শুক্রবার, ফেব্রুয়ারি ২১

বিজয় আহমেদ-এর কবিতার পাণ্ডুলিপি : তিন আসমানের কিসসা

0

মূল কাহিনি

যমুনাবিধৌত টাঙ্গাইলের কালিহাতী/ভূঞাপুর ঘেঁষে এক ইউনিয়ন গোহালিয়া। গ্রামের নামও তা-ই। গ্রামের উঠোন ঘেঁষে যমুনার স্রোত বয়ে চলে। ফি বছর ভাঙে, আবার গড়ে। এখানেই ধনুকের মতো বেঁকে গিয়ে ধলেশ্বরী নদীর জন্ম।

এই গ্রামের যুবক শাহজাহান। ছয় ভাইয়ের ছোটোজন সে। চলনসই চাষি পরিবার। এক জোছনাধোয়া রাতে যখন ফসলের খেতের গজিয়েছে ডানা, তখন কী যে হয় শাহজাহানের, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সে এক অবাক বিস্ময়ের মুখোমুখি হয়। দেখে এক পরি। রূপকথা না হলেও এমনটা ঘটে শাহজাহানের চোখের সামনেই। সে বিচলিত হয়, বিমূঢ় হয়। এক চূড়ান্ত অজানা ঘটনা ঘটার পরিপ্রেক্ষিতে সে আসলে ঘোরগ্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রথমে অবাক ঘটনার ঘাতে সে অনুসন্ধিৎসু হয়, পরে তা রূপ নেয় মোহে। মোহ থেকে এক সুন্দর সর্বনাশের দিকে আগাতে থাকে শাহজাহান।

মোহও প্রেমে রূপ নেয়, বিস্মিত করে তোলে আকুল মত্ত কাউকে, কখনো কখনো। যেমনটা ঘটতে দেখা যায় নিয়তিতাড়িত শাহজাহানের ভাগ্যে। সে আগে-পিছে ভাবে না। ভাবার সুযোগও যেন থাকে না তার। ফলে সে অমোঘ অলক্ষ্যের দিকে যায়। পরির তালাশে তার দিন যায় রাত যায়। পাগলপারা এক যমুনার সহোদর যেন সে যুবা। একদিন সে পরির দেখা পায় দ্বিতীয়বারের মতো ঠিকই, কিন্তু তারপর গোহালিয়া গ্রাম, এই সুফলা টাঙ্গাইল বা এই পৃথিবীর কেউ আর পায় না তারে। উধাও হয়ে যায় মুহূর্তের বজ্রপাতের মতো। আর দেখতে পাই পরির তালাশমত্ত এক যুবক, অকল্পনীয় এক রূপকথার পরিণতি বরণ করে নেয়। স্মরণ করতে পারি, একইভাবে উধাও হয়েছিল তার পোষা চৌদ্দটি হাঁস। গোহালিয়া গ্রামের জনতা, তার বাকি পাঁচ ভাই—সবাই এই ঘটনার পিছু ছোটে। খোঁজ করে শাহজাহানের। পূর্ব-পশ্চিম, পাতাল কি নক্ষত্রম-লে চলে সেই অভিযান। আর ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, এই শাহজাহানের খোঁজে গিয়ে নিখোঁজ হয় আরেক ভাই।

তারপর গ্রামের লোকজন ভাবে এর প্রতিশোধ নিতে হবে। তারা আকাশে-বাতাসে জোছনায় পরি খুঁজে ফেরে। বাতাসে বল্লম ছুড়ে মারে। কিন্তু কোথাও পরিকে তারা পায় না।

এবার গ্রামের লোকজন নিজেদের অভিশপ্ত ভাবা শুরু করে। কালা হাজি সাহেব তাদের তওবা করতে বলেন। যদিও একের পর অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে গ্রামে, যা আগে কেউ দেখেনি। এমনকি ভাবেওনি।

 

বিবিধ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি

শাহজাহান: লস্কর বংশের মানুষ। কৃষি ও পশুপালন তার পেশা। বলিষ্ঠ পুরুষ। ২৫-৩০ বছর বয়স। অবিবাহিত। ছয় ভাইয়ের সবার ছোটোজন সে। অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। নদীতে বড়ো ফাঁসের জাল দিয়ে বাগাড়ের পিছু ছোটার অভ্যাসও আছে এই যুবকের।

পরি: ধারণা করা যায়, দূরে কোথাও তিন আসমান শেষে ফাঁকা কোনো অলৌকিক ও অজানা স্পেসে পরিদের এক দেশ আছে। পরি সেই না-জানা জগতের তরুণী। গল্পটা পরিকে কেন্দ্র করে বিবৃত হলেও তাকে কেউ দেখেছে কি না—এই কাহিনিকাব্যের লেখকের জানা নেই।

গ্রাম গোহালিয়া: যমুনাপাড়ের এক গ্রাম, যমুনা সেতু নির্মাণ শেষে যে গ্রামের লোকজনের ভাগ্য উন্নত হয়েছে। ইউনিয়নের নামে নাম। গ্রামের অর্ধেক কালিহাতী উপজেলা ও বাকি অর্ধেক ভূঞাপুরে পড়েছে। দুটি উপজেলাই টাঙ্গাইলের অন্তর্গত। এই গ্রামের সম্মুখভাগ দিয়ে গেছে যমুনা। অন্য পাশ দিয়ে গেছে ধলেশ্বরী। ওই গ্রামেই ধলেশ্বরী নদীর জন্ম। এই গ্রামে যেমন চর আছে, তেমন আছে ধান ফলানো উর্বর জমিও।

কাজল খাঁ: পশুপালন তার পেশা। সারা বছর যমুনার চরে সে তার বিশাল পশুর পাল সামলায়। আর বর্ষায় চর ডুবো ডুবো হলে পশুসহ সে ফিরে আসে টানে।

আজহার: এক গায়ক কৃষক, বুকে যার গানের বাজনা আর হাতে থাকে কাস্তের ধার।

আলাউদ্দিন: গ্রাম গোহালিয়ার আরেক কৃষক, যার ছেলে ছোটোবেলায় পালিয়ে ১০ বছর পর বাড়ি ফিরেছিল।

মাস্টারের মেয়ে: গ্রামের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত মাস্টার পরিবারের মেয়ে। শিক্ষাদীক্ষায় তারা অগ্রগামী। মাস্টারের মেয়ে অতি সুন্দর যেকোনো তরুণীর সৌন্দর্যের তুলনায়, যে কারণে তার নাম আসে প্রথমে।

সালাম: আরেক কৃষক, নদীতে গোসল করতে গিয়ে যার ছেলে পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল।

রহিমুদ্দি ভাই: পেশায় জেলে। বড়ো ফাঁসের জাল দিয়ে যে যমুনা নদীর এখানে-ওখানে, বেলকুচি থেকে সিরাজগঞ্জ সদর কি আরো উজানে ছুটে যায়। মাঝেসাঝে শাহজাহান তার সঙ্গী হয়।

খাজা ইউনুস: গ্রামের ওই পাড়েই অবস্থিত পীর খাজা ইউনুসের মাজার। যদিও নদীর ওই পাড় মানেই সিরাজগঞ্জ। হ্যাঁ, খাজা ইউনুসের মাজার পড়েছে সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে। কিন্তু গ্রাম গোহালিয়া থেকে যদি একদম পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে নৌকা বেয়ে যাওয়া যায়, কতক্ষণ আর লাগবে, মেরেকেটে ২০ মিনিট।

উত্তরের নলছিয়া: ভূঞাপুর থানাধীন এক চর। প্রতি বর্ষা শেষে জেগে ওঠে। যমুনা সেতুর উত্তরে কিলোখানেকের মধ্যেই অবস্থিত। এখন যেখানে ক্যান্টনমেন্ট, তার উল্টো দিকে নদীর পেটের এক চর।

 

প্রথম অধ্যায়: লস্করবাড়ির শাহজাহান ও তৎসম্পর্কিত জনপদের ইতিবৃত্ত

(এই বয়ান লস্করবাড়ির শাহজাহানের মুখে বিবৃত হইতে থাকে আশপাশের পশু, প্রাণপ্রকৃতি ও জনপদ-সহযোগে। কখনো মনে হইবে লৌকিক এবং কখনো মনে হইবে ঢাহা অলৌকিকতার বিবরণী।

জন্ম আর মৃত্যু যেহেতু সেকেন্ডেরও কম দূরত্বে বসবাস করিতে থাকে, সেহেতু এমন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। বাস্তব আর অবাস্তব এখানে মিলিয়ামিশিয়া জড়াজড়ি করিয়া থাকে। ফলে দৃশ্যত শাহজাহানকে দুই পা, দুই চোখ আর দুই হাতওয়ালা স্বাভাবিক মানুষ বলিয়া মনে হইলেও প্রকৃতপক্ষে এই জনপদের পুরুষের বলিষ্ঠ ডানার ওড়াল থাকে, পায়ের নিচে থাকে সর্বংসহা মাতৃরূপী মাতার সুকঠিন তাকত আর তামাটে ত্বকের আড়ালে থাকে কঠিন এক বর্ম, যাহার মাধ্যমে তাহারা পুরুষ হইয়া উঠিতে থাকে। অথবা মরিয়া যাইতে থাকে। ইত্যবসরে আমরা মুখোমুখি হইতে থাকি এক সোনাফলা আখ্যানের।)

 

এক

নদী পানি ঝিলিমিলি মাছ করে চকমক চকমক
সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফেরে রাখালের পশু পক্ষী বক।

নদীর বাতাস এলোমেলো করে সদায় আনচান
তিল কাউনের পরে ধান বুনি আমি শাহজাহান।

ঝড় আসে বান আসে শোনো গরু মহিষের ডাক
ডরভয় নাই দিছে রে সাহস বুকে আল্লাপাক।

ছয় ভাই, বাবা নাই মা-ও নাই, এতিম জীবন
বালির ফোটাই শস্য-ফুল আসে যদিও মরণ।

যমুনার কূল ভাঙে কূল গড়ে ফি বছর জানি
চেনা বাস্তুসাপ হঠাৎ হারায় ফণাতোলা স্রোতে
স্বপ্ন নয় যেন অন্য কিছু থাকে নির্ধারিত
চাঁদ ভেঙে ভেঙে সুতা বুনে চলে অনাত্মীয় তুঁতে।

বসতের শোক নাই আছে শুধু অসম লড়াই
জলের মিনার বলে, ‘শাহজাহান, কোরো না বড়াই’

ধনুকের মতো নদী জড়িয়েছে গ্রাম গোহালিয়া
কত না জমিন ফসল বাতাস নিয়েছে গিলিয়া।

টিয়া ওড়ে টিয়া মরে আচানক নদী খায় মাটি
ফুরায় চোখের পানি বাষ্পরূপে আসমানে আসমানে
মমতার দেখা কে পেয়েছে কবে এই দুজাহানে
অতৃপ্তি তাহার মিটিবে কোথায় গহিন কোনখানে।

পৈতৃক সূত্রের ভিটে চিরকাল যমুনার ধার
নিরালায় কেন এত ক্ষুধা আর অতৃপ্তি তাহার?
দূর গঞ্জ খেত বোয়াল-পিয়ালি বাতাসের দোল
রহম মাগিয়ো নেচেগেয়ে কেঁদে নিকটে খোদার।
জানি আল্লা ছাড়া কে-বা নেবে এই দুজাহানে আর
নদীভাঙা মানুষের শস্যের প্রাণের দেহভার।

 

দুই

মাঝে মাঝে চাঁদ পায় নীল স্তনে গ্রাম গোহালিয়া
চাঁদের গহন আলো ঝাকানাকা খই ফুটে ঝরে
দেখি ডানা মেলে পক্ষী নক্ষত্রের দল শত প্রাণ
তারা যূথবদ্ধ অযুত নিযুত সপ্রতিভ ওড়ে।

