প্রতিটি অন্ধকার অপেক্ষা করে সূর্যোদয়ের জন্য, নিজস্ব সংবাদের জন্য। এরপর বলি, প্রতিটি সকাল বহন করে আনে একটি সূর্যোদয়, একটি সংবাদ। সূর্যোদয় হাঁটতে হাঁটতে কিংবা দৌড়াতে দৌড়াতে যাক সূর্যাস্তের নিকটে, যেখানে একটি নদী ধুয়ে দিচ্ছে এ শহরের একজন একলা বৃদ্ধের, একজন একলা বৃদ্ধার ঘাম। আর সূর্যোদয়ের সামান্য পরে এ শহরের পত্রিকার পাতায় পড়ি, এই সংবাদ, বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি ভাড়া দেওয়ার জন্য লিখিত বিজ্ঞাপন বাড়ি থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছে।
২.
এক সঙ্গে সকল বিজ্ঞাপনের নিকটে যাওয়া না গেলে যাই একটি বিজ্ঞাপনের কাছে। সব সময় সকল বিজ্ঞাপন অস্থিরতার ওপর থাকলেও এ বিজ্ঞাপনটি আছে স্থিরতার ওপর। কবে এ বিজ্ঞাপনটি এ তিনতলা বাড়িটির শরীরে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল জানে কে। মানুষের বিজ্ঞাপন-স্মৃতি স্বল্প সময়ের হলে তা স্মৃতির ভেতর থাকে কীভাবে দীর্ঘ দিন। তবে বাড়ির মালিকের স্মরণশক্তি বাড়ির বিজ্ঞাপনকে গুরুত্ব দিলে জানা যেতে পারে তার স্মরণশক্তির নিকটে গিয়ে। কিন্তু আমরা যে কজন একসঙ্গে তার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে সকালে কিংবা দিনের অন্য সময় যাতায়াত করি তারা কেউই তার স্মরণশক্তির নিকটে যাইনি।
যারা এই বাড়িটিতে টাঙানো বিজ্ঞাপনের বাইরে অবস্থান করছে তাদের জন্য বাড়িটির একটা ভাঙাচোরা বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে। তিনতলা বাড়ি, নিচতলা গ্যারেজ, দোতলায় থাকেন বাড়ির মালিক, আর তিনতলা ভাড়া দেওয়ার জন্য টাঙানো আছে বাড়ি ভাড়া বিজ্ঞাপন। একসঙ্গে কোনো বাড়ির পরিপূর্ণ বর্ণনা না দেওয়া গেলে কয়েকবারে বলা যেতে পারে এ বাড়ির কথা। তারপর যদি এ বাড়ি শহরের সবচেয়ে পুরাতন বাড়ি হয় তার কথা বহুবারেও পুরোটা বলা যায় না—তা ছাড়া একটা বাড়ি যখন ধারণ করে একাধিক বাড়ি, একাধিক বাড়ির গল্প।
৩.
একটা বাড়ি আর তার বাসিন্দাদের বেঁচে থাকার জন্য কিংবা বেঁচে না থাকার জন্য বাজারের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে হয়। বাজারের সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে কেউ বাঁচতে না পারলে জানা যায় এ বাড়ি ও তার বাসিন্দাদের সম্পর্কে। প্রথমে দেখি একজন চাকরকে। সে বাড়ির গল্প বাজারে নিয়ে যায় আর বাজারের গল্প বাড়িতে নিয়ে আসে। আর একজন বাড়ির চাকরের চাইতে বাড়ির ও বাজারের গল্প কে বা বেশি জানে।
তার হাসির শব্দে শৈশবের কোলাহল ও কোলাহলের মাঠ জীবিত হয়। কিছুই মরে না তবে। তার কাছে এখনো জমা আছে তার শৈশব, তার যৌবন আর তাদের কোলাহল। ইঁদুরগুলো তখন ঘরের ভিতরে খেলা করছে। কী খেলা। ইঁদুর খেলা। ইঁদুর খেলা কী জিজ্ঞেস করে সে গাফফার মিয়াকে।
