আমার প্রেমিকাদের অভিযোগ ছিল, আমি নাকি তাদের বান্ধবীর দিকে বেশি নজর দিতাম।
এটা শুনে আপনাদের হাসি আসতেই পারে। কিংবা যারা আমাকে চেনে তারা বলবে, ঠিকই তো বলত। আর আমার স্ত্রী সুমি শুনলে তো বলবে, এর জ্বলন্ত প্রমাণ আমি নিজে।
যাই হোক, আমার বিরুদ্ধে প্রথম এই অভিযোগ এনেছিল নাহিদা। সে ছিল আমার কলেজ জীবনের প্রেমিকা। সবাই যখন কলেজ ড্রেস পরে ক্লাসে যেত আমি তখন মিরপুরের বিএন কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম।
এমন লুইচ্চাদের মতো কথা বলো কেন তুমি? তুমি তো একটা খাস লুইচ্চা। পড়াশোনা করো না, মেয়েদের কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকো। তোমার কলেজ নাই? ক্লাস নাই?
নাহিদা ওই কলেজেই পড়ত। নাহিদা আমাকে তেমন একটা ভালোবাসত বলে মনেই হতো না, এখনও মনে হয় না। যেমন, আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নাহিদা এমন এক ভেঙচি কাটত যে মনে হতো সে মহা বিরক্ত।
—তুমি এখানে কী করো?
—তোমাকে দেখতে আসলাম।
—সারারাত ফোনে কথা বলো আবার দেখা-দেখির কী দরকার?
—ফোনে তো দেখা যায় না।
এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে নাহিদা খেপে যেত।
—এমন লুইচ্চাদের মতো কথা বলো কেন তুমি? তুমি তো একটা খাস লুইচ্চা। পড়াশোনা করো না, মেয়েদের কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকো। তোমার কলেজ নাই? ক্লাস নাই?
এসব যা তা বলে কলেজের গেটের ভেতর ঢুকে যেত। মাঝে মাঝে নাহিদার ক্লাসমেট রুমানা আসত আমাকে দেখতে। সে আসত বার্তা বাহক হয়ে। বলত, নাহিদা আজ দেখা করবে না। কিংবা বলত, তোমার উপর মহা খেপা, তুমি কেন নিজের ক্লাস বাদ দিয়ে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকো?
এভাবে আস্তে আস্তে আসল প্রেমিকার থেকে বার্তা বাহকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক জমে ওঠে। যেমন, একদিন হুট করে রুমানা বলল— তোমার ফোন নম্বরটা দাও তো।
তখন অবশ্য মোবাইল ফোন ছিল না। ছিল ল্যান্ড ফোন।
তো, রাত গভীর হওয়ার আগেই রুমানা আমাকে ফোন দিত। তার অন্যতম কারণ হলো— রাত গভীর হলে নাহিদার সঙ্গে আমার কথা বলা শুরু হবে। তাই তার আগেই রুমানার সঙ্গে ফোলাপ সেরে ফেলতাম।
রুমানা ফোন দিয়ে সারাক্ষণ আবেগের কথা বলত। সে দেখতে সুন্দর না, একটু বেটে তাই কোনো ছেলেই তাকে ভালোবাসে না— এই ধরনের কথাবার্তা।
আমি রুমানাকে বোঝাতাম, না না অবশ্যই তোমার ভালোবাসার মানুষকে তুমি একদিন ঠিকই পেয়ে যাবে।
তো, একদিন রুমানা বলে বসল, ইশ তুমি নাহিদাকে কত ভালোবাসো। এমন কেউ যদি আমাকেও ভালোবাসতো তাহলে এই জীবনে কিছুই চাওয়ার ছিল না।
তখন একটু খটকা লাগত। মনে হতো রুমানা বোধহয় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে খেয়াল করলাম শুধু রুমানা না আমিও দুর্বল হতে শুরু করেছি। কারণ নাহিদা তো আমাকে পাত্তাই দেয় না। পর মানুষের মতো আচরণ করে। রুমানা যেমন ফোন দিয়েই বলত, ভাত খেয়েছে?
তখন একটু খটকা লাগত। মনে হতো রুমানা বোধহয় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে খেয়াল করলাম শুধু রুমানা না আমিও দুর্বল হতে শুরু করেছি। কারণ নাহিদা তো আমাকে পাত্তাই দেয় না। পর মানুষের মতো আচরণ করে। রুমানা যেমন ফোন দিয়েই বলত, ভাত খেয়েছে?
—না খাইনি। খিদে নেই।
—মানে কী? যাও এখনই ভাত খাও। খেয়ে আমাকে ফোন দাও। আমি অপেক্ষা করছি।
এমন প্রশ্ন নাহিদা কখনো আমাকে করেনি। যদিওবা মাঝে মাঝে করত। আমি যদি বলতাম, না খাইনি। তখন বলে বসত, থাক আর খাইয়ো না। খাইয়া খাইয়া তো ভুড়ি বানাইতেছো। ভুড়িয়ালা ভাদাইম্মা হইতাছো দিন দিন।
আমাকে আঘাত করে কষ্ট দিয়ে নাহিদা কেমন যেন বিকৃত এক সুখানুভূতি লাভ করত। আচ্ছা মানুষ কেন মানুষকে কষ্ট দিয়ে কথা বলে? বলতে পারেন?