তারা কোটি ডানা তারা তুলো ঘুম হাসি শর্ষে ছিঁড়ে
ধীরে ধীরে যায় বনে তরমুজের, বিল শাপলা জলে;
সে রাত বেদম বুনো চন্দ্রাহত আরো ঘোরলাগা
আর গ্রাম গোহালিয়া পিঠে চেপে বসে জিনেদের।
আমি শাহজাহান বুকে রক্তজবা কাঁধে সূর্য ধরি
দেখি জনপদ ছেড়ে উড়ে যায় ফেরেশতার দল
পশ্চিমের সমতলে, উত্তর-দক্ষিণ পাশ কেটে
কিছুটা পুবের দিকে বেঁকে গিয়ে দ্রুত মধ্যযামে।
জানি এই ওড়ালের কোনো নাম-জন্ম-চিহ্ন নেই
এ কাফেলা বলো সুবেহ সাদিকে কোথায় লুকায়।

আজানের শব্দে প্রলম্বিত চাঁদ গুঁজে নেয় ডানা
ঢেউ ওঠে ফোঁস ফোঁস নদীর গহিন গর্ভ থেকে
দূরে দলপতি বৃদ্ধ বাগাড়ের সুউচ্চ মিনার
কিছু ঘূর্ণি তবু স্মৃতিকথারূপে জেগে থাকে।
ভাবি শতবর্ষী এই প্রবীণ বাগাড় আমাদের
রচিবে সুরক্ষা, তার সুগভীর গর্ভে, দীর্ঘ পিঠে

উত্তর-দক্ষিণে দেখো চিরকাল যমুনার পাড়ি
ধলেশ্বরীর হঠাৎ জন্ম এই গ্রাম শেষে এসে;
মাতৃকোলে যেন কন্যা আছে নীল ফুল হয়ে ফোটে
দুর্ধর্ষ নারীর গর্ভদেশ রক্ত স্তন ভালোবেসে।

উৎসমুখে খরস্রোতা তীব্র খাড়া ধনুকের পেট
পেটের অতলে বস্তি বংশধারা আত্মীয়জনের
আসমান-জমিনে রচিত বেহেশত দোজখ সাজানো
খোদা শোনো গান জিন ও ইনসান, পক্ষী ও প্রাণের।
এপার-ওপার অজানা ভীষণ আন্দাজে না মেলে
সংগীতের সুর বেঁধে গর্ভে শুয়ে আছে অজগর
দীর্ঘ ঘুম শেষে ক্ষুধা পেলে তার গিলে খায়, আহা
নিমেষেই শস্যফলা খেত, চাঁদ, মানুষ ও ঘর।

মানুষের ঘ্রাণ সোনাফলা চর হেমন্তের দিন
বংশস্মৃতি, অদৃশ্যের যত টগবগানো কালা ঘোড়া
প্রাচীন বাগাড় আর মুখে মুখে থাকা কাহিনিরা
জনপদ জ্বরে ভোগে গাঁথার প্রলাপে বেরহম
রূপকথা জাগে স্বর্ণের প্রলেপসহ সেই ফাঁকে।
রহিমা বিবির মৃত কুমড়া ফুল থেকে ঝরা মধু
সূর্যাস্তের মাছি আরো কিছু বলো যতটুকু জানো
যতটুকু জানো আঁটকুড়ের কথা যথা সিরাজালী
বলি মাতুব্বর সিরাজালী যার পুত্র-কন্যা নাই
যার কান্নাজলে পুষ্প ভাসে যমুনার পূর্ণিমায়
যার খেদ মান-অপমান যেন চাকা ঘুরে ঘুরে
পিষে দিয়ে যায় গলা কেটে মরে, আহা, সিরাজালী
কেন কোনো মায়া নেই খোদার তোমার প্রতি, জানো?

লাগে না কেরদানি কোনো দিলের রহম যদি থাকে
ভাবো হালিমের কথা অঙ্গুলি হেলনে যার ভাসে
পীরের বসতি, দূরদিগন্তের কেশরের দিকে;
অজানা পক্ষীও ভাসে দলে দলে কাঁধে কাঁধ বেঁধে
হারমোনিয়ামের দিকে ভীষণ লাজুক সুর তুলে
ঘাড় উঁচু করে বিহঙ্গের, বলে, জীবিতের দিকে
অনির্দিষ্ট যাত্রা হবে অনির্ণেয় নীলাভ কুসুম।

 

তিন

তামাটে ত্বকের দেহে সূর্য ধরি ঘাড়েতে তুফান
খলবল নদীর গুপ্তগর্ভে থাকি আমি শাহজাহান
কাজলকালোর পুষ্প পুষি আর রাত্রে ধরি চাঁদ
গহন বুকের বাঁকা হাড়ে বোনা আড়াআড়ি ফাঁদ।

খামোকা দুপুরে কন্যা তুমি এক জেনেছি দোয়েল
ভাঙা ডানা কাঁদে যত বোবাস্বরে নীল জন্মদাগে
কচুরিপানার মৃদু স্পর্শ যেন চেতনার হীরা
স্মৃতিচিহ্ন ধরে ঋতু ফোটে ওঠে গহন শ্রাবণে।
নৌকা টেনে যাই ক্রমে যমুনার দিকে সূর্যোদয়ে।
ভাঙা ডানা কাঁদে যত বোবাস্বরে নীল জন্মদাগে।

প্রতিবেশী বিল কবরের পাশে সুহাস্য সন্ত্রাসে
পালোয়ান জনপদ কী করে জেগেছে নদীপাড়ে
মধ্যযামে পিটপিট চোখ খোলে বাদামের বীজ
প্যাঁচাদের ডাক পারে রাত্রিদের স্তন খোলে
সুনিপুণ তারা, জাগো নিমন্ত্রণে শরীরী মজলিশ।

নিম্ন থেকে ক্রমে আরো কোনো নম্র নিম্নভূমি, শস্য
জলাভূমি, মৃত জল ছেড়ে যদি যাও তুমি প্রাণ
নক্ষত্রের থুতু ছিটে পড়া সোনাফলা প্রান্তরের
হু হু রোদ কাদামাটি জলজ উদ্ভিদ গ্রাস করে
রাক্ষসের মতো ক্ষিপ্ত লম্বালম্বি গ্রাম পাবে এক
হয়তোবা নাড়িপোঁতা খাঁড়ির মতন বেপরোয়া…

বারোজন ধানচারার অপরূপ দোল খেলা শেষে
বুক বাঁধে খাড়া নেমে আসা সূর্যরশ্মি আর তীর
লাজুক আত্মার জোড় ময়নার পাখা উড়ে যায়
কোন সে আয়না ধরে পুরুষেরা বীর রূপ পায়।

মানুষের দেহ থেকে নির্গত সুবাস, আর্দ্র ক্ষীর
আর তিন ধরনের কুফর-কালাম অশরীরী
যেখানে আশ্রয় গড়ে জন্মায় যেখানে কলঙ্কেরা
এই জনপদ, তার শেষ থেকে শুরু…শেষ থেকে
বারোজন ধানচারার অপরূপ দোল খেলা শেষে।

 

চার

ছায়াঢাকা জনপদে আমি রোজ মরি আর বাঁচি
আত্মীয়ের মুখে দেখি প্রস্ফুটিত প্রসন্ন সকাল;
বউ কথা কও ডাকে অহোরাত্রি মাঠে-ময়দানে
সংগোপনে কুটুমের কাটা জিব কেবা রাখে মনে?

মখমল রোদের চৈত্রদিন উড়ে যায় উড়াধুরা
প্রতিটি শরীরে ধরে ছককাটা বিস্ময়ের ফল;
ঋতু কার কাছে যায় খোঁজে অমরত্ব ডানা ছেঁটে
আসমান-জমিন জানি ফেরেশতার, নীলাভ সজল।

 

পাঁচ

রাত্রিভর অলৌকিক জিনেদের পিছু
দাবড়াই। কী যে আলো ছড়ায় দেহের
থেকে জিনেদের। চোখ বুজে আসে শুধু
তীব্র বিচ্ছুরণে। তবু অন্ধের মতন
হাতড়ে হাতড়ে যাই, যেতে থাকি, অভিশপ্ত
কোনো আলিবাবা, লোভী, সম্পদের পিছে
চিরকাল। মৃত্যু যদি নিশ্চিত তবুও
ফেরার সম্ভাব্য সব পথ নিশ্চিহ্নের
পর, যা যা ঘটে। মৃত্যু, নক্ষত্রের বোন
জেনে, স্বপ্ন আর জেগে থাকার মিশ্রিত
কোনো দল্লি বিলে, এই যাত্রা তবু চলে।
পায়ে পায়ে। দেহ ঘষে যেনবা আগুন।
যেনবা কোরান পড়ে কেউ, মৃদু স্বরে
সুরের নহর ভাসে দুধেল জোছনা।
পতপত হে উড়ে যায়, পাখিরূপী জিন
আর জিনরূপী পাখি ছোড়ে অভিশাপ।
জমাট মাহফিল কাঁপে থরোথরো, আহা
গলিত চাঁদের ঋতু, বৈশাখের রাত
আহা, হাঁটুজল থিরথির মুহূর্তরা
আহা, জঙ্গলের সাদা দাঁত, ভাঙা কোনো
ভগ্নাংশ, পেশিদের অসারতা ভুলে
হাঁটুতে দেহের শক্তি সঞ্চয়ের পর
বোরাক ঘোড়ার দেহে তীব্র ডালিমের
বিস্ফোরণ শেষে, যতটুকু প্রাসঙ্গিক
রে গজার, তোর ত্বক যেন গেরিলার
পোশাক, মস্তকে যেন নির্মম বিদ্যুৎ
উছলে উথলে ওঠা দেহে দিগ্বিদিক, কাঁপে।
তোর কশেরুকা যেন অসমাপ্ত কোনো
ডাক বিপ্লবের, যায় সৈন্যরা, মৃত্যুর
পয়গাম কাঁধে। আমি শাহজাহান, আজ
সুমিষ্ট ফলের খোঁজে জনপদ ধরে
দোজখের পিছু পিছু ছুটি। সাথে থাকে
গলিত চাঁদের মুখ, জলের প্রতিভা
ডুবো শালুকের রতিক্রীড়া। ওই গ্রাম…

রাতভর রত্নের পিছু ছুটি আর মরি।
প্রতিটি ঋতুতে মরে যাই এভাবেই
প্রতিটি মৃত্যুর পর দেহ পুনরায়
মমির খামার থেকে জাগে আশ্রিতার
লাল আত্মাসহযোগে। ক্রমান্বয়ে তাই
বিপদের ড্রাম বাজে উদ্ভিদে ফসলে।

 

ছয়

উর্বর প্রান্তরজুড়ে ধানের জ্যামিতি খেলা করে
সত্তর দিনের দৃঢ় বলিষ্ঠ দেহের পালোয়ান
গুচ্ছবাঁধা পেশিসহ সুহাসিনী যেন সন্তানেরা
শীর্ষে তরুণীর খোঁপামতন রক্তিমবর্ণ ফল।

ধানশিষে ধরছে পাক হেমন্ত-মাতম যেন এই
পলকা হাওয়া এসে স্পর্শ করে আর চরাচরজুড়ে
লাল অলৌকিক ঢেউ আছড়ে পড়ে জমিনের বুকে
যেন মহাজাগতিক মাঠে আলেয়ার ফুল কাঁদে।

মাস্টারের মেয়ে তুড়ি মেরে যেইভাবে ডাকে ভোরে
মনে হয় হেঁয়ালির শুরু আছে, শেষ নাই কোনো।
দুপুরে এমন ঘটে এলোমেলো কত শব্দ-কুহু
চিল পাক মারে তব্দা খেয়ে পড়ে থাকে তীব্র রোদ
শালিখেরা ডানা খোঁটে, স্তব্ধ ইঞ্জিনের প্রপেলার
ভাষাহীন শরীরের কাছে ভিক্ষা মাগে সূর্যোদয়।

ড্রেজারের ছেলেগুলো ভাত খায়। দূর চর থেকে
কলাসহ নৌকা ভেড়ে ঘাটে। মৃদু মৌয়ালেরা ঘোরে।
বড়শির আধার গিলে ছুটে রিটা বাউশের দল
বালিভর্তি ট্রাক ছুটে দূর জেলা শহরের দিকে।
সালামের বড়ো ছেলে কাঁধে পায় ডানা অতর্কিতে
বোকা রাখালেরা সেই ডানা চড়ে যায় আরো দূরে।

নীরবে ছড়াতে থাকে কুর্চি জেলে-জাল নদীতলে
খাঁ খাঁ ধলেশ্বরী, সূর্য বল্কে বল্কে ওঠে। রাস্তা খুঁটে
ঘুঘুগুলো খায় গম-ধান। প্রান্তরের মাঠে-ঘাটে
সত্তর দিনের দেহে পুত্র-কন্যা পুরুষ্টু ঝলমলে।

ধান যেন ধান নয় ভাবো শাল তরুদের ছায়া
মাথার ওপর খাড়া সূর্য শুধু বাড়িয়েছে মায়া।
নিজ হাতে সোনা গড়ে মানুষ আজিব কারিগর
জলপাই বন, দুপুরে যেমন রহস্যবিভোর।

 

সাত

আমার তো বাবা নাই। মা-ও নাই কোনো
এতিম ধানের চারাগুলো জানেমান।
সূর্যাস্তের গর্ভে শুয়ে থাকি লম্বালম্বি।
লুপ্ত পৃথিবীর ঘ্রাণ আসে শ্বাস বুজে
আসে ধীরে। মনে হয়, মরে যাই। মরে
যাই। ঘ্রাণ অজানায়। অচেনা জগতে।
কিম্বা ডালিমের বুকে পোকার মতন
ঢুকে যাই। আর ফিরে না-আসি না-ফিরি।

স্নেহময়ী ধানগুচ্ছ কাছে এসে ঝুঁকে
বোলায় মাথায় হাত বোজে চোখ সুখে।
বলি, ‘আমার তো বাবা নাই। নাই মা-ও
পুত্র বলে আমাকেই বুকে তুলে নাও!’