নিভৃতনীড় বাড়ির নাম। এ বাড়ি থেকে চাকর গাফফার মিয়া বাজারে যাবার জন্য বের হলে জানতে পারা যায় এ বাড়ির কথা। কথাকে কেউ কেউ গল্প বললে বলি এ বাড়ির গল্প। এসব গল্পের কথক এ বাড়ির চাকর গাফফার মিয়া। গাফফার মিয়া এখন কয়েকটা ইঁদুরকে খাওয়াচ্ছে। তারা পোষা ইঁদুর। ইঁদুর পছন্দ করে বাড়ির মালিক আনিসুর রহমান ও আনিসুর রহমানের স্ত্রী রাশেদা বেগম। ইঁদুরদের খাওয়া শেষ হলে গাফফার মিয়া আসে আনিসুর রহমান ও রাশেদা বেগমকে গল্প শোনাতে। বাড়ির বাইরের গল্প, বাজারের গল্প, ইঁদুরদের গল্প। গাফ্ফার মিয়ার চাকরি হয়েছে ভালো গল্প বলতে পারার কারণে। গাফফার মিয়া গল্প জানে—বাড়ির গল্প, বাজারের গল্প, ইঁদুরের গল্প। আনিসুর রহমান জিজ্ঞেস করে খাওয়ার পর ইঁদুরেরা কী করে। গাফফার মিয়া বলে পুনরায় খাওয়ার জন্য তারা দাঁত মাজে। এই বাক্যে আনিসুর রহমান হাসে। তার হাসির শব্দে শৈশবের কোলাহল ও কোলাহলের মাঠ জীবিত হয়। কিছুই মরে না তবে। তার কাছে এখনো জমা আছে তার শৈশব, তার যৌবন আর তাদের কোলাহল। ইঁদুরগুলো তখন ঘরের ভিতরে খেলা করছে। কী খেলা। ইঁদুর খেলা। ইঁদুর খেলা কী জিজ্ঞেস করে সে গাফফার মিয়াকে। গাফফার মিয়া বলে ইঁদুরের পিছনে ইঁদুর, ইঁদুর খেলা। আনিসুর রহমান বলে তবে মানুষের পিছনে মানুষ, মানুষ খেলা। আনিসুর রহমানকে গল্প বলা শেষ হলে গাফ্ফার মিয়াকে গল্প বলতে হয় রাশেদা বেগমকে। রাশেদা বেগম জিজ্ঞেস করে খাওয়ার পর ইঁদুরেরা কী করে। গাফফার মিয়া বলে খাওয়ার পর ইঁদুরেরা পুনরায় খাওয়ার জন্য গৃহ খোঁজ করে। সে সময় ইঁদুরগুলো এক খুঁজে না পাওয়া গর্ত থেকে আরেক খুঁজে না পাওয়া গর্তের দিকে দৌড়াদৌড়ি করে। রাশেদা বেগম অনুভব করে শৈশব থেকে সে গর্তবিদ্যা শিখে এসেছে। তার সে সময় মনে হয় সে গর্ত থেকে বের হতে চেয়েছিল। গাফফার মিয়াকে জিজ্ঞেস করে গর্ত বিষয়টা কী। গাফফার মিয়া বলে এক ঘর থেকে আরেক ঘরের দিকে যাত্রা অথবা অযাত্রা, গর্ত থেকে বের হওয়া কিংবা প্রবেশ করা।
গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে আনিসুর রহমান ও রাশেদা বেগম। গল্প তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। ইঁদুর সারাক্ষণ গল্প তৈরি করতে পারলে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। তারা ঘুমিয়ে পড়লে গাফফার মিয়া বাজারে যায়। প্রতিদিন বাজারে যাবার সময় সে এ বাড়িতে টাঙানো বাড়ি ভাড়া বিজ্ঞাপনটির দিকে তাকায়। কত দিন থেকে এই বিজ্ঞাপনটি টাঙানো আছে জানে না সে। তার এ বাড়িতে আসবার আগে থেকে এ বিজ্ঞাপনটি বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো আছে। অনেকে বাড়ি ভাড়া নিতে আসে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউই এ বাড়িটির তিনতলা ভাড়া নেয় না। গাফফার মিয়া জানে না কী কারণে এ বাড়িটি ভাড়া হয় না। তবে তার ভালো লাগে এই যে, এ বাড়িটি ভাড়া দেওয়া যাবে এই চিন্তায়। তার মনে হয় কারো যদি ভাড়া দেওয়ার কিছুই না থাকে তবে সে দারুণ ব্যর্থ। সবাই নানাভাবে নানা কিছু ভাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে। কেউ তাদের সে সবকিছু ভাড়া দিতে পারছে কেউ ভাড়া দিতে পারছে না। যেমন সে তার কাজ ভাড়া দিচ্ছে, গল্প ভাড়া দিচ্ছে আনিসুর রহমান ও তার স্ত্রী রাশেদা বেগমকে। আনিসুর রহমান ও রাশেদা বেগম তাদের তিনতলার ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছে কিন্তু ভাড়া দিতে পারছে না অথবা কেউ ভাড়া নিচ্ছে না। ভাড়া দেওয়া ও ভাড়া নেওয়ার ভেতরে আছে সফলতা ও ব্যর্থতার গল্প।
৪.