যাই হোক, এভাবে একসময় দেখা গেল রুমানার সঙ্গে কথা বলার সময় আমার দীর্ঘ হতে লাগল। আর নাহিদার সঙ্গে কথা বলার সময় কমতে থাকল। তাদের কলেজের সামনে গেলে নাহিদা পাত্তা দিত না, কিন্তু রুমানা ঠিকই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আমার সঙ্গে চিড়িয়াখানায় হাঁটতে হাঁটতে গল্প করত।
আমি যে রুমানার সঙ্গে কথা বলছি এটা নাহিদা একদিন টের পেল। সেদিন রাতে আমাকে ধরল।
—খুব তো রুমানার সঙ্গে জমাইয়া দিছো? খুব পিরিত লেগেছে দুজনের, হা।
—এটা কোন ধরনের কথা? রুমানা ভালো মেয়ে। বাজে কথা বলো কেন?
—ওরে বাবা! খুব লেগে গেছে গায়ে? খুব ভালো মেয়ে! চিড়িয়াখানায় দুজন একসঙ্গে হাঁটো। বান্দর দেখো, বাঘ দেখো, ভাল্লুক দেখো। রাত জেগে জেগে দুজন মিলে আকাশের চাঁদ দেখো। তাই না?
আমি নাহিদার কথা শুনে চুপ করে থাকি।
একদিন নাহিদা আমাকে বলল, তুমি আর আমাকে ফোন দিবা না। তোমার মতো ফালতু লুইচ্চা ছেলের সঙ্গে আমি কোনো সম্পর্কে জড়াব না।
আমি কেন যেন অযাচিত মনে বিষয়টা মেনেই নিলাম। কারণ তখন রুমানার সঙ্গই ভালো লাগত। আর তাছাড়া তখন মনে প্রশ্ন জেগে উঠত, আচ্ছা নাহিদা কি আমাকে ভালোবাসত? ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে দিনের পর দিন কেউ কি এত বাজে আচরণ করে?
এদিকে রুমানা কেন নাহিদার প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলে এটা নিয়ে বান্ধবীদের মধ্যে তোলপাড়। তাই মোটামুটি রুমানাকেও গ্রুপ থেকে আউট করে দিল নাহিদারা। এটা নিয়ে রুমানা আমার উপর খুব চড়াও।
—নাহিদা রাগ তো করবেই। আসলেই তো দোষ আমারই। আমি কেন অন্যের বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলব। ছি ছি! আমি ওর জায়গায় হলে তো একই কাজ করতাম। মুনির প্লিজ আমাকে আর ফোন দিও না।
এই যে রুমানা ফোন রাখল আর ধরল না। নাহিদাও ধরল না।
আমি বর্তমান ও সম্ভবনাময় দুটি প্রেমই হারালাম।
এভাবে আমার হারিয়ে ফেলার গল্প অনেক। বলে শেষ করা যাবে না।
এই গল্পটা মৌনতাকে নিয়ে। সেও আমার এক প্রাক্তন প্রেমিকার বান্ধবী ছিল।
তবে মৌনতার বিষয়টা ছিল ভিন্ন। সে ছিল আমার বন্ধু। তার বান্ধবী মাহমুদা।
মৌনতার সঙ্গে আমার কোনো প্রেমের সম্পর্কই ছিল না। একবার এক আড্ডাতে মৌনতা নিয়ে আসে মাহমুদাকে। দেখি কী অপরূপ এক সৌন্দর্য যেন চারপাশ দখল করে বসল। কাজল দেয়া মেয়েটির টানা টানা চোখে এক ধরনের স্থিরতা আছে। মনে হয়, চোখটা কী যেন ভাবে সারাক্ষণ। এমন মগ্ন হওয়া চোখ প্রথম দেখেছিলাম। অবসন্ন মন যেন হারিয়ে যায় সেই চোখে।
মৌনতাকে অনেক পটিয়ে মাহমুদার ফোন নম্বর নিলাম। বারবার বলছিল, আরে ওর একটা ছেলের সঙ্গে কথা হয়। মনে হয় প্রেম, স্বীকার করে না।
আরে ধুর। প্রেম থাকুক। আমি মাম্মা ফোন দিলে, কথায় এমন ঝড় তুলব যে সব বাতাসে উড়ে যাবে।
এরপর মাহমুদার সঙ্গে আমার আলাপ শুরু ফোনে। সে কী আলাপ। দিন নেই রাত নেই শুধু গল্প আর গল্প। ফোনের বিল নিয়ে এদিকে প্রতি মাসেই বাসায় হাঙ্গামা। আব্বা কডলেস ফোন তুলে আদি কালের চাক্কা ঘুরানো এনালগ ফোনটা অবার লাগাল। তাও ওনার রুমে। আমিও তো কম যাই না। বাইরের তার কেটে ডুয়েল লাইন টেনে নিজের রুমে নিয়ে আসলাম। তারটা এমনভাবে রাখলাম যেন না বোঝে। বাইরে থেকে তারটা এসে ডায়নিং রুমে ক্যাবলিং করা ছিল। সেখান থেকে তার গেছে আব্বা-আম্মার রুমে। তো, রাতে বেলা মূল ক্যাবেলটা খুলে দিতাম। যেন রাতে কথা বলা যায়। মাহমুদার সঙ্গে কথা বলা থেমে নেই।
মাহমুদা অবশ্য নাহিদার মতো ছিল না। তবে কেমন একটা মাদকতা ছিল ওর মধ্যে। দেখা গেল কথা নেই বার্তা একদিন হুট করে কেঁদে দিল। জিজ্ঞেস করতাম, আচ্ছা তুমি কাঁদছ কেন?
