এই গভীর রাতে অনেকদিন পর খুব সুন্দর বৃষ্টি হলো। অনেকটা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ গল্পের মতো বৃষ্টি, সারারাত ঝুমঝুম। চারপাশে এক অদ্ভুত মেলানকোলিক আবহ আর বাতাসে বাতাসে কে যেন লিখে যাচ্ছে এলিজি। খুব খেয়াল করলে শোনা যায় পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ, পাতার ফাঁকে ফাঁকে মনে হয় কিছু মেঘ আড়ি পেতে আছে। কী অদ্ভুত মন কেমন করা রাত, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে আছে ব্যাঙ ও ঝিঁঝিঁর কোরাস। এমন রাত জীবনে খুব কমই আসে।
বৃষ্টির সাথে প্রেমের ব্যাপারে ঘটকালী করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, খুব শৈশবে কিংবা তারও অনেক আগে যখন আমি কেবল হাঁটতে শিখেছি, তখন কোনো এক বৃষ্টির দিনে কলোনির মাঠে সারা শরীরে কাঁদা মেখে কী অদ্ভুত খেলা খেলেছিলাম, এখনও আবছা আবছা মনে পড়ে। মা সেদিন খুব বকা দিয়েছিল, এখনও দেয় তবে সেই উন্মাদনার কোনো তুলনা হয় না। একটু বড়ো হওয়ার পর মায়ের ইচ্ছেতেই পরিচয় হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সাথে, শিখেছিলাম গান। ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে’ কিংবা ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ গাইতে গাইতেই হয়তো এই ষড়ঋতুর দেশে আমি অন্য সব ঋতুকে উপেক্ষা করে পড়েছিলাম বৃষ্টির প্রেমে। হুমায়ূন আহমেদও আত্মজীবনীতে বৃষ্টিকে অদ্ভুতভাবে গ্লোরিফাই করেছেন আর শৈশবে এতো হুমায়ূন পড়েছি, বৃষ্টিকে ভালো না বেসে আমার কোনো উপায় ছিল না।
শুধু বৃষ্টির দিনেই না, যে কোনো মন খারাপের দিনে, যখন ‘আম্মা বলেন পড়রে শোনা, আব্বা বলেন মন দে’ পাঠে আমার মন বসে না, কাঁঠালচাঁপার গন্ধে’ তখনও বইয়ের পাতা খুলে পড়েছি একটা রচনা, ‘বর্ষণমুখর সন্ধ্যা’।
শুধু বৃষ্টির দিনেই না, যে কোনো মন খারাপের দিনে, যখন ‘আম্মা বলেন পড়রে শোনা, আব্বা বলেন মন দে’ পাঠে আমার মন বসে না, কাঁঠালচাঁপার গন্ধে’ তখনও বইয়ের পাতা খুলে পড়েছি একটা রচনা, ‘বর্ষণমুখর সন্ধ্যা’। ঐ সন্ধ্যার জন্য কতো কতো দিন অপেক্ষা করেছি, আম পাকার দিনে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ভেবেছি আর কিছুদিন তারপরেই তো বর্ষা। ঝড়ের দিনে আম কুঁড়াতে কুঁড়াতে কীভাবে কেটে গেলো শৈশব! তবু মনে পড়ে, বৃষ্টি দিনের কথা, ‘মধু-গন্ধে ভরা মৃদু-স্নিগ্ধছায়া নীপ-কুঞ্জতলে’ যে বর্ষা আসে তাকে কী ভুলে থাকা যায়?