এখন গাফফার মিয়া যাচ্ছে বাজারের দিকে। সকাল হেঁটে যাচ্ছে দুপুরের বাজারের দিকে। গাফফার মিয়ার মনে হয় হঠাৎ এই সময় আজ, সে এ শহরের বাড়িগুলো দেখবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। এ সময় সে দেখে অধিকাংশ বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো আছে বিজ্ঞাপন—বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে এই বিজ্ঞাপন। গাফফার মিয়া খুব বিস্মিত হয় যে সে এত দিন কেন বাড়িভাড়া বিজ্ঞাপন দেখেনি আনিসুর রহমানের বাড়ির বাইরের অন্য বাড়িগুলোতে। তাহলে এ শহরে এত বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে। সে এখন বুঝতে পারে কেন আনিসুর রহমানের বাড়ি ভাড়া হচ্ছে না। যে শহরের এত মানুষ এত বাড়ি ভাড়া দেওয়ার জন্য বিজ্ঞাপন টাঙিয়েছে যে সেখানে বাড়ি ভাড়া দেওয়া সত্যি কঠিন। লোকজন তবে নিজের প্রয়োজনের চাইতে এত এত বাড়ি বানিয়েছে শুধু ভাড়া দেওয়ার জন্য। এখন গাফফার মিয়া বুঝতে পারে মানুষ, হয়তো সকল মানুষ বাড়ি ভাড়া দেওয়ার জন্য বাড়ি বানায়। বাড়ি ভাড়া না দিতে পারলে হয়তো মানুষ নিজেকে প্রচণ্ড ব্যর্থ মনে করে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়ি বানানোর ভেতর এবং ভাড়া দেওয়ার ভেতর রয়েছে সর্বোচ্চ সফলতা। প্রতিটি শহরে তবে রয়েছে প্রয়োজনের চেয়ে অধিক বাড়ি। গাফফার মিয়া আরও খেয়াল করে বাড়িগুলো দেখতে প্রায় একই রকম। স্থপতিরা খুব বেশি জ্যামিতির বৈচিত্র্য জানে না কিংবা জ্যামিতি খুব বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। জ্যামিতি তবে সীমিত রেখা নিয়ে কাজ করে। রেখার গঠন সীমিত। যদি বাড়িগুলো একই রকম হয় তবে বাড়িগুলোকে আলাদা করতে হয় নানা সংখ্যা দিয়ে ও নানা নাম দিয়ে। মানুষের যেমন নাম থাকে এ শহরে বাড়িগুলোরও নাম হয়, নাম থাকে—সংখ্যা দিয়ে, শব্দ দিয়ে। সে কি বাড়ি দেখতে দেখতে বাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সে যাচ্ছে কি বাজারের বাইরে? বাজারের বাইরে যাওয়ার সামর্থ্য কারো না থাকলে সেও বাজারে বাইরে যেতে পারে না। মানুষ যেখানে যায় সেটাই বাজার। আজ সে যাচ্ছে সেই জায়গায় যেখানে আনিসুর রহমানের সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিল। চলে এসেছে সে শহরের তিন মাথায়। এই তিন মাথায় অনেক বছর আগে এক সকালে যখন তার ঘুম ভাঙে তখন দেখা হয় আনিসুর রহমানের সঙ্গে। আনিসুর রহমান তার সঙ্গে কথা বলে নিয়ে যায় তার বাড়িতে চাকর বানাবার জন্য। কোথা থেকে এসেছে গাফফার মিয়া বলেনি সে আনিসুর রহমানকে কিংবা অন্য কাউকে। নিজের গল্প কাউকে বলবে না সে। নিজের গল্প বললে নিজের অস্তিত্ব কোথায়! আসলে জানে সে, কেউই নিজের গল্প অন্যকে বলে না। অন্যের গল্প নিজের নামে চালায় সবাই কিংবা নিজ সম্বন্ধে গল্প বলে বানিয়ে বানিয়ে।
মানুষ যেখানে যায় সেটাই বাজার। আজ সে যাচ্ছে সেই জায়গায় যেখানে আনিসুর রহমানের সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিল। চলে এসেছে সে শহরের তিন মাথায়। এই তিন মাথায় অনেক বছর আগে এক সকালে যখন তার ঘুম ভাঙে তখন দেখা হয় আনিসুর রহমানের সঙ্গে।
তিন মাথায় তিনটা রাস্তা, আর প্রতিটি মাথায় তিনটা করে ইঁদুরের গর্ত। আর কত কত যে ইঁদুর। এ সকল ইঁদুর কোথা থেকে এসেছে, সংখ্যায় তারা কত, জানে না কেউ। এখান থেকে আনিসুর রহমানের বাড়িতে যাবার সময় তার গল্পের সঙ্গী হিসেবে নিয়ে গেছে গাফফার মিয়া কয়েকটি ইঁদুর। আর ইঁদুরের গল্প বলে সে জীবিকা নির্বাহ করছে দিনের পর দিন। গাফফার মিয়া আরও জানে এ শহরের সকল বাড়ির রয়েছে পোষা ইঁদুর, ইঁদুরের শব্দ আর ইঁদুরের গল্প। ইঁদুর পোষার বিষয়ে রাষ্ট্রের আছে সম্মতি, আছে পৃষ্ঠপোষকতা।