মাহমুদা অবশ্য নাহিদার মতো ছিল না। তবে কেমন একটা মাদকতা ছিল ওর মধ্যে। দেখা গেল কথা নেই বার্তা একদিন হুট করে কেঁদে দিল। জিজ্ঞেস করতাম, আচ্ছা তুমি কাঁদছ কেন?
কোনো জবাব দিত না। শুধু কেঁদেই যেত।
কথা শুরু হওয়ার তিন চার মাস পর হুট করে একদিন বলল, আমাকে তোমার কেমন মেয়ে মনে হয়?
আমি একটু হোঁচট খেলাম। এমন প্রশ্ন তো ভেবে দেখেনি। তারপরও ত্বরিৎ মনে যা আসলো বলে ফেললাম।
—তুমি খুবই উদাসীন আর ভাবুক ধরনের মেয়ে। অনেক চাপা স্বভাবের। কিছু শেয়ার করতে চাও না। সবসময় নিজের ভেতর নিজেকে গুটিয়ে রাখো।
এটা বলার পর একটু হেসে উঠল মাহমুদা। জিজ্ঞেস করলাম, হাসো কেন? ভুল বলেছি মনে হয়।
—কী জানি। তোমাকে আজকে কিছু কথা বলি। তার আগে প্লিজ তুমি এসব মৌনতার সঙ্গে শেয়ার করো না।
—আচ্ছা, ঠিকাছে। আর তোমার সঙ্গে কী কথা হয় তার কিছুই আমি মৌনতাকে বলি না।
—খুব ভালো। শেয়ার করাও উচিত না। আমার একজনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। সম্পর্কটা ঠিক ভালো কিছু না। খুব খারাপ একটা সম্পর্ক। বলতে পারো একটা ফিজিক্যাল রিলেশন।
এটা শুনে আমার মনে হলো যেন সাত আসমান থেকে পড়েছি। ভাবছিলাম প্রেম জাতীয় কিছু হবে। এখন তো দেখি সে পুরা ফিজিক্যাল রিলেশনের কথা বলে।
আমি একটু ঢেকুর গিলে বললাম, বলো।
—ওই লোকটা আমার টিউটর ছিলেন। এসএসসিতে আমাকে ম্যাথ পড়াতেন। কীভাবে কীভাবে যেন আমার তার সঙ্গে এমন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। আমার বাসা তো খালিই থাকে। বাবা-মা চাকরি করেন। উনি বিকেলে পড়াতে আসতেন। একদিন কী মনে করে যেন উনি হঠাৎ আমার বুকে হাত দিয়ে বসলেন। আমি চমকে উঠলাম। চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। অবিরাম ঘামতে থাকি। শরীরটায় যেন এক তীব্র বেগে বিদ্যুৎ চমকে গেল। আমারও ওনার প্রতি একটা দুর্বলতা ছিল। তাই বাধা দিইনি। হাতাহাতি উনি এরপর কনটিনিউ করলেন। আমি যেহেতু কিছু বলি না, প্রতিবাদ করি না তাই উনি আরও আগালেন। আগাতে আগাতে আমাদের মধ্যে একটা শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। আমি ভাবতাম উনি হয়তো আমাকে ভালোবাসেন। কিন্তু পরে দেখলাম, না, ওনার আসলে আগ্রহ আমার শরীরে। আমি খুব চেষ্টা করছি এই সম্পর্কটা থেকে বের হতে। কিন্তু কোনোভাবেই পারছি না। উনি ব্যাচেলার ফ্ল্যাটে থাকেন। কয়েক বন্ধু মিলে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া থাকে আর কী। আমাকে প্রায়ই ওই ফ্ল্যাটে ডাকেন। উনি ডাকলেই আমি আর নিজেকে সামলাতে পারি না। যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা বাঁশিতে ফু দিয়েই চলেছে। আমি আর আমার মধ্যে থাকি না। আটকে রাখতে পারি না। মনটাকে আটকে রাখলেও শরীরটা দৌড়ে চলে যায়। এখন বুঝি আমার একটা ফিজিক্যাল চাহিদাও তৈরি হয়ে গেছে। উনি বললেই দৌড়ে চলে যাই হয়তো এ কারণেই। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি এখান থেকে বের হতে চাই। খুব ঘেন্না হয় নিজের দিকে তাকালে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় আত্মহত্যা করি।
