মা
শীতের সকাল। বারান্দায় গ্রিলের পাশে আমি চমৎকার রোদে বসে আছি। না না, রোদ্দুরটা সুন্দর বলিনি কিন্তু। চমৎকার আমার নাম, এ-গল্পও এক বেড়াল-ফ্যামিলির। আজ মানুষের রোববার, কিন্তু বেড়ালের ক্যালেন্ডারে লেখা, ‘দেরিতে ব্রেকফাস্ট’। মনুষ্যজাতির মধ্যে যারা অফিসবাবু, ছুটির দিনে আটটার আগে তো বিছানা ছাড়েন না। আর সেই জন্যেই এখনও পর্যন্ত বিবিলের দেখা নেই, পাড়া টহল দিতে বেরিয়েছে। বাচ্চা মানুষ, স্যরি বেড়াল, খিদেও বেশি। তবে শুধু বয়সের দোষ দেব কেন, বিবিলের ফিগারটাও মাথায় রাখা দরকার। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কসরত করতে গেলেই তারা আমার কাছে এসে কমপ্লেন ঠোকে : ছেলেকে সামলাও। আমরা সব তিন কেজি বিভাগের কুস্তিগির, অথচ বিবিল সাড়ে পাঁচ কিলো চেহারা নিয়ে লড়তে আসছে। আমাদের ঘাড় মটকে যাবে না!
বুন্নি গেমস খেলতে খেলতে হয়তো জিজ্ঞেস করল, ‘বল তো এবার কোন বাটনটা টিপতে হবে?’ অমনি সে অ্যাত্তোখানি পায়ের থাবায় ভুল বোতাম প্রেস করে দেয়। বুন্নি হেসে ফেলে, ‘তুই একরকমই থেকে গেলি, বোকা বোকা লম্বা, সংক্ষেপে বি বি এল, মানে…উঁ উঁ…আমার বিবিলসোনা’।
মনের এই হতাশায় বেচারা আরও বেশি মানুষ-ঘেঁষা হয়ে পড়েছে। আমাদের আস্তানা, মানে এই দত্তবাড়ির ছোটো মেয়ে বুন্নির ল্যাপটপের দিকে সারাক্ষণ হা করে তাকিয়ে বসে থাকে। বুন্নি গেমস খেলতে খেলতে হয়তো জিজ্ঞেস করল, ‘বল তো এবার কোন বাটনটা টিপতে হবে?’ অমনি সে অ্যাত্তোখানি পায়ের থাবায় ভুল বোতাম প্রেস করে দেয়। বুন্নি হেসে ফেলে, ‘তুই একরকমই থেকে গেলি, বোকা বোকা লম্বা, সংক্ষেপে বি বি এল, মানে…উঁ উঁ…আমার বিবিলসোনা’।
গল্প থামিয়ে চমৎকার উল্টো দিকে ঘুরে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ল। তারপর পাঁচিলের ওপর দিয়ে এক দৌড়ে রান্নাঘরের সামনে। আজ এত সকাল সকাল গ্যাস ওভেনে চায়ের জল চাপানোর শব্দ শোনা যায় কেন? পেছনে হেঁটে সে জানলা দিয়ে মুখ বাড়ায়। এটা বুন্নির ঘর। মেয়েটাও নেই বিছানায়। হয়তো কাল রাতে দোতলার স্টাডি রুমে আলো জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। দেয়াল-ঘড়িটা উল্টো দিকের দেয়ালে, দেখা যায় না। কিন্তু ঘন্টা পড়ছে। চমৎকার গুনতে লাগল : আউ, সাউ, চিন কিত, অন্তা, মিউ, পার…। হা ভগবান, সবে সাতটা বাজে! টোস্টের কয়েকটা পোড়া টুকরো, তিন-চারটে বিস্কুট, কিছুটা ছানা, ডিমের কুসুম একটুসফোঁটা— এইটুকুমাত্র সকালের খোরাকের জন্যে আরও দেড়টি ঘন্টা চুপ করে বসে থাকা পোষায়, বলো তো!