আনিসুর রহমান এবং তার স্ত্রী রাশেদা বেগমের শব্দ কমে গেলে, গল্প কমে গেলে তারা ভাড়া করে নিয়ে আসে চাকর গাফফার মিয়াকে। আর গাফফার মিয়া তার সঙ্গে নিয়ে আসে কয়েকটি ইঁদুর, শব্দ আর গল্প তৈরি করার জন্য। আনিসুর রহমান ও তার স্ত্রী জানে শব্দ ও গল্প না থাকলে জীবন কবরস্থান, বাড়ি কবরস্থান। তারা জীবনকে রক্ষার জন্য নিজেদের বাড়িকে রক্ষার জন্য শব্দ ভাড়া করে, গল্প ভাড়া করে। এখন শব্দ আসে ইঁদুরদের খেলা থেকে, গাফফার মিয়ার গৃহে প্রবেশ থেকে। গাফ্ফার মিয়া বাজার থেকে নিয়ে এসেছে বাজারের শব্দ, বাজারের গল্প। গাফফার মিয়া বাজার থেকে এসে জানায় একটা সমস্যা হয়ে গেছে। তাদের বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপনটি চুরি হয়ে গেছে। যদি বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে যায় তবে যারা বাড়ি খুঁজছে তারা কীভাবে জানবে এই বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে। এ ছাড়া কোনো বাড়ি ভাড়া দেওয়া না গেলে বাড়িওয়ালা কী করে জানবে তার বাড়ি আছে। আনিসুর রহমান বাজারের এই শব্দে মন খারাপ করে এবং গাফফার মিয়াকে জানায় যেন সে দ্রুত বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন কোনো বিজ্ঞাপন লেখার দোকান থেকে লিখে নিয়ে বাড়িতে টাঙিয়ে দেয়।
এ শহরে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে লেখার কত যে লেখক আর কত যে তাদের দোকান। তাদের কেউ কেউ বলে কবিতার সাহায্যে তারা লেখে বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন, কেউ কেউ বলে গল্পের সাহায্যে তারা লেখে বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন, কেউ কেউ বলে উপন্যাসের সাহায্যে তারা লেখে বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন, কেউ কেউ বলে পত্রিকার সাহায্যে তারা লেখে বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন, কেউ কেউ বলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাহায্যে তারা লেখে বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন। আর কয়েকজন বলে তারা ইঁদুরের সাহায্যে লেখে বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন। কেউ কেউ বলে তারা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপনী সংস্থা। তারা দেশ ও বিদেশ ভাড়া দেওয়া বিষয়ক বিজ্ঞাপনও লেখে। গাফফার মিয়া ইঁদুর বিজ্ঞাপনে যায় এই ভেবে যে, বাড়ির জন্য তা সবচেয়ে উপযোগী হবে। সে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে এই বিজ্ঞাপন লিখে নেয় ইঁদুর বিজ্ঞাপনী সংস্থা থেকে। আবার টাঙিয়ে দেয় সে সে বিজ্ঞাপন আনিসুর রহমানের বাড়ির দেওয়ালে।
রাত কত। ঘরে আলো নাই। গাফফার মিয়া স্টোররুমে ঘুমাচ্ছে। রাশেদা বেগম আনিসুর রহমানের পাশে ঘুমাচ্ছে অথবা জেগে আছে। ইঁদুরদের শব্দ ভেসে আসছে। এই শব্দ আনিসুর রহমানের কাছে ঘুমের চেয়ে প্রিয় মনে হয়। এই শব্দগুলো যেন পথ, সে এই পথ বেয়ে চলে যাচ্ছে জানা-অজানা, চেনা অচেনা ছায়ার কাছে, আলোর কাছে। এই ছায়াটুকু তার শরীরে আলো দেয়, এই আলোটুকু তার শরীরে ছায়া দেয়। ইঁদুরেরা কীভাবে এ রকম শব্দ করা শিখেছে যা মানুষকে নিয়ে যায় আলো আর ছায়ার যে স্নিগ্ধতা, যে বিশুদ্ধতা—তার কাছে। তার সে সময় মনে পড়ে সংগীতের কথা। সংসারের বিশুদ্ধতম সংগীত সম্ভবত সবচেয়ে ভালো জানে ইঁদুরেরা। আনিসুর রহমান গান ভালোবাসে। সে গান গায় এখনো। রবীন্দ্রসংগীত তার খুব প্রিয়। রবীন্দ্রসংগীতের ভেতর প্রবেশ করার জন্য কত নদীর জলের নিকটে গিয়ে যে সে দাঁড়িয়েছে! সে জেনেছে সকল নদীর জলে গান ভেসে যায়, সুর ভেসে যায়, ভেসে যায় শ্রোতা।
ইঁদুর-দাঁত কেন একজন শিশু হঠাৎ প্রশ্ন করে আলোর ভেতর থেকে। আলোর ভেতরে গেল কীভাবে সে অন্ধ হয়ে যাবে। তাকে অন্ধত্বের কবর থেকে তুলে আনার জন্য তার মা তার প্রশ্ন বন্ধ করে দেয়, অন্ধ করে দেয়। তার মা জানায় তাকে তার দাঁতও ইঁদুর-দাঁত, তার বাবার দাঁতও ইঁদুর-দাঁত।
৫.