এসব বলেই আবারও কাঁদতে থাকে মাহমুদা।
আমি তখন মাত্র কলেজ ছাত্র। এত গভীর মনোবেদনা আমাকে স্পর্শ করেনি, করেছে শুধু বিস্মিত হওয়ার মতো এক ঘটনা। আমি কথা বলার মতো শক্তি অর্জন করতে পারিনি। এখন এই বয়সে এসে বুঝি একটা মেয়ে কী পরিমাণ মানসিক চাপে ছিল, কী বেদনা ভর করে ছিল মনে। তাই তো তার চোখজোড়ায় ছিল না তারুণ্যের কোনো উচ্ছ্বাস, ছিল না কোনো অনুভূতি। চোখে ছিল একরাশ স্থিরচিত্র। যে চিত্রটা ছিল ভয়ংকর মর্মস্পর্শী একটা গল্পমাত্র।
কিন্তু আমি তো তখন কলেজ ছাত্র। বয়স কম। আমার কেন যেন মাহমুদাকে ভয়ও করতে লাগল। মনে হলো এই মেয়ে তো মেন্টাল কেস। এর সঙ্গে প্রেম কেন, কোনো সম্পর্কেই আগানো যাবে না।
২.
গল্পটা তো মৌনতার। মৌনতা ছিল আমার খুব কাছের বন্ধু। একদম জিগরি দোস্ত যাকে বলে। যার সঙ্গে এই শহরে আমি রিকশা দিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি, বৃষ্টিতে ভিজে আইসক্রিম খেয়েছি। যার সঙ্গে সকল অপরাধও করেছি। যেমন ধরেন, আমরা লুকিয়ে সিগারেটেও টান মেরেছি। মৌনতা আর আমি ছিলাম কৈশোর বেলার দুরন্তপনার সঙ্গী। তবে কখনো আমাদের মধ্যে প্রেম-টেম টাইপ সম্পর্ক ছিল না।
এটা ভুল হবে বললে, আমার তো পুরুষের মন। পুরুষ তো নারীদের একটু সঙ্গ পেলেই প্রেম-প্রেম ভাব ধরতে চায়। আমার মনে মাঝে মাঝে ঠিকই লাল গোলাপ উঁকি দিয়েছিল। সেটা অস্বীকার করব না। কিন্তু সাহসে কুলায়নি। এত ভালো বন্ধুটা যদি হারিয়ে যায়! এই ভয় সারাক্ষণই কাজ করেছে।
এইচএসসি পাস করে মৌনতা চলে গেল লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে। আমি রয়ে গেলাম এই ঢাকা শহরেই, একা। এই যে লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। এদেরই আমি একজন ছিলাম। যাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খোদ সরকারও কখনো ভেবে দেখেনি। অদ্ভুত সিলেবাসে নিম্নমানের পড়ালেখার পরিসরে পড়ে কতজন কীভাবে জীবন সংগ্রাম করছে তার হদিছ তো জানে না কেউ। তো, আমিও এই সিলেবাসের পড়ায় ঢুকে পড়লাম। মৌনতার সঙ্গে কোনো যোগাযোগই রইল না। হয়তো দুজনের মধ্যেই যোগাযোগ রাখার কোনো তাড়নাই ছিল না। চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল— কথাটা তো সাধে সাধে আসেনি।
মৌনতার সঙ্গে আমার আবার দেখা হয় অনেক পরে। সেটা ২০১৩ সালে। শাহবাগে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে হাজার হাজার লোক দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছিল সেখানে আমিও ছিলাম। হঠাৎ একদিন দেখি আমার পাশে এক মেয়ে এসে বলছে, ওই হারামি কেমন আছিস?
হারামি শব্দটা শুনেই চমকে উঠি। ওমা, এ দেখি মৌনতা! মুহূর্তে আমার মধ্যে বিদ্যুৎ চমকে ওঠে।
মৌনতা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, দোস্তো কত্ত বছর পর তোরে দেখতেছি। ফেসবুকে তোরে কত খুঁজলাম কিন্তু পাইলামই না। এমন এক বন্ধু তুই যে মিউচ্যুয়াল ফ্রেন্ডও নাই। আজব!
