০১.
মনি হায়দার বহু বহু বিষয় নিয়েই গল্প লিখে চলেছেন! সেগুলো কখনো আমাকে বেশ টানে, কখনো একটু কম টান পাই! তবে, তিনি যখন একটা বিশেষ ভূভাগের গল্প বলেন; তখন আমি শুধু কী মুগ্ধ পাঠকই হয়ে থাকতে পারি? পারি না কিন্তু! তখন আমার ভেতরে আমি আর সুভদ্র থাকি কই? ভেতরে ভেতরে আমি তখন কেমন একটা ঈর্ষাঅলা -কেমন একরকমের -দ্বিপদ যেন হয়ে উঠি!
কী আশ্চর্য! ওই সেই দূর ভূমণ্ডল কিনা একান্তই কথাকার মনি হায়দারেরই অধিগত! জন্মসূত্রে প্রকৃতি কিনা তাঁকেই ওই ভূমার স্বত্ব আর দখলদারিত্ব দিয়ে রেখেছে! আর, আমি পাঠককে দেখো শুধু বিবরণ পাঠ করে করেই, ওই পৃথিবীর সঘন মেঘমালার ঝাপটাটুকু পেতে হচ্ছে! ওইই পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে! প্রকৃতির এ কী অন্যায্যপনা! আমার জন্য ওই ভূখণ্ডের পুরোটা ভূগোল পুরো এমন দুরধিগম্য করে রেখেছে সে! আমিও কী ওইখানে জন্মে যাবার ভাগ্য পেতে পারতাম না? পারতাম তো!
অমন ওই ভূভাগে কী আছে? আছে এক স্রোতস্বিনী! নাম তার কচা নদী! সেই নদী সুচির থইথই! ওই স্রোতজটিলা নদী কী শুধুই বিজনে বিজনে একাকী বহতা? নাহ! তার কূলে কূলে জনপদ! পাড়ে পাড়ে নদীলগ্ন জীবন! নিত্যদিনই এই নদী তল্লাটের লোকদের চোখের সামনেই বিরাজ করে, কিন্তু সে অবোধগম্য ও অনিকট! বরাবর!
সেইখানের জনপদে, মনুষ্য সংসারে সংসারে— সুখের দিন আসে! সেই সুখ স্বল্পায়ু! সুখের দিনগুলোর চেয়ে ঢের বেশী থাকে সেইখানে, দুর্গতির কাল! জীবনে রাষ্ট্রসংঘের ভয়াল থাবড়া পড়ে! দেশ-কেন্দ্রের রাজনীতির ঝাপট এসে এসে সেইখানে, জনপদের নিজস্ব রাজনীতিকে আরও ঘোরালো করে তোলে! শক্তিমানের শয়তানী আর ক্রূরতা তো সেইখানে চির বিরাজমান!
সেইখানে রাত্রি আর দিবসেরা আসে চোরা কূটকাচালী, হিংস্রতা, আশাপূর্ণতার বাঞ্ছাকে নিয়ে! কোনো আশাই যেন সেইখানে পূর্ণ হবার নয়! সেইখানে সর্বনাশ কেবলই যেন যেকোনো ছুতায় ছুতায় এসে হাজির হবার জন্য ঘোর প্রস্তুত হয়ে থাকে!
ইলিশের মওসুমে নৌকারা সেইখানে নদী মোহনার দিকে যাত্রা করার জন্য একে একে তৈরি হতে থাকে! বহুজনের নাও ঘাটে বাঁধা থাকলেও, দু-একজনের নৌকা নিঁখোজ হয়ে যায়! সাথে করে নিয়ে যায় ইলিশ ধরার ছান্দি জাল, আর লোকের বেঁচে থাকার সবটা তাকদকে! কোনো অন্যায়ের প্রতিবিধান করার কোনো পরিস্থিতি সেইখানে আসে না! সামান্যজনেরা ধুঁকন্ত থেকে আরও ধুঁকন্ত হতে হতে দেহ ধারণ করে চলে শুধু!
সেইখানে বৃক্ষে বৃক্ষে অঢেল সবুজ! কচা নদীতে তুরন্ত-দুরন্ত ঢেউ! সাধারণ জনের জীবনে জীবনে আছে অসাধারণ সহজতা! আছে নিরুদ্ধার বেদনার ভার!
ওই সমস্তকিছুকে গল্পের তরঙ্গে তরঙ্গে, অতি অবলীলায় ভাসিয়ে আনেন মনি হায়দার! আমি গন্ধে গন্ধে সেই বাস্তবতাকে পাই! চোখের সম্মুখে ওই বাস্তবতা এসে দাঁড়ায়! জিভেও যেন কখনো কখনো এসে ঝটকা দিয়ে ওঠে তিক্ত ও কটু ও ঝাল ও মিঠা স্বাদ! শ্রবণেন্দ্রিয় পায় আক্রোশ ও নরমতার বিবিধ ধ্বনি!
আমি তাঁর ওই গল্পগুলোকে ভালোবাসি!
০২.
তবে মনি হায়দারের ‘ইলিশের মাংস’ বইয়ের গল্পগুলো পড়তে পড়তে অন্য আরেক বোধকে পেলাম আমি! সেইকথা বিস্তারিত বলার আগে বরং এ-বইয়ের গল্পগুলোর নাম জেনে নিতে পারি!
