সোমবার, নভেম্বর ২৫

‘ভূতের সাথে যুদ্ধ’: এ এক সত্যি ভূতের গপ্পো : শামীম সাঈদ

0

নন্দিত কথাসাহিত্যিক মঞ্জু সরকারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি গল্প ‘ভূতের সাথে যুদ্ধ’। গল্পটি পাঠক কেন পড়বেন ও কেমন করে পড়বেন তাই নিয়ে কিছু কথা বলা উদ্দেশ্য। কিন্তু, উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, তার একটি বিধেয়ও থাকে। সুতরাং, বিধেয় তথা বলার কথাটি বলার পূর্বে একটু অসংযমী ভণিতার প্রয়োজন আছে। ভণিতাটি শুরু করছি এমন করে: একটি শিল্পকর্মের নানামাত্রিক, নানান-দৃষ্টিকৌণিক, বিচিত্র বোধসঞ্জাত পাঠোন্মোচন হতে পারে; তেমনই হয়ে থাকে এবং তেমনই হতে হয়। শিল্পের তকমা নিয়ে সাহিত্য হয়ে ওঠা একটি গল্পেরও কি তেমনই পাঠ জরুরি নয়! এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া কিংবা পাওয়ার অপেক্ষা থাকে না; না লেখকের কাছে, না পাঠক-সমালোচকের কাছে। লেখক একটি গল্পে যা কিছু বলতে চান তার সবটুকু বলা হয়ে ওঠে না। সবটুকু বলা মানে খুলে বলা; তা করতে গেলে লেখকের লেখাটি শিল্পের মহিমা হারাতে পারে। এবং বিপরীতভাবে যদি লেখক শিল্পের আঙ্গিকটুকু বজায় রেখে তার বলার কথাটি বলতে চান, তবে, সবটুকু বলতে পারেন না। তখন তাকে ইঙ্গিতের সাহায্য নিতে হয়, রূপকের আধারে না বলাটুকু বলে ফেলতে হয়— এ এক না-বলায় বলার ছল। এই ছলই হলো শিল্প। কিংবা, কোনো সাহিত্য পাঠের আরেকটি জনপ্রিয় মতবাদ রয়েছে, বিখ্যাত সাহিত্য-শিল্প-সমালোচক পিয়ের মার্সির সেই মত। তিনি বলেন, লেখক কী লিখেছেন সেটির চেয়ে তিনি কী লিখেননি বা যা বলেছেন তার বিপরীতে কী কী গোপন করেছেন কিংবা বলতে দ্বিধান্বিত ছিলেন, সেইটির অনুসন্ধান জরুরি— সেটি শিল্প-সাহিত্য পাঠের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি।

লেখক একটি গল্পে যা কিছু বলতে চান তার সবটুকু বলা হয়ে ওঠে না। সবটুকু বলা মানে খুলে বলা; তা করতে গেলে লেখকের লেখাটি শিল্পের মহিমা হারাতে পারে। এবং বিপরীতভাবে যদি লেখক শিল্পের আঙ্গিকটুকু বজায় রেখে তার বলার কথাটি বলতে চান, তবে, সবটুকু বলতে পারেন না। তখন তাকে ইঙ্গিতের সাহায্য নিতে হয়, রূপকের আধারে না বলাটুকু বলে ফেলতে হয়— এ এক না-বলায় বলার ছল।

অনুসন্ধান কেবল সমালোচকের নয়, পাঠকেরও। সমালোচক সেটি নিশ্চয় করেন, করবেন। কিন্তু, পাঠক? পাঠকের পক্ষে, লেখক যেটুকু লিখে রাখেন, আক্ষরিক সেটুকু পড়েই তৃপ্ত থাকলে চলে না। সেটি করলে একই সাথে পাঠকের পাঠের এবং লেখকের লেখার উদ্দেশ্যটি মাঠে মারা যায়। প্রায়শ, লেখক যা কিছু বলেন তার প্রায় সবটুকু বা অধিকাংশই পাঠকের অভিজ্ঞতার সাথে কিংবা যাপিত বাস্তবের সাথে মিলে যায়, মিলে যেতেই পারে। এমন হলে সেই গল্পটি পাঠক কেন পড়বেন? আর, পাঠকের জানা কথাটি লিখে কেনই-বা আবার লেখক পাঠকের হাতে তুলে দিবেন? সত্যি, এতোটা সরলভাবে সাহিত্য হয় না; আর শিল্পের, সাহিত্যের পাঠোন্মোচনও হয় না এমন আক্ষরিক; এমন হলে আসলে চলে না। আর, এজন্যই লেখককে শিল্পের ছদ্মবেশে ঢেকে দিতে হয় জানা কথাটিকে। এই ক্ষেত্রে আক্ষরিক পাঠ আসলে সাহিত্যের, শিল্পের প্রথম পাঠ, শিশুতোষ পাঠ; যা মূলত পাঠই নয়। শিশুতোষ পাঠ হলেও তাতে সামান্য উপভোগ থাকে। কিন্তু বয়স ও বুদ্ধিতে বেড়ে ওঠা পাঠকের উপভোগেই শেষ হলে চলে না। সাহিত্যের প্রকৃত পাঠ শুরু হয় সেটি উপভোগ শেষে, একটি প্রশ্ন করার মাধ্যমে, আর প্রশ্নটি হলো— কেন? অথবা— কী? কিংবা, কী কী? প্রথম প্রশ্নটি লেখকের উদ্দেশ্যে আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রশ্নসমূহ পাঠকের নিজের প্রতি। পাঠক মনে মনে প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, এই গল্পটি লেখক কেন লিখলেন কিংবা নিজের কাছেই প্রশ্ন করতে পারেন যে, এই গল্পটি পড়ে আমি কী বুঝলাম কিংবা পড়ে লাভটা হলো কী? এই জিজ্ঞাসার সাথে-সাথেই গল্পটির বা শিল্পকর্মটির গূঢ় পাঠোন্মোচন শুরু হয়ে যায়। কেন-র উত্তরটি কখনো লেখক পাঠকের কাছে দিতেন আসবেন না; তার যা বলার, না-বলার, বলতে না-পারার আক্ষেপ— তা তো তিনি রেখেই দিয়েছেন গল্পের ভিতরে, বলা-না-বলাতেই— ওটুকু বুঝে নিয়ে পাঠককেই দিতে হয় তার উত্তর নিজেকেই। এ পর্যায়ে শুরু হয় সাহিত্যের আরেক পাঠোন্মোচন, লেখক যা লিখেছেন তা দিয়ে নয়, বরং লেখকের মনোভঙ্গি আর তার মতাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি বুঝবার চেষ্টা দিয়ে। একটি লেখার মধ্যে লেখকের মনোভঙ্গি, সমাজ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মতাদর্শটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে; ওঠেই। কিন্তু লেখকের মতাদর্শের বিপরীত এক বা একাধিক মতাদর্শও একই সময়ে সমাজে প্রচলিত থাকতে পারে, সাধারণত থাকেই। সেইটির অনুসন্ধান করা সাহিত্যের আরেক পাঠ। ‘ভূতের সাথে যুদ্ধ’ পড়ার কালেও পাঠকগণ এই পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করতে পারেন। কিন্তু, এখানে পদ্ধতিসমূহ প্রয়োগের উদ্দেশ্য ‘ভূতের সাথে যুদ্ধ’ গল্পটির পাঠ হলেও পদ্ধতিসমূহ তথা বিধেয়টি সাধারণ, সর্বজনীন তথা সব শিল্পমাধ্যমের পাঠোন্মোচনের জন্যই গ্রহণ করা যেতে পারে। পাঠককুল সমোঝদার, তাদেরকে সবটুকু বলবার প্রয়োজন নিশ্চয় নেই। যাহোক…, তবু…