আমি তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কী হচ্ছে। এত বছর পর আমার বান্ধবী মৌনতা আমার চোখের সামনে। খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম।
স্লোগানের চিৎকারের ভেতরই আমি মৌনতাকে বললাম, চল টিএসসির দিকে যাই এখানে কথা শোনা যাচ্ছে না। মৌনতার সঙ্গে তার আরও দুই বান্ধবী ছিল।
—আজ না দোস্তো, আজ থাক। কাল আসিস। এখন বাসায় যাব।
আমাকে যাওয়ার সময় মোবাইল নম্বর দিয়ে গেল। আর ফেসবুকেও অ্যাড করে নিলাম।
রাতে বাসায় ঢুকে দেখি ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে মৌনতার ম্যাসেজ।
—বন্ধু তোরে কতদিন পর দেখলাম। খুব মিস করেছি তোকে জানিস?
—কচু মিস করেছিস। একবারও খোঁজার চেষ্টাও করলি না।
—তুইও তো করিস নাই।
—তুই কি এখন ব্যারিস্টার? দেশে কবে আসলি? কবে যাবি আবার?
—না বন্ধু ব্যারিস্টার আর হই নাই। এলএলবি করে এলএলএম করেছি। তবে আর ফিরছি না। দেশেই প্র্যাকটিস করব ভাবছি।
—বলিস কী? বিলেত থেকে কেউ ফেরত আসে নাকি?
—আর বলিস না, ব্রিটেনে স্যাটেল হওয়া অনেক কঠিন। দেশের মগাগুলো বুঝে না। দেশের জীবনটাই সুন্দর, পরিপাটি। বিদেশে সব পাবি, খালি পাবি না কোনো সম্পর্ক। আচ্ছা কাল কখন থাকবি শাহবাগ? আমিও আসছি। আড্ডা দেব।
—অফিস শেষ হবে পাঁচটায়। তারপর যাব। ছয়টার মধ্যে পৌঁছে যাব।
—ওকে। আমিও থাকব। তুই কোথায় চাকরি করছিস?
—আমি একটা পত্রিকার মার্কেটিংয়ে আছি।
—ঠিকই আছে। তুই যেমন চোপাবাজ, মার্কেটিংই তোর পেশা হওয়া উচিত। যাক, কাল দেখা হচ্ছে। বাই।
সেই আমাদের আলাপ শুরু হলো আবার। পরদিন আমরা শাহবাগ গিয়ে চুটিয়ে আড্ডা দিলাম। মৌনতার সঙ্গে তার আগের দিনের দুই বান্ধবীও ছিল। সেদিন আমি মাহমুদার কথাও জিজ্ঞেস করলাম। মৌনতা বলল, ও-মা তুই জানিস না? মাহমুদা তো সুইসাইড করেছে বছর তিনেক আগে।
এটা শুনে বুকের ভেতর ছেৎ করে উঠল। বললাম, বলিস কী? আমি তো জানি না।
—ওহ! মেয়েটা অনেক ফ্রাস্ট্রেশনের মধ্যে দিন কাটিয়েছে। ওর এক টিউটর ছিল জানিস? ফিজিক্যালি এবিউজ করত। হারামিটা বিয়ে করেছিল আরেক মেয়েকে। কিন্তু মাহমুদাকে ছাড়েনি। তার সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে গেছে। মেয়েটাও একটা হদ্দরাম। পোলা বিয়ে করেছে এখন ছেড়ে দে, কিন্তু না ছাড়ে নাই। লেগেই ছিল। ভাবত কোনো একদিন হয়তো ছেলে তাকে বিয়ে করবে। এসব নিয়ে মানসিক স্ট্রেসে ছিল। একদিন সকালে তার মা রুমে গিয়ে দেখে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে।
—তোরা এত কিছু জানলি কীভাবে?
—ওর ছোটো ভাই লন্ডনে পড়তে এসেছিল। সেই বলেছে। মাহমুদার ডায়েরি থেকে জেনেছে। ওরা নাকি মামলাও করতে চেয়েছিল ওই বদমায়েশটার বিরুদ্ধে। কিন্তু মেয়ের মা দেয়নি। বলল, মেয়ে তো চলে গেছে আর এসব ফ্যাশাদে জড়িয়ে সমাজ জানিয়ে কী লাভ। আমি ওর ভাইকে সরাসরি বলেছি, তোমরা এটা ভুল করলে। এ ধরনের লোকদের শাস্তি অবশ্যই দরকার। তা না হলে এরা পরে আরেক মেয়েকে এভাবে অ্যাবিউজ করবে।
সেদিন বাসায় আসার পর আমার খুব মাহমুদার কথা মনে পড়তে থাকল। মনে হলো, আহারে মেয়েটা কী পরিমাণ মানসিক অত্যাচার সহ্য করে আত্মহত্যা বেছে নিল। আমি হয়তো পারতাম তখন তার পাশে থেকে ওই বদ লোকটার হাত থেকে রক্ষা করতে।
ভাবতে থাকলাম, মাহমুদা যেদিন এই প্রসঙ্গে বলেছিল, তখন থেকেই কি আমি তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম?