এখানে কচা নদীতীরের জনপদ এবং জীবনের গল্প আছে দুটি : ‘আসমানী মেওয়া’ আর ‘ইলিশের মাংস’।
অন্য গল্পগুলোর শিরোনাম এমন : ‘আহীর আলমের বাম পা : এক’, ‘আহীর আলমের বাম পা : দুই’, ‘আহীর আলমের বাম পা : তিন’; ‘আসুন, আমরা আবদুল খালেকের একটা ছবি আঁকি’, ‘মুজিবনগরে, আমবাগানে’, ‘আয়নায় ভেঙে যাওয়া ছবি’, ‘ছায়াবাজি’, ‘গৃহপালিত পশুর চিড়িয়াখানা গড়ে উঠবার প্রণালি’, ‘রক্ত থেরাপী’, ‘রাত যখন খানখান হয়ে যায়’, ‘সর্বনাশের পরও যে প্রেম সবুজ বোনে’, ‘স্পর্শ’, ‘বৈশাখের প্রেম’।
প্রথম নজরে এই পনেরোটি গল্পকে মনে হবে এরা বিচ্ছিন্ন কয়টা গল্প মাত্র, এদের মধ্যে আপাত কোনো যোগ নেই! কোনোটিই যেন কোনোটির সাথে সম্পর্কিত নয়! কিন্তু গল্পগুলো পড়ে নিতে নিতে আমাদের সেই ধারণাটা বদলে যেতে থাকবে! তখন আমরা দেখতে পাবো, মনি হায়দার এই বইয়ে, একটি দুর্দান্ত ঘটনা ঘটিয়ে নিয়েছেন!
প্রথম নজরে এই পনেরোটি গল্পকে মনে হবে এরা বিচ্ছিন্ন কয়টা গল্প মাত্র, এদের মধ্যে আপাত কোনো যোগ নেই! কোনোটিই যেন কোনোটির সাথে সম্পর্কিত নয়! কিন্তু গল্পগুলো পড়ে নিতে নিতে আমাদের সেই ধারণাটা বদলে যেতে থাকবে! তখন আমরা দেখতে পাবো, মনি হায়দার এই বইয়ে, একটি দুর্দান্ত ঘটনা ঘটিয়ে নিয়েছেন!
এখানে গল্পগুলোকে কাঠমোগতভাবে বিচ্ছিন্ন দেখাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তারা আদতে অবিচ্ছিন্ন! এইখানে গল্পরা একে অপরের সাথে গভীররকমে লগ্ন হয়ে, আমাদের এমন এক ভূখণ্ডের গল্প বলে চলেছে; যেই ভূভাগ অবধারিতভাবেই রাজনীতি শাসিত! গুমখুন দিয়ে ভয়াল ক্ষতাক্ত! খুনীরা সেখানে প্রায় সকল সময়েই পরাক্রমশালী বটে, তবে সেই দেশে শেষ পর্যন্ত শুভও জিতে যায়! ওই শুভকে অবশেষে প্রতিষ্ঠা দেয় কারা? সাধারণ জনতা! তারা যখন ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, তখনই শুভ জয় পায়!
এই ভূভাগ একদিন একটা ভয়াল যুদ্ধকে পেতে বাধ্য হয়েছিলো! জনপদবাসীরা বহুদিন হয় ওই যুদ্ধের দিনকে পেরিয়েও এসেছে! তাও বহুদিন পরের এই এখনকার সময়েও, বহু সংসারে বহু হৃদয়ে, এখনও ওঠে কান্নার রোল। প্রিয় সন্তানকে হারানোর যাতনায়, এখনও বিলাপে বিলাপে, রাত্রিকে ফালাফালা করে দিতে থাকে জননী! এই মা বৃদ্ধ থেকে ক্রমে অতি বৃদ্ধ হয়ে আসছে; কিন্তু তার ক্রন্দন তার সন্তানশোক এখনও আছে তাজা দগদগে!
এটাই ওই ভূখণ্ডের প্রকৃত পরিস্থিতি! নব সময়ের জীবন সেখানে এগিয়ে চলছে প্রাকৃতিক নিয়মে! সেখানে ক্রমে আসছে নব প্রকারের চটক ও বিনোদন! নতুন প্রজন্মের মানুষ পাচ্ছে নব জীবনধারা। নতুন কালে জীবনের ভিন্নরকমের দৌড়ে থাকতে থাকতে তারা পেয়ে যাচ্ছে নব নব জটিলতা ও বিচিত্র বিপন্নতাকে! পাচ্ছে আরও ব্যাপক দুর্গতিকে! জীবন চলিষ্ণু এইখানে! বিবিধ বিষয়ে মত্ত, বিবিধ রকমে উদভ্রান্ত!
কিন্তু তারপরেও ওই দেশরাষ্ট্র বা ওই সমস্তটা ভূভাগের গহনে জেগে আছে এক বিলাপ! একাত্তর সালকে যে পেতে হয়েছিলো তাঁকে, জন্মভূমি রূপিনী এই জননীকে! তাঁর সন্তানশোক, তাঁর নিরুদ্ধার বেদনা কী ঘুচে গেছে? কদাপি কী সেটি হয়েছে? কখনোই নয়! কখনোই যায়নি!