ছেলে
আমার মা যেদিন মারা যায়, এপাড়ার সব মা-বেড়াল গোল হয়ে আমাকে ঘিরে বসে ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিল। আমি তাদের মধ্যে চমৎকারের কাছে গিয়ে ওর কোলে মাথাটা গুঁজে দিই। সেদিন থেকে চমৎকারই আমার মা, আর এই গল্পটাও আমরা মা-ছেলেতে মিলেমিশে বলব। যাই হোক, পাড়া ঘুরে দত্তবাড়ির পেছনের পাঁচিল টপকে নিমগাছের ডাল থেকে একলাফে নেমেই থতমত খেয়ে দেখি, ঠিক সামনে গৌরীশংকর দত্ত। কিন্তু আজ তার আমাকে তাড়া দেওয়ার মেজাজ নেই, জলের পাম্পের পাশে বাতিল কাগজের ঝুড়িতে কী একটা খুঁজতে ব্যস্ত। পেরিয়ে যেতে যেতে শুনলাম, চেঁচিয়ে বলছেন, ‘আরিয়ান্তোসে ইকড়িমিং চাউতা’। না না, গৌরীকাকু বাংলাতেই বলেছেন কথাটা, কিন্তু আমরা বেড়ালরা তো আর বাংলা জানি না, বলি না, বা বুঝি না। অথচ আমরা বেড়ালরাই আবার পৃথিবীর সব ভাষাই জানি এবং বুঝি। আসলে বেড়ালের মস্তিষ্কের কোষে এমন এক অটোম্যাটিক অনুবাদ ব্যবস্থা রয়েছে যাতে যে কোনো ল্যাঙ্গুয়েজ বেড়ালের নিজস্ব ভাষা ‘মার্জারিক’-এ পালটে যায়। শুধু তাই নয়, মানুষ কোনো শব্দ উচ্চারণ করলেই তার মার্জারিক অনুবাদ মস্তিষ্ক থেকে স্পষ্ট উচ্চারণে আমাদের কানে পৌঁছোবে। ঠিক যেন মেট্রো রেলে ঘোষণা হচ্ছে, ‘অগলা স্টেশন গিরিশ পার্ক’।
দেখি, ঠিক সামনে গৌরীশংকর দত্ত। কিন্তু আজ তার আমাকে তাড়া দেওয়ার মেজাজ নেই, জলের পাম্পের পাশে বাতিল কাগজের ঝুড়িতে কী একটা খুঁজতে ব্যস্ত। পেরিয়ে যেতে যেতে শুনলাম, চেঁচিয়ে বলছেন, ‘আরিয়ান্তোসে ইকড়িমিং চাউতা’। না না, গৌরীকাকু বাংলাতেই বলেছেন কথাটা, কিন্তু আমরা বেড়ালরা তো আর বাংলা জানি না, বলি না, বা বুঝি না। অথচ আমরা বেড়ালরাই আবার পৃথিবীর সব ভাষাই জানি এবং বুঝি। আসলে বেড়ালের মস্তিষ্কের কোষে এমন এক অটোম্যাটিক অনুবাদ ব্যবস্থা রয়েছে যাতে যে কোনো ল্যাঙ্গুয়েজ বেড়ালের নিজস্ব ভাষা ‘মার্জারিক’-এ পালটে যায়।
যাই হোক, ‘আরিয়ান্তোসে ইকড়িমিং চাউতা’ মানে হলো, কাগজটা তো এখানেও নেই। রোববারের সাত-সকালে বাড়িসুদ্ধ লোক উঠে পড়ে কী খুঁজছে তাহলে? ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেব ভাবছি, আমার মা রান্নাঘরের জানলার নিচ থেকে ঠোঁট চাটতে চাটতে বেরিয়ে এলো। এসেই যথারীতি বকুনি, ‘কোথায় চরতে গেছিলি, হতচ্ছাড়াটা? এখন বেলা দুটো পর্যন্ত খালি পেটে ঘুরে বেড়াও গে’। তারপর গলা নামিয়ে বলল, ‘বুন্নি আর ওর বাবা কলকাতায় যাবে। মেয়েটার কী যেন পরীক্ষা আছে’।
—রবিবারে পরীক্ষা!