আজ ‘বিশ্ব দাঁত ও ইঁদুর রক্ষা দিবস’। এ শহরের হাজার হাজার শিশু ও তাদের বাবা-মা জমায়েত হয়েছে শহরের তিনমাথায়। উৎসব চলছে দাঁত ও ইঁদুর রক্ষা দিবসে। শহরের শিশু ও তাদের বাবা-মাকে সচেতন করার জন্য নানারকম লিফলেট ও বই বিতরণ করা হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারিভাবে। শত শত দাঁতের ডাক্তার যন্ত্রপাতি নিয়ে শিশুদের দাঁত তুলছে আর ইঁদুরের গর্তে ফেলছে। যেন শিশুরা ইঁদুরের মতো দাঁত পায় আর ইঁদুরের মতো কোলাহল করতে পারে গৃহে গৃহে। সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। অনুষ্ঠান মঞ্চের ওপরে বড়ো করে লেখা আছে ‘বিশ্ব দাঁত ও ইঁদুর রক্ষা দিবস’। দাঁত ও ইঁদুর সংস্কৃতি অনুষ্ঠানে চলছে দাঁত ও ইঁদুরবিষয়ক ছড়া, কবিতা আবৃত্তি আর সঙ্গে চলছে শহরের সরকারি ও বেসরকারি শিল্পীদের গান। দাঁত ফেলার বেদনাকে আনন্দে রূপ দেওয়ার জন্য এ সকল ছড়া কবিতা ও গান লেখা হয়েছে। শিশুরা নিজেদের দাঁত ফেলে ইঁদুরদের দাঁত পাবার জন্য প্রার্থনা করছে। এই কথা শিশুরা জেনেছে সকল পুস্তক থেকে ইঁদুরদের দাঁত পৃথিবীর সেরা দাঁত। ইঁদুরদের হাসি পৃথিবীর সেরা হাসি। শিশুদেরকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে ইঁদুরদের দাঁত ও ইঁদুরদের দাঁত পাওয়ার বিষয়ে। ইঁদুর-দাঁত কেন একজন শিশু হঠাৎ প্রশ্ন করে আলোর ভেতর থেকে। আলোর ভেতরে গেল কীভাবে সে অন্ধ হয়ে যাবে। তাকে অন্ধত্বের কবর থেকে তুলে আনার জন্য তার মা তার প্রশ্ন বন্ধ করে দেয়, অন্ধ করে দেয়। তার মা জানায় তাকে তার দাঁতও ইঁদুর-দাঁত, তার বাবার দাঁতও ইঁদুর-দাঁত। ইঁদুর-দাঁতের বাইরে এ শহরের কেউ নাই। এ শহরের সৌন্দর্য ইঁদুর-দাঁতে। এ শহরের দাঁতের ইতিহাস দেখানোর জন্য চলছে নানা সময়ের দাঁতের প্রদর্শনী।
আনিসুর রহমান, তার স্ত্রী রাশেদা বেগম এবং গাফফার মিয়াও এসেছে ‘বিশ্ব দাঁত ও ইঁদুর রক্ষা দিবসে’র উৎসবে। আনিসুর রহমান চাচ্ছিল আরও কিছু ইঁদুর তারা কিনবে তাদের বাড়ির জন্য। কিন্তু এদিন কোনো ইঁদুর বিক্রির স্টল তারা এখানে দেখতে পায় না। তবে ইঁদুরদের খাবারের ও তাদের পোশাকের অনেক স্টল তারা দেখতে পায়। তারা শেষ পর্যন্ত ইঁদুরদের খাবার ও পোশাক নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু বাড়ির সামনে এসেই তারা দেখে বাড়ির বাড়ি ভাড়া বিজ্ঞাপনটি চুরি হয়ে গেছে। তারা আরও খেয়াল করে শুধু তাদের বাড়ির নয় তাদের চারপাশের সকল বাড়ির বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে গেছে। তবে আনিসুর রহমানের বিজ্ঞাপন চুরি যাওয়া বিষয়টি ভালো লাগে। তার ভালো লাগে এই কারণে যে আবার তাকে নতুন করে লিখতে হবে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে। বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে যাওয়া ও পুনরায় তা টাঙানো বিষয়টি তার কাছে একরকম আনন্দময় খেলা মনে হয়। বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে এই শব্দগুচ্ছ তার আয়ত্তে থাকলে তার আনন্দ অলৌকিক। সে জানে সে কখনো তার তিনতলা ভাড়া দিবে না। বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে এই বিজ্ঞাপন সে লেখে এবং টাঙিয়ে রাখে নিজের বাড়ির দেওয়ালে শুধু এই কথা সবাইকে জানানোর জন্য যে তার বাড়ি ভাড়া দেওয়ার আছে। যখন সে অন্যান্য সবকিছু ভাড়া দেওয়া থেকে বঞ্চিত। সে জেনেছে জীবনের ও বইয়ের সকল জ্ঞান থেকে ভাড়া দেওয়ার ভেতরে রয়েছে ব্যক্তির গৌরব, ব্যক্তির অহংকার, ব্যক্তির অস্তিত্ব। কিছু ভাড়া দিতে না পারা মানুষ আসলে অস্তিত্বহীন। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষের এমন কিছুর অধিকার থাকা উচিত যা সে ভাড়া দিতে পারে। পৃথিবীর সকল মানুষ ভাড়া দেওয়ার জন্য আয়ত্ত করে বাড়ি—বাড়ি হতে পারে সত্যিকারের বাড়ি, হতে পারে গল্প, গান, পত্রিকা, কবিতা, দোকান, চেহারা—এ রকম অনেক কিছু।
বিভিন্ন মাধ্যমে এ বিষয়ে আলোচনা চলতে থাকে। অনেকে বলে শহরের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য একটা অপশক্তি বিজ্ঞাপন চুরি করছে। শহরের উন্নতির প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে বিজ্ঞাপন চুরির মাধ্যমে। অনেক অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যানবিদ গবেষণা করে দেখায় যে শহরের অর্থনীতি কী পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাড়ি-ভাড়া বিজ্ঞাপন চুরির মাধ্যমে।
৬.
শহরবাসীর অনুরোধে শহরের মেয়র, শহরের পুলিশ ও গোয়েন্দারা অনুসন্ধানে যায় বিজ্ঞাপন চুরির বিষয়ে। তারা কেউ বুঝতে পারে না কেন বাড়ি ভাড়া বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে যাচ্ছে। তারা প্রথমে এটাকে সাধারণ চুরি মনে করলেও পরে ভাবে এটা সম্ভবত রাজনৈতিক কিছু একটা। হয়তো কোনো রাজনৈতিক দল বিষয়টা ঘটাচ্ছে শহরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্য। বিভিন্ন মাধ্যমে এ বিষয়ে আলোচনা চলতে থাকে। অনেকে বলে শহরের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য একটা অপশক্তি বিজ্ঞাপন চুরি করছে। শহরের উন্নতির প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে বিজ্ঞাপন চুরির মাধ্যমে। অনেক অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যানবিদ গবেষণা করে দেখায় যে শহরের অর্থনীতি কী পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাড়ি-ভাড়া বিজ্ঞাপন চুরির মাধ্যমে। শহরের যারা প্রধান বুদ্ধিজীবী তারা টেলিভিশনের টকশোতে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিতে থাকে প্রতিদিন এবং এ বিষয়ে কলাম লিখতে থাকে জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে। একজন তরুণ সমাজবিজ্ঞানী যে ভবিষ্যতে এ শহরের বুদ্ধির মাথা হবে, সে বাড়ি ভাড়া বিজ্ঞাপন হারিয়ে যাওয়া নিয়ে লিখে ফেলে একটি অভিসন্দর্ভ। সে অভিসন্দর্ভের এক জায়গায় জাতির আবেগ দিয়ে লেখে—বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে যাওয়া মানে আমাদের ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়া, আমাদের লিখিত-অলিখিত সাহিত্য হারিয়ে যাওয়া, আমাদের লিখিত-অলিখিত বক্তৃতা হারিয়ে যাওয়া, আমাদের গাওয়া না গাওয়া গান হারিয়ে যাওয়া, আমাদের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত সংবাদপত্র হারিয়ে যাওয়া।
৭.