দিনের কোলাহলে ওই ক্রন্দনরোল চাপা পড়ে যায় হয়তো, কিন্তু রাত্রির ঘন নিঃঝুম শব্দহীনতার কালে যদি কান পাতা যায়, তখন ঠিক শোনা যাবে ওই চাপা বিলাপ ধ্বনি! এই দেশের অন্তরের আদত অবস্থাটা তখন ঠিক তুমি অনুধাবনে সমর্থ হবে! জননী মাতৃভূমি শোক দগ্ধ থেকে থেকেই তাঁর নবকালের সন্তানদের স্নেহশুশ্রুষা দিয়ে চলেছেন!
যুদ্ধ চলে গেছে কবে! তারপরে আবার নতুন রকমে নিজেকে গুছিয়ে নিতে নিতে এগিয়ে চলছে ওই জনপদ! আবার জীবন শুরু করেছে তার রোজকার চলাচলতি! আবার নতুন মানুষেরা অনুশীলন করা শুরু করেছে পাপ ও দুষ্কর্মের! তাদের বহু বহুজন, প্রাণের আশ মিটিয়ে উৎকোচ আত্মস্থ করে চলছে! অসাধুতার অনুশীলনকেই করে তুলেছে একমাত্র আচরণীয় ধর্ম! সেই বরাবরের মতোই!
তারপর কী হচ্ছে?
তাদের পূর্বসূরীদের মতো, এই নতুনকালের লোকেরাও; যথেচ্ছ ঘুষ খেয়ে, বা জীবনভর অন্যবিধ অনাচার করে করে; তারপরে কী করছে? ওই পূর্ববর্তীদের মতোই এরাও, জীবনের শেষ বেলায় এসে বিবিধ পুণ্যকর্মে মন দিচ্ছে! তওবা পড়ে-টরে, নিজেদের সাফ-সাফা করার উদ্যোগ নিচ্ছে!
কিন্তু এখন আর নিস্তারলাভ কী অতো সহজ! ঘুষ খেতে খেতে খেতে, সেটাই না এখন হয়ে উঠেছে ওদের স্বাভাবিক খাদ্য? ওই খাদ্য গ্রহণের ওপরই না এখন নির্ভর করছে তাদের দেহের সুস্থতা? হায়াত মউত? তাই এখন সহস্রবার তওবা পড়লে কী! নিজেকে সারাই করার আর কোনো উপায় তাদের নেই! ঘুষ খাওয়া বন্ধ করা মাত্র, তাদের দেহ অচল হয়ে ওঠে! তক্ষণ তক্ষণ শরীর থেকে রক্তমূত্র নিঃসরণ শুরু হয়! কোনো অষুধেই আর ওই রক্তমূত্র নির্গমণকে সারাই দেয়া যায় না!
তাহলে, এই ব্যামো থেকে রেহাই পাওয়ার কী কোনো নিদান নেই? আছে! নিদান আছে! শুধুমাত্র একটি উপায়েই সেরে ওঠা সম্ভব! সেটি হচ্ছে, আবার ঘুষ খাওয়া শুরু করা! তাহলেই লোকসকলের শরীর নিমেষে স্বাভাবিক মূত্রকে ফিরে পেতে পারে! ফিরে পায়ও! তাদের দেহ সুস্থির হয়ে আসে তক্ষণ তক্ষণই! এমনই পাপাচার নিবেদিত সেইসব শরীর!
দেশটির শহরে শহরে এমত বহুপ্রকারের দুষ্কর্ম-আচারী লোক জনগণ বসবাস করে! তাহলে সেই জনপদের গ্রামে গ্রামে এখন জীবনের কেমন দশা? সেই যে কচা নদী, তার পাড়ের মানুষের জীবনে কি এখন আলো এসেছে? অনেকটা আলো না হোক, অল্পখানিকটা আলো? এসেছে কী এখন?
আমরা দেখতে পাই, যুদ্ধ পরবর্তী নতুন কালের গ্রামে গ্রামে, জীবন আছে সেই আগেকার কালের মতোই স্তব্ধ, শ্লথগতি, প্রায় অচল! নাগরিক সচলতা থেকে বহু দূরবর্তী! সেখানে আঙুর ফল এখনও বেহেশতী মেওয়া হয়ে আছে সর্বসাধারণের কাছে! প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে যায়, কেউ এমনকী ওই বেহেশতী মেওয়াকে চক্ষের দেখাটা দেখে ওঠার ভাগ্য পায় না!
আমরা দেখতে পাই, যুদ্ধ পরবর্তী নতুন কালের গ্রামে গ্রামে, জীবন আছে সেই আগেকার কালের মতোই স্তব্ধ, শ্লথগতি, প্রায় অচল! নাগরিক সচলতা থেকে বহু দূরবর্তী! সেখানে আঙুর ফল এখনও বেহেশতী মেওয়া হয়ে আছে সর্বসাধারণের কাছে! প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে যায়, কেউ এমনকী ওই বেহেশতী মেওয়াকে চক্ষের দেখাটা দেখে ওঠার ভাগ্য পায় না! তাকে আস্বাদ করা তো দূর! সেই মেওয়া তাদের জন্য চির দুর্লভ এক ফল! ওটি অধিগত করার শক্তি আছে কার? টাউনের টাকাঅলাদের!
তবে কেবলই বেহেশতী মেওয়াকে চক্ষের দেখাটা দেখে উঠতে চাওয়ার আদি সহজতার মধ্যেই বসবাস করে না তারা! সেখানেও জীবন দুর্গতি আক্রান্ত! সেই চিরকালের মতোই সেইখানে এখনও, সামান্যজনের সরল দাম্পত্য-শান্তিকে মিসমার করে দেবার জন্য উদগ্র হয়ে আছে অর্থবান কুচক্রী!