মাতা বলে, ‘দুনিয়াতে সবাই এতিম
এই গাছ, মাছ, হাঁস, হাঁসেদের ডিম
এমনকি এতিম গো সূর্য গ্রহ তারা
এই গ্রাম নদী লতাপাতা আর পাড়া।’

আমি বলি, ‘বুক খুলে দেখো, লাল ক্ষত
নিমজ্জিত আত্মা চিরনামাজেই রত
সে-ও আল্লাহর কাছে মাগে পিতামাতা
যেন ঝোড়ো হাওয়ায় ওড়া ছেঁড়া পাতা।’

‘ধানমেয়ে আমি আর তুই যে মানুষ
কী করে সন্তান ডেকে কোলে নিই তোকে।
কার না ছেলেরে তুই। কোন মার বুক
হবে খালি। তোকে নিলে কী বলবে লোকে।’

মাতার আকুতি শুনে বুক যায় ফেটে
চুপ করে ধানমেয়ে, ফুঁপিয়েই কাঁদে
দুহাত বাড়ায়ে বলি, ‘আসো তো মা বুকে
মাতা-পুত্রে হয় মিল যদি, সাবলীল
পৃথিবীও উঠবে যে কেঁপে কেঁপে সুখে।’

ধানমেয়ে এইবার দেখো উজ্জ্বল খুশিতে
সন্তানের তরে দেয় স্নেহ-বুক পেতে।
সেই থেকে কী যে মধু বোশেখের রোদ
ছায়া ছায়া সব যেন পানের বরজ।

আমি শাহজাহান, শোনো মাতৃসুখ জানি
মা শব্দেই জেগে ওঠে মরুতেও পানি।

দুপুরের ঘ্রাণ ভাসে দুপুরের দিকে
পাখিগুলো নির্নিমেষ দেখে আমাকেই।

 

আট

ছয় ভাইয়ের ছোটোজন চেনে সবে
কিছু মেঘ হয় জমা আসমানের পুবে।
আমি শুধু শুয়ে থাকি লম্বালম্বি খেতে
মাতা যেন দিল পাটি শীতলের পেতে।

রোদগুলো মেঘ হয় মেঘ হয় পাখি
ভাটিয়ালি গাই আর মাতৃকোলে থাকি।

ধানচারা ভাই আর বোন ধানচারা
কাঁধে কাঁধে থাকি আর সুখে মাতে পাড়া।
মাতা ধানগাছ মিটিমিটি হাসে। দূর
থেকে এসে বাবা ধান বলে, ‘হতচ্ছাড়া
ওঠো, যাও, পড়ে আছে কত কাজ মাঠে
মাছ ধরো গিয়ে ঠেলে জেলেনৌকা ঘাটে।’

আমি তো এতিম হায় পিতার ভূমিকা
জানি না। নির্দয় বুঝি তাহারা এমন
মাতা যদি হয় নদী প্রশান্তির, বাবা
তবে বেদে বেপরোয়া, জীবিকাপ্রবণ।
মাথার ওপর চিল পাক মারে দ্রুত
প্রখর রৌদ্রও মিঠে হয়ে আসে দেখি
আগুনের কাছে গেলে সে-ও দেয় প্রেম
তার মতো করে নত হয়ে ধ্বংস শিখি।

 

নয়

নদীতেও ছলকে ছলকে ওঠে রোদ, আহা
নদী যমুনা, রে অজগর, শুয়ে থাকে
থাকে শুধু। ছোটে স্রোত। আর জেলে নৌকা
অতলে নদীর ঘাই তল্লাশি মাছের।
চর থেকে ভুট্টা মিষ্টি আলু আসে নৌকা
ভরে। থই থই হাসে মানুষ চরের
আত্মার গহিন থেকে এভাবেই উঠে
আসে কোনো আত্মা, দেহ, ফসলের রূপে।

আমি শাহজাহান শুয়ে ধানখেতে দেখি
মানুষের পুনঃপুন জন্ম অন্যান্যের
দেহে। ঝিম মেরে মেরে পালিত পশুরা
খাচ্ছে ঘাস। নিরুত্তর আর বিহ্বল
কোনো সৌরজগতের, মহাপৃথিবীর
ডানা, ডায়নামো, দৃশ্য, রমণী, ইঞ্জিন
সব যেন স্তব্ধ আর তব্দা লাগা কোনো
শিমুলতুলোর মতো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে।

আর গরুগুলো, গাভিগুলো যেন সত্য
চরাচরে। নিভৃতের ঘাসে, নিজেদের
আবিষ্কৃত ফলে, দিচ্ছে বিসর্জন একা।
কোথাও সান্ত¡না নেই। গ্রীষ্মের দুপুর
ভরা প্রায়শ্চিত্ত শুধু। কদিন পরেই
ধানগুলো সোনারঙে হবে বিচ্ছুরিত।
আজিজার গাইবে গান কাস্তে হাতে মাঠে
যত স্বর্ণরেণু, আহা, অযুত-নিযুত
গান হতে তার ঝরে পড়বে দুপুরে।
মাঠ-ঘাট-গাছ-বন-নদীর বন্দর
গ্রাম, গ্রামাঞ্চল আর কৃষক শরীর
গবাদিপশুর দল, রাখালের বাঁশি
সোনার বরনে দেখো উছলায় হাসি।
হাসি তো নয় রে যেন পিয়ালির ঝাঁক
উঠিতেছে হেসে, যেই পার হবে বাঁক।
দিন তো নয় রে যেন চিতলের পেটি
ঝাকানাকা অবিরাম মাতৃসম মাটি।
কৃষকের ঘরে নাচে মাটির পুতুলে
ধান কাটে গান গায় আজহার দোলে।

ধানের ঘটনাগুলো মৃদু। ধরো হুট
করে, বাড়ি ফেরে ছেলে আলাউদ্দিনের
দশ বছরের পরে, এই ফেরা গ্রামে
গুঞ্জন, রহস্য আর কিছু অবিশ্বাস
ছড়ায়। মৃত্যুর পরে, আরো এক বিশ্ব
গাঢ় প্রহেলিকা আছে ভেবে, রমণীর
কোলে ঘুমে ঢলে পড়ে পাড়া-প্রতিবেশী।
আর ছেলে বোঝে, কিছু ফেরা কখনোই
আকাক্সক্ষার মতো নয়। দৃশ্য, মুহূর্তের
কাছে কোনো অর্থ দাবি করে না, সূর্যাস্তে।

আর যেন সহোদর সব, ফুটে থাকে
কাঁধে কাঁধ বেঁধে, ফুল শস্য ধান পাকে…
আর ধনুকের পেটে গ্রাম গোহালিয়া
গজার মাছের তাজা স্মৃতি বুকে নিয়া
সৌর-সীমান্তের দিকে ছোটে। যদিও-বা
কেউ স্থির দুপুরের দিকে ঢিল ছোড়ে
কিন্তু কোনো গুঞ্জনের আতাফল জেগে
ওঠে না। তখন আমি শোনো ঢুকে যাই
আতাফলের শরীরে। দক্ষিণের দিকে
সে খাজা ইউনুস আছে সরব দরগায়।
জানি, উত্তরের দিকে গেলে আরো কোনো
পীর, তর্জনীর কাছে ধরে রাখে দেহ
তবু আতাফল দেয় আশ্রয় আমাকে।
জনপদ জানে, জানে রহিমুদ্দি ভাই
স্নেহের দরজা খুলে, নদীর মাছেরা
আসে। দরগাতে তাই ছোটে, নৌকাভরে
পশুদল, ধান-চাল, ভক্তি-মায়া-প্রেম।

পৃথিবী তবুও ঝুঁকে থাকে চিরকাল
ব্যাপ্ত বোশেখের দিনে, দাবদাহে পুড়ে
যেতে যেতে ধাঁধা-সোনারঙে জ্বলা কোনো
ধানশিষে। আর ক্রমে, বুকে জাগে ক্ষীর;
ক্ষীর ধরে জেগে ওঠে নির্জনের ফানা
নত হয় জিন পক্ষী, ডানা প্রকৃতির
আত্মা ইঞ্জিনের, মুখ, মানুষের। প্রেমে
রমণীর দেহ, ঘূর্ণি তুমুল তুফান।
ঝোড়ো হাওয়া ধরে ধীরে জাগে নানা সোনা
প্রান্তরের পর নীল আসমানে আলপনা।

 

দশ

ওই যে কাজল খাঁর গরুগুলো, একা
ঘাসের ঘটনা নিচ্ছে জেনে। কাজলের
দুনিয়াও বাঁধা পড়ে যাচ্ছে এভাবেই
ঘাসে, পশুদের দলে। বিদ্রুপের মতো
যদিও, বাঘডাশা কিছু ঘুরেফিরে পাশে
বাথানের পায়ে পায়ে, কাজলের ঋতু
সৌরজগতের ঘাসে মুখ রাখে মৃদু
হেমন্তের দিনে স্মৃতি জেগে ওঠে ধু ধু।

ভাবি মাতৃযান এই কাজলের দেহ
উড়ে যেতে যেতে নীল রশ্মিদলে, কিছু
শের লিখে রাখে তবু মধু গুঞ্জনের
গোবরে পশুতে ওড়ে দেহ কাজলের।

খররোদে পাকে ধান। ভেজে দেহ ঘামে
পবিত্র বেহেশতি নুর খেলে যায় মাঠে
রং জাগে সোনাঝরা ধান যেন কাচ
দোয়া ও দরুদ মাগে ইঁদুর ও মাছ।

 

দ্বিতীয় অধ্যায়: পরির সাথে শাহজাহানের পয়লা সাক্ষাৎ

(গ্রাম গোহালিয়াই শাহজাহানের দুনিয়া। এখানেই তার জন্ম, বসত, বেসাতি। ছয় ভাইয়ের শাহজাহান সবার ছোটো। শাহজাহানের এই দুনিয়ায়, শত শত ইলেকট্রিক বাতি, ঘরে বা বাজারের চা-স্টলে টিভির ঝনঝনানির শেষেও, প্রাগৈতিহাসিক রাত নেমে আসে আজও। যমুনাবিধৌত পল্লিতে রাতভর জোছনার ডাক বুক ধরে টানে। শিয়ালের হাঁকও শোনা যায়। এমনই এক রাতে, যখন কাজলের বাথানের পশুরা ঘুমিয়ে গেছে, তখন কী এক অজানা খেয়ালে ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসে শাহজাহান। আরেক বিস্ময়কর ঘটনার মুখোমুখি হয় সে প্রান্তরজুড়ে ঢেউখেলানো ফসলের খেতে। সেই আশ্চর্যজনক ঘটনার মোকাবিলায় শাহজাহান বিমূঢ় ও বোবা যেন…)

