আমাদের শহরে বাঘের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শহরের লোকদের ভেতরে একটা গোপন ভীতি ক্রমশ জমাট বাঁধতে থাকে। ঘটনাটা প্রথম শোনা যায় হঠাৎ এক সকালবেলায় যে, গতরাতে এক নৈশপ্রহরী বাঘটাকে দেখেছে খুব নির্বিঘ্নে হেঁটে গলির মোড় দিয়ে রাস্তা পার হতে। কিন্তু এই ঘটনা শোনার পর অনেকেই পাত্তা দেয়নি। যদিও আমাদের শহরের কিছু দূরে পৃথিবী-বিখ্যাত এক অরণ্য। তবু সেই অরণ্যের বাঘ এতোগুলো গ্রাম, শহরতলী ডিঙিয়ে আমাদের এইখানে আসতে পারে এটা কেউ আমলে নেয়নি প্রথম দিকে। কিন্তু দ্বিতীয় দিন সকালে যখন একজন লোকের লাশ পাওয়া গেল! তারপর জানা গেল লোকটা আসলে ভয়ে মরে গেছে। কিন্তু কিসের ভয়? এটা খুঁজতে গিয়েই বাঘ বেরিয়ে আসে। এবং জানা যায় যে, তারা তিনজন রাতের বেলায় ফিরছিল। আচমকা বাঘটা তাদের সামনে এসে হাজির হয় এবং মুহূর্ত দেরি না করেই তাদের একজনের উপর হামলে পড়ে এবং অন্য দুইজন দৌড়াতে শুরু করে। একজন পালাতে সক্ষম হয়। অন্য একজন বাঘের আতঙ্কে দৌড়াতে দৌড়াতে পড়ে মরে যায়!
পঞ্চম দিন ভোরে আমরা জানতে পাই যে, কর্পোরেশনের এক ঝাড়ুদার মহিলা ভোররাতে রাস্তা কুড়াচ্ছিল যখন, ঠিক সেই সময় সে দেখতে পায় বাঘটাকে এভিনিউয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে! চোখ দুটো যেন তাক্ করা বন্দুকের নল! মহিলা সাহসী থাকায় সে তার বাঁশের লাঠির সঙ্গে বাঁধা ঝাড়ু উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
যাকে বাঘ ধরেছিল তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। যদিও আমরা এই বিবৃতিদাতার ছবি দেখিনি। কিন্তু এবারের গল্পটা দ্রুত ছড়িয়ে যায় মুখ থেকে মুখে! তৃতীয় দিন কিছু ঘটে না তবে চতুর্থ দিন বা পঞ্চম দিন ভোরে আমরা জানতে পাই যে, কর্পোরেশনের এক ঝাড়ুদার মহিলা ভোররাতে রাস্তা কুড়াচ্ছিল যখন, ঠিক সেই সময় সে দেখতে পায় বাঘটাকে এভিনিউয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে! চোখ দুটো যেন তাক্ করা বন্দুকের নল! মহিলা সাহসী থাকায় সে তার বাঁশের লাঠির সঙ্গে বাঁধা ঝাড়ু উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে মহিলার দিকে বাঘটা আগাতে সাহস পায়নি হয়তো! এর কিছুক্ষণের মধ্যে একটা খোলা মিনিট্রাক এভিনিউ ক্রস করছিল আর তখনই বাঘটা লাফ দিয়ে ট্রাকে উঠে হারিয়ে যায়! এই ঘটনা পরের দিন পত্রিকার পাতায়, ‘নগরীতে বাঘের আতঙ্ক’ শিরোনাম দেখা যায়। পত্রিকার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি নগরীতে বাঘের আতঙ্ক বিরাজ করছে। ক্রমশ সেই