বরাবরের মতোই এখনও সেখানে, যে-কোনো দরিদ্র সংসারের নবীনা রূপময়ী স্ত্রীটিকে অধিগত করার জন্য শক্তিমান পামরেরা উন্মত্ত হয়ে ওঠে! আর পথের বিঘ্ন যে তরুণ স্বামীটি, তাকে গুমখুন করে নেয়াকেই সহজ উপায় বলে গণ্য করে তারা! সেই গুপ্তহত্যার বিচার হয় না!
সেই বরাবরের মতোই এখনও, ধনবান পামরের ওই অন্যায়েরও প্রতিবিধান হয় না! সকল অপরাধী এইখানে গৌরবের সঙ্গে বিহার করে চলে! সকল আক্রান্তজনই এইখানে যাপন করতে থাকে বিভীষিকার জীবন!
০৩.
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, এখন, জনপদের অতি সাধারণ নগরবাসীগণ কেমন আছে? কতোটা সুস্থ আছে তারা? সম্পূর্ণ সচল আর সক্রিয় কী আছে তারা? আমরা জানতে পারি, নাগরিক লোকসকলে এখানে দেহধারণ করে আছে! আছে তারা সমাজ নির্ধারিত সংসারে! দারাপুত্রকন্যা ও পরিবারের পোক্ত বিধিবেষ্টনেই আছে সকলে! কিন্তু তারা ভালো নেই! তারা প্রত্যেকেই বিষম অসুস্থ! কেউ প্রকাশ্যে অসুস্থ! কারো অসুখ ভেতরে ভেতওে শুষে খাচ্ছে ব্যক্তির রক্তকণিকা! আর ওই ব্যাধিগুলো বড্ড জটিল! নির্ণয়-অসাধ্য এক অসুখে ভুগছে এইখানের বাসিন্দারা, যেটি থেকে আরোগ্য লাভ করাও কখনো আর সম্ভব হয় না!
আবার এমনও নয় যে, অসুখটি একেবারে তক্ষণ তক্ষণ লোকের প্রাণ সংহার করে নেবে! এই অসুখ প্রাণে মেরে ফেলে, রোগীটিকে মুক্তি দেয় না! কিন্তু ওটি দিনে দিনে হয়ে ওঠে ব্যক্তির অস্তিত্বের অংশ! তারপর ওটি আক্রান্ত মানুষটিকে অথর্ব থেকে বিপুল অথর্ব করে দিতে থাকে! দেহ বেঁচে থাকে, কিন্তু ওটি হয়ে যায় যেন দুর্বহ এক বোঝা! কোথাও কোনোদিকে আর পরিত্রাণ নেই! একটুও কোনো নিস্তার নেই!
শহরে শহরে আর রাজধানীর সবখানে; চিকিৎসার জন্য বিস্তর চিকিৎসাশালা আছে! চিকিৎসকও আছে গণ্ডায় গণ্ডায়! ব্যাধি নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা কেন্দ্রও আছে অগুনতি! সেই সবখানে নিদানসন্ধানী ব্যাধিত্রস্ত বিপন্নরা শরণ নেয়! আষাঢ়ের ঢলের মতো বিপুলবেগে সকল সঞ্চয় নিঃশেষ হয়! কিন্তু কোনোভাবেই লোকের পক্ষে আরোগ্যকে পাওয়া সম্ভব হয় না!
এক নগরবাসীর নাম আহীর আলম! হঠাৎই একদিন আহীর আলমের বাম পায়ে, জটিল এক অসুস্থতা দেখা দেয়! ব্যথা বোধ করতে থাকে সে! যেন তার চলৎশক্তি ফুরিয়ে যেতে থাকে! নিরাময়ের জন্য দিশেহারা হয়ে সে ছুটতে থাকে এক চিকিৎসক থেকে অন্য চিকিৎসকের দরোজায়! কিন্তু নিরাময় মেলে না!
ব্যাধি তাকে যতো আঁকড়ে ধরতে থাকে, ততোই সে বোধ করতে থাকে যে; সে এবং অন্যরা আদতে আদ্যোপান্ত কী বিপন্ন! কী বিষম নিসঃঙ্গ! একার অধিক কতোটা একা তারা! ঠিক সেই চিরকালেরই মতো, অসুখে ভুগতে থাকা সংসারী ব্যক্তিটিকে সংসার তার প্রকৃত চেহারাটা দেখিয়ে দিতে থাকে! উপেক্ষা, অনাদর দিতে কোনো একটুও কুণ্ঠা করে না! সকলের কাছে সে অসহ হয়ে ওঠে! ক্রমে ওই ব্যাধিভোগান্তী পেতে থাকা ব্যক্তিটি, গৃহে থেকেও, হয়ে যেতে থাকে গৃহহীন, নিরালম্ব আর পরিত্যক্ত!
তখন ওই বিপন্ন মানুষটির অন্তরের অবলম্বন হয়ে কে আসে? আসে তার মতোই আরেক অসহায় প্রাণ!
