একদিন এই নক্ষত্র আলোর পৃথিবী দেখেছিল আনন্দ-যন্ত্রণার এক কবিকে, যিনি লিখেছিলেন—
আলো-অন্ধকারে যাই— মাথার ভিতরে/ স্বপ্ন নয়,— কোন এক বোধ কাজ করে!/ স্বপ্ন নয়— শান্তি নয়— ভালোবাসা নয়,/ হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
‘বোধ’ শব্দটির এমন অভাবনীয় ব্যবহার— রক্তের ঘূর্ণায় তাকে মিশিয়ে দিতে চাওয়া, গাঢ়তর বেদনার আতশি কাচে মেপে মেপে মানবমনের অতলের তল অনুসন্ধান করে ‘বোধ’কে গভীর করে তোলা যেমন প্রজ্ঞাময় তেমন অপার্থিবও। অলৌকিক এক ভাষায় মহাজাগতিক শরের ধ্বনিতে দুঃখ ও অযত্নের, চিৎকার আর গর্জনের, দলিত সুষমার পৃথিবীর আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে কবি লিখলেন— স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, তাঁর হৃদয়ের মাঝে এক ‘বোধ’ জন্ম নিয়েছে। সে এসেছে জলস্রোতের মতো। কবি এই মূর্তিকে এড়াতে পারেন না, ‘বোধ’ কবির হাতে-হাত রাখে, নিজের সব কাজ তার তুচ্ছ হয়, পণ্ড হয়, সব চিন্তা, এমনকি প্রার্থনার সময়টিও শূন্য মনে হয়।
সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো! তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর!— কোনও নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর?— শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর?— প্রাণের আহ্লাদ
সহজ লোকের মতো কে পাবে আবার!
সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই!— ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতো প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর প’রে?
স্বপ্ন নয়,— শান্তি নয়,— কোন এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে!পথে চ’লে পারে— পারাপারে
উপেক্ষা করিতে চাই তারে;
মড়ার খুলির মতো ধ’রে
আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
তবু সে মাথার চারি পাশে!
তবু সে চোখের চারি পাশে!
তবু সে বুকের চারি পাশে!
আমি চলি, সাথে-সাথে সে-ও চ’লে আসে!
কবির মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তাহীনতার ভুবনটা ঠিক কেমন ছিল বোঝা মুশকিল। সহজ লোকের মতো চলতে না-পেরে, সহজ লোকের মতো এই আলো-আঁধারের পৃথিবীর সবকিছু থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে, সহজ লোকের মতো সহজ ভাষায় কথা বলার অভিপ্রায়ে, চাষার মতো প্রাণ পেতে কবি পৃথিবীর শ্বাসরুদ্ধ পাটাতনের ওপর বসে আছেন। এক মায়ালোকের ছায়াচ্ছন্ন কোণে বসে ‘বোধ’ নামক এক আশ্চর্য কুহককে হৃদয়ে এবং ওষ্ঠে ধারণ করে তিনি সারাক্ষণ প্রশ্নমুখর।
‘সহজ লোক’ কারা! সহজ লোক তারা— যারা চাষবাস করে। এই নান্দনিক পৃথিবীর অশ্লীল জটিলতাগুলো, সার্কাসের ভাঁড়ের মতো মানুষগুলো আর স্বস্তি দেয় না। এতসব কঠিনের ভিড়ে কারা সহজ মানুষ— মনীষার অপূর্ব দীপ্তিতে কবি যেন সেই প্রপঞ্চকেও সামনে এনেছেন— সহজ লোকেরা হলো আমাদের কৃষকেরা। তাঁরা সহজ, তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন সমস্ত হতাশাব্যঞ্জকতার বিপরীতে আশার প্রদীপ জ্বেলে।
এদিকে অজ্ঞাত সীমানার প্রাচীর ভেঙে ‘বোধ’ নামের যে প্রপঞ্চের মুখোমুখি তিনি— স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, মাথার ভিতরের সেই কম্পমান বোধের তাড়নায় কবি তোলপাড়, বিহ্বল। সেই বিহ্বলতাকে চৈতন্যে ধারণ না-করে পেছনে ফেলতে চেয়ে, মড়ার খুলির মতো মাথাটাকে আছাড় মারতে চেয়ে তিনি দেখেন, মড়ক আর মারির মতো দুঃস্বপ্নময় সেই ‘বোধ’ জীবন্ত মাথার মতো কবির মাথার চারপাশে ঘুরছে। তার চোখের চারপাশে, তার বুকের চারপাশে লাটিমের মতো ঘুরছে। কবি পথ চলছেন, দিক সামলাতে-সামলাতে, আর সেই আশ্চর্য ‘বোধ’, সেও পাশে পাশে হাঁটছে। কুয়াশামাখা পৃথিবীতে কবি থেমে দাঁড়ালে সেও থেমে যাচ্ছে।
‘বোধ’কে মুখোমুখি করে স্খলিত কণ্ঠে জীবনানন্দকে বলতে দেখা যায়—
‘সকল লোকের মাঝে ব’সে/আমার নিজের মুদ্রাদোষে/আমি একা হতেছি আলাদা?/আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?/ আমার পথেই শুধু বাধা?’
