অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী, যিনি প্রতিটি চলচ্চিত্র, প্রতিটি চরিত্রে তাঁর দক্ষতা প্রমাণ করেছেন, ‘হিরোপান্তি ২’-এ খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। তাঁর চরিত্র, লায়লা সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে, অভিনেতা বলেন, ‘খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করার সময় আমি সবসময়ই আমার চরিত্রে একটি মেয়েলি ছোঁয়া দিতে চেয়েছিলাম। আমি মনে করি এটি চরিত্রটিকে খুব ভীতিকর করে তুলেছে। থিয়েটারের দিন থেকেই এটি আমার মনে ছিল এবং সেই ইচ্ছা ছিল। আমার কথা শেষ পর্যন্ত সত্য হয়েছে হিরোপান্তি ২-এ।’
নওয়াজউদ্দিন বলেন, তিনি সিনেমার প্রেমে পড়েছিলেন এবং তিনি সবসময়ই একজন অভিনেতা হতে চেয়েছিলেন, তারকা নয়। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এনএসডি (ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা) ছাড়ার পর যখন আমি আমার ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে ভাবতাম, আমি যে ধরনের চরিত্র করতে চাইতাম, সে সবই এখানে পাচ্ছি।’
‘হিরোপান্তি ২’-এ সুপারস্টার টাইগার শ্রফ এবং তারা সুতারিয়া নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর সাথে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। ছবিটি ২৯ এপ্রিল প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। সিনেমাটি মুক্তির আগে, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী মিডিয়ার সাথে একটি বিশেষ আলাপ করেছিলেন, যেখানে তিনি তাঁর স্ক্রিপ্ট নির্বাচন প্রক্রিয়া, স্টারডম, বড়ো বাজেটের প্যান-ইন্ডিয়া ফিল্ম এবং আরও অনেক কিছু সম্পর্কে অকপটে কথা বলেছিলেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ফ্লিল্মিবিটের পক্ষে নীতি সুধা। শ্রী-র জন্য ভাষান্তর করেছেন বিধান সাহা।
প্রশ্ন: নতুন বাংলোর জন্য অভিনন্দন। মুম্বাইতে আপনার নিজের একটি বাংলো— ভাবতে কেমন লাগে?
নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী: (মুচকি হেসে) সত্যি বলতে আমি এমন মানুষ নই যে বাড়ি বা বাংলো নিয়ে বেশি চিন্তা করি। কেউ আমাকে সেই জায়গাটি দেখিয়েছিল এবং আমি ভেবেছিলাম ভালোই তো, তৈরি করাই যায়। আমি যখন সেখানে স্থানান্তরিত হলাম, আমার আগে বড়ো রুম ছিল, কিন্তু আমি সেখানে ঘুমাতে পারিনি। তারপর আমি আমার বিছানা বাংলোর সবচেয়ে ছোটো ঘরে স্থানান্তরিত করি। ওই ঘরে মাত্র একটি খাট ও দুটি চেয়ার রয়েছে। এখন, আমি সেখানেই ঘুমাই।
প্রশ্ন: অভিনেতা হওয়ার পর আপনি কি আপনার পুরনো স্বাভাবিক জীবনকে মিস করেন?
নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী: আজকে যদি এভাবে একা বাইরে যাই, অটো বা ট্রেনে যাতায়াত করি, সেই সময় নিজেকে স্বাভাবিক মনে হয়। আমার মনে হয় আমি শ্বাস নিতে পারছি। আমার পৃথিবী আমার কাছে এমনই। আমি রঙিন দুনিয়া থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করি। বিলাসিতা একটি মরীচিকা এবং এর বেশি কিছু নয়। আমি সত্যিই শখ হিসাবে বিশেষ কিছু করতে, বা, দামী জামাকাপড় এবং জুতা পরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তা হয়নি।
প্রশ্ন: লকডাউনের দিনগুলিতে আপনি কি মুম্বইয়ের বাইরে ছিলেন?
নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী: হ্যাঁ, আমি দেরাদুনে একটা জায়গা দেখেছিলাম। একটা পাহাড়ের উপর একটা রিসোর্ট। আগে তিন-চার মাস একাই থাকতাম। তারপর মাকে ডাকলাম, বাকিটা সময় তাঁর সঙ্গেই থাকলাম। অনেক মুভি দেখা হয়েছে।
প্রশ্ন: আপনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে গত ৩ মাসে আপনি ২০০টি স্ক্রিপ্ট পেয়েছেন, যার মধ্যে আপনি ৫টি বেছে নিয়েছেন। স্ক্রিপ্ট বা চরিত্র বেছে নেওয়ার সময় আপনি কী কী বিষয় মাথায় রাখবেন?
নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী: একটি ফিল্ম বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমার মাপকাঠি হলো গল্পটি কতটা চরিত্র-চালিত তা দেখা। আমি আমার চরিত্র এবং তার চারপাশের পৃথিবী দেখি। গল্প যে কোনো কিছু হতে পারে। আমি যখন এমিসের জন্য নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম, তখন সারা বিশ্ব থেকে মনোনীত আরও চারজন অভিনেতা ছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ডেভিড টেন্যান্ট, যিনি বিজয়ীও হয়েছিলেন। তার অভিনয় দেখেছি। সেই সিরিজের গল্প ছিল— রেলওয়ে ইয়ার্ডে একটা খুন হয়, পুলিশ এসে কাছের একটা বাড়িতে গিয়ে খোঁজ খবর নেয়। ওই বাড়িতে একজন মানুষ থাকেন। পুলিশ তাকে জিজ্ঞেস করে যে এখানে একটা খুন হয়েছে, আপনি কি এ বিষয়ে কিছু জানেন! তখন সে বলে, মাত্র একটা! আমি ১৬টা খুন করেছি। তারপর বাকি ৩টি পর্বে সে শুধু থানায় বসে আছে এবং পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তাই গল্পটা এখানে বিশেষ কিছু নয়, পুরো সিরিজে শুধু তিনিই বলছেন কিভাবে তিনি এটা করেছেন, কিন্তু তার অভিনয় দক্ষতা দিয়ে পুরো গল্পটিকেই আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। আমি এই ধরনের চরিত্র পছন্দ করি।
আজকাল, এখানে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে ফিল্মটিকে জমকালো দেখানোর জন্য, এবং মানুষ তা পাগলের মতো দেখছেও। আমার চিন্তা সম্পূর্ণ বিপরীত। আমি বিশ্বাস করি গল্প কিছু নাও হতে পারে, কিন্তু একজন অভিনেতা, বিশ্বস্ততার সঙ্গে চরিত্রটিকে দাঁড় করাবেন। আজকাল অদ্ভুত জিনিস দেখানো হচ্ছে, জাহাজ উড়ানো, প্লেন ডুবিয়ে দেওয়া.. আমিও মাঝে মাঝে এই ধরনের ফিল্ম করি, কিন্তু আমি এটা বিশ্বাস করি না। আমি একটি চরিত্র-চালিত গল্প করতে চাই, কারণ এটি একজন ব্যক্তির মন পড়ার, কারও চিন্তাভাবনা জানার সুযোগ করে দেয়।
প্রশ্ন: আপনি কঙ্গনা রানাউত প্রযোজিত একটি চলচ্চিত্রও করছেন৷ অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী: কঙ্গনা একজন অসাধারণ প্রযোজক। তিনি সেটে এত সুন্দর পরিবেশ তৈরি করেছিলেন যে সমস্ত অভিনেতারা খুব আগ্রহ নিয়ে কাজ করেছিলেন। আমি নিশ্চিত যে এটি অবশ্যই চলচ্চিত্রেও প্রতিফলিত হবে।
প্রশ্ন: সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে, অক্ষয় কুমার বলেছিলেন যে ‘ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ৭০ ভাগ ভাগ্য কাজ করে এবং ৩০ ভাগ কঠোর পরিশ্রম’, আপনি এর সাথে কতটা একমত?
নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী: আমি এটা বিশ্বাস করি না। আমি ১০০ ভাগ পরিশ্রমে বিশ্বাস করি। আমি বলছি না যে তিনি ভুল, তবে আমার অভিজ্ঞতা অনুসারে, আমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে তা কোনো অলৌকিক বা ভাগ্য দ্বারা হয়নি। আমি যত বেশি পরিশ্রম করেছি, তত বেশি সাফল্য এসেছে।
প্রশ্ন: আপনি কোনো পারিশ্রমিক না নিয়েও কিছু সিনেমা করেছেন। আজকের জীবনে টাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী: প্রথম থেকেই আমি মনে মনে ভেবেছিলাম যে ‘মে পায়সে কো আপনা গুলাম বানাউঙ্গা, উসকা গুলাম না বানুঙ্গা’। নিজেকে এতটা যোগ্য করে তুলুন যে টাকা আপনার গোলাম হয়ে যায়। আমি সিনেমা ভালোবাসি, টাকা নয়। মান্টোর জন্য আমি কোনো পারিশ্রমিক নেইনি, যদি এরকম আরেকটি ছবি পাই, তাও পারিশ্রমিক ছাড়াই করব।
প্রশ্ন: অভিনেতা হিসেবে আপনি কি কখনও ইন্ডাস্ট্রিতে নিরাপত্তাহীন বোধ করেন?
নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী: আমি করি না, কারণ আমি যে চরিত্রগুলি করতে চাই তা পাচ্ছি৷ এজন্য চলচ্চিত্র শিল্পকে ধন্যবাদ। এনএসডি ছাড়ার পর সামনের জীবন নিয়ে যেভাবে ভেবেছি— …কী ধরনের ভূমিকা করব, সে সব করার সুযোগ পাচ্ছি। মান্টো, ঠাকরে, নো ল্যান্ডস ম্যান, সিরিয়াস ম্যান এবং হিরোপান্তির মতো ছবিও পাচ্ছি।
প্রশ্ন: বাস্তব জীবনে কখনো ‘হিরোপান্তি’ করেছেন? যদি কোনো গল্প শেয়ার করতে পারেন।
নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী: (হেসে) আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমাকে অনেক মার খেতে হয়েছে। আমার বয়স তখন ১৭-১৮, যখন আমরা সবাই মাঠে ক্রিকেট খেলছিলাম। আরও কিছু ছেলেও সেখানে এসেছিল, কিন্তু আমি অনড় ছিলাম আমরা খেলব, আমাদের দল আগে খেলবে। তাই সামনের লোকটি প্রথমে আমার দিকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত তাকাল, তারপর আমাকে অনেক মারধর করল। তারপর থেকে আমি আর কোনো বীরত্ব দেখাইনি।
জন্ম ১৯৮৪ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুরে, মামাবাড়িতে। পৈতৃক নিবাস বগুড়া জেলার ধুনটে। চারুকলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। প্রকাশিত বই : অব্যক্ত সন্ধির দিকে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৫], এসো বটগাছ [না-কবিতা; চৈতন্য, ২০১৭], শ্রীদেবী অপেরা [কবিতা, তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ২০১৯], অবিরাম বিস্মরণ [কবিতা, বৈভব, ২০২৩] এবং সম্পাদিত বই শতবর্ষে সত্যজিৎ [শ্রী, ডিসেম্বর ২০২১]। কলকাতা থেকে পেয়েছেন ‘আদম সম্মাননা-২০১৭’। সম্পাদনা করেন ওয়েবম্যাগাজিন ‘শ্রী’।