তবে সে মনুষ্যসন্তান নয়, সে একটা তেঠেঙ্গা উদ্বাস্তু কুকুর! সে আহীর আলমের কাছ থেকে পায় অভাবিত মমতা! তারপর সে আর ওই বিকল হয়ে যেতে থাকা মনুষ্যপুত্রটিকে পরিত্যাগ করে না! তার পাশে রয়ে যাবার সর্বচেষ্টা করতে থাকে।
আহীর আলমের অচিকিৎস্য ব্যাধি আর অমোঘ পঙ্গুত্বের গল্পগুলো পড়তে পড়তে অকস্মাৎই মনের ভেতরে একটা শঙ্কা ঘাঁই মেরে ওঠে! আচ্ছা! এই আহীর আলম কী শুধুই এক গল্পের চরিত্র! নাকি ওটা আমিই! নাকি ওটা আমরা সকলে! আমরাই তো নানা নাম নিয়ে, অমনই কোনো না কোনো আরোগ্য-অসাধ্য পঙ্গুত্ব নিয়ে, সংসারগৃহীত হবার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছি? আমরাই না ওটা?
আহীর আলমের অচিকিৎস্য ব্যাধি আর অমোঘ পঙ্গুত্বের গল্পগুলো পড়তে পড়তে অকস্মাৎই মনের ভেতরে একটা শঙ্কা ঘাঁই মেরে ওঠে! আচ্ছা! এই আহীর আলম কী শুধুই এক গল্পের চরিত্র! নাকি ওটা আমিই! নাকি ওটা আমরা সকলে! আমরাই তো নানা নাম নিয়ে, অমনই কোনো না কোনো আরোগ্য-অসাধ্য পঙ্গুত্ব নিয়ে, সংসারগৃহীত হবার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছি? আমরাই না ওটা? আমরাই না অমন অচিকিৎস্য ব্যাধির পেষণে নিস্তেজ হতে হতে হতে কেবলই ধুঁকছি? কেবলই না ধুঁকছি?
মনুষ্যসন্তানের জন্য প্রাণিকুল আর প্রকৃতির নিকট থেকে নিকটতর হয়ে ওঠাটাকে খুব জরুরী বলে গণ্য করেছেন লেখক! আরও এক দারুণ নিদানের সন্ধানও দিয়েছেন তিনি! তাঁর কাছে অনামা, সাদাসিধে, সামান্য জীবনই গণ্য হয়েছে পরিত্রাণের আরোগ্যসদন বলে!
লোভময় ক্ষতজরজর যে সংসারজীবন, যেখানে বার্ধক্যের কালে আমাদের জন্য বরাদ্দ হয়ে আছে নিকটজনের উপেক্ষা! আর আছে আত্মীয়গণের সম্পত্তিলিপ্সার দংশন! সেই ঘোর বিপন্নতার দিনে আমাদের জন্য উদ্ধার হয়ে আসবে কী? কীভাবে রক্ষা মিলবে? কোন পথে! কেবলই সন্তানদের উপেক্ষা সয়ে সয়ে, আর কপালে নিরুপায় করাঘাত করে করে?
নাহ! ওই ঘিনঘিনে আর মৃত্যু-অপেক্ষাময় সংসারবাস অপেক্ষা বাণপ্রস্থ উত্তম! বৃক্ষকুল ও অবোধ প্রাণিদের কাছে চলে গিয়ে, অনামা একজন হয়ে যেতে পারার মধ্য দিয়েই, ব্যক্তি সত্যকারের বেঁচে থাকার উল্লাসকে পেয়ে যেতে পারে!
কখনো কখনো মনে হতে থাকে, গল্পকার যেন কঠিনরকমেই বোধ করে চলছেন যে, মানুষের কাছ থেকে মানুষের আর কিছু পাবার নেই! মানবিক সুধা ও দরদ একেবারেই ফুরিয়ে গেছে! রূঢ়তা ও আঘাত ছাড়া যেন একে অন্যকে আর কিছু দেবারও নেই এইখানে!
তারমধ্যেও, আমাদের অমন নিষ্করুণ নিষ্ফল পণ্ডপ্রায় মনুষ্যজীবনের জন্যও, অমল মমতা নিয়ে কে যেন ঠিকই জেগে আছে!
ওইভাবে কে জাগে? চিরকাল ধরে কে জেগে থাকে?
মনি হায়দার জানান, ওইভাবে আমাদের জন্য প্রকৃতি জাগে! জাগে প্রকৃতির অবোধ প্রাণীরা!
০৪.
মানুষের ক্রূরতায়, মানুষের দেয়া আঘাতে আঘাতে, এইখানে মানুষ বিপন্ন হয়ে ওঠে ঠিকই; তখন প্রকৃতির শ্রুশ্রুষা পাওয়া ছাড়া ব্যক্তির আর গত্যন্তর নেই; এমন বোধও মনি হায়দার ব্যক্ত করে চলেন ঠিকই! তবে মানুষই কিন্তু মনি হায়দারের পৃথিবীতে আবার শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির শেষ আশ্রয় হয়ে আসে! রূঢ় পাষ-, দয়াহীন অশুভগণ সকল সুস্থিরতা ও শুভকে লণ্ডভণ্ড করে দেয় সত্য! কিন্তু ওই ছন্নভন্ন বিধস্ত দুনিয়াকে সারিয়ে তুলতে, সেখানে আবার শান্তি জাগাতে কিন্তু, এগিয়ে আসে মানুষই!
তারা অতি বলশালী, বিক্রম-পরাক্রান্ত কেউ নয়! তারা অশক্ত আর নিতান্ত সামান্যজন! আবার ভীরুও তারা! সবকিছুকে ভয় পায়। যেকোনো একটা কিছু করার জন্য পা বাড়াতে গিয়ে আতঙ্কে কেঁপে ওঠে!