এখন রাত। যে রাত ধারণ করে নক্ষত্রপুঞ্জের সৌন্দর্য। আনিসুর রহমান এই রাতে জেগে আছে বিজ্ঞাপন চুরির শব্দ শোনার জন্য। সে জানে সপ্তাহের কোনো এক রাতে তার বাড়ির বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে যায়। বিজ্ঞাপন চুরির সময় যে শব্দ হয় তা তার ভালো লাগে। তার আজকাল মনে হয় বাড়ি ভাড়া বিজ্ঞাপন লিখে টাঙিয়ে দেওয়া এবং তা চুরি হয়ে যাওয়ার যে শব্দ উভয়ই তার ভালো লাগে। বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে যাওয়ার শব্দকে তার সংগীত মনে হয়। বিজ্ঞাপন চোর তবে জানে কীভাবে সংগীত সৃষ্টি করতে হয়। এ শহরে দিনের চেয়ে রাতে বেশি বৃষ্টি হলে রাতকে দিনের চেয়ে মধুর মনে হয়। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আনিসুর রহমান রাতের পথ দিয়ে চলে যাচ্ছে জাগরণের বাইরে।
এখন সকাল। বৃষ্টি নাই। আলো আছে। কিছুই শাশ্বত নয়। না সকাল, না বৃষ্টি, না আলো। তবে বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে গেছে কাল রাতে, যখন আনিসুর রহমান চলে গিয়েছিল জাগরণের বাইরে। এ সকল বিজ্ঞাপন কোথায় যায়—অন্তের দিকে অথবা অনন্তের দিকে। চোরের কথা মনে পড়ে আনিসুর রহমানের। চুরির ভেতরে আনন্দ আছে এই কথা এই সকালে এই বৃষ্টিহীন সময়ে মনে পড়ে তার। সে চুরি করে ফল পেড়েছিল, ফুল তুলেছিল, বাগান দেখেছিল, নারী দেখেছিল—সে সকল আনন্দ জমা রেখেছিল স্মৃতির-বিস্মৃতির গৃহে, গৃহের বাইরে, সংসারের বাইরে।
৮.
বাড়ি ভাড়া বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে যাওয়া একটা বড়ো সমস্যা তৈরি করে এ শহরে। যারা বাড়ি ভাড়া নিতে চায় এবং যারা বাড়ি ভাড়া দিতে চায় উভয়েরই এই সংকট। অনেকে বাড়ি ভাড়া না করতে পেরে আশ্রয়হীন হয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ আশ্রয় ভাড়া দেওয়ার জন্য লোক না পেয়ে অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। এ শহরের কবিরা এ সময় তাদের কবিতায় কয়েকটি বিষয় নিয়ে আসে। এগুলো হলো—বাড়ি, বাড়ি ভাড়া, বিজ্ঞাপন, আশ্রয়। এ সকল কবিরা চিরকাল নিজেদেরকে নিরাশ্রয়ী জ্ঞান করেছে। তারা বলেছে কবিরা চিরকাল নিরাশ্রয়ী। তারা এই কথা ভেবে আনন্দিত হয় যে, আশ্রয় ভাড়া দেওয়া যায়, ভাড়া নেওয়া যায়। যদি আশ্রয় ভাড়া নেওয়া যায়, তবে তারা তা ভাড়া নেবে। কিন্তু সমস্যা এখন এমন যে বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে আশ্রয় ভাড়া নেওয়া যাচ্ছে না। এই যে এখন, একজন প্রেমিক অথবা প্রেমিকা, যে এই শহরের একটা গাছ তলায় অপেক্ষা করছে একজন প্রেমিকা অথবা প্রেমিকের জন্য, যার প্রয়োজন আশ্রয়, সেও আশ্রয় ভাড়া নিতে পারছে না বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে যাবার জন্য। ভালোবাসার বিজ্ঞাপন, প্রেমের বিজ্ঞাপন এ শহরে কত ভাবে যে বিজ্ঞাপিত হয়ে যায়—তাকে তুমি কবিতা বলো, নাটক বলো, গান বলো, উপন্যাস বলো, টাকা বলো, ক্ষমতা বলো, চাকরি বলো, ব্যাবসা বলো—বলো আরও নানা কিছু।
৯.
বিজ্ঞাপন চুরি এ শহরের প্রশাসন ও শাসকদের জন্য একটা হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। মেয়র হান্নান আলী এ শহরের সকল পুলিশকে অন্য শহরে বদলি করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করে। মেয়র আরও আবেদন করে যেন এ শহরে সবচেয়ে দক্ষ পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীকে পাঠানো হয়। এ শহরে ভাবমূর্তি খারাপ হলে সবার জন্যই তা খারাপ। এ শহরে ভাবমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে ইঁদুর-দাঁতসহ আরও কয়েকটা জিনিসের ওপর। আর বিজ্ঞাপন ছাড়া একটা শহর কীভাবে বা টিকে থাকবে তার গৌরব নিয়ে। বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে যাওয়া গৌরব হানিকর ঘটনা