 

এক

রাতভর জোছনার বেপরোয়া ডাক
বুক হিম বুক হিম শিয়ালের হাঁক।
হাত ধরে কে যে ডাকে ফসলের খেতে
সেই ডাক কোনোভাবে না-পারি ফেরাতে।

ঘর ছেড়ে যাই যেন ধরে কানাওলা
চোখ বুজে কত দূরে জানি না কিছুই
হেঁটে হেঁটে ভরা খেতে চোখ মেলে দেখি
শস্যের মা’ফিল আর জোছনা ও জোনাকি।
আকাশেতে চেয়ে দেখি বিস্ময়ের নীল
কিছু কিছু তারা যেন অতিকায় চিল।
টুপ করে সেই তারা নিচে আসে নেমে
বায়ু ছুটে দিগ্বিদিক পুবে কি পশ্চিমে।
গাঢ় ঘুমে কাজলের পশু ও বাথানে
মিটিমিটি আলোপোকা নেমেছে শিথানে।

লালচে তারা মাটি ছুঁয়ে ডানা ঝাড়ে দেখি
তারা তো নয় রে সোনা অপরূপ জরি
মাথা ঘোরে ভোঁ ভোঁ, দেখি দৃশ্য পুনরায়
আকাশের তারা চড়ে বাতাসের তরি
কী করে জমিনে নেমে পরি রূপ পায়!
দুরুদুরু বুক কাঁপে একা নিরালায়।

আমি শাহজাহান এই যমুনার ছেলে
এমন ঘটনা দেখি বিস্ময়ের ছলে।
দিনের মতন আলো খেলে মধ্যিরাতে
জোছনার ক্ষীর জমে ঘাড়-মুখ-হাতে।

ভয়ে ভয়ে যত যাই পরিটার দিকে
ব্যাপ্ত এ প্রান্তর যায় আয়তনে বেড়ে
বুঝি না কপালে আজ কী লেখা রে সোনা
পেয়েছে আমাকে ভাবি জিন কানাওলা।
যমুনার ছেলে বলে ভয় নাই বুকে
যেন ঘোরগ্রস্ত যাই সোনাখনি দিকে।
যত যাই প্রভা বাড়ে বেপরোয়া খুব
অজানা কারণে ভয়ে বুক কাঁপে খুব।

দুডানা পরির যেন বিস্ফোরিত হীরা
মরে যাব হীরাস্পর্শে আল্লাহর কিরা।
থমথমায় চতুর্পাশ থতমত মাটি
নদীতলে সাড়া নেই মাছেদের ঘাঁটি।

দারুণ আসমান দেখি ভাগ হয়ে আছে
ধীরে ধীরে যেতে থাকি পরিরও কাছে।
যত যাই তত দেখি দূরত্বই বাড়ে
জানি না কেন যে যাই এ চন্দ্রাভিযানে।
চাঁদ তো নয় রে মেয়ে পরি বলে জানি
খোঁপায় বেদম জ্বলে অফুরান জবা
শরীর সুবাসে তার চতুর্পাশ টলে
শব্দহীন কেয়ামত ভাষাহীন বোবা।

জানি না এমন ঘটে কি না এ ভূভাগে
কোনো দিন মানুষের মুখে শুনি নাই আগে
সত্যি তবু হলো হায় আমারই চোখে
পরি এক ডানা খোলে ফসলের মাঠে।
রূপে রূপে ফুল ফোটে অযুত-নিযুত
চাঁদের অধিক নারী নাই কোনো খুঁত।
দূর থেকে দেখে যদি যাই আরো কাছে
বোধ হয় যাব মরে আগুনের আঁচে।
পরি এক ডানা খোলে ফসলের মাঠে।

কৃষকের ব্যাটা আমি শাহজাহান এতিম
মৃত্যু বুঝি ধেয়ে এল খোদার কসম।
এমনই ভাবি আর অপলক থাকি
তারা জ্বলে তারা নেভে অরূপ জোনাকি।
জোছনার বীজ ঝরে নীল ফোঁটা ফোঁটা
হৃদয়ে ভাঙন জাগে খুব টুটাফাটা।
এই ঘটিতেছে জেনো প্রায় ভোররাতে
জাগিছে দুনিয়া তার বেহেশতের সাথে।
যখন আজান ছোটে দূরের মিনারে
নিঝুম স্তব্ধতা ভাঙে দুনিয়ার পরে।
দেখি যে নিমেষে নাই অলৌকিক প্রভা
মুহূর্তেই উবে গেছে অসীম প্রতিভা।
যেনবা বিদ্যুৎ-প্রভা জমিনের থেকে
আসমানের দিকে তীব্র হয়েছে বিলীন।
ইনসানের দিল ধক করে কেঁপে কেঁপে গেল
যুবক শরীরে ভয়-মায়া যে বাড়িল।
আঁতিপাঁতি করে দেখি চন্দ্রলাগা রাতে
ফসলের খেতে তার পড়েছে পালক
কুড়িয়ে বুকেতে রাখি সোনার ঝলক।

এমন নরম কোনো পালক দেখিনি
পরিদের ডানাখোলা মায়াও জানিনি
কোনো পালকের ওম সদা উষ্ণ থাকে
কোনো পালকেতে প্রশান্তির জল জাগে।

বুকের সাথেই চেপে রেখেছি পালক
মনোরম নদীবুকে রাখাল বালক।

কুড়ানো পালকে মায়া চূর্ণ হয়ে ঝরে
কেমন রমণী থাকো কোন সে হৃৎপুরে।
ছিনিয়ে আমার আত্মা কোথায় পালালে
করিয়ো রহম আল্লাহ এতিম রাখালে।

 

তৃতীয় অধ্যায়: এক অবিশ্বাস্য তালাশ ও পরির জন্য শাহজাহানের অপেক্ষা

(তখন ফাল্গুন মাস। ইংরেজি হিসেবে ফেব্রুয়ারি। যমুনা নদীর পানি এ সময়টায় সবচেয়ে কম থাকে। ইরি ধান বোনা শেষ ইতিমধ্যে। টানের জমিতে মেশিনের সেচ চলছে। আর চরে বোনা খেসারি বড়ো হচ্ছে। বাদামের চারা এখন শিশু। প্রথমবারের পরি দেখার অভিঘাতে শাহজাহান আজও তার চক্ষুদ্বয়কে অবিশ্বাস করে। কাজে-কর্মে মন নাই তার এখন। কড়ি গুনে অপেক্ষা করে, প্রতিদিন রাত জেগে ফসলের মাঠে যায় সে, পরি দেখার অপেক্ষা করে, ছমছমে অনুভূতি নিয়ে। সে এখন প্রায় ফানা। প্রায় পাগল। লোকজনে জিগায়, এ কেমন অবস্থা তোর? জবাব দিতে পারে না সে, মুখ ফুটে বলতে পারে না, রাতভর না-ঘুমিয়ে, বাড়ন্ত ফসলের খেতে কী তালাশ করে শাহজাহান।)

 

এক

কী দেখেছি আমি শাহজাহান চক্ষুদ্বয়ে
ভাবি মরে যাব বুঝি হীরা দেখা ভয়ে।
এ জীবনে শুনিয়াছি কত রূপকথা
দৈত্য-দানো প্রেত-পেতনি আরো যথাতথা।
শুনেছি গজার মাছ রহস্যের বিলে
বিরাট দুপুরে কেন ধড়ফড়িয়ে মরে চিলে?
জেনেছি আরো তো পানিতলে রাজ্য আছে এক
দারকিনা মাছ টানে মাঝি নাও অনেক।
শুনেছি হাফিজ সাবে ইশারায় নামিয়েছে কুড়া
শুনেছি বানের জলে জোলাপাড়া দিয়েছিল ওড়া।

কত কথা কত স্মৃতি গা-ছমছমের
উড়ো কথা পায় বুঝি রূপ গো দেহের!
জেনেছি আল্লাহ যারে দেখাবে ঝিলিক
সে কি পারে তা ঠেকাতে, মেগে মেগে ভিখ?
কত পাখি সুর তুলে ডাকে চিরকাল
ফুরফুরে বায়ু বয় শালিকের দিনে।
পলাশের ডালে আর শিমুলের ঝাঁকে
দেখি টিপপরা তীব্র ফাগুন মেয়েকে।
ইরি ধান বোনা শেষে কৃষকের ঘরে
মসজিদ ও ময়দানে মাহফিল ওড়ে।
এই ধান পেকে যাবে দিন নব্বইয়ে
সেচ দাও সেচ দাও সব ভাই মিলে।

আমি শাহজাহান দিন গুনি কড়ি গুনে
কবে পাব দেখা পরি, কোন সুলক্ষণে।
অমাবস্যা জানি থই থই পূর্ণিমার শেষে
অপেক্ষায় থাকি আমি শিকারির বেশে।
ঘুম ছেড়ে মাঠে যাই রাত ও বিরাতে
খুঁজি পরি আসে কি না ফসলের খেতে।
আরো খুঁজি পাই কি না পরির পালক
আগুনের চেয়ে তীব্র সোনার ঝলক।

মাঠ পাহারায় থাকি পরিটার খোঁজে
কুয়াশারা ক্ষীর হয় ফজরের ভাঁজে।
লোকে বলে, ‘শাহজাহান, কী হইছে তোর
পাগলের মতো ঘোরো কেন রাত-ভোর?’

কী খুঁজি লোকের কাছে বলতে না পারি
পাঁচ ভাই খোঁজে আমি নাই কেন বাড়ি;
বুকের মিনার খাঁ খাঁ শূন্য, নেই প্রাণ
জান ধরে হুট করে কে যে মারে টান;

একা একা জেলেনৌকা যমুনায় চড়ে
বড়ো ডানা বড়ো চিল আকাশেতে ওড়ে।
বড়ো জালে বড়ো ফাঁস বাগায়াড় ধরে
নদীতলে জিকিরের চাপা ধ্বনি কার বুকে মরে।

উত্তরের নলছিয়ার চর দক্ষিণের গান
কাঁদে এ মন গো আল্লা আকুল পরান।
ভাবি আমি যাব চলে আসমানের পরে
চরাব শতেক গরু প্রতিবেশী চরে।
এখন যায় না দিন, যায় না তো রাত
পরির তালাশে কাটে নির্ঘুম প্রভাত।

এদিকে ইরির চারা বড়ো হতে থাকে
কুমড়ো ফুলের চোখ ইশারায় ডাকে।
কমে আসা শীতে হাসে ফাগুনের বায়ু
চোখ বুজে ভাবি বুঝি কমে এল আয়ু।

 

চতুর্থ অধ্যায়: শাহজাহানের দিনগুলো-রাতগুলো

২৬ ফাল্গুন ১৪২৬ (পরি দেখার পর থেকে কী এক গহিন মোহে, মত্ততায় শাহজাহান উন্মাদ প্রায় ভেতরে ভেতরে। ঘুমহীন যুবক সে এখন। পরির কথা ভাবে। দোজখের আগুনে সে পোড়ে। কুড়িয়ে আনা একটা পালকের খণ্ডাংশ যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখে শাহজাহান।)

 

নদীঘেঁষা বাড়িঘর মুগ্ধ বাক্যহরা
দিবা-রাত্রি ভাইবোন যেন চন্দ্রপ্রভা।
পক্ষীর ডানায় সূর্য ভাসে আর পুন ডুবে যায়
রাত্রি এলে শজনেডালে মৃদু ডাকে অবাক প্যাঁচায়।
জেলেজালে দলে দলে ধরা পড়ে মাছেদের ঝাঁক
জোনাকের পিছু ছোটা মানুষেরা ঘুমে ঢলে যাক।

আশপাশে খাদ্য খোঁজে চালাক শিয়ালে
কার গো মোরগ কীবা হাঁস নিল তুলে;
গেরস্তবাড়ির আমগাছ মৃদু দোলে
নিঝুম হাওয়া যেন ফেরে মাতৃকোলে।

দূরে কেউ রাত জেগে ড্রেজার চালায়
ডুবুডুবু বাল্কহেড নদী ধরে যায়
বালু যেন টাকা সোনা জেনেছে মানুষে
নদীজুড়ে আরো কত জাদু না চলেছে।