বর্ষার দিনগুলোতে স্কুলে যেতাম না, যেন বৃষ্টি হলে স্কুলে যাওয়া মানা। তবে স্কুলে না গেলেও মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে কীভাবে যেন চলে যেতাম খেলার মাঠে, রবি ঠাকুর বারবার ঘরের বাইরে যেতে মানা করলেও আমাদের ফুটবল খেলা তিনি থামাতে পারেননি। ঈশানকোণে কালো হয়ে যে মেঘ আসে তারা যেন আমাদের পরম বন্ধু। কদম-কামিনীর ঘন সৌরভ আমাদের মাতাল করার জন্য ছিল যথেষ্ট, আহা, কীসব দিন গিয়েছে! এখনও মেঘে ঢাকা স্নিগ্ধ আকাশের দিকে তাকালে মনে পড়ে, কলেজের পুকুরে ডুবসাঁতার, জলের ভেতর বল ছুঁড়ে ছুঁড়ে চোর চোর খেলা।
আমি অতোটা র্যাশনাল তো কখনওই ছিলাম না। অনেকেই আছে আমার দলে। যখন বৃষ্টি নামে শহর জুড়ে আর সকলেই খুঁজে বেড়ায় নিরাপদ আশ্রয় তখনও আমার মতো কেউ কেউ বৃষ্টিতে ভেজে, যারা ভেজে তাদের কী যে আপন মনে হয়। মনে পড়ে চ্যাপলিনের বলে যাওয়া সেই অমর কথা, ‘I always like walking in the rain, so no one can see me crying’। বয়স যতো বাড়ল, বৃষ্টি ততো নতুন নতুন রূপে দেখা দিল জীবনে। এই কসমোপলিটন জীবনে, কোনো এক বৃষ্টির দুপুরে হুডখোলা রিক্সায় প্রেমিকাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার যে আনন্দ তা তো প্রেমিক মাত্রই জানে। আবার বিরহের শুরুও হয় বৃষ্টির দিনে, আকাশ কালো হয়ে এসেছে, মেঘ ডাকছে আর তখন মনে পড়ছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট নারীর মুখ, এইতো বৃষ্টি কিংবা প্রেমের সারসংক্ষেপ। বয়সের সাথে সাথে বৃষ্টির চেহারা বদলে যায় তবে যা থাকে তা স্মৃতি। ধুলো পড়ে, আবছা হয়ে যায় তবুও ভেতরে ভেতরে খোঁচায় কখনও কখনও।
ছবি নিয়ে বিশেষ কী বলব জানি না। ছোটোবেলায় আমার খুব ক্রিয়েটিভ কিছু করতে ইচ্ছে করত, কখনও লিখব তখনও জানতাম না, কবিতা চিরকালই আমার কাছে বড্ড শক্ত বিষয় ছিল, পড়তেই ভালো লাগতো না, লেখা তো দূর কী বাত!
কথা ছিল, কথা বলব ছবি নিয়ে, কিন্তু ছবির বিষয় যখন বৃষ্টি তখন আর ঐ র্যাশনালিটি মেইনটেন করা সম্ভব হলো না। ছবি নিয়ে বিশেষ কী বলব জানি না। ছোটোবেলায় আমার খুব ক্রিয়েটিভ কিছু করতে ইচ্ছে করত, কখনও লিখব তখনও জানতাম না, কবিতা চিরকালই আমার কাছে বড্ড শক্ত বিষয় ছিল, পড়তেই ভালো লাগতো না, লেখা তো দূর কী বাত! মনে মনে তখন অবশ্য অনেক হাতি-ঘোড়া মারতাম, স্বপ্ন ছিল বড়ো হয়ে ফিল্মমেকার হবো; ইচ্ছে যে এখনও নেই তা না, হবে হয়তো কখনও। কিন্তু, বড়ো হতে হতে দেখলাম কিছুই হওয়া হচ্ছে না। সিদ্ধান্ত নিলাম এমন একটা বিষয়ে পড়াশুনা করতে হবে যার সাথে ক্রিয়েটিভিটির সম্পর্ক আছে, ভর্তি হলাম মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজমে। বাসায় অনেক ভুজুংভাজুং দিয়ে কিনলাম ক্যামেরা, করলাম কিছু কোর্স, এইতো এভাবেই ছবি তোলার শুরু। সালটা ২০১১। তবে যা হয় অন্য অনেককিছুর মতো ছবি তোলা নিয়ে আমি কখনও সিরিয়াস হতে পারিনি, কে জানে কেন! ছবি তুলতে ভালো লাগত কিংবা এখনও লাগে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই হয়ে গেলাম শখের ফটোগ্রাফার। এদিকে কবিতারাও আসতে শুরু করল মনে, কী অদ্ভুত! আমিও লিখতে পারি! আবার তখন মাথায় সিনেমার ঝোঁক, কতো বড়ো বড়ো ডিরেক্টরের সিনেমা দেখছি, আর এভাবে একদিন পরিচয় হলো