—তাই তো বলল, ‘ইগুতিনো আঙরাসু চিয়াং ডলুমি’। কিন্তু বুন্নি ‘আডমিটিকার’ খুঁজে পাচ্ছে না বলে হুলুস্থুল। সে আবার কী জিনিস রে!
আমিও তো জানি না। মনে হচ্ছে, শব্দটা গ্রীক বা ইতালিয়। মুশকিল হলো, আমাদের ব্রেইন এখনও ততো উন্নত হয়নি বলে কেউ দুটো ভাষা মিশিয়ে কথা বললে শুধু প্রধান ভাষাটার অনুবাদই কানে পৌঁছোয়।
কিছুক্ষণ চুপচাপ দুই থাবার মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে থাকল বিবিল। তারপর হঠাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে বারান্দার গ্রিলের ফাঁক গলে উঠোনে লাফিয়ে পড়ে তীরবেগে ছুট। ‘আবার কোথায় আড্ডা মারতে চললি?’ বলে তার পেছনে হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়াল চমৎকারও।
মা
সরকারবাড়ির পুকুরে অর্ধেক জল, বাকি অর্ধেক ঢেকে গেছে কলমি-বেতো শাকে। সেখান থেকে ঢাল বেয়ে ওপরে উঠলে লম্বা ঘাসভরা জমি, মুখ না তুলে হাঁটো যদি, নাকে সুড়সুড়ি খেয়ে হাঁচি আসতে বাধ্য। তারপর বাতাবিলেবু গাছ একটা, যেখানে সোমঋতাদের দুধেল গরু আব্বুলিশ বাঁধা থাকে। জগন্নাথ সরকার বারাসাতে বাড়ি করে ফ্যামিলি সমেত উঠে যাওয়ার পর এই সবুজ মাঠের টুকরোটা পাড়ার বেড়ালদের আড্ডা বা সেমিনারের জায়গা। বিবিল সেখানে দাঁড়িয়ে বারবার তাকাচ্ছিল কীর্তনবাড়ির দিকে। মিনিট খানিক পরেই, ঠিক যা ভেবেছি, সে-বাড়ির গেট পেরিয়ে দিশা মেয়েটা এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে সুড়ুত করে কাঠটগর গাছের জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। দিশার পুরো নাম অনেকগুলো সিংঘে, নায়েকে, আর্থার, পেরেরা দিয়ে বানানো— তিংসা বগির ট্রেনের মতো (তিংসা মানে বারো)। ও আসলে শ্রীলংকার খ্রিষ্টান বেড়াল, কলোম্বোর বিখ্যাত উকিল মেন্ডিস পেরেরার কাছে মানুষ হয়েছে। ওই বাড়িতেই দু’বছর ভাড়া ছিলেন কীর্তনবাড়ির ডক্টর রামবিলাস কীর্তনিয়া। দেশে ফেরার সময় বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে আসেন।
কাঠটগর-বন পেরিয়ে জামরুল গাছের আড়াল দিয়ে দিশা খুব জোরে ছুটে এলো মাঠটুকু। তারপর বিবিলের নজরে আসার ঠিক আগে থেমে গিয়ে হেলেদুলে হাঁটতে লাগল। মুখের আহ্লাদি ভাব লুকিয়ে চোখদুটো উদাসীন-মতো করে বলল, আবার কী হলো? ডাকছিলিস কেন!
—এই, ‘আডমিটিকার’ মানে কী রে?
মেয়েটা তো হেসেই বাঁচে না। ‘ধুস, ওটা অ্যাডমিট কার্ড, ওতে রোল নম্বর, ছবি, সব দেওয়া থাকে। না নিয়ে গেলে পরীক্ষার হলে ঢুকতেই দেবে না। আমাদের বাড়ির বন্দনাদিও ন’টা বেয়াল্লিশের ট্রেনে যাচ্ছে, বিধাননগর কলেজে সিট পড়েছে তো! আমি আকাশের দিকে মুখ তুলে রোদের হেলানো রশ্মি দেখতে পেলাম। মনে মনে অল্প একটু পরিমিতি কষে নিয়ে বললাম, আর ঠিক আধ ঘন্টা বাকি। কিন্তু এখন আমাদের আর কী-ই বা করার আছে!