এবারে ‘ভূতের সাথে যুদ্ধ’ গল্পটি নিয়ে কহতব্য কথাটি বলা যাক। ধরে নিই, গল্পটি ইতোমধ্যে পাঠকগণ পড়েছেন অথবা পড়বেন। কথাটা— পড়েছেন, এখনো পড়েননি কিন্তু পড়বেন, এই উভয়বিধ পাঠকগণের জন্যই। তখন, গল্প ‘ভূতের সাথে যুদ্ধ’ পড়ার পরে মনে হবে হয়তো, যে, গল্পটি আসলে মামুলি একটি ভূতের গল্প! যদি সত্যিই কারো এমন মনে হয়ে থাকে, তখন আমার প্রশ্ন— তাই কি? উত্তরের অপেক্ষা করছি না। বলছি— একদমই তা নয়, নিশ্চয় বলছি। প্রাচীন বিশ্বাস কিংবা অপসংস্কারজাত ধারণার বশে কত লোকই তো অশরীরী আত্মার অস্তিত্বে আস্থা রাখেন! কিন্তু, একজন বিজ্ঞানমনস্ক, অপসংস্কারমুক্ত মনের লেখক কেন পাঠককে তেমন ভূতের গল্প বলতে যাবেন! আর যদিও-বা তেমন হয়, সেসব গল্প তো হয় শিশুদের জন্য, যার উদ্দেশ্য হতে পারে কেবল শিশুতোষ আনন্দ উৎপাদন আর শিশুদের কল্পনার আকাশকে রাঙানো এবং অবশ্যই ভয় দেখানোর জন্য নয়। যদিও ভয়ের রোমাঞ্চ কিঞ্চিৎ থাকতেই পারে, কিন্তু তা শিশুমনের আনন্দে আশ্লিষ্ট হয়। যাহোক, সেই গল্পসমূহ প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য নিশ্চয় নয়। তবু, প্রাপ্তবয়স্কগণ যদি সেগুলো পড়তেই চান, পড়েই ফেলেন তো আপত্তির কিছু আসলেই থাকে না। কিন্তু, লেখক নিশ্চয় পাঠককুলকে শিশু ঠাওরে বসেননি ‘ভূতের সাথে যুদ্ধ’ গল্পটি পড়ার ব্যাপারে। যাকগে, বলতে চাইছি যে, যা অলীক তা আসলেই অলীক। আসলে ভূত নেই, ভূত বলে কিচ্ছু নেই, ভূত বলে কিছু হয় না। এই প্রবোধ শিশুদের জন্য প্রথমে; আর বড়োদের কেউ কেউ যদি সত্যিই ভূতে বিশ্বাস করে থাকেন, তাদের জন্য। আসলেই, ভূত বলে কিছু নেই! কিন্তু, তাই কি? হুম, তা-ই। কিন্তু, তবু, সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন, শপৎ করে বলতে পারি— ভূত আছে, ‘ভূতের সাথে যুদ্ধ’ও আছে। ভূত তথা যা অস্তিত্বামন— দৃশ্যমান কিবা অদৃশ্য, তা আছে। মানুষের বর্তমান আছে, ভূতগ্রস্ত মানুষ আছে। তবে, ভূতগ্রস্ত মানুষ ভূত তথা বর্তমান তথা জীবন-যাপন থাকলেও তাদের ভবিষ্যৎ আছে কি নেই, এই ব্যাপারেনিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না, নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। যেমন দেখুন, ‘ভূতের সাথে যুদ্ধ’ গল্পে মফিজের ভূত আছে কিন্তু কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ভূতের পরে ভবিষ্যৎ থাকে, ভূতেরও ভবিষ্যৎ থাকে; কিন্তু সকলেরই, আসলেই কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। কিন্তু, ভূতেদের নিশ্চয় ভবিষ্যৎ থাকে। গল্পে মফিজের ভূত তথা বর্তমান, অস্তিত্বমান জীবন, বাস্তবতা কিংবা মামুলি যাপন— ঐটুকুই, সামান্য ঐটুকুই দেখিয়েছেন লেখক। মফিজের জীবন কেমন? অন্ধকার। মফিজের ভূতের রূপক কেমন? কালো, অন্ধকার, ‘…যেদিকে তাকায়, কেবই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার …’, সীমাহীন, দিক-চিহ্নহীন, থা-হীন। ভূতের ভয়াল এক থাবা, যেমন মফিজ অনুভব করে— ‘… একটি বিশাল কালো হাতের থাবা গলাটা টিপে ধরার জন্যে এগিয়ে আসছে, সেই হাতের একটি আঙুলে বরফস্পর্শ যেন গলায় অনুভব করল সে, …’। আর তখন মফিজের অস্তিত্ব ভূতের কবলে নিস্তারহীন। মফিজ যেদিকে পা বাড়াবে অতল জল; সাঁতার জানলেও দানবের কারসাজির কবলে তলিয়ে সে যাবেই। মফিজের খুব চেনা চড়কবিল। সে বিলের প্রতিটি মাটিকণা তার চেনা, কিন্তু পিশাচের কবলে সবই দিশাহীন পাথার। যেদিকে তাকাবে, কেবলই অন্ধকার; শনশন অট্টহাসি আর অনতিক্রম্য এক কবল যা থেকে যত দূরে যত দ্রুত পালাতে চাইবে; আজীবন কিংবা আমৃত্যু কোনো নিস্তার নেই। মফিজের আজীবন আর আমৃত্যু, দুই-ই যেন একই কথা, জীবন ও মৃত্যুর একই অর্থ। মফিজের তো মরলেই বাঁচা, ওর আর জীবন কী! মফিজের কিংবা লেখকের সংশয় ও জিজ্ঞাসা— ‘প্রায় দুই কুড়ি বছরের ঘনিষ্ঠ ফসলের ভুবনে কে আজ মফিজের জন্যে মৃত্যুফাঁদ বসাল?’ এই ফাঁদে পড়ে মফিজও গানে সুরে কান্দে— ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে …’। আর, ‘ফাঁদ বসাইছে ফঁন্দুয়া রে ভাইও, পুঁটি মাছও দিয়া, পুঁটি মাছের লোভেরে বগা-আ-আ…’ —গল্পের পাঠোন্মোচনে এই গানের রূপটিও পাঠক নিশ্চয় অগ্রাহ্য করবেন না। মফিজের দেখা ভূতের নাম ‘মঙ্গা’। মফিজ যে পিশাচের কবলে হয়রান, তার নাম ‘ক্ষুধা’। ক্ষুধাই মফিজের ভূত। তাই নয় কি? তাহলে জেনে নিন মফিজের উপলব্ধি— ‘কিন্তু টাকা ছাড়া কি আজকাল ভূত ছাড়ে?’ কিংবা— ‘ভেদা বউটাকে মাগুর মাছটার ঝোল আর গরম ভাত খেতে দেবে কাল।’ অর্থাৎ ভূতে ধরা বউয়ের ভূত তো আসলে ক্ষুধা, আর মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে পেট পুরে গরম ভাত খেলেই সেই ভূত ছেড়ে যাবে। এবং মফিজের বউ যে রাক্ষসের মতো খেতে চয়—‘আয়, আয় রে ভাল্ মানুষের বাচ্চা, আইজ তোর অক্ত খাইম, তোর ফতেহা খাইম…।’ বউয়ের শরীরে ভর করে কোন রাক্ষস হাড়-মাস-রক্ত খেতে চায়? ও কি সত্যিই রাক্ষস বা ভূত? ভূতই যদি হয় তো তার স্বরূপ ‘ক্ষুধা’। খেতে পেলেই ভূত পালাবে, রাক্ষস দেহ ছেড়ে উধাও হবে। আর টাকার অভাবই তো ভূত, সেই ভূত হাতে টাকা এলেই ছেড়ে যাবে! যে ভূত টাকায় ছাড়ে, তাড়াতে টাকা লাগে তার নাম ‘মঙ্গা’। মফিজ কেবল জানে টাকা লাগে, গরম ভাত খেতে হয়; তাহলে নিরাময় হয়। কী থেকে নিরাময়? অভাব থেকে, ক্ষুধা থেকে। কিন্তু, লোকে যে বলে ‘ভূত’! লোকে যে বলে মফিজের বউকে ‘ভূত’ ধরেছে! লোকে মফিজের ক্ষুধা আর মঙ্গাকে ভূত বলে প্রচার করতে থাকে; মফিজকে, বউকে, মেয়ে মজিরনকে ভূতগ্রস্ত করে রাখতে চায়। মফিজ ভূত আর ক্ষুধার তফাৎ স্পষ্ট করে বুঝে উঠতে পারে না; কিন্তু কীসে ভূত ছাড়ে তা বুঝতে পারে কেবল। লোকে মাফিজের বিশ্বাস এইরূপে তৈরি করে দেয়।