তবে, নিজের ওই কম্পমানতার মধ্যেই তারা অল্পে অল্পে একটি সত্য অবশেষে বুঝে উঠতে সমর্থ হয়! তারা বুঝে উঠতে পারে যে, যদি ওই সামান্য-সকলেই একসাথে মিলে যেতে পারে; যদি তারা একযোগে রুখে দাঁড়াতে জানে; তাহলে, তাহলে তারা যা করে উঠতে চায়, সেটি করা সম্ভব! তখন কোনো কর্মই আর অসম্ভব-কর্ম হয়ে থাকবে না!
থাকে নাও! বিরূপ রাষ্ট্রব্যবস্থার সকল বিরুদ্ধতাকে অচল করে দিয়ে, সংঘবদ্ধ ওই সামান্যরাই অসাধ্য সাধন করে নেয়! প্রয়াত নেতার প্রকাশ্য জানাজা দেওয়ার পথের সকল বিঘ্ন বিপাককেও হঠিয়ে দিতে সমর্থ হয় তারা!
এই ভূভাগের ওইসকল গল্পে গল্পে একটা খুব মিহি দরদের ঢেউ, একটা খুব মানবিক করুণার ধারাস্রোত; আর প্রায় অস্ফুট একটা দীর্ঘশ্বাস যেন বয়ে বয়ে চলেছে! মনুষ্য সম্পর্কের অকারণ বিনষ্টির জন্য দীর্ঘশ্বাস! মনুষ্যআয়ুর সামান্যতার জন্য দীর্ঘশ্বাস! অকাল প্রয়াণের বেদনাজনিত দীর্ঘশ্বাস এইখানে, গল্পে গল্পে চোরাস্রোত হয়ে হয়ে বয়ে চলেছে!
এই ভূখণ্ডে কী কেবল রাজনীতিক হীনতা ও হানাহানি, দুষ্টের শয়তানী, অসুখ আর মৃত্যুর আকস্মিক অভিঘাতই আছে? এইসবের চেয়ে আরও ঢের তেজালো, আরও গহন শক্তিমান যে প্রণয়, তার উপস্থিতি কী নেই এইখানে? এইখানের মনুষ্যজীবনে প্রেম কী আসে না?
আসে!
মনি হায়দারের পৃথিবীতে প্রেম এমন আশা জাগানিয়া রূপে, এমন পরম মিত্রের রূপে, এমন অশেষ আশ্রয় রূপে আসে যে, সেটাকে বিশ্বাস করতে ভয় লাগতে থাকে! অবিশ্বাসে অবিশ্বাসে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া আমাদের এই অন্তর; প্রেমের সেই তেজীয়াল রূপটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে নিতে অস্বস্তি পেতে থাকে! খুবই যেন ধন্দে পড়ে যায় আমাদের অন্তর! প্রেমের ওই সত্য স্বরূপটিকে আমাদের মনে হতে থাকে যেন মিথ্যে যেন প্রতিভাস! যেন অলীক এক রূপকথা মাত্র! অমনটা হয় না! অমনটা কখনোই সত্য হয়ে আসে না!
ইতরতা দেখে দেখে, নেতি আর নির্দয়তা দিয়ে বেষ্টিত থেকে থেকে; আমাদের প্রাণ ও মন- সেই কবে কোনকালে কুঁকড়ে, বেঁকেচুরে পঙ্গু-আধামরা হয়ে গেছে! এই অন্ধতাগ্রস্ত আর বাঁকাচোরা অন্তরের আর সাধ্য কী, জীবনের ওই পরম ঐশ্বর্যকে দেখে নেয়? আর তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে! আমাদের কেবলই বিভ্রম জাগতে থাকে! যা ঘটছে তা কী আসলেই ঘটতে পারে? এমনও হয় নাকি? কীভাবে!
মনি হায়দার প্রণয়কে সত্তার অপার শুশ্রুষা বলেই জানেন! চির অভয়াশ্রম বলেই মানেন তিনি! যতো দুর্গতিই আসুক প্রণয়ীর জীবনে, সমাজ সংসার যতোই ছিছিক্কার দিয়ে দিয়ে তছনছ করতে চায়, করুক! যতোই একঘরে করে দিতে চাক, দিক! প্রণয়ীর জন্য আশ্রয় হয়ে ওই খাড়া আছে প্রেমাস্পদ! কোনো ভয় নেই! ওই তো সে আমার অভয়!
যে-ভূমণ্ডল আধিব্যাধি ও অসাধুতা প্রপীড়িত, সেইখানে উচ্চ-রকমে আছে নারী নিপীড়ন। আছে ধর্ষণ!
দাপটের সাথেই এখানে ধর্ষণকারীও বিরাজ করে! নানা চেহারায় বিরাজ করে, এবং নারীর জীবনকে বিষাক্ত করে দিতে সমর্থ হয়!
আমরা দেখতে পাই, মনি হায়দারের পৃথিবীর এক কিশোরী, যে নিম্নমধ্যবিত্ত সংসারের এক কন্যা, জগতের আগুন-পানি বিষয়ে প্রায় কিছুই জানে না যে; সে একদিন তার প্রেমিকের সাথে দেখা করার স্বপ্ন নিয়ে বাসে চড়ে বসে! দীর্ঘ বাসযাত্রা শেষে সে একসময় রাজধানীতে এসে পৌঁছে! তারপর ছিঁচকে শঠের পাল্লায় পড়ে সে। ধষর্ণের শিকার হয়!