মনেই করতে পারছিলাম না। এত আগের কথা মনে থাকে কী করে? তবে এক অদ্ভুত বিষণ্নতা আমাকে ঘিরে রাখল। খুব চেষ্টা করলাম মাহমুদার সেই মুখটা মনে করার। আবছা আবছা সামনে আসে। কী সুন্দর, পরিচ্ছন্ন মুখ, কী অপূর্ব চোখ মেয়েটার। উফ! খুব খারাপ লাগছিল।
এরপর মৌনতার সঙ্গে আমার আবার খুব আড্ডা জমতে থাকল। শাহবাগ, ধানমণ্ডি আমরা আবার ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। আর স্মৃতিমন্থন। কোথায় আমাদের কী স্মৃতি, কোথায় কলেজ পালিয়ে এসে আড্ডা দিতাম ইত্যাদি ইত্যাদি।
তো, এরপর মৌনতার সঙ্গে আমার আবার খুব আড্ডা জমতে থাকল। শাহবাগ, ধানমণ্ডি আমরা আবার ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। আর স্মৃতিমন্থন। কোথায় আমাদের কী স্মৃতি, কোথায় কলেজ পালিয়ে এসে আড্ডা দিতাম ইত্যাদি ইত্যাদি।
মৌনতার সঙ্গে আবারও যোগাযোগ কমে আসে ওই বছরের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবের পর। সেদিন মৌনতা রাস্তায় হুজুরদের বেপরোয়া ভাব দেখে ব্যাপক ভয় পেয়ে বাড়ি চলে গেল। পরদিন ঢাকা শহরের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে আমাকে মোবাইলে মেসেজ দিয়ে বলল, দোস্ত আর বের হবো না এখন। দেশের অবস্থা যে কোন দিকে যাচ্ছে বোঝা মুশকিল।
হেফাজতের তাণ্ডবের কয়েকমাস পর নির্বাচন সামনে আসতে থাকল। আর বিএনপির পেট্রোল বোমা হামলায় যখন এই শহরে আমরা বাসে চড়া যাত্রীরা আতঙ্কে দিনযাপন শুরু করলাম তখন যোগাযোগই বন্ধ হয়ে গেল মৌনতার সঙ্গে। আর দেখা হলো না, কথাও কমে আসতে থাকল। আর মৌনতা একজন সিনিয়র ব্যারিস্টারের চেম্বারে কাজও পেল। সেখানে নিজের ক্যারিয়ার উন্নতিতে লেগে গেল জোরে সোরে। মাঝে মাঝে ফেসবুক ইনবক্সে মেসেজ দিলে দেখা যেত একদিন পর জবাব আসত, বন্ধু আমি অনেক ব্যস্ত। পরে কথা হবে।
যাইহোক, মৌনতার সঙ্গে দুই বান্ধবী আসত আগেই বলেছি। তাদের মধ্যে একজন হলো সুমি। আমার সর্বশেষ প্রেমিকা। যাকে আমি বিয়ে করেছি। মৌনতাকে বুঝতেই দেইনি সুমির সঙ্গে আমার চুটিয়ে প্রেম চলছে। মৌনতা বিষয়টা টের পায় অনেক পরে। প্রায় বছর দেড়েক পরে। কিন্তু আমাকে কিছুই বলেনি। সুমিকেও শুধু বলেছে, তোরা এমন লুকিয়ে প্রেম করলি কেন? আমাকে জানালে পারতি।
সুমি খুব সাধারণ মেয়ে। খুব সাধারণ মানে একদমই সাধারণ। এই জগৎ সংসারে সে কোনো খোঁজই রাখে না। সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত সুমি কেন যেন মৌনতা আর আমার বন্ধুত্ব সম্পর্কটাকে স্বাভাবিকভাবে নিত না। খালি খোঁচা দিত আমাকে। আমার মাঝে মাঝে খারাপও লাগত। তারপরও কিছু বলতাম না। মৌনতা না থাকলে সুমি আমার জীবনে আসত?
তো, আমাদের বিয়ের দাওয়াত দিতে মৌনতাকে ফোন দিলাম একদিন। সে ফোন ধরেই বলল, জানি বিবাহের দাওয়াত দিতে ফোন দিছ। আমি তো তোমার বন্ধু না। আমারে দাওয়াত দেয় তোমার হবু বউ। আমি বিয়াতে যামু, বউভাতে যামু না। তুই বন্ধু না। তুই একটা হারামি। আজীবন অন্যের বান্ধবীর দিকেই নজর দিয়া গেলি।
আমি খুব লজ্জায় বললাম, দোস্ত সত্যিই খুব লজ্জা পাচ্ছি। আর লজ্জা দিস না। তুই ছাড়া আমার কি আর ভালো বন্ধু আছে বল?