বউয়ের শরীরে ভর করে কোন রাক্ষস হাড়-মাস-রক্ত খেতে চায়? ও কি সত্যিই রাক্ষস বা ভূত? ভূতই যদি হয় তো তার স্বরূপ ‘ক্ষুধা’। খেতে পেলেই ভূত পালাবে, রাক্ষস দেহ ছেড়ে উধাও হবে। আর টাকার অভাবই তো ভূত, সেই ভূত হাতে টাকা এলেই ছেড়ে যাবে! যে ভূত টাকায় ছাড়ে, তাড়াতে টাকা লাগে তার নাম ‘মঙ্গা’। মফিজ কেবল জানে টাকা লাগে, গরম ভাত খেতে হয়; তাহলে নিরাময় হয়। কী থেকে নিরাময়? অভাব থেকে, ক্ষুধা থেকে। কিন্তু, লোকে যে বলে ‘ভূত’! লোকে যে বলে মফিজের বউকে ‘ভূত’ ধরেছে!

মফিজের ভূতের বিশ্বাসে তার অর্জিত সম্পদ ওঝার হাতে চলে যায়, যাবে। মফিজের বউয়ের রোগ বা ভূত ছাড়াতে ওর কাছে থেকে কেউ হাতিয়ে নিতে চায় ৩৫টি টাকা। এতো টাকা! মফিজের কাছে তা কত টাকা! ভূত তবে একটি বা নানাবিধ রোগ। এই রোগ কেউ বা ওরা ছড়ায়। কেউ বা ওরা, ভূত হয়ে ঘাড়ে বসে আর ওঝা হয়ে ঝাড়ে। তার মানে, ভূত আছে আর ভূতের সাথে যুদ্ধও আছে, মফিজের একার না, অনেকের। আর, কেউ-না-কেউ এই ফাঁদ পেতেছে, চড়কের বিলে। মফিজের জীবনটাই তো চড়কের বিল, অন্ধকার সমস্ত দিন-রাত আর মফিজ কোনো দিশা পায় না। সেখানে কেউ ফাঁদ পেতে তাকে ভূতের গ্রাস করেছে। ফাঁদ কে পেতেছে? কে? মফিজ জানে না, কিংবা জানতে সাহস করতে পারে না। এবং জন্মেই মফিজ এই ফাঁদে পড়েছে। পুঁটি মাছের লোভ দেখিয়ে ফাঁন্দুয়া বা ভূত মফিজকে অন্ধকার চড়কবিলের পাথারে ডেকেছে, পরিচিত মানুষের গলায় সে (ভূত বা ক্ষুধা) মাছুয়া মফিজের নাম ধরে ডেকেছে অন্ধকার রাতে। এই তথ্যটিকে, সত্যটিকে রূপক হিসেবে না-নিবেন কেন পাঠক? কিংবা রূপক হিসেবে না নিলেও হয়তো এক রকমের মর্মপাঠ হয়ে যায়। কিন্তু, মফিজ লোভী, এই কথাটি কেন বিশ্বাস করতে হবে, কেন বিশ্বাস করবেন পাঠক! ভূতের নামটি যদি হয় ক্ষুধা, তবে, ক্ষুধার ফাঁদটি কে পেতেছে? সেই ওঝা? সে মফিজকে ধরতে, মারতে কিংবা মফিজের সম্পদ লুট করতে ভূত রূপ ক্ষুধা লেলিয়ে দিয়েছে মফিজের পিছনে! মফিজ তো লোভী নয়, সে সংগ্রামী। লোভে নয়, মফিজ চড়কবিলে নামে ক্ষুধার কামড়ে বাধ্য হয়ে, পরিত্রাণের বাসনা নিয়ে। এখানে লোভ নেই, ক্ষুধাকে জয়ের আকাঙ্ক্ষা আছে যা সমস্ত অন্ধকারের ভীতিকে পরাস্ত করার সাহস জোগায়। মফিজ চড়কের বিলে নামে বরং যুদ্ধ করতে, হাতিয়ার মাত্র একটি কোচ। ‘এবং কাল বিলম্ব না করে হাতের কোচখানা পিশাচের বুক লক্ষ্য করে সবেগে ছুঁড়ে মারল।’ এই তো মফিজের লড়াই, ‘ভূতের সাথে যুদ্ধ’। মফিজকে লোভী বলা, লোভী প্রমাণ করতে চাওয়া, এ এক চরম মিথ্যে, ষড়যন্ত্র, অর্থনীতি নামের রাজনৈতিক মারণাস্ত্র। কে বা কারা ফাঁদ পেতেছে তা জানতে সাহস করে না মফিজ। তা জানতে প্রশ্ন করলেই তার বিরুদ্ধে কত না রক্তচক্ষু! এই সত্য জানতে সাহস করবে না, যে পাঠক, পাঠকগণ এই গল্পটি পড়ছেন, পড়বেন— হয়তো তারও। মফিজ তো যুদ্ধে হেরে যায় ভূতের কাছে। চড়কবিলের অন্ধকারে, তার হাতের কোচটিতে ভূত তো পরাস্ত হয় না, তার পিছু ছাড়ে না; তখন মফিজ আপস করে ভূতের সাথে, ভূতের বাপের সাথে, ফাঁদুয়ার সাথে। ‘আয়, তোর বাসা আগুন জ্বেলে পুড়ি দিম, এলাও মোর কোমরে আগুন আছে, মরা গরুর হাড্ডি আছে, আয়, আয়, মোর নাম …’। কী? মোর নাম কী? ওর নাম মফিজ। এর পরে ওর কণ্ঠ হারিয়ে যায় সাহসহীনতায়। মফিজের মিথ্যে আস্ফালন ‘মানুষ চিনিস নাই শালা, মোর নাম মাছুয়া মফিজ, চড়কবিলের ভাতার মুই, …’ —মফিজের এসব মিথ্যে আস্ফালন, ভূত জানে, ওঝা জানে। মফিজ কি সত্যিই চড়কবিলের ভাতার? না, মফিজ তা নয়, কখনো হতেও পারে না। মফিজের যুদ্ধ থেমে যায়। আক্রোশ, রাগের বদলে তার কণ্ঠে তখন অভিমান আর অনুনয়ের সুর ফুটে ওঠে— ‘তুই কি মানুষ আর পাইস নাই রে, তোর পাকাধানে কোনদিন মই দিছোঁ মুই…।’ মফিজ হেরে যায়। পাঠকও হয়তো হেরেই যাবেন। যদিও গল্পকার স্পষ্ট করে বলেন না যে মফিজ হেরে গেল কিনা, দিশা পেল খুঁজে পেল কিনা। মফিজ তো ছুটতে থাকে, থপ্ থপ্ থপ্ … কিন্তু, মফিজের যে বাস্তবতা, যে অস্তিত্বে মফিজ জীয়মান, তার কার্যকারণ সূত্রে এটা বলা যায় যে, মফিজ দিশা পাবে না, মফিজেরা দিশা পায় না। কেন না, মফিজের হাতে আলো নেই। মফিজকে দূর থেকে কেউ আলো দেখায় না। নিকট কিংবা দূরের কেউ তখন মফিজের ডাক শুনতে পায় না। আর ভূতের স্বভাব বিচিত্র। ভূত অভাবে আসে, অন্ধকারে আসে। অভাবে অন্ধকার আসে তো ভূতও আসে। দেওয়ানীর ঘরে কখনো অন্ধকার আসে না; কিন্তু মফিজের ঘরে কেরাসিন থাকে না বলে অন্ধকারে ভূত আসে। আর দৈবও মফিজের সহায় হয় না। ওর হাতের পাটখড়ির আগুন মুহূর্তে নিভে যায় আকস্মিক বৃষ্টিতে। তখন কেবলই অন্ধকার। আর তখনই ভূত আসে মফিজের কাছে। মফিজ সাহায্যের জন্য ডাকে, কিন্তু কেউ শোনে না। ভূত তাড়ানোর দাওয়াই কিনতে টাকা ধার চায় মফিজ দেওয়ানীর কাছে। দেওয়ানীও কথা কানে তোলে না। এই দেওয়ানীই তো ভূতের গল্পটা ফাঁদে। মফিজের বউকে যে ভূতে ধরেছে, এই তথ্যটি প্রমাণের জন্য তো দেওয়ানীই সোচ্চার। পাঠক কি এই রূপকটিও গ্রাহ্য করবেন না? সুতরাং ভূতের গল্প ফাঁদতে দেওয়ানী সফল, কিন্তু এই সত্যটি মফিজ জানল না। তবে কি সেই ফাঁদুয়া দেওয়ানী? দেওয়ানী কি স্বয়ং ভূত, সে-ই ওঝা? ভূতের বাবা, ক্ষুধার রূপকার? পাঠকগণ কি এই প্রশ্নটিও উত্থাপন করবেন না এই গল্পটির পাঠোন্মোচনে! মফিজ বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করলেও দেওয়ানী সে চিৎকার কানে তুলবে না; উলটো দেওয়ানীর আসমান বিদারী অট্টহাসি শোনা যাবে। ঔষধের ফর্দখানা হাতে নিয়ে দেওয়ানী হাসে। ‘এসব বড়োলোকী চিকিৎসা কি তোর মতো মাছুয়া কামলার জন্যে? তা ছাড়া তোর পরিবারকে ধরেছে ভূতে, ঔষধ খিলায়ে হবেটা কি!’ —বোঝা গেল কি তবে ভূতের রহস্যটা, দেওয়ানীর শয়তানী! পিশাচ, পিশাচ! পিশাচটা কেমন হাসে দেখো, ঔষধের ফর্দখানা হাতে নিয়ে কেমন হাসে দেখো! পিশাচ, পিশাচ! মফিজ যতই শাসাক, যতই আস্ফালন করুক, এই পিশাচকে সে পরাস্ত করতে পারবে না, পারে না। সামান্য ঔষধের ফর্দখানাই মফিজের কাছে আরেক ভূতরূপে আচরণ করে। মফিজ যেন তখন ফর্দখানার গোলাম, আর মফিজ সেই ফর্দখানার প্রতিদ্বন্দ্বী। ফর্দমতে ঔষধ সে কিছুতেই কিনতে পারে না, পারবে না; কিন্তু ফর্দখানা ছুড়ে ফেলতেও সে পারে না। যেন ফর্দখানা আরেক আরূঢ় ভূত। এই ফর্দখানাতেও হাজির সেই ভূত— মঙ্গা বা টাকার অভাব। আর মফিজ দেখে দেওয়ানীর মুখের দিকে; সে তখন দেখে কোন ভূত! সুতরাং, ভূত আছে। ‘ভূতের সাথে যুদ্ধ’টা সত্যি, তারও চেয়ে বেশি সত্যি— নিখাদ, নিষ্ঠুর বাস্তবতা তা। কেন না, ভূত তৈরির রূপকার আছে। ভূতের গল্প বলার লোক আছে হাজারও। এবং সেই গল্পগুলো এই গল্পটির মতো নিশ্চয় নয় বা হবে না, কিন্তু তা যেমন করেই বলা হোক না কেন তার আলাদা আলাদা ডিসকোর্স রয়েছে। প্রতিটির সন্ধানী পাঠোন্মোচনে গেলে নিশ্চয় এই গল্পটির কাছে পৌঁছানো যাবে। যাহোক, যদিও লেখক একটু চালাকি করে অস্পষ্ট রেখে, মফিজের সংগ্রামটকে অনিঃশেষ দেখাতে চান। হয়তো মফিজ ঘরে ফিরতে পেরেছিল, এই সম্ভাবনা পাঠকও মনে নিয়ে গল্পটি শেষ করতে পারেন; কিন্তু গল্পের এই পাঠও চূড়ান্ত নয়। মফিজের সংগ্রাম দেখতে দেখতে, হেরে যাওয়া দেখতে দেখতে পাঠকও অনুরূপ সংগ্রামে ডুবে থাকেন, সংগ্রাম চলতে থাকে। হারতে হারতে পাঠকগণ এই গল্পটি পড়ছেন, পড়বেন। লেখক তো সংগ্রাম অনিঃশেষ দেখেছেন। অনিঃশেষ হয়তো নয়, কিন্তু দীর্ঘ। এতো দীর্ঘ যে, এর সীমা কিংবা শেষ কোথায়, এখনো কেউ জানতে পারেনি; না লেখক, না পাঠক। সুতরাং এই সংগ্রামের, ভূতের সাথে যুদ্ধের ফলটা কী দাঁড়াল? একটা জীবন শেষ হয়ে গেল যুদ্ধের ভিতর দিয়ে, কেবলই যুদ্ধ, প্রকৃত জীবনকে তার ছোঁয়া হলো না। জীবন শেষ হয়ে যায়, সংগ্রাম টিকে থাকে, কেন না, জীবন অতো দীর্ঘ নয়। যতই আক্ষেপ করা হোক, ‘জীবন এতো ছোট কেনে’! তবু, কেউ যদি নিতান্তই হেরে যেতে না চায় তো, তার জন্য আছে মহাজীবনের ফাঁকি। কেন না, সমাজ ব্যাপ্ত আর মানুষের আবাদ সুফলা থাকে প্রজন্মান্তরে।

