ফিফার অফিসিয়াল পেইজের এক টুইটের মাধ্যমে আর্জেন্টিনার ফুটবলের প্রতি বাঙালিদের প্রেমের খবর এখন সারা পৃথিবী জানে। এই খবরে গোটা আর্জেন্টিনাবাসী বেশ অভিভূত! তাঁরা তাঁদের লেখায় এবং সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশ যদি কোনোদিন বিশ্বকাপে খেলে তবে গোটা আর্জেন্টিনাবাসী বাংলাদেশকে সমর্থন জানাবে।
আর্জেন্টিনার ফুটবলের প্রতি বাঙালির প্রেম শুরু হয়েছিল ম্যারাডোনা নামের অমিত প্রতিভাধর মানুষটির পায়ের জাদুর কল্যাণে। এর যাত্রা ১৯৮৬ সাল থেকে। অনেকেই যেটা জানেন না, তা হচ্ছে, আর্জেন্টাইন এবং বাঙালির প্রেম তারও অনেক আগেকার কথা। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এর সূচনা। এবং এটা শুরু হয়েছিল এক বাঙালির প্রতি এক আর্জেন্টাইনের প্রেম দিয়ে।
নোবেল পুরস্কারের মাধ্যমে গীতাঞ্জলি যখন সারা পৃথিবীর বিদগ্ধ মানুষকে তার অস্তিত্বের জানান দিল, তখন অন্যান্য দেশের মতো ল্যাটিন আমেরিকার ছোট্ট দেশ আর্জেন্টিনারও অনেক মানুষকে তা অভিভূত করেছিল। সে সময় আর্জেন্টাইন লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো তাঁর দাম্পত্য জীবন নিয়ে ভীষণ অবসাদে ভুগছিলেন। তখন একদিন তাঁর হাতে আসে আদ্রে জিঁদের করা গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ। এই বই, সেসময় তাঁকে তাঁর সবরকম মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি দেয়। এক দারুণ প্রশান্তি অনুভব করেন তিনি এটি পড়ে। সেই থেকে রবীন্দ্রনাথ নামক মানুষটির প্রতি তাঁর মুগ্ধতার শুরু!
১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ পেরুর উদ্দেশ্যে যাত্রার পথে মাঝখানে অসুস্থ হয়ে আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সের একটি হোটেলে ওঠেন। খবর পেয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো সেই হোটেলে যান কবিকে দেখতে। সে সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স তেষট্টি বছর, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বয়স চৌত্রিশ। ঊনত্রিশ বছরের ব্যবধান! তবু রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখার যে বর্ণনা দিয়েছিলেন তাঁর বইয়ে, সেখানে বয়সের ব্যবধানকে ছাপিয়ে প্রেমিকার দৃষ্টিটাই প্রকট হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ জেনে একপ্রকার জোর করে সেদিনই হোটেল থেকে ছাড়িয়ে নিজের টাকায় ভাড়া করা এক বাড়িতে নিয়ে তুললেন কবিকে। নিজের রাঁধুনিকে নিয়ে এলেন সেই বাড়িতে যাতে কবির খাওয়া-দাওয়ায় কোনো অসুবিধা না হয়। এরপর প্রতিদিন আসতে থাকলেন সেই বাড়িতে কবিকে সঙ্গ দিতে। রবীন্দ্রনাথও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গ পেয়ে দারুণ পুলক বোধ করলেন। ওকাম্পোকে কেন্দ্র করে একের পর এক কবিতা লিখতে থাকলেন। ওকাম্পোর একটা বাংলা নামও দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ— বিজয়া! আর্জেন্টিনায় রবীন্দ্রনাথের থাকার কথা ছিল সাতদিন, কিন্তু বিজয়ার কল্যাণে সেটা দুইমাসে গিয়ে ঠেকল। দেশে ফিরে রবীন্দ্রনাথ ‘পূরবী’ নামে একটি বই করলেন। সেটা উৎসর্গ করলেন তাঁর বিজয়াকে, মানে ওকাম্পোকে।
রবীন্দ্রনাথও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গ পেয়ে দারুণ পুলক বোধ করলেন। ওকাম্পোকে কেন্দ্র করে একের পর এক কবিতা লিখতে থাকলেন। ওকাম্পোর একটা বাংলা নামও দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ— বিজয়া! আর্জেন্টিনায় রবীন্দ্রনাথের থাকার কথা ছিল সাতদিন, কিন্তু বিজয়ার কল্যাণে সেটা দুইমাসে গিয়ে ঠেকল। দেশে ফিরে রবীন্দ্রনাথ ‘পূরবী’ নামে একটি বই করলেন। সেটা উৎসর্গ করলেন তাঁর বিজয়াকে, মানে ওকাম্পোকে।
রবীন্দ্রনাথের প্রতি ওকাম্পোর টান এতোটাই গভীর ছিল যে, রবীন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার ত্রিশ বছর পরে স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল, তখন সতেরো হাজার মাইল দূরের আর্জেন্টিনা থেকে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে তাঁর দেশের সরকারের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এটি জেনে যে, যারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে তাঁরা তাঁর প্রিয় রবীন্দ্রনাথের ভাষা বাংলায় কথা বলে! কী দুর্দান্ত, তাই না? তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করে। তাই বলি, আর্জেন্টিনা নিয়ে বাঙালিদের এখনকার এই উন্মাদনা ফুটবলকে কেন্দ্র করে ছিয়াশি থেকে শুরু হলেও এর ইতিহাস আরও অনেক গভীরে। কে জানে, আমরা হয়তো আর্জেন্টাইন এবং বাঙালির এই দুই মহান লেখকের প্রেমকেই বয়ে চলেছি অবচেতনে! যা কিনা ফুটবলের মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়েছে। এবং এটাও নিশ্চয়ই করে বলতে পারি, সুসময় কিংবা দুঃসময় কোনো অবস্থাতেই আর্জেন্টাইনের সঙ্গে বাঙালির এই প্রেম কখনও ফুরাবার নয়…
জন্ম বলরামপুর, শাল্লা, সুনামগঞ্জ। প্রকাশিত কবিতার বই একটি। ‘কেবল একটি কবিতা’ (২০২১)।