মনে করে মেয়র ও তার লোকজন। নতুন পুলিশ বাহিনী আসে, নতুন গোয়েন্দা বাহিনী আসে। তারা সঙ্গে আনে রাত পাহারা দেওয়ার প্রশিক্ষিত কুকুর বাহিনী। এক রাত যায়, দুই রাত যায়, তিন রাত যায়। তারপর রাত গণনা না করতে পারা গেলে পুনরায় বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে যায়—বাড়ি ভাড়া বিজ্ঞাপন। কী আশ্চর্য, কী বিস্ময়কর! দামি কিছুই চুরি করে না এই চোর, শুধু চুরি করে বিজ্ঞাপন। এ সকল বিজ্ঞাপন নিয়ে কী করে সে অথবা তারা। একবার পুলিশের প্রশিক্ষিত একদল কুকুর পুলিশদেরকে নিয়ে যায় শহরের নদীর পারে। যে নদী জমা রেখেছে এ শহরের মানুষের আগমন ইতিহাস, মানুষের গমন ইতিহাস। কুকুরগুলো সেখানে গিয়ে অনেকক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে। পুলিশেরা তখন এক দল জেলেকে ডেকে আনে। জেলেরা জাল ফেলে। কিন্তু নদীর এত গভীরে জাল পৌঁছায় না। তখন ডুবুরিরা আসে। তারা জলে নামে। অনেকক্ষণ পর তারা উঠে এসে জানায়, নদীর গভীরে অনেক বাড়ি-ভাড়া বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে এই বিজ্ঞাপন পড়ে আছে। সবাই স্বস্তি পায় এই ভেবে যে, তাহলে জানা গেল তাদের বাড়িভাড়া বিজ্ঞাপন কোথায় রয়েছে এখন। কিন্তু কীভাবে সেখানে গেল তা তারা বুঝতে পারে না।
নতুন পুলিশ বাহিনী আসে, নতুন গোয়েন্দা বাহিনী আসে। তারা সঙ্গে আনে রাত পাহারা দেওয়ার প্রশিক্ষিত কুকুর বাহিনী। এক রাত যায়, দুই রাত যায়, তিন রাত যায়। তারপর রাত গণনা না করতে পারা গেলে পুনরায় বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে যায়—বাড়ি ভাড়া বিজ্ঞাপন।
এক দিন সকালবেলা—যারা সকাল দেখতে নদীর কাছে যায়, তারা দেখে সে নদীতে একটা লাশ ভেসে উঠেছে। এক দিন বিকেলবেলা—যারা বিকেল দেখতে নদীর কাছে যায়, তারা দেখে সে নদীতে একটা লাশ ভেসে উঠেছে। এক দিন রাত্রিবেলা—যারা রাত দেখতে নদীর কাছে যায়, তারা দেখে সে নদীতে একটা লাশ ভেসে উঠেছে। মানুষের লাশ। কেউ কেউ বলে, যারা নদীর নিকটে যায় তারা বলে, বিজ্ঞাপন কি তবে মানুষের লাশ হয়ে যায়। কেউ কেউ দূর থেকে দাঁড়িয়ে বলে, যারা নদী থেকে দূরে, দৃশ্য থেকে দূরে—যারা বিজ্ঞাপন চুরি করেছে তাদের লাশ এগুলো। নদীর ওপরে পাখি ওড়ে, পাখিও মানুষের মাংস খায় মানুষের মৃত্যু হলে। মৃত মানুষেরা সবকিছু শান্তভাবে নেয় যেহেতু মৃত্যু সর্বদা আকাশগামী।
১০.
ফেসবুক কেমন জনপ্রিয় মাধ্যম, এই প্রশ্ন করে একজন, দুইজন অথবা সবাই। জনপ্রিয় সে নিজের মুখের মতো। জনপ্রিয় সে নিজের ছায়ার মতো। জনপ্রিয় সে আমাদের শহরের প্রতিটি বাড়িতে পোষা ইঁদুরের মতো। যে ইঁদুর গল্প তৈরি করে, শব্দ তৈরি করে আনিসুর রহমান ও তার স্ত্রী রাশেদা বেগমের জন্য কিংবা সবার জন্য। তারপর দেখো ভাইরাল হয়েছে এই খবর, দেখি একজন দশ বছরের বালিকার ফেসবুক পোস্ট। সেই দশ বছরের একজন বালিকা পোস্ট দিয়েছে নিজের ফেসবুকের টাইম লাইনে। গতরাতে শহরের আনিসুর রহমানের বাড়িতে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে বিজ্ঞাপন চুরি করতে গিয়ে একজন চোর তিনতলা থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছে। আর তার স্ত্রী আজ সকালে আমাদের বাড়িতে কাজ খুঁজতে এসেছিল, স্বামী খুঁজতে নয়। অতঃপর দেখি তার থেঁতলানো মাথা ভেসে যায় আমাদের সবার ফেসবুকের বিজ্ঞাপনের নদীতে।
জন্ম ১৯৬৮, কুষ্টিয়ায়। বর্তমানে সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করছেন। লেখেন বিভিন্ন লিটলম্যাগে। সম্পাদিত লিটলম্যাগ : নিজকল্পা। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : জল আসে মানুষের দীঘিতে, মানচিত্রকর, আমাদের গ্রামে একটা পাখিচোর আছে, বিড়াল পোষা প্রতিবেশিনীরা, কোথায় কোথায় ঘুমিয়েছিলাম এবং মেয়াদোত্তীর্ণ নিরাপত্তাসমূহ। উপন্যাস : কেউ মরছে না ।