Monju Sarker Book Cover

এ গেল গল্পের আরেক পাঠ। কিন্তু, এই পাঠও কি চূড়ান্ত? উঁহু, চূড়ান্ত নয়। কেন নয়? উত্তরটি অনুসন্ধানেয়। ফলে জবাব ও কারণসমূহের অনুসন্ধানে নামতে হয় পাঠককে কিংবা জানাই থাকে হয়তো তাদের, কারো কারো। কিন্তু, হয়তো তারা ভুলে যায়, ভুলে যেতে চায়। কিংবা ভুলে থেকেই প্রাণান্ত খোঁজার ভান করে। এভাবে খুঁজতে খুঁজতে পাঠকগণ কি হারিয়ে যান? মফিজ যেমন ভূতের প্রকৃত স্বরূপ না জেনেই হারিয়ে যায়, পাঠকও তেমনই গল্পের যথার্থ পাঠোদ্ধার না করেই হয়তো হারিয়ে যাবেন বা হেরে যাবেন; বা পাঠোদ্ধারে যথার্থ সাহস দেখাবেন না। পরাস্ত মফিজেরও হয়তো সাহস থাকে না বলেই ভূতের প্রকৃত নাম মুখে আনে না কিংবা ভূতে ধরা বা ভূত দেখানো ভেলকিতে মজে থাকে আর প্রশ্ন করে না— কে সেই ভেলকিবাজ? মফিজ কিংবা পাঠকগণ, বা সকলেই ভূতের স্বরূপ সন্ধানের কাজটি প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে চলে যায় ট্র্যাকের বাহিরে, রিলে দৌড়ের মতো; প্রজন্মের হাতে সেই বোধজাগরণের আশা রেখে। মফিজের কখনো কখনো মনে হয়, সে বোধহয় এই ভূতটাকে চেনে। আভাস পায় যেন মফিজ, কিন্তু, বলে যেতে পারে না মজিরনকে সেই আভাসটুকুও। তবু, অনুসন্ধান সচল থাকলে প্রজন্মের দেখা ভূতের মুখোমুখিও হতে হবে প্রজন্মের পাঠকগণকে; মুখোমুখী হতে হয়। লক্ষ্য করুন, মফিজের মেয়ে মজিরন কিংবা পাঠকের উত্তরজন্ম, কোন ভূতের কবলে তখন! মফিজ যেমন দেখেছে ভূতের অবয়ব ঠিক স্পষ্ট নয়, কিন্তু বিচিত্ররূপী, ভয়ঙ্কর। মজিরনও কি ভূতের প্রকৃত স্বরূপটা ধরতে পারবে? হয়তো লেখক আরেক গল্প ফেঁদে আরেক আশার পাখিকে উড়িয়ে দিবেন অসীম আকাশে, নিরুদ্দেশে। কিন্তু, নিরুদ্দেশ তো লক্ষ্য নয়। মফিজ তো তার উদ্দেশ্যে, তার অভিমুখে, তার ঘরে ফিরতে চেয়েছিল! পিশাচটা বার বার তার পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিয়েছে, হাঁটু জলকে করেছে নিতল; চেনা ডাঙা হঠাৎ হয়েছে অচেনা দিক-চিহ্নহীন পাথার। মফিজ তো মজিরনকে ভূতের চেহারাটি বলে যেতে পারেনি! কোন ভূতে মফিজকে বর্ষার অন্ধকার রাতে চড়কের বিলে ডেকে নিয়েছিল? কী কৌশলে? কাঁচা মাছের লোভ দেখিয়ে? উমহুঁ, সত্যি নয়। লোভটোভ কিছু নয়। মফিজ তো লোভী নয়! ফলে, গল্পের পাঠোদ্ধার এখানেই শেষ হলো না।