—আছে অনেক কিছু। বুন্নিদির অ্যাডমিট কার্ড আমি গতকালই দেখেছি ওর হাতে। নিশ্চয়ই ওই ঘরের মধ্যে কোথাও…। এই বলে বিবিল যেন কুকুরের তাড়া খেয়েছে, শরীরটা এমন ছোট্ট করে ছুট দিল দত্তবাড়ির দিকে। দিশা চেঁচিয়ে উঠল, ‘ঝামেলা মিটল কি না বিকেলবেলা এসে জানিয়ে যাস’। তারপর আমার দিকে চোখ পড়তে থতমত খেয়ে হাসল ক্যাবলার মতো, ‘আপনিও আসবেন, কাকিমা’।
কিন্তু সেসব দেখার সময় নেই এখন। প্রাণপণ দৌড়ে বড়োরাস্তা লাগোয়া কচুবাগানে ধরে ফেললাম বিবিলকে। তোর কি মাথা খারাপ হলো যে মানুষকে সাহায্য করতে ছুটছিস! ওরা এক্ষুনি বুঝতে পেরে যাবে আমরা বাংলা ভাষা জানি। তারপর বাকি জীবন কুকুর হয়ে কাটাতে পারবি তো?
—একটা অ্যাডমিট কার্ড খুঁজে দিলাম, আর এতকিছু ঘটে গেল!
—শোনো, তোমারই মতো বোকা একটি সারমেয় মানবজাতির কথা শুনে একবার শুধু আহ্লাদে লেজ নেড়ে ফেলেছিল। বাকিটা ইতিহাস। এখন কুকুরদের সারারাত জেগে বাড়ি পাহারা দিয়ে আবার ভোরের আলো ফুটতেই বুড়োবুড়িকে মর্নিং ওয়াকে নিয়ে ছুটতে হয়। তারপর সকালের খবরের কাগজ মুখে করে নিয়ে আসা থেকে বাজারের ব্যাগ বওয়া, দুপুরে বৌদি ঘুমোলে বাচ্চার নজরদারি, দুবেলা বাড়ির ছোটোদের সঙ্গে ফুটবল প্র্যাক্টিস— এসব তো আছেই। রেডিও-টিভিতে, সিনেমায়, এমনকি মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপনে পর্যন্ত খাটছে কুকুর, অথচ কোনো কুকুরের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির লিস্টিতে একটা নোকিয়া বা এলজির চোদ্দশো টাকার সেটও খুঁজে পাওয়া যাবে? আর, সবচেয়ে দুঃখের কথা কী জানিস? পুলিশ-মিলিটারিতেও কুকুর গিজগিজ করছে। মানুষ নিজের কাজ করাচ্ছে কুকুরকে দিয়ে!
আবেগে চোখে জল এসে গেছিল। বিবিল পেছনের দরজা দিয়ে দত্তদের ঘরে ঢুকে তক্ষুনি বেরিয়ে এসে বলল, কেন, ওরা মোটা মাইনেও তো পায়? তাছাড়া কুকুর কতো বিশ্বাসি প্রাণী সেটা বল? পেট ভরা থাকলেও রান্নাঘরে ঢুকে খাবারে মুখ দেবার কু-স্বভাবটা নেই।
শুনে মেজাজ এত গরম হয়ে গেল, বাঁ হাত তুলে ওর মাথায় এক থাবা বসালাম, ‘জিভ খসে পড়বে নিজের জাতের বদনাম করিস তো! আমাদের দেবতা বেড়াদাস বলেছেন, চুরিই হচ্ছে খাঁটি বেড়ালধর্ম। বুঝলি ইঁদুরটা?