স্নায়ু অবসন্ন করা বিবিধ প্রশ্ন হাজির হয়েছে।
মুদ্রাদোষ, এটি আসলে কী! বিপন্নতার মতো, উপহাসের মতো, অপরিচিত ঠোঁটের গহ্বর থেকে উচ্চারিত ধ্বনির মতো কোনোকিছু? আঙরার আগুন হয়ে মুদ্রাদোষগুলো কবিকে কেবল আলাদা করেছে, সময়ের প্রবাহের সঙ্গে মিলতে দেয়নি, তাই সময়ের প্রবঞ্চক ধাঁধায় কবি যেন অবিন্যস্ত, স্বস্তিহীন।
জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে/সন্তানের মতো হয়ে—/সন্তানের জন্ম দিতে দিতে/যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,/কিম্বা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়/যাহাদের; কিম্বা যারা পৃথিবীর বীজখেতে আসিতেছে চ’লে/জন্ম দেবে— জন্ম দেবে ব’লে;/তাদের হৃদয় আর মাথার মতন/আমার হৃদয় না কি?/ —তাহাদের মন/আমার মনের মতো না কি?/ —তবু কেন এমন একাকী?/তবু আমি এমন একাকী!
তিনি দেখছেন যারা এই পৃথিবীতে জন্মেছে— কারো সন্তান হয়ে, নিজে সন্তানের জন্ম দিয়ে, অথবা আগামীতেও যাদের সন্তানের জন্ম দিতে হবে— বীজের চিহ্ন রূপে জগতের জন্মপ্রক্রিয়ার সেইসব ক্রীড়নকের মতোই কি কবির হৃদয় এবং মাথা? তাদের মনের মতোই কি কবির মন? যদি সাদৃশ্যই থাকবে তাহলে কবি কেন এমন নিঃসঙ্গ— একা?
এদিকে পৃথিবীর ‘নির্জনতম কবি’ ধীমান মস্তিষ্কে এ-ও জেনে গিয়েছিলেন, তিনি অন্যরকম। সবার মতন নন। বলছেন—
হাতে তুলে দেখি নি কি চাষার লাঙল?/বালটিতে টানি নি কি জল?/কাস্তে হাতে কত বার যাই নি কি মাঠে?/ মেছোদের মতো আমি কত নদী ঘাটে ঘুরিয়াছি;/ পুকুরের পান শ্যালা— আঁশটে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে গিয়েছে জড়ায়ে;/ — এই সব স্বাদ;/ —এই সব পেয়েছি আমি;/ —বাতাসের মতন অবাধ বয়েছে জীবন,/নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন একদিন;/ এই সব সাধ/ জানিয়াছি এক দিন, —অবাধ —অগাধ।
দুই.
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে
অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে— যখন ডেকেছি বারে-বারে
ভালোবেসে তারে;
তবুও সাধনা ছিল এক দিন,— এই ভালোবাসা;
আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা ক’রে গেছি;
কবির অবকাশ হয়েছিল ভালোবাসার। হৃদয় ভরে উঠেছিল এক নারীর প্রেমে। তাকে হৃষ্ট পুরুষের মতো ভালোবেসে দেখেছেন তিনি, হোমো স্যাপিয়েন্সের ঘৃণা উদগীরণ করে দেখেছেন, অপরিচিতের মতো অবহেলা করেও দেখেছেন। বিপরীতে কম অভিজ্ঞতা হয়নি। এই মায়াবী গ্রহের নিচে যেমন মেয়েটির ভালোবাসা পেয়েছেন, পেয়েছেন উপেক্ষা, ক্লেদাক্ত ঘৃণাও কম পাননি।
রবীন্দ্র-উত্তর যুগের প্রধান কবি, জীবনানন্দ দাশের অন্তঃপুরের অলিগলিতে যার প্রেম সুবাস ছড়িয়েছে, ভালোবাসার নৈবেদ্য উপহার দিয়েছে, অস্তমিত সূর্যের মতো বিষণ্নতা উপহার দিয়েছে, শিথিল অন্ধকারের মতো ঘৃণা নিক্ষেপ করেছে— কবির চৈতন্যে সারাক্ষণ আসা-যাওয়া করা সেই মোহন বালিকা ততদিনে হয়তো বুঁদ হয়ে গেছে ভিন্ন কবিতায়, ভিন্ন গৃহস্থালিতে। কবিও ঘৃণাকে পরবাসে পাঠিয়ে, অবহেলাকে উড়িয়ে দিতে শিখে, নক্ষত্রের দোষে অসার্থক হওয়া প্রেমটি নিয়ে স্তব্ধ। শূন্য-মেরুবরফের শীতলতায় ঢেকে গেছে সেই প্রেম, সেই ভালোবাসা।
কিন্তু তবুও শেষ নয়!