পূর্বকৃত পাঠে, পাঠক তো ‘ক্ষুধা’ নামের ভূতটিকে চিনেছেন! মফিজ তা বুঝতে পারেনি। মজিরনও বুঝবে না। আর পাঠক, তারই বা বুঝে ফল কি! ভূত আছে। মফিজ মরে গিয়ে প্রমাণ করেছে ভূতের অতীত আছে।

পূর্বকৃত পাঠে, পাঠক তো ‘ক্ষুধা’ নামের ভূতটিকে চিনেছেন! মফিজ তা বুঝতে পারেনি। মজিরনও বুঝবে না। আর পাঠক, তারই বা বুঝে ফল কি! ভূত আছে। মফিজ মরে গিয়ে প্রমাণ করেছে ভূতের অতীত আছে। মজিরন অতীতকে ভুলতে পারে না। মফিজের মতো সেও কোন ভূতের হাতছানিতে কেমনতর গ্রাসে পরিণত হবে কে বলতে পারে! সুতরাং, কাহানি আভি বাকি হ্যায়! কেন না, ভূত আছে তো ভূতের বাপ-মা-ও আছে। ভূতের রূপকার আছে, একটা না বহু, নানান আকারের, নানান চেহারার। ভূতের ভবিষ্যৎ আছে, ভূতের বসবাস, ঘর-সংসারও আছে। ভূত বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকার জন্য তারা শিকার করে, শিকার ধরে, খায়। ঐ, যেমন মফিজকে খেলো! এখানে গল্পের আরেকটি পাঠ শুরু হতে পারে। শুরু হতে পারে যদি পাঠক ইচ্ছে করে, যদি পাঠক সাহস করে। নয়তো গল্পের পাঠ এখানেই শেষ, যেটুকু এ পর্যন্ত বলা হলো যে, ভূত আছে, ভূতের সাথে যুদ্ধ আছে, মফিজের কিংবা মফিজরূপী পাঠকের হেরে যাওয়া, দিশা না-পাওয়া, হারিয়ে যাওয়া অনিবার্য। কিন্তু, পাঠক যদি ইচ্ছে করে, সাহস করে প্রশ্ন করেই বসে— কেবলই ভূত কেন জিতে যায় আর বেঁচে থাকে, ভূতগুলো কেমন করে বেঁচে থাকে? ভূতেরা কোথায় বসবাস করে? কেন মফিজরা ভূতেদের চিনতে পারে না? কোথায় থাকে ভূতের প্রকৃত আস্তানা? কোথায় লুকানো ভূতের প্রাণ ভ্রমরা? কিন্তু না, এমন রূপকে আর বেশিক্ষণ পাঠকের থাকা চলবে না, থাকা চলে না; নয়তো মফিজের মতো পারিণতি তারও অনিবার্য। এইসকল প্রশ্নের মিমাংসা পেতে হলে যে আরও নির্দিষ্ট, আরও মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করতে হয়, যে প্রশ্নটি মফিজ করতে পারেনি, মজিরনও করতে পারবে না। মফিজ প্রশ্ন করতে পারেনি, হুজুরের ১০টাকার ফু-দেওয়া পানিতে ভূত নামে না কেন? পকেটের টাকা উধাও হয় অথচ ভূত কেন ছাড়ে না? সারাজীবন ধরেই তার মঙ্গা থাকে কেন? তার মঙ্গা তথা ক্ষুধা দূর হয় না কেন? তার কাজ নেই কেন? জমি নেই কেন? প্রশ্ন করতে পারে না— দেওয়ানীর ঘরে ক্ষুধা বাসা বাঁধতে পারে না কেন? সারা বছর দেওয়ানীর ঘরে তিন বেলাতেই চুলার আগুন নিভে না কেন? পাঠক যদি সত্যিই সাহসী হন, তবে, এই প্রশ্নসমূহের উত্তর পাওয়া যেতে পারে আর গল্পের প্রকৃত পাঠোদ্ধারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে পারেন পাঠক। অবশ্যই গল্পের সমূহ কালো কালো অক্ষরের অন্ধকার থেকে মুখ তুলে বাস্তবতায় চোখ রেখেই এই প্রশ্নগুলো করা বাঞ্ছনীয়। চোখ রগঢ়ে বাস্তবে তাকানোই তখন কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয়। তখন হয়তো পাঠক নিজেকে একটি নির্দিষ্ট ভূগোলের ভিতরে অস্তিত্বমান দেখতে পাবেন। পাঠক দেখতে পাবেন, সেই ভূগোলে একটি সমাজব্যবস্থা আছে, আছে একটি উৎপাদনব্যবস্থা আর নানান চেহারার ও নানান স্তরের সেই ব্যবস্থার চৌকিদার, ব্যবস্থাপক ও নিয়ন্ত্রকও। এই ভাবনার অবসরে পাঠকের ক্ষুধা পাবে, নিশ্চয় পাবে। পাঠক দেখবে তার ঘরে খাবার নেই। পাঠক বুঝতে পারবে তার খাবারের জন্য কাজ দরকার, তখন দেখবে তার কাজ নেই। তারা হয়তো কাজ পাবে কিন্তু যথোচিত মজুরি পাবে না, তার ক্ষুধার পর্যাপ্ত খাদ্য পাবে না। চার পাশে সে খাবারের প্রাচুর্য দেখবে, কিন্তু ছুঁতে পারবে না, খেতে পারবে না। পাঠক তার অর্জিত খাবারটুকু তখন ভূতের ভাঁড়ারে তুলে দিয়ে আসবে নত মুখে, ক্ষুধার্ত পেটে; কিন্তু কিছুই করতে পারবে না। পাঠক এবার স্মরণ করুন, মফিজ কেমন করে তার ধরা মাছগুলো, সেই চড়কের বিলের অন্ধকারে, ভূতের লোভী মুখে ছুঁড়ে দিয়ে নিঃস্ব হয়েছিল! আর রাতভর শ্রমে ধরা মাছগুলো নামমাত্র মূল্যে বাজারে বিকিয়ে এসেছিল যা দিয়ে আধা সের মাত্র আটা কেনা যায়! মনে আছে? মফিজের শ্রমের ফল কারা ভোগ করে? পাঠক হয়তো আবিষ্কার করে ফেলবেন পাতি-ভূতের, মাঝারি ভূতের এমনকি মহাভূতের, মহা-মহাভূতের প্রাণ ভ্রমরাটি, দেখে ফেলবেন ভূতের স্পন্দমান হৃদ্পিণ্ডটিও; কিন্তু কিছুই করতে পারবে না। এই না পারা পর্যন্তই তো আসলে যুদ্ধ। বাকিটুকু? যেমন গল্পের উপসংহারটি আশান্বিত, শিল্পিত! তেমনই কেবলই আশার গল্প সব, হতাশারও। নয় কি?