বাঁধা বাঁশ নিয়ে কেউ ব্যবসাতে যায়
এ জগৎ তারে বলো কোথা খুঁজে পায়?
রাত্রিভর কত শত রুটি-রুজি চলে
ভয়তোলা জিন ওড়ে স্বনির্ভর দলে।

দিন আর রাত দুই বানাইছে আল্লা
যার যার কর্মে সবে থাকে ফানাফিল্লা
কেন যে অচিন টিয়া ডাকে তারস্বরে
তারে কি যায় গো দেখা ক্ষীর ফোটা ভোরে।

পূর্ণিমার রাত ধরে মৃদু বায়ু বয়
ইরি খেত প্রতি রাতে কিছু বড়ো হয়
সরু দেহ পোক্ত হয় এই তো নিয়তি
যথা নিয়মের জেনো নাই কোনো যতি।

ভরা চাঁদ ফাঁকা হবে কদিনের পরে
থোকা থোকা অন্ধকার গিলে খাবে তারে।
দুনিয়ার পরে আছে আরেক দুনিয়া
কী কাজ সবার সেই তালাশেতে গিয়া।

জল ছুঁয়ে আসে যেন আচমকা ঢেউ
ঘুমঘোরে পাশ ফিরে স্বপ্নাহত কেউ
এপাড়-ওপাড় দুই ভাঙে দুই জাগে
আল্লা শুধু দেখে খেলা কঠিন দেমাগে।

মেঘ ওড়ে ফকফকা চাঁদেরও দিকে
কার মনে কান্না বলো কার খোঁজ নেবে;
গত রাতে বৃষ্টি হলো কাঁপিয়ে এ পাড়া
কোথা থেকে ছুটে আসে দুয়েকটা তারা।

শীত যায় অন্যখানে অন্য কোনো দেশে
বসন্তের দোলা লেগে শাহজাহান কাঁদে।
শিমুলের লালে প্রেম যাই লিখে দিক
উন্মাদ শাহজাহান নাই চোখে তার নিদ।
এদিক-ওদিক চারদিক শুধু দেখে
খুঁজে ফেরে ঘুমহীন, পরি মেয়েটাকে।
চোখের পাতায় ঘুম নাই তারা ঝরে
পতপত ওড়ে মেঘ অজানার তরে।

এক দিন দুই দিন কি হে বারো দিন যায়
অনামা পালক বুকে দিন কেটে যায়।
এক দিন দুই দিন কি হে ষোলো দিন যায়
নরম পালক বুকে রাত কেটে যায়।

 

অধ্যায় পাঁচ: শাহজাহানের তেতাল্লিশ হাঁস

(গ্রাম গোহালিয়াতে চাঁদ ওঠে নিয়ম মেনে আবার ডুবে যায়। যমুনাপাড়ের প্রান্তর জোছনায় ভেসে গিয়ে পুনরায় অমাবস্যার দিকে যাত্রা করে। কিন্তু এর মধ্যে আরো এক রহস্যের ভেতর ঢুকে যায় যুবক শাহজাহান। তার পোষা হাঁসের সংখ্যা তেতাল্লিশ হলেও পরপর চার দিনে, চারটি হাঁস নিখোঁজ হয়ে যায়। একে তো পরিজনিত বিভ্রমের জন্য অস্থির মানসিক অবস্থা, তার মধ্যে আরেক সমস্যার আবির্ভাবে এবার জেরবার শাহজাহান। খুব দ্রুত ঘটনা প্যাঁচ খেতে থাকে। চার হাঁসের হদিস তো সে পায়ই না, উল্টো এই ঘটনার আরো চৌদ্দ দিন পর ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে যায় আরো দশটি হাঁস। তেতাল্লিশটা হাঁসের মধ্যে অবশিষ্ট থাকে আর মাত্র উনত্রিশটি। আহা! আমরা জানি, শাহজাহান হাঁসের মালিক। তার বুকে ব্যথা। শোক। যদিও শেষ দশ হাঁস নিখোঁজের পাঁচ দিন পর থেকে আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে শাহজাহান। হাঁসের শোক তাকে আর আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে না। বরং পরি নামক এক রহস্যময় গোলকধাঁধা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে পুনরায়।)

 

এক

এদিকে শাহজাহানে হায় কান্দাকাটি করে
যদিও তাহার বুকে পরি নাহি ওড়ে।
চাঁদ ওঠে পূর্ণিমায় ভাসে চরাচর
হীরার কন্যা সে, রয় অজানা অপর।

চাঁদ যায় গান থামে নদীতলে মাছ
শাহজাহান পোষে জেনো তেতাল্লিশ হাঁস।
সেই হাঁসদলে কী যে হলো আল্লা জানে
নিখোঁজ হইছে চার হাঁস চার দিনে।

সন্ধ্যায় ঢুকেছে হাঁস খোঁয়াড়ে সকল
পরপর চার রাতে কে গো নিয়েছে দখল?
প্রতি রাতে এক করে চার রাতে চার
হারাল কোথায় কই হয়েছে পাচার?

চার হাঁস হারাইলে ছোটো হয় দল
চার বোন নিখোঁজেতে কাঁদে শতদল
প্যাঁক প্যাঁক করে কাঁদে বোবা হাঁসদল
কেউ না তো বুঝে ভাষা অবুঝ-অঞ্চল।

কিছুদিন পর তার ফিরে আসে হুঁশ
সম্পদ হারানো সে তো মজনু বেহুঁশ।
এরে কয় ওরে কয় হাঁসগুলা কই?
গ্রামবাসী হাসে বলে আমরা তো আর
হাঁসের মালিক নই। তবু বারবার
দুই দিন ধরে, খোঁজে পুকুর পাহাড়—
জংলা কি খেতে আর দূর বাথানে
তবু তো পায় না খোঁজ নিখোঁজ হাঁসের;

কী যে ধন্দ তার, আহা, দিনরাত মনে
পরি সে দেখিল রাতে কেমন কুক্ষণে
এখন যে তার জান যায়, যায় প্রাণ
সম্পদ হারিয়ে বুঝি গরিব পরান।

পাঁচ ভাই যদি বার্তা এই জানতে পারে
প্রাণাধিক প্রিয় ছোটো কে কী রাখে দূরে?
বাড়ির ত্রিসীমানা ধরে শাহজাহান না যায়
সে যেন হারানো মেঘ নভোসীমানায়।

‘পরি কেন তার বুকে আছড়ে পড়েছে
হাঁসগুলো তার হায় কোথায় মরেছে?’
এই করে করে আরো দিন দশ যায়
শাহজাহান খুঁজে কোনো উত্তর না পায়।
নরম পালক তবু লুকানো বুকেতে
রোজ এই জাদু তার জান ধরে টানে।
পরির লাগিয়া তার বুকেতে উথাল
কোথায় নরক স্বর্গ আকাশ পাতাল।
চার কমে গেছে তার তেতাল্লিশ হাঁস
জানে না সে হাঁসগুলো কার হলো গ্রাস?

দশ দিন শেষে আরো চার দিন গেল
নিঝুম রাত্তির খুব চোখ বুজে গেল
বহু বহু দিন পর শাহজাহান ঘুমে
যেন রে ঘুমায় শিশু মাতৃগর্ভ-ওমে।
এই ফাঁকে হায় হায় হাঁস গেল দশ
জানে না শাহজাহান ঘুমে বেঘোর অবশ।

পরদিন ঘুমতৃপ্ত শাহজাহান ওঠে
গুনে গুনে দেখে দশ হাঁস নাই তার
তেতাল্লিশ হাঁস থেকে পয়লায় চার
এখনে গিয়েছে আরো দশ অজানায়
মাথা ঝিম বুক ঝিম তালাশ না পায়।
টেঁটা যেন বিঁধিয়াছে বুকে এসে তার
একূল-ওকূল ভাবে শাহজাহান আবার।

উনত্রিশ হাঁস মিলে প্যাঁক প্যাঁক করে
কী যে কান্না ছড়ে হায় যমুনা ইথারে
চৌদ্দটা হাঁসের বোন বাকি উনত্রিশ
কাঁদে শোকে শোকে কাঁদে যেন সব বিষ।

রাত্তিরে যেন গো উঁকিঝুঁকি মারে চাঁদ
উনত্রিশ হাঁস দেখে কাঁদে সে নিখাদ
চৌদ্দটি হাঁসের বোন কোথায় যে গেল
বুড়ি চাঁদ সে-ও দেখো হদিস না পেল।

রাতভর চাঁদ আলো কান্নারূপে ঝরে
গাছপালা গ্রাম পাতা হাঁস খোঁজ করে।
কেমন বেদনা হায় শাহজাহান বুকে
মুষড়ে মুষড়ে ওঠে পাঁচ দিন ধুঁকে।

পাঁচ দিন শেষে শোক ভুলে শাহজাহান
পরির তালাশে মাতে পুরো দুজাহান।

 

অধ্যায় ছয়: গ্রাম গোহালিয়ার কিসসা

(যমুনায় যেমন পাড় ভাঙে, তেমন গড়েও। ভাঙা আর গড়ার খেলা। ভাঙতে ভাঙতে আর গড়তে গড়তে যমুনা সেতুর কোল ঘেঁষে সটান শুয়ে থাকা এই জনপদের চেহারাও বদলে গেছে। বদলে গেছে বুলি, পেশা। গরিবি হালও কমে গেছে। মানুষের হাতে টাকার নিশানা ওড়ে এখন। নানান ধরনের ব্যবসা আছে অত্র তল্লাটে এখন। কেউ কেউ লাখপতি হয়েছে। কেউবা হয়েছে কোটিপতি। হাতে হাতে মোবাইল, ইন্টারনেট। অব্যক্ত কথা আর এখন গুমরে মরে না বুকে এই প্রত্যন্ত গ্রামের। মোটকথা, নব্বইয়ের দশকের থেকে অনেক বদলে যাওয়া এক সমাজের প্রতিরূপ এই গ্রাম গোহালিয়া, এসো শুনি তার কথা।)

 

এক

যমুনার পেট থেকে ধনুকের মতো
জন্মে ধলেশ্বরী ছোটে নিজ মনমতো।
ধনুকের পেটে গ্রাম এক গোহালিয়া
মাতা আছে কালিহাতী থানা নাম নিয়া।
লস্করবাড়ির ছেলে নাম শাহজাহান
পরিবার মিলে ধরে মাছ পোষে পশু ফলায় গো ধান।
আছে ইশকুল মাদ্রাসা ও মসজিদ
আছে জেলে জোলা আর নানান উদ্ভিদ।
নদীতে বাঁধের কাজ ঠিকাদার করে
বালি বেচে অনেকেই কোটিপতি ওরে।
গ্রামে গ্রামে নাই আর আগের অভাব
অনেকেই ফুলবাবু বিশাল প্রভাব।
যমুনার আগে কেউ করত ডাকাতি
সেতু হয়ে অনেকের পাল্টেছে নিয়তি।

মোড়ে মোড়ে চা-দোকান, জোর টিভি চলে
ছেলে-বুড়ো সব মিলে গুলতানি চলে।

এসেছে বিদ্যুৎ গ্রামে। বাতি জ্বলে মোড়ে
অথচ মরার কথা বানভাসা তোড়ে।

ছেলেমেয়ে রোজ করে আজ স্কুলে যায়
যতই গরিব হোক কিছু শিক্ষা পায়।
তারপর কেউ খোঁজে চাকরি, ব্যবসা
অর্থকড়ি খুঁজে ছোটে জীবনের দশা।

নদী ছুটে যায় বুক ছেড়ে ফাল্গুনের
আসে চৈত্র ধা ধা রৌদ্র কাঁচা জমিনের
ইরি ধান বাড়িতেছে হাওয়ার মতো
গ্রামবাসী সেচ আর নিড়ানিতে রত।

পেকে গেছে গমখেতে সোনালি ঝরোকা
দূর থেকে যদি দেখো বোবা আচমকা।
এদিকে আমের গাছে সহস্র মুকুল
সে কী ঘ্রাণ সোনা আসে—বুকেতে ব্যাকুল।