—খুব তেল মারানি শিখছোস। শালা মার্কেটিং টাউট। আমি আসব বলছি, কিন্তু বউভাতে যাব না।
মৌনতা সত্যি সত্যি বউভাত অনুষ্ঠানে আসেনি। বিয়েতে এসেছে। অনুষ্ঠানে এসে মৌনতা আমার দিকে একবারও তাকায়নি। কথাও বলেনি। সুমিকে জড়িয়ে ধরেছে। কানে কানে কী কী যেন বলেছে। যা সুমি আজও আমাকে বলেনি।
যাইহোক, আপনারা এখনও বলতে পারেন, আসলে মৌনতার গল্প কেন বলছি।
মৌনতা এখন আইসিইউতে আছে। এজন্যই বলছি।
২০১৯ সালে চীনের উহানে করোনাভাইরাস নামে এক মরণব্যাধী হানা দিল। আর ধীরে ধীরে আগুনের শিখার মতো ছড়িয়ে পড়ল দেশে দেশে। সেই শিখার ছটা তো আমার দেশেও এসে লেগেছে। হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মানুষের উপর। আর এই শিখা আঘাত করল মৌনতা ফুসফুসে।
কিছুদিন আগে হঠাৎ মৌনতা আমাকে ফেসবুক ইনবক্সে লিখল, দোস্ত আমি করোনা পজিটিভ।
তাকে সাহস দিয়ে বললাম, সো হোয়াট? তুমি এখনও কচি আছো। কিছুই করতে পারবে না করোনা।
মৌনতা একটা হাসির ইমো পাঠাল।
এর তিন চারদিন পর মৌনতা আবার ইনবক্সে মেসেজে বলল, দোস্ত আমার অক্সিজেন লেভেল ফল করেছে। ৭৯-তে নেমে গেছে। হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছি, দোয়া রাখিস।
এর তিন চারদিন পর মৌনতা আবার ইনবক্সে মেসেজে বলল, দোস্ত আমার অক্সিজেন লেভেল ফল করেছে। ৭৯-তে নেমে গেছে। হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছি, দোয়া রাখিস।
আমি কিঞ্চিৎ ভয় পেলাম। তবুও সাহস রাখার জন্য বললাম, কোনো সমস্যা নেই বন্ধু। অক্সিজেন লেভেল ঠিক হয়ে যাবে।
পরদিন মৌনতা আবার আমাকে মেসেজ দিল। বলল, অক্সিজেন লেভেল এখন ৯১ আছে।
—গুড।
—তোকে খুব মিস করছি দোস্ত।
আমি একটা হাসির ইমো দিলাম।
—আমাকে ভুলে গেছিস না? খুব হিসেব করে কথা বলিস। সুমি রাগ করবে?
—রাগ করবে কেন?
এবার মৌনতা হাসির ইমো দিল।
—তুই সবসময় আমার বান্ধবীর দিকে নজর দিলি। আমি দেখতে কি খুব খারাপ ছিলাম?
—তুমি তো মহা সুন্দরী। তার উপর অ্যাডভোকেট মানুষ। নজর দেয়ার লায়েক তো ছিলাম না দোস্ত।
—ঠিক বলেছিস।
তার পরদিন আবার ইনবক্সে মৌনতা।
—দোস্তো আমি মনে হয় বাঁচব না।
—বলেছি না কচিদের করোনা কিছু করতে পারে না।
—আরে না, যাকে ধরে তাকে খেয়ে দেয়। কচি বুড়া বিষয় না।
মৌনতা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আমিও চুপ করে থাকি। ভাবতে থাকি, সত্যি সত্যি কি মৌনতার অবস্থা খুব ভালো না?