—আমার অতশত বুঝে-সুঝে কাজ-টাজ নেই। বুন্নিদি আমাকে ভালোবাসে। দিদি পরীক্ষা দিতে না পারলে খুব কষ্ট হবে, ব্যাস।
দেখলাম, বিবিল দত্তভিলার পেছন দিকটায় চলে গেল। তার মানে পেঁপে গাছ বেয়ে ছাদে উঠে স্টোররুমের ফোঁকর গলে দোতলায় ঢুকে তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবে। যে মানুষ ওকে ঘরে ঢুকতে দেখলেই তাড়িয়ে দেয়, উনি চললেন তাদের উদ্ধার করতে। হুঁহ্!
ছেলে
শুনেছি, এর আগে তিন দফায় আমার মোট পাঁচটা দাদা-দিদি হয়েছিল। মা তখন যে বাড়িতে, সেই হালদারবাবুরা আড়াল দিলে ওরা হয়তো শেয়ালের পেটে যেত না। তারপর থেকেই মা একটু মানুষ-বিরক্ত। যাহোক, অনেকদিন পরে স্টোররুমে ঢুকে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। এই ঘরই আমার জন্মস্থান কিনা! ওই তো সেই প্লাইউডের বাক্স যার মধ্যে খেলা করে আমার ‘বৈশব’ (বেড়ালের শৈশব আর কি) কেটেছে। কিন্তু পুরনো খবরের কাগজ লাট করে রাখার জায়গাটা যেন কোথায়?
বুন্নিদির খাটের ওপর বইপত্র আর খবরের কাগজ নিয়ে পড়তে বসার অভ্যেস। অ্যাডমিট কার্ড বইয়ের সঙ্গে উঠে গিয়ে থাকলে এতক্ষণে শেলফ ঘেঁটে খুঁজে পাওয়ার কথা। কিন্তু রাঁধুনি নিরুমাসি বা অন্য কেউ যদি পেপারের সঙ্গে তুলে ফেলে? কাগজের স্তূপ থেকে এক একটা করে কামড়ে নামিয়ে ফের মুখে তুলে ঝাঁকাতে লাগলাম। নাহ, কিচ্ছু নেই, শুধু ধুলোয় গা-মাথা ভরে গেল। হঠাৎ মনে হলো, নতুন কাগজের ডাঁই হলে তো এত ধুলো জমার কথা নয়! দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছি, বুন্নিদির গলায় চাপা কান্নার আওয়াজ! ইস, মা মারা যাওয়ার পর আমাকে তুলোয় করে দুধ খাইয়ে বাঁচিয়েছে যে, সেই দিদিটার জন্যে কিছুই করতে পারব না! সেই মুহূর্তে সিঁড়ির ঠিক নিচে গৌরীকাকুর সাইকেল আর গ্যাস সিলিন্ডারের মাঝখানটায় চোখে পড়ল— আরও কিছু খবরের কাগজ ভাঁজ করে সাজানো, আর আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে তার প্রথমটা ধরে টান দিতেই নিচে থেকে বুন্নিদির ছবি বেরিয়ে এসেছে!