দুদিন আগেতে বৃষ্টি হলো সুর তুলে
আমছানা গুটিকারে কিছু ঝরে গেছে।
গাছে গাছে বড়ো বড়ো মৌমাছির চাক
সোনা ছেলেমেয়ে সবে মধু খুঁজে পাক।

কাঁচা রাস্তা ছেড়ে যাও জমিনের দিকে
ইরি ধানচারা গন্ধ লাগবে গো নাকে।
গন্ধে আছে সোঁদা গন্ধ মাটি ও মায়ের
ধানচারা মাঝে খুঁজে পাবে চিহ্ন পিতার পায়ের।
পূর্ণিমার চাঁদ গেছে আট দিন আগেই
জোছনা লুকাল মুখ লাউঝোপ দেখে।
শীতের বাতাস নাই যমুনার কোলে
জেলেনৌকা ভরে আসে পিয়ালির দলে।

পলাশ-শিমুল ছেড়ে পাখি উড়ে গেছে
মুকুলে মুখর যত আম-জামগাছে।

 

অধ্যায় সাত: আশ্চর্য রাতের কালোবিদ্যা

(চরম আশ্চর্যের রাত আসে শাহজাহানের জীবনে। পূর্ণিমার ঝলক লাগা রাতের ঘনঘোর ঘুমে বেহুঁশ যুবকের ঘুম কেনই-বা ভাঙে আর কোন সে অজানার ডাকে সে ছুটে যায়, বাড়ির পেছনের ফসল প্রান্তরে, কিছুই জানা যায় না। ঘোরগ্রস্ত সেই যুবক ফসল প্রান্তরে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় এক জোছনার বিস্ফোরণ। আজব কাহিনির মতোই সেই সুতীব্র আলো ও জোছনার বিস্ফোরণের ভেতরে আরো মৃদুভাবে পরি সাব্যস্ত করা এক নারীকে আবিষ্কার করে সে। পরি তখন কাঁধ থেকে পালক খুলে রাখছে। ধবধবে সাদা মিহিন সেই দিঘল পালক। আরো ধবধবে তার সারা শরীর, চোখ নাক মুখ স্তন নিতম্ব ঊরু পা। ভয়াবহ আলোর তীব্রতার ভেতরেও শাহজাহান পরিকে ঠিকই আবিষ্কার করে নিতে সক্ষম হয়। যেমন শাহজাহানের চোখে পড়ে রাজহাঁসের গলার মতো সুন্দর পরির গলা, আর সেই গলায় তিনটা তিল।

এরপর শাহজাহান কিছুই জানে না আর। কিছুই জানে না এই আসমান জমিন বাতাস প্রকৃতি। আগাতে আগাতে সে আসলে সুতীব্র আলোর ঝলকানি পার হয়ে ঢুকে পড়ে জোছনার বিস্ফোরণে। একদম পরির কাছাকাছি। এরপর আরো অজানা, আরো রহস্য।

শাহজাহান, আহা, গোহালিয়ার শাহজাহান যেন এক নভোযানে চড়ে বসে এরপর। সেখানে উত্থান ও পতন আছে। তুলোর মেঘে অবিরাম ডুবে যাওয়া আছে। বলিষ্ঠ যুবক চাষার শরীর প্রস্ফুটিত হওয়ার বিষয় আছে। উত্তপ্ত চাঁদের গলে যাওয়া আছে। বিস্ফোরিত মহাজাগতিক ঝিকঝিক ও কালোবিদ্যা আছে।

এরপর কী ঘটে, জানে না শাহজাহান, আহা, জানে না শাহজাহান, এরপর কী ঘটে।)

 

এক

আশ্চর্যের রাত আসে দ্রুত ঘুমঘোরে
ক্লান্ত শ্রান্ত শাহজাহান ঘুমায় অঝোরে।
এদিকে বাহিরে বয় দক্ষিণের বায়ু
ওড়ে মেঘ, ডাকে। বাড়ে পাখিদের আয়ু।

গোলাকার এক চাঁদ ফকফকা নীলে
জোছনা নেই। পাক মারে যমুনার চিলে।
ঝিঁঝি ডাকে ক্রমে ঘন মধ্যরাত হলে
বলকানো দুধের গন্ধ বেহেশতে ছোটে।

এমন দশায় তারে কে ডাকে বাহিরে জানা নাই
ফসলের খেতে বুঝি কোনো জাদু নামে জোছনার।
শাহজাহান, আহা, শাহজাহান দেখে ভেসেছে প্রান্তর
পালকের দেহ খোলে পরি, ছড়াতেছে নীল হীরা
নগ্ন কি সে? স্তন যেন তার আনারের রূপে জাগে;
জানে না তো চাষা, আহা, ভিক্ষা কী করিয়া মাগে
শাহজাহান, আহা, শাহজাহান দেখে ভেসেছে প্রান্তর

পেটে হাস্নাহেনাসহ হাসে গোহালিয়া
বইছে যমুনা কাছে কীবা দূরে, আহা
চরের সহিত চর, জলের পিরান
গায়ে, চরাচর ভাসে, নীলাভ অসীমে।
দুনিয়া যেন গো ব্যাপ্ত শুধু যমুনায়
আর কোনো রাজা, শাহি বা রাজত্ব নাই
ইরি খেত ওড়ে শূন্যে বিমানের মতো
মেঘের জোছনা কোথা গেছে উড়ে ভাই।

এমন সঘন রাতে আশ্চর্য ফসল খেতে পুনরায়
গভীর গোপনে ডুবে যেতে যেতে যুবা শাহজাহান
ভাবে কোনো শরীরের ক্ষীরে যাচ্ছে ডুবে
ডুবে যাচ্ছে শাহজাহান আর তার প্রাণ।

ভাবে কোনো তুলো নদী ডুবছে আকুল
স্তনের সুষমা তার দাঁতে মুখে নাকে
আর গভীরের কোনো দুধ উপচানো কুয়াশায়
সে হাঁপায়, চোখ খোলে, চোখ বুজে রাখে।

শরীরে ভাঙন জাগে। সুতীব্র আগুন
হল্কা ছড়ানোর মতো ছড়ায়-ছিটায়।
উসখুস দেহের, আহা, শাহজাহান মরে
ঘন জঙ্গলে নীল তাজা পাতা ওড়ে।

অদৃশ্য শরীর কোনো নভোযান যেন
তুলে নেয় শাহজাহানকে। নিজের শরীরে
তারপর আর কিছু জানা নাই তার
বোবা, কালা, অন্ধ এক অনেকের ভিড়ে।

কী করে উত্থান চেনে মানুষের দেহ
যখন একটা ঘুড্ডি মেঘদেহে টক্করে বিলীন
যখন উজানে যায় বেঘোর চিতল
কোনো, নিজ দেশ ছেড়ে আজীবন, অন্য দেহে লীন।

কিছুই জানে না, আহা, এই শাহজাহান
এমন নারীর ডানা কোথায় জেগেছে
কোথায় উত্তপ্ত চাঁদ কেন যে গলেছে
কাদার মতন, ভেজা তাহার শরীরে।
গর্জনশীলা রাত্তিরে স্থির এ দুনিয়া
মহাব্যাপৃতের পর, জাতি উপজাতি
নদীকূলবর্তী জনপদ, ধানখেত
যেনবা সর্বত্র ওড়ে অন্ধ বোবা প্রেত।

শাহজাহান জানে না কিছু, ঢেউ ভাঙে ঢেউ।
মালিকানা ধরে জাগে ভূখ-ের কেউ।
সে শুধু গভীরে ফোটে, পুনরায় গলে
রমণীদেহের ক্ষীরে, কাঁধ-নাভি-চুলে।

আসমান জমিন যেন টক্করে বিলীন
শাহজাহান ওড়ে, মরে। পুনরায় জাগে
দেখে অজানার কোনো বিস্ময় জগতে
জেগেছে সে। দীর্ঘ দীর্ঘ জাগরণ শেষে।

কিছুই তাহার আর মনে না তো পড়ে
কোথায় জগৎ এই বিস্ময়ে খচিত
মানুষের গন্ধ নাই দুধফরসা দেশ
নাই তো আসমান কোনো হাওয়াও বিরত।
শুধু এক পরি দুই ডানা কাঁধে যেন নভোযান
শুশ্রুষার দোর খুলে মাখে স্নেহ আর গায় গান।
আর কোনো হাওয়া নেই চেনা গাছ নদী পক্ষী নেই
দুধের নহর যেন জাগে চোখ তুলে তাকালেই।

বৃহৎ কি তারও বড়ো যেন সবকিছু অতিকায়
হুট করে গোহালিয়া ডাকে আর তার কান্না পায়।
পরির তালাশে তার কী যে হলো সে কী সর্বনাশ
কোথা তার ভাই বোন ধান গম নদী আর ঘাস।

 

অধ্যায় অষ্টম: শাহজাহানের নিখোঁজের পর মানুষজনের প্রতিক্রিয়া ও তৎসংক্রান্ত বিবিধ রূপকথা বা লোককথা যেভাবে জন্মায়

(সকাল দুপুর হয়, দুপুর গড়িয়ে পড়ে মাগরিবের দিকে। মুখে মুখে রটে যায় শাহজাহানের উধাও হয়ে যাওয়ার খবরটা। এক গ্রাম থেকে হেলে পড়া সূর্যের সাথে আরো দশ গ্রামে। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনসহ সবাই মিলে যুবক শাহজাহানের খোঁজে নেমে পড়ে। তারা যমুনার প্রবীণ বাগাড়ের কাছে যায়। উত্তর জানে না সে বর্ষীয়ান মাছ। তারা উত্তরে যায়, দক্ষিণে যায়। চরে ও জঙ্গলে যায়। নদীরে শুধায়। পুষ্পিত ফুলের ঘ্রাণে নিজ ভাইকে খোঁজে তারা। খোঁজে যমুনা নদীর চিতলের পেট কেটে। কিন্তু আহা, শাহজাহানকে পায় না তারা। উল্টো নিখোঁজ হয় পাঁচ নম্বর ভাইটা। আহা, গ্রাম গোহালিয়া, আহা, শাহজাহান…)

 

এক

সে রাত হয়েছে পার রাত আসে আরো
নিখোঁজ শাহজাহান হায় কোথায় মরেছে
ভাই কাঁদে ভাবি কাঁদে পাড়াপড়শি সাথে
কোন সে পরির জাদু বেভুলো করেছে।

জোয়ান পুরুষ তবু কেন করে ভুল
আকাশের মেঘ যেন পরিদের চুল;
গল্প ছড়া রূপকথা ওড়ে গাঁয়ে
কোথায় প্রবীণ মাছ জাগে কার পায়ে?

প্রতিবেশী বন্ধুজনে যায় নদীপাড়ে
বাগাড়ের কাছে প্রশ্ন করে ঠারেঠুরে
‘কোথায় শাহজাহান বলো হঠাৎ হারাল?’
নিশ্চুপ থাকে গো মাছ। উত্তর জানে না
কান্দে দল বেঁধে সবে, ক্রন্দন থামে না
গ্রাম গোহালিয়া নিজ মানুষ চেনে না।

জনে জনে শুধু গল্প জমে জমে ক্ষীর
শাহজাহান স্মৃতি হলো চা-স্টলেতে ভিড়;
পরি তারে তুলে নিল জনে জনে বলে
উনত্রিশ হাঁস তার পিছু পিছু চলে।

ময়মুরব্বিরা দোয়া-দরুদেতে মাতে
নামাজের শেষে, আহা, ফজর প্রভাতে।
কেউ বলে গরু দাও পীরের মাজারে
কেউ বলে তাকে খোঁজো চাঁদপুর রংপুরে?
কেউ বলে আসবে ফিরে ফকিরের বেশে
দুই অমাবস্যা তিন পূর্ণিমার শেষে
সোনালাগা ভোরে কোনো এক শুক্রবারে
আহা, গ্রাম গোহালিয়া যদি পায় তারে!