এর কিছুক্ষণ পর মৌনতা লেখে, তুই কোনোদিন আমাকে বুঝলি না। সেই কলেজ থেকে আমি কত চেয়েছি তুই আমাকে প্রপোজ কর, কিন্তু করলি না। পরে এত বছর পর দেখা হলো কত খুশি হয়ে ভেবেছিলাম এবার অন্তত তুই আমাকে প্রপোজ করবি। আমাকে ভালোবাসবি, আমার কাছে আসবি, শুধু আমার হবি। তুই কিছুই বুঝলি না। তুই সবসময় আমার বান্ধবীদের দিকেই নজরটা দিলি। কখনো আমার চোখের দিকে তাকালি না। আমার চোখভরা যে শুধু তুই ছিলি এটা কোনোদিন তুই বুঝলি না। তোদের সঙ্গে আর কোনোদিন আমার দেখা আর কথা কিছুই হবে না। তুই ভালো থাকিস। সুমিকে দেখে রাখিস। আমি বোধ হয় বাঁচব না। আমাকে কেবিন থেকে যে কোনো মুহূর্তে আইসিইউতে নেয়া হবে। আমার ফোনটা হয়তো আব্বুকে দিয়ে দিতে হবে। তোকে কখনো কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করে দিস।
এমন একটা মেসেজ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে পড়ি। যেন, আকাশের চাঁদটা আমার হাতের মুঠোতেই ছিল কিন্তু স্পর্শ করার অনুভূতি টের পাইনি। এক অপরাধবোধ ক্রমশ আমাকে জড়িয়ে ধরতে থাকে, উথাল-পাতাল হতে থাকে ভেতরে। আমি এরপর কয়েকবার বেশ কয়েকটা মেসেজ দেই মৌনতাকে কিন্তু কোনো সাড়া নেই। মেসেজ সিনও হয় না। আমি সুমিকে ফোন দিয়ে জানাই।
বিষাদভরা একটা মন নিয়ে ঘরে ফিরি। রাতে সুমির সঙ্গে কোনো কথা হয় না। আমার ঘুমও হয় না। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকি মৌনতার সঙ্গে কাটানো আমার সকল সুখের সময়গুলো। কী উত্তাল কৈশোর ছিল আমাদের।
হঠাৎ মনে আসে একদিন তুমুল বৃষ্টিতে আমি আর মৌনতা রিকশার হুড তুলে বসে থাকি। বৃষ্টিকে আটকানোর প্লাস্টিক জাড়িয়ে রাখি। ঠিক এমন সময় মেঘের গর্জনে মৌনতা চমকে ওঠে। আমার ভেতর তুমুল আবেগ খেলা করে। আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। চোখ ঘোলা হতে শুরু করে। হঠাৎ মৌনতার ঠোঁটে আলতো স্পর্শ করি আমি। এই স্মৃতি যেন আমার মনের গহীনের কোটর থেকে বের হয়ে পড়ে। মৌনতা সেদিন কিছু বলেনি। মেনে নিয়েছিল। সেটাই ছিল কৈশোরে আমার সঙ্গে মৌনতার শেষ দেখা। তারপর দিন মৌনতা চলে যায় লন্ডন। হয়তো কিছু আশা করেছিল আমার কাছে। হয়তো আশা করেছিল আমি যোগাযোগ রাখব, হয়তো চেয়েছিল আমি আমার ভালোবাসার কথা মৌনতাকে জানাব। আর আমি বন্ধুত্ব নষ্ট করার অপরাধে, এক অপরাধবোধে, ভয়ে কুকড়ে গিয়ে মৌনাকেই ভুলে যাই। মনের গহীনে সে সন্ধ্যার গোপন কথাটি শুধু জানতাম আমি আর মৌনতা। আর কেউ নয়।
পরদিন সুমি নিজ থেকে বলে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। তাকে বলি, আমি তো জানি না সে কোন হাসপাতালে আছে। সুমি জানায়, সে জানে। আমরা দু’জন দ্রুত রওনা দেই কুর্মিটোলা হাসপাতালে। ততক্ষণে সব শেষ। বাইরে সুমি ও মৌনতার অন্য বন্ধুরা দাঁড়িয়ে। একটা ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স ধরে দাঁড়িয়ে আছে মৌনতার বাবা। নিঃস্ব বিধ্বস্ত বাবা দাঁড়িয়ে আছে, মুখে মাস্ক চোখে গোগলস। আহারে…
সেই রাতে সুমি আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি। দুজন দুপাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে ছিলাম। সুমি বাসায় এসে আমার ফেসবুকে মেসেজ করেছে। সেখানে লেখা, আমাকে ক্ষমা করে দিও। মৌনতা আমাকে বলেছিল তোমাকে বোঝাতে। তোমাকে জিজ্ঞেস করতে, সেদিন সন্ধ্যার ঘটনা তুমি ভুলে গেলে কী করে? মৌনতা তোমাকে ভালোবাসত। চাইত নিজ থেকে তুমি বলো। আমি এক বড়ো বিশ্বাসঘাতক। আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দিও।
সুমির মেসেজে আমার কিছু যায় আসে না। আমি তখনও সেই সন্ধ্যায় আটকে আছি। মৌনতার চোখটা তখনও বন্ধ ছিল। কী অসীম প্রেম ছিল সেদিন আমাদের। আমি কি তবে কাউকেই বুঝতে পারিনি? না মাহমুদাকে, না মৌনতাকে, না সুমিকে…
গল্পকার ও গবেষক। জন্ম সার্টিফিকেট অনুযায়ী ১৯৮৭ সালের ৬ নভেম্বর। আদতে সালটি হবে ১৯৮৩। পড়াশোনা করেছেন ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ থেকে। ২০১০ সালে ইলেকট্রনিক অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ও ২০১৩ সালে মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। বর্তমানে বাংলা ট্রিবিউনের গবেষণা বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: ‘কয়েকটি অপেক্ষার গল্প’ (২০১১), ‘এই ঘরে কোনো খুনি নেই’ (২০১৬), ‘খাঁচাবন্দি মানুষেরা’ (২০১৯)। গবেষণাগ্রন্থ: ‘শাহবাগের জনতা’ (২০১৫)। কিশোর উপন্যাস: ‘নাতাশা ও ডানপিটে নুসরাত’ (২০২০)।