কিয়ারোস্তামির সাথে। চেরির স্বাদ নিতে নিতে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম তার লং শট, ফ্রেমিং। এতো পোয়েটিক ভাবেও যে গল্প বলা যায় কিয়ারোস্তামির সাথে পরিচয়ের আগে আমি জানতাম না। এদিকে আমি কবিতার সাথে তখন শুরু করেছি সংসার। এরপর যখনই ছবি তুলতে যেতাম তখনও মাথার ভেতর একটা বোধ কাজ করত— ছবি তুলতে হবে পোয়েট্রির মতো করে। রুল অব থার্ডকে আমি খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম। ঐটুকু একাডেমিক ব্যাপার মাথায় রেখে, বাকি সব ঝেড়ে ফেলে তুলেছি কিছু ছবি। সেসব পাতে তুলে দেওয়ার মতো হয়েছে কি না সেসব নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আমার আছে। ছবিতে আমি আসলে গল্পই বলতে চাই। কার কাছ থেকে যেন ছবি নিয়ে একটা গল্প শুনেছিলাম। গল্পটা ছিল অনেকটা এমন, একদিন একটা সেটে পৃথিবীর পাঁচজন ফেমাস ফটোগ্রাফারকে এনে পাঁচটা টপিক দিয়ে ছবি তুলতে বলা হয়েছিল, পাঁচজনের জন্যই ছিল সেইম প্রফ, সেইম লাইট, সেইম মডেল, সেইম সেট, সেইম ক্যামেরা, সেইম লেন্স। পাঁচজন নিজের মতো এসব ব্যবহার করে তুলেছিল ছবি আর সবশেষে যখন পাঁচটা ছবি পাশাপাশি রাখা হলো, দেখা গেল পাঁচটা ছবি পাঁচ রকম গল্প বলছে। আমি যখন ছবি তুলি, তখন এমনই গল্প বলতে চাই, চেয়েছি চিরকাল।
যেহেতু ছবিগুলো বৃষ্টির, আর আমি আপাদমস্তক বৃষ্টিপ্রেমী— তাই বৃষ্টি নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করার লোভটুকু সামলাতে পারলাম না। ছবির মাধ্যমে গল্প বলতে চাই আর পাঠক হিসেবে আমার ভালো লাগে ঐসব গল্প যা বিমূর্ত, যা কখনও শেষ হয়েও শেষ হয় না
বৃষ্টি নিয়ে এতো কথা বলার পিছনে কারণ আসলে এটাই, ‘শ্রী’ আমার তোলা বিশটা বৃষ্টির ছবি প্রকাশ করছে। বিধান দা’কে বলেছিলাম, প্রত্যেকটা ছবির সাথে একটা করে ফটো স্টোরি কিংবা আর্টিস্ট স্টেটমেন্ট অ্যাটাচ করে দেবো। কিন্তু, যেহেতু ছবিগুলো বৃষ্টির, আর আমি আপাদমস্তক বৃষ্টিপ্রেমী— তাই বৃষ্টি নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করার লোভটুকু সামলাতে পারলাম না। ছবির মাধ্যমে গল্প বলতে চাই আর পাঠক হিসেবে আমার ভালো লাগে ঐসব গল্প যা বিমূর্ত, যা কখনও শেষ হয়েও শেষ হয় না, তাই আলাদা করে কোনো গল্প দিলাম না। ছবিগুলো যারা দেখবেন, আশাকরি তারা নিজের ইচ্ছেমতো গল্প তৈরি করে নিতে পারবেন। আর যদি না পারেন তাহলে সেটা অবশ্যই ফটোগ্রাফার হিসেবে আমার ব্যর্থতা।
‘পোস্টার অব টাইম’ সিরিজে আমি ছবি তুলি। ছবি তো সময়ের পোস্টার বটেই, অনেক অনেকদিন পর যখন পুরনো অ্যালবাম কেউ খুলে বসে, তখন তার মনে পড়ে যায় কতো স্মৃতি! ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। অনেক বেদনার মধ্যে থেকেও পুরনো ছবি দেখতে দেখতে তার মনে হতেই পারে, আহা, ওইদিন, অন্তত ওই এক মুহূর্তের জন্য হলেও আমি কতো সুখে ছিলাম!
বৃষ্টি বিষয়ক সিম্ফনি কিংবা পোস্টার অব টাইম
জন্ম ২ ডিসেম্বর, ১৯৯১; বরিশাল। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় স্নাতক। পেশায় সাংবাদিক। প্রকাশিত বই : মৃত্যুর মতো বানোয়াট [কবিতা; ২০১৭] থাকে শুধু আলেয়া [কবিতা;২০১৯], হিম বাতাসের জীবন [গল্প ;২০২০], উদাসীনতা, সঙ্গে থেকো; [উপন্যাস; ২০২১] ই-মেইল : dhrubonahid@gmail.com