আতঙ্ক প্রবল হচ্ছে। যে কারণে সন্ধ্যা নামার পর থেকে শহরের রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আমরা আরও জানতে পারি, নৈশ প্রহরীরা ডিউটি দিতে রাজি হচ্ছে না। জীবন বাঁচাতে তারা চাকুরি ছেড়ে দিচ্ছে। বাজারে বেড়েছে ধারালো অস্ত্র এবং লাঠির বিক্রি! আত্মরক্ষার জন্য সাধারণ মানুষেরা এগুলো কিনে রাখছে। এইসব সংবাদ দেখার পর আমাদের চিন্তার জগতে বাঘ ঢুকে পড়ে। আমরাও উৎসুক হয়ে পড়ি ব্যাপারটা নিয়ে। আর পত্রিকায় নিউজ হবার দিন সন্ধ্যা থেকে সত্যি সত্যি শহর ফাঁকা হয়ে যায়। যাদের ঘরের জানালার কাচ কিংবা গ্রিলের শিক ভাঙা ছিল তারা দিনের বেলাতেই মিস্ত্রী ডেকে সারাই করে ফেলে। আমরা শুধু একটা ব্যাপারে স্পষ্ট হই যে, বাঘ শুধুমাত্র রাতের বেলাতেই আক্রমণ করছে! সূর্যের আলোর সঙ্গে সম্ভবত তার বিরোধ আছে। কিন্তু যেই ক’জন মানুষ বাঘের হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে তাদের সঙ্গে দেখা করার এক অদম্য কৌতূহল আমাদের ভেতর টগবগ করতে থাকে কিন্তু অজানা নিরাপত্তার খাতিরে তাদের পরিচয় আড়াল করে রাখা হয়েছে। ফলে আমরা খুঁজতে থাকি বাঘ কিংবা বাঘের ছায়া দর্শনের সুযোগ। আমরা বাঘ বিষয়ক বিবিধ তথ্য ঘাটতে থাকি। লাইব্রেরি থেকে বাঘ বিষয়ক বই কিংবা গুগোলে সার্চ করে বাঘ বিষয়ক তাবৎ তথ্য নামাতে থাকি। ফলে এর মধ্যে কেটে যায় দুটো তিনটে নিরাপদ দিন। কিন্তু এরপরের দিনে আমরা জানতে পাই যে, গতরাতে টহল পুলিশের একটা গাড়ির সামনে এসে বাঘ দাঁড়ায় এবং মুখোমুখি হয়ে যাওয়ায় ড্রাইভার আচমকা বাঘটিকে পাশকাটিয়ে গাড়ি টান দিতেই বাঘ গাড়ির পিছু নেয় এবং একটা সময় গাড়ির পেছনে বাঘ কিংবা বাঘের পেছনে গাড়ি ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে একটা খাদে গিয়ে টহল পুলিশের গাড়িটি উল্টে পড়ে একজন নিহত সহ গুরুতর আহত হয় কয়েকজন পুলিশ সদস্য। ফলে পরের দিন প্রশাসন পুরোপুরি শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের রাস্তা নেয়। নগরপিতা ঘোষণা করেন এক বিরাট পুরস্কারের। যে ব্যক্তি বাঘটাকে শিকার করতে পারবেন তাকে দেয়া হবে সেই বিরাট পুরস্কার। আর জীবিত ধরতে পারলে পুরস্কারের মাত্রা দ্বিগুণ! ফলে আমাদের শহর ছাড়াও দেশের সকল চিড়িয়াখানার কিউরেটরদের মাধ্যমে জানা যায় সকল চিড়িয়াখানায় বাঘের সংখ্যা ঠিকঠাক আছে অর্থাৎ কোনো চিড়িয়াখানার গ্রিল ভেঙে বাঘ পালায়নি। বনবিভাগ এবং ফায়ারসার্ভিসের দলগুলো ফাঁদ পাততে থাকে বাঘটাকে আটকাবার। এইসব দৃশ্যের সঙ্গে যুক্ত হয় শহরে সান্ধ্য আইন জারির আচমকা