যদি পায় তারে ফিরে গ্রামের মানুষে
নামাবে না ধুলায় কভু রাখবে বুকে-পিঠে
ছয় ভাই তারে দেবে ভীষণ পাহারা
ভীষণ ডালিম লাল দুঃখে আত্মহারা।

চাঁদ ওঠে যেনতেন নাই যেন হাসি
সুরহীন গ্রামজুড়ে একা বাজে শুধু বাঁশি।
লেবু ফুলে ঘ্রাণ নাই পক্ষীরা নির্জন
ভাদ্রের পূর্ণিমা কাঁদে শোকে নিমজ্জন।

বাঁশঝাড় যদিবা কাঁপে ঝোড়ো হাওয়া এলে
গোহালিয়া গ্রাম ভাবে পুত্র বুঝি এল
সচকিত রাত হায় থাকে অপেক্ষায়
কোন সে রূপসী পরি কেন তারে খেল।

 

দুই

গ্রাম-ভূমি, জনে জনে পুত্র শোকে কাঁদে
আঁতিপাঁতি করে খোঁজে প্রবীণ বাগাড়ে;
‘যেখানে জন্মেছে নদী দুই পাড় ধরে’
নাই তো তাহার খোঁজ জঙ্গল কি চরে।

 

তিন

এক ভাই খুঁজে ফিরে পাঁচ ভাই মিলে
পূর্ব ও পশ্চিম আর উত্তর দক্ষিণে;
আরো এক দিক আছে আসমানে জান্নাত
আল্লার নিকটে কেঁদে তাই পাখনা খোঁজে।

পাঁচ ভাই পাঁচ দিকে অবিরাম ছোটে
এক দিন দুই দিন কি গো সাত দিন ধরে
চার ভাই ভূমি ধরে জেলা-উপজেলা
নদীপাড় গ্রাম চর-চরাঞ্চল ফেড়ে।

আর ভাই ডানা মেলে পাখিদের সাথে
যেন সাত ভাই চম্পা রূপকথা এই
নদীরে জিগায় তারা; পাখিরে শুধায়
মৌমাছির পেট চিরে ভাই কে কি পায়?

পুষ্পিত ফুলের ঘ্রাণে ভাইয়ের তালাশ
করে, দোয়েলের বাসা তছনছের শেষে
খুঁজে ফেরে ভাই পুরো বাংলাদেশে।
ধানের মধুতে রেখে ঠোঁট নেয় ঘ্রাণ
দেখে লুকিয়েছে কি না ভাইকে কেউ জাদুটোনা করে।

 

চার

‘চিতলের পেটে আছে গোপন তাবিজ’
শুনে চার ভাই ছোটে নদীর অতলে
পেট কেটে চিতলেরে জিগায় তাহারা
‘শাহজাহানের কি খোঁজ আছে নাকি কোনো?’
এই কথা শুনে হাসি পায় চিতলের
বলে, ‘প্রশ্ন কেন করো নাই বলো জীবিতের কাছে?’
কয়েক দিবস আরো কেটে যায় জলে
জ্যান্ত চিতলের তবু হদিস কি মেলে?
সুযোগ বুঝিবা মেলে একবার জগতে
ভাগ্যহীন তা হারায় করুণ সহজে।

এইভাবে কাটে, আহা, টানা সাত দিন
তাবিজ-কবজ শেষে কুফরি-কালামেও
কিংবা ইগলের পেট থেকে চুরি করা
ডিম; পায় না গো খোঁজ তারা তারপরেও।

 

পাঁচ

পাঁচ ভাই মিলে দেয় পাঁচ জেলা পাড়ি
বাথান বা চর রোগ-শোক কান্না ছাড়ি
এভাবে যায় গো কেটে আরো সাত দিন;
পক্ষী ডেকে কয় যাও দক্ষিণের ঢালে
তিন গাছ পরে অন্য গাছের আড়ালে
ছোট্ট পাখি এক জানে ‘কোথায় শাহজাহান?’
কথা শুনে দুরুদুরু কাঁপে পাঁচ ভাইয়ের পরান;
সূর্যাস্তের আগে আগে দক্ষিণের ঢালে
গিয়ে দেখে ছোটো পাখি মরে আছে কী যেন আকালে।
হায় হায় কাঁদে শোনো ভাইয়ের পরান।
হায় হায় কাঁদে শোনো ভাইয়ের পরান।

 

ছয়

এদিকে পঞ্চম ভাই আকাশেতে ওড়ে
মেঘেদের দেশে ভয়ে আল্লা নাম জপে
ঝড়ের মতন এক কালো পাকে পড়ে
রাক্ষসের দল তাকে ধরে নেয় ঘিরে।
মানুষের ঘ্রাণ পেয়ে ক্ষুধার্ত রাক্ষস
মানুষের রক্তে ক্ষুধা করে যে আনচান।
হাউমাউ করে তারা ছিঁড়ে খায় তারে
শাহজাহানের খোঁজে গিয়ে আরেকজন মরে।
(হায় রে মানুষ গেল রাক্ষসের পেটে)

দুই ভাই হারায়েছে গোহালিয়া গ্রামে
অঝোর কান্নার রোল কখনো কি থামে?
চার ভাই চার দিক পাগলের মতো
খোঁজে কাকে জানে না তো, মোনাজাতে রত।

আল্লা আল্লা ডাক বুঝি কাঁপায় আরশ
বৃষ্টি নামে কেন জানি দিন-রাত ধরে
মসজিদ মিনারে ক্লান্ত যেই পাখি বসে
সে-ও কাঁদে নীল শোকে ভীষণ অঝোরে।

 

অধ্যায় নয়: পরির তালাশ

(গ্রামবাসী পরির তালাশ করে। তারা জলে যায়, স্থলে যায়, যায় আসমানে। ফকফকা জোছনায় তারা ভাবে, এই বুঝি পরির দেখা পেল। হাওয়ায় হাওয়ায় তারা বল্লম ছোড়ে। তবু তারা পায় না পরির দেহ। পায় না পালক। পারে না নিতে প্রতিশোধ তাদের দুই সন্তান হারাবার। তারা দিনে খোঁজে। রাত্রে খোঁজে। রাত্তির যখন প্রায় শেষের দিকে, আসমানে তারা দেখে শাহজাহানের নিখোঁজ চৌদ্দটা হাঁস। প্যাঁক প্যাঁক করে ডাকে হাঁসগুলো। পরপর পাঁচ রাত সেই চৌদ্দটা হাঁস গ্রাম গোহালিয়ার আসমানে ওড়াউড়ি করে। নিখোঁজ হাঁসের ফিরে আসা, পাঁচ রাত অবস্থান করার ঘটনা গ্রামবাসীদের বিভ্রান্ত ও ক্রুদ্ধ করে আরো। তারা ক্লান্ত বোধ করে। অবশেষে তারা আল্লাহর কাছে হাত তোলে।)

 

এক

গ্রামের লোকেরা নামে পরির তালাশে
পূর্ণিমায় জাগে ঢেউ নির্মম আক্রোশে
বিল দিঘি নদীজুড়ে কোথায় না যায়
বল্লম-ছুরিতে শুধু খুন যে ঝলসায়।

চেনা শত্রু হলে তার খোঁজ পাওয়া যায়
অচেনারে তুমি বলো ‘কোথা পাবে আর’
হাওয়ার পেটেতে তুমি যতই চালাও
ছুরি, শূন্য পাবে অথই শূন্য পারাবার;

পরি কি ইঁদুর, তারে খেতে পাওয়া যাবে?
সে কি মানুষের মতো, ধরে ফেলা যাবে?
তবু গ্রামবাসী মত্ত পরি-ধরা কাজে
জোছনার বিস্ময়ে তারা শত্রু শুধু খোঁজে।

রাত্তির যখন প্রায় ফুরোয় ফুরোয়
আসমানেতে তারা দেখে চৌদ্দখানা হাঁস
প্যাঁক প্যাঁক করে ডাকে; চারপাশ থমকায়
গ্রামবাসী বিস্ময়েতে বোবা হয়ে যায়।

বিস্ময় কাটায়ে তারা শুধু ছোটে হাঁসেদের দিকে
অসীম আসমান যেন আরো যায় বেঁকে
ক্লান্ত-শ্রান্ত মানুষেরা মাঠে পড়ে যায়
দূরত্বের পরে, আহা, আক্রোশ না ফুরায়।

বিন্দু বিন্দুমতো মানুষেরা মত্ত মাঠে ঘাটে ঘুমে
পরিদের জননীরা চুপ আসে নেমে;
আঁচল বিছায়ে তারা শুশ্রুষা যে করে
শান্ত বায়ু বয় ভোর ফোটে পুবে ডাকে মোয়াজ্জিন
পুত্রশোকে পুরো গ্রাম নিজে যায় মরে।

এরপর কী ঘটে, আহা, কী যে আচানক
টানা পাঁচ রাত ডানা ঝাপটায় হাঁসেরা
আসমান ওপারে গোহালিয়া গ্রামে সোনা
যেনবা জরির রূপে সব জমি বোনা।
আল্লার কী মনে বোঝা যায় না কখনো
হাঁসেরা যে কেন আসে, না জানে যমুনা;
পরির তালাশে গিয়া একি পেল গ্রাম
হাফিজ সাহেব পড়ে কোরান কালাম।

পরির তালাশ করে গ্রামের মানুষ
চোখে খুন, অগ্নি আর বুকেতে আক্রোশ।
ডানা মেলে দেবে ওড়া যেনবা আসমানে
দেখে নেবে এই পরি লুকায় কোনখানে?

দিন যায় রাত যায় কখনো পূর্ণিমা
বাতাসে বাতাসে গাঁথে বল্লমের ঘাই।
হারায়ে দুভাই সবে শোকের দুনিয়া
মাজারে মানত করে মন-দিল দিয়া।

জরির আসমান জ্বলে রূপে সে ঝকমক
গ্রামের মানুষ ভাবে এই বুঝি পরি
নিহত ডানায় তারা ঘৃণা ছোড়ে মারে
খোদার আরশপানে মোনাজাত ধরে।

 

অধ্যায় দশ: গ্রামবাসীর প্রতিক্রিয়া

(শাহজাহানের সাথে সাথে হারিয়েছে তার আরেক ভাইও। গ্রামবাসী স্তম্ভিত, বিস্মিত, শোকাচ্ছন্ন। তারা ভাবে কালো জাদুর আসর পড়েছে গ্রামে। কালা হাজি সাহেবের কাছে তারা পরিত্রাণের উপায় খুঁজে ফেরে। কালা হাজি প্রাজ্ঞ ও আল্লাওয়ালা লোক। কালা হাজি সাহেব বলে, লোকজন দিনকে দিন খোদা ভুলে যাচ্ছে। সে স্মৃতি টেনে এনে মনে করিয়ে দেয় সবাইকে বছর ত্রিশেক আগের কথা। যখন এই গ্রামটা গড়ে উঠেছিল, তখন এক লাল ঘোড়া দেখা যেত আসমানে। আর প্রতিদিন কেউ না কেউ মারা যেত। সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতা থেকে সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে সম্ভবত পুনরায় অভিশাপ আসছে এই গ্রামে। ফলে কালা হাজি সাহেব সবাইকে তওবা করতে বলে। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে বলে। নামাজ-রোজায় মনোযোগী হতে বলে।)

 

দিন দিন করে দেখো দশ দিন গেল
দুই ভাই গ্রামে আর না ফিরে গো এল
গাছে জলে স্থলে ফুলে বয়ে যায় শোক
কী করে সামলায় পুত্র হারাবার দুখ।

গ্রামবাসী ভাবে কালো জাদুর আসর
আজ যদি এর ক্ষতি কাল যাবে ওর
পরির নজর থেকে মুক্তি পেতে হবে
এই নিয়ে কালা হাজি পরামর্শ করে।

‘সবল পুত্রেরা যদি এভাবেই মরে
সর্বনাশ হবে গ্রামে’ কালা হাজি বলে।
‘কার পাপে হায় কে যে মরে? চলো সবে
তাড়াও গ্রামের পাপ, রাখো কাঁধ কাঁধে।’

আরো বলে হাজি সাব, ‘জানো কি মসজিদে
কাতার কয়টা হয় ওয়াক্ত নামাজে;
আল্লারে না ডাকো যদি রহম কী করে
পাবে? ব্যস্ত সবে যত পাপে অনাচারে।’