আমরা দেখতে পাই, মনি হায়দারের পৃথিবীর এক কিশোরী, যে নিম্নমধ্যবিত্ত সংসারের এক কন্যা, জগতের আগুন-পানি বিষয়ে প্রায় কিছুই জানে না যে; সে একদিন তার প্রেমিকের সাথে দেখা করার স্বপ্ন নিয়ে বাসে চড়ে বসে! দীর্ঘ বাসযাত্রা শেষে সে একসময় রাজধানীতে এসে পৌঁছে! তারপর ছিঁচকে শঠের পাল্লায় পড়ে সে। ধষর্ণের শিকার হয়!
সমাজে কীভাবে মুখ দেখাবে-এই সংকট ও লজ্জায়, তার পরিবার যখন তাকে ত্যাগ করাই সমীচীন বলে সাব্যস্ত করে! হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণরত বালিকাটিও যখন আত্মহননকেই রেহাই পাওয়ার একমাত্র পথ বলে মনে করা শুরু করে! এমন যখন পরিস্থিতি, যখন সমাজসংসারের কেউই আর আশা করে না যে, বালিকাটির প্রিয় পুরুষ তাকে আর ঠাঁই দেবে! তখন সেই সামান্য প্রণয়ীই তার বিপন্নাকে দুই বাহুর ভেতরে আশ্রয় দেয়! তাকে সারিয়ে তোলার জন্যও এই প্রেমিকটিই সর্বস্ব পণ করে ফেলে!
মনি হায়দারের দুনিয়ার এই মানুষেরা এমনিতে একেবারে ভাঙাচোরা, নিতান্ত আমজনতা! কিন্তু যখনই তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠার সাহসটা পায়, তখন তারা দীপ্ত আর দুর্ভেদ্য আর পরাভব অসাধ্য একটা শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়! ঠিক তেমনই, রোজকার জীবনের সাধারণ বা তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যক্তিটি যখন প্রেমকে পায়; তখন সমাজের যতো নিম্ন স্তরেই তার অবস্থান থাকুক, সে হয়ে উঠতে জানে দৃপ্ত দৃঢ় মীমাংসিত পরোয়াশূন্য এবং অকম্প্র!
আমরা এখানে অন্য আরেক প্রণয়ীর কথা উল্লেখ করতে পারি! তার নাম আহমেদ উৎপল। সে তার চেয়ে বয়সে বড়ো একজনের প্রেমে পড়ে । মেয়েটি স্বামী পরিত্যক্তা এবং একটি শিশুপুত্রের জননী! নিজের পরিস্থিতিটা এবং বাস্তব সকলবিষয় মনে করে করে মেয়েটি কুণ্ঠায় জরজর থাকে! নিজেকে নিয়ে তার সংকোচের এবং লজ্জারও শেষ থাকে না!
বয়সে ছোটো এক পুরুষের প্রণয়কে কীভাবে গ্রহণ করবে সে! লোকে কী বলবে! আর, মেয়েরা কী অমনটা করতে পারে? নিজের চেয়ে বয়সে ছোটো কোনো পুরুষের প্রেম কী তার জন্য নাকি? মেয়েকে না গ্রহণ করতে হয়, তার চেয়ে বড়ো কোনো পুরুষের প্রেম! হয় এমনটাই হবে! নয়তো নয়! কিছুতেই নিজের চেয়ে ছোটো বয়সী কারো প্রেম নেয়া নয়! কিছুতেই নয়!
এমন ভাবনা-যন্ত্রণায় মেয়েটি গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যেতে থাকে, আর তার জন্য অভয় হয়ে এসে যেতে থাকে আহমেদ উৎপল! মেয়েটি প্রেমে পড়ার সাহস পায়! মেয়েটি প্রেমে পড়ে!
সমাজ নির্মিত ওই যে ট্যাবুটা! ওটাকে ভেঙে টুকরা-টাকরা হয়ে যেতে দেখে, ভারী একটা ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়তে থাকে পাঠকের আশেপাশে! বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করতে থাকে, এমনটা হয়! এমনটা সত্যই হয়! এমনটা হচ্ছে! এমন প্রণয়-ওই যে মাথা উঁচোচ্ছে! এমন করেই, এমন মধুর ভাবেই বিকাশ পাচ্ছে প্রণয় সম্পর্কগুলো!
০৫.
এই যে এমনসব গল্প বলেন মনি হায়দার! সেই গল্পকে তিনি কোন গদ্যবন্ধে দাঁড় করিয়ে দেন? কেমন গদ্যসুষমা সৃজন করেন তিনি? সেটি দেখতে গেলে, বড্ডই অস্বস্তির মুখোমুখি হয়ে যেতে হয়!
নিজের গদ্যকে কিছুমাত্র মমতা, কিছু মাত্র মনোযোগ দেবার, একটুও যেন সময় নেই আমাদের গল্পকারের! তাঁর গদ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেবলই যেন দায়সারা বাক্যরাশি মাত্র! কোনোরকমে কিছু কথা লিখে ওঠার তাগাদাই প্রকট হয়ে আছে ওই গদ্যে গদ্যে!