এই বিষয়গত পাঠোন্মোচনের পাশাপাশি শিল্পতাত্ত্বিক পাঠোন্মোচনও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেবল শিল্পের রসাস্বাদনের মধ্যেই তার শেষ হয় না। ঐ যে, বলেছি, শিল্পের আড়াল; ওটাকে এক্সপ্লোর করতে, এক্সপোজ করতে রসাস্বাদনের সাথে সাথে শিল্পের অভিঘাতটিও মনের, হৃদয়ের কিংবা মগজের শিল্পরসিক সংবেদনে গ্রহণ করতে হয়। এই অভিঘাতেই সেই আড়াল, গোপন আধারের দ্বার উন্মোচিত হয়। পাঠকের বোধকে এজন্য আবশ্যকরূপেই শিল্পসংবেদী হতে হয়। যেমন মহামতি সক্রেটিস বলেন, পাঠককেও শিল্পী, কবি হয়ে উঠতে হয়। খ্যাতিমান সাহিত্য সমালোচক এবারক্রাম্বি সাহিত্যের, শিল্পের সঞ্চার সক্ষমতাকে অনিবার্য গুণ হিসেবে দেখেছিলেন। ‘ভূতের সাথে যুদ্ধ’ গল্পটির সেই সক্ষমতা রয়েছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ চলে না। গল্পকার সেই আড়ালটি উন্মোচন করতে সঞ্চরণক্ষম সেই শিল্পদক্ষতার যথার্থ প্রয়োগও ঘটিয়েছেন এই গল্পে। কিন্তু, পাঠকের এন্টেনা যদি দুর্বল হয় কিংবা মগজের সংবেদন যদি হয় ভোঁতা, তবে আর পাঠোন্মোচন যথাযথো হলো না, উন্মোচনের সুযোগ ও সম্ভাবনাই তৈরি হলো না, হবে না; বলতেই হয়। এই গল্পটিতে দারিদ্র্যের অভিঘাত, দারিদ্র্যে রাজনীতি পাঠকের বোধে সঞ্চার করতে দারুণ শিল্পের প্রয়োগ রয়েছে। এখানে বলা জরুরি যে, পাঠকের যে সংবেদনের কথা বলা হচ্ছে তা আসলে তৈরি হয়ে ওঠে পাঠকের সমাজবাস্তবতার মিথস্ক্রিয়ায় তার মর্মের ভিতর থেকে, তার যাপনের অভিজ্ঞতা বিশ্লিষ্ট কিছু মানবিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক অনুসিদ্ধান্ত থেকে। পাঠককে সমাজব্যবস্থার প্রতি, সমাজকাঠামোর প্রতি সুতীক্ষ্ণ নজর রাখতে হয় তার জন্য। পাঠকের পর্যবেক্ষণ ব্যতীত তার অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার পূর্ণ হবে কী করে! দারিদ্র্যের রাজনীতি, অসমতার ধর্ম-সামাজিক অপপ্রচার ও বৈষম্যের নামে ন্যায়চেতনার শ্রাদ্ধ বিষয়ে পাঠকের কিঞ্চিৎ সচেতনতা থাকা জরুরি। ক্ষুধাই যদি প্রকৃত ভূত হয়, তবে, অসমতা হলো সেই ভূতের আত্মা। সমগ্র সমাজব্যবস্থায়ই একটি ভূতের খামার। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় কিংবা রাষ্ট্রীয়সহ সকল প্রকার কর্তৃত্বই এই ভূতের খামারের মালিক। নিশ্চিত জানুন, তারা এই গল্পের পাঠক নন। সুতরাং ক্ষুধার শৈল্পিক অভিঘাতটি তাদের জন্য নয়। ‘ভাত দে হামারজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো’—বললে কাব্য হয়ে ওঠে; ক্ষুধার কাব্য কিন্তু এতে রাষ্ট্র টলে না, শাসকের আসন দুলে ওঠে না। এখানে ক্ষুধার স্বরূপ অতোটা উন্মোচিত হয় না যতটা হলে মানচিত্র খাওয়া যায়। কিন্তু, ক্ষুধার আধার যে বোতলে, সেখানে ভূত থাকে, সেই বোতলের লেবেল তথা মানচিত্র, কর্তৃত্বের মুখোশটা যথার্থরূপেই চেনাতে সক্ষম হন কবি। এবার কথাশিল্পী কমলকুমার মজুমদারের ‘নিম অন্নপূর্ণা’য় একটু চোখ নিবদ্ধ করুন, দেখুন তো গল্পকার কেমন করে ক্ষুধার ছবি আঁকেন শিল্পীর তুলিতে! ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ বিপ্লবী কবি সুকান্তের বোধের এই ক্ষুধার শিল্পচিত্রও কম অভিঘাতপ্রদ নয়। কিন্তু, বহুপাঠে, বহুশ্রুতিতে পাঠকের কাছে এই উপমা আর রূপক ক্লিশে বোধ হতে পারে। বলা বাহুল্য, সুকান্তের বিপ্লব সেই কর্তৃত্বের কাছেই মার খেয়েছে; ক্ষুধার্তের সংগ্রাম সফল হয়নি। মফিজের ঔষধের ফর্দ, তার ক্ষুধার আর্তি সেই কর্তৃত্বের কাছেই নিগৃহিত হয় চরমভাবে। ফলে, ক্ষুধার শৈল্পিক অভিঘাতে ক্ষুধার্তকে, পাঠকগণকে জাগানোর প্রচেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সুতরাং, কবি নয় কেবল, কথাসাহিত্যিকগণের গদ্যও সেই সংবেদন জাগাতে ব্রতী। তাদের হাতেও ক্ষুধার বয়ান অবিসংবাদিত কবিতা হয়ে ওঠে। কমলকুমার মজুমদার ‘নিম অন্নপূর্ণা’য় ক্ষুধার অবয়ব, মানচিত্র আঁকায় এখানে আরও এক ধাপ অগ্রসর।

‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ বিপ্লবী কবি সুকান্তের বোধের এই ক্ষুধার শিল্পচিত্রও কম অভিঘাতপ্রদ নয়। কিন্তু, বহুপাঠে, বহুশ্রুতিতে পাঠকের কাছে এই উপমা আর রূপক ক্লিশে বোধ হতে পারে। বলা বাহুল্য, সুকান্তের বিপ্লব সেই কর্তৃত্বের কাছেই মার খেয়েছে; ক্ষুধার্তের সংগ্রাম সফল হয়নি।

একবার পড়ে আসুন— ‘লতি মেঘ কি করে হয় জানিস— হাজার হাজার বাড়ির রান্নার ধোঁয়া মেঘ হয়, ওটা না রুই মাছের ঝোলের মেঘ— ওটা না সোনা মুগের ডালের মেঘ’। ক্ষুধার্তের চোখে মেঘও খাবারের স্বাদ, গন্ধ আর রূপ নিয়ে আকাশে ওড়ে। এই গদ্যকবিতার (‘নিম অন্নপূর্ণা’) পাশে ক্ষুধার শিল্পিত ছবি, মানচিত্র ও ভূগোল অঙ্কিত হয়ে ‘ভূতের সাথে যুদ্ধ’ গল্পটিও দাঁড়িয়ে যায় সমান মর্যাদায়। ‘বুবু যার বাড়িত কাম করে, তামার ভাতের শ্যাষ নাই, পইসার নেখাজোকা নাই, ভাত বোঝাই একখান টাউন আছে— কত খাবু?’ সত্যিই কি টাউনে ভাতের অভাব নেই? কিন্তু, ক্ষুধার্তের এই কল্পনার অভিঘাত পাঠকের সংবেদনে কেন নাড়া দেবে না! ‘ভূতের সাথে যুদ্ধ’ গল্পে মজিরনের এই উচ্চারণ আর নিম অন্নপূর্ণার যুথির উচ্চারণে কোনো বৈশাদৃশ্য নেই। বৈশাদৃশ্য আসলে থাকে না, কোথাও-ই নয়। অবলীলায় যুথির মুখ এসে বসে যেতে পারে মজিরনের মুখে, তারা অবিকল। দুটি গল্প লেখার কালের ভিতর হয়তো ৩০/৪০ বছরের ব্যবধান রয়েছে, কিন্তু দুই শিল্পীর ক্ষুধার চিত্রে কোথাও অমিল নেই। তুলির আঁচড়ে হয়তো হেরফের রয়েছে, কিন্তু ছবি হয়েছে অনুরূপ, যেন একটি আরেকটির নকল। অতীতে ও বর্তমানে, স্থানের ভিন্নতায় ক্ষুধার রূপের কোনো হেরফের হয় না। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্তত আধুনিককালেই শতাধিক দুর্ভিক্ষের বয়ান পাওয়া যাবে। সেখানে অসংখ্য ক্ষুধার্তের আর্তি আছে এবং আছে সামান্য কিছু লোকের বিলাস জীবনের যুগপৎ ছবি। বলা যেতে পারে কালের ক্ষুধারা আসলে জমজ ভাই কিংবা বোন। আর সমস্ত কর্তৃত্বের, ক্ষুধার রূপকারদের চরিত্রও একই। প্রকৃতপক্ষে ক্ষুধার সমাজতাত্ত্বিক জিন সূত্র তো একই। তাই নয় কি?

তবু, গল্পের আরও পাঠ বাকি! ওটুকু পাঠকগণ নিশ্চয় বুঝবেন। নয়তো, পাঠকেরা মূলত মফিজ। মফিজের হেরে যাওয়াই পরিণতি। জীবন শেষ হবে, কিন্তু প্রজন্মান্তরে যুদ্ধ শেষ হবে না। তাহলে? তাহলে আর কি, বোঝাবুঝির কিছু নেই তবে। বোধ, গল্পের মর্মার্থ, পাঠোন্মোচন কিবা বিপ্লবের স্বপ্ন— এই সবই ভুলে যান, গল্পপাঠ শেষ হলে, স্বপ্নের মতো! পাঠ শেষে কিংবা ঘুমন্তের মধুর স্বপ্নের রোমাঞ্চ ঘুম ভেঙে গেলেই তো শেষ; তাই নয় কি? আর এটি তো আসলে একটি ভূতের গল্পই। ভৌতিকতার রোমাঞ্চই এ গল্পের অনুভব-সার; নয় কি?

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৭৯। কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: এই কথা বৃষ্টিবাচক (২০১৩, কাব্য), এভাবে খুলবে না আঁচলের খুঁট (২০১৪, কাব্য), সদা ভাগতেছে ভববান (২০১৪, কাব্য), নাঙ পূরাণ (২০১৭, কাব্য), স্বৈরমতি পিরিতের শূল (২০১৮, কাব্য), বাঙালির দ্বিধার চলক (২০২০, প্রবন্ধ), কুঁড়িকাল ও যুগযাপনের গল্প (২০১৪, সম্পাদিত গল্পগ্রন্থ)। সদস্য সম্পাদক, শিল্পসাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।