০১.
রাত শেষ হয়ে যাবে, কথা ফুরাবে না—
আগুনের শিখা নিভে যাবে, দহন ফুরাবে না।
রাষ্ট্র তার বিবিধ ব্যধি নিয়ে যেভাবে ধুঁকতে থাকে
আমরাও নিজেদের ছবি এঁকে, নিজেরাই কেটে দেব না হয়!
এতো ভাবার কিছু নাই। ঝড় আসে বলেই পৃথিবী শান্ত হয়।
তোমার অশান্ত পৃথিবীতে আমি এক শান্ত স্ফটিক—
জেগে আছি বলে গান গাই।
০২.
আমিই সেই আত্মপ্রতারক। সয়ম্ভু পাতার আড়ে চিনচিনে ব্যথার প্রলাপ। দণ্ড তো ভোগ করছিই। যদি পারো সংহারে সংহারে আমাকে দাও সবুজ সোপান। ওগো আয়ু, বলো, কেন সে পতাকারণ্যে মিশে গেছি পূর্বাপর ঠিকানাবিহীন। একদিকে তোমাকে সাজাই, আর দিকে ঘর। এটুকুই প্রবঞ্চনা। মিশে যেতে যেতে যে কালো আলো হয়ে উঠে গেছে নীলে, সেখানে নিজেরই মুখ ছাড়া আর কোনো স্পষ্ট ইশতেহার নেই।
খনন করেছি যত, খুন তত হয়ে গেছি নিজে।
০৩.
ধরো, সকলই সত্য ভেবে তুমি দেখছ পাতার বিন্যাস। ফুল ও ফলের সমাহার— এই দেখায় মিথ্যে যে নেই এটা তোমার অভিজ্ঞতা। আমার কাছে এর সকলই অসত্য হতে পারে। ধরো, তুমি শীতলক্ষ্যা আর আমি বিষণ্ন যমুনা— একে একে ভাসিয়ে দিচ্ছি দেহকীর্তন— ঝুমুর ও প্রলয়ের তালে। যে তোমাকে গোপনে চাবুক চালায়— সে সাইকো বা হীরালাল সেন; যে-ই হোক, আঘাতের কোনো দাগই মিথ্যে নয়। ভালোবাসার প্রতিটি তর্পণের মতো। তোমাকে স্রেফ বেছে নিতে হবে, কে কৃষ্ণচূড়া আর কে পাষাণ-চাবুক।
রাত্রি জাগরণ ভালো নয়। ভালো নয় অনিয়মের দাসত্ব। রঙিন যে ঘুড়ি গড়ে তুলছো, তাকে কোথায় ওড়াবে বলো! কোথায় সে সফেদ আকাশ? মেঘের তাঁবুর ভেতর তোমার যে গোপন কান্না বৃষ্টির সাথে মিশে যায়, তা দেখার জন্যও কেউ থাকতে হয়। থাকতে হয় পাশে বসে পাতার মর্মর শোনার জন্য।
আজ কোথায় সে অনির্বাণ? মহাকাশ ভেদ করা প্রেমিক পাণ্ডব—কোথায়? রাত নামলে কে আর আজ খবর রাখে প্রেমিকের ছদ্মবেশে?
রাত নামছে। রাত্রি জাগরণ ভালো নয়। ভালো নয় খণ্ডিত মিথ্যের ভেতর ফুঁসে ওঠা সাপ, তার বিষ ও বিশল্যকরণী।
০৪.
ফুল তুমি গণিতের সাঁকো।
তোমার ব্যাসার্ধে যে নিপুন মৌমাছি ঘুরে গেল, সে আমি। কেঁপে উঠছি ঘ্রাণের মৌতাতে। আর তুমি, রাজহংস ব্যাতিরেকে আমাকেই কেন ভাবলে নিজস্ব রেনু, এই প্রশ্ন উত্তরহীন। জগত দুইভাগে বিভক্ত। এক ভাগে পঞ্চভূত, আর ভাগে প্রবঞ্চনা। যাবো না যাবো না করেও যখন আত্মা গলে যায়, লুণ্ঠিত হয় দেহ; তখন দর্পনে ভেসে ওঠে ঘরণির মুখ। এই আত্মপ্রবঞ্চনার কথা আমি কাকে বলব? কাকে বলব আগুন কেবল পোড়ায় না, নিজেও পোড়ে। ওই ব্যাস, ব্যাসার্ধ, ফুল ও পাপড়ি তার নিজস্ব কায়দায় আমাকে ডেকে চলেছে আজও। অথচ আমি নিজের দিকেই থাকতে চেয়ে মরে যাচ্ছি জ্বরে।
আমাকে ডেকো না রাই, খুব বেশি খুন হয়ে গেছি।
০৫.
সমর্পণেও যদি মুক্তি পাওয়া যায়! তবে তাই হোক। এই দেখো, কালো বসন্ত, মিথ্যের মঞ্জরি, আর আমার রং করা মুখ। সব নাও। এই দেখো, পুনর্বৃষ্টি, বহু বছরের দ্রবীভূত লোভ, কামনা আর ছল। এসবও নাও। ভয়তাড়িত রাত পার হয়ে এইসব লিখছি। আমাকে কবুল করো।
এই মহুয়ার দেশে আমি কোথা থেকে এসেছি, জানি না। জানি না, কি করে নদী পার হতে হয়। অথচ সমুদ্রে নেমেছি। সুরাপান শেষে আমিই কি বেঁচে থাকি শুধু? আলোর সুরঙ্গ, সে কোথায়? কোথায় গুরুছায়া?
এইসবও নাও।
ওগো আলো, মাতাসুন্দরী, পূর্ণযোগে বসিয়াছি। আমাকে কবুল করো। কবুল করো।
জন্ম ১৯৮৪ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুরে, মামাবাড়িতে। পৈতৃক নিবাস বগুড়া জেলার ধুনটে। চারুকলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। প্রকাশিত বই : অব্যক্ত সন্ধির দিকে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৫], এসো বটগাছ [না-কবিতা; চৈতন্য, ২০১৭], শ্রীদেবী অপেরা [কবিতা, তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ২০১৯], অবিরাম বিস্মরণ [কবিতা, বৈভব, ২০২৩] এবং সম্পাদিত বই শতবর্ষে সত্যজিৎ [শ্রী, ডিসেম্বর ২০২১]। কলকাতা থেকে পেয়েছেন ‘আদম সম্মাননা-২০১৭’। সম্পাদনা করেন ওয়েবম্যাগাজিন ‘শ্রী’।