‘এক লাল ঘোড়া রোজ দেখা যেত রাতে
যখন গড়েছে গ্রাম যমুনাপাড়েতে
প্রতি রাতে মারা যেত কেউ রাখো নাই মনে আর
পাপে ভারী হলো বুঝি এলাকা আবার।’

বছর ত্রিশের কথা ভুলেছে সকলে
মনে আসে কারো কারো হাজির কথায়
ফজর মাস্টার বলে, ‘বের করো সবে
এই অভিশাপ থেকে বাঁচার উপায়;’

‘অন্নহীনে খাদ্য দাও, গরিবে সাহায্য
এত বড়ো গ্রামে নাই হাফেজি মাদ্রাসা’
এক বাক্যে রাজি সবে হাজির কথায়
এখানে মাদ্রাসা হবে, পুরাবে দুর্দশা।

‘আর তওবা করো মিয়া ওগো গ্রামবাসী
মাপ চাইলে জাইনো আল্লা হবে খুশি।’
মিলিয়া সবাই গ্রামে অমাবস্যা রাতে
মসজিদে নীরব দোয়া-দরুদের শেষে
তওবা করে। হাত তোলে মাওলার নিকটে
যেন অভিশাপ আল্লা নেয় আজ তুলে।

 

অধ্যায় এগারো: শাহজাহানের অন্তিম জবানবন্দি: ‘আমার না হয় কাজ শুধু তিন আসমান পাহারা।’

(শাহজাহানের মারফত আমরা জানতে পারি যে তিন আসমান শেষে ফাঁকা কোনো জায়গায় আছে ক্ষীরের মতো ফরসা ধু ধু এক জগৎ। জনমনিষ্যির কোনো চিহ্ন যেখানে নাই, এমন এক বিরান দুনিয়া। সেখানেই তার বাস। আপাত ঘর সন্ন্যাস ও সংসার। যদিও সে বলে, সেখানে কেবল তার শরীরেই মানুষের গন্ধ।

আমরা জানি না নাম না-জানা পরির সাথে যুগল জীবন কেমন কাটছে তার। সে এক অজানার চেয়েও অধিক অজানার দুনিয়া। যদিও জানা যায়, শাহজাহান যেমনই থাকুক, যতই সে সুখী হোক, যমুনা নদী আর গোহালিয়া গ্রাম তাকে কাঁদায় ঠিকই।)

 

পরির দেশেতে থাকি পরি দেশে খাই
হীরা লাগা জগতের পরির জামাই।
তিন আসমানের শেষে ফাঁকা কোনো ভূমি
চালাই লাঙল আর চাষ করি জমি।

ফকফকা আকাশে খুব চমকায় রংধনু
বিশাল দিঘিতে চরে উনত্রিশ হাঁস
মনেতে পড়ে না মোটে দিন রাত ভোর
আশি^ন কার্তিক ভাদ্র মাঘ কিংবা পোষ।

মনে আসে মাঝেসাঝে গ্রাম গোহালিয়া
পাড়া-প্রতিবেশী আছে কেমন করিয়া।
মনে পড়ে পাঁচ ভাই, আছে যে কেমন
পাড়া-প্রতিবেশী গ্রাম যমুনার বোন।

 

*
দল্লি বিল থেকে লাফ দিয়ে উঠে ছোঁয়
নক্ষত্র, যে মাছ, আমি দিগন্তরেখার
ওপরে দাঁড়িয়ে দোস্তি করেছি তাদের
সাথে। বলি, দিগন্তই শেষ নয়, পরে
আরো কোনো আসমান আছে, ধাবমান
প্রাণ, মেঘপুঞ্জে কী যে আকুলিবিকুলি…
আমার পাখার ভার পারি না লুকাতে
আর। বেদনার নীল দেহে, গঞ্জে, উঠে
চূড়ায়, দেখেছি শেষ বলে কিছু নেই
আসমানের পরেও আসমান থাকে
ফেরেশতাদের নুর কাঁপে আকস্মিক

 

*
আমি যে সুঠাম চাষা এক দৃঢ় প্রেমিক তাহার
আমি যে পুরুষ যুবা বাঁধি তার কোমরের হার
খোঁপা থেকে তার খুলি ফুল গড়ি আয়না আসমান
কোথা জন্মে সুফলার দেশে আর কই অবসান।

মানুষের গন্ধসহ একা আমি দেশে পরিদের
আছে চাষ আছে শস্য, হাওয়া ধরে ওড়াউড়ি ঢের
নিজ দেশে পিতৃ-মাতৃকুলে হাহুতাশ শুধু থাকে
খোদা যেন তা-ও ভূমি দেশ নারী পুষ্প ভালো রাখে।

এখানে তথাপি গন্ধ মানুষের ভয়ে বেঁচে থাকি
পরি রমণীর স্তনে, কাঁধে, পিঠে নিজ দেহ রাখি।
সন্ততি যদিবা হয়, কী হবে তাহার নাম ভাবি
যমুনার কূলে না জানি কতক পাখির ডাকাডাকি।

রাখিয়ো স্মরণে ভাই পাপী এক জাতিকুল ছাড়া
আমার না হয় কাজ শুধু তিন আসমান পাহারা।

 

*
এক আসমান নদীরূপে খ্যালে জমিনের নিচে
আরেক আসমান খেলে বসুধা-বাতাসে চিরকাল
আরেক আসমান দেখে না কখনো কেউ কভু
নিজের বুকেতে থাকে কবরের মতো প্রাজ্ঞ, স্তব্ধ।

তিন আসমান গুপ্ত রাখি আমি চোখের মণিতে
নিয়ো নিয়ো খোঁজ গোহালিয়াবাসী যদিবা বেহেশতে।

 

অধ্যায় বারো: যমুনায় দুই শাপলা ফুল: ‘ফিরেছে শাহজাহান, পুত্র এক, নিজ গ্রামে’

(শাহজাহানের আর হদিস মেলে না। না মিললেও সময় যায় বোরাকের চেয়ে দ্রুতগতিতে। দিন যায়, মাস যায়। যমুনাকূলের সবার চেনা প্রবীণ বাগাড় মরে ভেসে ওঠে। তা দেখে গ্রাম গোহালিয়ার মানুষজন শোরগোল তুলে কাঁদে। জলের বাসিন্দা হলেও প্রবীণ বাগাড়টা ছিল তাদের পরমাত্মীয়। জলে ও স্থলে, মুখে মুখে রূপকথার মতন প্রবীণ বাগাড়ের গল্প ঘুরে বেড়ায়। গ্রামের মানুষজন বিষণœ হয়। তারা তাদের হারিয়ে ফেলা স্বজনদের কথা ভাবে। এই আচানক শোকের ভেতর এক অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় সন্ধ্যা নেমে আসে মধ্যযমুনায়, গ্রাম গোহালিয়ার পেট বরাবর। সে সন্ধ্যা সোনারঙা, উজ্জ্বল। আসমান যেন ওখানটায় ওড়ালপ্রবণ। মনে হতে থাকে সোনালি কইতর উড়ে বেড়াচ্ছে। আর কুয়াশা কুয়াশা ভাব। পাখপাখালিও এমন আবহাওয়ার মুখোমুখি হয়নি কখনো। তারা ভয়ার্তভাবে চিৎকার ও ইতস্তত ওড়াউড়ি করে ভয়ে। কিছুক্ষণের ভেতরে এমন ঘনঘোর দুর্যোগ কেটে যায়। তারা তখন এক অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হয়ে যায় উদার যমুনার জলে কখনো তারা শাপলা ফুল না-ফুটতে দেখলেও। এবার তারা মধ্যযমুনায় ফুটন্ত দুইটা বিশাল বড়ো বড়ো শাপলা ফুল দেখতে পায়। একটা শাপলায় গ্রামবাসী আবার শাহজাহানের মুখের আদল দেখতে পায়। তারা বিশ্বাস করে, তাদের হারানো ছেলে ফেরত এসেছে আবার। আর গলা জড়িয়ে ধরা আরেকটা শাপলায় গ্রামবাসী পরিকে খুঁজে নেয়। তারা ভাবে, মানুষের ছেলে আর পরিদের মেয়ে যেনবা দুজন বেঁচে আছে পরস্পরে ছুঁয়ে, চিরকাল ধরে।)

 

দিন যায় মাস যায় ফুল ফোটে গাছে
প্রবীণ বাগাড় হায় মরে ভাসে ভোরে
পরমাত্মীয় হারায়ে স্তম্ভিত সবাই
যমুনার জলে শুধু স্মৃতি তার ঘাই।

আচমকা সন্ধ্যায় ঘোর সোনারঙে আসমান উজালা
থমথমে চারপাশ শুধু ঝিম মেরে থাকে
সোনালি কইতর যেন সহস্র হাজার
থ মেরে আশ্চর্য সবে গ্রামের বাজার।

ভয়ার্ত পাখালি অন্ধ মেতেছে চিৎকারে
আসবে কি কেয়ামত শিঙার ফুৎকারে।
কাছে দূরে ঝিঁঝি সব যায় না গো দেখা
কোথায় যমুনা তার কই গ্রামরেখা?

ধীরে ধীরে উড়ে যায় সোনালি কইতর
বাথানের পর হায় চর দেখা মেলে
কচলে দুই চোখ তারা বিস্ময়ের ছলে
দেখে দুই শাপলা ফুল মাঝযমুনায় দোলে।

দৈর্ঘ্য-েপ্রস্থে তারা পাঁচ মানুষের মতো
ভরাট সন্ধ্যায় চাঁদ টোপরের মতো
শাপলার মাথায় ঝুলে আছে যেন নাদা নীল ক্ষীর
নদীপাড়ে শত শত মানুষের ভিড়।
ইলিক-ঝিলিক লাগে ঝিকিমিকি জল
ধাঁধারূপে ফুটে আছে পুষ্প-শাপলা দল।
(ইলিক-ঝিলিক লাগে ঝিকিমিকি জল)।

ভিড়ের ভেতর থেকে কে যেন চিৎকার
করে ওঠে। বলে, ‘আরে, শাহজাহানের মুখ
ভাসে দেখি শাপলা ফুলে’—কী যে হুটোপুটি
পীতবর্ণে বিস্ময়ের। কী যে রব, আহা!
মুখে মুখে ঠোঁটে ঠোঁটে ছড়ায় দিগ্বিদিক
‘ফিরেছে শাহজাহান, পুত্রে এক নিজ গ্রামে’
—পুষ্পের আড়ালে মুখ ঢেকে নব চিহ্নে
এক জেলা দুই জেলা সারা দেশজুড়ে
সন্দেশ ছড়ায়। আহা, ফিরেছে শাহজাহান
‘রাক্ষুসী পরির প্রেমে মরা এক প্রাণ’;
যমুনা গভীরে তার প্রেমিকারেসহ
ফিরেছে তাদের পুত্র কেমন দুঃসহ।
মানুষের রূপে নয়, পুষ্পের আদলে
ঝিকিমিকি জলে, আহা, শাহজাহান দোলে
ঝিকিমিকি জলে, আহা, পরি এক দোলে

শাহজাহান ও পরি সেই থেকে শাপলা বেশে
ফুটে থাকে যমুনার পেটে, বাংলাদেশে।
মানুষের ছেলে আর পরিদের মেয়ে
যেনবা দুজন বাঁচে পরস্পরে ছুঁয়ে।
(ইলিক-ঝিলিক লাগে ঝিকিমিকি জল
রহস্য ফুটেছে যেন গভীর অতল)

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৬ ডিসেম্বর, নান্দাইল, ময়মনসিংহ। কবিতার বই: সার্কাস-তাঁবুর গান, মুচকি হাসির কবিতা, কমিকস, ক্যামেরা, ট্র্যাভেলগ ইত্যাদি, শস্য ও পশুপালনের স্মৃতি, আমি ইয়াসিন আমি বোরো ধান। ফিল্মের বই (যৌথ সম্পাদনা): ফিল্মমেকারের ভাষা (চার পর্ব: ইরান, আফ্রিকা, লাতিন ও কোরিয়া)। কিশোর উপন্যাস: বাবলুর অদ্ভুত সাইকেল। কিশোর কবিতার বই: লাল মোরগের ঝুঁটি। সম্পাদিত ওয়েবম্যাগ (যৌথ): লাল জীপের ডায়েরী

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।