অ্যাডমিট কার্ড মুখে করে ছুটতে যাচ্ছিলাম ওঘরে, মনে পড়ল মার সাবধানবাণী! আমাদের ধর্মগ্রন্থ (পড়ব পড়ব করে আর পড়া হয়ে ওঠেনি) ‘বেড়াভাগবতে’ নাকি লিখেছে, বেড়ালের বুদ্ধির কথা জানতে পারলে মানুষ তাদের রকেটে করে মহাশূন্যে পাঠিয়ে দেবে। আর সেখানে তাদের গায়ের লোম ঝরে গিয়ে চেহারাটা ঝাঁটার শলার মতো হয়ে উঠলে নিজেরাই নিজেদের তেলাপিয়া মাছের কাঁটা ভেবে খেয়ে ফেলবে তারা। আমি অ্যাডমিট কার্ডের ওপরে বসে পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগলাম।
গৌরীকাকু এসে ‘সোবাতাং জিয়াও মুনি’ (বাড়ি মাথায় করেছিস কেন?) বলে ঝুলঝাড়ু দিয়ে জোরসে পিঠে একখানা কষিয়ে দিল। কিন্তু ভয় পেলে সাহসের কাজ করা চলে না। আমি চিৎকারের ভল্যুম বাড়িয়ে দেওয়ামাত্র শুনতে পাচ্ছি তরুকাকিমার গলা, ‘বেজিনা লুসিও। পিং সে কাই অরন তুদা।’ (তুমি পারবে না। গায়ে জল ঢেলে দিলে ও শায়েস্তা)।
গৌরীকাকু এসে ‘সোবাতাং জিয়াও মুনি’ (বাড়ি মাথায় করেছিস কেন?) বলে ঝুলঝাড়ু দিয়ে জোরসে পিঠে একখানা কষিয়ে দিল। কিন্তু ভয় পেলে সাহসের কাজ করা চলে না। আমি চিৎকারের ভল্যুম বাড়িয়ে দেওয়ামাত্র শুনতে পাচ্ছি তরুকাকিমার গলা, ‘বেজিনা লুসিও। পিং সে কাই অরন তুদা।’ (তুমি পারবে না। গায়ে জল ঢেলে দিলে ও শায়েস্তা)। এই রে, পরীক্ষার প্রবেশপত্রও যে ভিজে সপসপে হয়ে যাবে! তরুকাকি এলে তেড়ে যাব কিনা ভাবছি, বুন্নিদি এতক্ষণে সিঁড়ির ঘরে ঢুকল : ‘সব সময় একটা অবলা জীবের পেছনে লেগে আছো কেন! সকালে খেতে পায়নি বলে চিৎকার করছে সেটাও বুঝলে না?’
‘ইচিদং ত্রামে সোহা’ (তোর জন্যেই এটা মাথায় উঠেছে) বলতে বলতে দু’জনে বেরিয়ে গেলে আমি মেঝেয় পড়ে থাকা অ্যাডমিট কার্ডটার চারপাশে পাক খেতে লাগলাম। বুন্নিদি তক্ষুনি লাফিয়ে এসে কাগজটা তুলে নিয়ে একদম অবাক হয়ে গেছে। ‘কোথায় পেলি এটা? এত বুদ্ধি তোর! এবার তো সিসিল বলে ডাকতে হবে ওস্তাদকে, মানে চালাক-চালাক-লম্বা! আমার কিন্তু প্রথম থেকেই সন্দেহ হতো বাংলা ভাষাটা তুই কব্জা করে ফেলেছিস…হ্যাঁ রে, হা করে দেখছিস কী?
আমার মাথার অনুবাদ-যন্ত্র ঘুমিয়ে পড়েছে। বুন্নিদির কথা শোনামাত্র বুঝে ফেলছি আমি। তার মানে মানুষই হোক, বা পশু-পাখি বা গাছপালা, ভালোবাসার ভাষা সবার বেলাতেই এক। একজনের মুখ ফুটলেই আরেকজন টের পেয়ে যাবে। এমনকি উচ্চারণ করারও দরকার নেই। যেমন বুন্নিদি এখন আমার গলায় সুড়সুড়ি দিতে দিতে মনে মনে বলছে, কিন্তু তুই ইংরিজি কী করে শিখলি, বিবিল? নিশ্চয়ই তোর সেই শ্রীলংকান বান্ধবীর কাছে!
জন্ম ৭ শ্রাবণ (২৪ জুলাই), ১৯৬০, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার দত্তপুকুরে। পূর্বপুরুষের ঠিকানা ছিল তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের খুলনা জেলার সেনহাটি গ্রামে। রসায়ন নিয়ে স্নাতক হয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সরকারি চাকরি করতেন। এখন অবসরপ্রাপ্ত। ২০০০ সালে বের হওয়া ‘জাতকের কবিতা’ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এ পর্যন্ত মোট আটটি কবিতার বই, একটি ছড়াসংগ্রহ ও একটি প্রবন্ধপুস্তক প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। সম্প্রতি শিশুকিশোরদের জন্যও লিখছেন চন্দন, যা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে।