ভারতীয় সংস্কৃতিতে মায়েদের অবস্থান সুউচ্চে এবং ভারতীয় শিল্পে মাতৃত্বকে ব্যাপকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। দিল্লি আর্ট গ্যালারির প্রদর্শনী ও প্রকাশনা বিভাগের কর্মকর্তা ঐশ্বরিয়া কিরিত সাহাপিডিয়াতে পাঁচজন আধুনিক ভারতীয় শিল্পী এমভি ধুরান্ধার, এম এফ হুসেন, যামিনী রায়, মাধবী পারেখ এবং পি টি রেড্ডির আঁকা ‘মা ও শিশু’র শিল্পকর্ম নিয়ে এই রচনাটি লেখেন কোনো এক মা দিবসকে উপলক্ষ্য করে। শ্রী-র পাঠকদের জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন অনুবাদক এবং প্রবান্ধিক মাইনুল ইসলাম মানিক।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে মা খুবই উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন, আর মাতৃত্বকে ভারতীয় চিত্রকলায় প্রদর্শন করা হয়েছে অত্যন্ত বিস্তৃত পরিসরে। ভারতীয় আধুনিক চিত্রশিল্পীগণ বিশেষত এম ভি ধুরান্ধার, মকবুল ফিদা হুসেন ও যামিনী রায়ের আঁকা চিত্রকলায় আমরা মা ও শিশুর সম্পর্ক নিয়ে পর্যবেক্ষণ করব। (এখানে ব্যবহৃত চিত্রগুলো দিল্লি আর্ট গ্যালারি থেকে নেয়া হয়েছে)
চিত্রকলার একটি চিরায়ত অনুষঙ্গ হচ্ছে মা ও শিশু বিষয়ক চিত্রকল্প। মাতৃবৎ চরিত্রের প্রতি ভারতীয়দের শ্রদ্ধাভক্তি প্রদর্শনের একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পৌরাণিক মা ও শিশুর চিত্রকল্প ভারতীয় চিত্রশিল্পের একটি স্থায়ী ও মোহনীয় অনুষঙ্গ হয়ে আছে। সিন্ধুসভ্যতা থেকে যে শিল্পকর্ম পাওয়া গেছে সেখানে মাকে দেবী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
মৃৎশিল্পে মাকে দেবী হিসেবে উপস্থাপনের অনেকগুলো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, কিন্তু যে বিষয়টিতে আমরা একটি সুনির্দিষ্ট উপসংহারে আসতে পারি, আমাদের আদি পুরুষেরা মায়ের মাঝে কিছু দেবত্ব খুঁজে পেয়েছেন। ‘যশোদা ও বালক কৃষ্ণ’, ‘মা মেরি ও যীশু খ্রীষ্ট’ মাতৃত্বের আদর্শ হিসেবে ভারতীয় ও অপরাপর চিত্রশিল্পে স্থান দখল করে নিয়েছে। এমনকি ভারতীয় চিত্রশিল্পে ভারতমাতা একটি বিস্তৃত স্থান দখল করেছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে অমৃতা শেরগিলের চিত্রকর্মে এর প্রমাণ মেলে।
রেনেসাঁ থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী চিত্রশিল্পীরা তাদের মাকে দেবী হিসেবে এঁকে আসছেন। তাদের মধ্যে রেমব্রান্ট, আলব্রেখট ড্যুরার, সালভাদর দালি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ম্যাডোনা ও শিশু যীশু বিষয়ক চিত্রকলার বিষয়বস্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের শুরুর দিকে রাফায়েলের আঁকা জনপ্রিয় ‘স্বর্গীয় মা ও শিশু’ বিষয়ক অঙ্কিত চিত্রকলার সাথে সাদৃশ্যতা পাওয়া যায়।
পাঁচজন আধুনিক ভারতীয় চিত্রশিল্পীর চিত্রকলার মধ্য দিয়ে মা ও শিশুর জটিলতম সম্পর্কটি কীভাবে নান্দনিক সারল্যে উঠে এসেছে, সে বিষয়ে দৃষ্টিপাত করি।
এম. ভি ধুরান্ধার (১৮৬৭-১৯৪৪)
রাজা রবি ভর্মার পর সম্ভবত এম ভি ধুরান্ধারই হচ্ছেন ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় চিত্রশিল্পী। তিনি বোম্বের জনপ্রিয় জে জে আর্ট স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। চিত্রকলায় বোম্বে ও তার আশপাশ থেকে তুলে এনেছেন নারীদের নৈমিত্তিক যাপনের বিভিন্ন ধরন। তাঁর Otto Rothfield’s Women of India খুবই চিত্তাকর্ষক, বিশেষত তিনি একজন মা ও শিশুর মধ্যে সম্পর্ককে ঘিরে যে চিত্র এঁকেছেন তা খুবই মোহনীয়।
‘মাই ওয়াইফ ইন আর্ট’ নামে একটি বইও প্রকাশ করেছেন ধুরান্ধার। বইটিতে তিনি তাঁর নিজের পরিবারের মধ্য দিয়ে মা ও শিশুর সম্পর্কটি উদঘাটন করেছেন। এই বিশাল সংগ্রহ থেকে মা ও শিশুর সম্পর্ক ঘিরে দুটি ছবি খুবই হৃদয়স্পর্শী। একজন মা ও মেয়ের নৈমিত্তিক কাজের সময়গুলোতে তারা কতটা ঘনিষ্ঠতম হয়ে ওঠেন তা নিবিড়ভাবে উঠে এসেছে এই চিত্র দুটিতে। ‘মাই ওয়াইফ ইন আর্ট’ বইটিতে ধুরান্ধার তার নিজের পরিবারের ওপর যে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি রাখতেন তার বর্ণনা পাওয়া যায়। শুধুমাত্র একজন চিত্রশিল্পী হিসেবেই নয়, একজন বাবা হিসেবেও তিনি তার চতুর্পাশের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন।
মকবুল ফিদা হুসেন (১৯১৫-২০১১)
সিনেমার ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে মকবুল ফিদা হুসেনের পেশাবৃত্তি শুরু হয়। তিনি চিত্রকলার বিভিন্ন শৈলী, ধারা ও মাধ্যম নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন। তার মাদার তেরেসা চিত্রায়ন এমন একটি গাথা যা মানুষের প্রতি এই নারীর মহিমা ও মহানুভবতাকে তুলে ধরে। ফিদা হুসেনের মাদার তেরেসা সিরিজে যে কেউ দেখতে পাবেন, শুধুমাত্র শিশুই নয় এমনকি বয়স্কদের প্রতিও এই নারীর সীমাহীন মমতা যা হুসেনকে উৎসাহিত করেছে এই নারীকে একজন ‘আদর্শ মা’ হিসেবে চিত্রায়িত করতে। তিনি তার কোনো চিত্রেই তেরেসার মুখাবয়বের বৈশিষ্ট্য আলোকপাত করতে চেষ্টা করেননি, বরং তিনি তাঁর নীল পাড়ের শাড়িকে এমন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যা মাতৃত্বময় ব্যক্তিত্বের প্রতি একজন শিল্পীর জীবনভর অনুসন্ধানকে প্রতীকায়িত করে। মাদার তেরেসা যখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন, হুসেন তাকে স্বাগত জানিয়ে তার মুখাবয়ব আঁকা একটি চিত্রকর্ম উপহার দেন যেটিতে তেরেসা অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন, ‘স্রষ্টা তোমার মঙ্গল করুন।’
মাধবী পারেখ (জন্ম : ১৯৪২)
মাধবী পারেখের চিত্রকর্ম অনেকটা অপরিকল্পিত। তার চিত্রকর্মের ন্যারেটিভ যতটা সামনের দিকে এগিয়ে যায় ততটাই পরিবর্তন হতে থাকে গল্পের মতো। গ্রামীণ চরিত্র ও অনুষঙ্গ ব্যবহার ছাড়াও পারেখ বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ও বিমূর্ত চরিত্র ব্যবহার করেছেন। ‘মাদার’ চিত্রকর্মের মূল চরিত্রটি চিত্রের কেন্দ্রভাগে আঁকা হয়েছে যেটি একাধিক তাৎপর্য বহন করে: সকল সৌন্দর্য ও উন্মত্ততা নিয়ে তিনি ‘Mother Nature’, হতে পারেন, তিনি গল্পের কোনো মা চরিত্র, অথবা এমনটিও হতে পারে একজন মায়ের চরিত্রকে শিল্পী যেভাবে অনুভব করেন; এই সবগুলো একসাথে একীভূত করে অনেকগুলো উদ্দেশ্যকে পারেখ একসাথে বিকশিত করেছেন। মজার বিষয় হলো, একজন শিল্পী হিসেবে পারেখের যাত্রা শুরু হয় তার প্রথম সন্তান গর্ভধারণের সময়, যেটি তার চিত্রকর্মে এক ধরনের কোমলতা এবং শিশুসুলভ বৈচিত্র্য আরোপ করে।