কখনো কখনো মস্ত নীরক্ত ওই গদ্য! যেন কেবল কাহিনীকে কোনোরকমে নামিয়ে দিতে পারলেই হলো! গদ্যকে আবার আর সুষমাশাণিত করে নেয়ার কী আছে! গদ্যকে চিত্তপ্লাবী করে তোলারও কোনো আন্তরতাগিদ যেন তিনি কদাপি পান না!
গদ্যের প্রতি তাঁর এতো অবহেলা কেনো? এমন ঔদাসীন্য কীভাবে বোধ করতে পারেন তিনি, যিনি অমন অপরূপ এক ভূভাগকে জানেন? আর আমাদের জন্য সেই ভূমণ্ডলের সত্য প্রতীয়মান রচনার তাগাদা বোধ করতে পারেন? কেনো তিনি এমন গদ্য-অন্যমনস্ক? এখনও কেনো?
শব্দ ব্যবহারের সময়ও কোথাও কোথাও মনি হায়দার প্রচণ্ড অসতর্ক। ফলে প্রায়শই ভুল জায়গায় ভুল ভাবে বসে পড়েছে বেঠিক শব্দ! আর পাঠককে করে তুলেছে বিমূঢ়! গল্পের শ্রী ও মাধুর্যকে বিকট এক ধাক্কা দিয়ে এবড়া-জাবড়া করে দিয়েছে! যেমন, প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যায় ‘আসমানী মেওয়া’ গল্পটিকে! ওটি এমন এক দূর তল্লাটের গল্প, যেখানকার বাসিন্দারা কখনো আঙুর ফল চোখে দেখেনি! শুধু জানে ওটি এক বেহেশতী ফল! মুমূর্ষু পিতার আঙুর ফলের রস আস্বাদের ইচ্ছা পূরণের জন্য পুত্রকন্যারা তখন দিশাহারা!
তাদের কথোপকথনকে মনি হায়দার এভাবে বর্ণনা করেন :
“ভ্রু কুঁচকে তাকায় মিনহাজ, ‘হের কাচে ক্যান যামু!’
‘হেয় তো বিদেশে গেছিল। আমি হুনচি, একফির বাড়িত আঙুরফল আনচিল।’
‘হাচাই?’ কনফার্ম হতে চাইছে মিনহাজ।”
এইখানে এই হতদরিদ্র, প্রায় নিরক্ষর মুদিদোকানীর নিশ্চিত হওয়ার বিষয়টি বোঝাবার জন্য ওই ‘কনফার্ম’ শব্দটি খাপসই কী?
লেখকের আরও কিছু গদ্য-অন্যমনস্কতার সাথে পরিচয় ঘটিয়ে নিতে পারি।
ক. ‘দুপুরের কড়া মাছভাজা রোদে ভিজে ভিজে হাঁটছে আকবর উদ্দিন।’ (‘ছায়াবাজি’; মাছভাজা রোদ কী দাউদাউ কিছু নয়? নাকি সেটা রোদরূপী জল? তাই কড়া ওই রোদে ভিজে ভিজে হাঁটা যায়? এমন? নাকি? নাকি এই আলোচক ওই বাক্যের মরতবা বুঝতে অসমর্থ!)
খ. ‘হাতের নাগালে কেউ নেই, কে আমাকে ব্যাখ্যাতীত যন্ত্রণার নরকে জিইয়ে রাখছে?’ ( ‘ওই’, এই নরকও কী জল থইথই? নতুন কালের নরক নাকি এটা? তাই সেখানে পাপী বান্দাকে আটকে না-রেখে, স্রফে জিইয়ে রাখা হচ্ছে? নরকে আটকে রাখে না? নাকি!)
এমত উদাহরণ আরও বিস্তর উদ্ধৃত করা খুবই সম্ভব! কিন্তু আমরা বরং সেটি পরিহার করি! আমরা বরং বলি, প্রিয় মনি হায়দার! আপনার গদ্য-অন্যমনস্কতা ঘুচুক! একদম ঘুচে যাক! আমরা খুব অপেক্ষায় থাকলাম!
বাংলা ভাষার একজন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। আকিমুন রহমানের গ্রন্থসমূহ হলো : ‘আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ (১৯২০-৫০)’, ‘সোনার খড়কুটো’, ‘বিবি থেকে বেগম’, ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’, ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’, ‘এইসব নিভৃত কুহক’, ‘জীবনের রৌদ্রে উড়েছিলো কয়েকটি ধূলিকণা’, ‘পাশে শুধু ছায়া ছিলো’, ‘জীবনের পুরোনো বৃত্তান্ত’, ‘নিরন্তর পুরুষভাবনা’, ‘যখন ঘাসেরা আমার চেয়ে বড়ো’, ‘পৌরাণিক পুরুষ’, ‘বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার দলিল (১৩১৮-১৩৫০ বঙ্গাব্দ)’, ‘অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী’, ‘একদিন একটি বুনোপ্রেম ফুটেছিলো’, ‘জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ’, এবং ‘নিরুদ্দেশের লুপ্তগন্ধা নদী’।
আকিমুন রহমান ভালোবাসেন গন্ধরাজ আর বেলীফুল আর হিজলের ওড়াভাসা! আর তত্ত্বের পথ পরিক্রমণ! আর ফিকশন! ঊনবিংশ শতকের ইউরোপের সকল এলাকার গল্পগাঁথা আর এমিল জোলার কথা-বৈভব! দূর পুরান-দুনিয়ায় বসতের সাথে সাথে তিনি আছেন রোজকার ধূলি ও দংশনে; আশা ও নিরাশায়!