ফরমান। জনগণের নিরাপত্তার জন্যই জনগণকে ঘরে ঢুকে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়! শুধুমাত্র শিকারি এবং বন্দুকধারীরাই রাতে রাস্তায় থাকতে পারবে। শহরের সীমানায় বিশেষ পুলিশ চৌকি বসানো হয় যেন বাঘ অন্য শহরে পাচার হয়ে না যেতে পারে কিংবা অন্য শহরগুলো অধিক সচেতন হয় তাদের সীমানায় এই বাঘকে ঢুকতে না দেওয়ার ব্যাপারে। আমাদের দলটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাঘটাকে ধরবার কিংবা মারবার! আমরা একদল বেকার ছেলেমেয়ে যারা চাকরি খুঁজছি হন্যে হয়ে বেকার জনগোষ্ঠীর এই বিরাট বাজারে। যদি বাঘটাকে মেরে ফেলা যায় তবে পুরস্কারের টাকায় আমাদের একটা সস্তা নিরাপদ জীবনযাপনের হিল্লে হয়ে যাবে। আমাদের জন্য ঝুঁকিটা বেশি। কারণ শহরে জারি করা সান্ধ্য আইনের মধ্যে নিজেদের প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাই আমার সবাই কালো পোশাক পরে বেরিয়েছি। যাতে অন্ধকারে মিশে থাকা যায়। যেহেতু মোড়ে মোড়ে নিরাপত্তাবাহিনীর লোকেরা সার্চ লাইট নিয়ে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে– ঘুরে বেড়াচ্ছে বাঘের সন্ধানে। ফলে তাদের মুখোমুখি হয়ে গেলে তারা হয়তো বাঘাতংকে বা বাঘ ভেবেই আমাদেরকে গুলি করে ফেলতে পারে। তাই আমরা খুব শান্ত গেরিলার মতোই ছায়া হয়ে নগরের অলিগলি চষে বেড়াচ্ছি বাঘটার খোঁজে। আমাদের সঙ্গে কয়েকটা দেশীয় অস্ত্র, মাছা ধরার জাল, দড়ি আর ছোরা আছে। বাঘটাকে আমারা খুঁজছি আবার নিরাপত্তাকর্মীরাও খুঁজছে, ফলে আমাদের দুইদলের মধ্যে বাঘ। আমাদের দলের রসিক একজন বলে বসল, বাঘটা কি বোবা একবার হুংকারও দেয় না? আমারা সবাই সম্মত হই, তাইতো! কিন্তু শহরের জীবনযাপনে এই বাঘজ্বর তুমুল ভাবে সেঁটে যায়। জনগণ রোজকার রুটিন বাঘের আতঙ্কের সমান্তরালে বেঁধে ফেলে। বিকেলের মধ্যেই জনগণ বাজার-সদাই, ঘোরাফেরা সেরে ফেলে। অফিস থেকে সরাসরি ঘরেই ঢুকে পড়ে লোকজন। বাইরে বিশেষ করে সন্ধ্যায় আড্ডা দেওয়ার দিন শেষ বলেই তারা মেনে নেয়। ‘বেঁচে থাকাটাই আসল’ এইরকম একটা বাক্যকে বুকে নিয়ে আমাদের মধ্যবিত্ত শহরের লোকেরা বেঁচে থাকে চারদেয়ালের মাঝে। এরই ফাঁকে ফাঁকে জনগণ খবর পায় সংবাদপত্রের মাধ্যমে বাঘ শহরে কোন প্রান্তে কাকে কোথায় কিভাবে টেনে নিয়ে গেছে। আমরা খুঁজতে খুঁজতে বুঝতে পারি বাঘটার ক্ষুধা ভয়ানক বেশি! কিন্তু আমরা আরও আবিষ্কার করি শহরে ক্রমশ আমাদের মতো আরও কয়েকটা দলের লোকেরা আমাদের মতো ছায়ামানুষের জীবনযাপন শুরু করেছে। তারাও নিরাপত্তাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে চলাফেরা করছে! তারা অবশ্য বাঘ শিকারের জন্য বের হয়নি। আমাদের চিন্তার ঘরে অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে! আমাদের সেই রসিক বন্ধুটি আরেকদিন বলে বসে, আচ্ছা বাঘটার রঙটা কী? ডোরাকাটা বাঘ নাকি কালো বাঘ? আমাদের করোটির ভেতর আবার জিজ্ঞাসা চিহ্ন দাঁড়ায়! কিন্তু বাঘের সন্ধান থামে না, কিংবা আমাদের পক্ষে থামানো সম্ভব না। কারণ আমাদের বেকারত্ব থেকে মুক্তির একটা উপায় হতে পারে এই বাঘ শিকার! কিন্তু ক্রমশ আমাদের দলের মধ্যে হতাশা নেমে আসে। আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা কমে আসতে থাকে কিংবা হয়তো তারাও বাঘের আতঙ্কজ্বরে জড়িয়ে পড়ে।
আচ্ছা এটা কি সত্যিই বাঘ নাকি বহুরূপী কেউ বাঘ সেজে এই অস্থির সময়ের মধ্যে আতঙ্ক ঢেলে দিয়ে গেছে? ফলে আমাদের চিন্তার ঘরে অন্ধকার আরও গাড় হয়ে আসে এবং আমারা বহুরূপী খুঁজতে থাকি। আমাদের সময়ে এসে বহুরূপীরা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাদের গল্পই কেবল আমরা শুনেছি। তবে হাতড়াতে হাতড়াতে আমার এক বহুরূপীর সন্ধান পেয়ে যাই।
আমাদের সেই রসিক বন্ধুটি আবার একদিন বলে, আচ্ছা এটা কি সত্যিই বাঘ নাকি বহুরূপী কেউ বাঘ সেজে এই অস্থির সময়ের মধ্যে আতঙ্ক ঢেলে দিয়ে গেছে? ফলে আমাদের চিন্তার ঘরে অন্ধকার আরও গাড় হয়ে আসে এবং আমারা বহুরূপী খুঁজতে থাকি। আমাদের সময়ে এসে বহুরূপীরা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাদের গল্পই কেবল আমরা শুনেছি। তবে হাতড়াতে হাতড়াতে আমার এক বহুরূপীর সন্ধান পেয়ে যাই। আমরা দিনের বেলায় একদিন তার বাড়ি গিয়ে দেখি, শহরের এক পুরাতন স্যাঁতস্যাঁতে এলাকায় এক ভাঙাচোরা বাড়ির মধ্যে একটা কক্ষে এক মুমূর্ষু বৃদ্ধ বিছানার সঙ্গে মিশে আছেন। তার ঘরের চারিদিকে বিচিত্র মুখোশ। বিচিত্র ধুলো জমা পোশাক দেয়ালে ঝুলছে। একটা বড়ো ট্রাংক, যার মধ্যে সাজের নানান জিনিস। আমাদের একজন জিজ্ঞেস করেন তাকে, বাঘের মুখোশ কোথায়? বৃদ্ধ কোনো উত্তর দেয় না। তবে আমরা বুঝতে পারি, বাঘ এখন বাজারে নেমে গিয়ে প্লাস্টিক হয়ে গেছে! ফলে এরপরের দিন গুলোতে আমাদের দলের সকলেই একে একে বিদায় নিয়েছে। আমি এখনো খুঁজে যাচ্ছি। এই ভীত জনবহুল শহরে একটা বাঘের দর্শন পাওয়ার জন্যে আমি হন্যে হয়ে ছায়ার মধ্যে থেকে ছায়ায় মিশে যাচ্ছি। সেই ক্ষুধার্ত বাঘের একটা হুঙ্কার কিংবা তার ডোরাকাটা বা কালো লেজের দর্শন আমাকে পেতেই হবে! এবং পুরস্কারটা আমাকে জিততেই হবে, কারণ বাঘের গন্ধ আমি পেয়ে গেছি!