বিচ্ছেদ-আকাঙ্ক্ষার সরল স্তর অতিক্রম করে সংবেদনশীল সেই প্রেম নামক প্রপঞ্চ বুঝিবা নিজ অক্ষের ওপর তখনো ঘুরছে।
কবি লিখলেন—
যে-নক্ষত্র— নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা
আমি তা ভুলিয়া গেছি;
তবু এই ভালোবাসা— ধুলো আর কাদা—।
চেনা আর ছদ্ম শত্রুদের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে ক্রমশ একা হয়ে যেতে যেতে গাইতে হয় শেষ পারানির গান। হয়তো জীবনেরই নিয়ম। জীবনানন্দ ঝুর ঝুর ভেঙে পড়া মানুষের মতো পলকা নন। সমস্ত জীবনখানা সামলে চারপাশের কোনো দেবতাইকেই কবি তখন আর অস্তিত্বশীল রাখেননি। এমনকি নিজের প্রাণের কাছে পৌঁছে কুয়াশালীন এই জীবনের সমস্ত পাথরখণ্ড ভেঙে কবি পৌঁছে গেছেন নিজের কাছে। নিজের কাছে পৌঁছুনোই হয়তো মানুষের অন্তিম গন্তব্যেরই প্রধান উদ্দেশ্য।
জীবনের নতুন তটরেখা স্পষ্ট। অস্তসূর্য যখন কেবল অন্ধকারের, তখন মর্মরপ্রশ্ন প্রশ্ন আরো দুলে দুলে উঠেছে।
সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়!/ অবসাদ নাই তার?/ নাই তার শান্তির সময়?/ কোনও দিন ঘুমাবে না?/ ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ পাবে না কি?/ পাবে না আহ্লাদ/ মানুষের মুখ দেখে কোনও দিন!/ মানুষীর মুখ দেখে কোনও দিন!/ শিশুদের মুখ দেখে কোনও দিন!/ এই বোধ— শুধু এই স্বাদ/পায় সে কি আগাধ— অগাধ!
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ/চায় না সে?/— করেছে শপথ/ দেখিবে সে মানুষের মুখ?/ দেখিবে সে মানুষীর মুখ?/ দেখিবে সে শিশুদের মুখ?
বেলাশেষের সময় চলে গেছে, বা যায়নি। কবি দেখছেন—
চোখে কালো-শিরার অসুখ,/ কানে যেই বধিরতা আছে,/ যেই কুঁজ — গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে/নষ্ট শসা— পচা চারকুমড়ার ছাঁচে,/ যে-সব হৃদয়ে ফলিয়াছে/ —সেই সব।
বোধের অপার ক্ষমতা। পৃথিবীর পথ ছেড়ে অসীমের পথ অনুসন্ধানের প্রবৃত্তি কবির নেই, তবে কি বায়বীয় নির্যাস ছেড়ে কবি পৃথিবীর মানুষের-মানুষীর মুখই দর্শন করবেন? দেখবেন শিশুদের মুখ?
আসলে তো ফিরতেই হয়, বেঁচে থাকার অমোঘ নিয়মে নেমে আসতে হয় মাটি-পৃথিবীর ধুলোতেই। এসে দেখা যায় — চোখে কালো শিরার অসুখ, কানে বধিরতা, নষ্ট শসা কুমড়োর ছাঁচে যে কুঁজ-গলগণ্ড শরীরে জন্ম নিয়েছে, হৃদয়ে ছটফট করছে যে যন্ত্রণা, কদর্য রসিকতায় তারা জলজ্যান্ত তরঙ্গের মতো ঢেউ খেলছে।
জীবন হয়তো এটাই!