেওয়া। ব্রিটিশরা আমাদের ওখানে গিয়ে প্রায় চারশ বছর ধরে সভ্যতার দোহাই দিয়ে শাসন-শোষন দুটোই করেছিল সমান ক্ষীপ্রতায়, ইন্সটিটিউশনলাইজড্ প্রিসীশনে। অন্যদিকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সামাজিক অস্থিরতাটা অবশ্যম্ভাবী হলেও সাময়িক। কিন্তু তাদের সমস্যা তখনই বড়ো হয়ে দাঁড়ায়, যখন বাইরের শক্তিগুলো সেই অস্থিরতাকে জিইয়ে রেখে ভূ-রাজনীতির পিঠাভাগের অংশ নেয়ার জন্য স্টেইক-হোল্ডার-এ রূপ নেয়। এটা হলো ‘ডিভাইড এন্ড রুল’-এর সর্বাধুনিক প্রয়োগ। সুকৌশল লুটতরাজ। আর আবেগের কথা প্রসঙ্গে বলব, আবেগ আছে বলেই মানুষ মানুষ হয়ে উঠতে পারে।

জমে ওঠা আলাপ আরো দীর্ঘায়িত হতে পারত। কিন্তু রাত বেশি হবার আগেই ক্রিস্টিনাকে ওর বাসায় পৌঁছে দেবে বলে কথা দিয়েছিল রাতুল। তাই অনেকটা জোর করেই ছোটো বিতর্কটির ইতি টানতে হলো। এভাবে আড্ডার মাঝপথে ওকে বিদায় নিতে দেখে ডি’ কিছুটা বিরক্ত হলেও আজ সে বেফাঁস কোনো মন্তব্য করল না।

৪.
মুখচোরা মানুষের মুখে হঠাৎ খই ফোটার রহস্য কি? —কৌতূহল দেখিয়ে জিগ্যেস করল ক্রিস্টিনা। পার্কিং মোড থেকে ড্রাইভিং মোডে অটো-ট্রান্সমিশন গিয়ার বদলাতে বদলাতে রাতুল বলল, ‘ইন্ট্রোভার্ট-দেরও মাঝে মাঝে আলাপ করবার ইচ্ছে জাগতে পারে’। গাড়ির হিটারের সূচককাঁটা সত্তর ডিগ্রী ফারেনহাইটে স্থির করে, স্টিয়ারিং হুইলটি বাঁয়ে সামান্য ঘুরিয়ে জাস্টিনদের সরু ড্রাইভওয়ে থেকে ও বেরোল ক্রিস্টিনাকে নিয়ে। আজ রাস্তা বেশ ফাঁকা। দিগন্ত ছেড়ে সামান্য উপরে ওঠা গোল চাঁদটি আকাশ জুড়ে মৃদু নীলচে আলো ছড়িয়ে রেখেছে। মিনিট দশেকের মধ্যেই মোলডেন-এর লোকাল সড়ক পেরিয়ে, হাইওয়ে ধরে আবার ডাউনটাউন বোস্টনের এক্সিট নিয়ে ছোটো সড়কে পৌঁছে গেল তারা। ক্রিস্টিনা কিছুক্ষণ ধরেই একটা কিছু বলি বলি করছিল। ওর বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই জিগ্যেস করল—
: প্রফেসর রথ সেদিন বলছিলেন, তুমি আগামী বছর বাংলাদেশে একেবারে পার্মানেন্টলি চলে যাচ্ছ?
: ‘হুম্… হ্যাঁ। ভাবলাম দেশে গিয়ে এবার থিতু হই’, বলল রাতুল
: ‘ইউনাইটেড স্টেইটস্ ছেড়ে বাংলাদেশ?! সিদ্ধান্তটা হুইমজিক্যাল্ হয়ে গেল না?’
: ‘তা হবে কেন? ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবে এটাই তো স্বাভাবিক’।
: ‘তোমার আর একটু ভেবে দেখা উচিত রাঠুল। ঐদেশে নিশ্চয়ই এখানকার মতো এতো সুযোগ সুবিধা পাবে না। একজন ওয়েল-উইশার হিসেবেই বলব, ছেলেমানুষি-আবেগের বশে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করার মানে নেই’।
: ‘আবেগ কিনা জানি না ক্রিস্টি, তবে প্রবাসের জমকালো চাকচিক্যের চেয়ে আমার দেশের সাদামাটা আবহ আমাকে বেশি টানে। হয়ত আমরা একেই নাড়ির টান বলি। আর নিজ দেশের মাটি-মানুষের কাছে আমার যে ঋণ, ঘরে ফেরাটা হয়তো নিজের অবচেতন মনে তারই সামান্য স্বীকারোক্তি’।
: কি এমন আছে ওখানে? যার জন্য সব ছেড়ে যাচ্ছ?
: ষড়ৈশ্বর্যময় হৃদয়। থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়া। বসন্তের বাতাসটুকুর মতো নরম জোনাকি। আর আছে পলাশরাঙা ফাল্গুন… বাংলাদেশ এক নিটোল মহাকাব্য, ক্রিস্টি! এটা ব্যাখ্যার বিষয় নয়; আমার যা কিছু— সবই ওখানে।
ধীরে ধীরে কথাগুলো বলে রাতুল লক্ষ্য করল সাবলীল, চৌকশ, চাবি দেয়া পুতুলের মতো দেখতে ভিনদেশী মেয়েটি বিস্ময়ভরা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। যেন কুয়াশায় ঘোরলাগা বিভ্রমের ভেতর থেকে কোন এক জীয়নকাঠির ছোঁয়ায় সে জেগে উঠছে। মুহূর্ত নীরব থেকে খুব ধীরে অচেনা গাঢ় স্বরে জিগ্যেস করল,
: ‘আমাকে তোমার সাথে তোমার দেশে নিয়ে যাবে?’

রাতুল খেয়াল করে দেখল, ওরা ততক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২৪ নভেম্বর ১৯৭৮। নৃবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। ঢাকা, বোস্টন ও নিউইয়র্কে বেড়ে ওঠায় তাঁর আত্মগত স্বর ও শৈলীতে রয়েছে বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও প্রসঙ্গের সমন্বয়। সাম্প্রতিক সময়ে অনুবাদ, সম্পাদনা ও সমকালীন সাহিত্য নিয়ে নিয়মিত লিখছেন কয়েকটি পত্রিকায়।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।