শীতকালের যমুনা মনটাকে বিষণ্ন করে দেয়। তার জৌলুসহীন রূপ, আমি নিশ্চিত আপনি দেখলেও আপনার মন খারাপ হবে। জল নেমে গেছে অনেকটা দূর পর্যন্ত। চর জেগেছে। নিজের বেদনার কথাগুলো বলার জন্য পাথরের বোল্ডারগুলো যেন তিন চার কোনা মুখ উঁচিয়ে উদাসীন তাকিয়ে আছে। এরই মধ্যে পৃথিবীতে রোদ উঠে গেছে। নদীর জলে সেই রোদের কিরণ ঝলমল করে উঠছে। আর কোথাও নিশ্চয়ই একটা প্রজাপতি একা একাই উড়ে চলেছে। উড়েই চলেছে…
নদীর পাড়ে গেলে এরকম আটকে থাকা লঞ্চ দেখা যায়। তখন নিজের শৈশবকে মনে পড়ে। মামাবাড়ি যাওয়ার স্মৃতি মনে পড়ে। লঞ্চ চলছে… চলছে… চলছে… মামাবাড়ি যেন আরো আরো দূরে সরে যাচ্ছে। মামাবাড়ির বন্ধুরা, সমবয়সী মামা-মাসীরা যেন আরো দূরে সরে যাচ্ছে। পথ ফুরাচ্ছে না।
দুইটি ফুলের দুই দিকে মুখ ঝগড়া পরস্পর।
জীবন যে কতটা আনন্দের নিজেরই চারপাশটায় অন্তর দিয়ে, মমতা দিয়ে না তাকালে আপনি জীবনেও অনুভব করতে পারবেন না। জীবন ভীষণ সুন্দর। কখনও কখনও শীতকালের সরিষা ফুলের মতো।
জীবন আমার ভালো লাগে। অন্যের জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। এক একটি জীবনকে সামনে রেখে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, জীবনের সঞ্চয় কতটুকু হলো?
এইসব দৃশ্য দেখি। আমার শান্তি লাগে।
দেখি, স্নান শেষে এক প্রৌঢ় তার পরনের কাপড় উড়িয়ে দিয়েছে হাওয়ায়। হাওয়ার সে মূলত তার দুঃখ শুকাতে দেয়। নদী পাড়ে এইসব ঘটে। এইসব উড়ন্ত বসনের গল্পের ভেতর জেগে ওঠে যমুনার চর।
যেন ইরানি সিনেমার পর্দা থেকে নেমে এসেছেন তিনি। যেন নদীর পাড় ঘেঁষে বিলি করছেন তার সাইকেলের টুংটাং। মেয়েটা কি তার অপেক্ষায় থাকে রোজ। তিনি কি স্কুলের ঘন্টা পিটিয়ে দিয়ে ছুটে চলেছেন তার নিজস্ব আঙুরলতার কাছে?
অনেক অনেক ছবি তুলতে তুলতে আর দৃশ্য দেখতে দেখতে আমাদের বয়স বেড়ে যায়। আমরা ভোরের আলোয় আইসক্রিম আর রিং চিপসের হলুদ প্যাকেট হাতে নিজেদের আবিষ্কার করি। দেখি, অদূরে চায়ের দোকান। যতন চৌধুরী সেখানে কাঁপা কাঁপা হাতে চা বানায়। যতন বাবুর পৈত্রিক ব্যবসা ছিলো মাছ ধরা। সারা রাত যমুনায় মাছ ধরে সকাল বেলা মতিন সাহেবের ঘাটে যে সাময়িক বাজার বসে, সেখানে ডাকে মাছ বিক্রি করতো। তারা জাতিতে পশ্চিমা। চৌধুরীপাড়ায় তারা প্রায় চল্লিশ ঘর আছেন। সামনের পূজায় যতনের তিন হাজার টাকা চান্দা ধরা হয়েছে। ‘পূজা খুব আমোদেই হবো। এই যমুনাতই বিসজ্জন হবো।’ —বলতে বলতে তার চোখ-মুখে যে খুশির রেখা ফুটে ওঠে, তা দেখে বুঝেছি, এই সুবিধা-বঞ্চিত, তৃণমূল মানুষগুলোর জীবনে খুব সামান্য ঘটনাও অনেক বড় আনন্দের উপলক্ষ্য হয়ে আসে। যমুনার ঢেউয়ের মতোই আবার মিলিয়ে যায় তা। আবার নতুন ঢেউ…
জন্ম ১৯৮৪ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুরে, মামাবাড়িতে। পৈতৃক নিবাস বগুড়া জেলার ধুনটে। চারুকলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। প্রকাশিত বই : অব্যক্ত সন্ধির দিকে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৫], এসো বটগাছ [না-কবিতা; চৈতন্য, ২০১৭], শ্রীদেবী অপেরা [কবিতা, তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ২০১৯], অবিরাম বিস্মরণ [কবিতা, বৈভব, ২০২৩] এবং সম্পাদিত বই শতবর্ষে সত্যজিৎ [শ্রী, ডিসেম্বর ২০২১]। কলকাতা থেকে পেয়েছেন ‘আদম সম্মাননা-২০১৭’। সম্পাদনা করেন ওয়েবম্যাগাজিন ‘শ্রী’।