পি টি রেড্ডি (১৯১৫-১৯৯৬)
পি টি রেড্ডি অন্ধপ্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন এবং বোম্বের জে জে আর্ট কলেজে চিত্রকলা বিষয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি তারুণ্যের দিনগুলো পারিবারিক ব্যবসার কাজে কাটিয়ে দেন। তারপর আবার চিত্রকলায় ফিরে আসেন ১৯৫০-এর দিকে। চিত্রকলায় তিনি এক বৈচিত্র্যময় দৃষ্টিভঙ্গি অভিব্যক্ত করতে সক্ষম হন। ধুরান্ধার যেভাবে তার নিজের পরিবারকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, রেড্ডি তার চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম। তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন জগত সংসার। ‘মাদার এন্ড চিলড্রেন’ চিত্রকর্মটি আঁকা হয় ১৯৫৮ সালে। চতুর্পাশের জীবনঘনিষ্ঠ বাস্তব দক্ষতা ও তার সংবেদনশীলতা চিত্রকর্মটিকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে। এই চিত্রটিতে তিনি একজন মা এবং দুজন শিশুকে উপস্থাপন করেছেন। চিত্রটিতে উঠে এসেছে তাদের বর্ণিল পোশাক। চিত্রটি দেখে মনে হচ্ছে মা ও শিশুরা ক্রিড়ারত। মাকে দেখলে মনে হয় তিনি ছেলেটিকে ধরে আছেন এবং পেছন ফিরে মেয়েটিকে দেখছেন।
যামিনী রায় (১৮৮৭-১৯৭২)
যামিনী রায় একাডেমিক বাস্তববাদী শৈলীতে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি তার নিজস্ব আধুনিক শৈলী উদঘাটন করতে সক্ষম হন। তার এই শৈলীর মূল অনুষঙ্গ ছিল স্থানীয় গ্রামীণ ঐতিহ্য। যামিনী রায় মা ও শিশু বিষয়ক চিত্রকর্ম প্রায়ই এঁকেছেন। তার চিত্রগুলো খুবই চিত্তাকর্ষক ও সাবলীল; মা ও শিশু— দুটি চরিত্রের মধ্যে সুগভীর সংযোগ স্থাপন করে। তার চিত্রকর্মে শুধুমাত্র স্থানীয় মা ও শিশুর চরিত্রই নয়, এমনকি পৌরণিক ও ধর্মীয় চরিত্রসমূহও উঠে এসেছে, যেমন : যশোধা, কৃষ্ণ, শিশু যীশু ও মেরি। যামিনী রায়ের চিত্রকলায় মাতৃত্ব শুধু মানুষের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকেনি, সকল প্রাণীর মধ্যেই মা ও শিশুর মধ্যবর্তী মানবিকতাবোধের স্ফূরণ ঘটেছে।
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। জন্ম ১৯৮৪ সালের ১১ মার্চ, চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলাধীন বলশীদ গ্রামে। ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে বর্তমানে ইংরেজি প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। নিয়মিত লিখছেন জাতীয় দৈনিক ও বিভিন্ন সাময়িকীতে। ওয়েবম্যাগ তীরন্দাজ-এর সহযোগী সম্পাদক। লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন নাগরিক বার্তা লেখক সম্মাননা, নতুন কুঁড়ি লেখক সম্মাননা, ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম পদক (প্রবন্ধে), ছায়াবানী মিডিয়া কমিউনিকেশন লেখক সম্মাননাসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। প্রকাশিত অনুবাদগ্রন্থ মধ্যপ্রাচ্যের সমকালীন গল্প (মাওলা ব্রাদার্স, বইমেলা ২০১৯), দশ নোবেলজয়ী লেখকের সাক্ষাৎকার (পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি., বইমেলা-২০১৮) ও কাব্যগ্রন্থ স্বপ্নের শঙ্খচিল (২০১৪)।